#বিষবৃক্ষ ❤️
#সাদিয়া
৫
সম্রাট রাজ কক্ষে প্রবেশ করতেই নাইলার প্রস্থান ঘটল। নিজের শ্যাযায় তাকিয়ে দেখতে পেল বলহীন শরীর নিয়ে মেহের শুয়ে আছে। তাকে দেখামাত্র সে উঠতে চাইলেও পারছিল না। তা দেখে রাজ আদেশস্বরে বলল,
“উঠতে হবে না ছোট্ট রাজকন্যা। শুয়ে থাকো।”
একটু থেমে রাজ বিছানার কাছে গেল। একদম কাছে নয় দূরত্ব বজায় রেখে দাঁড়িয়ে বলল,
“তোমাকে খুব তাড়াতাড়ি তোমার রাজ্যে ফিরিয়ে দেওয়া হবে। চিন্তা করো না। তবে তোমার পিতা রাজা তৈজুল আমার সাথে প্রতারণা করেছে। অনেকের কাছে আমাকে অপমানিত হতে হয়েছে। তোমাকে অপহরণের মাধ্যমে আশা করি তিনি উনার ফলাফল হাতে নাতে পেয়ে গেছেন।বিশ্রাম করো।”
সম্রাট আবার ফিরে গেল। মেহেরের ছোট্ট মনে এই কথা গুলি বাজে প্রতিক্রিয়া ফেলেছে তা অপর মানুষটা চতুর ও প্রখর বুদ্ধিমান ব্যক্তি হয়েও আঁচ পর্যন্ত করতে পারল না। যখন শুনেছে তাকে তার রাজ্যে ফিরিয়ে দিবে তখন খুশি হয়েছিল সে। সম্রাট কে মহানও ভেবে বসেছিল। কিন্তু যখন বাকি কথা গুলি কর্ণকুহরের নরম পর্দায় টোকা দিচ্ছিল তখন মানুষটার প্রতি নেতিবাচকই মনোভাব পোষণ করে ফেলেছে। তার বাবা কোনো দিন এমন বাজে কাজ করতে পারে না। তিনি ভীষণ সৎ আর উদার মনের মানুষ। প্রতারণা নামক এমন নিকৃষ্ট একটা কাজ তিনি কখনোই করতে পারেন না। এটা কেউ বিশ্বাস করাতে পারবে না তাকে। বরং সম্রাট রাজের প্রতি বিষাক্ত একটা কিছু মনের কোণায় টাই নিয়েছে তার।
রাতের মাঝেই মেহেরকে অন্য একটা কক্ষে স্থানান্তর করা হয়েছে। রাতে আর রাজ সেই কক্ষে একবার গিয়ে দেখে আসেনি মেহেরের শারীরিক অবস্থার কথা। তবে নাইলার কাছ থেকে খবর নেওয়ার কাজে অবহেলা করে নি। শ্যাযায় শুয়ে কপালে ডান হাত ভাঁজ করে রেখে বা হাত পেটের উপর দিয়ে চোখ বুজল।
—-
গত দুইদিনে সম্রাট একবারও কাজের ব্যস্ততায় প্রাসাদের অতিথির সাথে দেখা করা হয়ে উঠেনি। ভেবেছে আজ রাতে একবার দেখে আসবে মেহের কে। নিজের পোশাক খুলে হাম্মামখানায় এগিয়ে গেল। নিজেকে পরিষ্কার করে আবার কক্ষে ফিরে এলো। ঘরে আহারের ব্যবস্থা দেখে এত চমকায়নি। এখন নাইলার খবর পাওয়া যায় না বলেই চলে। মেহেরের সাথে বেশ সখ্যতাও হয়েছে তার। তাই অযথা কথা বাড়ায় না এ নিয়ে। নিজের আহারটুক শেষ করে গায়ে অন্য পোশাক পরে নিল সে। দরজায় টুকা দিতেই দুই পাশ থেকে দুজন প্রহরী দরজা টেনে নিল। সটান বুক নিয়ে লম্বালম্বা পায়ে মেহেরের কক্ষের দিকে এগিয়ে গেল। সম্রাট কে দেখা মাত্র প্রহরীরা দরজা খুলে দিল। রাজ বেখেয়ালি ভাবে কোনো রকম শব্দহীন সে ঘরে প্রবেশ করলে থমকে যায়। রাতের ঢিলেঢালা পাতলা পোশাকে মেয়েটা হতভম্বের মতো বিস্মিত চোখে নির্বোধের মতো তাকিয়ে আছে তার দিকে। রাজ স্তম্ভিত, কিংকর্তব্যবিমূঢ়। মেহের হঠাৎ উনার আগমনে ভয়কে গেল। ঢোক গিলে এদিক ওদিক করে লাফিয়ে বিছানায় উঠে চাদরটা টেনে নেয় গায়ে। আকস্মিক এমন কান্ডে রাজ নিজেও বিব্রত। দাঁত চিবিয়ে মুখ পাশ ফিরিয়ে নেয়। মেহের ঘনঘন পাতা ফেলে চোখের। ভাবেওনি রাজ আসবেন তার কক্ষে। এই কক্ষে নাইলা আর দুজন দাসী ছাড়া কারো প্রবেশ নিষেধ। তাই এতটা আদলে নেয়নি এটা। কিন্তু এভাবে.. মেহের আবারও ঢোক গিলল।
“দুঃখিত আমি আসলে..”
থেমে গেল রাজ। এরপর আবার বলতে লাগল,
“আমি ব্যস্ততায় আপনার খবর নিতে পারিনি মেহের। কিছু মনে করবেন না। আশা করি খুব তাড়াতাড়ি নিজের রাজ্যে ফিরে যেতে পারবেন।”
মেহের স্তম্ভিত ভঙ্গিতে নির্বাক তাকিয়ে রইল রাজের দিকে। নাইলা আর দুজন দাসী কে খুব মনে পড়বে নিজের রাজ্যে ফিরে গেলে।
“ছোট্ট রাজকন্যা তুমি নাইলা কে দেখতে এ আরশিনগর আসতে পারো নির্দ্বিধায়।”
মেহেরকে দমকে যাওয়া দেখে রাজ বলে উঠল,
“শুভরাত্রি মেহের।”
তারপর গটগট করে আবার রাজ চলে গেল। মেহের ফুস করে নিশ্বাস ছেড়ে দিয়ে আবার প্রাণ ভরে নিশ্বাস টেনে নিল।
“আপনার এই রাজ্যে আর না। দরকার হয় নাইলা আপা কে আমাদের রাজ্যে দাওয়াত করব। তবুও এখানে না। আপনি খুব পঁচা।”
রাজের ভেতরটা অজানা অনুভূতিতে কেমন জ্বলছে। জীবনের এই প্রথম এমন জ্বলনদ্বারা অনুভূতি অনুভব করছে বক্ষপিঞ্জরায়। নিশ্বাস আটকে আটকে আসছে। অসহ্য বুকের চিনচিনে ব্যথা নিয়ে দ্রুত নিজের কক্ষের দিকে অগ্রসর হলো।
—-
রাজা তৈজুল আরশিনগর পৌঁছে গেছেন। ব্যথায় জর্জরিত বুকে এক রাশ ভয় আর আশা নিয়ে তিনি সম্রাট আব্রাহাম মুনেম রাজের দরবারে হাজির হয়েছেন। নিজের কাজে তিনি লজ্জিত তবুও মেয়েকে ফিরে পাবার লোভে সে লজ্জা তিনি ঢেকে রেখেছেন মোটা চাদরের নিচে।
সম্রাট রাজের সামনে তাজিম করে সম্মান প্রদর্শনের কাজ সারলেন তিনি। বয়সে হয়তো নিজের ছেলের বয়সী তবুও তাকে উনার সম্মান করতে হয়েছে। কারণ এটাই নিয়ম। সম্রাট সে। তার নিকট সকল রাজারা সম্মান প্রদর্শনীতে বাধ্য। এমনকি তার দাপটে বিভিন্ন সম্রাটও তার নিকট নতজানু হয়। এ সবই যেন এই অল্প বয়সে রাজের কীর্তি। রাজা তৈজুল দুই হাত একত্র করে মাথা নিচু করে দাঁড়ালেন। তা দেখে মুখে তাচ্ছিল্য হাসি ফুটে উঠে রাজের। সটান বুক নিয়ে নিজের আলিশান আসনে বসল।
“আসন গ্রহণ করুন রাজা তৈজুল।”
“আমি আমার কর্মের কারণে লজ্জিত মাননীয় সম্রাট।”
“আপনি এভাবে আগেও আমার দরবারে উপস্থিত হয়েছিলেন। তবে সেদিন কোনো প্রতারণার ঘটনা ছিল না আমাদের মাঝে অথচ আজ..”
“…
“নিজের আসনে বসুন শান্ত হয়ে কথা বলি।”
তৈজুল মাথা নিচু করে আসন গ্রহণ করলেন। ঢোক গিলে আড়চোখে তাকালেন রাজের দিকে। গম্ভীর মুখটা দেখে তিনি ভয়ে জড়ো হয়ে গেলেন। কিছু বলতে নিলে রাজ নিজ থেকেই বলল,
“সেদিন এসেছিলেন আপনার রাজ্যের পাশের একটা সীমান্ত আমার থেকে দান হিসেবে নিতে। আমি আপনায় সেটা দিয়েছিলাম। আপনি আমার পার্শ্ববর্তী সম্রাটের রাজ্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হওয়া সত্বেও। অথচ আপনি বিভিন্ন রাজ্যের রাজাদের নিকট খবর পাঠিয়েছেন আপনি যুদ্ধ করে আমার থেকে সীমান্ত টা ছিনিয়ে নিয়েছেন। আপনার রাজ্যের সম্রাট জাহাঙ্গীরেরও শক্তি নেই আমাকে পরাজয় করে আমার সীমানায় তার পতাকা ঝুলানোর। আর সেখানে আপনি…. আপনার মতো একটা মানুষের কাছে বিষয়টা খুবই লজ্জাজনক।
নিজের এমন কর্মে তৈজুল ঘৃণিত আর লজ্জিত। চোখ বুজে লজ্জা নিবারণ করতে চাইলেন তিনি। মাথা খানিক উঁচু করে কিছু বলতে নিলে হাতের ইশারায় রাজ আবার থামিয়ে দিল।
“আপনি কি ভেবেছেন সম্রাট জাহাঙ্গীরের কুপরামর্শতে আপনি এমন ঘৃনিত একটা কাজ অনায়াসে করে ফেলবেন আর আমি টের পাবো না? সম্রাট আব্রাহাম মুনেম রাজ কে এতই নির্বোধ ভাবেন আপনি কিংবা আপনার সম্রাট জাহাঙ্গীর? ছিঃ। আপনি আমায় একবার জানাতে পারতেন কোনে সমাধান দিতাম আমি।”
“আমায় মাফ করুন সম্রাট। অনুরোধ অনুগ্রহ করে আমার রাজকন্যা কে ফিরিয়ে দিন আমায়। সম্রাট জাহাঙ্গীর আমায় হুমকি দিয়েছিল। তাই ভয়ে আমি নিরুপায় ছিলাম সম্রাট। আমায় মাফ করুন।”
বলে চোখে পানি ফেলতে শুরু করলেন। এতে রাজ তেমন টলল না। আগের ভাব বজায় রেখে বলল,
“আপনার রাজকন্যা নিরাপদ আছে। তাকে অপহরণ করার একটাই উদ্দেশ্য অন্যান্য রাজে আপনার বীরত্বের প্রমাণ দেওয়া। আমার সাথে যুদ্ধ করে সীমান্ত জয় করেছেন সেই আপনার রাজকন্যা প্রাসাদ থেকে অপহরণ। ব্যাপারটা কেমন বেখাপ্পা না? সীমান্ত জয়ের কথা যেমন সবাই শুনল এটাও শুনুক আমি চেয়েছি। তাই অনিচ্ছা থাকার পরেও এমন একটা কাজ করতে বাধ্য হয়েছি আমি। আপনি চাইলে আপনার মেয়েকে নিয়ে যেতে পারেন আজই। আর ওই জাহাঙ্গীর কে আমি না হয় দেখে নিব। আমার বিরুদ্ধে…”
রাজ থেমে আবার বলল,
“আপনি প্রহরীদের সাথে অতিথি বিশ্রামাগারে বিশ্রাম করুন আপনার মেয়েকে নিয়ে আসছি।”
তৈজুল কে কিছু বলতে না দিয়ে রাজ চলে গেল। দম টা সেদিনের মতো আটকে আটকে আসছে। এমন কেন হচ্ছে বুঝতে পারছে না সে। অদ্ভুত একটা অনুভূতি তার রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে যাচ্ছে। সেটা যে খুব সুখকর তা নয়। কেমন যন্ত্রণাদায়ক একটা অনুভূতি!
রাজ ধীরগতিতে এগিয়ে গেল নিজের কক্ষে। সেখানে নিজের পছন্দের জিনিসটা হাতে তুলে নিয়ে আবার মেহেরের ঘরে গেল। দরজা খুলতেই হাস্যোজ্জ্বল মেহেরের বদনখানি চোখে পড়তেই থমকে গেল বিস্ময়ে। হাসলে নারীদের এত মোহিনী লাগে জানত না সে। মায়ের হাসি আর বোনের হাসি ছাড়া কখনো কোনো নারীকে হাসতে দেখেনি সে। কি প্রাণবন্ত সেই হাসি। এই হাসিতে যেন নিজের ঠোঁটের কোণাতেও এক চিলতে হাসি ফুটে উঠে। হৃদয়ে শীতল হাওয়া দুল খেয়ে গেলো রাজের। নাইলার সাথে কোনো বিষয় নিয়ে হয়তো রসিকতা করছিল মেহের। হঠাৎ রাজের আগমনে দুজনের মুখেই হাসির দেখা মিলিয়ে গেল। মাথা নিচু করে দুজনই বসেছিল। রাজ এগিয়ে গেল। নাইলার উদ্দেশ্যে বলল,
“নাইলা রাজকন্যার থেকে বিদায় নিয়ে নাও। আজই সে নিজের রাজ্যে ফিরবে। তার বাবা অপেক্ষা করছে রাজকন্যার জন্যে।” এমন দ্বারা কথা শুনে দুই জোড়া চোখ অবাক নয়নে তাকাল রাজের দিকে। নাইলার চাউনি দেখে খারাপ না লাগলেও মেহেরের। ওমনি দৃষ্টিতে ভেতরে রাজ আহত হলো। মুখ ফিরিয়ে নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরল। আবার স্বাভাবিক গলায় বলল,
“নাইলা এবার তুমি যাও। আমি রাজকন্যার সাথে কিছু কথা বলব।”
“জ্বি ভাইজান” বলে নাইলা প্রস্থান করল। যাওয়ার আগে করুণ চোখে একবার মেহেরের দিকে তাকালও।
রাজ ধীর গতিতে এগিয়ে এলো মেহেরের দিকে। তা দেখে মেহের মাথা নিচু করে নিল। শুকনো ঢোক গিলে অন্তরে পানি ঠেলে দিল। রাজ একদম মেহেরের কাছে গিয়ে উপস্থিত হলো। মাঝে সামান্য দূরত্ব। মেহেরের দিকে কোমল চোখে তাকিয়ে বলল,
“মেহের আপনার হাতটা দিবেন একটু?”
মেহের স্তম্ভিত চোখে তাকাল রাজের দিকে। হাত চাইছে কেন বুঝতে পারছে না সে। শূন্য মস্তিষ্ক নিয়ে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে। রাজ আবার বলল,
“ছোট্ট রাজকন্যা হাতটা কি দিবে?”
এবার মেহের চোখ নামিয়ে নিল। আবার ঢোক গিলল। লোকটার হঠাৎ তুমি আপনির দরকষাকষি বুঝতে পারে না সে। একটার মাঝে স্থির নেই। এটা মেহেরের কেমন লাগল। কি ভেবে ইতস্তত করে নিজের ডান হাতটা এগিয়ে দিবে তখন রাজ বলল,
“বা হাতটা দিন মেহের।”
দাঁত কেটে মেহের মন্থর গতিতে এগিয়ে দিল নিজের বা হাতটা। ভেতরের যন্ত্র টা কেমন করে লাফাচ্ছে। এতে আরো অস্থিরবোধ করছে সে। মেহেরের বা হাতটা নিজের বা হাতের তালুতে এনে রাখলে সারা শরীরে শিহরণ বয়ে গেল তার। বক্ষপিঞ্জরায় কেমন উথাল ঢেউ আছড়ে পড়তে শুরু করেছে। পরিস্থিতি নতুন এক অনুভূতির সাগরে তাকে ভাসিয়ে নিচ্ছে। রাজ বিব্রত কর পরিস্থিতিতে বেশি সময় না দিয়ে ডান হাতে থাকা মধ্যমা আঙ্গুলের পাশের অনামিকা আঙ্গুলে সবুজ পান্নার একটা আংটি গুঁজে দেয় যত্নসহকারে। অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে সেই পান্নার কারুখচিত সবুজ রং এর আংটিটির দিকে। এই অল্প বয়সেও সে এসব নিয়ে বেশ পরিপক্ব। এই পান্নার পাথরটি সহজলভ্য নয় তা অনেক আগেই বুঝতে পেরেছে। খুব কম রাজা বাদশার কাছেই এই ধরনের পান্নার পাথর পাওয়া যায়। এমন একটা পাথরের খুব শখ ছিল মেহেরের। যা তার শরীরে সুভা পাবে। কিন্তু অনেক স্বর্ণমুদ্রা দিয়েও ব্যর্থ হয়ে ছিল সে। আর সেই পাথর কিনা সম্রাট রাজ তাকে দিল? মেহের রাজের দিকে তাকিয়ে আবার নিজের হাতের দিকে চোখ পড়ল। রাজও সেই আংটি পরনো হাতে নজর দিল। ফর্সা দুধে আলতা হাতের উপর সুবজ রং এর পান্নার আংটিটি যেন ঝলমল করছে। এমন একটা হাতে ঠাই পেয়ে স্বয়ং পান্না পাথরটিও যেন নিজেকে সার্থক মনে করছে।
“তোমার আঙ্গুলের মাপ জানিনা। আন্দাজে নিজের হাতে বানিয়েছি তবুও ঠিকঠাক হয়েছে। উপহার পছন্দ হয়েছে রাজকন্যা?”
মেহের বিস্ময়ে কিছু বলতে পারছিল না। এবার রাজ তার হাত ডান টা নিজের দিকে এগিয়ে এনে তাতে একটা তামার পাত রাখল। মেহের ভ্রুকুটি করে সেটা দেখলে একটা চিহ্ন চোখে পড়ে।
“এটা আমি আমার দাদাভাই এর কাছ থেকে পেয়েছিলাম। তিনি বলেছিলেন আমার পছন্দের কাউকে এটা তুলে দিতে। আমি আপনার হাতে তুলে দিলাম। আমাকে অপছন্দ করলেও তা কখনো অযত্নে রাখবেন না। এটাও হতে পারে আমি সময় মতো আপনার কাছ থেকে আবার ফিরে নিতে পারি। তবে সেটা সময়ের অপেক্ষা।”
রাজ তড়িঘড়ি করে আবার বেড়িয়ে গেল কক্ষ থেকে। মেহের তখনো যেন বুঝতে পারছিল না কথার মানে। আশ্চর্য চোখে হাতে থাকা তামার বস্তুটির মাঝে সুক্ষ্ম অঙ্কিত চিহ্নের উপর গভীর মনোযোগ দিল সে।
যাওয়ার জন্যে সব ব্যবস্থা করা হয়েছে। রাজ নিজের দেহরক্ষী আর সৈন্য পাঠানোর ব্যবস্থা করেছেন। এ ছাড়া রাজ বংশের নারীরা যে পর্দা বেষ্টিত ঘোড়ার গাড়িতে যাতায়াত করে তার ব্যবস্থা করেছে মেহেরের জন্যে। রাজা তৈজুল এমন ব্যবস্থায় প্রসন্ন হলেন। রাজ সটান বুক নিয়ে দুই হাত পিছনে মুষ্টিবদ্ধ করে রেখেছে। মৃদু চিনচিনে একটা ব্যথা তার বুকের বা পাশে স্থান নিয়েছে। নাইলার থেকে বিদায় নিল মেহের। খুব খারাপ লাগছে। তার ছোট মনটা বলছে নাইলাকে তাদের রাজ্যে নিয়ে যেতে। মুখে করুণ অসহায়ের ভাব ফুটে উঠেছে দুজনের।
“রাজা তৈজুল আপনি আপনার রাজকন্যা কে নিয়ে মাঝেমাঝে আরশিনগর আসবেন। এতে দুই সখীর সাক্ষাৎ হবে। নাইলা তাকে ছেড়ে দাও দেড়ি হয়ে যাচ্ছে।”
ভাইয়ের কথায় মেহের কে শেষ বার জড়িয়ে ধরল নাইলা। তারপর একটা উপহারের বাক্স এগিয়ে দিল মেহের কে। মেহের যখন রাজের পাশ কাটিয়ে হেটে যাচ্ছিল রাজ যেন সেই মুহূর্ত টায় নিশ্বাস নেওয়াও ভুলে বসে ছিল। বাবার কাছে গেলে তিনি আস্তে করে কানে কিছুু বলে দিলেন। মেহের আবার এগিয়ে গেল রাজের দিকে। এবার চোখ বরাবর তাকাল মাথা উঁচু করে।
“আপনার হা হাত টা..”
“আপনি চাইলে এই নিয়ম পালন করতে হবে না মেহের। যাত্রা শুভ হোক।”
মেহের বাবার দিকে তাকাল। তিনি ইশারায় বুঝিয়ে দিতেই সে বলল,
“নিয়ম নিয়মই হয় সম্রাট।”
রাজ এবার মেহেরের দিকে তাকাল। তার চাউনির দাপটে মেহের তৎক্ষণাৎ চোখ নামিয়ে নিল। রাজ ঠোঁটে এক গালে হাসি টেনে নিজের ডান হাত এগিয়ে দিল মেহেরের দিকে। বন্দিকে মুক্তি দেওয়ার পর সে রাজা বা সম্রাট কে যে সম্মান প্রদর্শন করে মেহের সেটাই করতে যাচ্ছে।
ঢোক গিলে মেহের রাজের হাত স্পর্শ করল। সেটা নিজের মুখের কাছে এনে নিজের কোমল ঠোঁট আলতো করে স্পর্শ করে দিতেই রাজ চোখ বন্ধ করে নেয়। এই প্রথম কোনো মোহিনীর উষ্ণ ঠোঁটের স্পর্শ পেল সে। সর্বাঙ্গ কেঁপে উঠেছে শিহরণে। রন্ধ্রে রন্ধ্রে শিউরে উঠছে রাজ। মেহের দ্রুত সে হাত সরিয়ে নিল। ভেতরের প্রবল ভাবে কিছু একটা উঠানামা করছে। রাজ ফুস করে তপ্ত নিশ্বাস ছাড়ে। মেহেরের একটু কাছে মুখ নিয়ে বেশ চিকন সুরে বলল,
“আমাদের আবার দেখা হবে ছোট্ট রাজকন্যা। হবেই। যত খারাপই মনোভাব পোষে রাখুন না কেন মনে, আমাকে ভুলতে পারবেন না কক্ষনোও।”
বেশি দেরি না করে মেহেরা তাড়াতাড়ি রওনা দিল রাজের কথায়। অনেকটা পথ বাকি। মেহের গাড়িতে উঠে বসতেই ঘোড়া চলতে শুরু করেছে। পর্দা সরিয়ে কি মনে করে মেহের আবার তাকাল প্রাসাদের দিকে। আবছা সম্রাট রাজের মুখটা দেখে পর্দা দ্রুত টেনে ধরল। রাজের উপহার দেওয়া সবুজ রং এর পান্নার পাথরের আংটিটি সত্যি তার হাতের সৌন্দর্য দ্বিগুণ করে দিয়েছে। হাল্কা রোদের আলো এসে পড়তেই চোখ ধাঁধানো ঝলমল করে উঠছে। আংটির দিকে তাকিয়েই মনেমনে আওড়াল।
“আপনি আমার মনে যে প্রভাব ফেলেছেন সম্রাট তাতে আপনার এ আরশিনগর মুখো কখনো হতে চাই না আমি। আর না আপনার সম্মুখীন। ধরে নিন এটাই আমাদের শেষ দেখা। ভুলেও আর কখনো আমি আপনার মুখোমুখি হবো না। কারণ আপনি সত্যিই আমার তরে নিতান্তই বিষবৃক্ষ।”
সমাপ্ত
(❤️)
গল্প টা সমাপ্ত হলো না । দয়া করে এর দ্বিতীয় খন্ড বের হক