বিবর্ণ সিঁদুর পর্ব ১২

বিবর্ণ সিঁদুর
পর্ব-১২
#Taniya Sheikh

রাত ঠিক চারটা বায়ান্ন, ওদের গাড়িগুলো আর সব গাড়ির সাথে ফেরিতে উঠেছে। সবার যেন কোমরে খিল ধরে এসেছিল এতোক্ষন গাড়িতে বসে। গাড়ি ঠিকঠাক ফেরিতে উঠতেই একে একে নামতে শুরু করল সব। মানুষের পদচারনা, হকারের হাঁক ডাকে মুখর আশপাশ। মিতুল ওয়াশরুমে যাবে বলে রজনীকে বলল,

” চল আমার সাথে।”

” কোথায়?”

” ওয়াশরুমে।”

“আচ্ছা,চল।” কিছুটা প্রয়োজন রজনীর নিজেরও ছিল। সুতরাং দু’জনই ওয়াশরুমে যাবে বলে গাড়ি থেকে নামল। ওর কাজিনরা আগেই নেমে গেছে। ফেরির দোতলায় ছোটোখাটো একটা হোটেল মতো আছে। মিতুলের কাজিন তিনজন সেখানেই গিয়েছে। বলেছে আসার সময় চা-কফি সহ যা পায় নিয়ে আসবে। রজনী মিতুলকে সাথে নিয়ে ডান দিকের ওয়াশরুমের সামনে সিরিয়াল ধরেছে।বা’দিকে দাঁড়ান ছেলেরা। মিতুলের সামনে পাঁচজন মহিলা। ছটফট করছে মিতুল। তাই দেখে রজনী মুচকি হেঁসে চাপাস্বরে বলল,
” দেখিস কেলেঙ্কারি যেন না হয়।”

” নিশ্চয়তা নাই। প্রকৃতি আর প্রবৃত্তি দমন করা সহজ নয়। আমারে ধরেছে সখি প্রকৃতির চাপ। এখন আমার অবস্থা বাপরে বাপ।”

কোমর ধরে অস্থিরভাবে পায়চারি করতে করতে বলে মিতুল। রজনী মুচকি হেঁসে কপাল চাপড়ায়।এই অবস্থায়ও এমন মজা কেবল মিতুলের দ্বারাই সম্ভব। কলেজে উঠে অনেকটা বদলে গেছে মিতুল। এখন বই কম সাজসজ্জায় মনোযোগ খুব। চঞ্চলতাও বেড়েছে আগের চেয়ে বেশি। তবে যাইহোক বন্ধু হিসেবে চমৎকার সে। অন্তত রজনী দৃষ্টিতে। অবশেষে ওয়াশরুমে ঢুকতে পারল মিতুল। ওয়াশরুমের বাইরে দাঁড়িয়ে এদিক ওদিক তাকাতেই অদূরে দাঁড়ান তন্ময় কে দেখল রজনী। পুরো মুখ ভেজা, নির্ঘুম চোখ দুটো মলিন আর রক্তাভ খানিকটা। ফেরির রেলিং ঠেস দিয়ে দাঁড়ান। এদিকে তাকাতেই রজনী দৃষ্টি সরিয়ে নেয়। একটু পর কেন যেন আবারও সেদিকে চোখ চলে গেল। তখনো একইভাবে চেয়ে ছিল তন্ময়। নিজের উপর বিরক্ত হয়ে ঘুরে দাঁড়ায় সাথে সাথে রজনী। তন্ময় স্যারকে দেখলেই সব গুলিয়ে যায়। ইচ্ছার চেয়ে অনিচ্ছার প্রভাব বাড়ে।

ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে মিতুল,রজনী গাড়িতে না বসে গিয়ে দাঁড়াল ফেরির এককোনে। চারপাশে পদ্মার অথই জলরাশি। এই অন্ধকারে ঢেউগুলোর সৌন্দর্য্য অন্যরকম। বাতাসের ঝাপটা এসে লাগছে ওদের গায়ে। শীত শীত অনুভব করতেই ওড়নাটা ভালোভাবে গায়ে জড়িয়ে নিল রজনী। ঢেউয়ের দুলে দুলে ভাসছে ফেরি। অদূরে আগত লঞ্চ,ফেরির আলো ছাড়া যতদূর চোখ যায় অন্ধকার। ঢেউয়ের শব্দ আর লঞ্চ, ফেরির হর্নের শব্দ মিলেমিশে কানে আসছে। সবকিছু মিলিয়ে সৃষ্টি হচ্ছে অন্যরকম অনুভূতির।

” দারুন না দৃশ্য? ” মিতুল দু’হাত ফেরির কিনারের ইস্পাতে ভর দেয়। রজনী চোখ বন্ধ করে লম্বা শ্বাস টেনে বলে,

” অপূর্ব। ভয়ংকর সুন্দর এই আছরে পড়া ঘোলাটে ঢেউ, তারচেয়ে সুন্দর কি জানিস?”

মিতুল মাথা নাড়ায় ওর দিকে চেয়ে।

” ঐ আকাশ। শূন্যতার মাঝেও পূর্ণতা ঐ আকাশ। পৃথিবীর সৌন্দর্যের একাংশ এই আকাশ আর জল। পানিচক্র মনে আছে তোর?

” হ্যাঁ।”

” একবার বাষ্প থেকে আকাশে মেঘ হয়ে ভেসে থাকে তো, পরে আবার বৃষ্টি হয়ে এই স্থলের বুকের জলরাশিতে মিশে এসব কানায় কানায় পূর্ণ করে, সঞ্জীবিত করে। জলের রূপবদল। বাষ্প,মেঘ অবশেষে সেই বৃষ্টিজল। ঘুরেফিরে একই স্থানে,একই রূপে। এ ধরা সুন্দর তার কারন আকাশ আর জল। দুইয়ে এক হলেই ধরা সুন্দর, পবিত্র হয়ে ওঠে।”

” কি বলছিস বলতো? এতোক্ষন জার্নি করে এমনিতেই শরীরের পার্টস পুটস ঢিলা। তোর কথা শুনে মাথা ঘুরান্টি দিতাছে এখন।”

” না,কিছু না। রাতের পদ্মা অনেক সুন্দর হুম।” রজনী ম্লান হাসল। মিতুল বলল,

” হুমম, যাকে বলে ভয়ানক সুন্দর। একবার পড়লে এতে, খোঁজ পাওয়া যাবে না কোনোমতে।”
রজনী শব্দ করে হাসল। বলল,
” তুই কি কবি হওয়ার প্লান করছিস?”

” না, তো? ওহ! কথা মিলিয়ে যাচ্ছে তাই। আরে পাগলি, ওটা তন্ময়’দার কারনে। পুরো জার্নিটা নষ্ট করে ছেড়েছে। অসহ্য।”

” অনেক রাগ দেখছি স্যারের উপর তোর।”

” অনেক।”

” হুমম, বড়’দা থেকে সরাসরি তন্ময়’দা।”

” হি! হি! রাগ উঠলে এমনই বলি আমি।”
একহাতে বান্ধবীর গলা জড়িয়ে হাসে মিতুল সাথে রজনীও। মিতুলের মা সামনের গাড়ি থেকে মিতুলকে ডাকে। মায়ের গাড়িতে বসে রজনীর সাথে মা’কে পরিচয় করিয়ে দেয় মিতুল। কিছুক্ষন আলাপচারিতা শেষে ওরা ফিরে আসে নিজেদের গাড়ির কাছে। এসে দেখে তন্ময় নিজের সিটে চোখ বন্ধ করে বসে আছে। দেখে মনে হচ্ছে ঘুমাচ্ছে। রজনী মিতুলকে চাপাস্বরে বলল,

” স্যার মনে হয় ঘুমাচ্ছে। ফেরি যতক্ষন ঘাটে না পৌঁছায় আমরা বরং বাইরেই দাঁড়ায় কি বলিস?”

” হুমম, চল।”

দুজনে হাত ধরাধরি করে ফেরির দোতলায় এসে দাঁড়ায়। মাঝ নদীতে ফেরি ভাসছে। নিচের চেয়ে উপরে প্রচুর বাতাস। গায়ের কাপড় পৎ পৎ করে উড়ছে। মুখের উপর এসে পড়ছে ছোট ছোট এলোমেলো চুল। বেশ হালকা লাগছে এখানে দাঁড়িয়ে, পাখির পালকের ন্যায়। রজনী রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে চোখ যতদূর যায় দেখছে। গায়ে গা লাগিয়ে পাশেই দাঁড়ান মিতুল। দুজনের মাঝের নীরবতা ভাঙে মিতুলের গলার স্বরে।

” একটা কথা জিজ্ঞেস করি তোকে?”

” বল।”

একটু ইতস্তত করে মিতুল বলল,

” তুই কি বড়’দাকে লাইক করিস?”

রজনী চমকে তাকায়। বিস্মিত গলায় বলে,

” মানে।”

” না, মানে এমনিতেই জিজ্ঞেস করলাম। মাইন্ড করিস না, দোস্ত।”

” না, এমনিতে নয়। সত্যি করে বল।”

” আরে, সত্যি বলছি। এমনিতেই। ”

” মিতুল, দ্যাখ। কি হয়েছে বল আমাকে। হঠাৎ এসব বলার মানে কি? আমার কসম লাগে, বল।”

এই কথা জিজ্ঞেস করবে না ভেবেছে বহুবার মিতুল। মাঝে মাঝে গলা অব্দি এসে গেলেও প্রকাশ করে নি। কিন্তু আজ নিজেকে রুখতে পারল না। মিতুলকে চুপ করে থাকতে দেখে রজনী মৃদু ঝাকুনি দিয়ে পুনরায় জিজ্ঞেস করে। পুরো পৃথিবীর অন্ধকার নেমে এসেছে যেন ওর মুখে। মিতুল লোকজনের ভীর থেকে ফাঁকা জায়গায় টেনে আনে রজনীকে। রজনী বার বার একই প্রশ্ন করছে। ওর গলার স্বর কাঁপছে মিতুল স্পষ্ট বুঝতে পারছে। মিতুল নিজেকে স্বাভাবিক রেখে বলল,

” রজনী, রাগ করিস না বাট,,!”

মিতুলকে কথা শেষ করতে দেয় না রজনী। ভেতরটা ওর অস্থির হয়ে উঠেছে। শ্বাস প্রশ্বাসের গতি ক্রমশ বেড়ে যাচ্ছে। অস্থির স্বরে বলে,
” মিতুল, তুই তো কোচিংএর বিষয় জানতিস। স্যার আমাকে এক্সট্রা সময় ক্লাস করাতো, সেটা শুধুমাত্র পড়ায় ভুল হতো সেই জন্যে। বাসায় পৌঁছে দিত এজ অ্যা টিচার হিসেবে৷ এর বেশি কিছুই ছিল না। তোকে তো বলেছিলাম আমি। তবুও কেন আজ হঠাৎ এমন কথা বলছিস?”

” রজনী, রিলাক্স মাইডিয়ার। আমি তোকে সন্দেহ করছি না।”

” তাহলে এসব কেন বলছিস? ”

” বলছি সেটা আমার বড়’দার জন্য।”

ভ্রুকুঞ্চন করে রজনী বলল,

” আমি বুঝলাম না।”

মিতুল রজনীর হাত ধরে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে,
” এটাই তো প্রবলেম। তুই কেন বুঝিস না বড়’দা তোকে লাভ করে? তুই কেন বুঝিস না অ্যাজ এ টিচার নয় এর বেশি কিছু তিনি ফিল করেন তোর প্রতি। তুই,,,!”

রজনী রেগে হাত ছাড়িয়ে বলে,
” মিতুল, শাট আপ। একদম মজা করবি না বলে দিচ্ছি। আমার কিন্তু এসব মজা পছন্দ না।”

” আমি মজা করছি না। আ’ম সিরিয়াস।”

” মিথ্যে কথা।”

মিতুল ঘুরে দাঁড়ায়। অদূরে দৃষ্টি রেখে বলে,
” না, মিথ্যা নয়। বড়’দার ফ্রেন্ডস মহলে এসবই আজকাল চর্চা হচ্ছে। অনেকেই জানে। কিন্তু যার জানার দরকার নেই আনজান। আমি তোকে কথাটা বলতে চায়নি কিন্তু না বলেও থাকতে পারলাম না। ”

রজনীর মাথা ঘুরছে। দু’হাতে রেলিং ধরে রেখেছে সর্বশক্তি দিয়ে। ইচ্ছা করছে ডুবে মরতে এখানেই। নিজেকে সামলাতে ওর মিনিট পাঁচেক সময় লাগল। কিন্তু কথা আর বলল না সে। একেবারে চুপ হয়ে গেল। ঘাড় ঘুরিয়ে মিতুল বলল,

” তুই কি পছন্দ করিস না দাদাকে?”

রজনী জবাব দিল না এ’কথার। স্থির চোখে চেয়ে রইল ঢেউয়ের দিকে। মিতুল ওর কাঁধে হাত রেখে বলল,

” আমার দাদাকে বিশ্বাস করতে পারিস। মানুষ হিসেবে মোটেও খারাপ না। পারফেক্ট জীবনসঙ্গী। আর তুইও আমার বউদি হিসেবে পারফেক্ট। ” মিতুল হাসার চেষ্টা করে। সে চেষ্টা পুরোপুরি সফল হওয়ার আগেই ম্লান হয় রজনীর কথায়,

” আমি তার জন্য পারফেক্ট নই,বুঝেছিস তুই। আমি কারো জন্য পারফেক্ট নই।”

রজনীর রক্তিম চোখ দেখে মিতুল চিন্তিত হয়ে পড়ে। একদৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করে রজনীকে। কিন্তু বুঝতে আর পারে না। ভেবেছিল এসব শুনে রজনী শকড হবে কিন্তু এতোটা অদ্ভুত বিহেভ করবে জানা ছিল না মিতুলের। রজনী মুখ ঘুরিয়ে ঠোঁট কামড়ে কান্না আটকে রেখেছে। প্রচন্ড রাগ হচ্ছে তন্ময় স্যারের উপর ওর।

——————————————————————————————————-

গোয়ালন্দের ঘাটে এসে পৌঁছেছে ফেরি। গাড়ি চলছে আবার। তন্ময় একমনে গাড়ি চালাচ্ছে আর মাঝে মাঝে দেখছে তার প্রেয়সীকে। রজনী চোখ বন্ধ করে সিটে বসে আছে। মাথায় যন্ত্রণা হচ্ছে খুব। আলো বন্ধ থাকায় ওর চোখের জল কারো চোখে পড়ল না। ফরিদপুরের কাছাকাছি আসতেই বমি করল। শরীরটা ভীষন দূর্বল হয়ে পড়েছে। তারচেয়ে বেশি দূর্বল হয়ে পড়েছে ওর মন। তন্ময় স্যারের চোখে আজ ও সত্যিই ভালোবাসা দেখেছে। তবে এতোদিন কেন দেখতে পেল না। পাশে বসা মিতুল আর ওর কাজিনরা মোবাইল নিয়ে ব্যস্ত। চুপ আছে তো কেবল রজনী এবং তন্ময়। দুজনই দুজনকে দেখছে, তবে চার আঁখি এক হচ্ছে না।

ক্লান্তিকর জার্নিতে আবার চোখ লেগে আসে রজনীর। আজ স্বপ্নে একজন নয়, দুজন পুরুষের মুখাবয়ব দেখল। জাগরণে যে পীড়া ছিল, ঘুমের রাজ্যে গিয়েও তা বুঝি একটুও কমলো না। দিনের সূর্য তাপে মুখের সাথে সাথে হৃদয়টাও জ্বলছে।দুপুরের আগেই ওরা পৌঁছে যায় গন্তব্যে। এই পাড়াটা হিন্দু অধ্যুষিত। গাড়ি এ অঞ্চলে ঢুকতেই বাতাসে ধূপধুনোর গন্ধ পাওয়া গেল। মণ্ডপে মণ্ডপে প্রতিমার সাজসজ্জা চলছে। পূজো পূজো আমেজ সর্বত্র। গাড়ি এসে থামল দ্বিতল পুরোনো বাড়ির সামনে। সবাই ক্লান্ত, শ্রান্ত হয়ে বাড়ির ভেতর প্রবেশ করল। বাড়ির লোকেরা হাসি মুখে অভ্যর্থনা জানায় সবাইকে। রজনীকে নিয়ে মিতুল আর ওর কাজিনরা সোজা চলে এলো দোতলার সর্বদক্ষিণের রুমে। এরমধ্যে একবারও চোখ তুলে তন্ময়ের দিকে তাকায়নি রজনী। মিতুল ওর মুখের থমথমে ভাব দেখে মন খারাপ করলেও বাহ্যিক ভাবে তাকে হাসি খুশিই দেখা গেল। সবাই ফ্রেশ হয়ে হালকা নাস্তা সেরে নেয়। নাস্তার টেবিলে তন্ময়কে দেখা গেল না। নাস্তা সেরে যে যার মতো আরাম করছে। শরীরের ক্লান্তি দূর করতে বিশ্রামের জন্য চলে এলো রুমে রজনী। এরমধ্যে হ্যাঁ, না ছাড়া একটা কথাও বলে নি কারো সাথে। বিছানায় গা এলানোর খানিকক্ষণ বাদেই ঘুমিয়ে পড়ে।

চলবে,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here