বিরহ শ্রাবণ পর্ব -০৮+৯

#বিরহ_শ্রাবণ
#পর্ব_৮
#লেখিকা:সারা মেহেক

অভ্র ভাই কয়েক সেকেন্ড সময় নিলেন। পেলব দৃষ্টিতে আমার দিকে একনজর চেয়ে মেঘে ঢাকা অর্ধ চন্দ্রের পানে দৃষ্টিপাত করে বললেন,
” আছে একজন, যে আমার মনে রাজত্ব করে।”

আমি বিস্ময়াভিভূত হলাম। চক্ষুজোড়া স্বাভাবিকের তুলনায় বৃহদাকার ধারণ করলো। অভ্র ভাইকে জিজ্ঞেস করলাম,
” সত্যিই আপনার গার্লফ্রেন্ড আছে! কই আগে কখনো বলেননি তো। ”

অভ্র ভাই দৃষ্টি হটিয়ে আমার পানে চাইলেন। ভ্রুজোড়া কুঁচকে শুধালেন,
” গার্লফ্রেন্ডের কথা কে বললো?”

” কেনো, আপনিই তো বললেন, আপনার মনে রাজত্ব করে। ”

” হ্যাঁ আমি তাই বলেছি। কিন্তু গার্লফ্রেন্ডের কথা বলিনি৷ সে তো আমার গার্লফ্রেন্ড না। ”

” তাহলে কে সে?”

অভ্র ভাই বোধহয় সুখময় চিন্তার রাজ্যে হারিয়ে গেলেন। উনার ঠোঁটের কোনে ফুটে উঠলো মুগ্ধময় হাসি। নিশ্চয়ই মেয়েটিকে নিয়ে চিন্তায় মগ্ন তিনি!
অভ্র ভাই আমার পানে চেয়ে প্রগাঢ় গলায় বললেন,
” মেয়েটি আমার মন কুঠিরে ঠাই নেওয়া তৃতীয় নারী। মা আর অনামিকার পরে আমার হৃদয়ে স্থান করে নেওয়া মেয়েটি দেখতে ঠিক যেনো চাঁদের মতো৷ যাকে দেখলে মুগ্ধতায় সর্বাঙ্গ শিউরে উঠে। যাকে দেখলে আলতো করে ছুঁয়ে দিতে মন চায়। যার দুষ্টুমি দেখলে তাকে আরো তীব্রভাবে ভালোবাসতে মন চায়। যাকে দেখলে মনে আকাঙ্খা জাগে, তার হৃদগহীনের একমাত্র ব্যক্তি হবো আমি৷ যে আমি-হীনা অসম্পূর্ণ হবে। আর আমি সে-হীনা অপূর্ণ হবো। ”

অভ্র ভাইয়ের প্রতিটা কথা মুগ্ধ হয়ে শুনলাম। এই ভেবে খানিক বিস্মিত হলাম, ছোট হতে দেখে আসা চুপচাপ এই মানুষটিও কাউকে এভাবে ভালোবাসতে পারে! কাউকে নিয়ে এতো স্নিগ্ধ ভাবনা ভাবতে পারে! আমার বিশ্বাস, অভ্র ভাই যে মেয়েকে ভালোবাসেন সে পৃথিবীর অন্যতম ভাগ্যবতী একটা মেয়ে। তবে সেই কখন হতে কৌতূহলী মন আমার ভাগ্যবতী মেয়েটার নাম জানতে চাইছে। অভ্র ভাইয়ের এ কথার দরুণ আমার কৌতূহল পূর্বের তুলনায় বেড়ে দ্বিগুণ হলো। ফলে নিজেকে নিয়ন্ত্রণে না রাখতে পেরে উনাকে জিজ্ঞেস করলাম,
” মেয়েটার এতো প্রশংসা করলেন। এবার তার নামটাও বলুন। জানতে চাই, কে সেই ভাগ্যবতী মেয়ে যাকে আপনি এভাবে ভালোবাসেন?”

অভ্র ভাই হাসলো। তবে উনার হাসিটা স্বাভাবিক হাসি বোধ হলো না। কিছুটা রহস্যমিশ্রিত লাগলো সে হাসি। উনি বললেন,
” নামটা অজানাই থাকুক। সঠিক সময় আসলে আমি নিজেই তোমাকে তার নাম বলবো। ”

অভ্র ভাইয়ের এ কথা শুনে মুহূর্তেই আমার কৌতূহলী মনটা ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেলো। আমি ঠোঁট উল্টে মৃদু অভিমানী স্বরে বললাম,
” এটা ঠিক না অভ্র ভাই। আপনার মনে মেয়েটার প্রতি অনুভূতি জানিয়ে নাম না বলে এভাবে মাঝ নদীতে ফেলে দেওয়ার কোনো মানে হয় না। আপনি মানুষটা বড্ড খারাপ৷ ”

অভ্র ভাই হাসলো। নিঃশব্দ হাসি। বললো,
” হতে পারে আমি খারাপ। তবে আমি নিশ্চিত, আমার মনে রাজত্ব করা স্বপ্নচারিণীর কাছে আমি ভালো হবো। ”

” আপনার তার নাম বুঝি স্বপ্নচারিণী?”

অভ্র ভাই পুনরায় হাসলেন। আকাশ পানে চেয়ে বললেন,
” হ্যাঁ। আমার কল্পনা রাজ্যে বিচরণ করা রমনীর নাম স্বপ্নচারিণী। কারণ সে রোজ আমার স্বপ্নে এসে তার হাসি দিয়ে মুগ্ধ করে আমায়। তার প্রতি আরো ভালোবাসা জাগায়। তাকে নতুন করে ভালোবাসতে শেখায়।”

অভ্র ভাইয়ের ব্যগ্রতায় আকুল কণ্ঠ শুনে আমি আবেগী হয়ে পড়লাম৷ মুহূর্তের জন্য হারিয়ে গেলাম উষ্ণ অনুভূতির রাজ্যে। উনাকে জিজ্ঞেস করলাম,
” খুব ভালোবাসেন আপনার স্বপ্নচারিণীকে?”

” হুম, খুব ভালোবাসি। ”

” সে-ও কি আপনাকে ভালোবাসে?”

” বোধহয় না। ”

” তাহলে স্বপ্নচারিণীর প্রতি আপনার ভালোবাসা একতরফা? ”

” উমম, সেটাই ভেবে নাও৷ ”

” কখনো বলবেন না তাকে? ”

” হ্যাঁ বলবো তো। শুধু সঠিক সময়ের অপেক্ষায় আছি। ”

” সে সঠিক সময় কখন?”

” জানা নেই আমার। ”

” আচ্ছা? আপনার অনুভূতি, ভালোবাসা প্রকাশ করার পর আপনার স্বপ্নচারিণী যদি আপনাকে ফিরতি ভালোবাসা না দেয় তাহলে?”

” তাহলে আর কি?”

” মন খারাপ করবেন? কষ্ট হবে?”

” কষ্ট, তা তো হবেই। ভালোবাসা কষ্ট ছাড়া কল্পনা করা অসম্ভব। ”

” মেনে নিতে পারবেন এটা?”

” মেনে নিতে কষ্ট হবে। তবে মেনে নিবো আমি। এমনটা না যে, আমি তাকে ভালোবাসি বলে সে-ও অবশ্যই আমাকে ভালোবাসবে। থাকুক না একতরফা ভালোবাসা। সে আমার ভাগ্যে না থাকলেও আমি সারাজীবন তাকে ভালোবেসে যাবো। ”

” আপনার স্বপ্নচারিণী অনেক ভাগ্যবতী অভ্র ভাই। দোয়া করি, সে-ও যেনো আপনাকে এমনভাবেই ভালোবাসে। ”

এই বলে আমি অভ্র ভাইয়ের উপর হতে নজর হটিয়ে চায়ের কাপে মনোযোগী হলাম৷ অভ্র ভাই এতোক্ষণ অন্তরীক্ষ পানে একদৃষ্টিতে চেয়ে ছিলেন। এখনও সেদিকে চেয়ে আছেন।
হঠাৎ আমার সময়ের কথা মনে হলো। হাতে থাকা ফোনের স্ক্রিন অন করে দেখলাম এখানে প্রায় আধঘণ্টা সময় পার করে দিয়েছি। ঘড়ি দেখার পর সময় জ্ঞান হতেই আমি দ্রুত চায়ের কাপ রেখে হুড়মুড় করে উঠে দাঁড়িয়ে পড়ি। ভীষণ ব্যস্ত হয়ে বলি,
” অভ্র ভাই, অনেক সময় কাটিয়ে দিয়েছি এখানে। আজ বাড়ি গেলে আর রক্ষা নেই। আমি আসি। ”
এই বলে আমি অভ্র ভাইদের বাড়ির প্রধান গেটের উদ্দেশ্যে পা বাড়ালাম। হাঁটার গতি করলাম স্বাভাবিকের তুলনায় দ্বিগুণ। পিছন হতে অভ্র ভাই আমার পিছে আসতে আসতে বললেন,
” ধীরে হাঁটো চন্দ্রিমা। বৃষ্টির কারণে উঠোন পিছলে হয়ে আছে। পড়ে যেতে পারো কিন্তু। আমি আসছি৷ একটু দাঁড়াও। ”

অভ্র ভাইয়ের কথার তোয়াক্কা করলাম না আমি। দ্রুত হাঁটতে হাঁটতে বললাম,
” পড়বো না আমি। আপনার আসার দরকার নেই অভ্র ভাই। ”
বলার কয়েক সেকেন্ডের মাঝেই উঠোনে পা পিছলে উবু হয়ে পড়ে গেলাম। সঙ্গে সঙ্গেই হাতের তালুসহ হাঁটু হতে নিচ পর্যন্ত কাঁদায় মাখামাখি হয়ে গেলাম। ভিজে কাঁদার ফলে হাঁটুর নিচে যাচ্ছেতাই অবস্থা হয়ে গেলো। নিজের এ করুণ অবস্থা দেখে নিজের প্রতিই নিজের প্রচণ্ড রাগ হলো। কোনো সন্দেহ নেই আজ, মামি আর প্রোজ্জ্বল ভাইয়ের নিকট সর্বোচ্চ পর্যায়ের হুমকিধামকি শুনবো। বিশেষ করে প্রোজ্জ্বল ভাই তো আমাকে পড়ার টেবিল ছেড়ে উঠতেই দিবেন না! কি এক মহাযন্ত্রণা!
আমি কাঁদায় মাখোমাখো হাত দুটো মাটি হতে উঠিয়ে একনজর তাকালাম। একদম বিতিকিচ্ছিরি অবস্থা! কোনোমতে হাটুঁ ও হাতের তালুয় ভর দিয়ে মাটি ছেড়ে উঠে দাঁড়ালাম। অমনিই দেখলাম আমার একদম নিকটে প্রোজ্জ্বল ভাই দাঁড়িয়ে আছেন। অকস্মাৎ উনাকে দেখে ভূত দেখার মতো চমকে উঠলাম। ফলস্বরূপ কয়েক কদম পিছিয়ে এলাম৷ তবে পিছিয়ে যেতেই ওদিকে ধাক্কা খেলাম অভ্র ভাইয়ের সাথে। উনার সাথে ধাক্কা খেতেই তৎক্ষনাৎ পাশে সরে এলাম আমি। দৃষ্টি তুলে চাইলাম অভ্র ভাই ও প্রোজ্জ্বল ভাইয়ের দিকে। দুজনে আমার সামনে দুদিকে দাঁড়িয়ে আছেন। উনাদের দাঁড়ানোর ভঙ্গি কিছুটা একই। তবে চাহনি ভিন্ন। প্রোজ্জ্বল ভাইয়ের চাহনিতে স্পষ্ট আগ্নেয়গিরির ন্যায় ক্রোধ। অপরদিকে অভ্র ভাইয়ের চাহনিতে স্পষ্ট কৌতুকাবহ আমেজ। নিশ্চিত আমার এ অবস্থা দেখে হাসছেন অভ্র ভাই।

প্রোজ্জ্বল ভাই একবার অভ্র ভাইয়ের দিকে চেয়ে দৃষ্টি হটিয়ে আমার দিকে চাইলেন। অকস্মাৎ একটা ধমক দিয়ে বললেন,
” সারা বাড়ি খুঁজে হয়রান হয়ে মরছি, আর ম্যাডাম চাঁদ, চন্দ্রিমা এখানে!”

উনার ধমকের প্রত্যুত্তরে আমি কিছু বললাম না৷ উনি পুনরায় বললেন,
” ছোটবেলায় কাঁদা দিয়ে খেলে শখ মিটেনি? এই বুড়ো বয়সে আবার কাঁদা দিয়ে খেলছিস! ”

প্রোজ্জ্বল ভাইয়ের এভাবে খোঁচা মারায় ভীষণ রাগ হলো আমার। একে তো অনিচ্ছাপূর্বক হুটহাট কাঁদায় ভরপুর জায়গায় ধাপ করে পড়লাম। তারপর আবার উনার এ খেলা নিয়ে খোঁচা! এ কারণে ভীষণ রাগ ও বিরক্তি নিয়ে বললাম,
” আমি খেলার জন্য কাঁদায় পড়িনি। বৃষ্টির কারণে উঠোন পিছলে ছিলো বলেই পড়েছি।”

” চুপ! চোরের মুখে বড় বড় কথা! এখানে কি করছিস হ্যাঁ?”

আমি জবাবে কিছু বলতে যাবো কিন্তু এর পূর্বেই অভ্র ভাই প্রোজ্জ্বল ভাইকে বললেন,
” এতো বকছিস কেনো মেয়েটাকে? ওকে আমিই ডেকেছিলাম চা খেতে। একা চা খেতে ভালো লাগে না। তোকে তো খুঁজে পাওয়া মুশকিল। এজন্যই চন্দ্রিমাকে ডেকেছি।”
এই বলেই অভ্র ভাই চোখের ইশারায় আমায় চলে যেতে বললেন। উনার ইশারা বুঝা মাত্রই আমি দৌড়ে প্রোজ্জ্বল ভাইকে পাশ কাটিয়ে চলে গেলাম। ওদিকে প্রোজ্জ্বল ভাই আমায় উদ্দেশ্য করে উচ্চস্বরে বললেন,
” বাড়িতে গিয়ে পড়তে বস। আজ সারারাত পড়বি। খবরদার, তোকে যদি উঠতে দেখেছি!”

আমি প্রোজ্জ্বল ভাইয়ের কথা আধো আধো শুনলাম৷ তবে নিশ্চিত হলাম, উনি পড়া নিয়েই বলছেন আমাকে। যদিও উনি না বললেও আমি বাড়িতে গিয়ে পড়তে বসতাম। এ নিয়ে যেতে যেতে নিজেকে ওয়াদাও করলাম,আজ কি, আগামী সাতদিনও পড়ালেখা ছাড়া সময় কাটানোর কথা চিন্তাও করবো না আমি! এ ওয়াদায় বদ্ধ পরিকর হলাম আমি৷

————–

একটা কলমের মাধ্যমে বৃত্ত ভরাট করে আমার ভবিষ্যত জীবনের কলকাঠি নাড়িয়ে আসলাম আজ। প্রশ্ন মোটামুটি হয়েছে বলে ১০০ টা প্রশ্নের মধ্যে প্রায় ৯০টা দাগিয়ে আসলাম৷ দাগানো সব প্রশ্নই আমার জানা, হাতে গোনা অল্প কয়টা ছাড়া। এখন এই জানা অজানার মাধ্যমেই নির্ধারিত হবে, আমার ভাগ্যে আদৌ মেডিকেলে পড়া আছে কি না।

দীর্ঘ এক ঘণ্টা ভাগ্যের উপর নির্ভর করে পরীক্ষা দিয়ে বের হলাম আমি। আমার ভর্তি পরীক্ষার সিট পড়েছিলো আমাদেরই এলাকার মেডিকেলে। এ কারণে প্রোজ্জ্বল ভাই-ই আমাকে পরীক্ষার হলে পৌঁছে দিয়েছিলেন।
পরীক্ষার হল থেকে বের হয়ে দেখলাম শত শত মানুষ প্রধান ফটকের বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। প্রত্যেকেই আমার সাথে আসা পরীক্ষার্থীদের অভিভাবক। এতো বিপুল সংখ্যক অভিভাবকের ভীড় দেখে গেটের কাছে কয়েক সেকেন্ড থম মেরে দাঁড়িয়ে রইলাম আমি। এতো মানুষের মধ্যে প্রোজ্জ্বল ভাইকে কোথায় পাবো আমি! কোথাও তো দেখছি না উনাকে।
আমি গেটের কাছেই দাঁড়িয়ে রইলাম। অস্থির চাহনি দিয়ে তন্নতন্ন করে প্রোজ্জ্বল ভাইকে খুঁজলাম। অকস্মাৎ কে যেনো ভীড়ের মধ্যে থেকে আমার হাত ধরে টেনে গেটের কাছ থেকে ভীড়ের মাঝে নিয়ে এলেন আমাকে। অজ্ঞাত ব্যক্তিটি আমার হাত ধরে ভীড় ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে আমাকে। প্রথম কয়েক সেকেন্ড অজ্ঞাত ব্যক্তিটি কে তা চিন্তা করতেই গলা শুকিয়ে আসছিলো আমার৷ কিন্তু যখন প্রোজ্জ্বল ভাইয়ের কণ্ঠে শুনলাম,
” আমার হাত ছাড়িস না চন্দ্রিমা। শক্ত করে ধরে রাখ। না হলে হারিয়ে যাবি কিন্তু।!”
তখন নিশ্চিত হলাম, অজ্ঞাত ব্যক্তিটি আর কেউ নয় বরং প্রোজ্জ্বল ভাই।

প্রোজ্জ্বল ভাই ভীড় ঠেলে আমাকে নিয়ে অপেক্ষাকৃত কম ভীড়সম্পন্ন একটা খালি জায়গায় এসে দাঁড়ালেন। দেখলাম, সেখানে আগে থেকেই অভ্র ভাই উপস্থিত ছিলেন। আমায় দেখে এক গাল হেসে জিজ্ঞেস করলেন,
” পরীক্ষা কেমন হলো চন্দ্রিমা?”

আমি বললাম,
” এই তো মোটামুটি ভালোই হয়েছে। ”

” কত মার্ক এন্সার করেছো?”

” ৯০। তার মধ্যে কিছু কিছু তেমন শিওর না। ”

” আচ্ছা। ও নিয়ে চিন্তা করো না। আল্লাহ ভরসা। হয়ে যাবে মেডিকেলে।”
এই বলে উনি প্রোজ্জ্বল ভাইয়ের দিকে চেয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
” তোর কি মনে হয়?”

প্রচণ্ড রোদে ভ্রুজোড়া অত্যধিক পরিমাণ কুঁচকে রেখেছেন প্রোজ্জ্বল ভাই। অভ্র ভাইয়ের প্রশ্নে উনি আমার দিকে চেয়ে আশ্বস্তমূলক কণ্ঠে বললেন,
” চন্দ্রিমাও চেষ্টা করেছে। আমিও চেষ্টা করেছি। এখন বাকিটা আল্লাহর উপর। দেখা যাক উনি ভাগ্যে কি রেখেছেন। ”

অভ্র ভাই বললেন,
” আচ্ছা। পরীক্ষা নিয়ে এখন আলোচনা বাদ দেই। চল তিনজনে মিলে একটু ডাবের পানি খেয়ে আসি। ”

” চল। ”

আমরা তিনজনে একটু দূরে এক ডাবওয়ালার কাছ থেকে তিনটা ডাব নিলাম। তিনটা স্ট্র দিয়ে তিনজনে তৃপ্তি সহকারে ডাবের পানি খেলাম। তীব্র গরমে ডাবের পানিই ঠাণ্ডা পানির ন্যায় মনে হলো।
ডাবের পানি খাওয়া শেষে অভ্র ভাইকে জিজ্ঞেস করলাম,
” আপনার কি ডিউটি নেই অভ্র ভাই? ”

” আছে তো। এখন ওয়ার্ডে রোগী নেই তেমন। আর আধ ঘণ্টার জন্য আমার এক ফ্রেন্ডকে রোগী রিসিভ করার দায়িত্ব দিয়ে এসেছি।
তুমি মেডিকেলের ভিতর ঘুরবে?”

অভ্র ভাইয়ের এহেন প্রস্তাবে আমি তৎক্ষনাৎ রাজি হয়েছিলাম। কিন্তু প্রোজ্জ্বল ভাই ক্লান্ত স্বরে আমাদের বললেন,
” আজ না রে। আজ আমার শরীরটা ভালো লাগছে। প্রচণ্ড গরমে অস্থির লাগছে। চন্দ্রিমা, তোকে অন্য একদিন নিয়ে আসবো। আজ বাসায় চল।”
প্রোজ্জ্বল ভাইয়ের অসুস্থার কথা শুনে ঘুরার ইচ্ছা ত্যাগ করতে হলো। অগত্যা উনার অসুস্থতার দরুন বাসায় ফিরে আসতে হলো আমাদের।

.

পরীক্ষার দুদিন বাদে বিকেলের দিকে রেজাল্ট দিলো। সারাদিন উৎকণ্ঠা ও অস্থিরতায় কাটিয়ে দিনশেষে যখন রেজাল্ট হাতে পেলাম, তখন আমার কিছুতেই বিশ্বাস হলো না যে আমি মেডিকেলে চান্স পেয়েছি। সেটাও আবার আমার মন মোতাবেক মেডিকেলে! আমাদের শহরের মেডিকেলে! এ যেনো মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি। এভাবে ভাগ্য গুণে এই মেডিকেলে চান্স পেয়ে যাবো তা কল্পনার বাইরে ছিলো।
রেজাল্ট বের হওয়ার পর বাড়ির সবার খুশি দেখে কে! বিশেষ করে প্রোজ্জ্বল ভাইয়ের খুশি ছিলো দেখার মতো। খুশিতে উনি রীতিমতো সোফায় উঠে কোমড় দুলিয়েছেন! অত্যধিক খুশিতে উনি আমায় নিজ পকেট হতে তৎক্ষনাৎ হাজার টাকা বকশিসও দিয়েছেন। পাশাপাশি নানু, মামা, মামি, প্রত্যাশা আপুও আমাকে আদর স্নেহ করেছে। আমার উপর খুশি হয়ে বকশিসও দিয়েছে। কিন্তু এই বাঁধভাঙা খুশির মহলে আমার খুশি ধীরে ধীরে উবে যেতে লাগলো। আমার আপন মানুষগুলোর কথা মনে পড়ে। আজ যদি তারা বেঁচে থাকতো তাহলে নিশ্চয়ই খুশিতে আমাকে কোলে নিয়ে নাচতো। মজা করতো। অজস্র চুমুতে আমার গালদুটো ভড়িয়ে দিতো। কিন্তু আজ তারা নেই। তারা চলে গিয়েছে আমার ধরাছোঁয়ার বাইরে। যাদের চাইলেও কখনো ফিরিয়ে আনতে পারবো না।

———–

মেডিকেল ভর্তি হওয়ার দিন মামা ও প্রোজ্জ্বল ভাইয়ের সাথে মেডিকেলে এলাম। মামা ভর্তির মূল কার্যক্রম শেষে উনার স্টুডেন্টদের ক্লাস নিতে চলে যান। আর আমি ও প্রোজ্জ্বল ভাই মিলে ভর্তির বাকি কার্যক্রম শেষ করি।

ভর্তির ঝইঝামেলা শেষে প্রোজ্জ্বল ভাই আমাকে মেডিকেল ঘুরে দেখালেন। প্রথমত দেখালেন, আমাদের ক্লাস কোথায় হবে, ক্যান্টিন কোনটা, কমনরুম কোনটা। অতঃপর আমাকে নিয়ে এলেন ওয়ার্ডে। দুটো ওয়ার্ড ঘুরা শেষে আমরা দুজনে চলে এলাম সার্জারি ওয়ার্ডে। যেখানে বর্তমানে অভ্র ভাই কর্মরত আছেন৷
স্বাভাবিকভাবে ওয়ার্ডে ঢুকেই একটা অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার শিকার হলাম আমরা। দেখলাম অভ্র ভাই………..
®সারা মেহেক

#চলবে#বিরহ_শ্রাবণ
#পর্ব_৯
#লেখিকা:সারা মেহেক

স্বাভাবিকভাবে ওয়ার্ডে ঢুকেই একটা অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার শিকার হলাম আমরা। দেখলাম অভ্র ভাইকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে বেশ ক’জন স্বাস্থ্যবান লোক। তাদের পোশাক পরিচ্ছদ ও মুখের অঙ্গভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে তারা গু’ণ্ডা সদৃশ কেউ। অবশ্য আমার এ অনুমানকে তারা মুহূর্তেই সত্য প্রমাণিত করলো অভ্র ভাইয়ের শার্টের কলার চেপে ধরে।
অভ্র ভাইকে ঘিরে দাঁড়ানো চারজন লোকের মধ্যে একজন অভ্র ভাইয়ের শার্টের কলার চেপে ধরে ক্ষি’প্র কণ্ঠে বললেন,
” তোকে যা বলছি তা করতে সমস্যা কোথায়? এ রোগীক পরেও দেহা যাবে। আগে আমাদের লোক দেখবি তারপর।”

লোকটির ভয় দেখানো চাহনি ও কণ্ঠস্বরে অভ্র ভাই মোটেও ভয় পেলেন না। বরং দৃঢ়তা এবং কাঠিন্যের সহিত বললেন,
” আমি একজন ডক্টর। আমার কাছে সব রোগীরই অধিকার সমান। আপনাদের লোকের অবস্থা এই রোগীর তুলনায় যথেষ্ট ভালো। একজন নার্সকে বলে উনাকে ড্রেসিং করিয়ে দিলে হয়ে যাবে। এখন ছাড়ুন আমাকে। ”

লোকটি অভ্র ভাইকে ছাড়লো না৷ বরং পূর্বের চেয়েও জোর গলায় হিং’স্র’তার সহিত বললেন,
” এ ডাক্তার! যা বলতেছি তাই কর। আমাদের সাথে লাগতে আসিস না৷ আমাদের লোককে তুই দেখে ঠিক করবি। তা না হলে এখানকার একটা রোগীরেও আস্ত রাখবো না আমি। ”

অভ্র ভাই পূর্বের ন্যায় বললেন,
” রাস্তায় মা’রপি’ট করা লোকদের প্রতি আমার বিন্দুমাত্র সহানুভূতি হয় না। মন চায় না তাদের সেবা করি। কিন্তু এই ডাক্তারি পেশা আমাকে তা শেখায়নি। বরং সব রোগীকেই সমান অগ্রাধিকার দিতে শিখিয়েছে। কিছু ক্ষেত্রে ইমার্জেন্সি পেশেন্টদের বেশি দেখভাল করা শিখিয়েছে। সে হিসেবে আমার সামনে এক্সিডেন্টের পেশেন্ট আছে, যার অবস্থা খুব একটা ভালো না। আপাতত তাকেই চিকিৎসা দেওয়া আমার সবচেয়ে বড় দায়িত্ব। ”

লোকটি এবার অভ্র ভাইয়ের কলার ছেড়ে দিলেন। দাঁতে দাঁত চেপে হিং’স্র’তাপূর্ণ মুখশ্রী নিয়ে ক্ষি’প্ততার সহিত অভ্র ভাইয়ের গালে এক ঘু’ষি দিলেন। অমনিই ওয়ার্ডে হইহট্টগোল শুরু হয়ে গেলো। ভয়ে তটস্থ রোগী, ওয়ার্ডবয়, নার্সরা চিৎকার করলো, যে যার মতো নিরাপদ স্থানে ছুটে গেলো। বেডে শুয়ে থাকা দূর্বল রোগীরা ভয়ে কাচুমাচু হয়ে নিজেদের গুটিয়ে নিলো। অভ্র ভাইয়ের উপর আক্রমন দেখে প্রোজ্জ্বল ভাই আমাকে রেখেই ওদিকে তেড়ে গেলেন। পিছন হতে গার্ডও চলে এলেন।
এসব হইহট্টগোলপূর্ণ, চিৎকার চেঁচামেচিপূর্ণ পরিবেশ দেখে আমার ভেতরে প্রচণ্ড অস্বস্তিকর অনুভূতির সৃষ্টি হলো। শরীরে অস্থিরতা বাড়তে লাগলো। হাত-পায়ে ঘাম ছুটে ঠাণ্ডা হয়ে এলো। গলা শুকিয়ে এলো। ওদিকে প্রোজ্জ্বল ভাই, অভ্র ভাই ও লোকগুলোর মধ্যে হাতাহাতি হচ্ছে। গার্ডটা তাদের ঠেকানোর চেষ্টা করছেন৷ আমি চোখের সম্মুখে এ দৃশ্য ঘটতে দেখে অসহ্যকর ভয়ে অল্পবিস্তর কাঁপছি। সম্মুখে চলমান এ ঘটনা আমার ভেতরটা নাড়িয়ে দিলো। চোখের সামনে নিয়ে এলো অতিতের কিছু দুঃসহ স্মৃতি। আমি আর নিজেকে স্বাভাবিক রাখতে পারলাম না৷ ভোঁ চক্কর দিয়ে আমার মাথা ঘুরতে লাগলো। কিছু বুঝে উঠার পূর্বেই আমার চারপাশ অন্ধকার হয় এলো।

———–

পিটপিট করে চোখ মেলে তাকালাম আমি। কয়েক সেকেন্ড সময় নিলাম, কোথায় আছি তা বুঝার জন্য। মাথার উপরে শুভ্র দেয়ালে সেঁটে দেওয়া রঙবেরঙের অনেক তারা দেখে বুঝতে বাকি রইলো না আমি আমার রুমেই শুয়ে আছি। স্বস্তি পেলাম খানিক।

দূর্বল চাহনিতে ঘাড় ঘুরিয়ে বাম পাশে তাকালাম। অতঃপর ডান পাশে তাকাতেই ভূত দেখার মতো চমকে উঠলাম। পাশ ফিরে দেখলাম প্রোজ্জ্বল ভাই আমার দিকে নিষ্পলক চেয়ে আছে। তবে এ নিষ্কম্প চাহনিতে রয়েছে উদ্বিগ্নের ঝলক৷ উনি খানিক বিচলিত গলায় জিজ্ঞেস করলেন,
” ঠিক আছিস তো? বেটার ফিল করছিস এখন?”

প্রোজ্জ্বল ভাইয়ের প্রশ্নে আমি দ্বিধাগ্রস্ত চাহনিতে উনার পানে চাইলাম৷ চিন্তা করলাম, আসলেই কি আমি ঠিক আছি? শরীরের অবস্থাটা একটু পর্যবেক্ষণ করা দরকার। খানিক সময় নিয়ে নীরবে নিজের শারিরীক অবস্থা পর্যবেক্ষণ করলাম। অতঃপর মৃদু হেসে প্রোজ্জ্বল ভাইকে বললাম,
” হ্যাঁ। এখন আগের চেয়ে অনেক বেটার ফিল করছি। ”

তৎক্ষণাৎ উনি আমার কপালে হাতের উল্টো পিঠ আমার কপালে রাখলেন। নিমিষের জন্য ভ্রুজোড়া কুঞ্চিত করে আমার দিকে চাইলেন। অতঃপর হাত সরিয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বললেন,
” যাক, জ্বর আসেনি তোর। আমরা তো তোকে নিয়ে খুব টেনশনে ছিলাম৷ ”

” কেনো? আমায় নিয়ে এতো টেনশন করার কি আছে?”

” টেনশন করবো না মানে! ওভাবে হুটহাট অজ্ঞান হয়ে পড়লে কার টেনশন হবে না বল?”

আমি আপাতত আর কথা বাড়ালাম না৷ এভাবে শুয়ে কথা বলতে বেশ অসুবিধা হচ্ছিলো বলে দুপাশে দু হাত ঠেকিয়ে উঠতে নিলাম৷ কিন্তু শরীর খানিক দূর্বল হওয়ায় উঠতে কষ্ট হচ্ছিলো। ফলে প্রোজ্জ্বল ভাই আমায় উঠে বসতে সাহায্য করলেন। আমার হাত ধরে খাটের সাথে হেলান দিয়ে বসিয়ে নিজেও চেয়ারে বসে পড়লেন। বললেন,
” তোর শরীরটা বেশ দূর্বল মনে হচ্ছে চন্দ্রিমা। একটু ডাবের পানি খাবি?”

এ মুহূর্তে খাওয়ায় অরুচি বোধ করায় বললাম,
” না প্রোজ্জ্বল ভাই। আমার এখন কিছু খেতে মন চাইছে না৷ আগে বলুন, ওদিকের অবস্থা কি?”

” কোন দিকের অবস্থা? ” প্রোজ্জ্বল ভাই আমার প্রশ্ন ঠিকই বুঝলেন। তবে ব্যাপারটা আড়াল করতে এমন প্রশ্ন জিজ্ঞেস করলেন। আমি বললাম,
” এমনভাব ধরেছেন যেনো জানেন না আমি কি নিয়ে জিজ্ঞেস করছি! হসপিটালে কি অবস্থা? অভ্র ভাই ঠিক আছে তো? আর হ্যাঁ, আপনার কিছু হয়নি তো আবার?”

প্রোজ্জ্বল ভাই ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছাড়লেন। আমার এতো প্রশ্নের চাপে যে উনি পরাজয় স্বীকার করে নিয়েছে তা বলা বাহুল্য। উনি ঈষৎ উদ্বিগ্ন কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন,
” এসব জানা কি খুব জরুরি তোর জন্য? এমনিতেই হসপিটালে মা’রামা’রি দেখেই তুই অজ্ঞান হয়েছিলি। সে হিসেবে এসব ভুলে যাওয়া বেটার না?”

আমি খিটখিটে গলায় বললাম,
” উফ, প্রোজ্জ্বল ভাই! আপনি বলুন তো আমায়। ”

প্রোজ্জ্বল ভাই প্রলম্বিত নিঃশ্বাস ছাড়লেন। বললেন,
” হসপিটালে সবকিছু স্বাভাবিক হয়ে এসেছে। আর অভ্রেরও তেমন কিছু হয়নি। শুধু গালে ঘুষি মারায় একটু রক্ত জমে গিয়েছে যাস্ট। ”

” আর আপনার?”

” আমার কিছু হয়নি। ” এই বলে প্রোজ্জ্বল ভাই অন্যদিকে চাইলেন। বুঝলাম, উনি আমার নিকট হতে কিছু লুকানোর চেষ্টা করছেন। কিন্তু আমিও যে না জেনে উনায় ছাড়ছি না!
আমি হাত বাড়িয়ে প্রোজ্জ্বল ভাইয়ের থুতনি ধরে মুখটা নিজের দিকে ঘুরিয়ে আনলাম৷ অনুসন্ধানী দৃষ্টিতে উনার পুরো মুখশ্রীতে একবার চোখ বুলিয়ে আনতেই লক্ষ্য করলাম, উনার ঠোঁটের পাশে লাল হয়ে আছে। ফর্সা গালে আঘাতের লাল চিহ্ন বেশ ভালোভাবেই দৃষ্টিগোচর হচ্ছে এখন। গালের দাঁড়ির জন্য উনার ঠোঁটের পাশে এ আঘাতের চিহ্ন পূর্বে তেমন দৃষ্টিগোচর হয়েছিলো না। এক নজরে এ আঘাতের চিহ্নটা লক্ষ্য করার মতোও না৷

উনার ঠোঁটের পাশে আঘাতের চিহ্ন দেখে আমি দাপটের সহিত জিজ্ঞেস করলাম,
” মা’র খেয়ে নিজের ফর্সা গালটা তো টমেটো বানিয়ে ফেলেছেন! নিজের শরীরের নেই ঠিক। আবার আসছে আমার খেয়াল নিতে!”

প্রোজ্জ্বল ভাই কথা বললেন না। থুতনি হতে আমার হাত হটিয়ে দিয়ে উদ্বিগ্ন গলায় বললেন,
” আমার শুধু গালটা লাল হয়েছে। আর তোর? আমি জানি, তখন তুই ভয়ে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলি। এখনও কি সেসব ভুলতে পারিসনি চন্দ্রিমা?”

প্রোজ্জ্বল ভাইয়ের প্রশ্নে আমি মিইয়ে এলাম। তবে উনি যেনো আমায় নিয়ে বেশি চিন্তা না করেন সে কারণে সঙ্গে সঙ্গেই নিজেকে এ মুহূর্তে চটপটে মেজাজের প্রমাণ করে বললাম,
” আপনি এতো চিন্তা করেন কেনো আমাকে নিয়ে? আমি ঠিক আছি। ঐ হঠাৎ হঠাৎ এসব দেখলে একটু মনে পড়ে। তাছাড়া আমি একদম ঠিকঠাক। ”

প্রোজ্জ্বল ভাই মুহূর্তেই আমার কথায় দ্বিমত পোষণ করে বক্র কণ্ঠে বললেন,
” খুব জানি তোর ঠিকঠাক অবস্থা। উপরে ফিটফাট আর ভেতরে সদরঘাট! একদম এমন তুই৷ ”

আমি তৎক্ষনাৎ ভেঙচি কেটে কথা আবারো অভ্র ভাইয়ের দিকে নিয়ে এলাম। জিজ্ঞেস করলাম,
” ঐ লোকরা কি কারণে মা’রামা’রি শুরু করেছিলো? ”

” আর বলিস না। সরকারি হাসপাতালে এসব গু’ণ্ডা প্রজাতির লোকরা ডাক্তারদের একেবারেই সম্মান করে না। মাঝে মাঝে সাধারণ রোগীর লোকদের কাছেই সম্মান পাওয়া যায় না। আর এ তো রাস্তার গু’ণ্ডা।
ঐ দলের একটা লোক কার সাথে যেনো মা’রামা’রি করে ঠোঁট মুখ ফাটিয়ে এনেছিলো। সেজন্য চিকিৎসা নিতে হাসপাতালে চলে এসেছিলো। অভ্র তখন এক্সিডেন্টের একটা পেশেন্টের রক্ত বন্ধ করতে, ব্যান্ডেজ করতে ব্যস্ত। আর কিছুক্ষণ পরেই ঐ লোককে ওটিতে পাঠানোর কথা। কিন্তু এর মধ্যে গু’ণ্ডাগুলো এসে অভ্রকে জোর করতে থাকে যে, এক্ষুনি তাদের লোকের চিকিৎসা করতে হবে। তুইই বল, এ মুহূর্তে এক্সিডেন্টের ঐ লোকের জরুরি চিকিৎসা করবে না কি মা’রপি’ট করে নাকমুখ ফাটিয়ে আনা লোকের চিকিৎসা করবে? ঐ লোকের কিন্তু নার্স দিয়েই কাজ চালানো যেতো। কিন্তু ব’দমা’শগুলো নার্সের হাতে চিকিৎসা নিবে না। ব্যস তারপর তো মা’রামা’রি শুরু হলো। ”

আমি কিছুটা চিন্তিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলাম,
” এমন কি এই প্রথম?”

” না। মাঝে মাঝেই এমন হয়। কিছু গরম টেম্পারের লোকগুলো তো ডাক্তার, ওয়ার্ড বয়দের উপর হুটহাট হাত উঠিয়ে দেয়!
মা’রামা’রি দেখে তোর অজ্ঞান হয়ে যাওয়া নিয়ে বাবা বেশ টেনশনে আছে। ”

” টেনশন কি কারণে?”

” এই যে, মেডিকেলে যাওয়ার পর এমন টাইপের কিছু দ্বিতীয়বার দেখলে তুই আবারও না অজ্ঞান হয়ে পড়ে যাস।”

প্রোজ্জ্বল ভাইয়ের কথায় আমি নিঃশব্দে হাসলাম। হঠাৎ মামির কথা মনে আসতে জিজ্ঞেস করলাম,
” মামির কি অবস্থা? মামি কোথায় এখন? সুস্থ আছে তো?”

প্রোজ্জ্বল ভাই আমার প্রশ্নে সন্দেহ ভরা চাহনিতে চেয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
” তুই কিভাবে জানিস, মা অসুস্থ?”

আমি বিস্ময়ে, চিন্তায় আঁখিজোড়া বড় বড় করে জিজ্ঞেস করলাম,
” সত্যিই মামি অসুস্থ? এখন কি অবস্থা? আমি গিয়ে দেখে আসি। ”
এই বলে আমি উঠতে নিলাম। কিন্তু প্রোজ্জ্বল ভাই আমার হাত ধরে আটকে বললেন,
” মা এখন ঠিক আছে। ঘুমাচ্ছে। তোর এ অবস্থা দেখে প্রেশার হাই হয়ে গিয়েছিলো। আমি ওষুধ খাইয়ে দিয়ে ঘুমাতে বলেছি। ”

উনার কথা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম আমি। বললাম,
” জানতাম মামির প্রেশার আবারো হাই হয়ে গিয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে উনি একটু হাইপার হলেই হয়েছে! সামান্য অসুস্থ মানুষের থেকেও উনি বেশি অসুস্থ হয়ে পড়েন। ”

প্রোজ্জ্বল ভাই হাসলেন। উনার সাথে যোগ দিলাম আমিও। মামির এ হাইপার হয়ে যাওয়া, প্রেশার বেড়ে যাওয়া নিয়ে যে কত কাহিনি আছে তা ভাবতেই আপনাআপনি হাসি চলে আসে।

ক্ষণিকের মাঝেই প্রোজ্জ্বল ভাই হাসি থামালেন। বললেন,
” তুই একটু রেস্ট নে। আমি বাবাকে আর অভ্রকে জানিয়ে দেই তোর জ্ঞান ফিরেছে। আর তুই সুস্থ আছিস। ”
এই বলে প্রোজ্জ্বল ভাই ফোনে ডায়াল করতে করতে চলে গেলেন। আমিও শুয়ে একটু বিশ্রাম নিলাম। এভাবে যে কখন ঘুমিয়ে পড়লাম তার ঠিক নেই।

———

ছাদ থেকে কাপড়চোপড় উঠিয়ে একটু হাওয়া খেতে রেলিঙ ঘেঁষে দাঁড়ালাম। চারপাশে শীতল শান্ত পরিবেশ। কিন্তু হঠাৎ করেই সে শান্ত পরিবেশ অশান্ত হয়ে উঠলো। চারপাশে হইহট্টগোল শোনা গেলো। চিৎকার চেঁচামেচি শোনা গেলো। আমার উৎসুক চাহনি গিয়ে ঠেকলো আমাদের বাড়ির গেটের উপর।
দূর হতে চিৎকার চেঁচামেচি শুনতে শুনতে ক্রমশ সে শব্দ অতি নিকটে অনুভূত হলো। দেখলাম গেট হতে বেশ কয়েক কদম দূর থেকে কেউ একজন ছুটে আসছে। তার পিছে দা নিয়ে ছুটে আসছে গুটিকয়েক লোক। প্রত্যেকের জবানে হিং’স্র’মূলক বুলি। বুঝা যাচ্ছে লোকগুলো সামনের সেই মানুষটাকে মারতে ছুটে আসছে। এদিকে সেই মানুষটা প্রাণপনে দৌড়াচ্ছে। তার পরনের শার্ট র’ক্তে ভিজে জবজবে হয়ে আছে। এ দৃশ্য দেখে আঁতকে উঠলাম আমি৷ কিন্তু জখম ব্যক্তিটির চেহারা যখন উপর হতে দেখলাম তখন যেনো আমার পুরো দুনিয়া চক্কর দিয়ে উঠলো। রক্তে জর্জরিত ব্যক্তিটি আর কেউ নয় বরং…………
®সারা মেহেক

#চলবে

/

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here