বিনিময় পর্ব ৬

#বিনিময়
পর্ব-৬
রুহান ভেবেছিল নিজের বন্ধুদের দিয়ে লিসাকে গুম করাবে…এরপর এমনভাবে বাসায় ঘটনাটা সাজাবে যেন লিসা পালিয়ে গিয়েছে কারো সাথে। এসব কাজ রুহানের জন্য কোনো ব্যাপারই না। বাসার সবাই এখন তাকে হেয় চোখে দেখছে। রুহানের প্ল্যান সাকসেসফুল হলে এক ঢিলে দুই পাখি মারা হবে। লিসাকে উচিত শাস্তি দেওয়া হবে আবার পরিবারের লোকজনের থেকে সিমপ্যাথিও পাবে সে।
.
কিন্তু লিসাকে আন্ডারএস্টিমেট করেছিল সে। কোত্থেকে সে জামিলের বোনের ঘটনা জানলো কে জানে!!! কিন্তু জামিলের দুর্বলতা খুজে পেয়েছে লিসা। জামিল বোনকে নিয়ে কোনো চান্স নিবেনা। লিসার কথায় রুহানকে মেরে ফেলতেও দ্বিধাবোধ করবেনা.
.
তিনজন বন্ধু মিলে রুহানকে এমন করে চেপে ধরলো যে রুহান নড়াচড়া পর্যন্ত করতে পারছেনা। এমন সময় সে অনুভব করলো কেউ একজন তার গলা চেপে ধরেছে। সে আর কেউ না তার বন্ধু জামিল।
.
সে জামিলের কাছে অনেক অনুনয় বিনয় করতে থাকলো। কিন্তু জামিল ভাবলেশহীন।
শেষমেশ সে লিসার দিকে তাকিয়ে বলল, “লিসা…..প্লিজ….”
গলার চাপ আরও বেড়ে যাওয়ায় সে আর কিছু বলতে পারলোনা।
.
লিসা দূরে বসে এতক্ষণ রোবটের মত দেখছিল সব ঘটনা। রুহানের কথায় হঠাৎ সে যেন প্রাণ ফিরেফিরে পায়।
“থামো”…দৃঢ়কণ্ঠে বলে লিসা।
রুহানের গলা ছেড়ে দেয় জামিল সাথেসাথে।
পুরো ঘটনা ঘটতে বড়জোর দুইতিনমিনিট সময় লেগেছে কিন্তু রুহানের মনে হল কতঘন্টা পার হয়ে গেছে। হা করে নি:শ্বাস।নিতে থাকে সে।
.
লিসা বলল, “আর ইউ ক্রেজি…মেরে ফেলছ কেন আমার হাসবেন্ড কে? ”
জামিল জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালো লিসার দিকে। বলল, “তুমিই তো বললে ওকে শাস্তি দিতে.”
লিসা রুহানের কাছে যেয়ে তাকে উঠে বসালো।
রুহান অবাক হয়ে লিসার দিকে তাকালো।
লিসা জামিলের দিকে তাকিয়ে বলল,
“আমি কি তোমাদের বলেছি ওকে মেরে ফেলতে? মাত্র কয়েকদিন আগে বিয়ে হল এখনই বিধবা বানাতে চাও আমাকে? বিয়েতে কত সুন্দর ড্রেস পেয়েছি একটাও পড়া হবেনা.”
.
লিসার কথা শুনে রুহান কেন…জামিলসহ দুই বন্ধুরাও শকড হয়ে যায়।
মনে মনে তাদের আশা ছিল যে কোনো মেয়েই এভাবে নিজের সামনে হাসবেন্ডকে এভাবে খুন হতে দিবেনা, সে যে পরিস্থিতিতেই বিয়ে হোক না কেন… লিসা যখন থামতে বলায় এজন্যেই তারা অবাক হয়নি। কিন্তু তাই বলে সে এই কারণ দেখাবে এটা তারা ভাবতেও পারেনি।
.
জামিল বলল, “কি চাও তাহলে তুমি? সময় নষ্ট না করে যে ইনফরমেশন চেয়েছি সেটা দাও।”
লিসা বলল, “রুহান যে কাজ করেছে তার শাস্তি তো দেওয়াই লাগবে। কিন্তু বিধবা হওয়ার ইচ্ছা নাই আমার।”
জামিল মুখ শক্ত করে বলল, “কি শাস্তি?”
লিসা বলল, “ছোটবেলায় তোমার বন্ধুর মা তাকে ঠিকমত শাসন করেনি। প্রথম খারাপ কাজ যখন করলো তখন একটা থাপ্পড় দিলেই আজ এত খারাপ হতনা সে। তোমরাই ভালোমত শাসন করে দাও তো। আমিই মারতাম তাকে কিন্তু হাসবেন্ড এর উপর হাত তোলা উচিৎ না” লাজুক কন্ঠে বলল লিসা।
লিসার কথা শুনে মনে হল মা টিচারকে বলছে তার ছেলেকে শাসন করতে।
.
জামিল রুহানকে ঘুষি মারতে যাবে তখন লিসা আবার থামালো তাকে,”এই, চেহারা নষ্ট করনা আবার। ওর চেহারার কারণেই একমাত্র ওকে একটুআধটু সহ্য হয় আমার। নাহলে দেখা গেল আমিই মার্ডার করে দিলাম ওর।”
লিসা রুহানের দিকে তাকিয়ে চোখ টিপ দিল একটা।
জামিল রুহানের দিকে তাকালো…মুখে ভাবখানা এমন যে এ কেমন মেয়েকে বিয়ে করে এনেছে সে!!
“আর হ্যা…হাত দিয়ে না মেরে অন্য কোনো জিনিস দিয়ে মারো। নাহলে তোমার হাত ব্যাথা হয়ে যাবে। ট্রাস্ট মি…ইউ ওয়ান্ট ইওর হ্যান্ড টু বি ফুললি ফাংশনাল।”
লিসা কেমন করে যেন কথাটা বলল, জামিলের ব্যাপারটা ভাল ঠেকলনা।
.
যাই হোক….লিসার কথা শুনে হাতের কাছে একটা রড দিয়ে জোরে করে রুহানের পেটে আঘাত করলো জামিল…লিসা ইশারা করলো, “চালিয়ে যাও”.
.
.
.
দূর থেকে লিসা প্রত্যক্ষ করছে তাদের পিটানো। রুহান মরলে তার তেমন কিছু যায় আসেনা। কিন্তু কেবলমাত্র তার বিয়ে হয়েছে। সম্পর্ক এখন অনেক দুর্বল। রুহান মারা গেলে সেই পরিবারের সাথে তার আর কোনো সম্পর্কই থাকবেনা। তার যে পরিকল্পনা তাও পূরণ হবেনা। তার ভাই এর অপারেশন হয়েছে ঠিকই। কিন্তু তাদের পরিবারের অবস্থা এখনো আগের মতই আছে। রুহানের পরিবার এর ব্যাকআপ
থাকলে দ্রুতই তাদের অবস্থা আবার আগের মত হয়ে যাবে। ভাই এর জন্য বাবা এতদিন কাজে মনোযোগ দিতে পারেনি…এখন তাদের ফাইনানশিয়াল অবস্থার দিকে মনোযোগ দেওয়ার সময় এসেছে।

এছাড়া তাকে এভাবে মারার আরেকটা কারণ আছে। সে ভালোমতই জানে কিছুদিন পার হলেই রুহানের দাদি আর মা মিলে তোড়জোড় শুরু করবে রুহানকে গেস্টরুম থেকে নিজের রুমে শিফট করার জন্য। ব্যাপারটা রিস্কি লিসার জন্য। রুহান হাতপা ভেঙে পড়ে থাকলে অন্তত ৪-৫ মাস নিশ্চিন্তে থাকতে পারবে লিসা। এরপরেরটা পরে দেখা যাবে।
.
রুহান সেন্সলেস হয়ে যাওয়ার পর লিসা তাদের থামতে বলল। সেন্সলেস মানুষকে মেরে কি লাভ?
জামিল বলল, “তোমার ইচ্ছা পূরণ হয়েছে এবার বল আমার বোনের ব্যাপারে কি জানো?”
লিসা বলল, ” এখানে ইনফরমেশন পাওয়ার আশা বাদ দাও।
তুমি আর আমি আমাদের গাড়িতে করে আগে নিরাপদ জায়গায় জায়গায় যাবো। তোমার ফ্রেন্ডরা রুহানকে হাসপাতালে নিয়ে যাবে। তারপর আমার শ্বশুড়কে ফোন দিয়ে যা মিথ্যা বলার বলবে…আমার যায় আসেনা।”
জামিল কিছু বললনা। লিসার সাথে বাইরে এসে তাদের গাড়িতে উঠলো।
.
সকালের বের হয়েছিল তারা। এখন সন্ধ্যা হয়ে গেছে…বাবা মা রা নিশ্চয় চিন্তা করছে।
একটা ভদ্র রেস্টুরেন্টে ঢুকলো তারা। ক্রাওডেড জায়গায় জামিল তাকে আক্রমণ করবেনা আশা করা যায়.
জামিল অনেকক্ষণ ধরে চুপ ছিল…এবার সে বলল, “স্টিল ওয়েটিং”.
লিসা কথা না বলে তার ফোন বের করলো…জামিলকে বললে শেয়ারইট অন করো।
জামিল চুপচাপ তাই করলো…লিসা তাকে কয়েকটা ছবি ট্রান্সফার করলো।
ছবি দেখে জামিল শকড হয়ে গেল।
লিসা তাহলে হিন্ট দেওয়ার চেষ্টা করছিল।
ছবিগুলোতে রাহাত আর জেমিকে দেখা যাচ্ছে। একটা ছবিতে জেমির কোচিং এর সামনে থেকে রাহাত তার বাইকে তুলে নিয়ে যায় তাকে। বিভিন্ন লোকেশনে..বিভিন্ন ড্রেসে, বিভিন্ন দিনের অনেকগুলো ছবি।

লিসা ব্যঙ্গাত্মক কন্ঠে বলল, “আরও ছবি আছে কিন্তু সেগুলো সেন্সরড…রেটেড পিজি।”
জামিল শকড হয়ে বসে থাকলো… রাহাত? এত বড় সাহস তার? জামিলের সামনে রাহাত সবসময় বলতো, “তোর বোন আমার নিজের বোনের মত”… এই তার নমুনা?
লিসা তার চোখেমুখে রাগ স্পষ্ট দেখতে পারলো।
তারপর বলল, “এ লিওপার্ড ক্যাননট চেঞ্জ ইটস স্পটস। কি আশা করেছিলা? তোমার সুন্দরী বোনের দিকে তোমার কোনো ফ্রেন্ড তাকাবেনা? তোমাকে চালাক ভাবতাম আমি সবচেয়ে… কিন্তু চরম হতাশ হলাম”.
.
লিসা আর কিছু না বলে বের হয়ে আসলো রেস্টুরেন্ট থেকে।
জামিল মুখ শক্ত করে ফোনের দিকে চেয়ে আছে। রাগে অন্ধ হয়ে গিয়েছে সে।
লিসা কখন চলে আসলো টেরই পেলনা সে।
লিসা কোত্থেকে এত ইনফরমেশন পেয়েছে তা জিজ্ঞাসা করার কথাও মনে হলনা তার।
.

বাসায় বাবা মা অনেকক্ষণ ধরে অপেক্ষা করছে লিসার জন্য.
লিসাকে বাসায় আসতে দেখেই মা ছুটে আসলেন…বললেন, “এত দেরি কেন হল? আর জামাই কোথায়?”
.
এতক্ষণ ধরে নিজেকে অনেক শক্ত করে রেখেছিল লিসা…মাকে দেখেই জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকলো সে। মা মনে করলেন মেয়ে তাদের জন্য মনখারাপ করছিল।
কিন্তু বাবামায়ের প্রটেকটিভ লেয়ার থেকে বের হয়ে লিসা প্রকৃতপক্ষে বুঝতে পেরেছে যে দুনিয়া কত ভয়ানক.
.
যদিও সে আগেই দুনিয়ার ভয়ংকর রূপ সম্পর্কে জানতো…কিন্তু সব জানা আর নিজে এক্সপেরিয়েন্স করার মধ্যে অনেক পার্থক্য… আরো অনেক বেশি কেয়ারফুল হতে হবে লিসাকে।
.
কিছুক্ষণ পর লিসা স্বাভাবিক হয়ে বলল,
“সে পরে আসবে। তার একটা কাজ ছিল একটা।”
মা বললেন, “তোর শ্বশুড় বললেন তোরা বলে সকালেই বের হয়েছিস…এত সময় লাগলো কেন?
লিসা লাজুক ভাব এনে বলল, “আমরা ঘুরতে গিয়েছিলাম.”
সরাসরি মিথ্যা কথা বলতে খারাপই লাগছিল তার…কিন্তু এবারই প্রথম সে মিথ্যা বলছেনা। কাজেই অপরাধবোধটা বেশিক্ষণ থাকলোনা লিসার মনে।
.
মেয়ের উত্তর শুনে মা হাসি দিলেন… হঠাৎ তাদের বিয়ের কথা শুনে একইসাথে রাগান্বিত আর ভীত হয়েছিলেন তিনি। এমন বিয়েতে পরে শ্বশুড়বাড়িতে সমস্যা হয়। কিন্তু ধীরে ধীরে ভয় কমছে উনার।
.
লিসা ফ্রেস হওয়ার জন্য ঘরে আসলো।
এতক্ষণে কেন ফোন আসলোনা তার শ্বশুড়ের? তার শ্বশুড়বাড়ি নিশ্চয় এতক্ষণে রুহানের হাসপাতালে ভর্তির খবর চলে গিয়েছে। সে হিসেবে এতক্ষণে তাকে কল দিয়ে হাসপাতালে আসতে বলার কথা।
মায়ের ডাকে ভাবনায় ছেদ পড়লো তার।
ভালোই হয়েছে ফোন আসেনি।
হাসপাতালে যাওয়ার ইচ্ছা নাই তার আপাতত। হাসপাতাল তার অসহ্য লাগে। এ জীবনে যথেষ্ট সময় সে হাসপাতালে কাটিয়েছে…ভাই এর জন্য সে চুপচাপ কষ্ট করে গেছে। রুহানের জন্য সে ওই কষ্ট করতে রাজি না।
ফোন অফ করে দিল সে।
.
কিছুক্ষণ রেস্ট নিয়ে বাবামায়ের কাছে গিয়ে গল্প করতে লাগলো সে।
টিভিতে আস্তে করে খবর চলছিল….কেউ কনসেন্ট্রেশন দেয়নি এতক্ষণ।
হঠাৎ করে এক খবর শুনে কান খাড়া করলো লিসা.
.
কোন যেন ব্যবসায়ীর ছেলের লাশ উদ্ধারের কথা খবরে বলছে। সবচেয়ে বড় কথা জামিলরা লিসাকে যেখানে নিয়ে গিয়েছিল তার পাশেরই এলাকায় এক পুকুরে লাশটা ভেসে উঠেছে..
খবর শুনে ফ্যাকাশে হয়ে গেল লিসার চেহারা।
জামিলের ফ্রেন্ডরা সময়মত রুহানকে হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিল তো?
.
চলবে…
.
#ফারিহা_আহমেদ
.

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here