বিবর্ণ আলোকবর্ষ পর্ব -০৫

#বিবর্ণ_আলোকবর্ষ
#পর্বঃ৫
#লেখিকাঃদিশা মনি

আচমকা মায়া পেছন থেকে এসে আলোর চু’লের মু”ঠি টেনে ধরে। আলো ব্যাথায় আহ করে ওঠে। মায়ার আলোর উপর একটুও দয়া হয়না সে আরো জোরে আলোর চু’ল টানে। জোনাকি এগিয়ে এসে আলোকে ছা’ড়িয়ে নেয়। মায়া রাগে ফু’সতে ফু’
‘সতে বলে,
‘কেন এসেছিস তুই? সাজিদ ভাইয়ের সাথে আমার বিয়ের কথাটা কোনভাবে জেনে গেছিস তাইনা? সেইজন্য চলে এসেছিস যেকোনভাবে বিয়েটা যদি আটকানো যায় সেই ধান্ধায়।’

আলো কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে যায়। মায়ার এই ব্যবহার যদিও তার কাছে নতুন কিছু না। ছোটবেলা থেকেই মায়া আলো আর জোনাকির সাথে এরকম আচরণ করে। তারা মায়াকে সৎবোনের চোখে না দেখে নিজের বোনের চোখে দেখলেও মায়া তাদের কখনো আপন ভাবেনি।

জোনাকি মায়াকে এভাবে আলোর চু’ল ধরতে দেখে বলে,
‘ছেড়ে দে ওকে লাগছে তো।’

মায়ার রাগ আরো বেড়ে যায়।

‘এই তুই চুপ থাক। নিজে তো একটা অ’পয়া বাচ্চার জন্ম দিতে পারিস নি ব’ন্ধা মেয়ে কোথাকার, স্বামীও সহ্য করতে না পেরে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে। এখন আমাদের ঘাড়ে বসে খাচ্ছিস আবার বড় বড় কথা।’

মায়ার কথাগুলো শুনে জোনাকি থম মে’রে যায়। আলো হতবাক হয় জোনাকির এরকম ব্যবহারে। ছোটবেলা থেকেই আলো বা’চাল, জোনাকি চুপচাপ শান্ত। বা’চাল হলেও আলো কখনো মায়ার ব্যবহারের সেরকম প্রতিবাদ করেনি। সবসময় মুখ বুজে সহ্য করেছে। জোনাকি কখনো সেরকম করেনি। ছোটবেলা থেকেই সে প্রতিবাদী ছিল। আজ তার এভাবে গুটিয়ে যাওয়া আলো মেনে নিতে পারে না।

ঠা’স করে একটা থা’প্প’র বসিয়ে দেয় মায়ার গালে। মায়া গালে হাত দিয়ে আলোকে খারাপ ভাষায় গালি দেয়। আলো তখন আরো রেগে গিয়ে মায়ার অপর গালে আরো একটি থা’প্প’র মা’রে।

‘আলো তুই আমায় মারলি? এত বড় সাহস তোকে কে দিল?’

‘আলো না আলো আপু বল। ভুলে যাবিনা আমি তোর থেকে বয়সে বড়। আর জোনাকি আপুকে এত কথা বলার তুই কে? কত টাকা কামাই করিস তুই? ভুলে যাবিনা তুই এই বাড়ির মেয়ে হলে আমরাও এই বাড়িরই মেয়ে। তাই জোনাকি আপু যদি ঘরে বসে খায় তাহলে তুইও তাই করিস। জোনাকি আপু তো তাও ঘরের একটু কাজকর্ম করে তুই তো সেটাও করিস না।’

আলোর কথা শুনে রাগে ফুসতে ফুসতে ঘর থেকে বেরিয়ে যায় মায়া। জোনাকি বলে,
‘আলো তুই তো অনেক বদলে গেছিস। জীবনে এই প্রথম তুই মায়ার গায়ে হাত তুললি।’

আলো মৃদু হেসে বলে,
‘তুমিও তো বদলে গেছ আপু। তোমার মধ্যে তো আগের সেই প্রতিবাদী জোনাকি আপুকে দেখতে পাচ্ছি না। আসলে পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতিই মানুষকে বদলে দেয়। আমাদের সাথেও ঠিক তাই হয়েছে। তুমি প্রতিবাদ করে কোন ফল না পেয়ে ভেবেছ চুপ থাকাই ভালো, আর আমি চুপ থেকে কষ্ট সহ্য করে বুঝতে পেরেছি প্রতিবাদ করাই ভালো। দিনশেষে আমিই কিন্তু ঠিক।’

৯.
মালেকা বেগম খাবার পরিবেশন করছিলেন। মায়া হুট করে রান্নাঘরে ছুটে এসে বলে,
‘কার জন্য এত রাজভোজ সাজাচ্ছ আম্মু?’

‘কার জন্য আবার আলোর জন্য। কতদিন পর মেয়েটা এলো একটু খাতির যত্ন করব না।’

আলোর কথা শুনে মায়ার মাথা গরম হয়ে যায়। একটু আগে খা’ওয়া থা’প্প’রের কথা মনে আসতেই মায়া সব খাবার ফেলে দেয়। মালেকা বেগম খুব রেগে যান মায়ার এই আকস্মিক ব্যবহারে।

‘কি করলি মায়া? আমি কত কষ্ট করে এতকিছু রান্না করলাম আর তুই সব ফেলে দিলি।’

‘বেশ করেছি আরো হাজারবার ফেলব। সৎমেয়ের প্রতি এত দয়ামায়া কোথা থেকে আসে তোমার? আমি তো মাঝেমধ্যেই গু’লিয়ে ফেলি আমি তোমার নিজের মেয়ে নাকি ওরা।’

‘আমার কাছে তোরা প্রত্যেকেই সমান।’

‘জানো তোমার ঐ আলো আজ আমার থা’প্প’র মেরেছে। দেখো আমার গালগুলো কিরকম লাল হয়েছে।’

মালেকা বেগম মায়ার গালের দিকে কিছুক্ষণ পরখ করে বলেন,
‘আমি আলোকে খুব ভালো করেই চিনি। ওকে জন্ম দেইনি ঠিকই কিন্তু ছোটবেলা থেকে কোলেপিঠে করে মানুষ করেছি। আমি খুব ভালো করেই জানি আলো এমনি এমনি তোর গা’য়ে হাত তুলবে না। ছোটবেলা থেকে মেয়েটাকে কত অত্যা’চার অপমান করেছিস তুই। মেয়েটা তো সব সহ্য করেছেম আজ নিশ্চয়ই বেশি বাড়াবাড়ি করে ফেলেছিস। তাই আলো নিজেকে সামলাতে পারেনি। আমার তো এখন ইচ্ছা করছে তোর গালে আরো একটা চ’ড় মা’রতে।’

নিজের মায়ের মুখে এরকম কথা শুনে আলোর প্রতি মায়ার রাগের মাত্রা আরো বেড়ে যায়। মায়া বিড়বিড় করে বলে,
‘তোকে আমি ছাড়ব না আলো। দেখ শুধু তোর সাথে কি কি হয়।’

মালেকা বেগমের মন খুব খারাপ হয় তার মেয়ের এরকম ব্যবহারে। ছোটবেলা থেকেই মেয়ের এই ব্যবহার দেখে আসছেন। শা’সন করেও মায়াকে ঠিক করতে পারেন নি। দিন কে দিন তার হিং’সা রাগ আরো বৃদ্ধি পাচ্ছে। মালেকা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে।

আলোর জন্য কতকিছু রান্না করেছিলেন সব খাবার মায়া ফেলে দিও। মেয়েটা কতদিন পর এলো আর ভালোমন্দ কিছু খাওয়াতে পারলেন না এটা ভেবেই মালেকার খারাপ লাগছে।

আলো জোনাকির সাথে গল্পগুজবে ব্যস্ত ছিল। কথায় কথায় জোনাকি আলোকে আতিকের সম্পর্কে জিজ্ঞেস করে। আতিকের নাম শুনে আলোর মনটা বি’ষিয়ে ওঠে। চোখের সামনে ভেসে আসে ভ’য়ংকর সব অতীত। আতিকের নোং’রা চেহারাটাও মনে পড়ে। আলো দ্রুত প্রসঙ্গ পরিবর্তনের চেষ্টা করে। জোনাকির সন্দেহ হয় ব্যাপারটা নিয়ে।

‘আলো তুই সত্যি করে বল কি হয়েছে। আমার মনে হয় না সবকিছু ঠিক আছে। আতিক তোকে একা এখানে আসতে দিল, আসার পর তোকে একবারও দেখলাম না আতিক ফোন করে খোঁজ খবর নিচ্ছে। তুইও এই বিষয়ে কিছু বলছিস না।’

আলো আর নিজের আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। জোনাকির সামনেই ফুপিয়ে কেদে দেয়। জোনাকি এবার নিশ্চিত হয়ে যায় নিশ্চয়ই কোন না কোন ঝামেলা হয়েছে।

১০.
‘আম্মু জানো আলো এসেছে ঢাকা থেকে। কতদিন পর মেয়েটাকে দেখলাম আগের থেকে শুকিয়ে গেছে। এখন অনেকটা চুপচাপ হয়ে গেছে জানো।’

খাবার টেবিলে বসে নিজের আম্মু দেলোয়ারার সাথে কথা বলছিল সজীব। দেলোয়ারা আলোর আসার কথা শুনে খুব খুশি হন। তিনি বলেন,
‘কি বললি আলো এসেছে। আমি কালই যাব ওর সাথে দেখা করতে। কতদিন থেকে মেয়েটাকে দেখি না। আগে তো চাচি বলতে পাগ’ল ছিল। সবসময় আমার কাছে এসে যত রাজ্যের গল্প জুড়ে দিত। আর এখন কিনা সেই মেয়ে চুপচাপ হয়ে গেছে। কাল গিয়ে দেখে আসবো একবার।’

টেবিলের এককোণে বসেছিল সাজিদ।আলোর আসার কথা শুনে সাজিদ খাওয়া থামিয়ে দেয়। তার মনটা উশখুশ করছিল একটিবার আলোকে দেখার জন্য। ভাগ্য কতটা নি’ষ্ঠুর। আগে যেই আলোকে না দেখে সে একদিনও থাকতে পারতো না এখন তাকে না দেখেই দীর্ঘ একটা বছর কা’টিয়ে দিল সাজিদ।

সাজিদকে খুব অস্থির দেখাচ্ছিল। দেলোয়ারর নজর সাজিদের দিকে যায়।

‘সাজিদ তুই এভাবে চুপচাপ বসে আছিস কেন? আর তোকে এত অস্থির কেন লাগছে যে কোন সমস্যা?’

‘আমি একটু বাইরে যাচ্ছি আম্মু।’

‘এত রাতে কোথায় যাচ্ছিস তুই? খাবার শেষ করে যা।’

‘ক্ষিধে নেই। পরে এসে খেয়ে নেব।’

সাজিদ দ্রুত বেরিয়ে যায়। দেলোয়ারা বেগম বলতে থাকেন,
‘কি হলো টা কি ছেলেটার? না খেয়ে বেরিয়ে গেল।’

দেলোয়ারা বুঝতে না পারলেও সজীব ব্যাপারটা বুঝতে পারে। আলোর প্রতি সাজিদের অনুভূতি সম্পর্কে সজীব খুব ভালো ভাবেই অবগত।

যদিও সাজিদ নিজের মুখে তাকে কিছু বলেনি কিন্তু আলোর প্রতি সাজিদের কেয়ার, তাকে চোখে চোখে রাখা, বারবার আলোর কাছে ছু’টে যাওয়া এসবই তাকে বুঝিয়ে দিয়েছে সাজিদের অনুভূতি। এই কারণেই তো সে আলোর জন্য নিজের মনে অনুভূতিগুলোকে সযত্নে লুকিয়ে রেখেছিল সবসময়।

এখন আর এসব ভেবে কোন লাভ নেই। আলো এখন অন্য কারো। সাজিদেরও কিছুদিন পর বিয়ে হবে। সজীবকেও হয়তো অন্য কাউকে বিয়ে করতে হবে। কেন যে কেউ তার পছন্দের মানুষটাকে নিজের করে পায়না। সজীব দীর্ঘ শ্বাস ফেলে। সাজিদ তবুও আলোকে নিজের মনের কথা জানাতে পেরেছিল। যার কারণে তার মনের বো’ঝা একটু হলেও হালকা হয়েছিল। কিন্তু সজীব তো এই জায়গায় পুরোপুরি ব্যর্থ। আলোকে নিজের মনের কথা বলার সাহস সে দেখাতে পারেনি, হয়তো কখনো পারবেও না।

আলো কান্না দেখেই জোনাকি বুঝতে পারে বড় কোন সমস্যা হয়েছে। আলোকে একটু চাপ দিতেই আলো জোনাকিকে পুরো ঘটনা খুলে বলে।

নিজের শরীরে আতিকের দেওয়া সব আঘাত সে দেখায় জোনাকিকে। জোনাকি নিজের বোনের এই করুণ অবস্থার কথা শুনে খুব কষ্ট পায়। আলো এতকিছুর পরেও সংসার টিকিয়ে রাখতে চেয়েছিল। অথচ আতিক এতোটাই খারাপ যে তাকে জে’লে যেতে হয়েছে। বিভিন্ন আশংকা জোনাকির মনে বাসা বাধে। তাকে ডিভোর্সি হওয়ায় এতদিন যেসব কথা শুনতে হয়েছে আলোকেও এখন তেমন কথা শুনতে হবে। জানি না এসব ব্যাপার জানাজানি হলে আলোকে কত কঠিন পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যেতে হবে। জোনাকি কিভাবে আগলাবে এখন নিজের বোনকে?

দরজায় দাড়িয়ে আলো ও জোনাকির সব কথোপকথন শুনে ফেলে…
চলবে ইনশাআল্লাহ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here