#বিনিময়
পর্ব-৫
ধীরে ধীরে জ্ঞান ফিরে আসলো লিসার। কিছুক্ষণ ধরে ব্রেন ব্ল্যাংক হয়ে ছিল তার। চোখের সামনে রুহান আর তার তিনটা বন্ধুকে দাড়িয়ে থাকতে দেখে সব মনে পড়লো লিসার। সেই সাথে সারা শরীরে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে তার।
.
রুহানও বুঝতে পারলো লিসার মনের অবস্থা। লিসাকে উদ্দেশ্য করে হাসি দিলো সে। লিসা উঠে দাড়ানোর চেষ্টা করলো কিন্তু হাত পা বাধা অবস্থায় একটুও নড়তে পারলোনা সে।
এত বড় বোকামি কেমন করে করলো লিসা! কেন সে আগেই এটা আন্দাজ করেনি। রুহানকে এভাবে জোর করে বিয়ে করেছে সে। প্রতিশোধ নিবে সে একটা সেটা জানা কথা। কেন আরো কেয়ারফুল হলনা লিসা?! এখান থেকে বের হবে কেমন করে?
.
রুহান তাকে জিজ্ঞাসা করলো, “কেমন লাগছে? আর ইউ কমফোর্টেবল? ”
লিসা উত্তর দিলনা।
চারপাশে তাকালো সে। রুমটা অন্ধকার আর পরিত্যক্ত মনে হচ্ছে। কতক্ষণ সে অজ্ঞান ছিল বুঝতে পারছেনা। কোথায় আছে সে এখন? ফিরে যাবে কেমন করে?
.
রুহান যেন তার মনের কথা বুঝতে পেরে বলল, “ফিরে যাওয়ার কথা চিন্তা করা লাগবেনা তোমার। দেখ তো জায়গাটা পছন্দ হয় কি না? এটাই তোমার নতুন ঘর. মৃত্যুর আগ পর্যন্ত এখানেই থাকতে হবে তোমার। ”
.
লিসা ভালোভাবেই বুঝতে পারছে ব্রেন ঠিকমত কাজে না লাগালে এ জায়গা থেকে আর জীবিত ফেরা লাগবেনা।
সে উত্তর দেয়, “তুমি যতক্ষণ আমার সাথে থাকবে ততক্ষণ আর কিছু লাগবেনা আমার”. কিছুটা ব্যঙ্গাত্মক ছিল তার কথাকথা। ।
.
রুহানের চোখ রাগে জ্বলে উঠলো। এই সময়েও এই মেয়ের মুখ থামেনা! একে কিভাবে লাইনে আনতে হয় তা তার খুব জানা আছে।
কিছু একটা বলতে যাবে রুহান, এই মুহুর্তে লিসা রুহানকে কমপ্লিটলি ইগনোর করে তার বন্ধুকে লক্ষ্য করে বলল, “জামিল ভাইয়া কেমন আছেন? বিয়েতে আসেননি কেন?”
তার আচরণ থেকে জামিল সহ সবাই অবাক হয়ে গেল। এ সময়ে মেয়েটার কান্নাকাটি করে হাতজোড় করার কথা তাকে ছেড়ে দেওয়ার জন্য আর সে এমন ক্যাজুয়ালি কথা বলছে যেন কিছুই হয়নি?!
.
নাকি এদের আসল চেহারা সম্পর্কে কোনো ধারণাই নাই এই বোকা মেয়ের?
সে কি মনে করছে রুহান আছে তাই সে সেফ? রুহানের জন্যই তো সে এখানে।
লিসার মনের মধ্যে যে ঝড় চলছে তা তো আর তারা দেখতে পারছেনা!
.
মুখে শান্ত ভাব রেখে লিসা বলল, “আপনার বোনকেও তো নিয়ে আসেননি বিয়েতে। কাজটা ঠিক করেননি। আমরা কত ভাল ফ্রেন্ড হতে পারতাম। তাকে একটু দেখেশুনে রাখবেন। সুন্দরী মেয়েরা সাধারণত বোকা হয় ।”
.
জামিলের বোনের কথা শুনে কান খাড়া হয়ে গেল সবার। এত ইনফরমেশন জানলো কেমন করে এই মেয়ে? রুহানের সব ফ্রেন্ডদের আর তার ফ্যামিলি কে এত অল্প সময়ে চেনা সম্ভব না।
আর জাহিদের বোনের কথা টেনে নিয়ে আসার পরিস্থিতি না এইটা।
.
জামিল বলল, “আমার বোনের চিন্তা করার মত পরিস্থিতিতে আছো বলে মনে হচ্ছে তোমার? চারপাশে তাকিয়ে দেখ।”
.
লিসা বলল, “তা কি করে হয়! আজকালকার পরিস্থিতি কি খারাপ। যেমন দেখেন আপনার বোন আজকে গান শিখতে গিয়েছে। কিন্তু আপনি জানতে পারলেন যে
সে ক্লাসে পৌছায়নি! কত ভয়ংকর ঘটনা বুঝতে পারছেন? রাস্তাঘাটে কতকিছু হয়! স্প্রে করে কিডন্যাপও হয়ে যেতে পারে।”
.
রুহান বলল, “এর মুখ বাধ কেউ। খুব কথা বলছে।”
জামিল রুহানকে থামিয়ে বলল, “আমার বোন আজকে গান শিখতে যায় এটা কেমন করে জানলে তুমি? আর তার কথা বারবার বলছো কেন? তোমার কি মনে হয় বোনের কথা টেনে আনলেই তোমাকে ছেড়ে দিবো? হ্যা আমার বাসায় মা বোন আছে কিন্তু তুমি আমার বোন না।”
.
লিসার হৃদস্পন্দন বেড়ে গেল। জামিল এত গাধা কেন?
তারপর বলল, “তোমরা না পাঁচজন ফ্রেন্ড? আরেকজন কোথায়? চারজন দেখছি যে?
রাহাত ভাইয়া কোথায়?”
রুহান কষে চড় মারে এ সময় লিসাকে। অনেক বকবক সহ্য করেছে সে। আর না।
.
জামিল তাকে বলে, “মুখে মারিসনা। চেহারা খারাপ হয়ে যাবে.”
রুহান কিছু বললনা। তাদের মধ্যে জামিল সবচেয়ে ঠান্ডা মাথার আর সবচেয়ে ডেঞ্জারাস। সবাই তার কথা মেনে চলার চেষ্টা করে।
জামিল লিসার দিকে তাকিয়ে বলে, “দো ইটস নান অফ ইওর বিজনেস, তাও জানাচ্ছি, তার কাজ ছিল তাই আসেনি। ব্যস্ত সে। তবে চিন্তা করলা। পাঁচজনের সাথে দেখা হবে তোমার।”
হাসি দিল জামিল।
.
লিসা এবার হাসিহাসি ভাবটা সরিয়ে বলল,”তোমার কি ব্যাপারটা স্ট্রেঞ্জ লাগেনা যে সপ্তাহে এই দিনে ঠিক এই সময়েই কেন তোমার ফ্রেন্ড মিসিং থাকে? কখনোই তোমাদের সাথে থাকেনা!
একদিকে তোমার বোনের গানের ক্লাস শেষ হয়। অন্যদিকে সেও আড্ডায় ফিরে আসে।”
.
জামিল ভ্রু কুঁচকে বলল, “কি বলতে চাও স্পষ্ট করে বলল”.
লিসা বলল, “তোমার বোনের ক্লাসে ফোন দাও। সব বুঝে যাবে.”
রুহান ছটফট করে বলল, “এ মেয়ে মাস্টার ম্যানিপুলেটর। এর সাথে এত কথা বলছিস কেন? ”
জামিল কিছু না বললনা।
অন্যান্য খারাপ ছেলের মতই সে বোনের প্রতি ওভারপ্রটেক্টিভ। লিসার কথা আর তার ইঙ্গিত ভাল লাগছেনা তার।
সব টিউটর এর নাম্বার থাকে তার কাছে।
ডায়াল করলো সে বোনের টিউটরকে।
কিছুক্ষণ রিং হওয়ার পরে কল রিসিভ করে টিউটর।
জামিল বলে, “আসসালামু আলাইকুম স্যার। আমার বোন জেমিকে ডেকে দিবেন? ইমার্জেন্সি আছে একটা”.
ওপ্রান্তে কি কথা হচ্ছে শুনতে পারছেনা রুহাননা। লিসা মনে মনে খালি প্রার্থনা করছে যাতে কাজ হয়। রুহানের সাথে একা বের হওয়া মোটেও উচিত হয়নি। এযাত্রা মুক্তি পেলে আর এমন রেকলেস কাজ করবেনা.
.
ফোনে কথা শুনে জামিলের মুখে রাগের ছাপ স্পষ্ট দেখতে পায় সবাই। জামিল বলল, “আপনি ভালোমত চেক করেছেন তো? ক্লাসে তো অনেকেই আছে”.
কিছুক্ষণ পরে জামিল যখন ফোন রাখে তখন তার সাথে কেউ কথা বলার সাহস পায়না। রাগে ফুঁসছে সে।
.
লিসার কাছে এসে দাঁতে দাঁত চেপে বলল সে, “জেমি কোথায়? কি জানো তুমি মেয়ে?”
রুহান বলল, “টিউটর কি বলেছে রে?”
জামিল বলল, “জেমি গত তিনমাস ধরে ক্লাসে যায়নি। অথচ আমি নিজে প্রতি সপ্তাহে তাকে টিউটরের বাসার গেটে নামিয়ে আসি”.
তারপর লিসাকে আবার জিজ্ঞাসা করে, “মুখ খুলো মেয়ে।”
লিসা ধীরে ধীরে হেসে বলল, “আমি তো বলতেই চাই। কিন্তু এমন হাত অয়া বাধা অবস্থায় ব্রেন কাজ করে? মাথা পুরাই ব্ল্যাংক আমার”।
জামিল লিসার লম্বা কালো চুল টেনে বলল, “আমার সাথে গেম খেলবেনা। মুখ খুলো”.
লিসা বলল, “ভাইয়া আপনি কে? আমি কোথায়? কিছুই মনে নাই কেন আমার?”
.
এ অবস্থাতেও এ মেয়ে এমন তামাশা করতে পারে!!!
জামিল এদিকে অধৈর্য হয়ে যাচ্ছে।
শেষমেশ সে লিসার বাধন খুলে দিল।
লিসা উঠে দাড়ালো। হাত পা ব্যাথা হয়ে গিয়েছে তার.
জামিল বলল তাকে, “মুখ খুলো এবার।”
লিসা বলল, “এখনো মাথা ব্ল্যাংক। ”
জামিল থ্রেট মেরে বলল, “বেশি সাহস দেখিওনা মেয়ে। তুমি সহ তোমার পুরো পরিবার গায়েব হয়ে যাবে।”
.
লিসা বলল, “তাহলে আল্লাহই রক্ষা করুক তোমার বোনকে। ”
মিটিমিটি হাসলো সে।
নিজের পরিবারের ব্যাপারে জামিল একেবারেই অন্ধ। রুহানের উপর যখন রিসার্চ চালিয়েছিল সে তখনই সে এসব ব্যাপারে জানতে পারে.
.
এদের সবার মধ্যে সবচেয়ে খারাপ জামিল।
সে তার বন্ধুদের সাথে যাবতীয় খারাপ কাজ করে বেড়াতো। বন্ধুদের অনেক খারাপ কাজ করেও দিতো সে।
বিনিময় তার বন্ধু রাহাত তাকে পুলিশ আর যাবতীয় ঝামেলা থেকে মুক্ত রাখতো।
শর্ট টেম্পারড সে। তাই রাহাতরাও তাকে ঘাটাতোনা।.
.
সেখানে লিসা যেভাবে জামিলের সাথে কথা বলছে তা দেখে সবাই স্তব্ধ হয়ে গেল।
.
জামিল শেষমেশ বলল, “ব্রেনে ইনফরমেশন রিস্টোর করতে আর কি করা লাগবে? ”
রুহানের নিজস্ব প্রবলেম এর থেকে অবশ্যই জামিলের বোন বড়। লিসা যদি বলে তাকে ছেড়ে দিতে তাহলে তাকে ছেড়েই দিবে জামিল। পরে যে কোনো সময় আবার লিসাকে তুলে আনা যাবে কিন্তু তার বোনের ব্যাপারে কি ইনফরমেশন আছে লিসার তা জানা দরকার জামিলের।.
।
লিসা বলল, ” তুমি যদি কখনো খবর পাও তোমার বোনের হাসবেন্ড তোমার বোনকে কিডন্যাপ করিয়েছে। মেরে ফেলার পরিকল্পনা করেছে। তাহলে তুমি সেই ছেলেকে কি করতে?”
.
জামিল আস্তে আস্তে বলল, “খুন করে ফেলতাম। দিয়ে তার বিকৃত লাশ গাছে ঝুলিয়ে রাখতাম যাতে সবাই দেখতে পায়”.
লিসা তখন রুহানকে দেখিয়ে বলল, “তাহলে এই ছেলের শাস্তি কি হওয়া উচিত?”
.
লিসার কথায় রুহান একরকম প্যারালাইজড হয়ে গেল। বলে কি এই মেয়ে?
“চুপ কর মেয়ে…তোমার মাথা ঠিক আছে?”
রুহান বলল।
জামিলের দিকে তাকিয়ে কাতর স্বরে বলল রুহান, “জামিল…দেখ আমি তোর কতদিনের বন্ধু… আমরা জেমিকে নিজের বোনের মত দেখি আমরা খুজে বের করব সে কি করে। এই মেয়ের কথা শোনা লাগবেনা। ”
.
জামিল ভাবলেশহীন ভাবে বলল, “জানি তুই আমার অনেক ভাল বন্ধু। বাট ব্লাড ইজ থিকার দেন ওয়াটার। ইটস নাথিং পার্সোনাল।”
লিসার মিটিমিটি হাসছে জামিলের পিছে দাড়িয়ে।
.
জামিল তার আরও দুই ফ্রেন্ডকে ইশারা করল, তারাও রুহানের দিকে এগিয়ে আসতে থাকে।
রুহান এমন সময় যেম সম্বিত ফিরে পায়। ঘুরে দৌড়াতে থাকে সে পালানোর জন্য।
.
দরজার কাছে এসে তার মনে পড়ে যে দরজা তো ভিতর থেকে লক করা। চাবি জামিলের কাছে। দরজা ছাড়া এ ঘরে যাতায়াত করার কোনো রাস্তাও নাই। লিসা যাতে পালাতে না পারে তাই রুহান নিজেই এ ঘর সিলেক্ট করেছে।
.
নিজেই এভাবে ভিক্টিম হয়ে যাবে তা সে কল্পনাও করতে পারেনি। সারা শরীরে আতঙ্ক এসে ভর করলো তার।
.
বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে দেখল সে…তারই এককালের বন্ধু, তার পার্টনার ইন ক্রাইম তার দিকে এগিয়ে আসছে…অন্যরকম ক্রুয়েলটি তাদের চোখে…
.
চলবে…
.
#ফারিহা_আহমেদ
.