বিধুর রজনী পর্ব -১৬+১৭

#বিধুর_রজনী
#পলি_আনান
[পর্ব সংখ্যা ১৬]
___________________
৩৩.
ঘোর অন্ধকার’কে পিছনে ফেলে আজকের মতো নিশাবসান ঘটলো, হয়তো বা আজকের এই নব সূর্যে যোজন হতে চলছে অপ্রত্যাশিত অন্যকিছু।সম্রাট তাসবীর তার সৈন্যসামন্ত নিয়ে উপস্থিত অলকপুরী রাজ্যের দ্বারে।ঘোড়া থেকে নেমে খানিকটা বিশ্রামের উদ্দেশ্যে সবাইকে স্থির হতে বলে।তিনি নিজেও ক্লান্তি কাটাতে সুরাই ভরতি পানি পান করলেন।উজির আতেফ এবং সেনাপ্রধান রউফ তখন সম্রাট তাসবীরের পাশেই ছিলেন

” উজির মশাই এবং সেনাপতি মশাই।বিনা যুদ্ধে অল্পস্বল্প পরিস্থিতিতে এর আগে কি রাজ্য জয় করে ফিরেছেন?”

” আজ্ঞে না সম্রাট।র/ক্তার/ক্তি পরিস্থিতি সৃষ্টি হবেই আর এটাই স্বভাবজাত।”

মুখে পানি ছিটিয়ে সেনাপ্রধান রউফের কথায় কিঞ্চিৎ হাসলেন সম্রাট তাসবীর।

“তবে আজ অন্যকিছুর সৃষ্টি হতে চলেছে।প্রাসাদের মূল ফটকে প্রবেশ করলে দেখতে পাবেন সব জলের মতো স্বচ্ছ।”

” আপনার কথা আমার বুঝে আসছে না সম্রাট।”

সম্রাট তাসবীর হেঁয়ালি না করে আসনে বসলেন।তার পাশে বসতে ইশারা করে সেনাপ্রধান এবং উজির মশাইকে। দুজনেই সম্রাটের ইশারা মোতাবেক বসে পড়েন।

” এতকাল যাবৎ অত্যাচার,অনাচার,ব্যভিচার থেকে মুক্তি পেতে চলেছে অলকপুরী রাজ্য যে সম্রাট তাদের অন্ধকারে নিমজ্জিত করে রেখেছে তার হয়ে যু/দ্ধ করবে সৈন্য দল নাকি যে আলোর পথ দেখাতে চলছে তাকে অনুসরণ করবে?”

” যদি বুঝদার হয় তবে আলোর পথে।কিন্তু স্বার্থপরতা কে করবে সম্রাট?”

“উজির মশাই জীবন বাঁচানো ফরজ।সম্রাট আব্বাস এবং তার পুত্র ইবনুল যে রঙ্গমঞ্চ শুরু করেছে তার সমাপ্তি এবার হওয়া জরুরি।সব দিকের যেমন ভালো এবং মন্দ দিক রয়েছে তেমনি ধরে নিম স্বার্থপরতা’র ভালো এবং মন্দ দুইটাই রয়েছে।সে যাই হোক আমার কিছু নির্দেশ সৈন্যসমান্তদের বলে দেবেন।

নির্দেশাবলী ১. আমাদের জন্য এই যু/দ্ধ ভাগ্যক্রমে সহজ তাই বলছি কোন সৈন্য বা প্রজাকে বিনা কারণে হ/ত্যা করা যাবে না।
২. সম্রাজ্ঞী এবং ছোট শাহজাদা’কে বন্দি করবেন।তারা আমার কাছে অতি কোমল আপনজন।তাদের কেউ অনাদর করলে তা আমি বরদাস্ত করবো না।তাই তাদের বন্দি করে সুরক্ষিত স্থানে নিয়ে যাবেন।তাদের সাথে শাহজাদার ফুফুমাও থাকবেন।তাকেও নিয়ে যাবেন।
৩.বড় শাহজাদা ইবনুল রাশীদকে এবং সম্রাট আব্বাসকে যু/দ্ধে কোন ক্রমেই হ/ত্যা করা যাবে না আমি চাই না এত সহজে তাদের মৃত্যু হোক।তাদের যত দ্রুত সম্ভব বন্দি করতে হবে।
৪. সম্রাট আব্বাসের একমাত্র কন্যা শেহজাদী আরওয়া নূর তার গায়ে যেন ফুলের টোকাও না লাগে।অতি সাবধানে সবার থেকে আলাদা করে তাকে সুরক্ষিত স্থানে বন্দি করবেন।”

সম্রাট তাসবীরের কথা শুনে মাথা দুলালেন উজির এবং সেনাপ্রধান।নির্দেশনা গুলো তাদের খানিকটা অবাক করলেও এ নিয়ে ফের প্রশ্ন করলেন না কেউ।সময় অপচয় না করে পুনরায় সবাই সবার নির্দেশ মোতাবেক অলকপুরী রাজ্যের দিকে অগ্রসর হয়।
.
মেসবাহ তার দলবল নিয়ে অলকপুরীতে যু/দ্ধে আসার কথা থাকলেও আহমেদাবাদ রাজ্য থেকে যে নব সম্রাট যুদ্ধে আসবেন তা ঘুণাক্ষরেও টের পেল না কেউ।টের পেল না তা অবশ্য বললে ভুল হবে।উজির হাযম আগে থেকেই সবটা জানতেন কিন্তু সব দিক বিচেবচনায় চুপচাপ ছিলেন তিনি।এবার সময় এসেছে মুক্তির,শান্তিতে বাঁচার।অত্যাচারিত জীবন আর নয় সর্বদিক ভেবে সেনাপতি ফারুক এবং উজির হাযম সবটা চেপে যান।
প্রত্যুষের আলো যত দ্রুত ফুটতে শুরু করেছে ঠিক যেন তত দ্রুত হট্টগোল,প্রজাদের অস্থিরতা বেড়েছে।আহমেদাবাদের সৈন্যদল চারিদিকে ছড়িয়ে পড়েছে।
পরিকল্পনা মোতাবেক যু/দ্ধ চলাকালীন সম্রাট আব্বাসের সেনাপতি ফারুক এবং উজির নিজেদের গুটিয়ে নেন।সেনাপতি ফারুকের নির্দেশ অনুসারে তাদের সৈন্য-সমান্তর নিজেদের নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেয়।সম্রাট তাসবীরের নিষেধাজ্ঞা মোতাবেক শাহজাদা ইদ্রীস, সম্রাজ্ঞী শাহাবা’কে কোন রকম আঘাত করা হয়নি বরং তাদের সুরক্ষিত স্থানে স্থানান্তরিত করা হয়।যু/দ্ধ চালিয়ে যান সম্রাট আব্বাস এবং শাহজাদা ইবনুল তাদের সাথে কিছু সৈন্য বেশ কিছুক্ষণ যুদ্ধ চালিয়ে যায়।সময় যত পেরিয়ে যাচ্ছিল ততই সম্রাট তাসবীরের দখলে চলে আসে অলকপুরী রাজ্যের প্রাসাদ।নাটকীয় পরাজয় মানতে নারাজ ইবনুল।নিজের জান বাঁচাতে খুব দ্রুত গা ঢাকা দেন তিনি।নিজের রাজকীয় পোশাক পরিবর্তন করে সৈন্যদের পোশাক পরিধান করে অতি শীঘ্রই প্রাসাদ ছেড়ে পালিয়ে যান।অবশেষে কাঙ্ক্ষিত সময় এসেছে সম্রাট তাসবীর ক্রমশ ধীর পায়ে এগিয়ে গেলেন অন্দরমহলে।তার চোখে মুখে যে হিংস্রতা ধরা দিয়েছে তা হয়তো এর আগে কেউ দেখেনি।পেশি বহুল হাতে শানিত তরবারি আঁকড়ে ধরে এগিয়ে গেলেন সম্রাট আব্বাসের নিকট।মুখ থুবড়ে পড়া সম্রাট আব্বাস তাসবীরকে দেখে সম্পূর্ণ ভড়কে গেলেন।স্পষ্ট স্মৃতির কোণ থেকে ভেসে আসছে সেদিনের শরাব পানের আসরে বসা সেই মুখ।এই কি সেই তাসবীর যে নিজেকে কবি, চিত্রকর বলে সব রাজ্যে পরিচয় দিয়েছে!এই কি সেই তাসবীর যে শেহজাদী আরওয়ার কক্ষে প্রবেশ করার চেষ্টা চালিয়েছে!কি অদ্ভুত অতি সাধারণ ছেলেটি নাকি সম্রাট সিদ্দীকের পুত্র।
সেইদিনের কথা ভেবে চোখে মুখে বিকৃতি ভাব ফুটে উঠলো সম্রাট আব্বাসের।নিজের পায়ে নিজেই কুড়াল মা/রলেন তিনি।যদি তাসবীরকে ছেড়ে না দিয়ে হ/ত্যার নির্দেশ দেওয়া হতো তাহলে নিশ্চয়ই এই দিন দেখতে হতো না।সম্রাট আব্বাসের মুখের ভাব ভঙ্গিমা দেখে গা দুলিয়ে হেসে উঠলো তাসবীর।

” চিনতে পারছেন সম্রাট আব্বাস?ওহ দুঃখিত আপনি এখন আর সম্রাট নেই খুব শীঘ্রই নতুন সম্রাট সিংহাসনে বসবেন।আপনি এখন পরাজিত নৃপতি।”

” তোমার জান বাঁচানোটা মোটেও উচিত হয়নি সেদিন।”

” ঠিক এই জন্যই আপনাকে এখন নিহত করতে চাইছি না।অনেক বোঝাপড়া বাকি আছে।সেনাপ্রধান রউফ।”

” আদেশ করুন সম্রাট।”

” পরাজিত সম্রাট আব্বাসকে বন্দি করুন।”

” যথা আজ্ঞা সম্রাট।”
.
অন্দরমহলের ভেতরটায় চারিদিকে ঘিরে আছে সম্রাট তাসবীরের সৈন্যদল।এতক্ষণ যাবৎ চলতে থাকা যু/দ্ধের মাঝে ঠিক এক মুহূর্তের জন্যেও শেহজাদীর কথা ভুলে যাননি তাসবীর।বরং আরওয়াকে দেখার আকুলতা তাকে ক্রমশ গ্রাস করে।সম্রাট তাসবীর শেহজাদীর কক্ষের দিকে অগ্রসর হলেন এই উত্তেজনাপূর্ণ সময়ে উজির আতেফ এগিয়ে এলেন,

” গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দেওয়ার ছিল সম্রাট।”

” বলুন।”

” সারা প্রাসাদে খুঁজেও সম্রাট আব্বাসের একমাত্র কন্যা আরওয়া নূরকে খুঁজে পাওয়া যায়নি।তিনি কি পালিয়েছেন কি না সে বিষয়ে আমরা সুনিশ্চিত নই।”

উজির আতেফের বলা কথাগুলো সম্রাট তাসবীরের পৃথিবী থমকে দিয়েছে।পদ তলে মৃত্তিকা ফাঁক হয়ে সবটা যেন তলিয়ে গেছে।আকাশে যে বজ্রের ধ্বনি ধরণি কাঁপিয়ে দেয় সেই বজ্রে যেন সম্রাট তাসবীরের বুকটায় সব লণ্ডভণ্ড করে তুলছে।

” এ কথা আমি একবার শুনেছি আরেকবার শুনতে চাই না উজির মশাই।অক্ষত অবস্থায় আমার আরওয়াকে চাই।চাই মানে চাই।আপনি বুঝতে পারছেন না আপনি আমার কাছে কেমন সংবাদ পেশ করেছেন।যদি আজ আরওয়াকে না পাই তবে আমি হিংস্র হতে বাধ্য হবো।”

” আমি আমার সর্বোচ্চ দিয়ে শেহজাদীকে খুঁজে বের করবো।”

উজির এবং সম্রাটের কথার মাঝে উপস্থিত হন সেনাপ্রধান রউফ।

“সম্রাট, ইবনুল রাশীদ পালিয়েছে।সবার অগোচরে তিনি পালিয়েছেন।আমি রাজ্যের আনাচে কানাচে সৈন্য সদস্য পাঠিয়েছি তাকে যে করে হোক খুঁজে বের করবে।”

সম্রাট তাসবীর আরক্ত দৃষ্টিতে চেয়ে রইলেন মেঝের দিকে।আরওয়া তার প্রতিশোধ পূরণের ইন্ধন হলেও সবকিছুর আগে আরওয়া তার ভালোবাসা,আবু তাসবীরের সহধর্মিণী হওয়ার অধিকার একমাত্র আরওয়া নূরের আছে।
তাসবীর দ্রুত পায়ে এগিয়ে যান আরওয়ার কক্ষে।শূন্য কক্ষে সবকিছু সুসজ্জিত।কক্ষের চারিপাশে ঘুরে ঘুরে বেশ খানিকক্ষণ খুঁজলেন আরওয়াকে কিন্তু পেলেন’না।আরওয়াকে খুঁজতে খুঁজতে মাথায় এলো লতার কথা।কিন্তু লতার হদিস পেলেন না সম্রাট।তাসবীরের উন্মাদনা’য় একে অপরের দিকে সন্দিহান চোখে চাইলেন উজির এবং সেনাপ্রধান।বর্তমানে সবকিছু তাদের নিয়ন্ত্রণে।শুধুমাত্র সম্রাট তাসবীরের পরবর্তী কর্যের নির্দেশ দেওয়ার বাকি।

” সেনাপতি মশাই ইদ্রীস এবং সম্রাট আব্বাসের স্ত্রী কোন কক্ষে আছে?”

” তারা ডানের দিকে শুরু’তে যে ঘরটা সেখানে আছে।”

সম্রাট তাসবীর এগিয়ে গেলেন সেদিকে দ্বারে থাকা সৈন্যরা তাকে দেখে নত মস্তকে কুর্নিশ করেন।তাসবীর ধীর পায়ে কক্ষে প্রবেশ করেন।ইদ্রীসের সম্মুখে দাঁড়াতে কেমন যেন জড়তা কাজ করছে তার।তবুও নিজেকে দৃঢ় করলেন।তরবারি সরিয়ে পেছনে হাত গুটিয়ে এগিয়ে গেলেন পালঙ্কের কাছে।

” কেমন আছেন আম্মীজান?”

পরিচিত কণ্ঠে চমকে তাকান ইদ্রীস এবং শাহাবা।রাজকীয় পোষাকে তাসবীরকে দেখে দু’জনেই চমকে গেছে।

” বাবা তুমি এখানে!”

” আহমেদাবাদ রাজ্যের নব সম্রাট তাসবীর।”

মাথায় যেন আকাশ ভে/ঙ্গে পড়েছে দু’জনের।অতি সামান্য যুবক কিনা সম্রাট।এ কেমন রসিকতা।

” হেঁয়ালি করো না তাসবীর।অতর্কিত হামলায় আমরা বন্দি পিতার কোন খোঁজ নেই চিন্তায় আমাদের কি অবস্থা বুঝতে পারছো?”

ইদ্রীস রাশীদের কথায় কিঞ্চিৎ হেসে ফেললেন তাসবীর।পেছনে হাত গুটানো অবস্থায় তিনি আরো এগিয়ে যান তাদের সামনে।

” পরাজিত সম্রাট আব্বাসকে বন্দি করা হয়েছে।আমার হেঁয়ালি করার সময় নেই ইদ্রীস।আরওয়া কোথায়?”

“আরওয়া!আরওয়াকে তোমার কি প্রয়োজন।সেদিন প্রহরীকে হ/ত্যা করে তোমার জান বাঁচালো, আর আজ আমাদের এই দিন দেখতে হলো।তার মানে এতদিন শত্রুর বেশে আমার সঙ্গে সম্পর্ক টিকিয়ে রেখেছিলে তাসবীর?আমি তোমায় পরম বন্ধু ভেবেছিলাম।”

” বন্ধু নাকি শত্রু তার হিসেব পরে হবে আগে আরওয়ার খোঁজ দাও।”

” আমরা জানি না আরওয়া কোথায়।

” মিথ্যা বলছো।”

” সত্য নাকি মিথ্যা সেটা উপর ওয়ালা ভালো বলতে পারেন।তোমার সঙ্গে বাক্যালাপের ইচ্ছে অন্তত আমার আর নেই।”

সম্রাট তাসবীর ক্রুদ্ধ হলেন।উজির আতেফকে ডেকে উঠলেন গলা ছেড়ে।তার ডাকে বেশ দ্রুতে কক্ষে আসেন উজির আতেফ।

” আদেশ করুন সম্রাট।”

“এদের জিজ্ঞাসাবাদ করো শেহজাদী আরওয়া কোথায়।যদি নিদিষ্ট সময়ে উত্তর না পাও তবে সম্রাট আব্বাসের গর্দান নিয়ে নাও।

তাসবীরের এমন নির্দেশে কেঁপে উঠেন শাহাবা।তিনি ছুটে গিয়ে ছুঁতে যান তাসবীরকে।কিন্তু তার আগেই সৈন্যরা বাধা প্রদান করে।

” আমায় তুমি বিশ্বাস করো না তাসবীর?সত্যি বলছি আরওয়ার খোঁজ আমরা জানি না।গত দিন দুয়েক আগ থেকে সে গায়েব।একমাত্র ইবনুল জানে আরওয়া কোথায় আছে আর কেউ জানে না।আমার মেয়েটাকে খুঁজে এনে দাও তাসবীর তার ক্ষতি করো না।আমার একমাত্র মেয়ে আমার সাধনার ফল।”

ভেতরটা ভেঙ্গে যেন গুড়িয়ে গেল তাসবীরের।শাহাবার কথা অবিশ্বাস করার প্রশ্ন আসে না তিনি অন্তত মিথ্যা বলবেন না।যদি পালিয়ে যাওয়ার থাকতো তবে তারা সবাই পালাতে পারতো।তাসবীর ক্লান্ত দেহ টেনে এগিয়ে গেল শেহজাদীর কক্ষে।পিতলের দ্বার রুদ্ধ করে হাঁটু মুড়িয়ে বসলেন মেঝেতে।

” এভাবে হারিয়ে যেত পারো না তুমি।তুমি আমার কাছে ভালো থাকো আর না থাকো তবুও তুমি আমার চোখে চোখে থাকবে।সম্রাট তাসবীরের প্রতিজ্ঞা এতটাও সস্তা নয় যে কথা দিয়েছি আর কথা রাখবো না।আমি আমার কথা রাখবো তোমাকেও ফিরতে হবে আরওয়া।”

তাসবীর জোর গলায় চিৎকার দিলেন।একটা সময় পরাজিত ক্রীড়কের ন্যায় ছটফটিয়ে কেঁদে উঠলেন।চোখের পানি গড়িয়ে নাক বেয়ে ঠোঁটে লাগছে।অথচ এতবছরের সাধনা পূর্ণ হয়েছে অলকপুরী রাজ্য দখলে এসেছে আহমেদাবাদের।এবারে প্রজাদের শান্তির দিন,সুখের দিন।কিন্তু সুখটা যেন ধোঁয়ায় মিশে গেছে তাসবীরের।জিতেও যেন আজ চরম ভাবে হেরে গেছেন তিনি।
#চলবে___
পর্বটা কেমন হয়েছে জানাবেন।#বিধুর_রজনী
#পলি_আনান
[পর্ব সংখ্যা ১৭]
_________________
৩৪
আরশিতে চোখ বুলিয়ে হতাশার শ্বাস ছাড়লেন আরওয়া।চোখে মুখে বড্ড বিতৃষ্ণার ভাব।তার ভাব ভঙ্গিমায় যে কেউ সহজে বলতে পারবে শেহজাদী আরওয়ার মনে শান্তি নেই।বাম হাতটা নাতিদীর্ঘ কেশে রেখে হু হু শব্দে কেঁদে উঠলেন তিনি।তাসবীরের প্রতি মনটা বিতৃষ্ণায় ভরে গেছে।এমনটা কেন করলেন তিনি?আরওয়ার সঙ্গে তার তো কোন বৈরী ভাব ছিল না তাহলে তাসবীর কেন সেদিন রাতে এলো না?নিজের প্রতি নিজের বড্ড রাগ লাগলো আরওয়ার।সম্রাট সাঈদ তার মাতা,পিতা আরওয়ার সেবা যত্নে ত্রুটি রাখেনি।সম্রাট সাঈদ নিজের সর্বোচ্চ দিয়ে আরওয়ার আপ্যায়ন করছেন অথচ এই মানুষটার উপর তিনি কিছুতেই মন বসাতে পারছেন না।বিপদ কেটে গেলে আর কয়েকদিন বাদেই তাদের বিয়ে।বর্তমানে আরওয়ার উদাসীনতা সম্রাট সাঈদ বরদাস্ত করলেও বিয়ের পর নিশ্চয়ই করবেন না।এসব ভেবে হতাশার শ্বাস ছাড়লেন শেহজাদী।

” দ্বিপ্রহর ছেড়ে দিবার শেষ প্রহর চলে এলো অথচ আপনি এখনো মধ্যে-ভোজ শেষ করলেন না।এ কথা জানলে সম্রাট আমাকে খুব বকবেন শেহজাদী।”

হঠাৎ লতার কথায় চমকে উঠেন আরওয়া।কাঁধে থাকা উত্তরীয় দিয়ে খুব দ্রুত ঢেকে দিলেন চুল।লতার দিকে তাকালেন বিরক্ত হয়ে।

” কতবার বলেছি লতা হঠাৎ হঠাৎ আমার কক্ষে এসে চমকে দেবে না।আমার ভোজন-স্পৃহা নেই এক কথা বলে আমায় আর বিরক্ত করবে না।যাও এখন।”

লতা মাথা নত করলেন।ইদানীং শেহজাদীর কী হয়েছে কে জানে।কেমন অদ্ভুত আচরণ করছেন তিনি।সবসময় কিছু নিয়ে চিন্তিত থাকেন।শেহজাদীর এমন পরিবর্তন কিছুতেই হজম হচ্ছে না লতার।

” দুঃখিত শেহজাদী।সম্রাট নিজে আমাকে পাঠালেন আপনার খোঁজ নিতে।”

” উফফ তার এত আতিশয্য আমার ভালো লাগে না লতা।”

” সম্রাট আপনাকে খুব ভালোবাসেন শেহজাদী আপনি তাকে অবহেলা করবেন না।অন্তত আমি এতদিনে বেশ ভালো ভাবেই বুঝেছি।”

” বন্ধ করো তোমার সাফাই গাওয়া।আমার সহ্যর বাঁধ ভেঙ্গে যাচ্ছে।”

শেহজাদীর ধমকে কেঁপে উঠলো লতা।ক্ষিপ্র চরণে অতি শীঘ্রই বেরিয়ে যায় কক্ষ ছেড়ে।

৩৫
ক্ষুধার্ত বা/ঘের ন্যায় সামনে থাকা আহার গ্রহণ করছেন ইবনুল রাশীদ।তার চোখ মুখ দু’দিনে শুকিয়ে কেমন ফ্যাঁকাসে হয়ে গেছে।গায়ে থাকা পোশাক ধুলোময়লা পরিপূর্ণ থাকলেও আহার গ্রহণের আগে তা পরিবর্তন করে এসেছেন।সম্রাট সাঈদ ঠোঁটের কোণে কিঞ্চিৎ হাসি রেখা টেনে তাকিয়ে রইলেন ক্ষুধার্ত মানুষটার দিকে।ইবনুল রাশীদ শেষ পাতে তিন খানা রসগোল্লা গপাগপ মুখে পুরে নিলেন।তার কাণ্ডে শব্দ করে হেঁসে উঠলেন সম্রাট সাঈদ।

” কয় দিনের ভুখারি ছিলেন ইবনুল রাশীদ?”

” মজা নেওয়া বন্ধ করুন সম্রাট।পরিস্থিতি হাতের বাইরে চলে গেছে।”

” আপনাদের এমন বিশ্রী পরাজয় আমি মানতে পারছি না।তিন বার আহমেদাবাদের কাছে হেরে যাওয়ার পরেও যখন চতুর্থবার জিতে ফেরার আশার আলো দেখলেন তখনি অতর্কিত হামলায় সবটা ধূলিসাৎ হা হা হা ভাগ্য আপনাদের সহায় নেই জনাব ইবনুল।”

” শু**বাচ্চাদের দল যদি বেইমানি না করতো তাহলে জিতেই ফিরতাম।উজির,সেনাপতির সৈন্য-সমান্তর সবাই হাত গুটিয়ে ছিল সবটা যখন হাতের বাইরে চলে গেল তখনি পালিয়ে বাঁচলাম।”

ইবনুল রাশীদের কথার আড়ালে তাচ্ছিল্য হাসলেন সম্রাট সাঈদ।এই মানুষটাকে ব্যক্তিগত ভাবে মোটেও পছন্দ করেন না তিনি।পরাজিত সম্রাট আব্বাসের বর্ব/রতার তুলনায় তার ছেলে ইবনুল দশ পা এগিয়ে।

” তা আমার শশুড় বাবা কোথায়?তার খোঁজ পেলাম না যে।”

” পিতা কোথায় আছেন কিংবা বাকিরা কোথায় আমি কিছুই জানি না।আমি তো আমার জান নিয়ে বেঁচে ফিরেছি।এর প্রতিশোধ আমাকে নিতেই হবে ”

সম্রাট সাঈদ বেশ কিছুক্ষণ যাবৎ চুপ থাকলেন।হাসি হাসি মুখখানি কিছুটা সময় পর গম্ভীরে পরিণত হলো।

” আবু সিদ্দীক একজন সৎ বিচক্ষণ এবং নিষ্ঠাবান সম্রাট ছিলেন।তিনি ছিলেন দয়াবান।আমার সম্রাট হওয়ার পেছনে তার অবদান কম ছিল না কিন্তু ওই যে লোভ, লোভে আমিও পড়েছি আপনাদের সাথে আত্মীয়তার খাতির কর‍তে গিয়ে সম্রাট সিদ্দীকের সঙ্গে বেইমানি করার সিদ্ধান্ত নিয়ে ছিলাম।কিন্তু তার পুত্র তাসবীর তিনি ছেড়ে কথা বলার মানুষ নয়।তাসবীরের সম্পর্কে আমি খুব বেশি কিছু জানতাম অতি সাধারণ ভেবেছিলাম তাকে কিন্তু কে জানতো এই সাধারণ ছেলের মাঝেই এত চতুরতা।”

সম্রাট সাঈদ কথা শেষ করতেই ইবনুল রাশীদ গর্জ উঠেন।রাগ সংবরণ করে গজগজ করতে করতে সারা কক্ষে পাইচারি করেন।

” যদি জানতাম এই ছেলে একদিন বিড়াল থেকে বা/ঘে পরিণত হবে তবে সেদিনই হাতির পায়ে পিষে মা/রতাম।”

“আবু তাসবীর আপনার পূর্ব পরিচিত ?”

সম্রাট সাঈদের কথায় উত্তপ্ত শ্বাস ছাড়লেন ইবনুল।আসনে বসে স্থির কন্ঠে বলতে থাকেন সেদিনের কথা।আরওয়া কিভাবে প্রহরী’কে হ-ত্যা করে বাঁচিয়ে দিয়েছিল তাসবীরকে সবটা শুনে কিঞ্চিৎ অবাক হন সম্রাট সাঈদ।নিজের মনে চেপে রাখা কথা এক নিশ্বাসে বলে উঠেন ইবনুলের কাছে।

” আহমেদাবাদ থেকে সম্রাট তাসবীরের দূত এসেছিল।সাথে একখানা পত্র।আহমেদাবাদ রাজ্যের সাথে তেলিকোনা রাজ্যের সকল কূটনৈতিক,ব্যবসায়ী সকল সমঝোতা বাতিল করা হয়েছে।আমার সন্দেহ হচ্ছে তাসবীর কি জেনে গেছেন আপনাদের সাথে আমার সম্পর্কের কথা!জনাব ইবনুল রাজ্যে হারা হয়ে পথে পথে ঘুরছেন,এদিকে আহমেদাবাদ দখল করার স্বপ্ন দেখছেন।আহমেদাবাদ রাজ্যের সাথে সম্পর্ক খারাপ হওয়ায় আমার যে অনেক বড় আসন্ন লোকসান দেখতে পাচ্ছি আমি।আমার দিক থেকে আপনি আর সহযোগিতা পাওয়ার আশা রাখবেন না।”

” এ কেমন কথা।এখনো দু’টি রাজ্য আমার দখলে থাকলেও আপনার সাহায্য ছাড়া আহমেদাবাদের খবরাখবর পাওয়া যাবে না।”

” কি করে খোঁজ পাবেন?যেখানে আমার সাথে তারা সব সম্পর্কই বাতিল করেছে।”

চিন্তা মগ্ন হয়ে পড়লেন ইবনুল রাশীদ।থুতনিতে হাত ঠেকিয়ে ভাবলেন বেশ কিছুক্ষণ।সম্রাট সাঈদ তখন আড়চোখে তাকিয়ে ছিলেন মনে মনে তাচ্ছিল্য হাসলেন বেশ কয়েকবার।

” আরওয়া কেমন আছে? ”

” আপনার বোন বেশ ভালো আছে।তবে তিনি এখনো জানেন না অলকপুরী রাজ্য হারানোর কথা।”

” আরওয়ার নিকট খবর পাঠান তাসবীরের চক্রান্তে সম্রাট আব্বাস সহ প্রত্যেক সদস্য যু/দ্ধে প্রাণ হারিয়েছে।এমনকি আমিও বেঁচে নেই।”

” অসম্ভব এমন মিথ্যা সংবাদে কি হাল হবে আরওয়ার আপনি ভাবতে পারছেন?”

” আহ উত্তেজিত হবেন না।যা বলছি করুন।তাসবীরের সম্পর্ক যা যা বলার বলে ফেলবেন।আমাদের মৃত্যুর কথা শুনলে আরওয়া বেশ কয়েকদিন খুব করে কাঁদবে এরপর আপনার কাছেই গুটিয়ে রইবে।শুনুন সম্রাট সাঈদ আমার বোনকে আপনার কাছে দিয়ে গেলাম তার বিনিময়ে আহমেদাবাদকে মুখ থুবড়ে হারাতে সাহায্য করবেন আপনি।”

” বোনকে বিক্রি করছেন?নাকি বিনিময় প্রথা চালু করছেন?আমি হালাল ভাবে বিয়ে করে আমার স্ত্রীর মর্যাদা দিয়ে তাকে ঘরে তুলতে চাই কোন রাস্তার বিক্রি করা মেয়েকে নয়।বুঝে শুনে কথা বলবেন জনাব ইবনুল।যেখানে আরওয়া এখন আমার আয়ত্তে সেখানে আপনার এসব চুক্তি সাজে না ইবনুল রাশীদ।

খানিকটা থতমত খেয়ে গেলেন ইবনুল।উত্তেজিত সম্রাট সাঈদের চোখে চোখ রেখে ভড়কে গেলেন মুহূর্তে।এ সময় সম্রাট সাঈদের মন জুগিয়ে চলতে হবে।হেরফের হলে চিরজীবনের জন্য দাসত্ব জীবন কাটানোর ইচ্ছে তার নেই।

” আরওয়া আপনারি হবে সম্রাট উত্তেজিত হবেন না।আপনি আপাতত আরওয়াকে জানিয়ে দিন তার পরিবার মৃত”

” আপনার সঙ্গে কথা বলার রুচি চলে গেছে জনাব ইবনুল।এখন আসছি পরে কথা হবে।”

৩৬.
সম্রাট সাঈদের সান্নিধ্যে এলে অস্থিরতা বহু গুনে বড়ে যায় আরওয়ার।গলা শুকিয়ে চৌচির।চোখ তুলে তাকানোর সাহসটা তার যেন নেই।কেমন যেন জড়তা তাকে ঘিরে আছে চারিদিকে।অথচ সম্মুখে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটার আকুলতা বুঝতে পারেন তিনি।এই মানুষটা যে তার প্রতি কতটা উদার,নম্র,একটুখানি বাক্যালাপের লোভে উন্মত্ত তা বুঝেও পা পিছিয়ে ফেলেন আরওয়া।সন্দিগ্ধ চোখে সম্রাট সাঈদের দিকে তাকালেন আরওয়া।বেশ কিছুক্ষণ যাবৎ সম্রাট সাঈদ তার কক্ষে এসেছেন তবে কোন কথা বলেননি বরং চুপচাপ তাকিয়ে আছেন আরওয়ার পানে।এই বিষয়টা বড্ড অপ্রস্তুত করছে তাকে।

” আপনি কিছু বলবেন সম্রাট?”

” হুম বলতে চাই।আপনি কথাটি শ্রবণ করতে পারবেন কি না তাই ভাবছি।”

” ক..কেন কি বলবেন!”

“দু’দিন আগে নব সম্রাট আবু তাসবীরের নির্দেশে আহমেদাবাদ রাজ্যের সাথে অলকপুরী রাজ্যে যু/দ্ধ সংঘটিত হয়েছে।সেই যুদ্ধে প্রাণ হারিয়েছে আপনার পরিবার।”

সম্রাট সাঈদ যতটা সহজে সবটা বললেন ততটা সহজে কথাটা হজম করতে পারলেন না আরওয়া।মেয়েটার পায়ের তলার মাটি যেন ফাঁক হয়ে গেছে।মাথার ভেতরটা সব ফাঁকা ফাঁকা লাগছে।এ কেমন সংবাদ!তার পিতা মাতা ভাইয়েরা বেঁচে নেই।দু’কানকে বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে তার।আরওয়ার অস্থিরতা দু’গুন বাড়িয়ে দিলেন সম্রাট সাঈদ।

” শুনেছি আপনি নাকি তাসবীর নামক জনৈক ব্যক্তির প্রাণ বাঁচিয়ে ছিলেন।তার জন্য প্রহরীকে হ/ত্যা করতে কুণ্ঠা বোধ করেননি।আহমেদাবাদের নব সম্রাট হলেন সেই তাসবীর।ভেবে কুল পাই না যার জীবন বাঁচালেন আরওয়া সে আপনার পরিবার’কে হ/ত্যা করলো।এতিম করলো আপনাকে।আপনি বোধহয় সেদিন এক বেইমানকে বাঁচিয়েছিলেন।”

পাথরের ন্যায় জড় হয়ে গেলেন আরওয়া।ঝাপসা চোখে তাকিয়ে রইলেন সম্রাট সাঈদের দিকে।তবে কি বেইমানি করার উদ্দেশ্যেই তাসবীর সেদিন আসেনি অপরদিকে তার পরিবারকেও হ/ত্যা করলো।ভাবনার মাঝেই মাথাটা ঝিমিয়ে উঠলো আরওয়ার।চোখে পলকে চেতনা হারিয়ে সশব্দে মেঝেতে ছিটকে পড়লেন।সম্রাট সাঈদ উত্তেজিত হয়ে ডেকে উঠেন লতাকে দ্রুত হস্তে হাঁটু মুড়িয়ে আগলে নেন আরওয়াকে।

” আমি আগেই বলেছিলাম এ সংবাদ তার সহ্য হবে না।আরওয়া চোখ খুলুন।”
#চলবে___

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here