বিধুর রজনী পর্ব -০৫

#বিধুর_রজনী
#পলি_আনান
[পর্ব সংখ্যা ৫]
___________________
“কিসসা শুনবেন শেহজাদী?”

“উহহ উউউ”

” কি বলেন বুঝি না।”

” কবিতা বলি?ওই যে আপনার পছন্দের কবিতা।”

“উমমম”

” এবারো বুঝলাম না।থাক আপনার কিছু শুনতে হবে না আপনি বরং আমায় দেখুন।মশার কামড়ে অতিষ্ট হয়ে যাচ্ছি।”

খ্যাপা ষাড়ের মতো তাসবীরের দিকে তাকিয়ে আছেন শেহজাদী আরওয়া।মেঝেতে মশার কামড়ে অতিষ্ট তিনি তবুও তার রাগের কাছে এই মশার কামড় গুলো যেন কিছুই না।হাতের বাঁধন ছাড়াতে তার ছটফটে অবস্থা দেখে যেন ভীষণ মজা পাচ্ছেন তাসবীর।ছয় নয় ভেবে শেহজাদীর মুখের বাঁধন খুলে দিলেন তিনি।

” আপনার সাহস দেখে আমি অবাক হই সম্রাটের কন্যাকে গুম করেছেন।”

” জি আমার সাহস একটু বেশি সেটা আমি নিজেই স্বীকার করি।”

” এই পাতালের সন্ধান কি করে পেলেন?”

” সব সম্রাটের একটি পাতালঘর থাকে তা সবাই যানে।তবে এই পাতাল ঘরের মূল রাস্তা কিংবা দ্বারের খোঁজ কেউ জানে না।এই প্রাসাদের কোথায় কি আছে আমি সব জানি।”

” কি করে জানেন আপনি?”

” জিন্নাতরা সহজে সব জানতে পারে।”

” আপনার কথা আমি বিশ্বাস করি না”

শেহজাদীর কথায় তাসবীর হাসলেন।তাদের মাঝে থাকা গলানো মোমের দিকে তাকিয়ে কিছুটা চিন্তিত হলেন এই মোম শেষ পর্যায়ে, যদি শেষ হয়ে যায় তবে অন্ধকার পাতালে কি করে থাকবেন আরওয়া?

” সবাই নিশ্চই আমার খোঁজ করছে।সত্যি করে বলুন আপনার স্বার্থ কী?সম্রাট সাঈদের সঙ্গে আমার বিবাহ হলে আপনার সমস্যা কোথায়?”

” কঠিন সমস্যা শেহজাদী, বড্ড কঠিন সমস্যা।এই সমস্যার সমাধান আপনি ছাড়া সমাধান হবে না।”

” মানে?”

তাসবীর উঠে গেলেন শেহজাদীর প্রশ্নের উত্তর দেওয়া গুরুত্ব মনে করলেন না।পকেট থেকে ছোট মোম নিয়ে তা জ্বালিয়ে দূরে সরে গেলেন।আশেপাশে ঘুরোঘুরি করে একটি মরা মানুষের মাথার খুলি পেলেন তা এনে রাখলেন শেহজাদী আরওয়ার সামনে।মানুষের খুলি চিনতে খুব দেরি হলো না শেহজাদীর ফলে ভীতগ্রস্থ হয়ে খিঁচিয়ে গেলেন খানিকটা।

” ওও টা কোথায় পেলেন তাসবীর?”

“পাঁচিলের এক কোণে ছিল।”

” আপনি সরান এই খুলি আমার ভয় লাগছে।”

“ছিহ ছিহ ছিহ শেহজাদী আরওয়া সামান্য ম/রা মানুষের খুলি ভয় পায়?অথচ এত মানুষকে যে অল্প ভুলে হ/ত্যার নির্দেশ দেন তার ভয়াবহ ফল ভোগ করবেন কি করে?

তাসবীরের কথায় শেহজাদীর অনুশোচনা জাগলো না।তিনি বিরক্ত হয়ে চোখ বুঝলেন তাতে যেন ফলাফল উলটো বিপরীত।চোখের পর্দা ফেললে আঁধারে’রা ধরা দেয় এই আঁধার তার ভয় বাড়িয়ে দিল শতগুন।বারবার চোখের সামনে খুলিটা ভেসে উঠছে।অথচ তাসবীরের কোন ভয় নেই তিনি নেড়ে চেড়ে দেখছেন ম/রা মানুষের খুলিটা কি অদ্ভুত সাহস’রে বাবা!

” তাসবীর এখানে ম/রা মানুষের খুলি আসবে কি করে?পাতাল ঘরে তো কেউ আসে না।পাতাল ঘর সবসময় বন্ধ থাকে।আপনি নিশ্চই আমাকে ভয় দেখাতে সঙ্গে করে এনেছেন?”

তাসবীর হাসলেন শেহজাদীর কথা ভেবে খুলিটা সরিয়ে রাখলেন খানিকটা দূরে।

” আপনার দাদাজান অর্থাৎ সাবেক সম্রাট রাজ্য বিজয়ের পর সেই রাজ্যের সম্রাট সম্রাজ্ঞীদের এই পাতালে এনে রাখতেন।দিন দিন অনাহারে,পানির তৃষ্ণায় তারা গলে পঁচে মা/রা যেত।এভাবেই চলতে থাকে একেরপর এক।এই নিয়ম বন্ধ হয় আপনার বাবা অর্থাৎ সম্রাট আব্বাস সিংহাসন আহরোণের পর।সম্রাট আব্বাসের নির্দেশে এই পাতালঘর পরিষ্কার করে ধুঁয়ে মুছে রাখা হয় তারপর আর কারো প্রবেশ এখানে হয়নি।”

বিস্ময়কর সত্য জেনে চাপা উত্তেজনা ধরে রাখতে পারলেন না শেহজাদী আরওয়া।আবাক চোখে তাকালেন তাসবীরের দিকে।

” আপনি কি করে জানলেন?সম্রাট আব্বাসের মেয়ে হয়েও আমি এই সত্য সঠিক ভাবে জানি না।পাতালে আসার ইচ্ছে আমার আগেও ছিল কিন্তু পিতা কখনোই অনুমতি দেননি।”

” পুরোনো সকল রাজ কর্মীরা যানে এই সম্পর্কে।তাছাড়া ইতিহাসে সবচেয়ে নিষ্ঠুর বর্বর সম্রাট হিসেবে আপনার দাদার নাম উল্লেখযোগ্য।”

শেহজাদী আরওয়া ভীতিকর চাহনীতে আরেকবার তাকালেন চারিদিকে।শরীরটা কেমন ছমছম করছে।

” সাবধান শেহজাদী এখানে যে এত মানুষের বদ্ধ আত্মারা জমা আছে তারা আবার যদি প্রতিশোধ পরায়ণ হয়ে উঠে আপনাকে আঘাত করে।”

” ক..কি বলছেন আপনি আমাকে ভয় দেখাচ্ছেন তাই না তাসবীর?”

তাসবীর প্রত্যুত্তর করলেন না।মোম গলতে গলতে শেষ পর্যায়ে আছে তার দিকে নির্নিমিখ তাকিয়ে রইলেন তিনি।প্রাসাদের এখন কি অবস্থা?নিশ্চই কন্যা নিখোঁজ সংবাদে সম্রাট আব্বাস উন্মাদ হয়ে উঠেছে।উন্মাদনায় আবার শেহজাদীর দাসীদের শাস্তি দিয়ে না বসেন!তাসবীরের মনের সকল চিন্তার অবসান ঘটলো শেহজাদী আরওয়ার চোখে চোখ রাখতে।প্রমত্ত হৃদয়টা যেন গভীর ভাবে ব্যাকুল হয়ে উঠেছে।এই মনে যত প্রেম জমা তার অন্তিম এই রমনীর মাধ্যেমেই হবে।

” আমার প্রশ্নের উত্তর আমি পাইনি তাসবীর।আমাকে এখানে বন্দী করেছেন কেন?সম্রাট সাঈদের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে আপনার কোন স্বার্থে আঘাত লাগলো শুনি?”

“ঘরের চাঁদ কি কেউ বাইরে প্রদর্শিত করে?তাহলে আমার ঘরের চাঁদ আমি বাইরে প্রদর্শিত কেন করবো?”

তাসবীরের তীক্ষ্ণ ধারালো কন্ঠে অবাক চাহনীতে তাকালেন শেহজাদী।এই জিন্নাতের কথার আঘা গোড়া কিছুই মাথায় ডুকছে না তার।কে চাঁদ?কার ঘর?কিসব বলছেন তিনি।
হঠাৎ পাতালের পশ্চিম কোনের দরজায় বিকট শব্দ হলো নিশ্চই কেউ পাতাল ঘর খোলার চেষ্টা করছে।সঙ্গে সঙ্গে মোমের আলো নিভিয়ে দিলেন তাসবীর।ভয়ে চাপা আর্তনাদ করলেন শেহজাদী।শেহজাদীর কন্ঠ কেউ শুনে নিলে আর রক্ষে থাকবে না নিজেকে বাঁচাতে দ্রুত শেহজাদীর মুখ চেপে ধরলেন তাসবীর।

“দুঃখিত শেহজাদী আপনাকে আঘাত করার জন্য।”

ক্রমশ পাতালের দরজার শব্দ থেমে এলো।অন্ধকার নিশ্চুপ পাতালে শুধু দুজন নর-নারীর নিশ্বাস প্রশ্বাসের ধ্বনি এই দেয়াল থেকে ওই দেয়ালে ছিটকে পড়ছে।অতি উত্তেজনায় শেহজাদীর চেতনা হারানোর উপক্রম হয়েছে অন্ধকার পাতালে সেই মৃত মাথার খুলির কথা ভাবতেই গা গুলিয়ে আসছে।শেহজাদী আরওয়ার অবস্থা বুঝতে পেরে তাসবীর তার মুখ ছেড়ে দিল।

” আলো জ্বালান আমার ভয় করছে।”

“মোম ফুরিয়ে গেছে এখন আমাদের আলো ছাড়া থাকতে হবে।”

” আমি পারবো না থাকতে।একটু পানি পা…পানি দিন গলাটা শুকিয়ে গেছে।”

” হায় আল্লাহ আমি তো কোন তরল খাদ্য আনলাম না।একটু ধৈর্য্য ধরুন শেহজাদী।”

শেহজাদীর অস্বস্তিতে অস্থির হয়ে গেলেন তাসবীর।কিয়ৎক্ষণ পর অবস্থার অবনতি ঘটলো শেহজাদী আরওয়া চেতনা হারিয়ে ঢলে পড়লেন মেঝেতে।ঘুমুট অন্ধকারে শেহজাদীর চেতনা হারানোর বিষয়টি সহজে বুঝতে পারলেন তাসবীর।উচাটন মনে দ্রুত বক্ষে জায়গা করে দিলেন শেহজাদীর মাথা।

” শেহজাদী শুনতে পারছেন?শেহজাদী!”

শেহজাদী আরওয়ার সাড়া শব্দ মিললো না এই নিস্তব্ধ রুম জুড়ে।উৎকণ্ঠিত মনে হাসলেন তাসবীর।শেহজাদীর মাথা’টা খানিকটা জোরে চেপে ধরলেন তার বক্ষে।দেয়ালে মাথা ঠেকিয়ে বলেন,

” এত তেজ, এত জেদ,এত ক্ষমতা এই অন্ধকারেই হাওয়া!

১০.
প্রাসাদ জুড়ে বিশৃঙ্খলা অবস্থা।শেহজাদী আরওয়া নিখোঁজ সংবাদ ইতোমধ্যে সম্রাট সাঈদের কানে পৌঁছে গেছে এতে বিষয়টা নিয়ে তিনি কোন প্রতিক্রিয়া দেখালেন না বরং সম্রাট আব্বাসকে নিদিষ্ট সময় দিলেন এর মাঝে যে করে হোক শেহজাদী আরওয়া নূর’কে তার সামনে হাজির চাই।তিনি উদয় নগরীর সম্রাট ওয়াহাব কিংবা তার পুত্র মেসবাহ নন যে খালি হাতে ফিরে যাবেন।তিনি তেলিকোনার সম্রাট কিছুতেই খালি হাতে ফিরবেন না।চারিদিকে প্রহরী দাসিদের উপর চাপ সৃষ্টি হচ্ছে হঠাৎ রুম থেকে কোথায় হারিয়ে যাবেন শেহজাদী।যেখান থেকে পারুক শেহজাদী আরওয়ার খোঁজ চাই চাই।

” সম্রাট আব্বাস আপনার নিদিষ্ট প্রহর যে শেষ মুহূর্তে।”

সম্রাট সাঈদের কথায় চিন্তিত ভঙ্গিমায় মাথা দুলালেন সম্রাট আব্বাস।

” এই বিয়ে নিয়ে আমার মেয়ের কোন দ্বিমত ছিল না।বরং হাসিমুখে সম্মতি দিয়েছে কিন্তু হঠাৎ যে কি হয়ে গেল।”

” তা তো শুনতে চাই নি।আমি আমার বেগম’কে দেখতে এসেছি ওইদিকে আমার পিতা মাতা আমার জন্য অপেক্ষায় আছেন কখন তাদের সুসংবাদ জানাব।কি ভেবেছিলেন উদয় নগরীর শাহাজাদা মেসবাহ’র মতো খালি হাতে ফিরবো?তা হচ্ছে না যে।”

সাঈদের কথায় দাঁড়িয়ে গেলেন শাহজাদা ইবনুল উত্তেজিত হয়ে বললেন,

” পিতা বোনের নিখোঁজের পেছনে মেসবাহ’র হাত নেই তো?”

সম্রাট আব্বাস প্রত্যুত্তর করলেন না।সভা ছেড়ে উঠে গেলেন তিনি।আরেকবার প্রবেশ করলেন শেহজাদী আরওয়ার কক্ষে।সব কিছু সুসজ্জিত বেশ গোছানো তাতে বোঝাই যাচ্ছে শেহজাদীকে এখান থেকে কেউ জবরদস্তি করে নিয়ে যায়নি তবে কোথায় গেল শেহজাদি?সম্রাট আব্বাসকে মেয়ের কক্ষে দেখে পেছন পেছন কক্ষে এলেন সম্রাজ্ঞী শাহাবা।

” সম্রাট আমার কন্যার কোন খোঁজ পেলেন?”

” বেগম জান সত্যি করে বলুন কন্যা কোথায় আছে?”

সম্রাট আব্বাসের সন্দিহান কন্ঠে বিস্মিত হলেন সম্রাজ্ঞী।

” কি বলছেন আপনি সম্রাট?আমার কন্যাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছেনা তার দুশ্চিন্তায় জান যায় যায় অবস্থা আর আপনি….”

” আরওয়া যখন তৈরি হচ্ছিল আপনি তখন কোথায় ছিলেন?তাছাড়া এই বিয়েতে আরওয়ার সত্যি কি মতামত ছিল?”

“জ্বি সম্রাট ছিল আরওয়া নিজে খুশি মনে তৈরি হচ্ছিল।আমাকে খাস দাসী লতা নিশ্চিত করেছে এই বিবাহে আরওয়ার মতামত ছিল।আরওয়া যখন তৈরি হচ্ছিল আমি তখন হেঁশেলে ছিলাম।”

সম্রাট আব্বাস কক্ষ ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন।তখন দরজার বাইরে অবস্থান করছিলেন উজির হাযম।

” হাযম।”

” জি সম্রাট বলুন।”

” শেহজাদী আরওয়ার দ্বাররক্ষক’দের পুনরায় জিজ্ঞাসাবাদ করো যদি তারা সঠিক তথ্য দিতে না পারে একশত ঘা চাবুকের ব্যবস্থা করো,চাবুকের প্রহারে কাজ না হলে চামড়া তুলে লবন দিয়ে সিঞ্চন করো।আমার কন্যা কোথাও গেলে এই দ্বার দিয়েই যাবে তাহলে দ্বাররক্ষকরা কি পড়ে পড়ে ঘুমাচ্ছিল?”

” যথা আজ্ঞা সম্রাট আপনার নির্দেশ মোতাবেক সবটা করছি।”

” মনে রাখবে এই বিষয়ের সাথে আমার মান সম্মান জড়িত যদি হেরফের হয় তবে দাস-দাসী,প্রহরী তাদের আজ শেষ দিন।”
#চলবে____

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here