বিষাক্ত প্রেমের অনুভূতি পর্ব ৫০+৫১+৫২

বিষাক্ত প্রেমের অনুভূতি

উর্মি প্রেমা (সাজিয়ানা মুনীর)

পর্ব :৫০

সারাদিনের ক্লান্তি ভারী শরীর নিয়ে সেহের এপার্টমেন্টে ফিরে আসে। দরজা খুলতে বুক ফেটে চিৎকার আসছে। ঘরের প্রতিটা জিনিস আশনূহার স্মৃতি মনে করিয়ে দিচ্ছে। সকাল থেকে আশনূহাকে খুঁজছে ।আশনূহার ফ্রেন্ডদের থেকে জানতে পারে কোন এক জোকারের পিছু পিছু আশনূহাকে যেতে দেখা গেছে। জোকারের কোনো খোঁজ মিলেনি।তন্ন তন্ন করে সারাদিন সব জায়গা খুঁজেছে । আশেপাশে আত্মীয় বন্ধুবান্ধব কারো বাড়ি বাদ রাখেনি । কোথাও আশনূহার সন্ধান মিলেনি ।সেহেরের বেঁচে থাকার এক মাত্র কারণ আশনূহা।আশনূহাকে হারিয়ে সেহের বাঁচতে পারবেনা । চোখ জোড়া এখনো ভেজা। ফ্লোরে ধপ করে বসে হাউ মাউ করে কান্না করতে লাগে।সেহেরের বাবা অসহায় দৃষ্টিতে মেয়েকে দেখছে। সন্তানের কষ্ট দুনিয়াতে ভয়ংকর কষ্ট। বাবা মায়েরাই জানে সন্তানের উপর বিপদ আসলে ঠিক কি পরিমান যন্ত্রণা হয়। পুরো দুনিয়া বিষাক্ত লাগে। বেঁচে থাকাই বৃথা মনে হয়। এই যন্ত্রণা তিনি ভোগ করেছে যখন সেহেরের উপর অচেনা কেউ হ য়ে আরহাম নজর রাখতো। সেহেরের প্রতিদিন ধুঁকে ধুঁকে বাঁচা উনাকে সেই ভয়ংকর যন্ত্রণার সাথে পরিচয় করিয়েছে। মেয়েকে সান্ত্বনা দেওয়ার মত শব্দ তার কাছে নেই! আজ তিনি ভীষণ অসহায়!
হঠাৎ সেহেরের মোবাইল বেজে উঠে। আননোন নাম্বার । সেহের দ্রুত হাতে মোবাইল তুলে নেয়। রিসিভ করেকানে তুলতে অপর পাশ থেকে চিরচেনা এক আওয়াজ ভেসে আসে। অতীতের সেই আওয়াজ চিনতে সেহেরের এক সেকেন্ড সময় লাগল না। থমথমে স্বরে বলল, ” আরহাম? ” অপর পাশ থেকে নিরস কাঠখোট্টা স্বরে বলে ,” বাহ চিনেছ দেখছি! এখনো আমাকে মনে পড়ে? ”
সেহের উত্তর দিল না। এতো বছর পর আরহামের আওয়াজ শুনে সে জমে গেছে। অনুভূতিহীন পাথর । কিরকম প্রতিক্রিয়া করবে তার জানা নেই।আরহাম আবার বলল ,” মেয়েকে হারিয়ে কি রকম অনুভূতি হচ্ছে? কয়েক ঘন্টায় এই হাল! ”
সেহের কিছু বলবে এর পূর্বে- ই আরহামের তেজি আওয়াজ ভেসে আসে,”তোমার সাহস কি করে হলো এতো বছর আমার মেয়েকে আমার থেকে দূরে সরিয়ে রাখার? এখন থেকে আশনূহা তার বাবার কাছে থাকবে । এ জীবনে দ্বিতীয়বার আশনূহার মুখ দর্শনের সুযোগ পাবে না। আমি আমার মেয়েকে নিয়ে যাচ্ছি ! ”
সেহেরকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে আরহাম ফোন কাটল । সেহের তখনো বিস্মিত।মাথাটা ঘুরছে । এতো বছর পর আরহাম কি করে তাদের খোঁজ পেলো । সেহের তো সবার সাথে সবরকম যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রেখেছিল । তবে আরহাম কি করে জানল? আশনূহা আরহামের কাছে? আরহাম কিডন্যাপ করিয়েছে! এতো কিছুর পর আরহাম কি চায়।সেহেরের জীবন তো নষ্ট করেছেই এখনকি শেষ বেঁচে থাকার সম্বলটাও কেড়ে নিতে চায়?
আরহাম যদি সত্যি সত্যি আশনূহাকে নিয়ে যায়? না না সেহের তা হতে দিবে না। আরহামকে কোনভাবেই আশনূহাকে নিয়ে যেতে দিবে না। আশনূহা শুধু সেহেরের।আশনূহার উপর সকল অধিকার শুধু সেহেরের! আশনূহাকে আরহাম থেকে ছিনিয়ে আনতে সেহেরের যা করতে হয় সে করবে।এমন সময় মোবাইলের মেসেজ এলার্ট বেজে উঠে।আরহাম পাঠিয়েছে!

“মেয়েকে দেখতে চাইলে এই এড্রেসে চলে এসো ,নয়টার পর গেট বন্ধ হয়ে যাবে।সো কুইক! ”

সেহের ফ্লোর থেকে উঠে এলোমেলো ভাবে আরহামের পাঠানো এড্রেসে ছুটে চলে।সেহেরের পেছন পেছন তার বাবাও বেরিয়ে পড়ে।

পাঁচবছর পর আরহাম সেহের মুখোমুখি। আরহাম সামনের সোফায় বসে সেহের তার বিপরীতে।আরহামের শক্ত শান্ত চাহনি। সেহের মাথা নিচু করে বসে। ফ্লোরের টাইলসের নকশার দিকে তাকিয়ে। যেন এই মুহূর্তে নকশা দেখাটা ভীষণ জরুরী কাজ।আরহাম বরাবরই হিংস্র যদি আবার আটকে নেয়? নিজের কাছে রাখার জন্য জোর করে? এবারো কি হাত পায়ে শিকল বাঁধবে!সেই জীবন সেহের আর চায়না । আশনূহাকে নিয়ে খোলা আকাশের নিচে স্বাধীন জীবন চায়।
নীরবতা ভেঙে সেহের আমতা আমতা স্বরে বলল,” আশু কোথায়? ডেকে দিন বাড়ি ফিরবো ”
আরহাম তাচ্ছিল্য স্বরে বলল,””মাত্র কয়েকঘন্টায় এই হাল? আর আমি যে পাঁচটি বছর প্রতি মুহূর্ত সন্তানের মুখ দেখার জন্য ছটফট করেছি?…..এখন থেকে আশনূহা তার বাবাইর কাছে থাকবে।মানে আমার কাছে। ”
আরহামের কথায় সেহের থমকে যায়। কান্না জড়িত স্বরে বলল,” আশনূহা শুধু আমার।আমি ওর মা ,আপনার আশনূহার উপর কোন অধিকার নেই! তাড়াতাড়ি আমার মেয়েকে দিন নাহয় আপনার বিরুদ্ধে কিডন্যাপিং কেস করবো! ”
সেহেরের কথায় আরহাম হাসলো।বলল,”তোমার আশনূহা? তুমি তো বলেছিলে এই বাচ্চা তোমার চাইনা ।খুনির চিহ্ন নিয়ে তুমি বাঁচতে পারবে না! এখন কেন চাই? আর কেস করবে? কিডন্যাপিং? আমি তোমার বিরুদ্ধে এটাম টু মার্ডারের কেস করবো! বলবো পাঁচবছর আগে তুমি আমার বাড়িতে আগুন লাগিয়ে আমাকে মারার চেষ্টা করে পালিয়ে এসেছ! যার যথেষ্ট প্রমাণ আমার কাছে আছে। যেমন, বাড়ির কাজের লোকদের সাক্ষী! ”
সেহের অশ্রুভারাক্রান্ত ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে।
“আমি কোর্টে যাবো,আশনূহার কাস্টাডি নিবো । আমার মেয়েকে আমার থেকে কেউ আলাদা করতে পারবে না! ”
আরহাম আবারো তাচ্ছিল্য হাসল বলল,” কোর্টে নিশ্চয়ই খুনির হাতে বাচ্চার কাস্টাডি দিবে না! ”
“আপনি খুনি ,আমি নিজ চোখে আপনাকে নিষ্পাপ মানুষের প্রাণ নিতে দেখেছি । ”
“প্রমাণ? প্রমাণ তো সেই বাড়ির সাথে জ্বলে গিয়েছে । এখন কি করে তা প্রমাণ করবে? ….তুমি চাইলে আমার বাড়িতে আশনূহার আয়া হয়ে থাকতে পারো ”
সেহের বেশ বুঝতে পারছে আরহাম আশনূহাকে কেড়ে নেবার পুরো ব্যবস্থা করে এসেছে।আরহাম কেন এমন করছে? সেহেরকে ফিরে পাবার জন্য?
সেহের রাগী স্বরে বলল,”আপনি যাই করুন আমাকে ফিরে পাবেন না।আবারো আমি আপনার পিঞ্জিরায় বন্দি হবো না! ”
“আমার তোমাকে চাই না, নাও আ’ম নট ইন্টারেস্টেড উইথ ইউ ! আমার নতুন জীবন হয়েছে। ”
সেহের থতমত খেয়ে গেল।আরহাম বলল,”যাওয়ার আগে মেয়েকে দেখতে চাইলে দেখতে পারো । আমি তোমার মত নির্দয় নই! ”
সেহের তড়াক করে উঠে দাঁড়ায়।আরহামের পিছুপিছু যায়। আরহাম এক কাচের জানালার সামনে দাঁড়াল। আশনূহা ভিতরে খেলছে ।ঘর ভর্তি খেলনা পেয়ে সে ভীষণ খুশি।সেহেরের কথা কি তার মনে পড়ে? কি জানি!
আরহাম পাশ থেকে বলল ,”নূহা তার বাবাইকে পেয়ে ভীষণ ভালো আছে। আমার মেয়ের এখন তোমাকে চাইনা! ”
সেহের ডুকরে কেঁদে উঠলো । কাঁচের উপর থেকে আশনূহার উপর হাত বুলালো।আরহাম চোখ মুখ শক্ত করে সামনের দিকে তাকিয়ে । কিছুক্ষণ পর রুমে মিহিকে দেখে সেহের চমকে আরহামের দিকে এক পলক তাকায়। আরহাম তখনো সামনের দিকে তাকিয়ে। মিহির হাতে চুড়ি নাকে নোসপিন! তবে কি আরহাম মিহি স্বামী স্ত্রী? মিহিই আরহামের নতুন জীবন? খামাখা বন্ধুত্বের খাতিরে কেউ এক দেশ ছেড়ে অন্যদেশে আসবে নাহ।
সেহের ভাবনায় ডুবে।আনমনেই আরহামকে প্রশ্ন করল ,”মিহি আপনার স্ত্রী? ”
আরহাম শক্ত গলায় বলল,” নাও গেট আউট ,অনেক রাত হয়েছে।নূহা ঘুমাবে! ”
না চাওয়ার পরও সেহেরকে যেতে হলো।গেটে সেহেরের বাবা তার অপেক্ষা করছে। বাবাকে দেখে ,বাবার বুকে কান্নায় ভেঙে পরে। বাবা কোনরকম সেহেরকে গাড়িতে তুলে।দূর থেকে আরহাম মিহি সবটা দেখছে।মিহি বলল,”এতোটা হার্টলেস হইয়ো না! সে আশনূহার মা! ”
“স্যি ডিজার্ভ ইট! ”
আরহাম সেহেরের চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে বলল।

বাড়ি ফিরে সেহের আশনূহার কাপড় খেলনা জড়িয়ে কাঁদছে। সাড়ে চার বছরে এই প্রথমবার আশু তার থেকে এতো দূর। আরহাম এতোটা হৃদয়হীন কি করে হতে পারে। কেন আবারো ফিরেছে! মিহিকে বিয়ে করেছে তাকে নিয়ে সুখে থাকুক। আশনূহা সেহেরের বাঁচার কারণ, আশনূহাকে কেন ছিনিয়ে নিতে চাইছে? সেহেরের ঘর থেকে চিৎকার করে কান্নার আওয়াজ ভেসে আসছে। মেয়ের এমন যন্ত্রণা দেখে সেহেরের বাবা বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ে ।আশেপাশে আত্মীয় স্বজন বন্ধুবান্ধবের সাথে কথা বলবে।এতে যদি কোন রাস্তা বের হয়।
রাত গভীর।সেহের কান্না করতে করতে ঘুমিয়ে গেছে। বাহিরে প্রচণ্ড তুষারপাত হচ্ছে। বাহিরের সব রাস্তা ব্লক! গাড়ি চলাচল সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ! বাবা তখনো বাড়ি ফিরেনি। এপার্টমেন্টের মেইন ডোর খোলা। লক লাগানো হয়নি । সেহের বিছানায় মাথা রেখে ফ্লোরে ঘুমিয়ে। শীতে শরীর থরথর কাঁপছে।কেউ তার শরীরে চাদর জড়িয়ে দেয়। চুলে আলতো করে হাত বুলাতে থাকে!
বিষাক্ত প্রেমের অনুভূতি

উর্মি প্রেমা (সাজিয়ানা মুনীর)

পর্ব :৫১

অ্যালার্ম ডংডং আওয়াজে সেহেরের ঘুম ভাঙল ধরফরিয়ে উঠে বসে চারদিকে চোখ বুলিয়ে আশনূহাকে খুঁজতে লাগল ।রাতের কথা মনে করে থেমে গেল। মন ভার করে হাত পা গুটিয়ে চুপ করে বসে রইল।চোখ জলে টুইটুম্বুর। এই বুঝি বৃষ্টি হয়ে ঝরঝর করে নামবে।গায়ে চাদর দেখে চমকাল! কই রাতে তো গায়ে চাদর ছিলো নাহ ,এখন কী করে?
ভাবনার মাঝেই কান্ত ভারী শরীর নিয়ে উঠে দাঁড়াল।ঘুম ঘুম চোখ তুলে জানালার পাশে তাকাল । অন্ধকারে কারো অস্বচ্ছ আবছায়া দৃশ্যমান ।মানুষটা আরাম করে ছোট সোফায় বসে। কে সে! সেহের গুটিসুটি পায়ে সেদিকে এগিয়ে যায়। দু’চার কদম যেতেই।থেমে যায় শরীর বরফ খণ্ডের মত জমে যায়। এক কদম ও সামনে বাড়ছে না। নিজ চোখকে বিশ্বাস হচ্ছে না! এটা কি সত্যি আরহাম?
আরহাম অবক্র সিধা হয়ে বসে।চোখজোড়া ফোনের স্ক্রিনে স্থির । সেহেরের উপস্থিতি এখনো টের পায়নি । এতো সকাল সকাল এখানে ? সব কেড়ে কি নিতে এসেছে আবার ?
সেহেরের ভাবনায় টোকা মেরে আরহাম বলল,” সরি সকাল সকাল বিরক্ত করার জন্য । কিছু ইম্পরট্যান্ট কথা ছিলো। মেইন ডোর খোলা ছিলো , কাউকে পাচ্ছিলাম না তাই ভিতরে চলে এলাম ! তুমি কি ফ্রি? ”
আরহামের এমন ভদ্র শান্ত আচরণে সেহের ভীষণরকম বিস্মিত ।আরহামের কথা কেন যেন সেহেরের বিশ্বাস হচ্ছে না। চোখমুখ আর বসে থাকার ভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে সারারাত এখানেই ছিলো । তাও জেগে ।
আরহাম আওয়াজ করে বলল,”তুমি কি ফ্রি আছো? ”
সেহের নড়ে উঠল।”হ্যাঁ ” সূচক মাথা নাড়িয়ে বলল,” আপনি ড্রইং রুমে বসুন ,আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি । ”
আরহাম এক সেকেন্ড থামল না। বড় বড় পা ফেলে ড্রইং রুমের দিকে অগ্রসর হলো । সেহের বেশ কিছুক্ষণ আরহামের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইল।এতো শান্ত স্বভাবের আরহাম নয়। আরহামের বদমেজাজ সম্পর্কে সেহেরের স্পষ্ট ধারণা আছে।তবে কি পাঁচবছরে পরিবর্তন হয়েছে? এতোটা পরিবর্তন কি করে সম্ভব ?
সেহের ফ্রেশ হয়ে ড্রইং রুমে যেতে আরহামকে দেখল গভীর মন দিয়ে মোবাইলে কিছু একটা করছে।সেহের সামনের সোফায় জড়সড় ভাবে বসলো ।সকাল সকাল আরহামের এখানে আসা সেহেরকে ভীষণ ভাবাচ্ছে । কি এমন জরুরী তলব! গলায় ক্রোধের রেশ রেখে সেহের ভারী আওয়াজ করে বলল,”সবতো কেড়ে নিয়েছেন ,এখন আবার কি চাই! ”
আরহাম এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে উত্তর দিলো ,”তোমাকে ”
সেহেরের ভ্রু কুঁচকে আসলো।তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আরহামের পানে তাকাল।আরহাম গলা ঝেড়ে বলল,”আই মিন নূহার তোমাকে চাই ”
“তাহলে ফিরিয়ে দিন আমার মেয়েকে আমার কাছে !”
“সাহস দেখে অবাক হচ্ছি! নূহা আমারো মেয়ে ,তুমি পাঁচ বছর দূরে রেখেছ ।এখন আবারো দূরে সরাতে চাও? ”
সেহের বিব্রত স্বরে বলল,”আপনার কাছে থাকাটা নিরাপদ মনে করি না! ”
সেহেরের কথায় আরহাম রাগল তেজি স্বরে বলল,”আমি আমার মেয়েকে আঘাত করবো? আমি? এই নিম্ন চিন্তাধারা তোমার? নূহা আমার মেয়ে আমার অংশ! হৃদয়হীন তো তুমি যে জন্মের পূর্বে গর্ভে খুন করতে চেয়েছ! ”
আরহামের রাগের প্রতাপে সেহের গুটিসুটি মেরে গেছে।সোফার সাথে লেগে বসে। এই শীতে তুষারপাতের ভেতর আরহামের ঘাম ছুটেছে।জ্যাকেটের চেইন খুলে বড় বড় নিশ্বাস ফেলছে। রাগী ফোঁসফোঁস আওয়াজ শব্দহীন বিরান ঘরের চার দেয়ালে বাড়ি খাচ্ছে। খানিকটা সময় নিয়ে নিজেকে শান্ত করল।আরহাম আগের মত নেই । আগের মত রাগে নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে জিনিসপত্র ভাঙচুর করছে না।বিষয়টা সেহেরের চোখ এড়ায়নি।আরহামের কথার ধাঁচে বেশ পরিবর্তন ।
আরহামকে শান্ত দেখে সেহের নিচু স্বরে বলল,”কিছু বলতে এসেছিলেন! ”
আরহাম কয়েক পলক তাকিয়ে থেকে বলল,”নূহার আয়া প্রয়োজন! তুমি কি ইন্টারেস্টেড? ”
আরহামের কথায় সেহের অগ্নিগিরির লাভার মত ক্ষেপে গেল।বাজখাঁই আওয়াজ তুলে বলল ,”আমি আশুর মা! আপনি আয়া করে নিতে চাচ্ছেন? এখন আমার মেয়ের সাথে দেখা করতে আয়া হয়ে যেতে হবে? আশুর উপর আমারো ততটা অধিকার আছে যতটা আপনার। আপনি এমন অন্যায় করতে পারেন না।”
আরহাম সেহেরের কথা কানে তুলল নাহ।বলল,”তুমি কি ইন্টারেস্টেড? ”
সেহের ক্ষিপ্ত স্বরে পাল্টা প্রশ্ন ছুঁড়ল ,” আপনার ওয়াইফ কি আমার মেয়ের খেয়াল রাখতে অক্ষম? নাকি সে আশুকে চাইছে না! ”
আরহাম বাঁকা হাসলো।বলল ,”নূহার নতুন মা না, তার মাম্মামকেই চাই! সাথে বাবাইকেও ! ”
কিছুটা থেমে আবার বলল,” নূহার জেদ সম্পর্কে তোমার স্পষ্ট ধারণা আছে। আমি চাইনা নূহা নিজের কোন ক্ষতি করে বসুক ,তাই পাঁচ মিনিট সময় দিলাম ভেবে উত্তর দাও। উত্তর যেন হ্যাঁ- ই হয়! ”
সেহের চুপ থাকল।আরহামের কথা ফেলে দেওয়া নয় । নূহা ভীষণ জেদি।গতবছর বার্থডেতে তার বাবাই কে চাই বলে জেদ করেছিল।বাবাইকে না পাওয়ায় কেক ফেলে সব কিছু এলোমেলো করে সারা সন্ধ্যা দরজা লক করে বসে ছিল। সেহের তো ভয়ে জমে গিয়েছিল ,কেঁদে কেটে একাকার ।সেই অনেক মিছে বাহানা দিয়ে দরজা খুলিয়েছিল।
“পাঁচ মিনিট শেষ , তো কখন যাচ্ছো? ”
আরহামের কথায় সেহেরের টনক নড়ল ।আরহাম বলল,”আমার কিছু শর্ত আছে! ”
সেহের শান্ত দৃষ্টিতে আরহামের দিকে তাকাল।সব যদি নিজেই ঠিক করে দেয় তবে এই ভাবাভাবির নাটক কেন?
বিরক্তির স্বরে বলল,”কিসের শর্ত? ”
“তোমাকে আমাদের সাথে বাংলাদেশ ফিরতে হবে , আমার কথা মত চলতে হবে! ”
“আপনি এবার কিন্তু বাড়াবাড়ি করছেন!”
” আশনূহা তার পুরো পরিবারের সাথে থাকবে , তাছাড়া দেশে বাড়ি ঘর বিজনেস ছেড়ে সারাজীবন এখানে পরে থাকতে পারবো না ”
সেহের ক্ষিপ্ত চোখে আরহামের দিকে তাকিয়ে রইল।বাবা বাড়ি ফিরতে বাবাকে সবটা জানিয়ে ব্যাগপত্র গুছিয়ে বেরিয়ে গেল। আরহাম সেহেরের বাবা মুখোমুখি হলো ।দুজন দুজনাকে এড়িয়ে গেল।সেহেরের বাবার ক্রুদ্ধ দৃষ্টি আরহামের উপর!

আশনূহা তার মাকে দেখে তড়িৎ বেগে ছুটে এসে জড়িয়ে ধরে। সেহেরেরও একই দশা।ঝরঝর করে চোখের জল গড়িয়ে পরছে যেন কত কাল পর মা মেয়ের সাক্ষাৎ! আশনূহা মায়ের শরীরে ঘ্রাণে মাখামাখি করছে। এই ঘ্রাণ তার ভীষণ প্রিয়।সেহের মেয়ের কপাল গাল চুমুতে ভরিয়ে দিচ্ছে।আশনূহা মাম্মামের গালে ছোট ছোট হাত ছুঁয়িয়ে দিয়ে বলে ,” মাম্মাম ,আশু মিস ইউ লট! ”
সেহের কান্নার মাঝে মুচকি হেসে বলল,”মাম্মাম অলসো! ”
আশু তার মাম্মামের হাত টেনে নিজের নতুন রুম দেখাতে নিয়ে গেছে।চোখে মুখে উল্লাসের আভা।আজ তার পরিবার পূর্ন ।আরহাম মা মেয়ের হাসি উজ্জ্বল মুখ দেখে মুচকি হাসে । সেহের আশু রুমে যেতেই হতভম্ব হয়ে চেয়ে থাকে। পুরো রুম জুড়ে খেলনা পুতুলে ভরপুর।সেহের সামান্য অল্প আয়ের একটা চাকরি করে ।এই এক ঘরে যা আছে একবছরের ফুল ইনকামেও সেহের এতো কিছু এফোর্ট করতে পারবেনা ।
বিছানার দিকে সেহেরের চোখ আটকায়।আরহাম সেহেরের বিয়ের ছবিতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ।ছবি গুলো এখনো কত সুন্দর যত্নে রাখা। আরহাম তো সেহেরকে ঘৃণা করে! তবে কেন এসব যত্ন করে রেখেছে? আচ্ছা ,মিহির কি এসব দেখে আরহামের উপর রাগ হয়নি ? কি জানি! হয়তো আশনূহার সামনে তার বাবা প্রমাণ করতে এসব রেখেছে!

রাতে খাবার টেবিলে আরহাম সেহের মিহি আশনূহা বসে।মিহি আশনূহা আরহামের দু পাশে বসে।সেহের ঠিকশনূহার পাশের চেয়ারটায় বসে ।আরহাম মিহি খাবার ফাঁকে ফাঁকে টুকটাক কথা বলছে।সেহের আশুকে খায়িয়ে দিচ্ছে । আরহাম আশুকে খায়িয়ে দিতে চাইলে আশু জেদ ধরে।মায়ের হাতেই সে খাবে! আশু আরহামের পছন্দ অপছন্দ এক! দুজনের লাইটলি ডিনার পছন্দ ।রাতে ভারী খাবার মুখে তুলবে না। সেহের সেই সকাল থেকে না খাওয়া মিহি কাজের লোক খাবারের কথা কয়েকবার বলেছে।সেহের আরহামের উপর রাগ দেখিয়ে না করেছে।আরহাম এসব নিয়ে মাথা ঘামায় নি। এখানে আসার পর একবারও কথা বলেনি। না তাকিয়েছে!
সেহের তো এমনটাই চেয়েছে তবে কেন এই চিনচিন ব্যথা? মিহি আরহামের বর্তমান ,সবটা জেনে মানতে পারছে না কেন? তাদের এক সাথে দেখে বুকের বাঁ পাশ এমন জ্বলে উঠে কেন ?
এই পাঁচ বছরে সত্যিই কি সব পাল্টে গেছে? নাকি এখনো কিছু অবশিষ্ট আছে!
বিষাক্ত প্রেমের অনুভূতি

উর্মি প্রেমা (সাজিয়ানা মুনীর)

পর্ব :৫২

রুমের ছাদের দিকে তাকিয়ে আছে সেহের। পেটে ক্ষুধায় চোঁ চোঁ শব্দ হচ্ছে। বেশ কিছুক্ষণ শক্ত ভাবে পেট চেপে শুয়ে থাকে। কিন্তু কোন লাভ নেই । চোখের পাতায় কিছুতেই ঘুম নামছে না।পেটে ইঁদুর ফুটবল খেলছে ।নিজের উপর সেহেরের ভীষণ রাগ হচ্ছে কেন যে রাগ দেখিয়ে ‘খাবো না ‘ বলতে গেল! এখন কী করবে? চেয়ে খাবে? উহু ,কখনোই না!
আবারো শক্ত করে চোখ বুঝে রইল।বাহিরে তুষারপাত হচ্ছে।রুমে হিটার চলছে । এতো শীতের ভেতর উষ্ণ উষ্ণ হালকা গরম ছোঁয়া! ভীষণ আরামদায়ক।এতো আরামে যদি ঘুম না হয় তবে আর কি করার।আশু সেহেরের গা ঘেষে ঘুমিয়ে আছে।আশু একদম তার বাবার মত ঘুমিয়ে আছে।বিয়ের পর আরহামও সেহেরের গায়ের সাথে মিশে ঘুমাত।সেহের হাজার ছাড়াতে চেয়েও পারতো না। আরহাম ঘুম জড়ানো গলায় আদুরে মুখ করে বলতো ,”তোমার ঘ্রাণে মেখে থাকতে ভালো লাগে, সতেজ মিষ্টি মিষ্টি ঘ্রাণ! ইচ্ছে করে খেয়ে ফেলি। ”
“কাকে? আমাকে নাকি ঘ্রাণ ? ”
“দুটোই ”
আরহামের এমন উদ্ভট কথাবার্তায় সেহের তখন খুব হাসতো।আচ্ছা ,আরহাম এভাবে- ই কি মিহির ঘ্রাণে মিশে থাকে? হয়তো!
সেহের ভারী নিশ্বাস ফেলল।পাশ ফিরতে যেয়েও ফিরল না। আশু ঘুমে বিক্ষুব্ধ হচ্ছে।কপাল ভ্রু কুঁচকে নিয়েছে। সেহের চুপচাপ বেশ কিছুক্ষণ শুয়ে থাকার চেষ্টা করল কিন্তু হচ্ছে না।প্রেগন্যান্সির সময়কাল থেকে সেহেরের এমন সমস্যা শুরু হয়েছে ।আগে খাওয়া দাওয়া না করে অনায়াসে দিন পার করতে পারতো ,কিন্তু এখন না খেয়ে একদম থাকতে পারে না। একবেলা না খেলেই শরীর নেতিয়ে পরে।আজ তো পুরো দিন উপাস । মাথা ঝিমঝিম করছে।আরো মিনিট দশেক ভেবে সেহের বিছানা ছেড়ে দাঁড়ালো। চুপি চুপি পা তুলে কিচেনের দিকে গেল। পুরো বাড়ি অন্ধকারে ঢাকা ।জায়গা জায়গায় ছোট ছোট অল্প আঁচের আলো জ্বলছে । পুরো কিচেন তল্লাসি করে খাবার যোগ্য কিছু মিলল না। সব কিছু ফাঁকা।সেহের মুখ ভার করে যেতে নিলে চোখ আটকায় চুলার পাশে ঢাকা প্লেটের দিকে। দ্রুত পায়ে সেদিকে যায়। উপরের ঢাকন সরাতেই গরম গরম চিকেন চাউমিনে চোখ পড়ল ।সেহের খুশিতে লাফিয়ে উঠতে যেয়েও থেমে গেল।চাউমিন থেকে গরম ধোঁয়া উড়ছে ।যেন মাত্র- ই রান্না হয়েছে। এতো রাতে কে রান্না করেছে। কুক চলে গেছে সেই অনেকক্ষণ ।তবে কি মিহি? মিহি কি করে রান্না করবে তারা তো ঘুমাচ্ছে । যেই রান্না করুক তাতে সেহেরের কি ,তার ক্ষুধা লেগেছে সামনে খাবার পেয়েছে সে খাবে!
সেহের দাঁড়িয়েই গপাগপ খেতে শুরু করে।ভীষণ ক্ষুধার্ত সে!
তাড়াতাড়ি খাওয়ায় খাবার গলায় আটকেছে । শ্বাস নিতে ভীষণ যন্ত্রণা হচ্ছে।চোখ লাল হয়ে টপটপ পানি ঝরছে। এমন সময় কেউ মুখের সামনে পানি ধরে । সেহের মানুষটার চেহারা না দেখে পানির গ্লাসটা নিয়ে নেয়। ঢকঢক করে পুরোটা শেষ করে।দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে মুখে বিশ্ব জয়ের হাসি ফুটিয়ে “থ্যাংকইউ ” বলে যেই পিছনে ফিরে অমনি থমকে যায়। ভূত দেখার মত তাকিয়ে বলে “আপনি? ”
আরহাম ম্লান হাসলো।বলল,” হ্যাঁ ,আমি! এতো রাতে কিচেনে কি করো? ওহ খাচ্ছো! তুমি যে বললে ক্ষিধে নেই । ”
সেহের চোখমুখ খিঁচে নেয়।লজ্জা অপমানে সেহেরে গাল লাল হয়ে উঠে। আমতা আমতা স্বরে বলে,”ক্ষিধে নেই- ই তো । কিচেনে পানি খেতে এসেছিলাম সামনে চাউমিন দেখলাম তাই নষ্ট হবে ভেবে টেস্ট করলাম ”
“আচ্ছা? ”
সেহের দুবার হ্যাঁ সূচক মাথা ঝাঁকাল । আরহাম ধীরে ধীরে সেহেরের কাছে এসে টেবিলের দুপাশে হাত রেখে সেহেরকে আটকাল।মুখের দিকে ঝুঁকে গাঢ় দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, ” ভাঙবে তবুও মচকাবে না । এই পাঁচ বছরে কিছু পাল্টায়নি! না তুমি ,না তোমার রাগ জেদ! সবটাই আগের মত! ”
সেহেরে ছোট ছোট চোখ করে আড়দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখল আরহাম চোখ বন্ধ করে বড় বড় শ্বাস টানছে । ধীরে ধীরে সেহেরের ঘাড়ের দিকে ঝুঁকে যাচ্ছে।সেহের সেই প্রথমবার কাছে আসার মত থর‍থর কাঁপছে ।বুকটাও ভীষণরকম ধুকধুক করছে।সেহের চোখ বন্ধ করে অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে বলল,” কি করছেন? মিহি দেখলে ভুল বুঝবে!”
সেহেরের কথায় আরহামের হুশ ফিরল।তড়াক করে চোখ খুলে সেহেরের দিকে কোণাকোণি চোখে তাকাল।শান্ত স্বরে বলল,” মিহি তোমার মত ইমম্যাচিউর বাচ্চা না! সে যথেষ্ট বুদ্ধিমতী , সামান্য কারণে সে একা ফেলে যাবেনা! ”
আরহামের মুখে মিহির প্রশংসা বাক্য শুনে সেহের অগ্নিগিরির তপ্ত আগুন খন্ডের মত পুড়তে লাগল।ক্ষিপ্ত চোখে তাকিয়ে তাচ্ছিল্য হেসে বলল, ” কি অদ্ভুত তাই না? একটা সময় ছিল যখন আপনি আমার এই বাচ্চামো স্বভাবেই মুগ্ধ ছিলেন !”
“সেটা অতীত ছিল। এখন তো আর তোমার প্রতি ইন্টারেস্টেড না তাই না? ”
“সত্যি মানুষ গিরগিটির থেকে অতি দ্রুত রঙ বদলায়। ”
“এক বাচ্চার মা হয়েছো এখনো বাচ্চা রয়ে গেছো , সময় আছে চিন্তাধারা বদলাও! ”
সেহের পিটপিট চোখে আরহামের দিকে তাকাল । আরহাম সরে গিয়ে রুমের দিকে পা বাড়াল। কিছুটা এগিয়ে থামল । আওয়াজ করে বলল,” মিস. ন্যানি ,কিচেন থেকে চুরি করে খাওয়ায় এক হাজার টাকা পে- কাট।!
আরহাম কি বলল ‘মিস ন্যানি? ‘এখন কি নিজের মেয়ের কাছে ন্যানি হয়ে থাকতে হবে? সেহের রাগে লজ্জায় চেঁচিয়ে উঠল।
“থামুন, থামুন ! কি বললেন আপনি? ন্যানি? আমি ন্যানি? আর আপনার কাছে স্যালারি কে চেয়েছে? চাইনা আপনার স্যালারি আপনি রাখেন! ”
সেহেরের চেঁচামেচিতে আরহাম থামল । পিছন ফিরে এক পকেটে হাত রেখে বলল ,” তোমার কাছে টাকার গাছ আছে? স্যালারি না পেলে চলবে কি করে?
তোমাকে কি বলবো ? আমার ওয়াইফ তো নও । এক্স- ওয়াইফ বলে ডাকবো ? ”
সেহের ক্ষিপ্ত দৃষ্টিতে আরহামের দিকে তাকাল ।আরহাম দ্বিধাহীন বলল,”আমার কাছে তুমি আমার মেয়ের ন্যানি- ! ”
আরহাম চলে গেল। সেহের আহত চোখে আরহামের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে ।

নিউইয়র্কের সকাল । অন্যদিনের মত আজও সারা শহর বরফে ঢাকা। গরম কাপড় মুড়িয়ে জীবিকার তাগিদে বেরিয়েছে , কেউ বা সময়টাকে উপভোগ করতে । সবাই ব্রেকফাস্ট টেবিলে বসে। টেবিলের অপর পাশ থেকে মিহি আশনূহাকে গভীর দৃষ্টিতে দেখছে মিটমিট করে হাসছে ।যে কেউ আশনূহাকে দেখে বলবে ‘ছোট সেহের’ ।মুখের গড়ন ,হাসি ,তাকানো পুরোটাই সেহেরের।কিছু আচরণের কথা বলা পছন্দ অপছন্দ সবটা আরহামের।চলনবলন দেখে- ই বলে দিতে পারবে আরহাম কন্যা!
মিহি একবার আরহামকে দেখছে আরেকবার আশনূহাকে । দুজন প্রথমে গ্লাসের জুসটা হাতে নেয় ।এক চুমুক খেয়ে রেখে দেয়।ক্রিমি টোস্ট শেষ করে আরহাম ছুড়ি কাটা চামচ হাতে নিয়ে অমলেটের দিকে হাত বাড়ায় , আশনূহাও তাই আলতো হাতে ছুঁড়ি কাটা চামচ নিয়ে অমলেট কেটে খাচ্ছে । বাবার মতই পার্ফেক্ট! এই গ্রহে একটা আরহামই যথেষ্ট নয় কি? বড় হয়ে আশনূহা তার বাবার মেজাজ না পেলেই হয়! তাহলে যেই হিংস্রতার গাছ মিহি গোড়া থেকে কেটেছে সেই হিংস্রতা এক নতুন রূপ নিয়ে মাথা তুলে দাঁড়াবে!
অন্যদিকে সেহের ঘিয়েভাজা তেলে টইটুম্বুর পরোটা খাচ্ছে ।ঠোঁটের কাছে খানিকটা লেগেও আছে।এখনো বাচ্চামো রয়ে গেছে ,কাজকর্মে এখনো বাচ্চা! কে বলবে এই বাচ্চা মেয়ের একটা মেয়েও আছে? আরহাম আশনূহা যতটা পার্ফেক্ট সেহের ঠিক ততটাই এলোমেলো আর বেখেয়ালি!
কিন্তু এই এলোমেলো মেয়েটাই পৃথিবীর একদম ব্যতিক্রম জিনের দুজন পার্ফেক্ট মানুষের প্রাণ ভোমরা! খুব গভীর ভাবে দুজনের সাথে জড়িত।একজনের সাথে রক্তের সম্পর্ক অন্যজনের সাথে মায়া ভালোবাসায় বাঁধা!
মিহির ভাবনায় ছেদ পরে আরহামের আওয়াজে।বলল,”রবার্ট কখন ফিরছে? ”
“এই তো নেক্সট উইক ”
দুজন আবার খাবারে মন দিলো । সেহের ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রবার্ট কে? এর আগে তো কখমো নাম শুনেনি! পাশ থেকে আশুর আদুরে আওয়াজ ভেসে আসে। মায়ের কাছে আদুরে স্বরে বায়না ধরল ,” মাম্মাম ! তুমি বলেছিলে আমরা আজ ঘুরতে যাবো ”
“আজ কি করে যাবো মা ? নানুভাই যে ব্যস্ত! ”
“নানাভাই না ,আশু মাম্মাম আর বাবাই যাবে ”
সেহের একবার আরহামের দিকে তাকাল, পরক্ষণেই চোখ ফিরিয়ে মিহির দিকে তাকাল ,মিহির এসব নিয়ে বিন্দু পরিমাণ ভ্রুক্ষেপ নেই। সে বেশ আরাম করে নাস্তা করছে। সেহের আশনূহার দিকে ঝুঁকে বলল,” না মা ,আজ না কাল যাবো! ”
“না আশু বাবাই আর মাম্মামের সাথে- ই যাবে! ”
আশনূহা জেদ শুরু করে ।সেহের হালকা ধমক দিতে- ই ডাইনিং ছেড়ে সোফায় বসে। মায়ের কথায় রেগে মুখ ফুলিয়ে নেয়! আরহাম বেশ বুঝতে পারছে সেহের আরহামের কথা শুনে যেতে মানা করছে। আরহাম মেয়েকে কোলে তুলে বলে ,” অবশ্যই যাবো! আজ বিকালে নূহা বাবাই আর মাম্মাম বেড়াতে যাবে! কেমন? ”
কথাটা নূহাকে বললেও উদ্দেশ্য সেহেরকে। আশনূহা খুশিতে নেচে উঠে।সেহের অসহায় দৃষ্টিতে বাপ মেয়ের দিকে তাকিয়ে , এদের সামনে সেহেরের কোন কথা চলে না। বাপ বেটি দুজন সমপরিমাণ জেদি যা বলে তা করিয়ে ছাড়ে!

চলবে …..❣️

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here