বিধুর রজনী পর্ব -১৪+১৫

#বিধুর_রজনী
#পলি_আনান
[পর্ব সংখ্যা ১৪]
__________________
” সম্রাট সিদ্দীকের অবর্তমানে সিংহাসন আরোহণ করার ক্ষমতা আপনার রয়েছে শাহজাদা তাসবীর।”

” হুম।”

” চারিদিকে অবিন্যস্ত অবস্থা,প্রজাদের মাঝে সংশয় উদ্দীপনা সম্রাট সিদ্দীকের অবর্তমানে শাহজাদা বীর কি সিংহাসন আরোহণ করবেন না।নাকি তিনি অনন্য বারের ন্যায় এবারো গা ঢাকা দেবেন।”

” হুম।”

“আহমেদাবাদ রাজ্যের এই চরম বিপর্যস্ত অবস্থায় অন্য রাজ্যের সম্রাটরা অতর্কিত হামলা চালাতে পারে,রাজ্যে দখল করার বাসনা তাদের মনেও জাগতে পারে।আমাদের সকলের শেষ ভরসা আপনি শাহজাদা তাসবীর।”

” হুম।”

“মার্জনা করবেন শাহজাদা আপনাকে প্রশ্নটি করতে বাধ্য হচ্ছি আপনি কি আমায় অগ্রাহ্য করছেন?”

উজির আতেফের কথা এতক্ষণ মন দিয়ে শুনছিলেন তাসবীর।উজিরের নত মস্তকের প্রশ্নে মিহি হাসলেন তিনি।নিজের শীতল হাতাটা বাড়িয়ে আঁকড়ে ধরলেন উজির আতেফের হাত।একজন শাহজাদা নিজ থেকে আগলে নিয়েছে সামান্য একজন উজির’কে ভাবতেই কিংকর্তব্যবিমূঢ় উজির আতেফ। নত মস্তক তুলে চোখে চোখ রাখলেন তাসবীরের।

” উজির মশাই ছোট থেকেই আপনাকে চিনি জানি আর আপনিও জানেন আমি শান্ত প্রিয় ছেলে, রাজ্যে দখলে যে র/ক্তার/ক্তি বিবাদ, কলহ,যু/দ্ধ এসব আমার পছন্দ নয়।কিন্তু সময় পালটায় পরিস্থিতি সময় পাল্টাতে শিখিয়ে দেয়।এখন আমার পেছনে ফেরার পথ বন্ধ।আমি আহমেদাবাদের সিংহাসনে বসবো।আমার পিতার অবর্তমানে রাজ্যের দায়িত্ব আমি নিলাম।”

তাসবীরের দৃঢ় কথার ছন্দে চোখে মুখে আনন্দের উচ্ছ্বাস বইতে লাগলো উজির আতেফের মাঝে।অশ্রু ঝরছে চোখের কোনে।এই পুত্রটিকে তিনি বড্ড ভালোবাসেন।নিরহংকার,লোভহীন ছেলেটা বড্ড অমায়িক,বুদ্ধিসম্পন্ন,জ্ঞানী এবং ধূর্ত প্রকৃতির।সম্রাট সিদ্দীকের অবর্তমানে যোগ্য সম্রাট হলেন তাসবীর।কিন্তু রাজ্যের প্রতি অনীহা থাকায় সর্বদা রাজ্যের দূরে দূরে থেকেছেন মন দিয়েছেন জ্ঞান লাভের।ফারসি,ইংরেজি,আরবি সহ অনন্য ভাষায় জ্ঞান লাভের অধিকারী হয়েছেন।

উজির আতেফের সঙ্গে বাক্যালাপ শেষ করে পিতার কক্ষের দিকে অগ্রসর হন তাসবীর।সেখানে উপস্থিত ছিলেন সম্রাজ্ঞী এবং একজন নফর, কবিরাজ মশাই।তাসবীর’কে দেখে নফর এবং কবিরাই মশাই তাজিম করলেন।তাদের হাত ইশারায় স্থির থাকতে বলেন তাসবীর।

” পিতার কি অবস্থা কবিরাজ মশাই?”

” পরিস্থিতি ক্রমশ প্রতিকূলের দিকে যাচ্ছে শাহজাদা।এতদিন ফলের রস মুখে দিলে তা পান করতেন।কিন্তু কিয়ৎক্ষণ আগ থেকে তাও করছেন না।আমি আমার চেষ্টার ক্রুটি রাখিনি বাকিটা আল্লাহর হাতে।”

বেশ শব্দ করে শ্বাস ছাড়লেন তাসবীর।বসে পড়লেন তার পিতার শিয়রে।মায়ের কাতর মুখখানির দিকে তাকিয়ে দৃষ্টি নত করলেন তাসবীর।

” আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি সিংহাসনে বসবো।এ বিষয়ে আপনার মতামত কি মা?”

” তুমি উত্তম সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছ।এ বিষয়ে আমার পরামর্শ হলো অন্তত যাই হোক পিতার মতো সৎ ন্যায় নিষ্ঠাবান থাকবে।”

” আপনার আদেশ মেনে চলবো।আমি আরেকটি সিদ্ধান্ত নিয়েছি তবে তাতে ভয়ংকর কিছু হতে চলেছে।”

” কি সিদ্ধান্ত জানতে পারি?”

” সময় হলে সব জানবেন।এখন আমি আসছি।

২৯.
অপেক্ষা শব্দটা বড্ড জালাতন করে শেহজাদী’কে।সময় তার মতো করে চলবে।তার নিয়ম সে কখনো বদলাবে না কিন্তু যখনি কেউ অপেক্ষায় থাকার আহ্বান জানায় তখনি যেন সময়টা দীর্ঘ হয় এবং দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর।উফফ সে কী অসহ্যকর পরিস্থিতি।আজ যেন জোছনায় অবগাহন করেছে এই রজনী।চাঁদের আলোয় আজ বোধহয় ঝলসে যাবে শেহজাদী।রাত্রিরে ঝিঝি পোকার ডাক,উদ্যানে মন-কাড়ানো পুষ্পের ঘ্রাণ,সারি সারি বাহারি রঙের পুষ্পের মাঝে সাদা রঙটা আজ তার সৌন্দর্যের বাহার নিয়ে বসেছে।জোছনার ফকফকা আলোয় বেশ মানানসই লাগছে সাদাপুষ্পের বিছানা।কক্ষে জ্বলছে প্রদীপের লেলিহান।লাল দোপাট্টা কাঁধ থেকে সরিয়ে ঘুরে তাকালেন শেহজাদী আরওয়া।খাসদাসী লতা তার পেছনেই দাঁড়িয়ে আছে মেয়েটা আজ শেহজাদীকে দেখছে অদ্ভুত দৃষ্টিতে।

” তুমি গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ো লতা।”

” শেহজাদী আপনি ঘুমাবেন না?”

” না।আজকের রজনী মোহনীয়, সুন্দর উপভোগ করতে চাই।”

” তাহলে আমি যাই শুভ রাত্রি শেহজাদী।”

লতা নত মস্তকে কুর্নিশ করে চলে যাওয়ার জন্য উদ্যত হলো।তার আগেই বাধা দিলেন শেহজাদী।

” দাড়াও লতা।”

ঘুরে তাকালো লতা।আসন ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন শেহজাদী, এগিয়ে গেলেন লতার সম্মুখে মিহি হেসে আচমকা জড়িয়ে ধরলেন লতাকে।শেহজাদী’র এমন অপ্রত্যাশিত কাণ্ডে হতবাক লতা।বরফে যেন জমে গেছে মেয়েটা শেহজাদী তাকে জড়িয়ে ধরেছে!লতার স্তব্ধতা,ভারী নিশ্বাস-প্রশ্বাসের আন্দোলন,হতবাক দৃষ্টি সবটাই বুঝলেন শেহজাদী।তাই তো মেয়েটাকে আর ঘাঁটালেন না পুনরায় বলেন,

” এবার যাও।”
.
রাত যত গভীর হতে লাগলো পরিবেশটা ততই সুন্দর হয়ে উঠলো।মানব-শূন্য নিস্তব্ধ পরিবেশ,ঝিঝি’র ডাক,ফুলের সুভাস,জোছনার আলো সব মিলিয়ে মুগ্ধতায় তাকিয়ে রইলেন আরওয়া।অলিন্দ ছেড়ে কক্ষে প্রবেশ করলেন তিনি আরশির কাছটায় দাঁড়িয়ে নিজেকে পরখ করে নিজেই লজ্জা পেলেন।মনে পড়ে গেল পাতালের কথা।তাসবীরের সান্নিধ্যে লাভের কথা,লজ্জায় মিহিয়ে গেলেন তিনি।তবে সবকিছুর মাঝেই ভয় হলো তার এখনো আসেন’নি কেন তাসবীর?
রাত পেরিয়ে যাবে কিয়ৎক্ষণ বাদেই ফজরের ওয়াক্ত শুরু।প্রহরীদের চলাচল বুঝতে পারছেন তিনি।তবে তাসবীর আসছে না কেন?শেহজাদী মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলেন প্রাসাদ ছেড়ে বেরিয়ে পড়বেন তবে ঠাণ্ডা মাথায় আবার ভাবলেন কক্ষে এসে যদি তাসবীর তাকে না পায়?দোটানায় বসে স্থির অলিন্দে বসে পড়লেন আরওয়া যা হবার হবে তিনি নড়বেন না একটুওনা।

বহমান সময় কারো জন্য অপেক্ষা করে না।অপেক্ষা করেন না শেহজাদী আরওয়া নূর।সর্বদা তিনি তার রাগ,জেদ,চাওয়া-পাওয়া,ক্ষমতার ব্যবহার করে গেছেন।তিনি যা চান তা হাজির হয় কিছু সময় ব্যয়ের মাঝে।তবে আজ তিনি অপেক্ষা করেছেন।একটা বিশ্বস্ত মানুষকে আঁকড়ে ধরবেন বলে অপেক্ষা করেছেন।দীর্ঘতর রজনী পেরিয়ে ফলাফল শূন্যের কৌটায় উপস্থিত।তাসবীর আসেনি,তার কথা সে রাখেনি।তবে শেহজাদী রেখেছেন কথা।স্বার্থপর শেহজাদী কথা রাখতে পারলে দায়িত্বশীল তাসবীর কেন কথা রাখতে পারেনি?তবে সব মিথ্যা!
ক্রোধে চিৎকার করে কেঁদে উঠলেন শেহজাদী।খোপায় গোজা সাদা গোলাপ টেনে হিঁচড়ে ছিড়ে ফেললেন মুহূর্তে।যতটা যত্ন নিয়ে সাজলেন ততটা অযত্নে ছাড়ালেন সবকিছু।রাগে জেদে ক্রমশ কান্নার আওয়াজ বাড়ছে।প্রতারণা, প্রতারণা করেছে তাসবীর।নিছক ভালোবাসা শেখাতে এসেছে।শেহজাদী ধারাল নখের সাহায্যে আঁচড়ে দিলেন,গাল, গলা, হাত।মস্তিষ্ক স্থির নেই সবটা এলো মেলো পাগল পাগল লাগছে তার কাছে।কাঁদতে কাঁদতে মেঝেতে বসে পড়লেন দ্রুত।তার চিৎকারে পিতলের দ্বার ঠেলে অনুমতি বিহীন প্রবেশ করলো লতা।লতাকে দেখে চোখ তুলে তাকায় আরওয়া।শেহজাদীর রক্তিম চোখ দেখে দু’কদম পিছিয়ে গেল মেয়েটা।এমন অদ্ভুত বিধ্বস্ত লাগছে কেন শেহজাদীকে?

” কি হয়েছে শেহজাদী?বেগম’কে ডাকবো?”

“চুপ একদম চুপ।কাউকে ডাকবে না খবরদার না।দ্বার বন্ধ করো।

লতা ঘাবড়ে গেল।কাঁপা কাঁপা হাতে দ্রুত দ্বার বন্ধ করে দাঁড়ালো শেহজাদীর সম্মুখে।

” আপনাকে এমন লাগছে কেন শেহজাদী?”

” কাঁচি নাও লতা।”

” ক..কি?”

” কি বলি বুঝনা?ফারসি নাকি আরবিতে বলবো।”

শেহজাদীর মতিগতি ঠিক লাগলো না লতার কাছে।তবুও আদেশ মানতে বাধ্য সে।হঠাৎ কেমন যেন ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো শেহজাদী।দাঁড়ালো আরশির সম্মুখে।দীর্ঘল কেশে হাত বুলিয়ে মুখ ফুটে আওড়ালো,

” চুল কেটে দাও লতা।এমন ভাবে কাটবে যেন এই চুলে আর খোপা বাধা না যায়।”

চমকে গেল লতা।এ কেমন আদেশ শেহজাদীর।সবচেয়ে যত্ন ও শখের চুল আরওয়ার।এই দীঘল কেশে কত রকম জড়িবুটি তেল মালিশ করেছে লতা।তাতে শেহজাদী ভীষণ খুশি হতেন মেয়েটার উপর।তিল তিল করে গড়ে তুলা যত্নের চুল এখন শেহজাদী বলছেন কেটে ফেলবে।এ কেমন আদেশ!

” কি বলছেন আপনি।এ হয় না।”

” আমার মুখে মুখে তর্ক!কে দিল এই সাহস তোকে?”

ক্ষিপ্ত হলেন আরওয়া।কক্ষে থাকা শানিত তরবারি নিয়ে এগিয়ে এলো লতার সামনে।মেয়েটা ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে নিজের আবেগ অনুভূতি বিসর্জন দিয়ে কাঁচি হাতে তুলে বলে,

” আপনি যা বলবেন শেহজাদী তাই হবে।আমি…”

লতাকে কথা শেষ করতে না দিয়ে হাত ইশারায় থামিয়ে দিলেন আরওয়া।ঘুরে তাকালেন পেছন ফিরে এরপর অনিচ্ছা সত্ত্বেও চুল কাটতে বাধ্য হয় খাস দাসী লতা।
আরেকবার বিষণ্ণ চক্ষুদ্বয় থেকে অশ্রু বিসর্জন দিলেন শেহজাদী।মনস-পটে ভেসে উঠলো তাসবীরের বদন।আর বললেও লাভ হবে না খোপায় সাদা গোলাপ দিও আরওয়া।সাদা গোলাপ দিতে একদম ভুলবে না।

শেহজাদীর হাত থেকে আলগা হয়ে আসে তরবারি ঝংকার শব্দে মেঝেতে পড়লে কেঁপে উঠে লতা। হাঁটু মুড়িয়ে বসলেন শেহজাদী কান্না ধমনের চেষ্টায় প্রতিবারের ন্যায় ব্যর্থ হলে কা/মড়ে ধরেন হাতে।তবুও জেদ কমার লেশ নেই খামচে ধরলেন এলোমেলো কেশ,

” আমি আর আমাকেও বিশ্বাস করি না।বিশ্বাস করার প্রশ্ন আসে না।আমি মানুষ চিনতে ভুল করি।ভুল মানুষের জন্য অপেক্ষার প্রহর গুনি।”#বিধুর_রজনী
#পলি_আনান
[পর্ব সংখ্যা ১৫]
___________________
৩০.
“শেহজাদীর আশেপাশে সর্বাবস্থায় তুমি থাকো লতা তাহলে আমার কন্যার কি এমন হয়েছে যার হেতু ধরে সে এমন কাণ্ড ঘটাবে?”

লতার গলা শুকিয়ে চৌচির নত মস্তকে কেমন হাঁসফাঁস করছে।মেয়েটার অস্থিরতা গম্ভীর-মুখে পরখ করলেন সম্রাট আব্বাস।

” কথা বলছো না কেন?ইবনুল যদি তোমাকে জিজ্ঞাসা বাদ করে তাহলে কিন্তু পরিস্থিতি আরো ঘোলাটে হবে সেটা কি তুমি চাও?”

” জি না।”

” তাহলে যা জানতে চাই উত্তর দাও।”

” গত রাত্রিরে শেহজাদী নিজের হাতেই সাজলেন।রাত্রির যত গভীর হলো তিনি অলিন্দে বসে জোছনার রজনী উপভোগ করছিলেন।আমি বার বার বলেছিলাম রাত জাগবেন না শেহজাদী ঘুমিয়ে পড়ুন।তিনি বারণ করেন আর আমাকে ঘুমাতে যেতে বলেন।কাল রাত্রিরে শেহজাদী বেশ খুশি ছিলেন অন্যরকম সুখী সুখী ভাব তার মাঝে আমি দেখেছি তবে রাত পেরিয়ে ভোরে কি এমন হলো আমি সেটা জানি না সম্রাট।বিশ্বাস করুন তিনি আমার শিরশ্ছেদ করার হুমকি দেন।নিজের জান বাঁচাতে আমি তার চুল কা/টতে বাধ্য হয়েছি।আমায় ক্ষমা করবেন সম্রাট।”

সম্রাট আব্বাস চিন্তিত ভঙ্গিমায় মাথা দুলালেন।আরওয়ার প্রতি তার সুপ্ত রাগ-জেদ থাকলেও মেয়েটাকে তিনি ভালোবাসেন।এ ভালোবাসা কখনো প্রকাশ হয়নি আর হবেও না।দুই ছেলের পর যখন সম্রাজ্ঞী শাহাবার কোলে আরওয়া এলো তখন শাহাবার খুশি দেখে মনটা হুহু করে কেঁদে উঠেছিল সম্রাটের।স্ত্রীর আনন্দে তিনি আনন্দিত।তবে একটা কথা থেকেই যায় কিছু কিছু সন্তান জন্মের পর পিতামাতার ঘরে সু’সময় নিয়ে আসে কিন্তু আরওয়া জন্মের পর তা হয়নি।যেদিন আরওয়ার জন্ম হয় সেদিন যু/দ্ধে চরম ভাবে হেরে যান সম্রাট আব্বাস।অপরদিকে রণক্ষেত্রেই প্রাণ যায় একমাত্র বোন আসমার স্বামী।একদিকে নতুন প্রাণ পৃথিবীতে আসার আনন্দ অপরদিকে আরেক প্রাণ পৃথিবী ত্যাগ করার বেদনা।সব মিলিয়ে তিক্তময় সময়টা ভাবলে মাথা ঝিমঝিম করে সম্রাট আব্বাসের।বোন আসমা বলা চলে এত বছর ধরে কানে কু-মন্ত্র ঢুকিয়ে গেছে আরওয়া, অপয়া অভিশপ্ত।তিনিও যেন সেই সুরে গাইলেন নাচলেন।
সম্রাটের ভাবনা চিন্তার মাঝে তার সামনে হাজির হয় শাহজাদা ইবনুল।পালঙ্কে শায়িতা আরওয়া।তার দিকে তাকিয়ে ছুটে গেল সে।

” কি হয়েছে আমার বোনের?কে আঘাত করেছে তোমায়?এই ভাইকে বলো তার শাস্তি এই ইবনুল রাশীদ দেবে।”

ত্যাজি কন্ঠে চোখ ঘুরিয়ে অন্যদিকে মুখ ঘুরায় আরওয়া।সব যে ফাঁকা আওয়াজ তা তিনি জানেন।দিনমণির ত্যাজ তার জানলার পর্দা গলিয়ে প্রবেশ করছে।তাসবীরের কথা ভাবতে ঠোঁট কাম/ড়ে কান্না দমনের বৃথা চেষ্টায় থাকে।পাশে থাকা ইদ্রীস শেহজাদীর এই কষ্ট চক্ষু গোচর করলেন।বোনের কষ্টে বুকের ভেতরটায় কেমন দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে তবুও তিনি নীরব।আরওয়া যখন মুখ খুলবে না বলেছে তখন সত্যি মুখ খুলবে না।

আরওয়ার বিষয়টা সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করব সম্রাটকে ইশারায় কক্ষের বাইরে আনেন শাহজাদা ইবনুল।

” গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ আছে পিতা।”

” কি সংবাদ?”

” আহমেদাবাদে নতুন সম্রাট সিংহাসন দখল করেছে।এবারের সম্রাট, সম্রাট সিদ্দীকের একমাত্র পুত্র আবু তাসবীর।যাকে বীর বলে সবাই সম্বোধন করে তিনি তাসবীর।”

পুত্র ইবনুলের কথায় তাচ্ছিল্য হাসলেন সম্রাট আব্বাস।পুত্রের কাঁধে হাত রেখে দম্ভ নিয়ে বলেন,

” তাসবীর কিছুই করতে পারবে না।যার রাজ্য সম্পর্কে ধারণা নেই সে আবার কি করবে?এখনি উত্তম সময় আক্রমণের তীরন্দাজ,সৈন্য,কামান,গোলন্দাজ সব প্রস্তুত করো আমরা যুদ্ধে যাবো কিছু দিনের মধ্যেই।”

তাসবীর নামটা শুনে একটুও খটকা লাগলো না পিতা পুত্রের।কয়েকদিন আগে যে শেহজাদীর কক্ষে তাসবীর নামক ব্যক্তিকে বন্দি করা হয় তার কথা বেমালুম ভুলে বসে আছে দুজনেই।এই সামান্য বিষয় তাদের হয়তো মাথায় রাখার কথাও না।কিন্তু এই সামান্য বিষয় যে অসামান্যর কাতারে পড়েছে তা ঘুণাক্ষরেও টের হয়তো পাবেনা তারা।ইবনুল রাশীদ হাসতে হাসতে মাথা দুলালেন।

” যথা আজ্ঞা পিতা।আমি সবটা অক্ষরে অক্ষরে পালন করবো।”

তাচ্ছিল্য এই হাসি সম্রাট আব্বাসের ঠোঁটে কতক্ষণ লেগে থাকবে কে জানে।কাউকে ছোট করে ভাবার আগে নিজের ভেবে নেওয়া উচিত আমি কতটা বড়!অহংকার শব্দটা যতটা ধারালো,এর বাস্তবতার ফলাফল ঠিক ততটাই ভয়াবহ।সম্রাট আব্বাসের ভাগ্যে কি আছে সেটা আব্বাস নিজেও অনুমান করতে হয়তো ব্যর্থ।

৩১.
আজ প্রজাদের জন্যে বিশাল জায়গা জুড়ে ভোজের আয়োজন করা হয়েছে।আহমেদাবাদে আজ নতুন সম্রাট তাসবীর সিংহাসন আরোহণ করেছেন এই বিষয়টা নিয়ে একদল প্রজা যেমন সন্তুষ্ট আরেকদল প্রজা তেমনি চিন্তিত।সর্বদা সকল অবস্থায় এই প্রজাদের জন্য সেরা ছিলেন প্রাক্তন সম্রাট সিদ্দীক।তার অবর্তমানে সিংহাসন দখলের অধিকার তার পুত্র আবু তাসবীরের রয়েছে সেই মোতাবেক তাসবীর সিংহাসনে বসলেও পিতার মতো যোগ্য কী পুত্র হবে?প্রজাদের দুঃখ কষ্টে নব সম্রাটকে পাশে পাবে তো সবাই?ভাবনা তাদের মাঝে রয়েই যায়।

তাসবীর তার পিতার কক্ষ ছেড়ে পাঠাগারের দিকে রওনা হলেন।মনে মনে আওড়াতে লাগলেন কিছু বাক্য।আজ আরওয়াকে বার বার মনে পড়ছে।যদি সবটা ঠিক থাকতো তবে এই মুহূর্তে আরওয়ার স্থান তার বুকের মধ্যেখানেই থাকতো।গত রজনীতে হয়তো আরওয়া তার জন্য বধূ সেজে অপেক্ষায় ছিল কিন্তু তাসবীর যায়নি।তাসবীর যে প্রতারণা করছে এই জোছনার রজনীতে হয়তো শেহজাদী ভাবছে তাসবীর নিশ্চিন্তে ঘুমে কাবু ছিল কিংবা শেহজাদীর কথা ভুলেই বসে আছে।কিন্তু কে জানবে সারাটা রাত ক্রন্দনে কেটেছে তাসবীরের।এ কোন পরীক্ষায় পড়লো সে আগামীর কথা ভেবে ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়ছেন।একদিকে আলোর হত্যার প্রতি/শো/ধ অপরদিকে মায়ারটান,হৃদয়েরটান কোন দিকে মোড় ঘুরাবেন তিনি।সব ভেবে ভালোবাসার প্রতি দুর্বল হলেন না তাসবীর।যদি ভালোবাসার কথা ভাবতে হয় তবে জালিমের রক্তের ঠাই হবে এই বংশে আর যদি প্রজাদের কথা ভাবতে হয় বোনের হত্যার প্রতিশোধ নিতে হয় তবে ভুলে যেতে হবে আরওয়ার কথা।মেয়েটার আবদারের কথা।
তাসবীর প্রতিশোধ-পরায়ণা হয়ে উঠলেন।পাঠাগারে সজ্জিত এক কোণে থাকা কাঠের মেজে বসে কাগজ দোয়াত হাতে তুলে লিখতে বসলেন যেখানে নিজের শপথ বাক্যগুলো পাণ্ডুলিপিতে আবদ্ধ রইবে।
৩২.
কিয়ৎক্ষণ আগে একজন দূত এসে পত্র দিয়ে যান শাহজাদা ইবনুলকে।সম্রাট সাঈদের পত্র ভেবে নিশ্চিন্ত মনে পত্রটি খুলে পড়তে লাগলেন তিনি।

জালিম ইবনুল রাশীদ

সময় এসেছে বদলা নেওয়ার।রাজ্য দখলের সময় আমার প্রাণপ্রিয় বোনের একমাত্র কন্যার সম্মানে আঘাত হানতে দু’বার ভাবেন’নি।ছোট্ট মেয়েটা তখনো বুঝতে পারেনি এই নির্মমতার অর্থ।আপনজন হারানোর ক্লেশ খুব শীঘ্রই বুঝতে পারবেন।

ইতি আপনার আসন্ন বিপদ মেসবাহ।

সর্বাঙ্গ কেঁপে উঠলো ইবনুল রাশীদের।ভয়ে গলা শুকিয়ে চৌচির।আরওয়ার ক্ষতির আভাস তিনি পাচ্ছেন যে করে হোক বোন’কে রক্ষা করতে হবে।ছোট্ট মেয়েটার ইজ্জত লুটের বিষয়ে কেউ অবগত নয়।এমনকি সম্রাট আব্বাস নিজেও না।নারী হ/ত্যার আগে যে শারীরিক লালসা মিটিয়েছে ব্যভিচার ইবনুল সেটা সম্পূর্ণ ধামাচাপা পড়ে গেছে।ইবনুল রাশীদের কুকীর্তি’তে হাত নেই আরওয়ার তাহলে এসব নোংরামি’তে কিছুতেই তিনি আরওয়াকে মিশতে দিতে পারেন না।আসন্ন বিপদের কথা ভেবে আরওয়াকে নিরাপদ আশ্রয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্তে উপনীত হন।
.
সম্রাট আব্বাসের ঘর্মাক্ত,দুশ্চিন্তাগ্রস্ত চেহারা দেখে বেশ অবাক হন শেহজাদী।তার কক্ষের খালি অংশে পায়চারি করছেন ইবনুল।পিতা এবং ভ্রাতার এমন ছটফট কাণ্ডে বেশ খটকা লাগলো শেহজাদীর।

” পিতা আপনাদের চিন্তিত মনে হচ্ছে।”

” হুম তার কারণ তুমি।”

” আ..আমি!”

” শুনো মা যা বলছি মন দিয়ে শুনবে।আমাদের ছেড়ে তোমায় তেলিকোনা রাজ্যে যেতে হবে।মেসবাহ তার শক্তি সঞ্চার করেছে।খুব শীঘ্রই তোমাকে নিয়ে যাওয়ার বাসনা জাগিয়েছে।এবার আর তোমায় সম্মানের সহিত নয় বরং নর্তকী হিসেবে নিয়ে যেতে চায়।মানে বুঝতে পারছো?অন্য রাজ্য দখল করে মেসবাহ তার শক্তি সঞ্চয় করেছে অপমানের বদলা সে নেবেই।তাই যা বলছি মন দিয়ে শুনবে এখান থেকে তোমার চলে যাওয়াই উত্তম।”

” আমি তোমাদের ছেড়ে যাব না।তোমরা কি পারবেনা আমায় রক্ষা করতে?”

ইবনুল উত্তেজিত হয়ে পড়ে এগিয়ে আসে শেহজাদীর সম্মুখে।

” শুনো সম্রাট সাঈদ’কে সব বলে রেখেছি তিনি তোমায় অনাদর করবেন না।আমাদের দিক থেকে সব ব্যবস্থা করা আছে।তুমি এই রাতেই রওনা হবে।তোমার সঙ্গে থাকবে দাসী লতা।আরেকটা কথা ইদ্রীস এবং মা এই বিষয়ে যেন কিছু না জানে।

” আমি যাব না ভাই,আমি যাব না পিতা এ হয় না।আমাকে যদি না পায় তাহলে মেসবাহ কি আপনাদের ছেড়ে দেবে?”

” সে কথা তোমায় ভাবতে হবে না৷”

” আমি বলেছি যাব না মানে যাব না।”

” আরওয়া তোমার মায়ের কসম, আমার কসম যদি না যাও তাহলে….

চোখ তুলে তাকালো আরওয়া।সর্বাঙ্গে শীতল সমীরণ বয়ে গেল মুহূর্তে।এমন কঠিন বাক্য কেন বলেন পিতা।একের পর এক ঘটনা ক্রমশ তার মস্তিষ্কের ধারণ ক্ষমতা যেন দুর্বল করে দিয়েছে।পিতার নির্দেশে অবশেষে জোছনা মাখা এই রজনীতে লতাকে সঙ্গে নিয়ে তেলিকোনা রাজ্যের উদ্দেশ্য বেরিয়ে পড়লেন শেহজাদী আরওয়া নূর।চোখের জলে সবটা ঘোলাটে লাগছে তার কাছে অপ্রত্যাশিত একের পর এক ঘটনা তাকে ক্রমশ অচল করে তুলছে।

” অথচ এই রজনীতে আপনার পাশে থাকার কথা ছিল তাসবীর।যাকে চাইনি জীবন বাঁচাতে আমার তার কাছেই ছুটতে হলো।তাহলে আমি মানুষ চিনতে সত্যি ভুল করেছি তাসবীর।আপনি আমার সেই ভ্রম যার মাধ্যমে আমি শিখেছি মিষ্টি মিষ্টি কথার অদলে নিজের অস্তিত্ব অন্যের কাছে হারাতে নেই।
#চলবে____

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here