বিবর্ণ আলোকবর্ষ পর্ব -০৪

#বিবর্ণ_আলোকবর্ষ
#পর্বঃ৪
#লেখিকাঃদিশা মনি

আতিকের কাছে ডিভোর্স পেপার পাঠিয়ে আলো চলে আসে নিজের গন্তব্যে। আমিনা বেগম অনেকবার তাকে বলেছিল তাদের বাড়িতে থাকতে কিন্তু আলো কোন কথা শোনেনি। আমিনা বেগমকে নিজের মায়ের সম্মান দিয়েছিল আলো আর বিনিময়ে যা পেল তাতে আর তার উপর ভরসা নেই আলোর।

আলো নিজের বাপের বাড়িতে যাওয়ার উদ্দ্যেশ্যে বাসে উঠেছে। আলো জানে সামনে ভালো কিছু হবে না।তবুও সে মনে সাহসের সঞ্চার করে। বাসে বসে থাকতে থাকতে কখন যে চোখটা লেগে যায় আলো সেটা টের পায়নি।

আচমকা কারো ডাকে আলোর ঘুম ভেঙে যায়। আলো তাকিয়ে দেখে তার চাচাতো ভাই সজীব তার দিকে তাকিয়ে হাসছে। আলো সজীবকে বলে,
‘সজীব ভাই আপনি!’

‘কিছু প্রয়োজনীয় কাজে ঢাকা এসেছিলাম। এখন আবার জামালপুরে ফিরে যাচ্ছি। বাট তুই কোথায় যাচ্ছিস আর এভাবে একা বাসে উঠেছিস কেন? তোর স্বামী কোথায়?’

আলো দ্বিধায় পড়ে যায় সজীবকে সব বলা ঠিক হবে কিনা। সজীব আলোকে চুপ থাকতে দেখে নিজেই বলে,
‘ও বুঝেছি তুই নিশ্চয়ই সাজিদ ভাইয়ার সাথে মায়ার বিয়ের কথা জেনে গেছিস। তাই জামালপুর যাচ্ছিস।’

আলো কথাটা শুনে বেশ চমকায়। মায়া হলো আলোর সৎবোন আর সাজিদ সজীবের বড় ভাই। আলো ভাবে মায়ার বিয়ে অথচ তাকে কেউ এই ব্যাপারে জানাল না। অন্য কেউ না জানাক তার সৎমা মালেকা বেগম অথবা বড় বোন জোনাকি তো জানাতে পারত। বিয়ের পর কি সে পর হয়ে গেছে? আলো খুব কষ্ট পায় ব্যাপারটায়। সজীবকে ব্যাপারটা বুঝতে না দিয়ে বলে,
‘আমি অন্য কারণে যাচ্ছি। অনেকদিন থেকে বাড়িতে আসা হয়না তো। ওদের বিয়ের ব্যাপারে প্রথম শুনলাম।’

আলোর কথাটা শুনে সজীব ভাবনায় পড়ে যায়। মায়ার বিয়ে অথচ এই ব্যাপারে আলোকে কিছু জানানো হচ্ছেনা। পরে আবার ভাবে এখনো এক সপ্তাহ বাকি আছে তাই হয়তো কেউ কিছু বলে নি।

সজীব আলোর পাশের সিটে বসে।

‘আমাদের যখন দেখা হয়েই গেল তখন একসাথেই যাই নাহয়। তোর বরকে নিয়ে এলে ভালো হতো।’

‘উনি আসলে কিছু কাজে ব্যস্ত তাই আসতে পারেন নি।’

আলো মিথ্যা কথা বলতে পছন্দ করে না। ভরা বাসে এভাবে সবার সামনে সব কথা বলতেও চায়না সে। তাই বাধ্য হয়ে মিথ্যাই বলতে হলো তাকে।

৭.
‘আলো ওঠ আমরা এসে গেছি।’

সজীবের ডাকে ঘুম ভাঙে আলোর। এই ক’দিনে যা ধকল গেছে তারপর একটুতেই ক্লান্ত হয়ে যায় আলো। আতিকের কারাগারে যাওয়ার এক সপ্তাহ পেরিয়ে গেছে। এই এক সপ্তাহ আলোকে হাসপাতালেই থাকতে হয়েছে। হাসপাতাল থেকে বেরিয়েই আলো প্রথমে উকিলের সাথে যোগাযোগ করে ডিভোর্স নিয়ে কথাবার্তা বলে। ডিভোর্স পেপার তৈরি করে আতিকের কাছে পাঠিয়ে দেয়। এখন আলো খুবই চিন্তিত তার ভবিষ্যৎ নিয়ে। এইচএসসি পাস করেই তাকে বিয়ে দিয়ে দেওয়া হয়। তাই এখন তাকে বাবার বাড়িতেই থাকতে হবে কারণ সে যে এখন বড্ড অসহায়।

‘কি হলো বসে আছিস কেন? চল তাড়াতাড়ি নাম। বাস তো আবার স্টার্ট করবে।’

আলো উঠে পরে। বাস থেকে নামার সময় পড়ে যেতে ধরে আলো। সজীব আলোকে ধরে ফেলে। শান্ত গলায় বলে,
‘সাবধানে চলাফেরা কর। এত বড় হয়ে গেছিস, বিয়েও হয়ে গেল বাট চঞ্চলতা এখনও গেল না। ছোট থেকেই ছুটোছুটি করে বেড়াতি এই বাড়ি থেকে ঐ বাড়ি।’

আলো মৃদু হাসে। তখনকার আলোর সাথে এখনকার আলোর যে কত পার্থক্য সেটা হয়তো সজীব জানে না। এই একবছরে আতিকের সাথে সংসার করে অনেক বদলে গেছে সে।

আলো ধীরে সুস্থে বাস থেকে নামে। সজীব একটা সিএনজি ডেকে আনলে আলো সজীবের সাথে সিএনজিতে উঠে পড়ে। সিএনজিতে বসেও আলোর চোখে রাজ্যের ঘুম এসে ধরা দেয়। সজীব আলোর দিকে তাকায়। এই এক বছরে মেয়েটা অনেক বদলে গেছে। আগে কিরকম চঞ্চল ছিল, মুখ দিয়ে কথার খই ফুটত। আর এখন এতক্ষণ যে সজীবের সাথে ছিল অথচ সেরকম কোন কথাই বলেনি। বেশিরভাগ সময় তো ঘুমিয়েই কা’টিয়ে দিল। সজীব আলোকে জিজ্ঞেস করে,
‘তুই ঠিক আছিস তো আলো?’

আচমকা এরকম প্রশ্নে চমকে ওঠে আলো। নিজেকে ধাতস্থ করে বলে,
‘আমি তো ঠিকই আছি। কি আর হবে আমার। আলোদের কি এত সহজে ভেঙে পড়লে চলে। তাদের যে গোটা একটা বিবর্ণ আলোকবর্ষ পারি দিতে হয়।’

আলোর কথাগুলোর কোন মানে খুঁজে পায়না সজীব। তার মনে হয় আলো ঠিক নেই। আলোর নিশ্চয়ই কোন সমস্যা হয়েছে।

‘আলো তুই সত্য করে বল তো আমায় তুই কি সত্যি ঠিক আছিস? আমার তোর ব্যবহার স্বাভাবিক লাগছে না একদমই। বিয়ের পর শুধু একবারই এসেছিলি সেই তারপর থেকে আর আসিস নি। তোর স্বামী তোর এখানে আসাটা পছন্দ করেনা শুনেছিলাম। আর সে তোকে এভাবে একা আসতে দিল। এটা ঠিক আমার বিশ্বাস হচ্ছেনা।’

‘সবকিছু ঠিক আছে সজীব ভাই। সব জিনিস সহজ সরলভাবে দেখতে শেখো তাহলে বুঝতে পারবে সবকিছু কত সহজ, স্বাভাবিক। বেশি ভিতরে গেলে যে অন্ধকারে তলিয়ে যেতে হবে।’

‘তুই কবে থেকে এরকম হেয়ালি করে কথা বলা শিখে গেছিস?’

‘যবে থেকে ভাগ্য আমার সাথে হেয়ালি করতে শুরু করেছে।’

সজীব, আলো দুজনই আর কোন কথা বলে না। পুরো রাস্তাটা তারা নিশ্চুপ থাকে। সন্ধ্যার দিকে তারা বাড়ির কাছাকাছি পৌছে যায়। আলোদের বাড়ি জামালপুরের মেলান্দহ উপজেলা শহরে। বাড়িটা বেশি বড় নয় একটি মহল্লায় ছোট পাকা একটা বাড়ি। তবে তাদের বাড়ির পাশেই রয়েছে সজীবদের দোতলা বাড়ি। সজীবদের আর্থিক অবস্থা বেশ ভালো। আলো এবং সজীব সিএনজি থেকে নামে। সজীব ভাড়া মিটিয়ে দেয় তারপর বাড়ির দিকে অগ্রসর হয়।

৮.
‘ছোট চাচি কোথায় তোমরা বাইরে এসো দেখো কাকে নিয়ে এসেছি।’

সজীবের ডাকে মালেকা বেগম রান্নাঘর থেকে ছুটে আসেন। এসে বলেন,
‘কে এসেছে সজীব?’

সজীবের পাশে আলোকে দেখে মালেকা বেগম অনেক খুশি হন। যদিও আলো তার সৎ মেয়ে তবুও আলোকে নিজের মেয়ের থেকে কম ভালো বাসেন নি তিনি।

আলো মালেকা বেগমকে সালাম দেয়।
মালেকা বেগম বলেন,
‘আলো তুই, তুই যে আসবি বলিস নি তো। আগে বললে আমি তোর জন্য তোর পছন্দের সবকিছু রান্না করতাম। তোর জামাই কোথায়?’

‘কেন আমি একা আসতে পারি না?’

‘কেন পারবি না এটা তোরই বাড়ি। যখন খুশি আসবি। সজীব তুই ওর দেখা কোথায় পেলি?’

‘আর বলো না চাচি আমি ঢাকা থেকে ফেরার সময় বাসে উঠে আলোকে দেখি। আলো একা আসছে শুনে আমিও অবাক হই। ও বললো ওর স্বামী নাকি কাজে ব্যস্ত আছে তাই একাই এসেছে।’

‘আচ্ছা। আলো তুই যা তুই যেই রুমে থাকতি সেখানে যা। জোনাকি আছে রুমে তোকে দেখলে খুব খুশি হবে। মেয়েটা প্রতিদিনই তোর কথা বলে। তোর স্বামী তোকে আসতেও দিতনা। যাক সেসব কথা। এখন যে আসতে পারছিস এটাই অনেক।’

আলো বিনাশব্দে নিজের রুমের দিকে যায়। আলোর এরকম নিশ্চুপতা দেখে মালেকা বেগমও হতবাক হন।

‘তুমিও মনে হয় আলোর এইরকম ব্যবহারে অবাক হয়েছ তাই না চাচি?’

‘মেয়েটা এরকম ব্যবহার করল কেন সজীব? আমার সত্যিই খুব চিন্তা হচ্ছে। মেয়েটাকে আমার গোটা মহল্লার লোক বা’চাল বলে জানতো আর আজ সেই মেয়ে এত শান্ত। কোন বিপদ হয়নি তো আলোর?’

‘কার বিপদের কথা বলছ আম্মু?’

‘জানিস মায়া তোর আলো আপু এসেছে।’

আলোর আসার কথাটা শুনে মায়া একটুও খুশি হয়না। আলোকে সে একটুও পছন্দ করে না। শুধু আলো কেন জোনাকিও তার অপছন্দের তালিকায় রয়েছে। কারণ তারা জোনাকির সৎ বোন হলেও মালেকা তাদের সবাইকেই সমান ভালোবেসেছে। ঠিক এই কারণেই মায়ার তাদের প্রতি এত রাগ। মায়া মুখ ভেংচি দিয়ে বলে,
‘আলোর স্বামী নাকি ওকে একা কোথাও আসতেই দেয়না। তাহলে এখন কিভাবে আসল?’

‘কেন তুই কি ওর আসায় খুশি হসনি। আজ নাহয় কাল ওকে তো আসতেই হতো। আর কয়েকদিন পরই তোর বিয়ে হবে। একটু নাহয় আগেই এসেছে।’

‘আমার বিয়েতে ওর আসাটা কি খুব দরকারি ছিল? আমি তো চাইনি ও আসুক। সাজিদ ভাইয়ে পাশে আমায় মেনে নিতে পারবে ও?’

পাশে সজীব ছিল জন্য মালেকা কিছু বলতে পারেন না। সাজেদ আর আলোর মধ্যে যে একটা প্রেমের সম্পর্ক ছিল সেটা সাজিদ না জানলেও মালেকা বেগম খুব ভালো করেই জানে। তিনি তাই মায়াকে চুপ করানোর জন্য বলেন,
‘মুখে একটুও লাগাম নেই তোর তাইনা? কখন কোথায় কোন কথা বলতে হয় সেটা আজও শিখলি না। যা এখান থেকে।’

মায়া বিরক্তিতে মুখ দিয়ে চ জাতীয় শব্দ বলে সেখান থেকে চলে যায়।

আলো রুমে এসে জোনাকিকে দেখে। জোনাকি আলোকে দেখে ছুটে এসে তাকে জড়িয়ে ধরে। দুইবোন এতদিন পর একে অপরকে দেখে খুশিতে কেদেই দেয়।

আচমকা কেউ পেছন থেকে এসে আলোর চু’লের মু”ঠি টেনে ধরে।
চলবে ইনশাআল্লাহ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here