বিষবৃক্ষ পর্ব -০৩

#বিষবৃক্ষ ❤️
#সাদিয়া


সম্রাট রাজ হতবাক ভঙ্গিতে নিষ্পলক তাকাল। কপালের ভাজ গুলি এবার আরো এক হয়ে এলো। তার কল্পনায় আসছে না এভাবে ফুঁপিয়ে কাঁদার কি আছে? না সে এমন কিছু বলল আর না কান্নার কোনো অযাচিত কারণ ঘটল। বেশ বিরক্ত হলো এতে সে। গম্ভীর গলায় বলল,
“ফ্যাচফ্যাচ করে কান্নার মতো কোনো কারণ কি ঘটেছে তহুরা জান্নাত মেহের?”

মেহের তখন ফুঁপিয়ে কেঁদে কেঁদেই জবাব দিল,
“আমি এখানে ঘুমাব কি করে? অথচ আমার শরীর ভালো লাগছে না। চিকা বারবার এদিকে আসছে। আমি ভয় পাচ্ছি।”

“রাজকন্যা তোমাকে এখানে আদর যত্ন করতে আনা হয়নি। তাই নিজের কান্না নিভৃতে সারো। আমার ঘুমের ব্যাঘাতের পরিণাম ভয়াবহ।”

রাজ চলে যাচ্ছিল এমন সময় মেহের আবার বলল,
“যে কারণেই অপহরণ করুন না কেন রাজকন্যা হিসেবে শুয়ার একটু ব্যবস্থা করে দিন।”
বেশ সাহস নিয়ে কথাটা বলে মেহের মাথা নিচু করে আবার। সারাদিন মুখে কিছু কাটেনি সে খিদে এখন পেটে ইঁদুর দৌড় দিচ্ছে। সামনের মানুষটার কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে সে ভেবেছে লোকটা চলে গেল কিনা। একটু একটু করে মাথা উঁচু করতেই ভুল প্রমাণিত হলো সে। মানুষটা সটান হয়ে প্রস্থ বুক মেলে এখনো তার দিকে তাকিয়ে আছে। সম্রাট কি মনে করে বলল,
“বের হয়ে আসো।”
এমন কথায় খানিক না একটু বেশি বৈকি অবাক হয়েছে। মেহেরের ঢোক গিলার সময়টাতে রাজ কারাগার থেকে বের হয়ে যায়। বুকের ভেতর ছোট্ট প্রাণটা ভয়ে দ্রিমদ্রিম করে শব্দ তুলছে। এর পরিণাম কি খুব বেশি ভয়াবহ হবে? তবুও হাত গুটিয়ে তো আর বসে থাকতে পারে না। বয়স কম হলে কি হবে? মুক্তির পথে একটু মশালের আলো নিয়ে এগিয়ে যাওয়াই যায়। এতে ভুল অন্যায় কিছুই দেখতে পায় না। মুক্তি সবার কাম্য। বুকের ভেতরের ভয়টা কোনো রকম হজম করে এক কোণায় ভয়ংকর স্পর্ধা সেঁটে নেয়। নিজেকে ধাতস্থ করে নিচ থেকে উঠে দাঁড়ায়। রাজকীয় জুতার উপর ভর দিয়ে দিয়ে অল্প পরিসরের বন্দিখানাটা থেকে বের হয় সে। বাহিরে তাকিয়ে বেশ চমকাল নিশ্চয় লোকটা কোনো রাজাবাদশা। তবে নিজের কক্ষে এমন ছোট্ট কারাগার এর আগে সে কোনো দিন দেখেনি কোথাও। কক্ষে বন্দিখানা? আশ্চর্য ব্যাপার! মেহের এখন যেটা করতে যাচ্ছে তাতে সে এবার আরো ভয় পেতে শুরু করলেও নিজেকে সামলানোর আপ্রাণ চেষ্টায় মেতে উঠেছে। তখনি পুরুষালির মোটা কণ্ঠস্বর শুনা যায়।

“আমার শ্যাযায় নিদ্রা যান আজ। কাল আপনার বন্দিখানায় ছোট গদির ব্যবস্থা করে দিব। এর পর বিরক্ত করার কোনো স্পর্ধা নয়।”

মেহের কিছু বলল না। আড়চোখে দেখতে পেল লোকটা বসার গদিতে চিত হয়ে শুয়ে পড়েছে। তার বিশাল দেহটা জুতসই আটল না গদিতে। পা অনেকখানি বের হয়ে আছে। তবুও কপালে ডান হাত টা ভাঁজ করে ঠেকিয়ে রেখেছে। আর বা হাতটা তার উদরে স্থান পেয়েছে। মেহের দাঁত চেঁপে নিজেকে একটু স্বস্তির করল। তারপর নিজের পোশাক ঝেড়ে বিছানায় শুয়ে পড়ল। কক্ষে মৃদু আলো জ্বলছে। জানালা নিয়ে হাল্কা বাতাস গায়ে এসে ছুঁইয়ে ছুঁইয়ে যাচ্ছে। মুহূর্ত টা একেকটা প্রহর সমান লাগছে। বিষণ্ণ সময়! যদিও কয়েক প্রহর পাড় হয়ে গিয়েছে। এবার নিশ্চত ঘরে বিদ্যমান লোকটা ঘুমিয়ে গিয়েছে। মেহের আস্তে করে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল মানুষটা যেভাবে শুয়েছিল সেভাবেই আছে। মেহের গলা ভিজিয়ে শব্দ হীন বিছানা থেকে নিজেকে উঠিয়ে আনল। জামার নিচে উরুতে থাকা ছোট ছুড়িটা ডান হাতে শক্ত করে চেঁপে ধরে ঘুমন্ত লোকটার দিকে রাগান্বিত ভাবে তাকাল। কক্ষে কোনো শব্দ বিদ্যমান নেই। অতি সাবধানে সে একটা একটা পা ফেলে এগিয়ে যেতে লাগল। পথ শেষ হচ্ছে না, এদিকে ভেতর থেকে ধুকধুক করা শব্দ যেন অপর মানুষটা পর্যন্ত না পৌঁছায়। আজ পর্যন্ত এতটা ভয় এতটা হৃদয়ের বেগতিক স্পন্দন কোনো সময় হয়নি তার। নিজেকে ধাতস্থ করে মনের সবটুক শক্তি একত্র করে পা বাড়িয়ে দিল। যেতে যেতে একদম গদির সামনে চলে গেছে সে। এবার শুধু একটা আঘাত বুকের ঠিক বা পাশটায়। তারপর একটু মুচড়ে দিতেই কাজ শেষ। গলগল করে রক্ত বের হয়ে তখনি নিশ্বাস থমকে যাবে। ছুড়ির মাথায় প্রবল কার্যকরী বিষ আছে কিনা! যা মুহূর্তে রক্তের সাথে মিশে গিয়ে প্রাণনাশ ঘটাবে। ভেবে মেহেরের মনে একটু প্রশান্তি হলো। দাঁত কপাটি গুলি একত্রে লাগিয়ে হাত উঁচু করে ছুড়িটা এগিয়ে দিল লোকটার বুকে। আফসোস স্বাভাবিক ভাবে লোকটা তার চিকন কোমল হাতটা শক্ত করে চেঁপে ধরেছে বা হাতে। কপাল থেকে ডান হাতটা সরিয়ে তীক্ষ্ণ চোখে তাকাল তার দিকে। যেন আশ্চর্য হওয়ার মতো কোনো ঘটনাই নয় বেশ স্বাভাবিক। মেহের তখনো শরীরের সর্বশেষ শক্তি দিয়ে চেষ্টা করে যাচ্ছে লোকটার দিকে ছুড়িটা এগিয়ে দিতে কিন্তু এক চুল নাড়াতে পারে না নিজের হাত। মৃদু আলোয় লোকটার ঠোঁটে বাঁকা হাসি দেখে ভয় যেন তার হৃদয় কে কামড়ে ধরেছে। শুকনো ঢোক গিলে নিল সে। এবার নিশ্চয় তার মৃত্যু। রাজ আরেকটু চেঁপে ধরতেই ছুড়িয়ে নিচে পড়ে শব্দ হয়। গম্ভীর গলায় রাজ বলে,

“আমি সম্রাট আব্রাহাম মুনেম রাজ। আর তুমি ছোট্ট ১৫/১৬ বছরের এক রাজকন্যা মাত্র। কি করে এত বড় দুঃসাহস দেখাও? কি মনে করে ছিলে? ঘুমিয়ে গেছি আমি? আমি বুঝি নি তখন তুমি কোন উদ্দেশ্যে কারাগার থেকে বের হতে চেয়েছিলে। আমি কি আর এমনেই তোমায় বাঁধ সাধিনি? ছোট্ট রাজকন্যা যে স্পর্ধা তুমি দেখিয়েছো তার পরিণাম কেবলই মৃত্যুদন্ড। এই মুহূর্তে ওই ছুড়ি তোমার গলায় চালিয়ে দিতে জানি আমি। এক মুহূর্ত ব্যয় হবে না তাতে। চোখের পলকে আমি কাজ সেরে দিতে পারি তোমার বুঝে উঠার আগে। এতে বেশ পরিপক্ব রাজ। তোমার এই স্পর্ধাতেও আমি বিস্মিত হচ্ছি না। কেননা আমার ধারণা ভুল প্রমাণিত হয়নি। এবার তুমি বলো তোমার এই স্পর্ধার পরিণাম আমি কি দিব?”

মেহেরের চোখ ফেটে পানি গড়িয়ে পড়তে লাগল। নিজের মন কে স্থির করে নিয়েছে এবার তার আর শেষ রক্ষা নেই। নিশ্চিত মৃত্যুদন্ড। চোখের সামনে বাবা আর ভাইদের মুখ ভেসে আসছে। কান্নার গতি এবার ফুঁপিয়ে উঠছে। শ্বাস নিতেও কষ্ট লাগছে বুকে। হাতটা যন্ত্রণায় ছিঁড়ে যাচ্ছে। এখনি বুঝি মচমচ করে হাতের হাঁড় ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে যাবে। চোখ মুখ খিঁচে ব্যথা সহ্য করার বৃথা চেষ্টা করতে লাগল ছোট্ট প্রাণটি। চোখের পানি অবাঁধে নিচে গড়িয়ে যাচ্ছে। এসবে কোনো তোয়াক্কা নেই রাজের। রাগে রক্ত তার টগবগ করলেও শান্ত স্বভাবে বসে আছে। ইচ্ছা হচ্ছে এখনি তার গাল বরাবর কয়েকটা থাপ্পড় এঁকে দিয়ে চুলের মুঠি ধরে অন্ধ কারাগারে নিক্ষেপ করতে। কিন্তু এসব তার শিক্ষা আর ব্যক্তিত্বে নেই। রাগে চোখ বন্ধ করল কয়েক মুহূর্তের জন্যে।

“এসো।”
বলে হেচকা টানে মেহেরকে ছোট কারাগারের দরজা ঠেলে ভেতরে নিয়ে দরজা লাগিয়ে দেয়। চোখ বন্ধ করে লম্বা লম্বা নিশ্বাস ফেলে নিজের বেসামাল ক্রোধকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করতে লাগে। হাত মুষ্টিযোগ করে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে চাইল। কারণ এই মুহূর্তে রাগ না কমলে ভয়াবহ কিছু একটা করে ফেলবে এতে তার সন্দেহ নেই। তপ্ত নিশ্বাস ঝেড়ে যেই পা বাড়াবে এমনি কারাগার থেকে মেহেরের ফুঁপানোর আওয়াজ পাওয়া গেল। দাঁত চেঁপে সহ্য করতে চেয়েও পারল না। দরজা খুলে আবার ভেতরে গেল তেড়ে। হিংস্র চেহারা নিয়ে তর্জনী আঙ্গুল উঠিয়ে ধরালো কন্ঠে বলতে লাগল

“এতবড় কাজের জন্যে যা শাস্তি পাও নি এবার তা দিতে বাধ্য করো না আমায়। একটু শব্দ যেন বাহিরে না যায়। তবে চিরদিনের জন্যে শব্দ বের করা বন্ধ করে দিব। একবারে কোনো শব্দ যেন কর্ণকুহরে প্রবেশ না করে।”

নিজের কথা শেষ করে ধুপধাপ পায়ে প্রস্থান করল রাজ। ক্লান্তি শরীরটা গদিতে হেলিয়ে দিলেও ঘুমায়নি সে। এবার নিশ্চিন্তে শ্যাযায় শুয়ে পড়তেই যেন ঘুম তাকে টেনে নিয়ে যাবে।

মেহের নীরবে হাটু ভাঁজ করে বুকের সাথে আলগোছ নিয়ে এলো। দুই হাত দিয়ে পা দুটি বুকের সাথে শক্ত করে চেঁপে ধরে মুখ গুঁজে নিভৃতেই চোখে অশ্রু ঝড়াতে লাগল। সে জানে না এই কারাগার থেকে কবে নিজের রাজ্যে যেতে পারবে। আর এই বন্দিদশার মুক্তির পথই বা কিরূপ।

চলবে
(কাল গল্প দিতে পারব না। দিলেও হয়তোবা দেরি হবে❤️)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here