বুকভরা ভালোবাসা পর্ব -১৩ ও শেষ

#বুকভরা_ভালোবাসা
#পর্বঃ১৩ ও শেষ পর্ব।
#লেখিকাঃদিশা মনি

ইতি মোহনাকে আটকে বলে,
‘কোথায় যাচ্ছিস ডা’ইনি? সবাইকে কষ্ট দিয়ে তুই সুখে থাকবি সেটা হবে না। তোকেও এবার শাস্তি পেতে হবে।’

মোহনা ইতিকে ধাক্কা দিয়ে চলে যায়। মোহনার মা অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে থাকে। মোহনার মা মোহনার হাত ছাড়িয়ে বলে,
‘আমি যাবো না কোথাও। তুই নিশ্চয়ই কোন অন্যায় করেছিস তাইনা?’

মোহনা দাতে দাত চেপে বলে,
‘হ্যা করেছি। আমিই তো সব অন্যায় করি। সব দোষ তোমার। তোমার জন্য আমাকে কাজের লোকের মেয়ে হয়ে বড় হতে হয়েছে। অথচ আমি এই বাড়ির মেয়ে ছিলাম।’

মোহনার কথাটা শুনে তার মা অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। মোহনা বাকা হেসে বলে,
‘অবাক হচ্ছো নিশ্চয়ই? তোমার এত যত্নে লুকিয়ে রাখা মিথ্যা কথাটা কিভাবে আমি জেনে গেলাম ভাবছ। তাহলে শোন আমি অনেক আগেই জানতাম মেহুল এই বাড়ির মেয়ে নয় আমি এই বাড়ির আসল মেয়ে। যেদিন হাসপাতালে আমার আর মেহুলের জন্ম হয় সেদিন তুমি নিজের মেয়ের সাথে আমাকে অদল বদল করে দিয়েছিলে। কারণ তুমি চেয়েছিলে তোমার মেয়ে ভালোভাবে মানুষ হোক আর আমি গরীবের মতো বাঁচি। তাইতো? আজ মেহুলের যায়গায় আমার থাকার কথা ছিল কিন্তু তোমার জন্য,,,,,’

মোহনার সব কথা শেষ হওয়ার আগেই মেহেজাবিন এসে চিৎকার করে বলে,
‘এসব তুমি কি বলছ মোহনা?’

২৫.
মেহুল স্মিগ্ধকে কল করছে। কিন্তু স্নিগ্ধ ফোন রিসিভ করছে না। মেহুলের খুব ভয় হয় যে স্নিগ্ধ হয়তো মেহুলকে ভুল বুঝেছে।

মেহুলের ভাবনাকে ভুল প্রমাণ করে স্নিগ্ধ মেহুলকে ফোন দেয়। মেহুল ফোন রিসিভ করেই কাদতে শুরু করে। স্নিগ্ধ মেহুলকে শান্তনা দিয়ে বলে,
‘তুমি কেদোনা মেহুল। সব ঠিক হয়ে যাবে দেখ।’

মেহুল কোনরকমে কান্না থামিয়ে বলে,
‘আর কিছু ঠিক হবে না স্নিগ্ধ। আমি হয়তো আর কোনদিনও তোমায় দেখতে পারব না।’

স্নিগ্ধ মেহুলকে ধমক দিয়ে বলে,
‘এসব তুমি কি বলছ মেহুল? কেন বলছ?’

মেহুলঃআমি চলে যাব। সব ছেড়ে চলে যাবো অনেক দূরে। আমি যে আর কিছু সহ্য করতে পারছি না। অনুশোচনা আমায় শে’ষ করে দিচ্ছে। আমি যে অন্য একজনের অধিকার কেড়ে নিয়েছি। অন্য একজনের হক নিয়ে বেচেছি। আমি যে একটা পাপী।

স্নিগ্ধঃতুমি কি বলছ মেহুল? আমায় প্লিজ বুঝিয়ে বলো।

মেহুলঃআমি আমার মা-বাবার আসল মেয়ে নই। আর এটা আমি অনেক আগেই জেনে গেছিলাম।

স্নিগ্ধঃতাহলে তুমি কার মেয়ে?

মেহুলঃআমার মামনীর মেয়ে। জানো আমার আসল মা চেয়েছিল আমায় বড়লোকের মতো করে রাখতে। আমার জন্মও হয়েছিল ধনী পরিবারে। কিন্তু আমার বাবা একজন দুশ্চ’রিত্র মানুষ ছিলেন। আমার মাকে গর্ভবতী অবস্থায় তিনি ছেড়ে দেন। তখন আমার মাকে আশ্রয় দেন আমার মম আর ড্যাডি। মমও(মেহেজাবিন) তখন প্রেগন্যান্ট ছিল। একই দিনে আমাদের জন্ম হয়। আমার মা আমাকে আর মোহনাকে অদল বদল করান। তাকে এই কাজে একজন নার্স সাহায্য করেছিল যে আমার মায়ের বান্ধবী ছিল। মনির চৌধুরী আর মেহেজাবিন চৌধুরীর আসল মেয়ে আমি নই মোহনা। এটা এক বছর আগে আমি আর মোহনা দুজনেই জেনে যাই। সেই নার্স মৃত্যুর আগে নিজে আমাদের ডেকে সবকিছু বলেন। কিন্তু আমি এসব স্বীকার করিনি। আমার যে ভয় ছিল মোহনা হয়তো আমার থেকে সব কেড়ে নেবে তাই আমি মোহনাকে বলি সে কাউকে কিছু যেন বলে। যদি বলে তাহলে আমি ওর সাথে অনেক খারাপ কিছু করব।
মোহনা ভয় পেয়ে সব কথা মেনে নেয়। আমি যখন যা বলি ও তাই করে। সেদিন স্টেজেও আমি ওকে ইচ্ছা করে ধাক্কা মে’রে ফেলে দেই, পরীক্ষার হলে আমার ডেস্কের নিচে কাগজ রাখতেও আমি বলি আর বুদ্ধি করে ওকে ঠিক সেই সময়েই কাজটা করতে বলি যেন কেউ দেখে। আর মুগ্ধই দেখে ফেলে । এর কারণ আমি চেয়েছিলাম সবাই আমাকে ভালো ভাবুক। আর সেদিন ফার্ম হাউজেও আমি মোহনার গলা টি’পে ওকে মে’রে ফেলার চেষ্টা করি। মোহনা নিজেকে বাঁচানোর জন্য আমায় ধাক্কা দিয়ে চলে যায়। আর তারপর কি হয় সব তো তুমি জানো। আমাকে বাঁচানোর জন্য,,,,,

মেহুলের সব কথা শুনে স্নিগ্ধ নির্বাক হয়ে যায়। নিজের কানকেই যেন তার বিশ্বাস হচ্ছিল না। কিন্তু এতকিছুর পরেই তার রাগ হচ্ছিল না মেহুলের উপর। কারণ সে যে খুব ভালোবাসে মেহুলকে। আর এই ভালোবাসা যে বুকভরা ভালোবাসা।

মেহুলঃআমি জানি তুমি আমায় অনেক ভালোবাসো। কিন্তু আমি তোমার ভালোবাসার যোগ্য নই। আমাকে ক্ষমা করে দিও। আমি চলে যাচ্ছি অনেক দূরে।

স্নিগ্ধঃতুমি প্লিজ আমাকে ছেড়ে যেওনা। তোমায় ছাড়া আমি বাচব না মেহুল। জানি তুমি অনেক ভুল করেছ কিন্তু এতকিছুর পরেও যে আমি শুধু তোমাকেই ভালোবাসি।

ওপাশ থেকে মেহুলের কোন উত্তর আসেনা। স্নিগ্ধ মেহুলের ফোনে কল করেও কোন উত্তর পায়না।

মেহুল আজ অনুশোচনার আ’গুনে দগ্ধ হচ্ছে। মুগ্ধর মৃত্যু তাকে নাড়িয়ে দিয়েছে। মেহুল সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে সব ছেড়ে চলে যাবে।

২৫.
মেহেজাবিন মোহনাকে জড়িয়ে ধরে কাদতে থাকেন। মেহুলের মা তাকে সব সত্য বলে দিয়েছে। মনির চৌধুরী নিজেও সব শুনেছেন। মেহুলের মা তাদের সবার কাছে ক্ষমা চায়। তারপর কাদতে কাদতে বেরিয়ে যান।

মেহুল হাসপাতাল থেকে বের হয়ে যায়। রাস্তা দিয়ে হেটে যেতে থাকে সে। কোথায় যাবে কোথায় থাকবে সে জানে না। সে শুধু জানে তাকে দূরে কোথাও যেতে হবে। মোহনার সাথে অনেক অন্যায় করেছে মেহুল। যার কোন ক্ষমা হয়না। মুগ্ধর মৃত্যুটাও তার জন্য অনেক বড় একটা শাস্তি। এসব কিছুতে মেহুল পুরোপুরি ভেঙে পড়েছে।

রাস্তায় বেখেয়ালি ভাবে চলছিল মেহুল। আচমকা এক বিকট শব্দে কেপে ওঠে মেহুল। কোন কিছু বুঝে ওঠার আগেই একটি বিশাল ট্রাক এসে মেহুলকে ধাক্কা দেয়। মেহুল দূরে গিয়ে ছিটকে পড়ে। যন্ত্রণায় মেহুলের পুরো শরীর অবশ হয়ে যাচ্ছিল। মেহুল বুঝতে পারছিল তার হাতে আর বেশি সময় নেই। নিজের মৃত্যুর ক্ষণেও সে ভাবতে থাকে স্নিগ্ধর কথা।

একটা মানুষ যতই অন্যায় করুক তার ভালোবাসায় কোন খাদ থাকেনা। স্নিগ্ধর প্রতি মেহুলের ভালোবাসাও ছিল অপরিসীম। এই ভালোবাসার নাম বুকভরা ভালোবাসা। মৃত্যুর আগে মেহুলের খুব ইচ্ছা করছিল শেষবারের মতো মুগ্ধকে একবার যেন দেখতে পায়।

মেহুলের শেষ ইচ্ছাটাও পূরণ হয়না। এটাই হয়তো তার পাপের শাস্তি। নিজের ইচ্ছা অপূর্ণ রেখেই মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করে মেহুল।

এক মুহুর্তেই তার জীবনের আলো নিভে যায়।

স্নিগ্ধ দ্রুত গাড়ি চালিয়ে মেহুলের সাথে দেখা করার জন্য হাসপাতালের দিকে যাচ্ছিল। মেহুলের বলা শেষ কথাগুলো যে তাকে খুব ভাবাচ্ছিল। মেহুল কি সত্যিই তাকে ছেড়ে চলে যাবে? এটা স্নিগ্ধ কিভাবে মানবে? মেহুলকে তো স্নিগ্ধ খুবই ভালোবাসে।

হাসপাতালে পৌছে স্নিগ্ধ জানতে পারে মেহুল হাসপাতাল থেকে চলে গেছে। স্নিগ্ধর মনের ভয় আরো বেড়ে যায়। মেহুলকে খোঁজার জন্য দ্রুতবেগে গাড়ি চালিয়ে দিক বেদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে ছুটতে থাকে স্নিগ্ধ। অসাবধানতাবশত একটি বাসের সাথে ধাক্কা খায় স্নিগ্ধ। মুহুর্তেই তার চোখে আধার নেমে আসে। স্নিগ্ধর মুখ নিঃসৃত শেষ বাক্যটি ছিল,
‘মেহুল আমাকে ছেড়ে যেওনা। আমি ভালোবাসি তোমায়। তোমার জন্য আমার ভালোবাসা যে বুকভরা ভালোবাসা।’

স্নিগ্ধর জীবনও থমকে যায়। মেহুল মৃত্যুর আগে যেমন স্নিগ্ধকে দেখতে চেয়েছিল একইভাবে স্নিগ্ধও চেয়েছিল মেহুলকে দেখতে। কিন্তু ভাগ্য যে বড়ই নিষ্ঠুর। তাদের শেষবারের মতো দেখাটুকুও করতে দিলনা। স্নিগ্ধ আর মেহুলের মৃত্যু হলো বুকভরা ভালোবাসা নিয়ে। সাথে রয়ে গেল অপূর্ণতা। আর এই অপূর্ণতার মাধ্যমেই শেষ হয়ে গেল এক অকৃত্রিম বুকভরা ভালোবাসা।
The End
>>

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here