বিনি সুতোর টান পর্ব -১৫ ও শেষ

#বিনি_সুতোর_টান
#লেখিকা_জেনিফা_চৌধুরী
#পর্ব_পনেরো [প্রথমাংশ]

–সমস্ত মান অভিমান ভুলে, আমার সমস্ত অপরাধ ক্ষমা করে, নতুন করে পথ শুরু করব। শুধু মাত্র আমার অনাগত সন্তানের জন্য।

জায়ানের কথায় জায়ানের কাঁধে নিঃশব্দে মাথা রাখলো জেমি। জেমির মনের মধ্যে কোথাও না কোথাও এখনো জায়ানের উপর অভিমান রয়েছে জায়ান বুঝতে পারছে। জেমি এখনো দ্বিধায় পড়ে আছে। জায়ান কে মেনে নিবে নাকি না। একবার মনে হচ্ছে জায়ান কে দ্বিতীয় বার একটা সুযোগ দেওয়া উচিত। আবার যখন জায়ানের করা অত্যাচার গুলোর কথা মনে হচ্ছে তখন জায়ানের প্রতি অভিমান, ক্ষোভ বেরিয়ে আসচ্ছে। জেমি কিছু না বলে জায়ানের কাঁধের থেকে মাথা তুলে বিছানায় গা হেলিয়ে দিয়ে চোখ বন্ধ করে নিলো। জায়ান বুঝতে পারছে জেমি এখনো তাকে মন থেকে ক্ষমা করতে পারেনি। জায়ানের কেনো যেনো মনে হচ্ছে জায়ান সবটা পেয়েও ধরে রাখতে পারছেনা। জায়ান কিছুক্ষন জেমির দিকে এক নজরে তাকিয়ে রইলো। এই মেয়েটার মুখে বোধহয় দুনিয়ার সমস্ত মায়া দিয়ে ভরপুর। ফর্সা হলেই কি শুধু সুন্দর হওয়া যায়। জেমি তো খুব বেশি ফর্সা না তাও জেমির মধ্যে আলাদা এক সৌন্দর্য বিরাজ করে। জেমির ঠোঁটের নিচের কালো তিল টা জায়ান কে সব সময় আর্কষন করে। জায়ান জেমির দিকে কিচ্ছুক্ষন এক নজরে তাকিয়ে থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে উঠলো…..

–আমি বুঝতে পারছি এত সহজে সব কিছু মেনে নেওয়া সম্ভব না। শুধু তুমি না তোমার জায়গায় যেকোনো মেয়ে হলে ও সেম কাজটাই করতো। কিন্তু একটা বার ভেবে দেখো কেউ যদি ভুল করে মন থেকে অনুতপ্ত হয় তাহলে স্বয়ং উপর ওয়ালা ও তাকে ক্ষমা করে দেয়। আর সেখানে তো আমরা উপর ওয়ালার বানানো মানুষ মাত্র। যেদিন বাড়ি ফিরে তোমাকে বেল্ট দিয়ে আঘাত করলাম সেদিন তোমাকে অপরিচিত একটা ছেলের সাথে পাশাপাশি হেটে আসতে দেখেছিলাম, আমার মায়ের কথাগুলো কে সেদিন সত্যি মনে হয়েছিলো, তাই নিজের চোখ আর নিজের গর্ভধারিনীকে অবিশ্বাস করতে পারিনি আমি, তারপর একের পর এক তোমার নামে অভিযোগ শুনে সত্যি আমি নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারিনি, যখনি নিজেকে একটু কন্ট্রোল আনার চেষ্টা করলাম তখনি তোমার নাম্বারে অপরিচিত এক ছেলের ফোন কল। আমার জায়গায় দাড়িয়ে তোমাকে ভুল বোঝার যথেষ্ট কারন ছিলো। আমি এইসব দেখে নিজেকে ঠিক রাখতে পারিনি। হ্যাঁ, আমার সব থেকে বড় ভুল সত্যি মিথ্যা যাচাই না করে তোমার উপর অত্যাচার করা। কিন্তু আমি কি করতাম বলো আমি তোমাকে অন্য কারোর সাথে সহ্য করতে পারিনা।

কথাগুলো মনোযোগ দিয়ে শুনছিলো জেমি। জায়ান কথাগুলো বলেই শান্ত হয়ে বসে রইলো। জায়ান থামতেই জেমি শান্ত কন্ঠেই জবাব দিলো….

–“অন্ধ মানুষ আর অন্ধ বিশ্বাসকারীর মধ্যে পার্থক্য কি জানো”?
“একজন চোখ থাকতেও অন্ধ আরেক জন চক্ষু হারা সত্যি কারের অন্ধ মানুষ”
তুমি ছিলে চোখ থাকতেও অন্ধ। সেদিন রাস্তায় যার সাথে আমাকে দেখেছিলে সে আমার ক্লাসমেট ছিলো অনেক দিন পর দেখা হওয়ায় কথা বলতে বলতে এসেছিলাম। আর ওই অপরিচিত নাম্বার থেকে কল টা মায়া করিয়েছিলো। কখনো সত্যি আর মিথ্যা যাচাই না করে দোষী করে শাস্তি দেওয়া পৃথিবীর নিকৃষ্ট অপরাধ গুলোর মধ্যে একটা।

বলেই জেমি পাশ ফিরে সুয়ে রইলো। জায়ান কিছুক্ষন চুপ থেকে বলে উঠলো…..

–তুমি নিজেকে গোছানোর জন্য যত খুশি তত সময় নাও। তবুও একটা অনুরোধ আমি থাকতেই আমাকে মেনে নিও, হারিয়ে গেলে কি খুঁজে লাভ আছে বলো। উপর ওয়ালা আমাকে আমার পাপের শাস্তি আমার মায়ের মতো নির্মম ভাবে দিলেও পারতো। এইভাবে বেঁচে থেকে ধুকে ধুকে ম/রার চাইতে একবারে ম/রে যাওয়া হাজার গুন ভালো।

বলেই জায়ান বেরিয়ে গেলো। জায়ান চলে যেতেই জেমি লাফ দিয়ে উঠে বসে পড়লো। জায়ানের শাস্তি কি একটু বেশিই দিয়ে দিচ্ছে ও। জেমি কিছুক্ষন শান্ত হয়ে বসে রইলো। জায়ান কিছুক্ষন পর এসে জেমির পাশে নিঃশব্দে সুয়ে পড়লো। জায়ান সুয়ে পড়তেই জেমিও সুয়ে পড়লো। ওর ঘুম আসচ্ছেনা।
____________________________________________

—একটু উঠো না প্লিজ।

মাঝ রাতে জেমির আদুরে গলায় ডাক শুনে জায়ান ঘুম কাতুরে কন্ঠে বললো….

–এত রাতে কোনো ডাকছো? ঘুমিয়ে পড়ো প্লিজ। অনেক ক্লান্ত লাগছে শরীর।

জায়ানের কথা শুনে জেমি কান্না করে দিলো। জেমির কান্না শুনে জায়ান ঘুম থেকে লাফ দিয়ে উঠলো। জেমিকে এত রাতে কাঁদতে দেখে জায়ান অবাকের সাথে কিছুটা ভয় পেয়ে গেলো।

–কি হয়েছে কাঁদছো কেনো? ব্যাথা করছে? শরীর খারাপ লাগছে? কি হয়েছে আমাকে বলো? ডাক্তার ডাকবো?

জায়ান জেমির গালে আলতো করে হাত রেখে কথা গুলো বলে উঠলো। জায়ানের কথা শুনে জেমি ঠোঁট ফুলিয়ে বাচ্চাদের মতো বলে উঠলো….

–আমার ক্ষুদা লেগেছে খুব?

জেমির কথা শুনে জায়ান ভ্রু কুচকে বলে উঠলো…

—এত রাতে ক্ষুদা লেগেছে। আচ্ছা দাড়াও আমি তোমার জন্য কিছু রান্না করে নিয়ে আসচ্ছি।

বলেই জায়ান খাট থেকে নামতে নিলেই জেমি জায়ানের হাত টা ধরে বলে উঠলো….

—আমি আইসক্রিম খাব।

জেমির কথা শুনে জায়ান এক প্রকার চেচিয়ে বলে উঠলো…..

—হোয়াট? এত রাতে আইসক্রিম। তাও এই অবস্থায়। তোমার কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে।

জায়ানের কথা শুনে জেমি কড়া কন্ঠে বলে উঠলো…..

–আমি এক্ষুনি খাব। মানে খাব। তুমি যদি না এনে দিতে চাও তাহলে আমি একাই যাব।

জায়ান জেমিকে হাজার বুজিয়ে মানাতে পারলো না। জেমির জেদ এর কাছে হার মেনে নিয়ে ফ্রীজ থেকে আইসক্রিম এনে দিতেই জেমি লাফিয়ে উঠে জায়ান কে জড়িয়ে ধরলো। জায়ান খাটের উপর বসতে নিলেই জেমি চেচিয়ে বলে উঠলো….

—নাহ এখন বসবে না এখানে তুমি? আমর বাইরে যাব হাটতে।

জেমির কথা শুনে জায়ান অসহায় ফেস করে বলে উঠলো…

–এই রাত ১২ টায় রাস্তায় বের হবে কেনো?

জেমির এক কথা সে আইসক্রিম খেতে খেতে খোলা আকাশের নিচে হাটবে। জায়ানের কাধে মাথা রেখে নিশ্চিন্তে ঘুরবে। জেমির বাচ্চাদের মতো ফেস করে বায়না করাতে জায়ান আর না করতে পারলো না। জেমিকে নিয়ে বেরিয়ে গেলো।
____________________________________________
রাতের খোলা আকাশের নিচে জায়ানের হাত ধরে আইসক্রিম খাচ্ছে আর আপন মনে বকবক করে যাচ্ছে জেমি। এতদিন পর মেয়েটাকে আগের মতো চঞ্চল দেখে জায়ানের মনে এক অদ্ভুত সুখের শিহরন বয়ে গেলো। রাস্তার দুই ধারে ল্যাম্পপোস্ট গুলো আপন মনে আলো দিয়ে যাচ্ছে চারদিকে। কয়েক টা গাড়ি শুনশান শব্দ করে জেমিদের পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছে। জায়ান জেমির বকবক গুলো মনোযোগ দিয়ে শুনছে আর কিছুক্ষন পর পর মৃদু হেসে উঠছে। রাস্তার পাশের চায়ের দোকান গুলো অনেক রাত অব্দি খোলা থাকে। হঠাৎ করেই জেমির নজর একটা ছোট খাটো চায়ের দোকানের দিকে গেলো। জেমি লাফিয়ে উঠে বলে উঠলো…..

–চলো না একটু চা খেয়ে আসি।

জেমির হাসি মুখের আবদার টা জায়ান কিছুতেই ফেলতে পারলো না। জেমিকে ফুটপাতের একটা ল্যাম্পপোস্টের নিচে বসিয়ে রেখে বলে উঠলো….

–এই রাস্তা ক্রস করে তোমাকে যেতে হবেনা। তুমি ৫ মিনিট বসো আমি নিয়ে আসচ্ছি।

জায়ান কিছুতেই জেমিকে নিতে রাজি হলোনা। জেমিকে বসিয়ে রেখেই জায়ান চা আনতে চলে গেলো। জেমি ও গালে হাত দিয়ে বসে রইলো। জায়ান দুই কাপ চা হাতে নিয়ে রাস্তা পার হওয়ার সময় মাল ভর্তি একটা ট্রাক এসে চোখের পলকেই জায়ান কে ধাক্কা দিয়ে চলে গেলো। জায়ান মুহূর্তেই মুখ থুবড়ে জেমির খানিক টা কাছে এসে পড়লো। চোখের পলকে এমন কিছু দেখার জন্য জেমি মোটেও প্রস্তুত ছিলো না। জেমি দাড়িয়ে বিস্ফোরিত চোখে জায়ানের দিকে তাকালো। মাথার দিক থেকে গলগল করে র’ক্ত পড়ছে। হাত টা উল্টে পিঠের নিচে চলে গেছে। রাস্তার সাথে ঘষায় গালের একদিকের মাংস থে’ত’লে গেছে। জায়ানের মুখ টা নিমিশেই র’ক্তা’ক্ত হয়ে গেলো। জেমির শরীর অবশ হয়ে আসতে লাগলো। এই ভ’য়ং’কর দৃশ্য দেখার মতো শক্তি ওর নেই। চোখ দুটো বন্ধ হয়ে আসতে লাগলো জেমির। জেমির কথা বলার শক্তি নেই। জায়ানের নিথর দেহটা চোখের দেখতে দেখতে জেমি ঢুলে পড়লো রাস্তায়। চোখ দুটো বন্ধ হয়ে আসার আগ মুহূর্তে জেমির মুখ থেকে শব্দ বেরিয়ে আসলো….

–জজজজজায়ান……
#বিনি_সুতোর_টান
#লেখিকা_জেনিফা_চৌধুরী
#পর্ব_পনেরো[শেষাংশ]

নিজের চোখের সামনে নিজের স্বামীর র’ক্তা’ক্ত লা’শ দেখে জেমি জোরে শব্দ করে “জায়ান” বলে চিৎকার করে উঠলো। জেমির চিৎকার শুনে জায়ান ধড়ফড়িয়ে উঠে বসে পড়লো। জেমি বসে কাঁপচ্ছে ওর চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়ছে, ঠোঁট গুলো কেঁপেই যাচ্ছে সমানে। জেমির এই অবস্থা দেখে জায়ান ভয় পেয়ে জিজ্ঞেস করে উঠলো….

–কি হয়েছে? কোনো খারাপ স্বপ্ন দেখেছো? শরীর খারাপ লাগছে? ডাক্তার ডাকবো। বলো না কি হয়েছে? আমার টেনশন হচ্ছে। বলো?

জায়ান একের পর এক প্রশ্ন করেই যাচ্ছে। জেমি এখনো কাঁপছে। ভয়ের চোটে ওর মুখ দিয়ে একটাও শব্দ বের হচ্ছে না। জায়ান জেমির দুই গালে আলতো করে হাত রেখে বলে উঠলো….

–শরীর খারাপ লাগছে? পেটে ব্যাথা করছে? কি হয়েছে আমাকে বলো?

জায়ানের কথা শুনে যেনো হঠাৎ করেই জেমির ওর র’ক্তা’ক্ত চেহারা টা চোখের সামনে ভেসে উঠলো। জেমি কোনো উওর না দিয়ে জায়ান কে ঝাপটে ধরলো। এমন ভাবে জায়ান কে খামছে ধরেছে যেনো ও ছাড়লেই জায়ান চলে যাবে। জায়ান জেমিএ কান্ডে বুঝতে পারছে হয়তো জেমি কোনো খারাপ স্বপ্ন দেখছে। জায়ান জেমিকে নিজের সাথে জড়িয়ে নিয়ে ওর মাথায় আলতো করে হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো। জেমি শব্দ করে কাদঁছে। জেমির চোখের পানিতে জায়ানের শার্ট ভিজে যাচ্ছে। অনেক ক্ষন এইভাবে কেটে যাওয়ার পর জেমি নিশ্চুপ হয়ে গেলো। জায়ান জেমিকে শান্ত করার জন্য বলে উঠলো…….

—স্বপ্ন আর বাস্তবতা যদি এক হতো। তাহলে, পৃথিবীর অর্ধেক মানুষ বোধহয় সুখী হয়ে বাঁচতে পারতো। আমরা অনেক স্বপ্ন দেখি বাস্তবে তা হয় পূরন করার সাধ্য থাকে না বা উপর ওয়ালা পূরন করে না আর উপর ওয়ালা যা করে ভালোর জন্য।
ঘুমের ঘোরে দেখা স্বপ্ন দেখে তুমি হয়তো আমাকে হারিয়ে ফেলার ভয় পেয়েছো বা পাচ্ছো। এইতো দেখো কিছুক্ষন আগেই কত শক্ত কথা বলছিলে। আসলে কি জানো? আমরা মানুষ, আমরা যতই শক্ত হইনা কেনো প্রিয় মানুষের কাছে আমাদের একটা দূর্বল পয়েন্ট থেকেই যায়। একটা স্বপ্ন কে নিয়ে এত ভয় পাওয়া উচিত না বাস্তবে ভয় করো বাস্তবতা স্বপ্নের চাইতেও ভয়ংকর। বুজলে মাই কুইন।

মাই কুইন নামটা শুনেই জেমির বুকটা ধক করে উঠলো। বিয়ের পর আজকে প্রথম বার জায়ান মাই কুইন বলে ডাকলো জেমিকে। এই যে এই ডাকটা শোনার জন্য জেমি কতরাত চাতক পাখির মতো ছটফট করেছে। জেমি অশ্রুসিক্ত চোখে জায়ানের দিকে তাকাতেই জায়ান আলতো হাতে জেমির চোখের পানির গুলো মুছে দিয়ে জেমির ঠোঁটে গভীরভাবে চু’মু খেলো। জেমির মুখ টা মুহূর্তেই লজ্জায় ভরে উঠলো। জায়ান জেমির লজ্জা মাখা মুখ দেখে একটু হেসে জেমিকে জড়িয়ে ধরলো। আজ জায়ানের বুকে মনে হচ্ছে জেমির সব থেকে নিরাপদ আশ্রয়। কিন্তু এই ছেলেটাকেই জেমির এতদিন সহ্য হচ্ছিলো, এই ছেলেটাকেই এতদিন অচেনা মনে হচ্ছিলো। আসলেই “অতিরিক্ত শব্দটাই বিষাদময়, অতিরিক্ত বিশ্বাস আর অতিরিক্ত ভালোবাসা দুটোই বিষাদময় যন্ত্রনা সৃষ্টি করে” জায়ান জেমিকে বিছানায় সুয়ে দিয়ে ওর পাশে সুয়ে পড়লো। জেমি বাধ্যকন্যার মতো জায়ানের বুকে মাথা রেখে জায়ানের হাত আগলে ধরে রেখেছে। জায়ান আলতো হাতে জেমির মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলে উঠলো…..

—ভুল তো আমরা সবাই করি তাইনা। আমি জানি আমি যেই প/শুর মতো আচরণ করেছি তার কাছে এই শাস্তি খুব নগন্য। কিন্তু আমি পেয়েছি মানসিক শাস্তি আর তুমি শারীরিক। আমার মনে হয় কোনো এক দিক থেকে আমরা দুজনেই সমান শাস্তি পেয়েছি। শুধু একটাই প্রাথক্য তুমি দোষ না করে শাস্তি পেয়েছো আমি দোষ করে। আর এই অনুতপ্তের যন্ত্রনা আমাকে সারাজীবন তোমার কাছে দোষী করে রাখবে। আমি জানি তুমি শুধু মাত্র আমাদের সন্তানের জন্য আমাকে মেনে নিলে এখনো তোমার মনে আমাকে নিয়ে হাজার টা অভিযোগ আছে। এই শাস্তিটাই আমি প্রাপ্য। তুমি আমার হয়ে ও আমার হবে না বাকি জীবনে। এর থেকেও ভয়ংকর শাস্তি আর কি হবে বলো?

জায়ানের চোখ থেকেও পানি পড়ছে। একটা ভুলের শাস্তির ভার ওকে সারাজীবন বয়ে বেড়াতে হবে। জেমি কিছু না বলে নিশ্চুপে চোখ জোড়া বন্ধ করে রইলো আজ ওর বলার কিছু নেই। কাল থেকে অতীত ভুলে শুধু বর্তমান নিয়ে বেঁচে থাকবে। জায়ান ও কিছু না বলে জেমিকে বুকের সাথে মিশিয়ে নিয়ে ঘুমিয়ে পড়লো। কাল থেকে নিজের ভুল গুলো একটা একটা করে সংশোধন করার চেষ্টা করবে।
____________________________________________
জেমি সকাল সকাল কিচেনে কাজ করছিলো। কাল রাতে ওই দুঃস্বপ্ন টার পর সারারাত ও ঘুম আসেনি। হঠাৎ করে কলিং বেল বাজতেই জেমি একবার ঘড়ির দিকে চোখ দিলো। সকাল ৬ টা বেজে ২৫ মিনিট এত সকালে কে আসবে? জেমির মা ও জেমির পাশে দাড়িয়ে কাজ করছে। জেমি ওর মায়ের দিকে একবার চোখ দিতেই ওর মা ও প্রশ্নত্তর দৃষ্টিতে তাকালো। জেমি কিছু না বলে কোমরের থেকে কাপড়ের আচল টা ছাড়িয়ে দরজা খুলতেই অবাক হয়ে গেলো। সামনে থাকা এই মানুষটাকে এই মুহূর্তে জেমি আশা করেনি। জেমি অবাক চোখে তাকিয়ে বলে উঠলো….

–ইভা তুমি? এত সকালে? তা ছাড়া তুমি তো বা….

আর বলতে পারলো না তার আগেই ইভা জেমিকে জড়িয়ে ধরে কান্না শুরু করে দিলো। ইভাকে এমন করে কাঁদতে দেখে জেমি একটু ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলো। ইভার স্বামী দরজার বাইরে দাড়িয়ে আছে। ইভা কাঁদতে কাঁদতেই বলে উঠলো….

—আমার মায়ের উপর আমার অভিমান ছিলো। তোমার সাথে করা অন্যায়ের শাস্তি আমার মা এমন করে পাবে আমি ভাবতেও পারিনি। আমি অভিমানে মায়ের সাথে যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছিলাম যাতে মা একটু হলেও বুঝে মেয়ের কষ্ট। কিন্তু আমার মা আমার উপর অভিমান করে এত দূরে চলে যাবে আমি ভাবতে পারিনি।

বলেই আবারো কান্নায় ভেঙে পড়লো ইভা। জেমি কি বলে স্বান্তনা দিবে বুঝে উঠতে পারছেনা। জেমির মার চোখের কোনে ও পানি। জায়ান নিচে নেমে এসে ইভাকে দেখে অবাক হয়ে ইভা বলে ডাকতেই ইভা দৌড়ে গিয়ে জায়ান কে ধরে কান্না করে উঠলো। জায়ান ও বোন কে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে। যতই হোক মা তো।
____________________________________________
২ দিন পর। জেমি আর জায়ান দুজন মিলে একটা ডুপ্লেক্স বাড়ি কিনেছে। এই দুইদিন অনেক ঝামেলা গিয়েছে ওদের উপর দিয়ে। সন্ধ্যা থেকে জায়ান ড্রয়িং রুমের সোফায় বসে আছে। রাত ১১ টা বাজে। জেমিকে সন্ধ্যা থেকে একবার ও দেখেনি। তাই আরো ছটফট লাগছে ওর। জায়ান রুমে যেতে নিলেও সাজেদ আটকে দিচ্ছে বার বার। সাজেদ ইভার স্বামী আবার জায়ানের বন্ধু। জায়ান এহেতুক কান্ডে বিরক্ত হয়ে বলে উঠলো..

— এসব কি হচ্ছে সাজেদ? আমার কিন্তু এইবার ভীষন বিরক্ত লাগছে। ইভা কোথায়? ইভাকে আসতে বল।

সাজেদ চিপস গুলো মুখে দিতে দিতে বলে উঠলো….

—আহা শা-লাবাবু এত রাগ করছো কেনো? একটু ওয়েট করো তোমার জন্য সারপ্রাইজ আছে।

জায়ান ভ্রু যুগল কুচকে সাজেদ কে বলে উঠলো…..

–দেখ সাজেদ একদম রসিকতা করবি না এই মুহূর্তে আমার রাগ উঠছে। ইভা কোথায় আর জেমিই বা কোথায় আমাকে রুমে যেতে দিচ্ছিস না কেনো?

সাজেদ কিছু বলতে যাবে তার আগেই ইভা সিড়ি দিয়ে নামতে নামতে বলে উঠলো…..

–আহা ভাই তুই এত ব্যস্ত হচ্ছিস কেনো বলতো? আমরা তো তোর ভালোর জন্যই করছিলাম।

জায়ান রাগী কন্ঠে উওর দিলো….

–কি এমন ভালো করছিলেন শুনি? সন্ধ্যা থেকে এখানে বসিয়ে রেখেছেন।

ইভা জায়ানের সামনে এসে কোনো কথা না বলে চোখ টিপ মে/রে মারতেই পেছন থেকে সাজেদ জায়ানের চোখ টা বেধে দিলো। জায়ান চেচাতে শুরু করলে ইভা সেদিকে কান নিয়ে জায়ান কে নিয়ে সোজা উপরে চলে আসলো। রুমের মধ্যে এনেই জায়ানের চোখ টা খুলে দিতেই জায়ান ইভাকে রেগে কিছু বলতে গিয়েও রুমের দিকে নজর দিয়ে থেমে গেলো। রুমটা লাল আর কালো লাভ শেড বেলুন দিয়ে মারাত্নক সুন্দর ভাবে সাজানো। রুমের চারদিকে ক্যান্ডে-লাইট। খাটের চারপাশ খুব সুন্দর করে ফুল দিয়ে সাজানো। খাটের উপর মেরুন কালার শাড়ি পড়ে ঘোমটা টেনে বসে আছে জেমি। জায়ান বাকরুদ্ধ হয়ে তাকিয়ে দেখছে সব। জায়ান কে হা করে তাকিয়ে থাকতে দেখে ইভা বলে উঠলো…

–ধরে নে না আজ তোদের বিয়ে হয়েছে। আজ থেকে নতুন পথ চলা শুরু। আমার পেছনের কয়েক টা মাস অতীত ভেবে ভুলে যাই। পেছনে ফিরে না তাকাই। এইজন্যই এই সারপ্রাইজ টা তোদের জন্য। শুধু এইটুকু না আরেক টা বিগ সারপ্রাইজ রয়েছে।

জায়ান অবাক চোখে ইভার দিকে তাকাতেই ইভা আর সাজেদ একসাথে বলে উঠলো…..

—আমাদের পরিবারে আরো দুজন সদস্য আসতে চলেছে।

দুজন সদস্য কথাটা জায়ান ঠিক বুঝতে পারলো না। তাই, অবাক স্বরে বলে উঠলো…

–দুজন মানে? কারা?

ইভা একটু মুখ টিপে হাসলো। সাজেদ হাসতে হাসতে বলে উঠলো….

–মানে তোর টুইট বেবি হবে। কংগ্রাচুলেশনস ব্রো।

বলেই জায়ান কে জড়িয়ে ধরলো। জায়ান যেনো ঘোরের মধ্যে আছে। বিশ্বাস হচ্ছে না ওর। এত বড় একটা খুশির সংবাদ শুনে জায়ান ভাষাহীন হয়ে দাড়িয়ে আছে। ইভা আর সাজেদ নিঃশব্দে দরজা আটকে চলে গেলো। জায়ান এখনো ঘোরের মধ্যে আছে। বাবা হওয়ার আনন্দটা যে এতটা জায়ান আজ বুঝতে পারছে। ওর অদ্ভুত রকম ফিলিংস হচ্ছে। জায়ান বাবা হবে। তাও একসাথে দুইজন বাচ্চা ওকে বাবা বলে ডাকবে ভাবতেই জায়ানের খুশিতে নাচতে ইচ্ছে করছে। জায়ান এক মুহূর্তের জন্য কল্পনার সাগরে ভেসে গেলো। হঠাৎ করে জেমি জড়িয়ে ধরতেই জায়ানের হুশ ফিরে আসলো। জায়ান খুশিতে জেমিকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলে উঠলো….

—আমি তোমাকে বুঝাতে পারব না আজ আমি কত খুশি? এতবড় একটা খুশি এনে দেওয়ার জন্য তোমার কাছে আমি সারাজীবন ঋনী হয়ে থাকব মাই কুইন। আমি বাবা হবো। আমি আমার বাচ্চাদের সাথে খেলব, ওদের নিজের হাতে বড় করব,কবে আসবে সেইদিন মাই কুইন। আজ চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করছে “ভালোবাসি মাই কুইন ভালোবাসি”

বলেই জেমিকে কোলে তুলে নিয়ে ঘোরাতে লাগলো। জেমি শক্ত করে জায়ানের গলা জড়িয়ে ধরে আছে।আজ জায়ানের খুশি দেখে জেমির মনে হচ্ছে ও সব ভুলে গেছে। ওর ভেতরের সব ঘা নিমিশেই উবে গেছে। আজ থেকে ওদের নতুন পথা চলা শুরু।
____________________________________________
“৩ বছর পর”
–মাম্মা আজ আমি খাবো না। ভাই আমাকে মে/রেছে। আজ বাবাই আসলে বোলবো(বলব) ওকে চককেট(চকলেট) না দিতে।

একটা ৩ বছরের বাচ্চা মেয়ে গাল ফুলিয়ে বলে উঠলো। জেমি কিছু বলার আগেই পাশ থেকে আরেকটা বাচ্চা ছেলে বাচ্চা মেয়েটার চুল ধরে টেনে বললো….

—আমি চকলেট খাবো। তোকে দিব না। মাম্মা আমাকে এত্তগুলা চকলেট দিবে তাইনা মাম্মা।

বলতেই বাচ্চা মেয়েটা কেঁদে দিলো। বাচ্চা মেয়েটাকে কাঁদতে দেখে ছেলেটাও কেঁদে উঠলো। ওদের দুজনের ৩ বছর হলেও মেয়েটার এখনো কথা আধ ভাঙা কথা বলে। শুনতে বেশ কিউট লাগে। এদের দুজন কে জেমি মহা বিপদে পড়েছে। কাদলে দুজন একসাথেই কেঁদে দিবে। ওরা দুজন পাল্লা ধরে কাঁদছে আর জেমি অসহায় চোখে মাথায় হাত দিয়ে চেয়ে চেয়ে দেখছে ওদের। কাকে রেখে কাকে শান্ত করবে ও?
সময় প্রবাহমান। সময় সময়ের গতীতে বয়ে চলে। জেমি আর জায়ান সেদিন অতীত ভুলে নতুন করে সব শুরু করেছিলো বলেই সেদিনের পর কেটে গেছে তিন বছর। সেদিনের পর জেমি আর জায়ান আর পেছনে ফিরে তাকায় নি বলেই আজ ওদের কোল আলো করে দুইজন এসেছে। জেমির টুইন বেবি হয়েছে তাও আবার একটা ছেলে আর একটা মেয়ে। ছেলের নাম দিয়েছে নির্ঝর আর মেয়ের নাম নির্ঝুম। এই দুটো ওদের ডাক নাম। জেমি অনেক আগের থেকেই ঠিক করে রেখেছিলো। প্রায় ৫ মিনিট যাবৎ নিঝুম আর নির্ঝর দুজনে কেঁদেই চলছে জেমি ওদের শান্ত করতে না পেরে ওদের থেকে একটা চকলেট নিয়ে খেতে শুরু করে দিলো। ওদের কান্নার শব্দ শুনে জায়ান হন্তদন্ত হয়ে রুমে ঢুকলো। ঢুকে যা দেখলো তাতে ওর চড়ক গাছে। বাচ্চা দুটো কাঁদছে আর বাচ্চার মা খাটের উপর পা তুলে বসে বসে চকলেট খাচ্ছে। জায়ান গিয়ে দুজন কে একসাথে কোলে তুলে নিয়ে ওদের কান্না থামাতে থামাতে জেমির উদ্দেশ্যে বলে উঠলো…..

—তুমি ওদের না থামিয়ে বসে বসে চকলেট খাচ্ছো? তুমি কি এখনো বাচ্চা।

জেমি খামখেয়ালি ভাবে উওর দিলো…

—তোমার ছেলে-মেয়ে তুমি সামলাও ভাই। আমার বাবা এত ধৈর্য নেই।

বলেই আমার চকলেট খাওয়ায় মনোযোগ দিলো। জায়ানের মন চাচ্ছে নিজের মাথায় দেয়ালে ঠুকে দিতে। ও কাকে সামলাবে বাচ্চা দুটো কে নাকি বাচ্চার মাকে? জায়ান ওদের দুজনকেই চকলেট দিতে ওরা দুজন কান্না থামিয়ে দিলো। ওরা কান্না থামিয়ে জায়ানের গলা জড়িয়ে ধরে দুজন দুই গালে চুমু দিয়ে বলে উঠলো….

—বাবাই তুমি এত্ত গুলা ভালো।

জায়ান ও ওদের জড়িয়ে ধরে চুমু দিয়ে ওদের সাথে খেলতে লাগলো। পুরো রুম জুড়ে জায়ান আর নির্ঝর, নির্ঝুম দৌড়াচ্ছে ওদের খিলখিল হাসির শব্দ রুমে বাজচ্ছে। জেমি ওদের দিকে এক নজরে তাকিয়ে আছে। ওর চোখের কোনে পানি জমে গেলো। সত্যি জীবন অনেক কঠিন৷ তুমি লড়াই করে বেঁচে থাকো একদিন সুখের মুখ দেখবে। আজ জেমি সুখের মুখ দেখছে এত সুখে ওর বুকের ভেতর খুশিতে ঢৈউ খেলছে। জেমির চোখ জুড়িয়ে গেলো ওদের খুনশুটি দেখে। এত সুখে বিষাক্ত অতীত ওর মনে ও পড়েনা। সবাইকে একবার সুযোগ দিতে হয় না হয় ওরা নিজেকে শুধরানোর সুযোগ পাবেনা। জায়ান সেদিনের পর আজ অব্দি জেমির দিকে চোখ তুলে তাকিয়ে অব্দি কথা বলে না। জেমি তাকিয়ে এইসব এই ভাবছিলো। জায়ান এসে জেমির পাশে বসে জেমির কাঁধে হাত রাখতেই জেমি নিশ্চুপে ওর বুকে মাথা রেখে বলে উঠলো…

–আমরা সারাজীবন এইভাবেই হাসি খুশি থাকবো জায়ান।

জায়ান জেমির মাথায় ঠোঁট ছুঁয়ে বলে উঠলো…

—অবশ্যই থাকব মাই কুইন।

এর মাঝেই নির্ঝর আর নির্ঝুম এসে ওদের দুজন কে জড়িয়ে ধরতেই ওরা দুজনেই ওদের দুজনকে কোলে তুলে নিলো। আজ সমস্ত সুখ ওদের পরিবারে। আজ জেমির পরিবার সম্পূর্ণ। এই পরিবারে কোনো দুঃখ নেই। আজ শুধু সুখ। এই বাড়িটাকে জেমির এখন সুখের রাজ্য মনে হয়
আর এই সুখের রাজ্য রাজা-রানী আর রাজকন্যা রাজপুত্র মিলে সারাজীবন খুব সুখে থাকুক। ওদের জীবন চলুক ওদের মতো আর গল্প এখানেই সমাপ্তি হলো।

#সমাপ্ত

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here