বৃষ্টিপ্রিয়া পর্ব ৮

#বৃষ্টিপ্রিয়া
পর্ব- ০৮।
লেখা- জাহান লিমু।

আমাদের বিয়ে পড়াতে পড়াতে রাত হয়ে গিয়েছিলো। বউ নিয়ে ফিরে আসবো। কিন্তু তখনি তুমুল বৃষ্টি শুরু হলো। ঘন্টাখানিকের বৃষ্টিতে পুরো শহর ভেসে যাওয়ার অবস্থা। আমি মনে মনে ভাবতে লাগলাম,বৃষ্টিপ্রিয়ার বিয়েতে তার সখী আসবেনা, তা কি করে হয়?
হ্যাঁ,বৃষ্টিকে বৃষ্টিপ্রিয়ার সখীই বলি আমি। বৃষ্টির সাথে তার গভীর সম্পর্ক। এতোটাই গভীর যে, মাঝে মাঝে বৃষ্টিকেই আমার হিংসা হতো।
সেদিন বৃষ্টি থামতে থামতে অনেক রাত হয়ে গিয়েছিলো। তাই সেদিন আর বউ নিয়ে যাওয়া হয়নি। সবাই থেকে গিয়েছিলাম।
কিন্তু সেদিন প্রীতির চূড়ান্ত পাগলামী দেখেছিলাম আমি।
পাগলামী বলছি কারণ প্রীতি ঐ ভারী বৃষ্টির মাঝে বিয়ের পোশাকে ওয়েডিং ফটোশুট করেছিলো। আর ফটোগ্রাফার ছিলো আমার বোন। মায়ার ছবি তোলার হাত ভীষণ ভালো। বিয়ের অন্যন্যা ছবিও সেই তুলেছে। রাতে সে শুয়ে পড়েছিলো। তখন আমি ওকে ডেকে নিয়ে আসি। মায়া এতোরাতে আমাকে দেখে চোখ ছানাবড়া করে তাকিয়েছিলো। যখন আমি ওকে সব খুলে বললাম,তখন ঠিকই সেও চোখ চকচক করে তাকিয়েছিলো। তার রিএকশানটা ছিলো এমন যে,বৃষ্টির মধ্যে ওয়েডিং ফটোগ্রাফি! বিষয়টা ভেবেই মায়া যে রোমাঞ্চ অনুভব করেছিলো, সেটা আমি নিশ্চিত। এরকম ফটোগ্রাফি আর কোনো ফটোগ্রাফার হয়তো করেনি। তাই ভিন্নরকম কিছু এক্সপেরিয়েন্স করতে মায়া হুড়মুড়িয়ে উঠে এসেছিলো। এ কয়বছরে মায়া আর প্রীতির বন্ডিং বেশ জমে উঠেছিলো। যদিও মায়া দেশে ছিলো না। তবুও তাদের দেখে কেউ বলবেনা, ননদ ভাবী। মনে হবে বেস্ট ফ্রেন্ড। প্রীতি মাঝে মাঝে মায়ার সাথে কথা বলার জন্য, আমার কল পর্যন্ত কেটে দিতো। অনেকসময় ওয়েটিং এ পেতাম প্রীতিকে। তখন মায়াকে কল দিলে দেখতাম,সেও বিজি। তখন আমার যা বুঝার, বুঝে যেতাম। মনে হতো ওরাই প্রেম করছে,আমি থার্ড পারসন!
সেবার দুই পাগলের মধ্যেখানে আমি ফেঁসে গেলাম। একজন ছবি তুলতে ভালোবাসে,আরেকজন তুলাতে।
বৃষ্টির মধ্যে ভিজে ওয়েডিং ফটোশুট!
এটাই বোধহয় বাকী ছিলো।
বিয়ের শাড়ি মেয়েরা কত যত্নে তুলে রাখে। আর আমারজন বিয়ের দিনই শাড়ির বারোটা বাজিয়ে দিয়েছে। তবুও বৃষ্টিতে ভিজে ওয়েডিং ফটোশুট করতে হবে।
আজকালের মেয়েরা যদিও কখনোই বৃষ্টিতে ভিজে অন্তত ফটোশুট করতে চাইবেনা। তাহলে যে কিছুক্ষণ পর পর তাদের চেহারা চেঞ্জ হবে। কিছুটা ফেয়ার এন্ড লাভলীর বিজ্ঞাপনের উল্টো। মানে সেখানে দেখানো হয় কি করে ধাপে ধাপে ফর্সা হয়। আর বৃষ্টিতে ফটোশুট করলে ছবিগুলো এমন আসবে যে কিভাবে ধাপে ধাপে ফর্সা থেকে রং মলিন হয়।
অবশ্য প্রীতির সেসবে মাথা ব্যাথা নেই কোন। কারন সে নিজের মত করে ঘরেই সেজেছে। মুখে মেকআপের আস্তরণ ফেলে দেয় নি। সে যেমন,তেমনি। নিজেকে ফর্সা প্রমাণ করার কোন চেষ্টা সে করেনি। আর আমি তাকে তেমনই ভালোবাসি।

মায়া যখন প্রীতির সিংগেল ছবি তুলে দিয়েছিলো,তখন আমি ওর উপরে ছাতা ধরে রেখে দাঁড়িয়েছিলাম। কারণ প্রীতি বাগানের বিভিন্ন জায়গায় দাঁড়িয়ে ছবি তুলছিলো। আর আমাদের ডাবল ছবিগুলো কিছু বারান্দার ফাঁক দিয়ে, আর কিছু বাগানের ছাতাটার ভেতর বসে মায়া তুলে দিয়েছিলো।
আমি শুধু হতভম্বের মত বৃষ্টিপ্রিয়ার পাগলামী দেখছিলাম সেদিন। সেই প্রথমদিনের মতই এখনো সে বৃষ্টিতে আসক্ত। আমাতেও বোধহয় এতোটা আসক্ত নয়!
আমার পছন্দ অনুয়ায়ী অবশ্য একটা ছবি তোলা হয়েছিলো। সে দু’হাত মেলে চোখ বন্ধ করে আকাশের দিকে তাকিয়ে ভিজছে। আর আমি তার সামনে দাঁড়িয়ে তাকে দেখছি অপলক। কিছুটা আমাদের প্রথমদিনের দেখা হওয়াটার মতন। কিছু কিছু বিষয় স্মরনীয় করে রাখা ভালো। কখনো মন খারাপ হলে, তা দেখে বা মনে করে অজান্তেই হাসি ফুটে উঠে।

সেরাতে বৃষ্টিতে ভিজে সকালেই আমার জ্বর এসে গিয়েছিলো। প্রীতির কিছুই হয়নি। আমি বৃষ্টিতে ভিজে অভ্যস্ত নয়, তাই হয়তো। যারা সবসময় বৃষ্টিতে ভিজে,তাদের সহজে জ্বর হয় না। হঠাৎ করে কেউ ভিজলেই জ্বর আসার সম্ভাবনা প্রবল।
আমাদের এই কান্ড অবশ্য কেউ টের পায়নি। কারণ কাপড় ফ্যানের নিচে রেখে শুকিয়ে ফেলেছিলাম। অবশ্য পরবর্তীতে ওয়েডিং এলবামের ছবি দেখে সবাই চোখ বড় বড় করে তাকিয়েছিলো। তখন আর বকলেই কি লাভ।
তবে ঐ ছবিগুলো আমার ভীষণ পছন্দ হয়েছিলো। যদিও তখন আমার বিষয়টা পাগলামী মনে হয়েছিলো পুরো। মাঝে মাঝে একটু আধটু পাগলামী থাকতে হয় জীবনে। কারণ সেগুলোই জীবনের বিশেষ মুহুর্ত হয়ে উঠে। সেগুলো নিয়ে ভাবতেও ভালো লাগে। অজান্তেই ঠোঁট দুটো প্রসারিত হয়ে যায়।
আমার বিয়ে করা নিয়ে আরেকটা সমস্যা দেখা দিয়েছিলো অবশ্য। তবে আমরা সেসবে পাত্তা দেয় নি। কিছু কিছু বিষয় একদম পাত্তা দিতে নেই। মায়া আর আমি জমজ হওয়ার দরুণ সমস্যাটা হয়েছিলো। কারণ আমরা দুজন একই বয়সের হওয়া স্বত্তেও, বোনকে বিয়ে না দিয়ে আমি বিয়ে করে ফেলেছিলাম। যেটা আমাদের সমাজের মানুষের আঙুল তোলার জন্য যথেষ্ট।
আমাদের ধারণা ঘরে বিবাহ উপযুক্ত বোন রেখে কোন ভাইয়ের বিয়ে করা উচিত নয়। হ্যাঁ,মানছি ধর্মে মেয়েদের উপযুক্ত বয়সে বিয়ে দেয়ার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু একইসাথে তো ছেলেদেরও সময়মত বিয়ের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু আমরা শুধু মেয়েদেরটাই গুরুত্ব দেয়। পাপাচার থেকে বাঁচার জন্য,উভয়েরই উপযুক্ত সময়ে বিয়ে করা উচিত। আর মায়ার বিয়ে ঠিক হয়ে আছে। এতোদিন পড়াশোনা শেষ হয়নি,তাই হয়নি। কিন্তু মানুষের মুখ তো আর ধরে রাখা সম্ভব না। তারা তাদের মত আমার নামে আজেবাজে কথা বলতে লাগলো। তবে প্রকাশ্যে বলার সাহস দেখায়নি কেউ।
আর পেছন থেকে কথা বলা মানুষদের কখনো গুণায় ধরতে নেই। তাহলে সামনে এগুনো যায় না।
মায়া নিজেও অবশ্য বেশ মজা পেয়েছিলো বিষয়টা শুনতে পেয়ে। মায়ার যার সাথে বিয়ে ঠিক হয়ে আছে, তিনি একজন স্থপতি। এরেঞ্জ মেরিজই হচ্ছে ওদের। এবং সেটা সম্পূর্ণ মায়ার মতামত নিয়ে।

আমার বিয়ের পর পর ছুটি শেষ হওয়ার কয়েক মাস পর প্রীতিকে আমার সাথে নিয়ে আসি। মা,বাবাই প্রীতিকে আমার কাছে পাঠিয়ে দিয়েছে। আর আমিও ততদিনে অফিস থেকে কোয়ার্টার পেয়ে গেছি। আমার পোস্টিং তখন চট্টগ্রাম। প্রীতিকে নিয়ে আমাদের ছোট্ট সংসার সাজিয়েছিলাম। প্রীতির তখনো মাস্টার্স শেষ হয়নি। বেশ কাঁটছিলো দিনগুলি। মনে হতো জীবন আসলেই সুন্দর। আমরা যতটা ভাবি,তার চেয়েও জীবন সুন্দর। শুধু সঠিক সময়ে,সঠিক কাজটা করতে পারলে। আমি যদি নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার চিন্তা না করে ছ্যাচড়া পোলাপানের মত প্রীতির পিছনে পড়ে থাকতাম,তাহলে হয়তো কিছুই পেতাম না। প্রীতিও হয়তো আমাকে বখাটে ভাবতো।
তাই আজকে আমি যা যা পেয়েছি,তা হয়তো আমার ঐ ত্যাগটুকুর জন্য। বড় ভার্সিটিতে পড়ার স্বপ্ন আমারও ছিলো। কিন্তু কখনো কখনো কিছু পাওয়ার স্বার্থে, জীবনে কিছু ত্যাগ করতেই হয়। আর এটাই জীবনের ধর্ম। তুমি কিছু ছাড়লেই,কিছু পাবে। হয়তো ত্যাগে প্রাপ্তির খাতা কিছুটা শূণ্য হয়,তাই সেটা পূর্ণ করতে অন্যটা ফিরে আসে। আর আমার ঐটুকু ত্যাগে,আমি আমার বৃষ্টিপ্রিয়াকে পেয়েছিলাম। যাকে আমি ভালোবেসেছিলাম। এখনও বাসি,আজীবন বাসবো।

#চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here