বিবর্ণ আলোকবর্ষ পর্ব -০৬

#বিবর্ণ_আলোকবর্ষ
#পর্বঃ৬
#লেখিকাঃদিশা মনি

দরজায় দাড়িয়ে আলো ও জোনাকির সব কথোপকথন শুনে ফেলে সাজিদ। আলোর জীবনের এত কষ্টের কথা শুনে সাজিদের খুব খারাপ লাগে।

আলো উপলব্ধি করতে পারে কেউ দরজায় দাঁড়িয়ে সব কথা শুনছে। আলো এগিয়ে গিয়ে সাজিদকে দেখে চমকে যায়। সাজিদ হেসে বলে,
‘তোর সাথে দেখা করতে এসেছিলাম আলো। কেমন আছিস তুই?’

‘লুকিয়ে যে কারো কথা শুনতে নেই এটা তুমি জানো না সাজিদ ভাই? আর কথাগুলো যখন শুনতেই পেরেছ তাহলে আমি কেমন আছি সেটা তুমি নিশ্চয়ই বুঝে গেছ।’

আলোর এরকম শক্ত কথা শুনে সাজিদ রেগে যায়।

‘তুই কি ভদ্রতা ভুলে গেছিস আলো? আমি তোর খোঁজ খবর নিতে এলাম আর তুই,,,’

‘আমি বলেছি আমার খোঁজ নিতে? আমার ব্যবস্থা আমি নিজেই করে নিতে পারবো। তুমি যাও এখান থেকে।’

সাজিদ অপমানিত বোধ করে। আলোর উপর রাগ করে হনহন করে চলে যায়।

সাজিদ যাওয়ার পর জোনাকি আলোকে বলে,
‘তুই এভাবে কেন কথা বললি সাজিদের সাথে? তুই জানিস না ও তোকে,,,’

জোনাকির কথাটা পুরোপুরি শেষ করতে দেয় না আলো। তার আগেই বলে,
‘পুরাতন কথা ভেবে কোন লাভ নেই আপু। আমার জীবন এখন অনেক এগিয়ে এসেছে। সাজিদ ভাইয়ের অনুভূতি যাই হোক সেটা এখন অতীত। বর্তমানে আমাদের পথ সম্পূর্ণ আলাদা। তাছাড়া সাজিদ ভাইয়ের সাথে মায়ার বিয়ে হতে চলেছে। আমি চাইনা সাজিদ ভাইয়ের সংস্পর্শে আসতে।’

‘আমার খুব চিন্তা হচ্ছে তোর জন্য আলো। এখন তুই কি করবি?’

‘আপাতত চেষ্টা করছি কোনভাবে এই সমাজে টিকে থাকার।’

১১.
মালেকা বেগম রাতের খাবার তৈরি করে সবাইকে খেতে ডাকেন। মায়া রাগ করে খেতে আসবে না বলে দিয়েছে।

আলোর বাবা আসাদুল করীম খেতে বসে আলোকে এতদিন পর দেখে খুব খুশি হন। আলো ছোটবেলা থেকেই আসাদুল করীমের চোখের মণি। আলোকে নিজের হাতে খাওয়ানো, পড়ানো সব করেছেন তিনি। আজ দীর্ঘ একবছর পর মেয়েকে কাছে পেলেন তিনি। তাই খাতির যত্নের কোন ত্রুটি রাখতে চান না।

খাওয়ার সময় একপর্যায়ে আলোকে আতিকের কথা জিজ্ঞেস করে আসাদুল করীম। আলো খাওয়া থামিয়ে দেয়। আতিকের কথা শুনে তার চোখে জল চলে আসে। আলো আর চুপ থাকতে পারে না। আর কতক্ষণ সব লুকিয়ে রাখবে সে? তাই আলো এবার সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেলেছে যে সবাইকে সব সত্য বলবে। আলো এবার বলা শুরু করে,
‘আতিক এখন জে’লে আছে। ও একটা খা’রাপ লোক। দ্বিতীয় বিয়ে করে আমাকে বাড়ি থেকে বের করে দিতে চেয়েছিল তার থেকেও বড় কথা আতিক একজন ধ*র্ষ*ক।’

আলোর কথা শুনে আসাদুল করীম, মালেকা বেগম দুজনেই হতবাক হয়ে যান। আলো তাদের সম্পূর্ণ ঘটনা বলে।

সব শুনে আসাদুল করীমের দুচোখ রক্তবর্ণ ধারণ করে। তিনি রা’গী চোখে মালেকা বেগমের দিকে তাকান। মালেকা বেগম অপ’রা’ধীর মতো চোখ নামিয়ে নেন।

তিনিও বা কি করবেন? আমিনা তার অনেক ভালো বান্ধবী ছিল। আতিক এত ধনী তাই মালেকা বেগম ভেবেছিলেন আলো হয়তো এই বিয়ের পর সুখী হবে। তাই আমিনা বেগমের এককথায় তিনি বিয়েতে রাজি হয়ে যান। এরকম কিছু হবে সেটা আগে জানলে কখনো রাজি হতেন না।

আসাদুল করীম মালেকা বেগমকে মা’রতে উদ্যত হলে আলো আর জোনাকি মিলে তাকে থামিয়ে দেয়,
‘কি করছ আব্বু? আম্মুকে কেন মা’রছ? আম্মুর কোন দোষ নেই সব দোষ আমার ভাগ্যের।’

‘তুই চুপ থাক আলো। মানুষ ঠিকই বলে সৎমা কখনো মা হতে পারে না। এই মালেকা কখনো তোকে নিজের মেয়ে ভাবে নি। যদি তোকে মেয়ে ভাবত তাহলে কখনো এরকম একটা ছেলের সাথে তোর বিয়ে দেওয়ার কথা ভাবতো না।’

মালেকা বেগম আলোর কাছে এসে তার হাত ধরে বলে,
‘বিশ্বাস কর আলো আমি জানতাম না আতিক এরকম ছেলে। আমিনা অনেক ভালো মেয়ে ছিল জানিস তাই আমি ভেবেছিলাম ওর ছেলেও অনেক ভালো হবে। ওরা এত ধনী এত সম্পত্তি ওদের তাই,,,,’

আলো মৃদু হাসে।
‘ধন সম্পদ থাকলেই কি মানুষ সুখী হয় আম্মু? সুখী হওয়ার জন্য অর্থ যেমন প্রয়োজন তেমনি ভালোবাসা থাকাটাও জরুরি। ‘

‘ঠিক বলেছিস তুই আলো। আমি ভুল করেছি। এখন সেই ভুলের পরিণাম তোকে ভোগ করতেই হচ্ছে। পারলে আমাকে তুই ক্ষমা করিস।’

‘তোমার কোন দোষ নেই আম্মু। আমি জানি তুমি আমার ভালোই চাও।’

মুহুর্তের মধ্যে পরিস্থিতি ঘোলাটে হয়ে যায়। আসাদুল করীম মেয়ের চিন্তায় অস্থির হয়ে যান। বড় মেয়ে জোনাকি এমনিতেই কত অপমানের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, এখন আলোরও যদি একই দশা হয় তাহলে তিনি কিভাবে সামলাবেন?

নিজেকে নিয়ে তার কোন চিন্তা নেই৷ কথা শুনতে শুনতে এখন তার অভ্যাস হয়ে গেছে। তার চিন্তা নিজের আদরের মেয়ে আলোর জন্য।

সমাজ যে আলোর মতো মেয়েদের বাঁচতে দেয়না। সমাজের লোকের সমালোচনা যে আলোর মতো মেয়েদের গলা টি’পে মা’রে।

১২.
শীতকালে প্রকৃতি যেন বড্ড কঠিন হয়ে ওঠে। শীতের সকালে ঘুম থেকে উঠতেই ইচ্ছা করেনা।

আলো আর জোনাকি ঘুম থেকে উঠে ফজরের নামাজ পড়ে নেয়।

শীতের সকালে ঘুরে বেড়ানো আলোর একটি পছন্দের কাজ। এইসময় তাদের বাড়ির পেছনের মাঠে শিশির পরে৷ সেই শিশিরের উপর হাটতে তার বড্ড ভালো লাগে।

আজ অনেকদিন পর আলোর ইচ্ছা হলো আগের মতো খালি পায়ে মাঠে একটা চক্কর দিয়ে আসতে। জোনাকিকে বললে জোনাকি সোজাসুজি না করে দেয়।
‘এত সকালে যাওয়ার দরকার নেই। বাইরে কুয়াশা। ঠান্ডা লাগলে শরীর খারাপ করবে।’

‘আপু তুমি কোন চিন্তা করবো না আমি চাদর গায়ে দিয়ে যাব। আমি এসবে অভ্যস্ত।’

জোনাকি বোঝে আলোকে বলে কোন লাভ নেই৷ তাই আর আলোকে কিছু বলে না সে। শুধু বলে,
‘তাড়াতাড়ি চলে আসিস।’

আলো খুশি হয়ে গায়ে চাদর জড়িয়ে বেরিয়ে পড়ে। তাদের বাড়ির পেছনে বিশাল একটা মাঠ। এলাকার ছেলেরা এখানে খেলাধুলা করে। জুতা খুলে ঘাসের উপর পা রাখতেই আলো শিশিরে ভেজা ঘাসকে অনুভব করতে থাকে। মুহুর্তেই তার মনের অদ্ভুত এক প্রশান্তি বয়ে যায়।

মাঠে কিছুক্ষণ হাটার পর নিজের পেছনে কারো উপস্থিতি অনুভব করে আলো। পেছনে তাকিয়ে সজীবকে দেখে আলো স্বস্তি পায়।

‘এই অভ্যাসটা তাহলে এখনো আছে তোর? শীতের সকালে বাইরে ঘুরে বেড়াতে চলে এসেছিস।’

‘কিছু কিছু স্বভাব আজীবন থেকে যায়। চাইলেও বদলানো যায়না।’

‘তাহলে তুই এত অল্পভাষী হয়ে গেলি কেন?’

‘আগে অল্প কথায় অনেক কিছু বোঝাতে পারতাম না বলে।’

‘এখন তুই অল্প কথায় অনেক কিছু বোঝাতে পারিস? তাহলে বল আমি এত সকালে এখানে কেন এসেছি এর কারণ ব্যাখা কর।’

‘আমাকে দেখে চলে এসেছো।’

‘বুঝতে পেরেছিস তাহলে।’

সজীব হাসে। এই কারণেই সে নিচে এসেছে। ছাদে উঠে ব্যায়াম করার সময় মাঠে কাউকে দেখতে পায় সজীব। চারিদিক কুয়াশাচ্ছন্ন হওয়ার ঠিক বুঝতে পারে না এত সকালে কে মাঠে হেটে বেড়াচ্ছে। আলোর কথা মনে আসতেই বুঝে যায় আলোই হতে পারে। আলোর তো অভ্যাসই সকাল সকাল মাঠে ঘুরে বেড়ানো।

‘তো কি খবর তোমার সজীব ভাই? সাজিদ ভাই তো বিয়ে করছে এরপর তোমার বিয়ে করার পালা।’

‘কি যে বলিস তুই। আমার বিয়ে করার কোন ইচ্ছা নেই। আমি আজীবন অবিবাহিত থাকতে চাই।’

‘এরকম কথা অনেকেই ভাবে।’

‘যাকে ভালোবাসি, যাকে নিজের করে পেতে চেয়েছিলাম তাকেই তো পাইনি। তাই বিয়ের ইচ্ছে আমার আর নেই।’

সজীবের কথা শুনে আলোর ভ্রু কুচকে যায়। সে যতদূর জানতো সজীবের এরকম প্রেম ভালোবাসার কোন রেকর্ড নেই, সাজিদের ব্যাপারটা ভিন্ন, সাজিদ স্কুল-কলেজ থেকেই অনেক রিলেশনে ছিল। আলো সাজিদকেই পছন্দ করতো। তাই তো সাজিদের স্বপ্নে বিভোর ছিল সবসময়। দিনের অধিকাংশ সময় আগে সে সাজিদদের বাড়িতেই কা’টিয়ে দিত সাজিদকে একনজর দেখার জন্য৷ কিন্তু বেশিরভাগ সময় সাজিদের দেখা পেতো না। সজীব বেশ সকাল সকাল বাড়িতে আসত। স্কুল থেকে ফিরেই পড়ার টেবিলে বসে যেত। এরকম ছেলে যে কাউকে ভালোবেসে আজীবন অবিবাহিত থাকতে চাইতে পারে আলো সেটা ভাবতেই পারছে না।

আলোর ভাবনার মধ্যেই সজীব বলে,
‘কি ভাবছিস এত?’

‘কিছু না।’

আলো আর বেশিক্ষণ সেখানে না থেকে বাড়ি চলে আসে। ভালোবাসা শব্দটা শুনে আলোর এখন রাগ হয় খুব৷ একসময় সাজিদের প্রেমে কতটা পাগল ছিল সে। সবসময় চাইতো সাজিদ যেন আলোকে ভালোবাসে। যখন সাজিদের ভালোবাসা পেল তখনই ভাগ্য তার থেকে সাজিদকে আলাদা করে দিল। নিজের ভাগ্যের উপর খুব রাগ হয় আলোর। আলো বলতে থাকে,
‘জন্মের পর থেকেই আমাকে একটা বিবর্ণ আলোকবর্ষ পারি দিতে হয়েছে। আর কত আল্লাহ আর কতো? আমি যে আর সহ্য করতে পারছি না।’

দূর থেকে দাড়িয়ে আলোর কথাগুলো শুনে মালেকা বেগম বলেন,
‘তুই মুদ্রার একপিঠ দেখেছিস আলো আরেকপিঠ দেখিসনি।’
চলবে ইনশাআল্লাহ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here