বিধুর রজনী পর্ব -১৮+১৯

#বিধুর_রজনী
#পলি_আনান
[পর্ব সংখ্যা ১৮]
_____________________
৩৭.
” গুপ্তচর ফিরে এসেছে সম্রাট আরওয়া নূর সম্রাট সাঈদের কাছে তেলিকোনা রাজ্যে নেই।”

উজির আতেফের প্রশ্নে থুতনিতে হাত ঠেকালেন তাসবীর।আরওয়ার দুশ্চিন্তায় গত কয়েকদিন দু’চোখ থেকে তার ঘুম উবে গেছে।চোখে মুখে সর্বদা চিন্তার ছাপ স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে।

“আব্বাস রাশীদের কি খবর তিনি মুখ খুলেছেন?”

” আজ্ঞে না সম্রাট।অনেকবার জিজ্ঞেসবাদের পরেও যখন মুখ খুললেন না তখন সেনাপ্রধান রউফ তার নখ তুলে নিয়েছে।এমন মরণ যন্ত্রণাও তিনি একটাই কথা বলেছেন,আরওয়া কোথায় আছে তিনি জানেন না সে সম্পর্কে একমাত্র ইবনুল রাশীদ জানেন।”

সুপ্ত রাগে চোখ বন্ধ করলেন তাসবীর।আরওয়ার খোঁজ কিছুতেই মিলছে না।অপরদিকে ইবনুল রাশীদের কোন হদিস নেই।এভাবে চলতে থাকলে সমস্ত পরিকল্পনা ভেস্তে যাবে।

” ইবনুলের খোঁজ লাগাও যত সৈন্য আছে চারিদিকে ছড়িয়ে দিন মনে রাখবেন ইবনুল ধূর্ত প্রাণী আমাদের ক্ষতি করতে কখনই পিছপা হবেন না।”

” জি সম্রাট আমি ব্যবস্থা করছি।”

” সম্রাট ওয়াহাব তার পুত্র মেসবাহ এখন কোন রাজ্যে আছে?”

” রূপনগর সেখানেও আমাদের গুপ্তচর পাঠানো হয়েছে তারা এখনো ফিরে আসেন’নি।”

” ঠিক আছে আপনি যান।”

উজির আতেফ নত মস্তকে কুর্নিশ করে ফিরে গেলেন।সম্রাট তাসবীর আরাম কেদারায় গা এলিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়লেন।শরীরটা বড্ড ক্লান্তিতে ছেয়ে গেছে।আরওয়ার খোঁজ না পেলে এই অবসাদ তার কিছুতেই কাটবে না।আরওয়ার মা শাহাবার সঙ্গে গত কয়েকদিন দেখা সাক্ষাৎ হয়নি তাসবীরের।ভাবনা মোতাবেক শাহাবার সঙ্গে দেখা করার উদ্দেশ্যে দ্রুত কক্ষ ছেড়ে বেরিয়ে পড়েন তাসবীর।মহলের প্রত্যেকটি দ্বারে দ্বাররক্ষকর কড়া পাহারায় আছে।সম্রাট তাসবীরকে আসতে দেখে সকলে নত মস্তকে কুর্নিশ করেন।
শাহাবা তখন জানলার পাশে বসে তাসবীহ পাঠে ব্যস্ত।সূর্যের ফকফকা আলোয় সারাটা কক্ষ আলোকিত।এখানে আসার পর থেকে তিনি নিষ্কর্ম অবসাদে জীবন কাটাচ্ছেন।মাঝে সাঝে ইদ্রীসের সঙ্গে গল্পগুজব করলেও এছাড়া কক্ষের বাইরে যাওয়া তার জন্য সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।যখন দাসীরা আসে তখন তাদের সঙ্গে গল্পের আসর জমান শাহাবা।এই প্রাসাদের দাসীরা বড্ড অমায়িক হয়তো তাসবীরের নির্দেশেই তারা ভালো ব্যবহার করেন সর্বদা।

” আম্মীজান কেমন আছেন?”

তাসবীহ পাঠ বন্দ করে তাসবীরের পানে তাকালেন শাহাবা।বুক চিড়ে বেরিয়ে আসে হতাশার দীর্ঘ নিশ্বাস।

” আলহামদুলিল্লাহ।”

” আপনার এখানে সেবা যত্ন কম হচ্ছে না তো? ”

” শুনো বাবা মনের শান্তি সবচেয়ে বড় শান্তি।যেখানে আমার মনের শান্তি নেই সেখানে এসব সেবা যত্ন আমার মন ফেরাতে পারছে না।আরওয়ার বাবার সাথে আমার দেখা করার ব্যবস্থা করে দাও তাসবীর।তাকে দেখিনা বহু দিন”

” মাফ করবেন আম্মীজান তা আমি পারবো না।একমাত্র ইদ্রীস এবং আপনি ছাড়া কারো প্রতি আমার দয়া কিংবা ভালোবাসা জমে নেই।”

” আরওয়ার প্রতিও না?যে তোমার জান বাঁচিয়েছিল।”

পেছন থেকে ইদ্রীসের কন্ঠে সচকিতে তাকালেন তাসবীর।আরওয়ার নাম মনে পড়তে কলিজাটা যেন ছিড়ে আসে।ইদ্রীস রাশীদ তাচ্ছিল্য হেসে এগিয়ে আসেন তাসবীরের সম্মুখে।

” তুমি বড্ড বেইমান তাসবীর।তোমায় বন্ধু ভেবেছিলাম।”

” রাজ্য দখল করা যদি আমার বেইমানির মতো কাজ হয় তাহলে বলতে হয় অত্যাচারিত প্রজাদের মুক্তি করাও আমার মহৎ কাজ।প্রজাদের সাথে যে বেইমানি করে তার সাথে বেইমানি করতে আমার আফসোস নেই।”

তাসবীরের কথায় মুখ ঘুরিয়ে নিলেন ইদ্রীস।বাইরে থেকে জেদ দেখালেও ভেতরটায় স্বাভাবিক এমনটা হওয়ারি ছিল আজ নয় কাল সম্রাট আব্বাসের পাপের মোচন হতই।তবে মনে একটা প্রশ্ন থেকেই যায় তাসবীর কেন তার পরিচয় আড়াল করেছে।

” তা মানলাম তবে আমার সাথে কেন মিথ্যা বলেছিলে?তুমি সম্রাটের ছেলে।একজন রাজপুত্র অথচ সেই পরিচয় লুকিয়ে রাখলে অন্তত আমার কাছে প্রকাশ করতে পারতে।”

” এ পরিচয়ের প্রকাশ আমি কারো কাছেই করিনি।করার ইচ্ছেও ছিল না।আমি আমার পরিচয়ে গড়ে উঠতে চেয়েছি।পিতার রাজত্বের প্রতি আকর্ষণ আমার কোন কালেই ছিল না।কিন্তু দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে ইদ্রীস তোমার ভাইয়ের নোংরামি আমাকে এ পথে হাটতে বাধ্য করেছে।তুমি যদি আমার বন্ধু না হতে এতদিনে তোমার চামড়া ছিলে রাজ্যের কু/কুরকে দিতাম।”

ইদ্রীস রাশীদ ক্রুদ্ধ হয়ে এগিয়ে গেলেন তাসবীরের নিকট কিন্তু তার আগেই তার হাত ধরে থামিয়ে দিলেন শাহাবা।চোখের জল মুছে তাসবীরের নিকট এগিয়ে যান তিনি।

” তুমি আমায় আম্মীজান ডাক।তোমার উপর আমার একটু হলেও বিশ্বাস বজায় আছে তাসবীর।আমার ইবনুল কী করেছে?সে কেন আরওয়াকে আড়াল করেছ।তুমি কেন আরওয়া হন্য হয়ে খুঁজছো?সবটা আমার ধোঁয়ায় মিলিয়ে যাচ্ছে।তাসবীর আমায় আর দুশ্চিন্তায় রেখো না সত্যটা প্রকাশ করো।”

সম্রাট তাসবীর পেছনে হাত রেখে সারা রুম জুড়ে পাইচারি করলেন।শাহাবা এবং ইদ্রীসের এই অস্থিরতা তার কাছে ভীষণ মজা লাগছে।প্রতিশোধ-পরায়ণা হয়ে উঠলে মানুষের অনুভূতি যে শূন্যের কৌটায় পৌঁছে যায় তা বেশ ভালো ভাবেই বুঝলো তাসবীর।নীরবতা কাটিয়ে তাসবীর একে একে সবটা খুলে বললেন।সম্রাট সাঈদের সঙ্গে আরওয়ার বিয়ের চুক্তিপত্র,আলোর হ/ত্যা কাণ্ড,সম্রাট সিদ্দীকের জীবন মরণের সন্ধিক্ষণ সবটা শুনে থমকে গেলেন শাহাবা।

” আ..আমার ইবনুল এত নোংরা ছিহহ।এ কাজ করার আগে কি তার মাথায় এলো না তার ঘরেও বোন আছে লজ্জায় মাথা কাটা যাচ্ছে আমার।নিজ গর্ভে আমি কুলা/ঙ্গার জন্ম দিলাম।”

সম্রাট তাসবীর তাচ্ছিল্য হাসলেন।চেপে থাকা রাগ জেদ হিংস্রতা আবার বেরিয়ে আসছে।মানসিক শান্তি নামক বিষয়টা তার জীবন থেকে যেন চিরতরে বিদায় নিয়েছে।

” ঠিক এজন্যই,এজন্যই আরওয়াকে খুঁজে বের করবো আমি।আরওয়া’র মাধ্যমেই ইবনুলকে বোঝাবো বোন হারানোর যন্ত্রণা।”

সর্বাঙ্গ শিউরে উঠলো শাহাবার।চোখে যেন অন্ধকার দেখছেন।তিনি চপল পায়ে এগিয়ে এলেন তাসবীরের সম্মুখে।

” বাবা বাবা এসব বলো না।আরওয়ার কোন দোষ ছিল না।তুমি এসব বলো না।আমার একটা মাত্র মেয়ে।”

” আমারো একটা মাত্র বোন ছিল আম্মীজান।”

বড় বড় কদম ফেলে দ্রুত কক্ষ ছেড়ে বেরিয়ে যান তাসবীর।এখানে আর এক মুহূর্ত থাকার ইচ্ছে নেই।

৩৮.
এই সুন্দর রহস্যময় অবনিতে নিজেকে এক তুচ্ছ কন্যা বলে মনে হচ্ছে আরওয়ার।কতটা অভাগী হলে নিজের পিতা মাতার বিপদের সময় হাত গুটিয়ে বসে ছিল সে।সবচেয়ে অপরাধ-বোধ তখনি জাগ্রত হয় যখন ভাবনায় আসে সেদিন তাসবীরকে বাঁচিয়ে দেওয়ার কথা যদি তাসবীরকে সেদিন না রক্ষা করত তবে বিশ্বাসঘাতক তাসবীর এমন জঘন্য অপরাধ করার সুযোগ পেত না।সম্রাট সাঈদের মায়ের কোলে কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন আরওয়া।
এই মেয়েটাকে তিনি বড্ড স্নেহ করেন।যখন যা প্রয়োজন তৎক্ষণাৎ হাজির করেছেন দাস-দাসীরা।গতকাল যখন জানতে পারলো আরওয়ার পিতামাতা মৃত্যু বরণ করেছে তখন যেন মায়া আরো কয়েক ধাপে বেড়ে গেছে।এত অল্প বয়সে পিতামাতা হারানোর শোক একটু হলেও যেন আঁচ করতে পারছিলেন তিনি।আরওয়াকে ঘুমন্ত অবস্থায় নরম তুলোর শিরোধানে মাথা রেখে নিজের কক্ষে চলে যান।কিয়ৎক্ষণ বাদে সম্রাটের খাওয়ার সময় এ সময় তাকে পাশে বসেই থাকতে হবে।খাসদাসী লতা তখন পালঙ্কের এক কোনে পা গুটিয়ে বসে ছিল।আরওয়ার ঘুমের মাঝে হাসি হাসি মুখ দেখে কিঞ্চিৎ অবাক হয় সে।লতা সন্দিহান চোখে আরওয়ার গায়ে হাত রাখতে ধড়ফড়িয়ে উঠে বসেন তিনি।অকস্মাৎ ঘুম ভাঙ্গায় তিনি যেন স্বপ্নের ঘোরেই পড়ে ছিলেন।চারিদিকে চোখ বুলিয়ে ছটফটিয়ে বলেন,

” তাসবীর কই?তাসবীর এই তাসবীর আমি সেজেছিলাম আপনি কোথায় আসুন আমার সামনে আসুন।”

আরওয়ার মুখে তাসবীরের নাম শুনতে অবাক হয় লতা।তাসবীরের প্রতি যে অসীম ঘৃণা জন্মেছে তা বেশ ভালো ভাবেই বুঝেছে লতা তবে হঠাৎ এসব কি বলছেন আরওয়া?তাসবীরের জন্য সেজেছেন মানে কি।ক্ষিপ্র চরণে পিতলের দরজা দ্রুত বন্ধ করে লতা এবং ছটফটানো আরওয়ার নিকট দাঁড়িয়ে প্রশ্ন ছুড়ে।

” তাসবীর কে খুঁজছেন কেন আরওয়া?ভুলে গেলেন আপনাকে এতিম করেছে সে।”

লহমায় নিশ্চুপ হয়ে যান আরওয়া।চোখে ভাসা নেত্র বারি মুছে দেন এক নিমিষে।

” আমি বড্ড ভুল করে ফেলেছি লতা।মন দেওয়া নেওয়ার মতো পাপ না করাই শ্রেয়।মনে আর শান্তি বেঁচে রয় না রে। যদি এই পাপ না করতাম তাহলে এতবড় ভুল হতই না।”

লতা ভ্রু কুঁচকালো মন দেওয়া নেওয়া মানে কি?কিসব বলছেন শেহজাদী।

” আমি আপনার কথা কিছুতেই বুঝতে পারছি না।”

” আ..আমি বাঁচতে চাই।বাঁচতে চাইরে লতা এভাবে মনে কথা চেপে রেখে দিন দিন উন্মাদে পরিণত হচ্ছি।”

শেহজাদীর উত্তেজিত মুখখানি দেখে আগলে নেন লতা।মাথায় হাত বুলিয়ে স্থির থাকতে বলেন শেহজাদীকে।

” কি হয়েছে আমায় বলুন শেহজাদী।এখানে আপনার বিশ্বস্ত আমি ছাড়া আর কেউ নেই।”

” তার আগে বল কাউকে বলবে না কথা দাও।”

” অবশ্যই কাউকে না।আপনি নিশ্চিন্ত মনে আমায় বিশ্বাস করতে পারেন।”

শেহজাদী বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ রইলেন।বলবে কি বলবে না ভেবে ক্রমশ অস্থিরতা বাড়ছিল।একটা সময় না পেরে উঠে লতাকে সবটা সত্য প্রকাশ করেন।তাসবীর আর তার প্রণয়ের পরিণতি এরপর কি হতে পারে ভেবে কুল পায় না লতা।এই মুহূর্তে চুপচাপ থাকাই শ্রেয় ভেবে সে পালঙ্কে বসে তাকিয়ে রইলো শেহজাদীর ক্রদনরত মুখের পানে।

৪০.
দ্বিপ্রহর সময়টা থেকে সম্রাট সিদ্দীকের স্ত্রী বিনিতার মনটা আজ বেশ ভালো।কবিরাজ মশাইয়ের অক্লান্ত পরিশ্রমে সম্রাট সিদ্দীক ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠছেন।আজ হঠাৎ চোখ খুলে আধো আধো বুলি ফুটিয়েছেন মুখে।সম্রাট সিদ্দীকের সুস্থতার খুশিতে চোখের কোল বেয়ে অশ্রু ঝরছিলো তার মনে মনে আল্লাহর দরবারে বেশ কয়েকবার শুকরিয়া আদায় করেছেন।আরওয়ার পিতামাতার আহমেদাবাদ প্রাসাদে এসেছে বেশ কিছুদিন হলো ব্যস্ততার অজুহাতে একবারো দেখা হয়নি তাদের সাথে।হাতের কাজ সেরে শাহাবার কক্ষের উদ্দেশ্য পা বাড়ায় বিনিতা।দরজার দ্বারে থাকা দ্বার রক্ষীরা নত মস্তকে কুর্নিশ জানান বিনিতাকে।শাহাবা তখন পালঙ্কে পিঠ ঠেকিয়ে ভাবনা চিন্তায় মগ্ন।

” আসসালামু আলাইকুম ভালো আছেন আপা?”

অপরিচিত কন্ঠে চমকে তাকান শাহাবা।দ্বারে দাঁড়িয়ে থাকা অর্ধ বয়স্ক মহিলাটিকে দেখেন খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে।জনৈক মহিলার রাজকীয় পোষাকে খানিকটা হলেও আঁচ কর‍তে পেরেছেন ইনি সম্রাট তাসবীরের মা।

” আপনি সম্রাট তাসবীরের মা হন?”

” জি আমার একমাত্র ছেলে তাসবীর।এখানে আসার পর থেকে আপনার সঙ্গে আলাপচারিতা হয়ে উঠেনি আসলে তাসবীরের পিতার শরীরটা ভালো নেই আজকে একটু ভালো দেখলাম তাই মন মেজাজ ভালো ভাবলাম আপনার সঙ্গে দেখা সাক্ষাৎ করে আসি।”

তাসবীরের মায়ের পরিচয় পেয়ে সুযোগটা কাজে লাগালেন শাহাবা।দ্রুত পায়ে পালঙ্ক ছেড়ে এগিয়ে এসে ধরলেন সম্রাজ্ঞী বিনিতার হস্ত।দু’চোখে তখন ঝাঁপিয়ে নেমেছে অশ্রুজল।সম্রাজ্ঞী বিনিতা তখন কাছ থেকে মহিলাটিকে দেখলেন।ফর্সা মুখশ্রী শুকিয়ে বড্ড করুন লাগছে।গলায় থাকা মণিমুক্তার হার অযত্নে এলিয়ে আছে একদিকে।

” আপা আমার মেয়েটাকে বাঁচান একমাত্র আপনি পারবেন আমার মেয়েটাকে বাঁচাতে।”

” আপনার মেয়ে আরওয়া?”
” হ..হ্যাঁ হ্যাঁ আরওয়া আমার একমাত্র মেয়ে।আপনার কন্যা আলোর হ/ত্যাকারী আমার ছেলে ইবনুল সে কথা নিশ্চয়ই জানেন।”

মুহূর্তে সম্রাজ্ঞী বিনিতার মুখে আঁধার নেমেছে।ভ্রু কুচকে তাকালেন ত্যাজ নিয়ে।এত সুন্দর অপসরীর ঘরে কি না এমন কুলাঙ্গারের জন্ম।ভাবতেই হতাশার শ্বাস ছাড়লেন।ভেতরের রাগ আর বাইরে প্রকাশ করলেন না, সম্রাজ্ঞী বিনিতা নিজেকে দমিয়ে রাখলেন যা হবার হয়েছে আল্লাহ তার যোগ্য জবাব দেবে জালিম ইবনুলকে।

” হুম জানি।”

” আমার ছেলের প্রতি আমার বিশ্বাস নেই আমি জানি সে ব/র্বর তার পিতা এবং পিতামহের থেকেও বেশি উৎপীড়ক।আমার ভাবতেও অপমানবোধ হয় এমন ছেলের মা আমি।সে যা করেছে তার যোগ্য জবাব পাবে সে।কিন্তু এসবের মাঝে আমার মেয়েটার কোন দোষ নেই আপা আপনি আমার মেয়েটাকে বাঁচান।”

” আরওয়ার কি হয়েছে?শুনলাম তাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।”

” তাসবীর বলেছে আলোর হ/ত্যার প্রতিশো/ধ নেবে আরওয়ার মাধ্যমে।আরওয়ার মৃত্যুতে ইবনুল এবং সম্রাট আব্বাসকে বুঝিয়ে দেবেন আপনজন হারানোর তীব্র যন্ত্রণা।”

লহমায় ক্রদনরত অবস্থায় সম্রাজ্ঞীর বিনিতার পায়ের কাছে বসে পড়েন শাহাবা।লজ্জায় দু’কদম পিছিয়ে যান সম্রাজ্ঞী।

” ছি ছি আপনি কি করছেন।”

” আমার কন্যা’কে বাঁচান।যদি তাসবীরের হাত থেকে আমার কন্যাকে রক্ষা করতে পারেন সারাটা জীবন আপনার খাসদাসী হয়ে থাকবো।”

” আপা ছি ছি এসব বলবেন না উঠুন।দয়া করে উঠুন আমি বেঁচে থাকতে আরওয়ার কোন ক্ষতি হবে না।”
.

এতদিন সম্রাজ্ঞী বিনিতা নিশ্চুপ তাসবীরের কাণ্ড কর্ম দেখেছেন।সিংহাসনে বসার পর থেকে তাসবীরের কোন কাণ্ডে হস্তক্ষেপ করেননি আর কখনো করবেন না।তিনি জানেন অন্তত তার ছেলে কখনো কোন অন্যয় কাজ করবে না।কিন্তু শাহাবার মুখ থেকে যা শুনলেন নিজের কানকেও বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে।যাকে স্ত্রীর মর্যাদায় ঘরে তুলতে চেয়েছিল তাকে নিয়ে এত নোংরা ভাবনা চিন্তা তাসবীরের মাঝে আসে কি করে?

অলিন্দে বসে ছবি আঁকছিলেন সম্রাট তাসবীর।একটি মেয়ের দীর্ঘল কেশের ছবি ফুটিয়ে তুলেছেন মেয়েটির দীঘল কেশ ঘাসের চাদরে বিছিয়ে আছে আর সেই চুলে হরেক রঙের ফুল।কক্ষে কারো উপস্থিত পেয়ে সর্তক দৃষ্টিতে চারিপাশে তাকান।অনুমান সঠিক ভেবে দ্রুত হস্তে লাল রেশমি কাপড়ে ঢেকে দেন ছবিটি।

ততক্ষণে অলিন্দে সম্রাজ্ঞী বিনিতা উপস্থিত।

” মা আপনি! আসনে বসুন।”

” কিছু কথা ছিল।আশা করি স্পষ্ট জাবাব দেবে।”

” অবশ্যই।বলুন।”

” আরওয়াকে বিয়ে করতে চাইছিলে এখনো কি করতে চাও?”

সম্রাজ্ঞী বিনিতার প্রশ্নে গভীর ভাবনায় পড়লেন তাসবীর।নিজের জেদ বজায় রেখে বলেন,

” একটা সময় চেয়েছি এখন আর না।”

” আলোর হ/ত্যার প্রতিশোধ কি আরওয়ার মাধ্যমে নিতে চাও?”

” আলোর মৃ/ত দেহ আমি ভুলতে পারি না ঘুমের মাঝেও তার প্রতিবিম্ব ভেসে উঠে।যতদিন না বোন হারানোর যন্ত্রণা ইবনুল রাশীদকে বোঝাতে পারছি আমার শান্তি নেই।”

তাসবীর শেষোক্ত কথা গায়ে ঝংকার তুললো সম্রাজ্ঞী শাহাবার।জন্মের পর থেকে যে ছেলের গায়ে কোন আঁচ লাগতে দেননি আজ সেই ছেলের গালে সশব্দে চপেটাঘাত করলেন।তাসবীর স্তম্ভিত,হতভম্ব।

” তোমার বাবা আমায় একদিন একটা কথা বলেছেন তিনি গর্ব নিয়ে বলেছেন আমাদের একমাত্র সন্তান তাকে কখনো আঘাত করবেনা বিনিতা।দেখবে সে পিতামহ এবং পিতার আদর্শে সে বড় হবে।আমাদের ছেলে জেনে বুঝে কোনদিন কোন ভুল করবে না।আর সেই তুমি বুঝার বয়সে অবুঝের মতো কাজ করছিলে।রাজ্যের প্রতি তোমার উদাসীনতা তা নিয়ে কোন দিন তোমার পিতা মনঃক্ষুণ্ণ হয়নি।তিনি সবসময় বলেছেন আমার ছেলের ইচ্ছের বিরুদ্ধে আমি তাকে জোর করবো না। আর সেই তুমি তোমার পিতার আদর্শে দাগ লাগালে তাসবীর।”

” আমি কি করেছি মা?আমি জানি আমি কোন ভুল করিনি।”

” ভুল করেছো তুমি।একদিন আরওয়াকে স্ত্রীর মর্যাদা দিয়ে এই রাজমহলে তোলার ইচ্ছা পোষণ করেছিলে।তোমার পিতা তোমার চাওয়াকে প্রাধান্য দিয়েছেন।অলকপুরীর সম্রাট আব্বাসের প্রতি ঘৃণা জন্মালেও তার কন্যাকে তিনি পুত্রবধূ হিসেবে গ্রহণ করতে চেয়েছিল।সবচেয়ে বড় কথা আরওয়াকে তুমি ভালোবাসো যাকে ভালোবাসো তাকে নিয়ে নোংরা চিন্তা ভাবনা তোমার মাথায় আসলো কি করে?তাহলে ইবনুল আর তোমার মাঝে কোন তফাত রইবে না।”

” মা এসবের মাঝে ভালোবাসা টেনে…”

” চুপ কোন কথা বলবে না তুমি।সম্রাট আব্বাস ভুল করেছেন তার শাস্তি তিনি পাবেন।জঘন্য পাপ ইবনুল করেছে তার শাস্তিও সে পাবে।তুমি শাস্তি দেওয়ার কেউ নয়।এই রহস্যঘেরা ধরণি’র মালিক যিনি তিনি উত্তম শাস্তি প্রদান করবেন।”

” কিন্তু মা..”

” কোন কথা নয় তাসবীর।তোমার প্রতি আমার বিশ্বাসের দেয়াল ভেঙ্গে গেছে এমন জঘন্য সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে তোমার বুক কাঁপলো না?আমি বলছি তুমি আরওয়াকে খুঁজে বের করবে এবং তোমাদের বিয়ে আমি নিজে দায়িত্ব নিয়ে দেব।এরপর থেকে তোমার মাধ্যমে আরওয়া যদি কোন দিন কষ্ট পায় অসন্তুষ্ট হয় তবে আমি ভুলে যাব আমার একমাত্র ছেলের কথা।”

সম্রাজ্ঞী বিনিতার চোখের কোণে পানি তা সম্পূর্ণ আড়াল করে বেরিয়ে যান কক্ষ ছেড়ে।হঠাৎ দমকা বাতাসে শিউরে উঠে সম্রাট তাসবীরের গাত্র এই সময়টা কেমন যেন ছিল সারা শরীরটা নেতিয়ে পড়ছিল ক্রমশ। দমকা বাতাসের স্থির নেই সে তার দাপট নিয়ে উড়িয়ে দিচ্ছে সবকিছু।লাল রেশমি কাপড়ে আড়াল করা ছবিটি লহমায় সাদৃশ্য হয় তাসবীরের চোখে।তাসবীর দু’হাতে বুলিয়ে দেয় ছবিটিতে।

” আমার কেশবতী এই দীঘল চুলে আবার ফুলেরা হাসবে লজ্জায় নুইয়ে পড়া মুখকমল দেখে আমি বলবো মারহাবা মারহাবা!”

আদৌ তাসবীরের স্বপ্ন সত্যি হবে কী না কে জানে নাকি তার আগেই সম্রাট সাঈদের পাঁজরে বাধা পড়বেন আরওয়া!#বিধুর_রজনী
#পলি_আনান
[পর্ব সংখ্যা ১৯]
৪১.
হরিৎ বনের পাশ ঘেঁষে যাওয়া নদীটির দিকে কূলে বসে আছেন সম্রাট তাসবীর।নদীর কূলে শুকনো গাছের পাটাতনে বসে জলের কলকল ধ্বনি শুনতে তার কাছে মন্দ লাগছে না।ঘন জঙ্গল ঘিরে আছে অসংখ্য পাখির দল।নাম না জানা পাখিগুলোর কিচিরমিচির শব্দে কানটা যেন বিবশ হয়ে আসছে।পাখপাখালিদের কলরব সুনসান নির্জীব মানুষ-হীন এই ঘন জঙ্গল বেশ পছন্দ করলেন সম্রাট।
আরওয়ার পরিচিত বৈরাগীর বাস এই বনে।অবশ্য আরওয়ার একার নয় সম্রাট তাসবীরের সাথেও সেই বৈরাগীর ভাব।কিয়ৎক্ষণ আগে বৈরাগীর সঙ্গে দেখা সাক্ষাৎ করে ফিরেছেন তাসবীর।এর পেছনে অবশ্য একটা উদ্দেশ্য আছে আর তা হলো আরওয়া।আরওয়া যদি ছলচাতুরী করে বৈরাগীর কাছে ঘাপটি মে/রে থাকে।সম্রাট তাসবীরের সন্দেহের ফলাফল শূন্য।আরওয়া এখানে নেই বৈরাগী একাই আছে এই বনে।অলকপুরী রাজ্যে বর্তমানে দায়িত্বজ্ঞানে আছে উজির হাযম।সম্রাট তাসবীরের নির্দেশ মোতাবেক প্রাসাদের রাজকার্য তিনি তত্ত্বাবধান করছেন।

ছুটন্ত ঘোড়ার পায়ের টগবগ আওয়াজে সর্তক দৃষ্টিতে চোখ ফেলেন সৈন্যরা।হাতে থাকা তরবারি বের করে সম্রাটকে ঘিরে নেয় সকলে।সম্রাট তাসবীরের তাতে কোন হেলদোল নেই তিনি দিব্যি চেয়ে আছেন নদীর স্বচ্ছ জলে।নিশ্চিত মনে সম্রাট তাসবীর বলেন,

” উত্তেজিত হবেন না সৈন্যদল।উজির হাযমের দলবল আসছে হয়তো।”

” না না সর্তক থাকা ভালো সম্রাট বলা তো যায় না কখন বিপদ ওত পেতে থাকে।”

উজির আতেফের কথায় বিগলিত হাসলেন সম্রাট।পাশে বসে থাকা সভাকবি কেমন যেন ঘামছেন।বিষয়টা আঁচ করতে সময় লাগলো না তাসবীরের।

” সভাকবি মশাই ভালো আছেন?”

” আমার সম্রাট ভালো থাকলে আমি ভালো।”

চমৎকার হাসলেন তাসবীর।মানুষটা ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে ঘামছেন অথচ বলছেন তিনি ভালো।ঘোড়ার শব্দ ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পেতে চলেছে এর মাঝে সম্রাট সভাকবিকে বলেন,

” আপনার মধুর কন্ঠে একটি কবিতা বলুন আমি শুনতে চাই।”

” ক…কবিতা এখন যে আমার গলায় কবিতার চরণ আসবে না সম্রাট।”

” কিন্তু কেন?”

ভ্রু যুগল কুচকে নিলেন সম্রাট।কথার ঝুড়ি মেলার আগেই তাদের সম্মুখে এসে হাজির হন উজির হাযম এবং তার সৈন্যদল।অপর পক্ষের উজির আতেফের নির্দেশে সবাই তরবারি সরিয়ে নেয়।উজির হাযম সম্রাটের সম্মুখে দাঁড়ালেন নত মস্তকে কুর্নিশ জানিয়ে বলেন,

” সম্রাটের আদেশ পেলে তার হস্তে চুম্বন করিতে চাই।”

” অনুমতি দিলাম।”

সম্রাট তাসবীরে হাত আঁকড়ে ধরে চুম্বন করলেন উজির হাযম।সম্রাটের নির্দেশে তার পাশের একটি ম/রা গাছের কাঠে বসলেন।

” রাজকার্য কেমন চলছে উজির মশাই?”

” আপনার দোয়ায় সবটা আলহামদুলিল্লাহ।প্রজারা অন্তত সন্তুষ্ট।বহুকাল পর প্রজারা সজীব শ্বাস নিয়ে বাঁচতে পারছে সম্রাট।”

” প্রজার খুশি মানে আমার খুশি আমার ভালো থাকা।”

” ইবনুল রাশীদের খোঁজ পেয়েছেন সম্রাট?”

” না পাইনি।তাদের দখলে থাকা যত রাজ্যে আছে সবটা আমি দখল করে নিয়েছি।এবার ইবনুল রাশীদ মুখ থুবড়ে পড়েছে সাহস নিয়ে ফেরার আর দম নেই।”

“শাহজাদা মেসবাহ ওত পেতে আছেন যেখানে পাবেন গর্দান নিয়ে নেবে তার।একমাত্র সম্রাট সাঈদ, আব্বাস রাশীদ আর ইবনুল রাশীদের পা চাটতে ব্যস্ত। ”

” সম্রাট সাঈদের সিংহাসন আরোহণ নিয়ে আমার পিতার অবদান সবচেয়ে বেশি।সৈন্যসমান্ত কামান গোলা সব দিয়ে সাহায্য করেছিল তাকে।অথচ শেষ পর্যায়ে নারীর লোভে আমাদের পিঠেই তরবারি চালিয়েছে।”

” তিনি আমাদের প্রাক্তন শেহজাদীর প্রতি অত্যন্ত দুর্বল।আর দুর্বলতায় তাকে গ্রাস করে এমন বিশ্বাসঘাতকতার কাজে নেমেছেন।”

ভেতরটা জ্বলে উঠলো তাসবীরের।আরওয়ার প্রতি অন্য পুরুষের আসক্তি তিনি যেন সহজে মেনে নিতে পারছেন না এই বিষয়।নিজেকে স্থির রেখে নরম গলায় বলেন,

” আরওয়া কোথায় থাকতে পারে?এই বিষয়ে উজির মশাই আপনি ছাড়া আর কেউ ভালো জানবেন না।”

” সেদিন মেসবাহ’র দূত এসে পত্র দিয়ে যায় তারপর থেকেই আমি শাহজাদা ইবনুল এবং সম্রাট আব্বাসের মাঝে অস্থিরতা দেখেছি এরপর দিন সকাল থেকে শেহজাদী নেই।এ বিষয়টা নিয়ে ইদ্রীস রাশীদ এবং বেগম ইবনুল রাশীদের সাথে অনেক বার তর্কবিতর্কে জড়িয়েছেন তাতে হয়তো কোন উত্তর মেলেনি।”

” তার মানে সম্রাট আব্বাস সবটা জানেন?”

” আলবাৎ জানেন।আব্বাস রাশীদ আর ইবনুল রাশীদ এক ঘাটে জল খায়।তবে কিছু কাজ ইবনুল রাশীদ সর্বদা আড়াল করে যেতেন সম্রাটের নিকট হতে যেমন দূর্গে সেদিন মেয়েটাকে হ/ত্যা,আপনার বোনের সঙ্গে জ/ঘ/ন্য পাপাচার।এসব কখনই পছন্দ করতে না সম্রাট আব্বাস নারীদের প্রতি তার লোভ লালসা তেমন নেই কিন্তু ইবনুল রাশীদ নারীদের কখনো সম্মানের চোখে দেখেন’নি সর্বদা ভোগের চোখে দেখেছেন।”

তাসবীর চিন্তিত ভঙ্গিমায় মাথা দুলালেন।এই পর্যায়ে কোন পদক্ষেপ নেওয়া যায় সে বিষয়ে বড্ড চিন্তায় পড়েছেন।

” তাহলে আব্বাস’কে আবার জিজ্ঞেসবাদ করা উচিত আরওয়া কোথায়?”

” অবশ্যই সম্রাট।আরওয়ার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত ইবনুল রাশীদ কখনোই একা নেবেন না।যা করার দু’জনে মিলে করেছে।”

উজির হাযমের দৃঢ় সম্মতি পেয়ে দাঁড়িয়ে পড়লেন সম্রাট তাসবীর।আর এক মুহূর্ত দেরি করা যাবে না এক্ষুনি প্রাসাদে ফিরতে হবে আরওয়ার খোঁজ না পাওয়া পর্যন্ত স্বস্তি নেই।
৪২.
আহমেদাবাদ রাজ্যের কারাগৃহ একটু অদ্ভুত।এখানে প্রবেশ করলেই সমস্ত গাত্র সর্বাঙ্গ শিউরে উঠে।কেমন যেন গা গুলিয়ে আসে।সিদ্দীক ছিলেন একজন দয়াবান সম্রাট অল্পস্বল্প ভুল তিনি সামান্য শা/স্তিতেই ক্ষমা করতেন।যখন কারো অন্যায় তার সহ্যর সীমানা অতিক্রম করে তখনি তিনি হয়ে উঠেন হিংস্র থেকে হিংস্রতর।সোপান বেয়ে নিচে নামলেন সেনাপ্রধান,উজির এবং সম্রাট তাসবীর।কারাগৃহ তাদের পাতালেই অবস্থিত।চারিদিকে দেয়ালে সজ্জিত মৃত মানুষের মাথার খুলি,হাড়।মাটির দেয়ালে মশাল জ্বলছে যার মাধ্যমে অন্ধকার পাতাল বেশ আলোকিত হয়ে আছে।কারাগৃহে এখনো বন্দি দশায় আছেন অনেকেই।তাদের দিকে ঘুরেও তাকালেন না তাসবীর।তিনি সোজা-সাপটা হেটে প্রবেশ করে সম্রাট আব্বাসের কামরায়।মেঝেতে থাকা খড়ের মাঝে বসে ছিলেন আব্বাস তাসবীরকে দেখে ধড়ফড়িয়ে উঠে বসেন তিনি।

” কেমন আছেন পরাজিত নৃপতি?”

” এখানে কেন এসেছো?আমার পুত্র, বেগম কোথায়?তারা কেমন আছে?”

” এসব প্রশ্নের জবাব দিতে আমি আসিনি।আমি যা জানতে চাইছি তা সোজা-সাপটা বলুন আরওয়া কোথায়?”

” আমি জানি না।”

” ভালো।বেশ ভালো।”

ওষ্ঠ-কোণে হাসি রেখে শেষ শেষোক্ত কথাটি বললেন তাসবীর।সম্রাট আব্বাস হাতের দিকে মাথা হেলে তাকালেন তিনি।মানুষটার হাতের পাঁচ আঙুল কাপড় দিয়ে বাঁধা আছে।কয়েকদিন আগেই সেনাপ্রধান রউফ সবকটা নখ টেনে টেনে তুলে নিয়েছেন সেই দৃশ্য যদি স্বচক্ষে তাসবীর দেখতে পেত তবে হয়তো মনের জ্বালা কিঞ্চিৎ হলেও মিটতো।

” আজ আর বেশি কথা হবে না আজ যা হবে সব সোজাসুজি কাজে দেখানো হবে।দেয়ালে থাকা হাড়,মাথার খুলি দেখছেন?ভেবে নিন এইভাবে আপনাকে আজ ঝুলিয়ে দেওয়া হবে।তাই ভালো ভাবে বলছি আরওয়ার খোঁজ আমাদের দিন।”

” বললাম তো জানি না।ইবনুল ছাড়া কেউ জানেন না।”

” সত্যি কি তাই?”

” হ্যাঁ তাই।”

তাসবীর নিশ্চুপ চোখের ইশারায় সেনাপ্রধান রউফকে কিছু ইশারা করলেন।তৎক্ষণাৎ তিনি হাতের তরবারি দিয়ে সম্রাট আব্বাসের ডান বাহুতে পোঁচ দিলেন।অন্য একজন সৈন্য লবণ পানি সিঞ্চন করলেন ক্ষত স্থানে।তীব্র জ্বালা,যন্ত্রণায় ছটফটিয়ে উঠেন সম্রাট আব্বাস।তার চিৎকার আহাজারি সমস্ত পাতালঘর কাঁপিয়ে তুলছে।অথচ তাসবীর নিশ্চুপ সে কাণ্ড দেখছেন। এভাবে চলতে থাকে বেশ কিছুক্ষণ।সম্রাট আব্বাসের পরিহিত সাদা পোশাক র/ক্তে লাল বর্ণ ধারণ করেছে।এভাবে চলতে চলতে বেশ কিছুক্ষণ পর সহ্যর সীমানা পেরিয়ে সম্রাট আব্বাস তাসবীরের দু’চরণ জড়িয়ে ধরে,

” আর নয় আর নয় সহ্য হচ্ছে না।ওদের থামতে বলো।”

” আরওয়া কোথায়?”

” সম্রাট সাঈদের কাছে আছে।মেসবাহ’র ভ..ভয়ে ইবনুল তাকে পাঠিয়ে দিয়েছে তেলিকোনা রাজ্যে।”

চোখ বন্ধ করে তপ্ত শ্বাস ছাড়লেন সম্রাট তাসবীর।উজির আতেফকে নির্দেশ করেন কবিরাজ মশাইকে ডেকে যেন সম্রাট আব্বাসের চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়।
.
রাজসভা বসেছে সেখানে সম্রাট তাসবীর উপস্থিত।চারিদিকে ভৃত-গন উন্মুখ হয়ে তাকিয়ে আছেন সম্রাটের পানে।গুরুত্বপূর্ণ আদেশ জারি করবেন তিনি।ইতোমধ্যে উজির এবং সেনাপ্রধান বুঝে ফেলেছেন সম্রাট তাসবীর কি আদেশ করতে চলেছে।নিজের বুদ্ধি কাজে লাগিয়ে উত্তম পরিকল্পনায় সিদ্ধান্ত নেন আজ রাত্রিরে তেলিকোনা রাজ্য দখলে যাবে আহমেদাবাদের সম্রাট তাসবীর।যত সৈন্যসামান্তর,কামান গোলা,তীরন্দাজ যেন প্রস্তুত থাকে এবারের যু/দ্ধ জয় হওয়া আগের বারের তুলনায় বেশ কঠিন।সেনাপ্রধান রউফ সর্তক হলেন নিজের সর্বোচ্চ দিয়ে সৈন্যদের উত্তম প্রস্তুতি দেওয়ার ব্যবস্থা করলেন।
৪৩.
ঘুমন্ত দু’চোখের পাতা আচম্বিতে নড়ে উঠে সূর্যালাকে উপচে এসে আরওয়ার দু’চোখ স্পর্শ করতে।মাথার টনটন ব্যথায় দুই হাতের সাহায্যে দ্রুত চেপে ধরেন।কয়েক পল তাকাতে দুর্বল গলায় ডেকে উঠেন লতাকে।কিন্তু কক্ষে যে লতা নেই তা বেশ ভালোভাবেই বুঝতে পারছেন তিনি।লতার উপস্থিতি এ কক্ষে থাকলে এতক্ষণে মেয়েটা নিশ্চয়ই ছুটে আসতো তার কাছে।গতকাল থেকেই জ্বরাক্রান্ত শেহজাদী।কবিরাজ মশাইয়ের পথ্যে কোন কাজে আসলো না।জ্বর কমার পরিবর্তে ধীরে ধীরে যেন বাড়লো।সারাটা রাত চেতনাহীন ছিলেন তিনি। তীব্র জ্বরে তার শিউরে যে সারাটা রাত সম্রাট সাঈদ এবং তার মাতা উপস্থিত ছিলেন সে বিষয়ে আরওয়া এখনো অবগত নয়।সম্রাট সাঈদ আরওয়াকে ছেড়ে বেরিয়ে যান প্রত্যুষে যখন খবর আসে আহমেদাবাদ রাজ্যে থেকে আক্রমণের ইঙ্গিত এসেছে এবং তারা অতিদ্রুত রাজ্যের দ্বারে উপস্থিত।নয় ছয় না ভেবে সম্রাট সাঈদ তখন নিজের সর্বোচ্চ দিয়ে যু/দ্ধের প্রস্তুতি নেন।এক মুহূর্তের জন্য ভুলে গেছেন আরওয়ার কথা বর্তমানে একটাই চিন্তা এই রাজ্য তাকে বাঁচাতেই হবে এবারের মতো যদি রাজ্য হারা হয় তবে সারাটা জীবন সম্রাট তাসবীরের কারাগৃহে পচে ম/র/তে হবে।

বাইরে কামানের গোলার শব্দে কেঁপে উঠলেন শেহজাদী।পালঙ্ক ছেড়ে পা মেঝেতে রাখার মতো শক্তি তার কাছে অবশিষ্ট নেই।জ্বরের ঘোরে মা মা শব্দে কেঁদে উঠলেন তৎক্ষণাৎ।এই মুহূর্তে শাহাবাকে ভীষণ মনে পড়ছে বাইরে কি হচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছেন না তিনি। লতা কোথায়?লতা মেয়েটা তাকে একা করে কোথায় গেল।

পিতলের দ্বার ঠেলে তখন ছুটে কক্ষে উপস্থিত হয় লতা।দ্রুত পিতলের দ্বার রুদ্ধ করে এগিয়ে আসেন শেহজাদীর কাছে।

” পালিয়ে জান শেহজাদী এখানে আর এক মুহূর্তে ও আপনি নিরাপদ নয়।”

” ক..কেন?”
” সম্রাট তাসবীরের সৈন্যরা যাকে যেখানে পাচ্ছে হ/ত্যা করছে।ধীরে ধীরে সমস্ত দাস-দাসী প্রহরীরা তাদের কাছে বন্দি হয়ে গেছে।সম্রাট সাঈদ এখনো যু/দ্ধ চালিয়ে যাচ্ছেন তার পরিবারকে বন্দি করা হয়েছে।প্রাসাদ ছেড়ে এবার মহলে প্রবেশ করছে সৈন্যরা।আপনাকে পেলে জানে মে/রে ফেলবে সম্রাট তাসবীর , আপনি পালিয়ে যান শেহজাদী।”

” আমি আর বেঁচে থেকে কি হবে লতা?আমার পরিবারকে হত্যা করেছে আমি আর বেঁচে থেকে কি হবে?”

” এসব আমি শুনতে চাই না আপনাকে বাঁচতে হবে শেহজাদী আপনি পালিয়ে যান।”

মাথা তুলে বসতে চাইলে গা গুলিয়ে উঠলো শেহজাদীর।লতা তাকে তুলতে সাহায্য করলে লাভের লাভ কিছুই হলো না।ক্রমশ নেতিতে পড়ছেন শেহজাদী।তীব্র জ্বরে দুই চোখ কেমন রক্তিমভাব ধারণ করেছে।ফর্সা মুখশ্রী পাংশুবর্ণ ধারণ করেছে।শেহজাদীর শারীরিক অবস্থার অবনতি দেখে হু হু শব্দে কেঁদে উঠলো লতা।তার দেহে প্রাণ থাকতে আসন্ন বিপদে কিছুতেই ফেলবে না সে শেহজাদীকে।

” আপনি উঠুন শেহজাদী আপনাকে বাঁচতে হবে পালাতে হবে।”

” ত…তু..মি চ…চলে যা..ও ল.. তা।ভেবে নাও আমার মি..মিথ্যা…ভা..ভালোবাসার মূল্য দিচ্ছি।”

” আমি আপনাকে ছেড়ে কোথাও যাব না আপনাকে পালাতে হবে।যে করে হোক পালিয়ে যান শেহজাদী।”

” যার জন্য এত কৌশল, কসরত যু/দ্ধ সে যদি পালিয়ে যায় তবে তা মানা যায় না লতা।”

পিতলের দ্বার আচম্বিতে বেশ শব্দ নিয়ে খুলে গেল।রাজকীয় পোষাকে সম্রাট তাসবীরকে দেখে কেঁপে উঠলো লতা।মানুষটার সারা শরীরে তাজা র/ক্তের দাগ।ওষ্ঠের কোণে লেগে আছে এক চিলতে হাসি।

শেহজাদীর নরম দেহখানি আগলে ধরলো লতা।জ্বরের কারণে সমস্ত কায়া যেন উত্তপ্ত লাভা ছড়াচ্ছে।লতার গলা আঁকড়ে ধরলেন শেহজাদী।ভেজা চোখে তাসবীরের পাণে একবার তাকিয়ে সরিয়ে দিলেন দৃষ্টি।আরওয়ার ঘৃণা মিশ্রিত চাহনী বুঝতে সময় লাগলো না তাসবীরের।অথচ এই চোখ একটা সময় ছিল অসীম ভালোবাসা।

” ভালো বেশ ভালো।এইজন্য লতা আপনাকে ভরসা করি।শেহজাদীর খাসদাসী হিসেবে আপনি উত্তম।শেহজাদীকে যে ভাবে আগলে নিলেন এর মানে সহজেই বোঝা যায় আপনার জান থাকতে আপনি আপনার মনিবের কিচ্ছু হতে দেবেন না।কিন্তু এখন আপনার মনিবের আসল মানুষ এসে গেছে তাকে আমার হাতে নিশ্চিন্তে তুলে দিন।”

“এ দেহে প্রাণ থাকতে না।শেহজাদী আপনার কাছে নিরাপদ নয়।”

” কার কাছে শেহজাদী নিরাপদ তা দেখার দায়িত্ব আমার।শেহজাদী এখন আমার সাথে যাবে”

সম্রাট তাসবীর হিসহিসিয়ে কথাটি বলে এগিয়ে এলেন পালঙ্কের কাছে।তীব্র ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে গেলেন শেহজাদী।লতাকে শক্তপোক্ত হাতে ধরে বলেন,

” ওনাকে চলে যেত বলো লতা।ম/রে যাব তবুও ওনার সাথে যাব না।”

ঘর কাঁপিয়ে হেসে উঠলেন তাসবীর।এগিয়ে এলেন পালঙ্কের কাছে।ততক্ষণে একজন সৈন্য এসে হাজির দ্বারের সম্মুখে।

” সৈন্য ওনাকে নিয়ে যাও।”

লতাকে ইশারা করে আদেশ স্বরে বলে উঠেন তাসবীর।সৈন্য এগিয়ে এসে লতার গলায় তরবারি ধরলেন।সেই সুযোগে শেহজাদীর হাত টেনে ছিটকে সরিয়ে আনলেন তাসবীর।লতাকে নিয়ে সৈন্য বেরিয়ে যেতে উদ্যত হলে তাসবীর হুংকার ছেড়ে বলেন,

” খবরদার লতার আগে যেন কোন আঁচড় না লাগে।অতি সাবধানে তাকে নিয়ে যাবে সাবধান আবার যেন পালিয়ে না যায়।”

সৈন্য বেরিয়ে যেতে শেহজাদী তাসবীরের কাছ থেকে ছাড়া পেতে মরিয়া হয়ে উঠলেন।তাসবীর ছাড়লেন না বরং শেহজাদীর নরম শরীর আঁকড়ে ধরে পাঁজারে কোলে তুলে নিলেন।ততক্ষণে শেহজাদীর ছটফট বেড়ে গেছে হাজার গুনে।দুই হাতের সাহায্যে ক্রমশ ধাক্কা দিতে লাগলেন তাসবীরের বক্ষে।আরওয়ার শরীরের তাপ তাসবীর অনুভব করতে বুঝে গেলেন মেয়েটার শরীর জ্বরিত।

” এত অসুস্থ আপনি জ্বরের মাত্র যে প্রবল।চলুন জ্বর সারিয়ে তুলবো এই তাসবীরে হাতে পড়েছেন জ্বর বাবা পালাই পালাই করে পালাবে।”

” ছা..ছাড়ুন আমায় যাব না আপনার সাথে।”

“আরওয়া ধরে নিন আপনার শখ পূরণ করছি।মনে আছে সেদিন আফসোস সুরে বলেছিলেন আমি কেন সম্রাট হলাম না তাহলে ঘোড়ার পিঠে টগবগিয়ে আপনাকে অলকপুরী রাজ্যে থেকে নিয়ে যেতাম।এখন আমি এসেছি আপনার দ্বারে এসেছি আপনাকে নিয়ে যেতে চাই আমি সেই ঘোড়ার পিঠে।তবে তার আগে যে আপনাকে সুস্থ হতে হবে।”

সেদিনের কথা ভাবতে সর্বাঙ্গ শিউরে উঠলো শেহজাদীর।ঝাপসা চোখে তাসবীরের দিকে তাকিয়ে নিজেকে ছাড়াতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।”

” সুস্থ হবো না আমি।এই জ্বরেই ম/রে যাব তবুও আপনার কাছে ধরা দেব না।”

” তবে কি ধরে নিব এ জ্বর প্রেমজ্বর?শেহজাদী প্রেমজ্বরে মরতে চায়?”

তীব্র লজ্জা মিশ্রিত রাগে দাঁতে দাঁত খিচিয়ে উঠলো শেহজাদী।তাসবীর তখন হাসছিলো।শেহজাদী খুকখুক কেশে গা ভরিয়ে বমি করে দিলেন লহমায়।বমির ছিটকে গিয়ে পতিত হয় তাসবীরে বুকে।মুহূর্তে বিচলিত হয়ে পড়েন তাসবীর।আরওয়াকে কোল থেকে নামিয়ে দু’বাহু চেপে বসানোর চেষ্টা করেন

” মাত্র ছুঁয়ে দিলাম তাতেই গা ভাসিয়ে বমি যদি সম্পূর্ণ আমার হন তাহলে উফফ ভাবতেই গায়ে কাঁটা দিচ্ছে আমার।”

তাসবীরের কথা কানে তুললেন না শেহজাদী।দুর্বল শরীরটা নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ঢলে পড়লেন তাসবীরের বুকে।”
#চলবে___

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here