বিধুর রজনী পর্ব -০৬+৭

#বিধুর_রজনী
#পলি_আনান
[পর্ব সংখ্যা ৬]
__________________
১১
অন্ধকার গহ্বরে নিজেকে হারিয়ে ফেলেছেন শেহজাদী আরওয়া।একফালি আলোর আশায় ছুটছেন দ্বিকবিদিক।ঘর্মাক্ত জুলফি হাতের উলটো পিঠে মুছে আবারও দৌড়তে শুরু করেছেন তিনি উদ্দেশ্য আলোর খোঁজে। কিয়ৎক্ষণ বাদে আলোর ঠিকানা তিনি পেয়েছেন তবে সেই স্থানে যাওয়ার আগে কেউ যেন তাকে পেছন থেকে বন্দি করেছে।শেহজাদী আরওয়া পেছনে তাকালেন তাকে ঘিরে ধরেছে বেশ কয়েকটি কঙ্কাল।এত কঙ্কালের মাঝে নিজেকে অসহায় লাগছে পালাতে গিয়েও তিনি বন্দি।এক পর্যায়ে নিজেকে বাঁচাতে বিকট শব্দে চেঁচিয়ে উঠেন শেহজাদী।চোখ মেলতে টের পান এই মুহূর্তে তিনি নিজের কক্ষেই আছেন।তবে এতক্ষণ কি স্বপ্ন দেখছিলেন?কবিরাজ মশাই আড়চোখে তাকালেন সম্রাট আব্বাসের দিকে।

” আমি ঠিকি বলেছি সম্রাট আমাদের শেহজাদী ভয় পেয়ে চেতনা হারিয়েছেন।”

কবিরাজের কথায় কেউ কোন প্রত্যত্তুর করলো না।সম্রাজ্ঞী শাহাবা জড়িয়ে ধরলেন তার কন্যাকে।চোখের কোনে গড়িয়ে পড়ছে নোনা জল।

” আমার আম্মু আমার চাঁদ কোথায় হারিয়ে গেছিলে?”

” মা আমি…”

” হ্যাঁ বলো কোথায় ছিলে তুমি?”

শেহজাদী সচকিতে সবার দিকে তাকালেন।মনে মনে ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে গেলেন, গলাটা কেমন শুকিয়ে আসছে তার।

” পানির পাত্রটি দিন।আর সবাই এই কক্ষ ছেড়ে চলে যান।আমি মাতার সঙ্গে একা থাকতে চাই।”

শেহজাদী আরওয়ার নির্দেশে সবাই কক্ষ ছেড়ে গেলেও সম্রাট আব্বাস গেলেন না।তিনি ঠায় দাঁড়িয়ে রইলেন পালঙ্কের ধারে।

” আরওয়া তুমি কোথায় ছিলে?কি হয়েছে তোমার সাথে?”

” এই প্রাসাদে যে জিন্নাত আছে তা কি আপনি জানেন?”

“জিন্নাত কিসব বলছো তুমি!”

” হ্যাঁ জিন্নাত সেই জিন্নাত আমায় নিয়ে গেছে আমায় বন্দি করেছে।”

শেহজাদীর অস্থির কথার তালে অবাক হলেন সম্রাট এবং সম্রাজ্ঞী তারা একে অপরের দিকে তাকালেন।এমন অদ্ভুত কথা এই প্রাসাদ নিয়ে এর আগে কখনো শুনেন’নি তারা।

” তোমার কোথাও ভুল হচ্ছে মা জিন্নাতের প্রবেশ এই প্রাসাদে নেই।”

” জানতাম আপনারা বিশ্বাস করবেন না।তাই…তাই আগেই বলিনি আপনাদের।আমার সব অসহ্য লাগছে চলে যান আপনারা চলে যান এখান থেকে।”

সম্রাট আব্বাস তার বেগমকে ইশারায় বললেন এই কথা যেন পাঁচ কান না হয়।এবং তিনি দ্রুত বেরিয়ে গেলেন কক্ষ ছেড়ে মাথায় তার ভর করেছে আরেক দুশ্চিন্তা।

ইতোমধ্যে সম্রাট সাঈদের কানে পৌঁছে গেছে শেহজাদীর খোঁজ মিলেছে আর তা শুনে বেশ খুশি হলেন তিনি।সম্রাট আব্বাসকে দুশ্চিন্তায় মত্ত দেখে ভ্রু কুঁচকলেন তিনি।

” কোন সমস্যা?শেহজাদী কোথায় ছিল কিছু বলেছেন কি?”

” আসলে শেহজাদী আমার উপর অভিমান করে গা ঢাকা দিয়েছে তাই…”

বেশ সাবলীল ভাবে মিথ্যা বলে ফেললেন সম্রাট আব্বাস।তবে তার মিথ্যা বানী খুব সহজে ধরে ফেললেন সম্রাট সাঈদ,তিনি তার উজিরের দিকে তাকিয়ে তাচ্ছিল্য হাসলেন।

” তাই নাকি তবে আমার তো মনে হচ্ছে অন্যকিছু।সে যাই হোক আমার বেগম এখানে অনিশ্চিত জীবনে বসবাস করছে।আমি টের পাচ্ছি তার সাথে অন্যকিছু হয়েছে আর আপনারা আমার কাছে তা গোপন রেখেছেন।আমি বরং একবার শেহজাদী আরওয়ার সঙ্গে দেখা করতে চাই।”

” অবশ্যই অবশ্যই আপনি অপেক্ষা করুন শেহজাদীর অনুমতি নিয়ে ডেকে পাঠানো হবে।”

সম্রাট সাঈদ শেহজাদী আরওয়ার সঙ্গে দেখা করলেন এবং আরওয়ার মুখ থেকে জানতে চাইলেন তিনি এই বিবাহে রাজি কি না?দুই’চার না ভেবেই শেহজাদী এই বিবাহে সম্মতি দিয়েছেন এতে খুশি হয়েছে সম্রাট সাঈদ তিনি যাওয়ার আগে জানিয়ে যান খুব শীঘ্রই বিবাহের দিন ধার্য হবে।

শেহজাদীর বিবাহের বিষয়টি একে একে সবার কাছে জানা হয়ে গেছে।জেনে গেছেন তাসবীর নিজেও।তখন শেহজাদীর অবস্থার অবনতি দেখে পাতাল থেকে শেহজাদীর কক্ষে ফিরিয়ে আনেন তাসবীর এরপর থেকেই গা ঢাকা দিয়েছেন তিনি।তাসবীর ইদ্রীসের কক্ষের এক কোনে বসে আছেন ঘাপটি মেরে।শেহজাদী আরওয়ার রুমে নিরাপত্তা আগের থেকেও বাড়ানো হয়েছে।কক্ষের আশেপাশে চারিদিকেই প্রহরীরা রয়েছে।এছাড়াও দাসী লতা সর্বদা শেহজাদীর সঙ্গে কক্ষে অবস্থান করছেন।

” বন্ধু তুমি এখানে?সকাল থেকে কোথায় ছিলে?”

ইদ্রীসের কন্ঠে চমকে যান তাসবীর।

” রাজ্যে ছিলাম ঘুরে ফিরে দেখছিলাম।আমি চলে যাবো।”

“সে কি কথা আর কয়েকদিন থেকে যাও।আগামী মাসে বোনের বিয়ে।”

” শেহজাদীর বিয়ে!”

“হুম সম্রাট সাঈদ তো তাই বলে গেলেন।আগামীকাল প্রত্যুষে পিতা এবং ভাই সবাই মিলে উদয় নগরীতে রওনা হবে।তুমি নিশ্চিন্ত মনে এখানে থাকতে পারো।”

“উদয় নগরী কেন যাবে?”

“উদয় নগরী জয় করতে।পিতার ভয় শেহজাদীর নিখোঁজের পেছনে মেসবাহ’র হাত আছে এবং এই বিষয়টি নিয়ে তিনি শঙ্কিত যদি বিয়ের দিন কোন গণ্ডগোল করে।তাছাড়া পিতা কোন কাঁটা রাখতে রাজি নয় সময় সুযোগ থাকতে থাকতে তিনি কাঁটা উপড়ে ফেলবেন।”

“হুম বুঝলাম।আবার যু/দ্ধ হা-না-হা-নি,রক্তপাত উফফ এসব আমার সহ্য হয়না।”

” আমিও তোমার মতো বন্ধু কিন্তু কি করার আমার রক্তে যে সম্রাটের রক্ত মিশে আছে।এই রাজ্য ছেড়ে যাই কি করে।”
লেখনীতে পলি আনান
তাসবীর মিহি হাসলেন মনে মনে বেশ দুশ্চিন্তায় আছেন কি করে ঠেকাবেন শেহজাদীর বিয়ে?

১২.
ফজরের আযান শোনা যাচ্ছে।সম্রাট সহ প্রাসাদের সকলে নামায সেরে রাজ সভায় উপস্থিত এখনি সবাই উদয়নগরীর উদ্দেশ্য রওনা হবেন।আস্তাবল থেকে চার’শ ঘোড়া,তিন হাজার অসিচালনার দক্ষ লোক,ছয়’শ তীরন্দাজ এবং নয়টি কামান গোলা নিয়ে সম্রাট আব্বাস এবং তার বড়পুত্র ইবনুল বেরিয়ে পড়েছেন উদয় নগরীর উদ্দেশ্যে।এত শক্তিশালী দলকে যে হারানোর ক্ষমতা উদয়নগরীর সম্রাট ওয়াহাবের হবে না তা ভালো করেই যানে সকলে।

দ্বাররক্ষক সকলে তখন ঘুমে কাবু।সম্রাট বেরিয়ে পড়েছেন খবরটা নিশ্চিত হয়ে দরজার কাছে ঘুমিয়ে পড়েছে তারা।তাসবীর সেই সু্যোগ’টা লুফে নিল আশেপাশে তাকিয়ে দ্বার কয়েকবার ধাক্কা দিতে থাকেন কিন্তু শেহজাদী আরওয়ার কক্ষের দ্বার ভেতর থেকে বন্ধ তাসবীরের সুযোগ’টা বিফলে গেল ভাবতেই দাঁত মুখ খিচে রাগ ঝাড়লেন।অতিদ্রুত প্রাসাদ থেকে বেরিয়ে শেহজাদীর জানলার কাছটায় গেলেন।অন্ধকার আকাশে আজ চাঁদ নেই আর নেই কোন তারা, আজকের আকাশটাও যেন বিষণ্ণ মনে অপেক্ষায় আছে সূর্যের।তাসবীর জানলা টপকে শেহজাদী আরওয়ার কক্ষে প্রবেশ করেন।পালঙ্কের মাঝ বরাবর চাদর মুড়িয়ে ঘুমিয়ে আছেন শেহজাদী।প্রদীপ মিটে মিটে আলোয় অন্ধকার কক্ষের বিষণ্ণ রেষ কাটিয়ে তুলেছে বেশ সাবলীল ভাবে।তাসবীর পালঙ্কে পা তুলে বসে এক ধ্যানে খানিকক্ষণ তাকিয়ে রইলেন শেহজাদীর দিকে।একদিনের আতঙ্কে ভয়ে মেয়েটার মুখখানি কেমন চুপসে গেছে।মনে মনে অনুশোচনা জাগলো তাসবীরের শেহজাদীর কপালে হাত রেখে গায়ের তাপ নির্ণয় করলেন,নাহ স্বাভাবিক আছে।

” শেহজাদী উঠুন ভোর হয়ে এসেছে।”

তাসবীরের কন্ঠে চোখ মেলে তাকালেন শেহজাদী।পাতালের ভয়ে এক নিমিষেই মনে পড়ে গেল তার ফলে দ্রুত শোয়া থেকে উঠে আকস্মিক দু’হাতের সাহায্য ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিল তাসবীরকে।নিজের নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখতে না পেরে সহসা মেঝেতে ছিটকে পড়লেন তাসবীর।মানুষটার চাপা আর্তনাদে কোন হেলদোল হলো না শেহজাদীর বরং তিনি নিজেকে বাঁচাতে খুব দ্রুত ছুটে গেলেন দ্বারের কাছে দ্বার খোলার আগেই তাসবীরের নির্দেশে দু’পা থেমে গেল তার।

” কসম শেহজাদী যদি দরজা খুলেছেন তো…”

” তো?”

তাসবীর প্রত্যুত্তর করলেন না বরং ত্বরান্বিত দু’হাতের সাহায্য বন্দি করলেন শেহজাদী আরওয়াকে।

” আমি ভূ-ত নই যে আপনাকে গিলে খাব এত ছুটছেন কেন?মায়া দয়া আপনার নেই তা আমি জানি তবে যে আমার কোমরের কলকব্জা সব ছাড়িয়ে দিয়েছেন তার কি হবে?”

” অসভ্য ছাড়ুন আমায়।দিন দিন আপনি যে দুঃসাহস দেখাচ্ছেন তার ফল কতটা ভয়ংকর হতে পারে সে ধারণা আপনার নেই।”

” আর আমি আমার ক্ষমতা’র ব্যবহার করলে আপনার চৌদ্দ গুষ্টির কি হবে তার ধারণা আপনার নেই।”

” মূর্খ কি আছে আপনার?পিতাকে সব জানিয়েছি তিনি অতি শীঘ্রই আপনাদের ব্যবস্থা করবেন।প্রাসাদে জিন্নাতের চলাচল বন্ধ।

শেহজাদীর কথার পিঠে তাসবীর মিহি হাসে।আলগা হয়ে আসে তার হাতের বাধন।

” আমি জিন্নাত নই শেহজাদী।মার্জনা করবেন মিথ্যা বলায়।রক্তে মাংসে গড়া মানুষ আমি।”

” আবার মিথ্যা?এবার নিজেকে মানুষ সাজাতে চাইছেন।”

“আল্লাহ রাব্বুল আলামিন পবিত্র কুরআনে বলেছেন, আর অবশ্যই আমি মানুষকে সৃষ্টি করেছি শুকনো ঠনঠনে, কালচে কাদামাটি থেকে। আর এর পূর্বে জিনকে সৃষ্টি করেছি উত্তপ্ত অগ্নিশিখা থেকে। [সূরা আল হিজর : ২৬-২৭] আমি মানুষ, জিন্নাত নই আর না আছে আমার তেমন কোন ক্ষমতা।”

শেহজাদীর হাত আপনা আপনি ছুঁয়ে দেয় তাসবীরের হাত।তিনি যেন বিশ্বাস করতে পারছেন না এই লোকটা মানুষ।এতদিন তাসবীরের প্রতি দুর্বল হলেও তা তিনি প্রকাশ করেননি।জিন্নাত আর মানুষ এক হতে পারে না কেউ তা মেনে নেবে না।তাসবীর নামক এই সুপুরুষ মানুষ!ভাবতেই খুশিতে কান্না চলে আসছে শেহজাদীর।

” তাহলে এত সব গোপন তথ্য কি করে জানেন?আপনি তো বলেছেন জিন্নাতরা সব জানে কিন্তু আপনি তো মানুষ।এই প্রাসাদে কিংবা আমার কক্ষে আপনাকে কোন দিন দেখিনি।”

” আমি এর আগেও প্রাসাদে এসেছি এই রাজ্য সম্পর্কে খুঁটিনাটি অনেক তথ্য জানি শেহজাদী।আমি এটাও জানি আপনাকে সকলে অমঙ্গল,অভিশপ্ত ভাবে।যদিও এই কথা দাস-দাসী’রা কেউ জানে না শুধুমাত্র আপনার পিতা এবং বড় ভাই সেটা মানে।”

সহসা মাথা নিচু করে নেন শেহজাদী আরওয়া।এ যে অপবাদ আর সেই অপবাদের কথা আগন্তুক জানলো কী করে?চোখের কোনে চিকচিক করছে নোনাজল।তাসবীর তা ত্বরান্বিত মুছে দিয়ে বলে,

” আমি চব্বিশ’টি রাজ্যে ঘুরেছি।আর সে রাজ্যের শেহজাদীদের মুখ দর্শন করেছি।কখনো চিত্রকর সেজেছি কখনো কবি সেজে তাদের মনোরঞ্জন করেছি তবে আপনার মতো ঘোর আর কারো আদলে পাইনি।আমি বলবো না আপনি অতি সুন্দরি তবে নিঃসন্দেহে বলতে পারি আপনি আমার সুখানুভূতি!”

শেহজাদী আরওয়া নিজেকে ছাড়িয়ে নিলেন।পালঙ্কে পা দুলিয়ে বসলেন তিনি।কোণা চোখে তাকালেন তাসবীরের দিকে অতি দৃঢ় স্বরে বলেন,

” প্রেম নিবেদন করতে চাইছেন নাকি?”

” একদমই নয়।এসেছিলাম শেহজাদি আরওয়ার মনোরঞ্জন করতে।”

“পেরেছেন কি?”

” তা তো অনেক আগেই।তবে যে সে আমার মনোরাজ্য দখল করেছে তার কী হবে?”

শেহজাদী দাম্ভিক হাসি দিলেন।পালঙ্ক ছেড়ে আরশির কাছটায় দাঁড়ালেন।

” সে যাই হোক।আপনি যে বড্ড দেরি করে ফেলেছেন তাসবীর।আসা করি ইতোমধ্যে যেনে গেছেন সম্রাট সাঈদের সঙ্গে আমার বিবাহের দিন নির্ধারিত হয়ে গেছে।”

” তাতে কি?সময় সুযোগ মতো আমি আমার ক্ষমতা দেখিয়ে দিব।”
#চলবে____#বিধুর_রজনী
#পলি_আনান
[পর্ব সংখ্যা ৭]
___________________
১৩.
গরম জলে স্নান সেরে শেহজাদী আরওয়া খাসদাসী লতাকে নিয়ে রাজসভার দিকে গেলেন।জিন্নাতের ব্যাপারে কথাটি যে তার ভ্রম সেটি সম্রাট’কে সুনিশ্চিত ভাবে বলতে হবে, না হলে আরেক কেলেঙ্কারি ঘটে যাবে।রাজসভায় উপস্থিত হয়ে খানিক’টা চমকালেন শেহজাদী।আজ রাজসভা বসেনি
শূন্য উদ্যানের ন্যায় খা খা করছে রাজসভা।

” একি আজ সভা বসে’নি?”

” আজ্ঞে না শেহজাদী।”

” পিতা কোথায়?হঠাৎ সভা বন্ধ করলেন যে?”

” সম্রাট আজ প্রত্যুষে উদয় নগরী রাজ্য দখলের উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছেন।”

গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ’টি এই মুহূর্তে পেয়ে বেশ চমকালেন শেহজাদী।চোখে মুখে অবাকের রেশ বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না।খাসদাসী লতাকে সঙ্গে নিয়ে তিনি পুনরায় ছুটলেন সম্রাজ্ঞী শাহাবার কক্ষে।সেখানে উপস্থিত ছিলেন সম্রাট আব্বাসের বোন আসমা।

” শুভ সকাল মাতা।”

“শুভ সকাল কন্যা।ঘুম কেমন হলো?”

” বেশ ভালো।ফুফু’মা কেমন আছেন এখন?পায়ের ব্যথা কমেছে?”

শেহজাদীর প্রশ্নে তার ফুফু আসমা মাথা ঝুঁকালেন।শেহজাদী মিহি হাসলেন এগিয়ে গেলেন জানলার কাছটায়।সোনা রোদের চকচকে আলোয় পুষ্পাধারে থাকা হলুদ অলকানন্দা ফুলগুলো বেশ ঝকমক করছে।একটি ফুল ছিড়ে হাতের মুঠোয় রাখলেন শেহজাদী।

” আমার একটা প্রশ্ন ছিল মা।”

” অনুমতি চাইছো?আমি তোমার মা হই যখন যা মনে আসবে নির্দ্বিধায় বলতে পারো।”

” কিন্তু তার আগে যে আপনি সম্রাট আব্বাসের স্ত্রী।এই অলকপুরী রাজ্যের সম্রাজ্ঞী।কিছু বলার আগে অনুমতি অবশ্যই নেওয়া উচিত আমার”

” এভাবে কথা বলছো যে?কি বলবে বলো।”

” শুনলাম উদয় নগরী রাজ্যে দখলে গেছেন পিতা।যুদ্ধে যাওয়ার বিষয়টি প্রাসাদের সকলে অবগত হলেও আমি জানতে পারিনি কেন?তাছাড়া যাওয়ার আগে পিতা একবার আমার সঙ্গে দেখাও করলেন না!যুদ্ধ মানেই জীবন মরণের সন্ধিক্ষণ।অন্তত…..”

শেহজাদীর মুখের কথা অবজ্ঞা’র সহিত কেড়ে নিলেন ফুফু আসমা।

” লজ্জা নেই কি তোমার?আর কতবার বললে শুধরাবে?কোন শুভ কাজে যাওয়ার আগে তোমার মুখ দেখা মানা তাহলে অমঙ্গল গায়ে লেপটে যায়।”

আসমার কথায় হতভম্ব হলেন সম্রাজ্ঞী শাহাবা।

” থামুন আপা এভাবে বলছেন কেন?মঙ্গল অমঙ্গল সব আল্লাহর উপর এভাবে বলছেন কেন মেয়েটাকে!”

” তুমি চুপ কর।আমার ভাইজান শুভ কাজে যাওয়ার আগে এমনি এমনি এই মেয়ের মুখ দর্শন করেন না এর পেছনে নিশ্চয়ই উত্তম কারণ আছে।আর শুনে নাও আরওয়া তুমি যে তোমার পিতার জন্য অভিশপ্ত তা……. ”

বুকের ভেতরটা ধুমড়ে মুচড়ে গেল এক নিমিষে।শেহজাদী ছুটে চলে গেলেন কক্ষের বাইরে।ফুরফুরে মেজাজ চোখের পলকে তার গায়েব হয়ে গেল ।

” কাঁদছেন কেন শেহজাদী?”

” খবরদার পেছন পেছন আসবে না।শাস্তি ভোগ করতে না চাইলে আমাকে একা ছেড়ে দাও।”

ঘন জঙ্গলে পাখপাখালির শব্দে কানে হাত দিয়ে অগ্রসর হলেন শেহজাদী।স্থানীয় নাম অনুসারে এই জঙ্গলের নাম হরিৎ বন।হিংস্র জন্তু জানোয়ারের ভয়ে এই জঙ্গলে মানুষ প্রবেশ নেই বললেই চলে তবুও ঘন জঙ্গলের একজন বৈরাগীর বসবাস।ঈশান কোণের দিকে জঙ্গলের মাঝে একটি কুটির আর সেখানে বৈরাগী নিজের মত করে সবটা গুছিয়ে নিয়েছে।শেহজাদী আরওয়া খাস দাসী লতার মাধ্যমে এই বৈরাগীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন,বৈরাগীর সঙ্গে বাক্যালাপে শেহজাদী বড্ড সন্তুষ্ট হন।বিশেষ করে তার একতারার সুরের গান যে সুরের মূর্ছনায় হারিয়ে যান শেহজাদী আরওয়া।তারপর থেকেই উচাটন মনে বেশ কয়েকবার ছুটে যান বৈরাগীর কাছে।

” কুটিরে আছেন বৈরাগী?”

” কে লো কে এসেছিস?”

” আমি শেহজাদী আরওয়া নূর।”

শেহজাদীর নাম শুনতে ছুটে বাইরে বেরিয়ে আসেন বৈরাগী।চোখে মুখে বিস্ময় ভাব ছড়িয়ে পড়ে মুহূর্তে।খুশিতে চোখ দু’টো করে উঠে চকচক।নত মস্তকে শেহজাদীকে সম্মান প্রদর্শন করলেন তিনি।

” ভেতরে আসুন শেহজাদী।”

শেহজাদী মৃদু হেসে কুটিরের ভেতর প্রবেশ করে।বৈরাগী তার পেছন পেছন ছুটে যায়।

” রাজ বাড়িতে যান না কেন বৈরাগী।আপনাকে আমি বলে ছিলাম অন্তত সপ্তাহে একদিন আমাকে গান শোনাতে যাবেন।”

” আপনার নির্দেশ ছিল তাই তো আর যাওয়া হয় না।”

” আমি!এমন কথা কে বললো আপনাকে?”

রুষ্ট মনে শেহজাদীর ধারালো সুরে খানিকটা ঘাবড়ে যায় বৈরাগী।

” শাহজাদা ইবনুল বলেছেন আপনি প্রাসাদে আমার প্রবেশ নিষিদ্ধ করেছেন।তারপর থেকে আর যাওয়া হয়নি।”

শেহজাদী আরওয়া দু’চোখ বন্ধ করলেন।এমন মিথ্যা অপবাদ কিছুতেই হজম হচ্ছে না তার তবুও নীরব রইলেন।বিষণ্ণ মন কিছুতে কাটিয়ে উঠতে পারছেন না তিনি তাই মিহি স্বরে প্রশ্ন করেন,

” মানুষ আমায় ভালোবাসে না কেন বৈরাগী?”

বৈরাগী আড় চোখে তাকালেন শেহজাদীর পানে মেয়েটার চোখ টলমল করছে তেজস্বী মেয়েটা এই মুহূর্তে যেন সবচেয়ে দুর্বল বিক্ষিপ্ত।

” আপনি মানুষ’কে ভালোবাসেন শেহজাদী?বাসেন না।পান থেকে চুন খসলেই রেগে একাকার পরিস্থিতির সৃষ্টি করেন।অবশ্য আপনি একা নন আপনার দাদা, পিতা, ভাই সবাই এক ধাঁচের নিষ্ঠু-র বর্ব-র আর সেই রক্ত আপনার শরীরে বইছে এসব ব-র্বরতা আপনার দ্বারা হওয়া দুঃসাধ্য নয়।আমি কেমন তা আপনি জানেন কথার তালে কথা বলে ফেলেছি আমায় মার্জনা করবেন যদি শাস্তি দেওয়ার ইচ্ছে মনে জাগে তবে আপনার শাস্তি গ্রহণে আমি প্রস্তুত।”

ঝাপসা চোখ স্থির রইলো না আর এক মুহূর্তে টলটলিয়ে গড়িয়ে পড়লো সহসা।বৈরাগী এক পানির পাত্র এগিয়ে দিলেন শেহজাদীকে।ধরলেন তার সুরেলা কন্ঠের গান।একতারার সুরে মিহিয়ে গেলেন শেহজাদী ঝাপসা চোখ মুছে নিলেন বা’হাতের উলটো পিঠে।

১৪.
সম্রাট আব্বাসের দলবল নিয়ে একটি দুর্গের কাছে পৌঁছালেন।এই দুর্গ সম্রাট আব্বাস কয়েক বছর আগেই দখল করেছেন বর্তমানে রাজ্য’টির দায়িত্বে আছেন শাহজাদা ইবনুল।সন্ধ্যার বাতি জ্বালানোর ব্যবস্থা করে উজির হাযম এগিয়ে গেলেন শাহজাদা ইবনুল রাশীদের কক্ষে।

” আমায় ডেকেছিলেন শাহজাদা?”

” হুম, পিতা কোথায়?”

” তিনি কক্ষে বিশ্রাম গ্রহণ করছেন।জরুরি প্রয়োজন ছিল কী?কোন বার্তা পৌঁছাতে হবে?”

” তা নয়।তবে আমি যে ক্ষুদার্থ।”

” এক্ষুনি খাবারের ব্যবস্থা করছি আমি আপনি আরেকটু অপেক্ষা করুন।”

উজির হাযমের কথায় মুখ বাকিয়ে হাসলেন ইবনুল রাশীদ।

” কোন খাদ্যই আমার ক্ষুদা মেটাবে না।একমাত্র এই রাজ্যের রসালো তীপ্তময়ী খাদ্য ছাড়া।”

” রসালো খাদ্য!”

” আহ!মূর্খ উজির এখনো বুঝতে পারছেন না শরীরের ক্ষুধা মেটাতে চাই।কাঁখে কলসি নিয়ে নদী চরে হাটা সেই রমণীর কথা মনে আছে?”

” হ..হ্যাঁ।
“সেই মেয়েটার ব্যবস্থা করুন।যে করে হোক রাতের ভোজনের পর আমার কক্ষে মেয়েটিকে চাই।”

উজির হাযম খানিকটা বিচলিত হলেন।তবে এ আর নতুন কি?শাহাজাদা ইবনুল রাশীদের এমন নির্দেশ নতুন নয়।বাবার বয়সী একজন মানুষকে এভাবে রাতের সঙ্গী আনার ব্যবস্থার আদেশ করতে তার লজ্জা লাগতে না পারে তবে মাঝে মাঝে লজ্জায় মাথা নুইয়ে আসে হাযমের।
.
নিস্তব্ধতা ঘিরে থাকা দুর্গটি হঠাৎ একটি মেয়ের আহাজারিতে জেগে উঠলো।ঘুটে ঘুটে অন্ধকারে শেয়ালের হাঁক ভীতিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করে তুলেছে।সেনাপতির নির্দেশে আজ কক্ষের বাইরে বের হওয়া সকলের নিষিদ্ধ তাই পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করতে এগিয়ে এলো না কেউ।ক্লান্ত শরীর নিয়ে গভীর তন্দ্রাচ্ছন্ন সম্রাট আব্বাস তাই তো বাইরের বিপদ সংকেত তার কর্ণ কুহুরে পৌঁছালো না।শাহজাদা ইবনুলের কক্ষের দ্বারে এসে মেয়েটিকে ধাক্কা দিয়ে কক্ষে ছেড়ে দিল একজন প্রহরী তার পেছনে ছিলেন উজির হাযম।

” আপনার নির্দেশ মোতাবেক মেয়েটিকে এনেছি শাহজাদা।”

” এবার আসতে পারুন আমার যে আর তর সইছে না।”

বিধ্বস্ত মেয়েটি চোখের পলকে জড়িয়ে ধরলো ইবনুল রাশীদের দু’চরণ।মেয়েটি প্রাণ ভিক্ষায় নিজেকে সপে দিয়েছে জা/নো/য়ারের দু’চরনে।

” আমায় ছেড়ে দিন শাহজাদা আমার পবিত্র শরীর’টায় অপবিত্রতার দাগ লাগাবেন না।একটু দয়া করুন।”

” দয়া!শাহজাদা ইবনুল রাশীদের দয়া মায়া বলে কিছু নেই।”

” আমার বিধবা মায়ের একমাত্র মেয়ে আমি তার সে বেঁচে থাকার একমাত্র সম্বল আমি অন্তত আমার মায়ের কথা ভেবে…..”

হস্তের ইশারায় মেয়েটিকে থামিয়ে দিলেন শাহজাদা ইবনুল।বেশ রাজকীয় ভঙ্গিমায় বসে পড়েন হাঁটু মুড়িয়ে।কামুক দৃষ্টিতে আরেকবার দেখে নিলেন মেয়েটিকে।তর্জনী’র আঙুল ঘুরিয়ে ছুঁয়ে দিল মেয়েটির চিবুক।সমস্ত শরীর এক নিমিষে গুলিয়ে উঠলো অভাগিনী মেয়েটির।

“সুন্দরী কত দিরহাম চাই তোমার?”

” ক..কি বলছেন!”

” স্বর্ণ, রৌপ্য,দিরহাম জায়গির কি চাই তোমার? সুখে থাকার সমস্ত উপাদানে মুড়ে দেব তোমায় শুধু এই রাতটা সহ্য করে যাও।তোমার মায়ের লাভ,তুমিও আনন্দ পাবে শুধু….”

ঘৃণায় গা গুলিয়ে এলো মেয়েটির।লোভ তার কোন কালেই ছিল না তার।শস্য ফলিয়ে যা আয় হয় তা দিয়ে দিব্যি সংসার চলে যায় অথচ শাহজাদা তাকে দেহ ব্যবসার ইঙ্গিত দিচ্ছেন ব্যভিচার করতে চাইছেন তার উপর।মেয়েটি গাল ভরতি থুথু ছুড়ে দিলেন শাহজাদার মুখে।

” জা/নো/য়ার রাজার জা/নোয়ার ছেলে তোদের ভালো কোন কালেই হবে না।”

তীব্র অপমানে হিংস্র হয়ে উঠলেন ইবনুল।রক্তিম চোখের পলক ফেলে সমস্ত শক্তি দিয়ে কষিয়ে মারলেন মেয়েটির গালে চড়।শেয়ালের হাঁক তখন ক্রমাগত বাড়ছিল।নিশাচর প্যাঁচা’র রহস্যময় ডাক অন্ধকার দুর্গটির মানুষগুলোকে কিসের ইঙ্গিত দিচ্ছে কে জানে!কেউ কেউ মনে করে প্যাঁচার ডাক অশুভের প্রতীক তাই তো উজির হাযমের শিউরে উঠলো শরীর।
#চলবে___
❌?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here