#বিধুর_রজনী
#পলি_আনান
[পর্ব সংখ্যা ৩]
____________________
৫.
” প্রাসাদে যে জিন্নাত জাতির চলাচল শুরু হয়েছে তা কি তুমি জানও ভাইজান ?”
শেহজাদী আরওয়ার প্রশ্নে ভ্রু কুচকালেন শাহজাদা ইদ্রীস।ডানে বামে তাকিয়ে সর্তক সৃষ্টি নিক্ষেপ করেন।
” কিসব বলছো নূর?সাত সকালে তোমার আবার কি হলো”
” তার মানে তুমি কিছু জানো না।তোমার সাথে কিছু ঘটেনি?”
” কি ঘটবে?তোমার কি হয়েছে বোন বল আমায়।”
“না কিছু হয়নি।আমি আমার কক্ষে গেলাম।”
শেহজাদী আরওয়া অলিন্দ ছেড়ে মহলের দিকে অগ্রসর হলেন।সম্রাট এখন সভায় বসবেন তার সাথে উপস্থিত থাকবেন উজির,সেনাপতি,সভাকবি,কবিরাজ মশাই সহ অনন্যরা।উজিরের সঙ্গে বসে সলাপরামর্শ করছিলেন সম্রাট আব্বাস, সকলের সম্মুখে তখন হাজির হয় শেহজাদী আরওয়া।তাকে দেখে সকলের মনে অজানা আতঙ্ক ভর করে।এই কন্যার স্থিতি নেই কখন কোন আদেশ করে বসেন কে জানে।গত সাপ্তাহে এক প্রহরীর কানে সীসা ঢেলে হ-ত্যার নির্দেশ দেওয়া হয় এবং পরবর্তীতে তার কথা মত হ-ত্যা করা হয় সেই প্রহরীকে।আজ কোন আদেশে এসেছে শেহজাদী?
মহলে আগরবাতীর সুঘ্রাণ ছড়িয়ে আছে।সম্রাটের পেছনে দাড়িয়ে দুজন টানাপাখা টানছে।শেহজাদী আরওয়া সম্রাটের সম্মুখে এসে প্রথমে সম্রাটকে কুর্নিশ করলেন।
” সুপ্রভাত পিতা।”
“সুপ্রভাত কন্যা।”
” আপনার আজ্ঞা পেলে কিছু কথা বলতে চাই।”
“বলো তুমি কি বলতে চাও?”
” মহলে আজ কবিতার আয়োজন করা হোক সেখানে সকলে উপস্থিত থাকবে।রাজ্যর যত কবি আছে সকলকে সেখানে উপস্থিত হতে হবে আর আমাদের সভাকবি শুরুতে তার কবিতা পাঠ করে শোনাবেন।”
” আয়োজন কি আজকেই চাই?”
” হ্যা আজকেই চাই।আজ অপরাহ্ণে আসর শুরু হবে।”
” বেশ তুমি যা বলছো তাই হবে।”
শেহজাদী মাথা দুলালেন।কিঞ্চিৎ মাথা ঘুরিয়ে তাকালেন সভাকবির দিকে।
” সভাকবি মশাই শুনে রাখুন আপনার কবিতা যদি আমার মনে না ধরে তবে হাতির পায়ে পিষে মৃ-ত্যু হবে আপনার।”
নড়ে চড়ে বসলেন প্রত্যকে সবাই এই আশংকায় ছিল।কার দেহ থেকে প্রাণ নেওয়ার জন্য রাজকন্যা আজ মহলে এসেছে?তবে এবার সবাই নিশ্চিত শনির দশা তবে আজ সভাকবির উপরে ঘুরছে।
অপরদিকে আজ শেহজাদীর মন শান্ত নেই।গতরাতের সেই জ্বিনের কথা মনে পড়তেই বারবার আবেগী হয়ে উঠছেন তিনি।মনে মনে খুব করে চাইছে সেই জ্বিন আরেকবার তাকে দেখা দিক অন্তত আর একবার কিন্তু কি করে দেখা পাবে সেই অচেনা অজানা ব্যক্তিত্বের।
মহল থেকে দ্রুত নিজের কক্ষে ফিরে এসেছেন শেহজাদী পালঙ্ক বসে পা পা দুলিয়ে উচ্চ বাক্যে ডাকলেন লতাকে।
” আমাকে ডেকেছেন শেহজাদী?”
” কাগজ,রঙতুলির ব্যবস্থা করো আমি ছবি আকঁবো।”
“এত বছরপর হঠাৎ ছবি আকঁবেন?”
“সামান্য দাসী হয়ে আমার কাছে কৈফিয়ত চাইছো?”
” মার্জনা করবেন শেহজাদী আমার ভুল হয়েছে।আমি এক্ষুনি রঙের ব্যবস্থা করছি।”
দাসী লতা ছুটে গেল কক্ষের বাইরে।অনন্য দাসীরা একে একে সব সরঞ্জাম শেহজাদীর কক্ষে এনে রাখলেন।একজন দাসী ভুল ক্রমে শেহজাদীর গায়ে জল রঙের কৌটা ঢেলে দিলেন।ফল সরূপ শেহজাদীর পরনের জামাটা নষ্ট হয়ে যায়।মুহূর্তে রাগান্বিত হলেন শেহজাদী আরওয়া।তার হিংস্রতা ধরা দিল আরেকবার।চিৎকার দিয়ে ঠেকে উঠলেন লতাকে।
” লতা লতা?”
” হুকুম করুন শেহজাদী”
“এই দাসীকে মহলে নিয়ে যাও।সেনাপতি ফারুক মশাইকে নির্দেশ করো এই দাসীকে যেন একহাজার ঘা চাবুক মা/রা হয়।”
শেহজাদীর এমন নির্দেশে কেঁদে ফেললো দাসী।নিজের প্রাণ বাঁচাতে জড়িয়ে ধরলো শেহজাদী আরওয়ার দু’চরণ।
“ক্ষমা করুন শেহজাদী এমন ভুল আর কখনো হবে না।”
মেয়েটির ভুল মার্জনা করলেন না শেহজাদী আরওয়া।তিনি সরে দাড়ালেন এবং লতাকে ইশারা করলেন মেয়েটিকে নিয়ে যেতে বাকি দাসীরা নত মস্তকে দাঁড়িয়ে রইলো শেহজাদীর সামনে।
৬.
চিন্তিত ভঙ্গিমায় কক্ষ জুড়ে পায়চারি করছেন শাহজাদা ইদ্রীস তার উত্তজনার কারণ বুঝে আসলো না তাসবীরের।গাত্রে তৈল মালিশ করতে করতে প্রশ্ন ছুড়ে তার বন্ধুর নিকট।
” ইদ্রীস তোমায় চিন্তিত মনে হচ্ছে। ”
” চিন্তা সে তো আমার প্রত্যেক দিনের তালিকা।”।
” তা কি নিয়ে চিন্তিত তুমি?”
” শেহজাদী আরওয়ার নির্দেশ শুনেছো তুমি?আজ নাকি কবিতার আসর হবে যদি সভাকবি তার কবিতা দ্বারা নূরকে খুশি করতে না পারে তবে তাকে হত্যা করা হবে।কিছুক্ষণ আগে এক দাসীকে এক হাজার ঘা চাবুক মা-রার জন্য নেওয়া হয়েছে।নূরের এসব বর্ব/রতা আর সহ্য হচ্ছে না আমার।”
” তুমি ভাই হয়ে তাকে শাসন করতে পারো না?”
“যে মেয়ে পিতাকে অমান্য করে স্বয়ং সম্রাট আব্বাস যার নাম শুনলে সবার হাটু কাপে তাকে শেহজাদী নূর ভয় পায় না সে আবার ভাইকে মান্য করবে?এটা হাস্যকর।”
“অদ্ভুত কিসিমের তোমার বোন।”
” আজ আমার কাছে জিন্নাত জাতির সম্পর্কে জানতে চেয়েছে।প্রাসাদে নাকি জিন্নাত জাতির উপস্থিতি আছে।কে যে ওর মাথায় এসব ঢোকায়।”
শাহজাদা ইদ্রীসের কথায় ঠোঁট টিপে হাসলো তাসবীর।এই মুহূর্তে শেহজাদী আরওয়ার সঙ্গে দেখা করার লোভ কিছুতেই সামলানো যাচ্ছে না তার।
একা কক্ষে সাদা কাগজে রঙের সাহায্য কিছু আঁকার চেষ্টায় আছেন শেহজাদী অনেকদিন যাবৎ চর্চা না থাকায় বেশ বেগ পোহাতে হচ্ছে তাকে।কক্ষের বাইরে দ্বাররক্ষক না থাকায় কায়দা করে বেশ সহজে শেহজাদীর কক্ষে প্রবেশ করেন তাসবীর।
” দ্বিতীয় বার অনুমতিহীন আপনার কক্ষে প্রবেশ করায় ক্ষমা করবেন শেহজাদী আরওয়া নূর!”
কাংখিত কন্ঠে কেঁপে উঠলেন শেহজাদী আরওয়া।কোলে থাকা পাতলা বসনের সাহায্য ঢেকে দিলেন তার মুখ।আবৃতহীন রইলো শুধু দু’নয়ন।ঘুরে তাকালেন শেহজাদী আরওয়া, আড় চোখে তাকালেন বলিষ্ঠ পুরুষ তাসবীরের পানে।তাসবীর আজ নিজেও মুখ ঢেকে এসেছে।
” রাতের ঘুম ভালো হয়েছে শেহজাদী?”
“হ্যা হয়েছে।হঠাৎ আমায় দেখা দিলেন?”
“শুনলাম আমার খোঁজ করছিলেন।”
কিঞ্চিৎ ভ্রু কুচকালো শেহজাদী।হাতে থাকা রঙতুলি পাশে রেখে পরখ করলো তাসবীরকে।এই ব্যক্তির সম্মুখে পড়লে নেতিয়ে যান তিনি।শুষ্ক হয়ে যায় তার কণ্ঠদেশ কি মোহনীয় এই যুবক।
” একদমি নয়।”
“আবার মিথ্যা!প্রাসাদে যে জিন্নাতেরা আছে
তা কিন্তু একমাত্র আপনি জানেন আর কেউ নয়।কারন আমি আর কাউকে দেখা দিচ্ছি না।
” এখানে কেন এসেছেন আপনি?”
“কবিতা শুনবেন?”
মোহিত পুরুষের কন্ঠে কবিতা শোনার তীব্র বাসনায় ছিলেন শেহজাদী আর এত সহজে সুযোগটা পেয়ে মনে মনে বেশ খুশি হলেন তিনি।
” বেশ বলতে থাকুন আমি শুনছি।”
” তবে আমার যে শর্ত আছে শেহজাদী।”
” শর্ত?কিসের শর্ত?”
” আজ যে কবিতার আসর হবে সেখানে আপনি সভাকবিকে হ-ত্যার নির্দেশ দিতে পারবেন না।আমি জানি আপনার মনে তার কবিতা ধরবে না আর না ধরলে আপনি আপনার শর্ত পালনে অটুট থাকবেন।”
“অসম্ভব,আমি যা সিদ্ধান্ত নিয়েছি তাই হবে।”
“তাহলে আর কোনদিন আমি আপনার সম্মুখে আসবো না।”
ভীত চোখে তাসবীরের দিকে তাকালেন শেহজাদী।চোখে মুখে ফুটে আছে ভয়ের আভাস।না চাইতেও তাসবীরের শর্তে সম্মতি জানালেন তিনি।এতে বেশ খুশি হলেন তিনি।
” তা আপনাকে কি বলে সম্মোদন করবো জনাব?”
“তাসবীর।আমাকে তাসবীর বলে ডাকতে পারেন।তবে খবরদার প্রাসাদের কারো সামনে এই নাম উচ্চারণ করবেন না শেহজাদী।”
” কেন?”
“সে উত্তর না হয় অন্যদিন দিব।”
” এবার আপনার কবিতা আবৃতি শুরু করুন।”
শেহজাদী এগিয়ে এলো ক্যানভাসের সামনে হাতে তুলে নিল রঙতুলি। তার পেছনে এসে দাঁড়ালো তাসবীর শেহজাদীর হাতে হাত রেখে ক্যানভাসে রঙতুলি বসাতে রাগান্বিত হয় শেহজাদী আরওয়া।এই সামান্য যুবকের সাহস কি করে হলো শেহজাদীকে ছোঁয়ার।শেহজাদীর রাগান্বিত ভাব ধরতে পেরে তাসবীর নিজে থেকে কথা তুললো।
” ভালোবাসতে পারেন শেহজাদী?”
” আমার জীবনে ভালোবাসা শব্দটির প্রয়োজন নেই।”
” একটু প্রয়োজন বোধ করে দেখুন না,দেখবেন জীবন কী করে পালটে যায় চোখের পলকে।”
” আমি আমার জীবন নিয়ে খুশি আছি।”
” না আপনি খুশি নেই; খুশি নেই আপনি। জীবনের আসল স্বাদ এখনো গ্রহণ করেননি।তবে এবার আমি এসে গেছি পেছনে ফেরার পথ বন্ধ।”
” বন্ধ?তুচ্ছ যুবক আমাকে পরিচালনা করার স্বপ্ন দেখে যাও তবে পূর্ণ হবে না।শেহজাদী আরওয়া নূর’কে কবজা করা এত সহজ কাজ নয়।”
“দয়া করে আমায় সামান্য ভাববেন না।না চাইতেও যে বিষকন্যা’র সাক্ষাৎ আমি পেয়েছি তার বিষে আমার সারাদেহ,মন প্রাণ মস্তিষ্ক বিষঘ্ন হয়ে আছে।সেই বিধুর রজনীর সাক্ষী আমি বার বার হতে চাই।”
“বিধুর রজনী?”
বুদ্ধিমান যুবক তাসবীর কথা ঘুরিয়ে দিলেন,শেহজাদীর হাতে হাত রেখে ক্যানভাসে মনোযোগ বাড়ালেন,কথা রাখতে খুব দ্রুত শুরু করলেন কবিতা আবৃতি।শেহজাদী আরওয়ার কাছে তাসবীরের আবৃতি করা কবিতা যেন বশীকরণমন্ত্র মনে হয়।যা শ্রবণে বার বার কতল হোন তিনি।আর তাসবীর সে তো চতুর যুবক শেহজাদী আরওয়াকে নিজের বশে আনতে সর্বদা সচেষ্ট তিনি।
#চলবে_______
❌