বিধুর রজনী পর্ব -১০+১১

#বিধুর_রজনী
#পলি_আনান
[পর্ব সংখ্যা ১০]
_____________________
১৯
সম্রাট সাঈদের চিঠির উত্তর পাঠালেন না শেহজাদী বিষয়টি নিয়ে ক্ষুব্ধ হলেন সাঈদ।যাকে বিবাহ করবেন যে মেয়ে তার স্ত্রীর মর্যাদা লাভ করবে সেই মেয়ে যদি হয় এতটা উদাসীন তাহলে সম্রাট কি ক্ষুব্ধ না হয়ে পারেন!শেহজাদী তখন খাস দাসী লতাকে নিয়ে গল্পগুজবে ব্যস্ত কক্ষে সে সময় প্রবেশ করেন একজন দাসী।

” আসবো শেহজাদী?”

” এসো।”

দাসী নত মস্তকে কুর্নিশ করলেন শেহজাদিকে।

” সম্রাট আপনাকে স্মরণ করেছেন।তিনি আপনার জন্য নিজ কক্ষে অপেক্ষা করছেন।”

” আসছি আমি।”

দাসী পুণরায় মাথা নত করে চলে গেলেন।শেহজাদী চিন্তিত মনে এগিয়ে গেলেন সম্রাটের কক্ষে।

” আসবো পিতা?”

” হুম। ”

শেহজাদী কক্ষে প্রবেশ করে নত মস্তকে কুর্নিশ করলেন তার পিতা’কে।
সম্রাট আব্বাসের চোখ মুখ কেমন যেন রাগী ভাব ধারণ করেছে।দু’হাত পেছনে মুড়িয়ে কক্ষ জুড়ে পাইচারি করছেন তিনি।সম্রাটের রাগী রাগী ভাব শেহজাদী ধরতে পারলেও তবে রেগে যাওয়ার কারন বুঝতে পারলেন না।

” সাঈদ তোমাকে পত্র পাঠিয়েছে?”

” জি।”

” কতদিন হলো পত্র পাঠানোর?”

” নয়দিন হয়েছে পিতা।”

” তুমি কি তার পত্রের প্রত্যুত্তর পাঠিয়েছ?”

” জি না।”

ফসফস শব্দে শ্বাস ছাড়লেন সম্রাট।পাইচারি থামিয়ে এগিয়ে এলেন মেয়ের সম্মুখে।নিজের রাগ সংবরণ করার চেষ্টা করলেন খুব করে।

” কেন পাঠাও নি?সে পত্রে কি লিখেছে আমার জানা নেই।তবে তোমাকে কিছু প্রশ্ন করেছে তার উত্তর পাওয়ার আশায় সে দিন গুনছে তুমি কেন পত্র পাঠাওনি?”

” প্রয়োজন বোধ করিনি।”

” চুপ করো।সম্রাট সাঈদ দূত পাঠিয়েছে সে যত দ্রুত সম্ভব তোমার পত্রে তার প্রশ্নের উত্তর চায়।এক্ষুনি পাঠাগারে যাবে আমি দোওয়াতদার’কে পাঠাচ্ছি সে সব কিছুর ব্যবস্থা করে দেবে।তুমি নিজ হাতে পত্র লিখবে। যাও।”

শেহজাদী নত মস্তকে পুণরায় বেরিয়ে যান কক্ষ ছেড়ে।প্রচন্ড ক্রোধে শরীর জ্বলছে তবুও পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে চুপচাপ এগিয়ে যান পাঠাগারের দিকে।
.

‘ মহান তেলিকোনা রাজ্যের – সম্রাট সাঈদ,

আপনি আমার পত্রের উত্তরের অপেক্ষায় আছেন যেনে ব্যথিত হলাম।এই রহস্যময় ধরণি সৃষ্টি করেছেন মহান আল্লাহ তায়ালা।তিনি আমাদের মানুষ জাতির সৃষ্টি করেছেন।আমরা প্রত্যেকেই একে অপরের থেকে ভিন্ন।আমাদের চাওয়া পাওয়া গুলো ভিন্ন অথবা অভিন্ন।
তেমনি আমার চাওয়া পাওয়া হয়তো অনন্য রাজ্যের শেহজাদীদের তুলনায় ভিন্ন।আমি যাকে বিবাহ করতে চাই সে রাজ্য জয়ে নয় বরং সে শুধু আমার মন জয়ের ধ্যানে থাকবে।দিনমণি’র সমাপ্তি জানিয়ে যখন দীর্ঘ রজনী এই পৃথিবীর বুকে ধরা দেবে তখন সে আফিমের নেশায় কিংবা শরাব পানের নেশায় আচ্ছন্ন না থেকে আমার ভালোবাসার নেশায় আচ্ছন্ন থাকবেন।আমি তাকে বিবাহ করতে চাই যার কাছে তার পিতা মাতার পর আমার মূল্য সবচেয়ে বেশি থাকবে।আমি এমন কাউকে চাই না যার সান্নিধ্যে পেতে হলে আমাকে দিনে চার,পাঁঁচ বেলা কুর্নিশ করতে হবে।আমি অতি সাধারণ কাউকে চাই।আপনি নিঃসন্দেহে অসাধারণ ব্যক্তি বেশ অল্প বয়সে সিংহাসন আহরোণ করেছেন,রাজ্যে দখলে আপনি পটু তবে আমার মন দখলে পটু হতে পারেন নি।আমার চাওয়া পাওয়া বিবেচনায় রেখে মর্জনা করবেন আমায়।
ইতি শেহজাদী আরওয়া নূর ‘

পত্রটি পড়ে বেশ মুগ্ধ হলেন সম্রাট সাঈদ।তিনি হাসলেন রহস্যপূর্ণ ভাবে।তৃষ্ণার্ত হাতের ছোঁয়ায় বার বার ছুঁয়ে দিলেন আরওয়ার পত্রটি।পুণরায় দোয়াত কাগজ হাতে তুলে লিখতে বসে গেলেন,

‘ অপ্সরী শেহজাদী আরওয়া নূর

আমার চোখে আপনি ফুলের মতো কোমল আদুরে।তাই বলছি নিশ্চিন্ত মনে আমার জীবনের সঙ্গীসাথি হোন।এ দেহে যত দিন প্রাণ থাকবে ঠিক ততদিন নিজের ছাঁয়ায় মিশিয়ে রাখবো আপনাকে।

ইতি সম্রাট সাঈদ। ‘

সম্রাটের সাঈদের চিঠি পড়ে বেশ অবাক হলেন আরওয়া।মানুষ’টাকে দূরে সরানোর রাস্তা কিছুতেই খুঁজে পাচ্ছেন না তিনি।তাসবীরের সাথে এই মুহূর্তে দেখা করা ভীষণ জরুরি হয়ে পড়েছে কিন্তু ছেলেটার দেখা পাবে কি করে?দেখা করলে আরেক বিপদ সম্রাট আব্বাসের কানে বিষয়টি প্রহরীরা পৌঁছে দেবে।শেহজাদীর ভাবনার মাঝে ছুটে এলেন খাসদাসী লতা।তার বিচলিত মুখচ্ছবি দেখে বেশ ভড়কালেন শেহজাদী।

” কি হয়েছে লতা এভাবে ছুটছো কেন?”

“একজন গর্ভবতী দাসীর বেদনা উঠেছে…”

কথা শেষ করার আগেই থেমে গেল লতা।সে খুব করে শ্বাস নিচ্ছে।নিজেকে স্থির করে পুণরায় বলতে শুরু করে,

” মেয়েটা খুব ছটফট করছে শেহজাদী।”

” দ্রুত ধাত্রী’কে খবরদাও?”

” দিয়েছিলাম কিন্তু বড় শাহজাদা ধাত্রী’র প্রবেশ নিষিদ্ধ করেছেন।আর গর্ভবতী দাসীকে নিয়ে প্রাসাদ ছেড়ে চলে যেতে বলেছে।তিনি সাফ সাফ জানিয়ে দিয়েছেন একজন দাসীর সন্তান এই প্রাসাদে হবে না।আপনি কিছু একটা করুন শেহজাদী মেয়েটা ম-রেই যাবে।”

শেহজাদী আরওয়া ক্ষুব্ধ হলেন।গায়ের উত্তরী ভালোভাবে জড়িয়ে দিয়ে লতাকে সঙ্গে নিয়ে যান শাহজাদা ইবনুলের কাছে।

” এ আমি কি শুনছি ভাইজান ধাত্রীর প্রবেশ নিষিদ্ধ করেছেন কেন?”

শাহজাদা ইবনুল কড়া দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন লতার দিকে।মেয়েটা ভয়ে চুপসে শেহজাদীর পেছনে দাঁড়ায়।ইবনুলের চাহনী বুঝতে পেরে শেহজাদী পুণরায় বলে,

” ধাত্রীকে প্রবেশ করতে দিন ভাইজান প্রসব বেদনায় মেয়েটি মা/রাও যেতে পারে।”

” এসব তোমাকে বুঝতে হবে না আরওয়া।তুমি তোমার কক্ষে যাও আমি আমার ফরমান জারি করেছি এই প্রাসাদে একজন দাসীর জন্য কোন ধাত্রী প্রবেশ করতে পারবে না।”

” আপনি যদি সম্রাট আব্বাসের পুত্র হোন ভুলে যাবেন না আমিও সম্রাট আব্বাসের কন্যা।ফরমান জারি করার ক্ষমতা আমারো আছে।আমি বলছি ধাত্রী প্রবেশ করবে এবং দাসীর বাচ্চা এই প্রাসাদেই হবে।”

দুই ভাই বোনের বাদপ্রতিবাদের মাঝে সেখানে উপস্থিত হন সম্রাজ্ঞী শাহাবা।শাহজাদা ইবনুলকে অনেকবার বোঝানো স্বত্ত্বেও কিছুতেই ধাত্রীর প্রবেশের অনুমতি দেয়নি।বাধ্য হয়ে শেহজাদী আরওয়া সম্রাট আব্বাসের নিটক অভিযোগ পেশ করে এবং ধাত্রীর প্রবেশের অনুমতি চাইলে তিনি নিঃসংকোচে অনুমতি দেন।

ঘাতপ্রতিঘাত পেরিয়ে অবশেষে দাসীর কোল আলো করে আসে একটি কন্যা সন্তান।কক্ষের বাইরে তখন উপস্থিত ছিল আরওয়া,শাহাবা এবং আরওয়ার ফুফু আসমা।লতা সফেদ কাপড় জড়িয়ে বাচ্চাটিকে নিয়ে কক্ষ ছেড়ে বেরিয়ে আসে এবং শেহজাদীর সম্মুখে দাঁড়ায়।

” বাচ্চার মা বলেছেন প্রথমে যেন আপনার কোলে দেওয়া হয় আর আপনি বাচ্চাটির পছন্দ মতো নাম রেখে দিন শেহজাদী।”

শেহজাদী আরওয়া চমকে গেলেন।সদ্য জন্মানো শিশু এর আগে কখনো কোলে নেওয়ার মতো অভিজ্ঞতা হয়নি তার।উচ্ছ্বসিত হয়ে কাঁপা-কাঁপা দু’হাত এগিয়ে দিলেন শেহজাদী।কিন্তু এত আনন্দঘন মুহূর্তে বাদ সাধলেন শেহজাদীর ফুফু আসমা।

” এই এই খবরদার শেহজাদীর কোলে কিছুতেই বাচ্চাকে দেবে না।বলা তো যায়না এই মেয়ের ছাঁয়া পড়লে বাচ্চাটা আর বেঁচেও থাকবেনা।”

যতটা আনন্দ নিয়ে হাত বাড়ালেন ঠিক ততটা অপমানে হাত সরিয়ে নিলেন আরওয়া।নত মস্তকে চোখ বন্ধ করে হজম করলেন সবটা।শাহাবা খানিকটা রেগে গেলেন ফুফু আসমা উপর,

” এ কেমন কথা আপা।আমার মেয়েটাকে নিয়ে যা ইচ্ছে তাই বলতে পারেন না।আমার আরওয়া কতটা লক্ষ্মী সেটা আমি জানি।দুই পুত্রের পর দীর্ঘ অপেক্ষার প্রহর কাটিয়ে যখন কোল আলো করে আমার আরওয়া মা এলো তখন এই ভুবনের সবচেয়ে সুখী ব্যক্তি আমি ছিলাম।”

” তুমি ছিলে শাহাবা কিন্তু আমার ভাই ছিল না।ভুলে গেলে তুমি সেদিনের কথা?”

” না আমি ভুলিনি।যা আল্লাহর পূর্বে নির্ধারিত তা হবেই সেটা অন্যের ভাগ্যে ফেলার কিছুই নেই আপা।”

” মুখে মুখে তর্ক দেখছি বেড়ে গেছে ভাইকে বলে নতুন সম্রাজ্ঞীর ব্যবস্থা করতে হবে।তখন সতীনের ঘর করতে পারবে?”

শাহাবা চুপ করে গেলেন।দাসী লতা গোল গোল চোখে তাদের ঝগড়া দেখছিলেন।শেহজাদীর প্রতি তাদের এত বিতৃষ্ণা কেন বুঝতে পারেনা সে।লতা দৃঢ় কন্ঠে বলে,

” যা হবার হবে শেহজাদী আপনি বাচ্চাটা কোলে নিন। এবং নাম দিন আপনার উচিলায় বাচ্চাটা এ ধরণির আলো দেখেছে না হলে এতক্ষণে….!”

শেহজাদী বাচ্চাটাকে কোলে তুলে নিলেন।তীব্র অপমানে তার চোখ থেকে অশ্রু ঝরছে।

” তোমার নাম দিলাম সোহাগী।যার অর্থ ভাগ্যবান।”

দাসী লতার হাতে বাচ্চাটিকে দিয়ে গলায় থাকা ভারী স্বর্ণের চেন খুলে বাচ্চাটির গলায় পরিয়ে দিল শেহজাদী।তা দেখে আসমা আরো ক্ষেপে গেল।কিন্তু তাতে গা লাগালো না শেহজাদী।

২০.
শেহজাদীর অপেক্ষার প্রহর ক্রমশ বাড়ছেই।আজ সারাটা’দিন তাসবীরের অপেক্ষায় ছিলেন তিনি।কিন্তু তাসবীরের সাক্ষাৎ মেলেনি।মনে জমানো কথাগুলো যতক্ষণ না তাসবীর’কে বলছে শান্তি নেই এক ফোঁটা শান্তিও মনে আসবে না।বাধ্য হয়ে লতাকে ডেকে পাঠালেন তিনি,

” লতা অতিথি তাসবীর কী প্রাসাদে আছেন?”

” এ বিষয়ে আমি কিছু জানি না শেহজাদী।”

” খোঁজ নিয়ে জানাও যদি তিনি প্রাসাদে থাকেন তবে আমার কক্ষে আসতে বলো।”

লতা দ্রুত বেরিয়ে যায় তাসবীর’কে খবর দিতে।তাসবীর তার কক্ষেই ছিল শেহজাদীর বার্তা পেয়ে এক মুহূর্ত ব্যয় না করেই ছুটে যান শেহজাদীর কক্ষে।

” কেমন আছেন আরওয়া?”

” কোথায় ছিলেন আপনি?”

” আমার অপেক্ষায় ছিলেন বুঝি?”

তাসবীরের অসংগত হাসির মাঝে প্রত্যুত্তের করলেন না তিনি।বড় কড়া দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন তাসবীরের উপর।

” জরুরি কথা ছিল।সম্রাট সাঈদ যে পত্র পাঠিয়েছেন তার পত্রের উত্তর জানাতে আমি যে পত্র পাঠিয়েছি সেখানে স্পষ্ট জানিয়েছি আমি তাকে চাই না।কিন্তু তিনি ফের পত্র পাঠান।”

” সম্রাট সাঈদ কি লিখছেন পত্রে?”

” তিনি আমাকেই চান এবং আমি যেন তার সঙ্গীসাথী হই।কয়েকদিন পরেই বিবাহের দিন নির্ধারিত হবে আমি কি করবো তাসবীর?আমায় নিয়ে পালিয়ে যান এই ছাড়া পথ দেখছি না যে।”

” আগামীকাল উষালগ্নে সম্রাট আব্বাস আমায় প্রাসাদ ছেড়ে যেতে বলেছেন।আশা করি বুঝতে পারছেন আপনার সঙ্গে আমার আর দেখা হবে না।”

চাতক পাখীর ন্যায় ছটফটিয়ে উঠলেন শেহজাদী।

” এ হয় না আপনি আমায় ছেড়া চলে যাবেন?তবে আমার কি হবে?”

” যা বলছি শুনুন হরিৎ বনে যে বৈরাগী’র বসবাস….”

তাসবীরের কথা শেষ হওয়ার আগেই চমকে উঠলেন শেহজাদী।

” আপনি সেই বৈরাগী’কে চিনেন?”

” হ্যা চিনি।তার মাধ্যেমে আমি গোপনে খবর পাঠাবো আপনাকে।নির্ধারিত দিনে আপনি সেজে থাকবেন আর সেদিনি আমরা বিয়ে করবো।”

” বি…বিয়ে!”

” কেন আপনি কি মত পাল্টাচ্ছেন?”

” না না তা নয় আমি অপেক্ষায় রইবো আপনার।”

তাসবীর নিশ্চিন্ত মনে হাসলেন।তবে আরওয়া নিশ্চিন্তে হাসতে পারলেন না।মনে মনে চলছে দারুন চিন্তা।কি হবে এরপর!
#চলবে___#বিধুর_রজনী
#পলি_আনান
[পর্ব সংখ্যা ১১]
__________________
২১.
সন্ধ্যা নামতে আর দেরি নেই।সূর্যটা তার তেজ কমিয়ে ধীরে ধীরে পতিত হচ্ছে পশ্চিম আকাশে।দীর্ঘদিন ভ্রমণ শেষে আজ বাড়ি ফিরছে আহমেদাবাদ রাজ্যের রাজপুত্র।যদিও এ সম্পর্কে সম্রাট কিংবা সম্রাজ্ঞী কেউ অবগত নয়।প্রাসাদের মূল ফটকে দাড়িয়ে আছে দুইজন দ্বাররক্ষী তারা তাদের দায়িত্ব পালনে সর্বদা সচেষ্ট।সফেদ পাঞ্জাবি মাথায় টুপি এবং পাতলা কাপড়ে মুখ ঢেকে একজন জনৈক ব্যক্তি এগিয়ে এলেন প্রাসাদের মূল ফটকে।বিনা অনুমতি’তে প্রবেশ কর‍তে চাইলে তাকে রুদ্ধ করে দু’জন দ্বাররক্ষী।

” কাকে চাই?কে আপনি?আপনার পরিচয়?”

” সম্রাট সিদ্দীক আছেন?”

” তিনি প্রাসাদেই আছেন।আপনার পরিচয় দিন আগে।”

জনৈক ব্যক্তি কাপড়ের আড়ালে মিহি হাসলেন।হাতে থাকা তল্পি নিচে নামিয়ে সরিয়ে দিলেন মুখের কাপড়।তাকে দেখে প্রথমে অবাক হলেও পরবর্তীতে বিস্ময়ে হেসে উঠেন দু’জনের মাঝে একজন দ্বাররক্ষী।তিনি নত মস্তকে কুর্নিশ করলেন জনৈক ব্যক্তিকে।

” ভেতরে আসুন শাহজাদা ভেতরে আসুন।কি মুশকিল আপনাকে যে চিনতে পারিনি।ক্ষমা করবেন আপনাকে দাঁড় করিয়ে রেখেছি বলে।”

” ব্যস্ত হবেন না।আমি ঠিক আছি।অনেকদিন পর প্রাসাদে এলাম আপনারা ভালো আছেন?”

” আলহামদুলিল্লাহ আলহামদুলিল্লাহ আমরা ভালো আছি শাহজাদা আপনি এক্ষুনি ভেতরে যান।”

অনুমতি’তে জনৈক ব্যক্তি প্রাসাদে প্রবেশ করেন।

জনৈক ব্যক্তির মাধুর্য ব্যবহারে বেশ সন্তুষ্ট হন দ্বাররক্ষী।তবে পাশে থাকা নব্য দ্বাররক্ষী চিনতে পারেনি ব্যক্তিটিকে।

” মশাই উনি কে?শাহজাদা বলে অভিবাদন করলেন যে?”

” আরে বো/কা এখনো চিনতে পারো নি?সম্রাট সিদ্দীকের একজন পুত্র আছে সেটা তো জানো।”

” হ্যা জানি।”

” উনি হলেন রাজপুত্র তাসবীর।আবু সিদ্দীকের একমাত্র পুত্র আবু তাসবীর!”

বিস্মিত চোখে প্রাসাদের ভেতরে তাকালেন দ্বাররক্ষী।এত সাধারণ সাধাসিধা একজন ব্যক্তিকে কিছুতেই কি রাজপুত্র ভাবা যায়?কে বা ভাববে?

” কিন্তু সম্রাটের পুত্রের নাম তো শুনেছি বীর।সবাই বীর বীর বলেই ডাকে।”

” সে একই যে বীর সে তাসবীর।”
.
সন্ধ্যা নামার পর আহমেদাবাদের প্রাসাদে যেন আনন্দেরা ঝাপিয়ে পড়েছে।অনেকদিন পর ঘরের ছেলে ঘরে ফিরেছে।এই নিয়ে যেন আনন্দের শেষ নেই।সম্রাজ্ঞী ‘বিনিতা’ অর্থাৎ তাসবীরের মাতা নিজের হাতে আজ পুত্রের জন্য সব আয়োজন করছেন।ক্লান্ত শরীর’রা নিয়ে নিজের কক্ষে প্রবেশ করেন তাসবীর।নিজের কক্ষ’টাকে রমরমা না রেখে সম্পূর্ণ সাধাসিধা ভাবে সাজিয়ে তুলে ছিলেন।কিন্তু তার অবর্তমানে সম্রাজ্ঞী বিনিতা পুণরায় কক্ষটি নিজের হাতে সাজান একজন রাজপুত্রের কক্ষ কি না এত সাধাসিধা কিছুতেই মানতে পারেন না তিনি।কক্ষে নতুন করে আলিশান পালঙ্ক,নকশা খচিত সুন্দর আরশি,প্রদীপদানি ফুলদানি দিয়ে সজ্জিত করেছেন।সারা কক্ষে চোখ ঘুরিয়ে কিঞ্চিৎ হাসলেন তাসবীর।এক পা দু’পা করে এগিয়ে গেলেন আরশির কাছটায়।স্বচ্ছ আরশিতে যেন তিনি শেহজাদী আরওয়ার প্রতিবিম্ব দেখতে পান।মুহূর্তে খুশি খুশি ভাবটা মিলিয়ে গেল তাসবীরের,মনে চেপেছে দারুন বিষাদ। চৈত্রের খরার ন্যায় খা খা করে উঠে বুকটা।আরশি ছুঁয়ে শেহজাদিকে ভাবার চেষ্টা করেন তিনি।

” আমার আরওয়া এত শত চাকচিক্যের মাঝেও তোমার মনে শান্তি নেই।তোমার এই অশান্ত মনটা চাতক পাখির ন্যায় ছটফটিয়ে বার বার আমার কাছে আসতে চায়।কিন্তু কিচ্ছু করার নেই আমি এক দিশাহীন প্রেমিক।আগামীর দিন গুলো হয়তো আমাদের জন্য সুখকর নয়।তোমার ভাই এবং পিতা যে খেলায় নেমেছে তার যোগ্য জবাব তারা পাবে।সম্রাট সিদ্দীক’কে পরাজীত করে আহমেদাবাদ রাজ্যে দখল করা এত সোজা নয়।এই র/ক্তা/র/ক্তির খেলায় নিজেকে যে দুর্বল করা যাবে না আরওয়া নূর।তবে সে যাই হোক আমার ভালোবাসা আমার ঘরে ফিরবেই তাকে ফিরতেই হবে!”

তাসবীর কথা শেষ করে ঘুরে তাকায়।দ্বারের কাছটায় তখন দাঁড়িয়ে ছিল তার বোন আলো।তাকে দেখেই খানিকটা ঘাবড়ে যায় তাসবীর।

” আলো দাঁড়িয়ে কেন?ভেতরে আয় বোন।”

” তুমি কিছু বলছিলে ভাইজান?কার সঙ্গে কথা বলছো কক্ষে তো কেউ নেই।”

” ক..কই কিছু না।কবিতা বলছিলাম আয় কক্ষে আয়।

আলো হাসিহাসি মুখে প্রবেশ করে তাসবীরের কক্ষে।আলো নামের মেয়েটি তাসবীরের আপন বোন না হলেও মেয়েটিকে কেউ কখনো বুঝতেই দেয়নি তাসবীর তার নিজের ভাই নয় কিংবা সম্রাট সিদ্দীক সম্রাজ্ঞী বিনিতা তার আপন পিতা-মাতা নয়।সবাই ছোট থেকেই যত্নে আদরে লালন পালন করে বড় করে তুলেছে মেয়েটাকে।আলোর যখন চার বছর বয়স তখন যুদ্ধে মৃত বরণ করেন তার বাবা।স্বামীর মৃত্যুর কথা শুনে এক মূর্ছায় দেহ থেকে প্রাণ পাখি উড়ে যায় আলোর মায়ের।তারপর থেকেই এই তাসবীরের মা বাবা তার মা বাবা।

” কতদিন পরে এলে ভাইজান।তুমি মহলে থাক না কেন?জানো তোমার জন্য আমার কান্না পায় এত নিষ্ঠুর কেন তুমি?পিতা-মাতাকে ছেড়ে কি করে থাকো?”

” আমারো কষ্ট হয়।তবে তুই তো জানিস এসব জাঁকজমকপূর্ণ জীবন আমার পছন্দ নয়।আমি হলাম মুক্ত পাখি যেথায় ইচ্ছা সেথায় থাকি।”

দুই ভাই বোনের গল্প আলাপ বেশ কিছুক্ষণ যাবৎ চলতে থাকে।তার মাঝেই তাসবীরের কক্ষে এসে হাজির হয় একজন প্রহরী।

” সম্রাট আপনাকে স্মরণ করেছেন শাহজাদা।”

” পিতাকে বলুন আমি আসছি।”

২২.
হাতে তসবি নিয়ে অলিন্দ থেকে কক্ষে ফিরেন ইদ্রিস।জায়নামাজ মেঝে থেকে তুলে গুছিয়ে রাখলেন পালঙ্কের এক পাশে।সম্রাজ্ঞী শাহাবা তখন ইদ্রিসের কক্ষ দিয়েই যাচ্ছিলেন ছেলেকে তসবি জপতে দেখে ভেতরে প্রবেশ করেন তিনি।

” এশারের নামায আদায় করেছো বাবা?”

” জি মা নামায পড়া শেষ।”

” বলছিলাম কি তাসবীরের জন্য মনটা কেমন করছে এতটা দিন ছিল।”

” তাসবীর নিরাপদে এই প্রাসাদ থেকে বেঁচে ফিরেছে এটাই বড় কথা।আল্লাহর দরবারে খুশি হয়ে শোকরানা নামাজ আদায় করেছি মা।তাসবীরের যদি কিছু হয়ে যেত সারাটা জীবন আমি অপরাধী হয়ে থাকতাম।দস্যুদের হাত থেকে আমার জান বাঁচিয়েছে।তাছাড়া নূরের কথা ভুলে গেলে এর আগেও নূরের উপর হামলা করেছিল মারাঠা’রা হয়তো এবারো তা ঘটতে চলেছিল তাসবীরের কারণে পারেনি।”

মা ছেলের বাক্যালাপ আর দীর্ঘ হলো না সম্রাজ্ঞী শাহাবা বেরিয়ে গেলেন সম্রাট আব্বাদের ডাকে।এই সময়টা নৈশভোজের সময় সেখানে সম্রাটের পাশে উপস্থিত থাকবেন শাহাবা।
.
নৈশভোজের শেষে পুণরায় আসর বসেছে সম্রাট আব্বাসের নির্দেশে।আজ গুরুত্বপূর্ণ আসর এই আসরে আহমেদাবাদ রাজ্য দখলের কলাকৌশল নিয়ে আলোচনা সমালোচনা হবে।পূর্বের ন্যায় এবারো আমীর’রা উপস্থিত তবে এবারের আমীরের সংখ্যা বেশি প্রায় তেরোজন আমীর উপস্থিত সেখানে।এছাড়াও শাহজাদা ইবনুল,উজির হাযম,সেনাপতি ফারুক উপস্থিত হয়েছেন আসরে।সবাই কাতর চোখে তাকিয়ে আছেন সম্রাট আব্বাসের নিকট।সম্রাট আব্বাস উজির হাযমের দিকে সরু চোখে তাকিয়ে বলেন,

” তোমাকে দেওয়া সেই নির্দিষ্ট সময় শেষ হাযম।এবারো আমার সম্মুখে পেশ করো আহমেদাবাদ সম্পর্কে কি কি জানলে আর তাদের দূর্বল বিষয়গুলো।”

” শুরুতেই বলতে হয় আহমেদাবাদ রাজ্যের প্রজারা সম্রাট সিদ্দীকের অনুগত।এক কথায় সম্রাটের আদেশে তারা প্রাণ দিতেও বাধ্য।”

” আহ সেসব কথা জেনে আমার কাজ নেই।আমি জানতে চাই তার পরিবার পরিজন সম্পর্কে তার দূর্বলতা কি সেটাই বলো।”

” জি জি বলছি সম্রাট।সম্রাট সাঈদের একজন পুত্র ও কন্যা আছে।তবে পুত্রের সম্পর্কে খুব একটা বেশি কিছু জানতে পারিনি।কেননা সম্রাটের পুত্রকে কেউ ভালো করে দেখেওনি।ছেলেটা নাকি রাজ্যে থাকেনা।আর রাজ্যে সম্পর্ক তার কোন অভিলাষ নেই।সে নিজের মতো করে থাকতে পছন্দ করে।”

” পুত্র!সম্রাট সিদ্দীকের পুত্র আছে।কই আগে তো জানতাম না।তার নাম কি?”

” কয়েকজন বললো বীর।তার সম্পর্কে আর বেশি কিছু জানি না সম্রাট।”

উজির হাযমের কথা শেষ হতেই উত্তেজিত হয়ে পড়েন সম্রাট ইবনুল।

” আর কন্যা তার বিষয়ে কিছু বলো।”

” সম্রাট সিদ্দীকের বিবাহযোগ্য কন্যা।তিনি সম্রাটের কাছেই থাকেন।তাদের দূর্বলতা সম্পর্কে কিছুই জানতে পারিনি সম্রাট।যে শক্তি সামর্থ্য তাদের আছে রাজাধিরাজ সিদ্দীক’কে হারাতে বুদ্ধি কৌশল রপ্ত করা ছাড়া আর উপায় দেখছিনা আমি”

” কিন্তু আমি যে উপায় পেয়ে গেছি।এবার আহমেদাবাদ আমাদের দখলে আসবেই।পিতা যা ভাবার আমি ভেবে নিয়েছি।এবার শরাব পান শুরু করা যাক।”

গা দুলিয়ে কেমন যেন খিটখিয়ে হাসলেন শাহজাদা ইবনুল।তার কান্ডে নির্বাক তাকিয়ে রইলেন আমীররা।সম্রাট সিদ্দীক’কে হারানোর কৌশল ইবনুলের মাথায় এসেছে ভাবতেই উত্তেজিত হয়ে পড়ছেন সম্রাট আব্বাস।এত দিনের ইচ্ছে এত দিনে আকাঙ্খা, আশা সব তবে কি পূরণ হতে চলেছে।

২৩.
সম্রাট সিদ্দীক তার পুত্রের দিকে তাকিয়ে আছেন সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে।সারা শরীরের ক্ষতের দাগগুলো ঠিক কি কারণে হয়েছে তার প্রশ্নের উত্তর তাসবীর কিছুতেই দিতে চাইছে না।তাসবীর কখনো পিতার সম্মুখে দাঁড়িয়ে মিথ্যা বলেন’নি আর কখনো বলবেও না সে শিক্ষা সে পায়নি।

” বীর তুমি আমতা-আমতা করে কি বলছো?আশা করি তুমি কখনোই আমায় মিথ্যা বলবেনা যা বলবে সত্য বলবে।”

তাসবীর চোখ তুলে তাকায় সম্রাটের সিদ্দীকের দিকে।তিনি তার পুত্র’কে চোখ ইশারায় নিশ্চিন্তে জবাব দিতে বলে।তাসবীর একে একে অলকপুরী রাজ্যের সকল ঘটনা খুলে বলেন এমনকি আচমকা প্রণয়ে তিনি যে দূর্বল হয়ে পড়েছেন শেহজাদী আরওয়ার সম্পর্কে সবটা বলে থামলো তাসবীর।সম্রাট সিদ্দীক বেশ অবাক হলেন তবুও নিজেকে শান্ত রাখলেন।তেলিকোনা রাজ্য আর অলকপুরী এক হয়ে যে যু/দ্ধ এগিয়ে হানছে এই রাজ্যে তা ঠেকানো হয়তো মুশকিল তার মাঝে পুত্রের প্রণয় অত্যাচারী,লোভী সম্রাট আব্বাসের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলা ভাবতেই গা শিউরে উঠছে সম্রাট সিদ্দীকের।

” পিতা প্রজারা ভালো নেই একদম ভালো নেই।শাহজাদা ইবনুল মেয়েদের সতীত্বহানি করছে প্রাজারা খাজনা দিতে দেরি হলে অত্যাচারের শেষ পর্যায়ে নিয়ে ঠেকছে এমন শত শত কৃষক মারা গেছেন।এসব এবার বন্ধ করা জরুরি।আমি চাই অলকপুরী রাজ্যে আপনি দখল করবেন এবং প্রজাদের সুস্থ ভাবে বাঁচার সুযোগ করে দেবেন।”

তাসবীরের কথায় আসন ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন সম্রাট সিদ্দীক।পেছনে হাত গুটিয়ে খানিকটা পাইচারি করলেন।ওষ্ঠে হাসির লেশ রেখে বলেন,

” আমি পিতা হিসেবে আমার পুত্র তাসবীরকে বিশ্বাস করতে পারি।তবে প্রজাদের জন্য তোমায় বিশ্বাস করতে পারছিনা তাসবীর।প্রেমের তাড়নায় কোনটা ঠিক কোনটা ভুল হয়তো তার দিশা তুমি হারিয়ে ফেলবে।প্রজাদের জীবন নিয়ে তুমি হয়তো তখন ভাববে না কেননা ভালোবাসায় কাঙ্গাল হলে কেউ কেউ দিশাহীন হয়ে পড়ে।।সবার আগে আমার কাছে আমার প্রজাদের মর্যাদা।আমার প্রজারা ভালো থাকলে আমি ভালো।”

পিতার এমন কঠোর বাক্য শুনে থম মেরে রইলেন তাসবীর।তার পিতা কঠোর এবং প্রজাবৎসল তা তাসবীর জানে তাই খুব একটা ভেঙ্গে পড়লেন না তিনি।

” আমার পিতা আমায় যেহেতু বিশ্বাস করেন তাই আশা রাখছি এই বিষয়েও আমায় পূর্ণ বিশ্বাস করবেন।শেহজাদী অলকপুরী থেকে মুক্তি চান।আমি মুক্ত করবো তাকে তিনি আমার সাথে পালিয়ে যেতেও প্রস্তুত।”

” পালিয়ে যাওয়া কাপুরুষের কাম্য তা তুমি করবে?”

” কারো জীবন সঠিক পথে আনতে পালিয়ে যাওয়া কাপুরুষের কাজ নয়।আমি শেহজাদীকে সঠিক পথে আনতে চাই।তাকে স্ত্রীর মর্যাদা দিতে চাই।কিন্তু এতসব কিছুর মাঝেও আমি ভুলে যাইনি প্রজাদের দুঃখ কষ্ট।”

সম্রাট আব্বাস এগিয়ে গেলেন পুত্রের নিকট।কাধে হাত রেখে এক চিলতে হেসে আশ্বাস দিয়ে বলেন,

” বেশ শেহজাদী যদি সেচ্ছায় আসে তবে আমি নিজে তোমাদের বিবাহের ব্যবস্থা করবো।আশা করি আমার পুত্র বাকি সব সামলে নিবে।”
#চলবে___
❌কার্টেসী ছাড়া কপি করা নিষেধ❌
❌কার্টেসী ছাড়া কপি করা নিষেধ❌

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here