বৃষ্টিপ্রিয়া পর্ব ১

#বৃষ্টিপ্রিয়া
পর্ব- ০১।
লেখা- জাহান লিমু।

আষাঢ় মাস। পুরো দেশ যেন বৃষ্টির কব্জায় বন্দি। কিছুক্ষণের জন্য ইচ্ছে হলে ছাড়ে,আবার আকস্মাৎ দৈত্যের ন্যায় খপ করে মানুষগুলোকে ধরে ফেলে। প্রকৃতির কাছে মানুষ কতটা অসহায়। আর তারচেয়ে বেশি ভোগান্তি তাদের,যারা বাইরে বের হলে ছাতা নিতে মনে থাকে না। বৃষ্টি কোনকালেই পছন্দ ছিলো না আমার। আবেগী মানুষদের বৃষ্টি পছন্দ। আমার মধ্যে কোনকালেই আবেগের ছিটেফোঁটাও ছিলো না। আর সেই আমিই একসময় আবেগে ভেসে গিয়েছিলাম,কোন এক আবেগীর মায়ায়। তখন ইন্টার ভর্তি হয়েছিলাম মাত্র। নতুন নতুন কলেজ,বন্ধু-বান্ধব। সবমিলিয়ে ভালোই যাচ্ছিল সময়টা।
তারমধ্যে একদিন সোহাগের বাসায় গিয়েছিলাম। অল্প কয়দিনেই সোহাগের সাথে সম্পর্কটা অন্যদের চেয়ে বেশিই গাঢ় হয়ে গিয়েছিল। কলেজ থেকে একদিন ওদের বাসায় গিয়েছিলাম। অবশ্য যেতে হয়েছিলো। কলেজ ছুটির সাথে সাথেই আচমকা বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল। আর আমি বরাবরের মতই ছাতা নেয় নি। ছাতা বহন করা আমার কাছে, ছোট বাচ্চা হাতি ক্যারি করার চেয়ে কোন অংশে কম না। আমি ছোট থেকেই স্কুল থেকে ভিজে আসবো,তাও ছাতা নিবো না। বই প্লাস্টিকের পলিথিনে মুড়িয়ে, নিজে আরামসে ভিজে আসতাম। অথচ বৃষ্টি আমার কখনোই পছন্দ ছিলো না।
খেলাধুলা করতে পারতাম না,সারাদিন ঘরে বসে থাকতে হতো। ফুটবল খেলার প্রতি আমার ভীষণ ঝোঁক ছিলো। আমার বাবাও নাকি বেশ ভালো ফুটবল খেলতেন একসময়। এতই ঝোঁক ছিলো খেলার প্রতি যে পড়াশোনাটা ঠিকঠাক হলো না। অবশ্য খেলাতে তিনি সফল হয়েছিলেন বটে। তবে সেটা রোদ্দুরের বৃষ্টির মত,ক্ষণিকের জন্য। জাতীয় দলে সুযোগ পাওয়ার পরপরই হঠাৎ এক্সিডেন্ট করে পা ভেঙে যায়। তার কিছুদিন আগেই বিয়ে করেছেন মাত্র। ফুটবল খেলার স্বপ্ন তার সেদিনের পরই শেষ হয়ে যায়। যদিও পা পড়ে ঠিক হয়েছিলো,কিন্তু খেলার মত অবস্থা আর ছিলো না। কোন চাকুরিও আর করেননি,তাই ব্যবসাতেই মনোযোগ দিলেন অবশেষে। বাবার ফুটবল খেলাটা মায়ের কখনোই পছন্দ ছিলো না। আর এক্সিডেন্টের পর তো ফুটবল খেলার মানও কেউ বাসায় উচ্চারণ করতে পারেনা। তখন থেকে মা কেমন জানি অন্যরকম হয়ে গেছে। কেমন রুক্ষ, কঠিন স্বভাবের। বাবা সেটা বলেন সবসময়। তোর মায়ের এমন রূপ,হয়তো আমার জন্যই। একাহাতে সংসার সামলেছে। সবাই কত কথা শুনিয়েছে। দাঁত কামড়ে সেসব হজম করেছে তোর মা। আমার মত চালচুলোহীন ছেলেকে বিয়ে যে করেছিল। এক আকাশ আক্ষেপ নিয়ে বাবা কথাগুলো বলে।
আমি মাঝে মাঝে ভাবি,যদি দুটো মানুষ ভালো থাকে তাদের অবস্থানে,তাহলে অন্যদের এতো জ্বলে কেন?
কিসের দায় তাদের,যে তাদের সুখ সহ্য হয় না?
নিজ নিজ সংসার,নিজ নিজ জীবন। সেখানে অন্যের বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করলেই কি নয়?

বৃষ্টিতে অন্যরা ফুটবল খেললেও,আমার খেলা বারণ ছিলো। আর মায়ের কথা অমান্য করার মত সাহস আমার কোনদিনই ছিলো না। আমার মা ছিলেন ভীষণ কড়া। পড়াশোনার বাইরে আর কোনকিছুতেই তার আগ্রহ ছিলো না। তিনি নিজেও প্রাইমারী স্কুলের শিক্ষক। আর বাবা ব্যবসা করতেন। বড় মার্কেটের পাশেই স্টেশনারীর দোকান ছিলো। সেটা অবশ্য বিয়ের পর। আগে ফুটবলই ছিলো তার নেশা। লাভ ম্যারিজ ছিলো উনাদের। নানা বেকার ছেলের কাছে বিয়ে দিবেন না,আম্মা আব্বাকেই বিয়ে করবেন। আম্মা প্রচন্ড জেদীও ছিলেন। একমাত্র মেয়ে কিনা। এখনো আছেন অবশ্য। তখনো আম্মার চাকুরি হয় নি। এসব ঝামেলা চলাকালীন হুঁট করে আম্মার চাকরিটা হয়ে যায়। আর কি যেন ভেবে নানার মনও গলে যায়।
সে কারনেই আম্মা আমাদের পড়াশোনা নিয়ে এতো সিরিয়াস। আমাকে তো প্রায় প্রায়ই বলতেন,নিজের যোগ্যতা অর্জন করাটা যে কত জরুরি এখন বুঝবিনা। যখন বুঝবি, তখন হাত কামড়াবি। মায়ের কথাটার মানে তখন আসলেই বুঝতাম না। তবে পরে ঠিকই বুঝেছিলাম। আর বেশ ভালোভাবেই সেটার গুরুত্ব টের পেয়েছিলাম। জীবনে প্রতিষ্ঠিত হওয়া যে কতটা জরুরি। অনেক কঠিন বিষয়,সহজলভ্য হয়ে যায় যদি নিজের যোগ্যতা থাকে। আমরা মানি আর না মানি,তাতে কিছুই যায় আসেনা। কিন্তু জীবনে প্রতিষ্ঠিত হওয়াই চাই। সেটা চাকুরি,ব্যবসা যেভাবেই হোক। তবে আমরা এখনো চাকুরিটাকেই প্রাধান্য দেয়,কন্যা সম্প্রদানের ক্ষেত্রে। আর সেই যুদ্ধে আমাকেও অবতীর্ণ হতে হয়েছিল। কারন একটা যোগ্যতা অর্জন হলে,অন্তত একটু সুযোগ তৈরি হয়। আমার ভাগ্য হয়তো অনেক বেশিই ভালো ছিলো।
আর নয়তো মানুষ কথা দিয়েও রাখেনা,রাখতে পারেনা। আর সেখানে আমার ক্ষেত্রে মিরাক্যালই ঘটেছিল বলা যায়।
সেই বৃষ্টিপ্রিয়া আমার জন্য ভালোবাসার বৃষ্টির পসরা সাজিয়ে নীরবে গোপনে অপেক্ষার প্রহর গুণেছিল। যা আমারও অজানা ছিলো। আমি ভেবেছি আমি তাকে অগোচরে ভালোবেসে ভয়,উৎকন্ঠা নিয়ে অপেক্ষা করেছি। আর সে আমাকেও কিছু বুঝতে না দিয়ে, মনের গহীনে তীল তীল করে ভালোবাসার কুঞ্জ সাজিয়েছিল। আমার বৃষ্টিপ্রিয়া। এটা আমার আর আমার বৃষ্টিপ্রিয়ার বৃষ্টিস্নাত প্রণয়ের গল্প।

সেদিন ঝুম বৃষ্টি শুরু হলো কলেজ ছুটির পরপরই। সোহাগদের বাসা ছিল কলেজ থেকে মাত্র পাঁচমিনিটের পথ। ওদের বাড়িতে সেদিনই প্রথম গিয়েছিলাম। শহরের কাছে হলেও,ওদের বাড়িটা ছিল বিশাল। অবশ্য কলেজটা মূল শহরের কেন্দ্রে নয়,একপাশে। ওদের বাড়ির ভেতর ঢুকে আবার চক্ষু চড়কগাছ অবস্থা। মনে হচ্ছিল গ্রামের কোন বাড়ি। সামনে প্রকান্ড উঠানের মত ফাঁকা জায়গা। পুরো বাড়ি যদিও বাউন্ডারি করা। এর ভেতরে চতুর্দিকে বিভিন্ন রকমের ছোটবড় গাছ। ফুলের বাগান,সবজির বাগান। বিভিন্ন রকমের নাম না জানা ঔষধি গাছ। পুরো বাড়িটা ছবির মতো মনে হচ্ছিল। বাড়ির কোন একজন মানুষ যে বেশ যত্ন করে এগুলো গড়ে তুলেছে,সে বিষয়ে কোন সন্দেহের অবকাশ রইলো না।
ঘরটা বিশাল বড়,অথচ একতলা। এবং তারচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় ঘরের ছাদ টিনের। চারদিকের সবুজের মধ্যে, ঘরের সবুজ টিন মিশে একাকার হয়ে গেছে যেন। বাড়িটাতে ঢুকলে যে কারো মনটাই ভালো হয়ে যাবে। অন্তত যারা প্রকৃতির সান্নিধ্যে থাকতে ভালোবাসে। প্রকৃতির সাথে, সবুজের সাথে যাদের মনের টান রয়েছে।

একটা ছাতা দিয়ে আমরা দুজন আসার কারনে,দুজনেরই একপাশ ভিজে গেল। যখন বাসার ভেতর ঢুকতে যাবো,আমার দৃষ্টি আঁটকে গেল একটুকরো বৃষ্টিস্নাত লাল গোলাপের মাঝে।
সহসাই আমি থমকে দাঁড়ালাম।
গাছের নয়,সে ছিলো মানবী গোলাপ। বৃষ্টির জল তার শরীরে খেলা করছিলো,আর সে বৃষ্টির জলের সনে। বৃষ্টির ফোঁটা তার কোমল বদনে অগ্নিস্ফুলিঙ্গের ন্যায় ছিটে পড়ছিলো যেন। কি অদ্ভুত এক দৃশ্য! মেয়েদের সাথে বৃষ্টির কি কোন কানেকশান আছে?
হয়তো আছে।
ফুলের গায়ে বৃষ্টির ফোঁটা পড়ে যেমন প্রাণবন্ত,সজীব,মোহনীয় হয়ে উঠে। মেয়েদের বৃষ্টিস্নাত রূপ ঠিক অনেকটা সেরকম। আমার চোখ সেদিন না চাইতেও ঐ বৃষ্টিপ্রিয়াতে নিবদ্ধ হয়ে গিয়েছিলো। আমি থেমে গিয়েছিলাম সেই মানবী গোলাপের মুখশ্রীতে বৃষ্টির জলখেলি দেখে। মুখের উপর তার একগাছি অবাধ্য কেশ এলোমেলো হয়ে পড়েছিলো। সেই কেশ বেয়েও জল গড়িয়ে পড়ছিলো। সে চোখ বন্ধ করে রেখেছিলো,তাই হয়তো আমার উপস্থিতি টের পাইনি। আর আমি তখন অন্য জগতে বিচরণ করছি। বয়স কম,মনের ভেতর অবাধ্য আবেগেরা এলোমেলো ছুটোছুটি করতে লাগলো। আমি নিজের খেঁই হারিয়ে ফেলেছিলাম। আমি যে দাঁড়িয়ে বৃষ্টিতে ভিজছিলাম,সেদিকে আমার কোন হুঁশ নেই। সংবিত ফিরে পেলাম সোহাগের ডাকে। সে আমাকে রেখে ঘরে চলে গেছে,আর আমি ঠাঁয় দাঁড়িয়ে বৃষ্টিতে ভিজছিলাম। সোহাগের ডাকে বোধহয় মেয়েটাও চমকে তাকিয়েছিল আমার দিকে। গায়ের ওড়নাটা টেনে মাথা ঢেকে নিঃশব্দে চলে গেল সে। আর আমার মনটা ভাসিয়ে নিয়ে গেল সেই ঘোমটার আড়ালের বৃষ্টিস্নাত বদনের মাঝে। আর একটা অদ্ভুত বিষয় খেয়াল করেছিলাম অবশ্য। মেয়েটার সাথে সোহাগের চেহারা প্রায় হুবুহু মিল।
আমি বরাবরই চুপচাপ,শান্ত স্বভাবের ছিলাম। কিছুটা লাজুকও বলা যায়। খুব বেশি মানুষের সাথে মিশতাম না। যেটা আমার জন্য অনেক বড় বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল পরবর্তীতে। নিজের সাথে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিলাম। সে যুদ্ধে আমি জিতেছি,নাকি হেরেছি তা আমার জানা নেই। তবে আমি ভালোবেসেছি,এতটুকু জানি অন্তত।

#চলবে…
#জাহান_লিমু।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here