বিধুর রজনী পর্ব -১২+১৩

#বিধুর_রজনী
#পলি_আনান
[পর্ব সংখ্যা ১২]
__________________
২৪.
তাসবীর চলে যাওয়ার পর পেরিয়ে গেল বেশ কয়েকদিন।এই কয়েকদিন একটু শান্তিতেও ছিলেন না শেহজাদী।সর্বদা মনের ভেতরটা কেমন অশান্তির আগুন জ্বলেছে।রাত দিন তাসবীরের কথা ভেবে অতিবাহিত হয়েছে।কবে আসবে এই কাঙ্ক্ষিত মানুষটা?কবে নিয়ে যাবে তাকে? এসব ভেবে কোন উত্তর পায় না সে।অপরদিকে সম্রাট সাঈদ যেন অস্থির হয়ে উঠেছেন।শেহজাদীর এই উদাসীনতা তিনি কিছুতেই পছন্দ করছেন না।শেহজাদীকে যত্ন করে পত্র পাঠানোর পরেও তিনি সেই পত্রের কোন উত্তর পাঠাননি ।তাই সম্রাট সাঈদ পত্র প্রেরণ করাও বন্ধ করেছেন।মনে মনে জমা হয়েছে গাঢ় রাগ।
সময়টা তখন অপরাহ্ণ নিজের অলিন্দে বসে ছবি আঁকছিলেন শেহজাদী আরওয়া।হঠাৎ একতারার সুরে চমকে উঠেন তিনি।এই সুন্দর সুরের অধিকারী বৈরাগী হ্যা বৈরাগী একতারা বাজায়।কাঙ্ক্ষিত সময় এত তাড়াতাড়ি এসেছে ভাবতেই খুশিতে আত্মহারা আরওয়া।খাসদাসী লতাকে নির্দেশ দিলেন বৈরাগীকে যেন দ্রুত তার কক্ষে প্রেরণ করা হয়।নির্দেশ অনুযায়ী দাসী লতা শেহজাদীর কক্ষে এনে হাজির করেন বৈরাগী’কে।

” কেমন আছেন বৈরাগী?অনেক পর এলেন।”

” যেমন ছিলাম তেমন আছি।আপনি ভালো আছেন শেহজাদী?কত দিন বাদে দেখলাম আপনাকে মুখটা কেমন শুকিয়ে গেছে।”

” সকলের দোয়ায় ভালো আছি।এই লতা বৈরাগীর জন্য ফলের শরবত নিয়ে এসো।”

লতা কক্ষ ছেড়ে বেরিয়ে গেলে সেই সুযোগ’টি কাজে লাগায় বৈরাগী।থলেতে থাকা লালচে কাগজের পত্রটি নিয়ে দ্রুত এগিয়ে দেন শেহজাদীর হাতে।শেহজাদী নিজেও সাবধানতা অবলম্বন করে পত্রটি আড়ালে লুকিয়ে রাখেন।
.
সাঁঝের বেলায় কামরায় একাই ছিলেন শেহজাদী।লুকিয়ে রাখা পত্রটি হাতে তুলে পড়তে থাকেন দ্রুত।

আরওয়া
‘আর কয়েকদিন বাদে পূর্ণিমার চাঁদ আকাশে উঠবে।সেই পূর্ণিমার প্রথম রজনী’তে আপনি আমি মুখোমুখি হবো।আপনি বধূ সেজে অপেক্ষা করবেন আমার জন্য।চিন্তা করবেন না আরওয়া আমি সব ব্যবস্থা করে রেখেছি গভীর রাতে আপনাকে নিয়ে আমি বেরিয়ে পড়বো এই প্রাসাদ ছেড়ে।দীর্ঘল কেশে সাদা গোলাপ গুজে দিতে একদম ভুলবেন না আরওয়া।’

পত্রটি একবার নয় দু’বার নয় বেশ কয়েকবার পড়লেন শেহজাদী।লজ্জায় মিহিয়ে গেলেন বার বার।তাসবীর তাসবীরের জন্য বউ সাজবেন তিনি।হঠাৎ মনে এলো মেসবাহ’র কথা এই মানুষটার জন্যেও যত্ন করে বউ সেজেছিল আরওয়া কিন্তু শেষ পর্যায়ে বিয়েটা কেমন ঘেটে ঘ হয়ে গেল।যদি এবারেও এমনটা হয়?তাসবীর যদি না আসতে পারে?দ্বিতীয়বার বউ সাজাটাও কি বিফলে যাবে?তাসবীর আসবে না? না এ হয় না তাসবীর এক কথার মানুষ তাসবীরের কথায় কোন ক্রুটি নেই।তিনি যখন আসবে বলেছেন নিশ্চই আসবে।আর যদি না আসে তবে এর কঠিন মূল্য চুকাতে হবে তাকে।
আনমনে কথা গুলো ভেবে চোখ বুঝলেন আরওয়া এই দোটানা মন নিয়ে সিদ্ধান্তে পৌঁছবেন কি করে?

২৫.
শাহজাদা ইবনুল রাজ পোশাক ছেড়ে আজ অন্যরকম বেশভূষা ধরেছেন।তাকে দেখে সাধারণ মানুষের বুঝবার জো নেই তিনি রাজপুত্র।নিজেকে বণিকের বেশে দেখে কুটিল হাসলেন ইবনুল।সম্রাট আব্বাস পুত্রের সূক্ষ্ম বুদ্ধির প্রশংসা না করে পারলেন না নিজেই যেন আজ নিজের ছেলেকে চিনতে পারছেন না।

” বাহ তোমায় তো খাসা বণিকের মতো লাগছে।আর দেরি করো না সৈন্যদের নিয়ে বেরিয়ে পড়।আর যা করবে সাবধানে আহমেদাবাদের কেউ যেন তোমায় চিনতে না পারে।”

“পিতা আপনি চিন্তা করবেন না।আহমেদাবাদ রাজ্যের কেউ আমাকে চিনবে না।সবাই সাধারণ বণিক ভাববে।সেই রাজ্যে এমন ভাবে ডুকবো সম্রাট সিদ্দীকের সর্বনাশ করা ছাড়া কিছুতেই বের হবো না।”

ইবনুলের সহকারী হিসেবে একশ’র অধিক সৈন্য প্রস্তুত হয়ে এসেছে।নিজেদের আলাপচারিতা শেষে মহল থেকে বের হওয়ার সময় মুখোমুখি হয়ে যায় ইবনুলের দল এবং আরওয়া।

” একি অদ্ভুত সাজে আপনি কোথায় চললেন ভাইজান?”

শেহজাদী আরওয়াকে দেখেই বিরক্তে মুখ কুচকালেন ইবনুল।সৈন্যদের আগে যাওয়ার নির্দেশ দিয়ে আড় চোখে তাকালেন সম্রাট আব্বাসের দিকে।সম্রাট আব্বাস মেয়ের দিকে একবার তাকিয়ে নিজেও চোখ ঘুরিয়ে নিলেন।শেহজাদীর উপস্থিতিতে যে কেউ খুশি নয় তা ভালো করেই বুঝলেন তিনি।

” শুভ কাজে যাচ্ছিলাম তোমার সঙ্গে দেখা হওয়াটা ভালোর কাজ হলো না।আরওয়া ভেতরে যাও।”

” কেন আমার সঙ্গে দেখা করে কি এমন ক্ষতি হয়েছে আপনাদের?”

” চুপ করো মুখে মুখে তর্ক করবে না।তুমি জানো না শুভ কাজে যাওয়ার আগে তোমার মুখ দেখতে মানা।”

ক্ষুব্ধ হলেন শেহজাদী তবে কথা বাড়ালেন না তিনি।সম্রাট আব্বাসের দিকে তাকিয়ে সরে গেলেন পথ ছেড়ে।
.
প্রার্থিত সময় সম্রাট ইবনুলের এসে পড়েছে।বণিক বেশে আহমেদাবাদ রাজ্যে প্রবেশ করেছে দুদিন হতে চললো তবে যার অপেক্ষায় ছিল তার দেখা পাওয়াটা যে মুশকিল হয়ে পড়েছে তবুও পরিকল্পনা মত কাজ চালিয়ে যেতে স্থির থেকেছেন ইবনুল।

আজ সকাল থেকেই আকাশ’টা গম্ভীর রূপে ডেকে চলছে।সাদা আকাশটা অধিকার করে নিয়েছে দানবীয় মেঘ।বৃষ্টি নামবে নামবে করেও এখনো নামেনি।তবে হয়তো নামতে বেশি দেরি নেই তীব্র বাতাস শুরু হয়ে গেছে ইতিমধ্যে।তাসবীরের আদরের বোন আলো অলিন্দে বসে প্রকৃতির উত্তাল দৃশ্য দেখছে তার পাশে দাঁড়িয়ে আছে দাসী মালা।যদিও আলো মেয়েটা তাকে দাসী বলে সম্বোধন করে না আলো মেয়েটাকে সই বলেই ডাকে।

” চলো না সই বৃষ্টিতে ভিজি।”

” সম্রাট, বেগম দেখলে খুব বকবে যাওয়াটা কি ঠিক হবে?”

” অবশ্যই হবে চলো প্রাসাদের বাইরে পুষ্করিণী’র সামনে যাই।”

” ন..না না চলুন আমরা বরং নদীর ধারে যাই সেখানে অনেক মজা হবে।”

” নদী!আমার যে ভয় লাগছে।”

” ভয়ের কোন কারণ নেই আমি আছি।”

আলোর বিশ্বস্ত আরেক নাম মালা।পরিবারের বাইরে চোখ বন্ধ করে এই মেয়েটাকে আলো বিশ্বাস করতে পারে।সেই ছোট থেকে মালার সাথে সই পাতিয়েছে আলো।এই মেয়েটার মনের সব প্রশ্ন,আনন্দ, ইচ্ছে সবটাই মালার জানা।প্রাসাদের ফটকে থাকা প্রহরীদের চোখ ফাঁকি দিয়ে মালা আর আলো নদীতে যাওয়ার উদ্দেশ্য বেরিয়ে পড়ে।ইতোমধ্যে বৃষ্টির ফোঁটা ধীরে ধীরে বেড়ে গেছে আনন্দে উল্লাসে খিলখিলিয়ে হাসছে আলো এবং তার সঙ্গে আনন্দ’কে ভাগাভাগি করে নিচ্ছে মালা।বেশ খানিকটা পথ কাটিয়ে মালা আলোকে নিয়ে জঙ্গলের রাস্তার দিকে মোড় ঘুরালো।

” একি মালা জঙ্গলের দিকে যাচ্ছ যে?”

” জঙ্গলের ধারের রাস্তাটা দিয়ে নদী পাড়ে পৌঁছতে সহজ হবে।”

” তাহলে হাঁটা শুরু করো।”

সরল আলো মালার কথা বিশ্বাস করে এগিয়ে গেল তার পিছু পিছু।সাধাসিধে আলো’র আড়ালে মালা পেছনে ঘুরে তাকালো দাঁড়িয়ে পড়লো মুহূর্তে।তাদের পিছু পিছু তিনজন বণিক এগিয়ে আসছে।আর তাদের নির্দেশ মোতাবেক আলোকে নিয়ে গহিন জঙ্গলের দিকে প্রবেশ করছে মালা।মেয়েটার মনে চলছে ভয় সংশয় তবুও একটি সুন্দর ভোরের আলো দেখার লোভে স্বার্থপর হতে পিছ পা হলো না মালা।

ঝুমঝুম বৃষ্টি যখন বেড়ে চলছিল ঘন জঙ্গলের প্রায় মাঝামাঝিতে এসে থেমে যায় আলো।ভীতু চোখে তাকায় মালার দিকে।

” সই এতদূরে কেন এলাম?নদী কোথায়?এই রাস্তা আমি চিনি না।আমি প্রাসাদে ফিরবো চল ফিরে যাই।”

মালা ঘাবড়ে গেল।পিছু ফিরে বণিকদের দিকে তাকালো।তিনজন বণিক তখন পুরু গাছের আড়ালে নিজেদের লুকিয়ে নিল।মালা নিজের বুদ্ধি খাটিয়ে আলোকে বলে,

” এসে যখন পড়েছি না ভিজে প্রাসাদে ফিরবো কেন?আসুন আনন্দ করি সই চোখ বন্ধ করে আকাশের দিকে তাকান।গা ভিজিয়ে দেওয়া বৃষ্টি অনুভব করুন।উপলব্ধি করুন এ জগৎ সুন্দর।”

আলো মালার কথা মতো চোখ বন্ধ করে আকাশের দিকে মুখ ঘুরালো।যদি গাঢ় গাছগাছালির মাঝে আকাশের দেখা নেই বললেই চলে।তবুও আলো আনন্দ পেলো বৃষ্টির ফোঁটা যখন টপটপ মুখে পড়ছিল মেয়েটা খুশিতে আত্মহারা যেন।

আহমেদাবাদ সম্রাটের উপর আঘাত হানতে চাইলে তার আগে সবচেয়ে বড় বুদ্ধিমানের কাজ তার দূর্বল জায়গায় আঘাত করা।সম্রাট সিদ্দীক যখন শোকে দুঃখে কাতর হয়ে পড়বেন তখনি অতর্কিতে হামলা চালাবে সম্রাট আব্বাসের সৈন্যদল।আর এমনটাই ভেবে রেখেছিল শাহজাদা ইবনুল।তার সূক্ষ্ম বুদ্ধি’তে সহজে সায় দিলেন সম্রাট আব্বাস।আর পরিকল্পনা মোতাবেক সম্রাট সিদ্দীকের দূর্বল জায়গা খুঁজে নিল তারা।রাজ্যের প্রত্যেক সদস্যদের এ সংবাদ অজানা নয় সম্রাট সিদ্দীকের সবচেয়ে আদরের কন্যা আলো।তাই ইবনুল অতি সহজে সম্রাটের দূর্বলতা হিসেবে আলোর দিকে নিশানা ছুড়ে দিল।
ভেজা পাতার ঝপঝপ শব্দে চোখ খুলে সামনে তাকালো আলো।চোখের সামনে তিনজন অপরিচিত ব্যক্তিকে দেখে মেয়েটা ভয়ে দু’কদম পিছিয়ে গেল।

” আপ..না..নারা কে?সই কোথায়?”

শাহজাদা ইবনুল এক পা দু’পা মেয়েটার কাছে এগিয়ে গেল।আগাগোড়া একবার পরখ করে নিলেন তাকে।ভেজা শরীরের প্রতিটি ভাজে ভাজে আকর্ষণ অনুভব করলেন তিনি।যেখানে মেয়েদের দেহ তার নেশার বস্তু হিসেবে বিবেচত সেখানে আলোকে দেখে নিজের পুরুষত্ব দমিয়ে রাখতে পারলেন না।লাস্যময় দৃষ্টিতে মেয়েটার দিকে তাকিয়ে থাকলেন বেশকিছুক্ষণ।আগাম বিপদের ইঙ্গিত পেয়ে ছুটে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা চালালো আলো কিন্তু তার আগেই বাকি দুই সৈন্য তাকে বন্দি করে।

” ছেড়ে দিন আমায় আপনারা কে?মালা কোথায়?”

কেউ কোন বাক্যব্যয় করলো না।শাহজাদা সৈন্যদের চোখ ইশারা করলেন।তার ইশারা খুব সহজেই বুঝে নিল বাকি সৈন্যরা।তাদের চোখ মুখের প্রতিক্রিয়া পালটে গেল তারা যেন শাহজাদার বিরোধিতা করতে চাইছে।তাদের মাঝে একজন বললো।

” শাহজাদা সম্রাটের নির্দেশ ছিল মেয়েটার গর্দান নেওয়া।কিন্তু…”

” চুপ পিতা যা বলছে তাই হবে।তবে এখন আমি যা চাইছি তা হবে।মালা নামের মেয়েটাকে নিয়ে এখান থেকে চলে যা আমাকে আমার কাজ কর‍তে দে।”

ধীরে ধীরে সময় গড়িয়ে গেল।বৃষ্টি তখন সময়ের তালে তালে বাড়ছে।গহিন জঙ্গলে কোন জ/ন্তু জা/নো/য়া/রের দেখা নেই হয়তো বৃষ্টিতে যে যার মতো গা ঢাকা দিয়েছে।বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে এক অসহায় মেয়ের আর্তনাদ।এমন নিষ্ঠুর বাস্তবতার মুখোমুখি এর আগে কখনো হয়নি সে।আলো নামের মেয়েটি যার জীবনের পাতা এখানেই শেষ।আনন্দ হাসিরা কিছুক্ষণ আগেই বিদায় নিয়েছে তার কাছ থেকে।এই আনন্দ হাসিরা আর ফিরে আসবে না।ফিরে আসার সুযোগ নেই!
#চলবে____#বিধুর_রজনী
#পলি_আনান
[পর্ব সংখ্যা ১৩]
__________________
২৬
যতটা দাপট নিয়ে জমিনে বৃষ্টি এলো ঠিক যেন ততটা দাপট নিয়ে আবার ফিরে গেল।দুপুরের পর ঘোলাটে আকাশ একদম স্বচ্ছ নীল রঙ ধারণ করেছে।সূর্যের কড়া রৌদ্র ফালি হয়ে পড়ছে জমিনে।প্রাত্যহিক জীবনে যে যার মতো ব্যস্ত হয়ে পড়লো।আহমেদাবাদ প্রাসাদে তখন চলছি নিদারুণ হইচই।রাজকন্যা আলোকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।সেই সাথে তার খাসদাসী যাকে সে সই বলে ডাকে মালা নামের মেয়েটিও নিখোঁজ।এমন অতর্কিত সংবাদ পেয়ে মূর্ছা গেলেন সম্রাজ্ঞী বিনিতা।সম্রাট সিদ্দীক চারিদিকে প্রহরী পাঠিয়ে দিলেন যে করে হোক মালা এবং আলোকে সুরক্ষিত অবস্থায় মহলে হাজির করতে হবে।ইতোমধ্যে তিনি ঘোষণা দিলেন,যে মহৎ ব্যক্তি আলোকে সুরক্ষিত অবস্থায় ফিরিয়ে আনবে তাকে দশ হাজার স্বর্ণ মুদ্রা উপহার দেওয়া হবে।ঘোষণা ছড়িয়ে পড়ার সাথে সাথে প্রজারাও তাদের রাজকন্যাকে খুঁজতে ব্যস্ত।

তখন অপরাহ্ণ সময় চারদিকে যখন চলছে কোলাহল তখন প্রাসাদের মূল ফটকে উপস্থিত হয় তিনজন বণিক যাদের হাতে সুসজ্জিত কাঠের বাক্স।তাদের পথ রুদ্ধ করে ফটকে থাকা দু’জন দ্বাররক্ষী।

” বিনা অনুমতি’তে প্রাসাদে প্রবেশ করা নিষিদ্ধ।”

” সম্রাটের জন্য বিশেষ উপঢৌকন এসেছে।”

দ্বাররক্ষীরা একে অপরের দিকে ইশারা করলো।তারা নিজেরা যখন দ্বিধাদ্বন্দ্বে ছিল তখন উজির ‘আতেফের’ নির্দেশে বাক্স’টি মহলে প্রবেশ করানো হলো।কে বা কার নিকট থেকে এই উপহার এসেছে সে সম্পর্কে জানতে চাইলে বণিক’রা স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দেয় আহমেদাবাদে তারা বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে এসেছে আর তাই সম্রাট সিদ্দীকের জন্য সামান্যতম উপঢৌকন পাঠানো হয়েছে।রাজকন্যা আলোর চিন্তায় সবাই এতটাই দিশেহারা ছিল অনন্য বিষয় খুব একটা কানে তুললেন না কেউ।সময় ধীরে ধীরে অতিবাহিত হলো।মহলের এক কোণায় পড়ে রইলো সুসজ্জিত বাক্সটি।

আজকের সময়টা যেন অতিদ্রুত গড়িয়ে যাচ্ছে।তাসবীর উন্মাদের ন্যায় ছুটছে আলোকে পাওয়ার আশায়।চাচা চাচীর শেষ চিহ্ন ছিল আলো আর আজ যদি আলোর অপ্রত্যাশিত কিছু হয়ে যায় তাহলে সারাজীবনের জন্য অপরাধীর ন্যায় বেঁচে থাকতে হবে তাদের।মহলের এক কোণে থাকা বাক্সটি দেখে তাসবীর ব্রু কুঁচকলেন।এগিয়ে গেলেন বাক্সের সম্মুখে।বাক্সের উপরে সফেদ কাগজে ফারসি ভাষায় একটি লাইন লেখা।তাসবীর দ্রুত ফারসি ভাষায় সেই লাইনটি পড়লেন।তার অনুবাদ করতেও খুব একটা বেশি সময় লাগলো না।যেখানে লেখা ছিল ‘ধ্বংসের প্রথম প্রহর’।মুহূর্তে আতঙ্কে কাঁপতে শুরু করেন তাসবীর সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে গলা খেঁকিয়ে ডাকলেন উজির আতেফ’কে।তাসবীরের এমন অদ্ভুত আচরণ এর আগে মহলের কেউ দেখেনি তাই সেনাপ্রধান সহ অনন্য দাসীরা বেশ ভড়কে গেলেন।

” আদেশ করুন শাহজাদা।”

“উজির মশাই এ..এ বাক্স এখানে কেন?কে পাঠিয়েছে এই বাক্স?”

” তিনজন বণিক এনেছে সম্রাটের উপঢৌকন।”

” ক..কিসের বণিক এক্ষুনি ডেকে আনো তাদের।”

” বাক্সটি দিয়ে তারা চলে গেছেন শাহজাদা।কোন সমস্যা হয়েছে?আপনাকে এমন লাগছে কেন?”

তাসবীর সে কথার প্রত্যুত্তর করলেন না।খুব দ্রুত হাঁটু মুড়িয়ে বসে তালা বদ্ধ বাক্সটি খোলার চেষ্টা চালালেন।একজন তালা ভেঙ্গে সাহায্য করলো তাসবীরকে।বাক্সের ডালা সরিয়ে আলোর র/ক্তা/ক্ত নগ্ন লা/শ দেখে ছিটকে সরে গেলেন তিনি।ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে সিটিয়ে গেলেন দেয়ালের সঙ্গে।উপস্থিত সকলে বাক্সটি পরখ করতে নির্বাক ভঙ্গিমায় দ্রুত সরে গেলেন।সেনাপ্রধান রউফ খুব দ্রুত পুনরায় ডালা ফেলে দিলেন বাক্সটির।একজন দাসী ভয়ে আহাজারি শুরু করছেন।

” আল্লাহ আল্লাহ এ দৃশ্য দেখার আগে অন্ধ হলাম না কেন আল্লাহ!আমাদের আলো আর নেই!”

এক কান থেকে দু’কান ধীরে ধীরে সমস্ত আহমেদাবাদ রাজ্যে ছড়িয়ে পড়লো নৃশংস ভাবে আলোর হ/ত্যার ঘটনা।এমন ব্যভিচার ভাবে এর আগে কেউ মা/রা যায়নি এই রাজ্যে।আলোর মৃ/ত্যু নিয়ে প্রজাদের আগ্রহের কমতি নেই।ধীরে ধীরে ভিড় বেড়ে চলেছে প্রাসাদের মূল ফটকে।এমন নিষ্ঠুর পরিস্থিতিতে অচেতন,অচল,বাক্যহীন তাসবীর।

২৭.
আহমেদাবাদ রাজ্যে ছেড়ে অন্য অঞ্চলে এসে থেমেছে শাহজাদা ইবনুলের দলবল।এখন রাত্রি গভীর।নাম না জানা এক জঙ্গলে তাঁবু টানিয়েছে সৈন্য’রা।চারিদিকে তাঁবু টানিয়ে মোট একশ সাতজন সৈন্য নিজ নিজ তাবুতে ফিরে গেছেন।অন্য একটি তাবুতে অবস্থান করছে মালা নামের মেয়েটি।একা একা দুশ্চিন্তায় পড়েছে সে।হঠাৎ কেমন যেন অনুশোচনা জাগলো তার।রাজকন্যা আলোর সঙ্গে বেইমানি করা মোটেও ঠিক হয়নি কিন্তু নিজের ভালোর জন্য এই বেইমানি করতেই হতো।

অন্য তাবুতে অবস্থান করছেন শাহজাদা ইবনুল।হাতে তার অর্ধ খাওয়া আপেল।রাজকীয় ভঙ্গিমায় বসে ব্যক্তিগত প্রহরীর সঙ্গে গল্পগুজবে ব্যস্ত তিনি।

” সম্রাট সিদ্দীক এতক্ষণে নিশ্চয়ই বাক্সটি দেখে ফেলেছে।মেয়ের নগ্ন দেহ দেখে আবার না মূর্ছায় প্রাণ যায়।গেলেও অবশ্য মন্দ নয় কি বলো প্রহরী?”

” জি সম্রাট।”

” মালা নামের মেয়েটি কোথায়?”

” তিনি অন্য তাবুতে আছেন।”

জিভ দিয়ে ঠোঁট ভেজালেন ইবনুল।সরু চোখে চাইলেন প্রহরীর দিকে।আরেকটি প্রাণ বিদায় নেওয়ার ইঙ্গিত প্রহরী যেন খুব সহজেই পাচ্ছে ভাবতেই শিউরে উঠলো প্রহরী।

” মালাকে আমি বলেছিলাম যদি রাজকন্যা আলোকে আমার সামনে অন্তরালে হাজির করতে পারে তাহলে তাকে আমি আমার রাজ্যে নিয়ে যাব এবং আমার স্ত্রীর মর্যাদায় তাকে গ্রহণ করবো।যতদিন মালা বেঁচে থাকবে রাজকীয় জীবনে থাকবে। প্রহরী তোমার কি মনে হয় মালাকে বিয়ে করবো?”

” আজ্ঞে না শাহজাদা।”

” মালাকে তাহলে আমি কি করবো?”

” রাজকন্যা আলো’র সাথে যা করেছেন তা।”

নত মস্তকে উত্তর দিলেন প্রহরী।প্রহরীর অনুমান ঠিক দেখে হো হো শব্দে হেসে উঠেন ইবনুল।গা তুলে বসলেন আয়েশ ভঙ্গিতে।

” বাহ আমার সঙ্গে চলতে চলতে বুদ্ধি তোমার খুলেছে।অনুমান সঠিক হয়েছে প্রহরী।উপহার সরূপ একশ দিরহাম দিলাম তোমায়।”

প্রহরী দিরহামের পুটলিটা হাতে তুলে নিলেন।অর্থ লোভে এক গাল হাসি দিলেন তিনি।শাহজাদার ভাব ভঙ্গিমায় বেশ ভালো করেই বোঝা যাচ্ছে তিনি বেশ আমোদে আছেন।

” তাহলে দেরি করছো কেন?মালাকে নিয়ে এসো তাবুতে।বেইমানদের বেঁচে থাকার অধিকার নেই।পিতামাতা হীন মালার জীবনের দায়িত্ব নিয়েছিলেন সম্রাট সিদ্দীক।আলোর মতোই তাকে ভালোবাসতো সকলে কিন্তু শেষ কালে বেইমানিটা না করলেও পারতো।সে যাই হোক নীতি কথা আমায় মানায় না শাহজাদা ইবনুল রাশীদকে মানায় নারীর শরীরে।”

নিজের কথায় নিজেই হাসলেন ইবনুল রাশীদ।হাতের অর্ধ-খাওয়া আপেলটি শেষ করে প্রহরীকে নির্দেশ করেন,

” মালাকে নিয়ে এসো প্রহরী।”

রাত যত শেষ হতে লাগলো আসতে আসতে মালার দেহ থেকে প্রাণটাও বেরিয়ে যেত লাগলো।আলোর মতো তার শরীরটাও বিষাক্ত যন্ত্রণায় ছটফট করতে কর‍তে দেহ থেকে প্রাণ বেরিয়ে গেল।মেয়েটির অবচেতন মন তখন একটাই ইঙ্গিত দিচ্ছিল, ‘একি বিশ্বাসঘাতকতা’র উপহার?’

২৮.
চোখের পলকে পালটে গেল আহমেদাবাদ রাজ্যের প্রাসাদের কার্য পরিচালনা।সকলেই যেন ঝিমিয়ে গেছে যে প্রাসাদ জুড়ে ছিল
সুখে আনন্দেরা সে প্রাসাদে আজ বিষণ্ণরা ধরা দিয়েছে।আলোর মৃত্যুর একদিন পার হলো।সম্রাট সিদ্দীক আকস্মিক বুকে ব্যথা নিয়ে মূর্ছা যান এরপর আর চোখ মেলেন’নি তিনি।চেতনাহীন বিছানায় লেগে আছে দায়িত্বশীল মানুষটা।উজির তার সর্বোচ্চ দিয়ে সম্রাট’কে সুস্থ করার চেষ্টায় আছে কিন্তু আর চোখ মেলেনি সম্রাট।তার বড় বড় নিশ্বাস প্রশ্বাসের যে আন্দোলন তা দেখে যেন ক্লান্ত সম্রাজ্ঞী বিনিতা।সম্রাটের পাশ থেকে এক মুহূর্তের জন্যেও নড়েন’নি।একদিকে মেয়ের শোক অপর’দিকে স্বামীর চেতনাহীন অবস্থা ধীরে ধীরে যেন উন্মাদ করে তুলছে সম্রাজ্ঞীকে।

নিজের কক্ষের অলিন্দে বসে একটি পত্রের নিকট স্থির চোখে তাকিয়ে আছেন তাসবীর।পত্রটি র/ক্তে মাখামাখি।সেদিন আলোকে বাক্স থেকে বের করার পর পত্রটি পাওয়া যায় যেখানে লেখা ছিল,

‘ এবার থেকে যা হবে তা আমাদের জন্য উত্তম কিন্তু আহমেদাবাদের জন্য অভিশাপ।সময় এসেছে পাল্টা প্রতিক্রিয়ার।আমরা আর ঝিমিয়ে নেই দেখা হচ্ছে দেখা হতেই হবে।’

ইবনুল রাশীদ।

ইবনুলের প্রতি জমানো ঘৃণা আরো তীব্র থেকে তীব্রতর ধারণ করেছে তাসবীরের মনে।ঘৃণায়,ক্রোধে বার বার কেঁদে উঠছে সে।চোখের জলের বাঁধ কিছুতেই মানছে না।একদিকে সম্রাট আব্বাসের জীবন মরণ সংকট অপরদিকে সম্রাজ্ঞী ধীরে ধীরে নেতিয়ে পড়া,রাজ্যের বিপর্যস্ত অবস্থা সব, আলোর হত্যার বদলা, সব মিলিয়ে নিজেকে পাথর করে নিলেন তাসবীর।র/ক্তা/ক্ত পত্রটিতে হাত রেখে দৃঢ় স্বরে বলে,

” তোর এই রক্তে ছুঁয়ে বলছি ইবনুল রাশীদের পতন হবে।সম্রাট আব্বাসের পতন হবে।সমস্ত অলকপুরী আমার হবে।”

তাসবীর কাঁদতে কাঁদতে নিজের কক্ষে প্রবেশ করলেন।আরশির কাছটায় দাঁড়িয়ে ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসলেন,

“ইবনুল রাশীদ বোনের মৃত্যুর যন্ত্রণা তোকে আমি বোঝাব।ভাগ্যক্রমে তোর ঘরেও ফুটফুটে বোন আছে তবে একই পথে হাঁটবো আমি।
রক্তের বদলা রক্ত,হ/ত্যার বদলা হ/ত্যা, ব্যভিচারের বদলা ব্যভিচার।
আলোর মৃত্যু আর আরওয়ার মৃত্যু….’

কথা শেষ না করেই হাসলেন তাসবীর।তার কুটিল হাসির ছন্দে দ্বারে এসে থেমে গেলেন উজির আতেফ।ভ্রু কুচকে সন্দিহান মনে বলেন,
“এত অদ্ভুত ভাবে হাসছেন কেন শাহজাদা?”
#চলবে___

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here