বৃষ্টিপ্রিয়া শেষ পর্ব

#বৃষ্টিপ্রিয়া
পর্ব- ০৯ ( শেষ পর্ব)।
লেখা- জাহান লিমু।

সেদিন ডিউটি শেষে বাসায় ফিরছিলাম। দূরে একটা কাজে যেতে হয়েছিলো। পথিমধ্যে বৃষ্টি শুরু হলো। অফিসের গাড়ি করেই আসছিলাম,তাই ভেজার কোন সুযোগ নেই। কারণ গাড়ি বাসার সামনে এসেই থামবে। বাসায় এসে কলিংবেল বাজিয়ে যাচ্ছি, কিন্তু খোলার নামগন্ধ নেই। প্রীতিকে ফোন দিচ্ছি, কিন্তু ফোন উঠাচ্ছে না। ভীষণ চিন্তা হতে লাগলো। প্রীতি অসুস্থ হয়ে পড়েনি তো আবার?
নাকি ঘুমিয়ে পড়েছে?
হঠাৎ খেয়াল করলাম যে দরজা বাইরে থেকে লক করা। এতোক্ষণ সেটা খেয়ালই করিনি।
প্রীতির টেনশনে আবার আমি এটাও ভুলে গিয়েছিলাম যে,আমার কাছে বাড়তি চাবি আছে। তাড়াহুড়ো করে সেই চাবি বের করে দরজা খুললাম।
এমন সময় প্রীতি কোথায় যাবে?
আজকে তো ভার্সিটিও নেই। সরকারী ছুটি। যদিও সেটা আমাদের জন্য প্রযোজ্য নয়। সরকারী ছুটিতে আমাদের আরো বেশি কাজ থাকে। ইউনিফর্ম না খুলে,শুধু বেল্টটা খুলতে খুলতে আমি আবার প্রীতিকে কল দিলাম। তখন দেখি প্রীতির ফোন বালিশের নিচে বাজছে।
মানেটা কি?
ফোন রেখে কোথায় গেছে?
আমাকে ছাড়া একা একা তো কোথাও যায় না। তাছাড়া কোথাও গেলে আমাকে অন্তত বলে তো যাবে?
আমার মাথা নষ্ট হয়ে যেতে লাগলো। বাইরে তখনো বৃষ্টি।
হঠাৎ করেই আমার মাথায় একটা ভাবনার উদয় হতেই, আমি সাথে সাথেই দৌঁড় দিলাম। এবং আমি যেটা ভাবলাম,সেটাই ঠিক। প্রচন্ড মেজাজ খারাপ হচ্ছিল প্রীতির প্রতি। এরকম কাজ কেউ করে?
ভয়ে আত্না শুকিয়ে যাচ্ছিল আমার। যদিও এটা সম্পূর্ণ নিরাপদ আবাসস্থল। তবুও ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম ভীষণ।

আমাদের কোয়ার্টারটা ছিলো পাঁচতলা, চারপাশে অনেক গাছগাছালি। দূরে পাহাড় দেখা যায়, ছাদে উঠে দাঁড়ালে।
আমরা তিনতলায় থাকতাম। অস্থিরতার সাথে দৌঁড়ে দৌঁড়ে সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠলাম। সামনে তাকিয়ে জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিতে লাগলাম। টেনশনে, আর দ্রুত দৌঁড়ানোর কারনে হাঁফিয়ে গিয়েছিলাম। কতক্ষণ চোখ বন্ধ করে নিচের দিকে তাকিয়ে রইলাম। তারপর সোজা হয়ে সামনে দাঁড়ালাম।
অথচ সামনের বৃষ্টিস্নাত রমণীর কোনদিকে কোন ভ্রক্ষেপ নেই।
মনে হচ্ছে সে মনের সুখে বৃষ্টির পানি হা করে গিলছে।
শাড়ি পরে বৃষ্টিতে ভিজছে আবার। শাড়ি ভিজে শরীরের সাথে লেপ্টে গেছে। খোলা চুল কাঁধ,মুখময় ছড়িয়ে আছে। আমি ধীর পায়ে তার দিকে এগুলাম। বৃষ্টির শব্দ এতো তীব্র ছিলো যে,সে আমার উপস্থিতি টের পাইনি। আমি চুপ করে তার পেছনে দাঁড়িয়ে রইলাম। সে নীরবে নিঃশব্দে ভিজে চলেছে।
আমার চেয়েও বৃষ্টি তার কাছে অধিকতর প্রিয়। এজন্যই আমার বৃষ্টিকে হিংসে হয়। বৃষ্টির জল কি অনায়াসে তার সারা শরীর জুরে খেলা করে। সেটা দেখে আমার হিংসে হয়। আমার বৃষ্টিপ্রিয়াকে আমি ছোঁব,বৃষ্টি নয়।
যখন আমি এসব ভাবনায় ডুবে ছিলাম,তখনি আমার বুকে কারো অস্তিত্ব অনুভব করলাম। শীতল সেই স্পর্শ। প্রীতি আমাকে দেখে, ভূত দেখার মত চমকে তাকালো। ঘোর লাগানো দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়েছিলো। হয়তো বিশ্বাস হচ্ছে না, আমি এখানে দাঁড়িয়ে এভাবে বৃষ্টিতে ভিজছি। বিয়ের পর আর কখনো বৃষ্টিতে ভেজা হয়নি। যেহেতু ঐদিন জ্বর উঠে গিয়েছিলো।
আমি স্বশরীরে এখানে আছি, তাকে সেটা বিশ্বাস করাতে আমি শক্ত করে জড়িয়ে ধরলাম। প্রীতি শিউড়ে উঠলো সাথে সাথে।এভাবে জড়িয়ে ধরে একসাথে বৃষ্টিতে ভিজলাম দুজন। কতক্ষণ তা জানিনা। তবে দুজনের কেউই কোন কথা বলিনি সেই সময়টুকু। শুধু অনুভব করছিলাম পুরো সময়টা। আমি প্রীতিকে বললাম রুমে চলো,ঠান্ডা লেগে যাবে।
সে অনুনয় করে বললো,” আরেকটু ভিজি না।”
আমি হুঁট করেই ওকে পাঁজাকোলে তুলে নিলাম,আর কোন কথা বলার সুযোগ না দিয়ে। সেও আমার চোখের দিকে তাকিয়ে আর কিছু বলতে পারলনা। বুকের সাথে মিশে গেল পুরো।
আমি প্রীতির কানের কাছে মুখ নিয়ে বললাম,
বৃষ্টির জলে তো একা ভিজেছো,এবার না হয় আমাকেও ভিজাও। আমিও ভিজতে চাই,ভালোবাসার বৃষ্টিতে। আর তোমাকে ভেজাতে। প্রীতি আমার শার্ট খামছে ধরলো। আমি সিঁড়ি বেয়ে নামতে লাগলাম। বিন্দু বিন্দু বৃষ্টির ফোটা প্রীতির সারা বদন জুরে চিকচিক করছে। আমি ফুঁ দিয়ে সেগুলো সরিয়ে দিতে চাইলাম। প্রীতি কেঁপে উঠলো। আমার বৃষ্টিপ্রিয়ার সারা শরীর বজ্জাত বৃষ্টি দখল করে রেখেছে। যেন বউটা তার।
মানুষ মানুষকে হিংসে করে,আর আমার বৃষ্টিকেই হিংসে হতো।
আমার বৃষ্টিপ্রিয়া আজকের পর থেকে আমার ভালোবাসার বৃষ্টিতেই ভিজবে কেবল। বৃষ্টিকে তার অঙ্গ স্পর্শ করতে দিবো না আর। আমি যে বৃষ্টিপ্রিয়াতে আসক্ত,ভীষণভাবে আসক্ত।

আমাদের বিয়ের তিনটা বছর কেটে গেলো চোখের পলকেই।
মনেই হয় না। আমাদের ঘরে নতুন অতিথি আসতে চলেছে। এবং সবকিছু ঠিক থাকলে প্রীতির স্বপ্নই পূরণ হতে চলেছে। জুনিয়র রূপক আসছে আল্লাহর রহমতে। প্রীতি এখন আমার মা বাবার কাছেই আছে। আমিই পাঠিয়ে দিয়েছি। সে যেতে চায়নি, আমাকে একা রেখে। আমিই বুঝিয়ে শুনিয়ে পাঠিয়েছি। কারণ এখানে থাকলে আমি ওকে ঠিকঠাক সময় দিতে পারছিনা। আর ওর যত্নও নিতে পারছিনা। তবুও প্রীতি পাঁচ মাস পর্যন্ত এখানেই ছিলো। কিন্তু এরপর সে কোন কাজ করতে পারতনা আর। তাই আমি জোর করে পাঠিয়েছিলাম। যাওয়ার সময় প্রীতি ভীষণ কান্না করছিলো। কেমন করুনভাবে যেন তাকিয়েছিলো। আমি প্রীতিকে ভীষণভাবে আদর করে দিয়েছিলাম। আমার কিছু করার ছিলো না। সরকারের কর্মচারী আমরা,দেশের কাজে সদা নিয়োজিত।
আর প্রীতিকে বলেছিলাম ডেলিভারীর একমাস আগেই আমি আসবো। তবে আমি আমার কথা রাখতে পারিনি। কারণ ছুটি পাইনি। পরে অবশ্য পেয়েছিলাম। আর প্রীতির ডেটের একমাস আগেই ডেলিভারী পেইন শুরু হয়ে গিয়েছিলো। তাই তখন চাইলেও,আমার ছুটি পাওয়া সম্ভব হচ্ছিল না।
ভীষণ মন খারাপ হয়েছিলো আমার,তবে কাউকে সেটা বুঝতে দেয়নি। ছেলেদের মন খারাপ প্রকাশ করতে নেই।
আমি সোহাগের ফোন পেয়ে, ওর উপর সব দায়িত্ব দিয়ে ডিউটিতে চলে গিয়েছিলাম। কাজের সময় ফোন সাইলেন্ট রেখেছিলাম।
কিন্তু যেদিন প্রীতির ব্যাথা শুরু হয়,সেদিন সকাল থেকেই নাকি গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি হচ্ছিলো। যেটা বেলা বাড়ার সাথে সাথে তীব্র হয়। এমন ভারী বর্ষণ গত কয়েক বছরে হয়নি। টানা কয়েক ঘন্টার বৃষ্টিতে শহরের প্রধান রাস্তাই ডুবে গিয়েছিলো। সেই অবস্থায় প্রীতিকে নিয়ে হাসপাতালে যাওয়াটা অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছিলো। এদিকে প্রীতির শারীরিক অবস্থা ক্রমশ খারাপ হচ্ছিলো। আর আমি সেসবের কিছুই জানতাম না। পরে সব জেনেছিলাম। শুনে আমার গা কেঁপে উঠেছিলো।
বহু কষ্টে হাসপাতালে নেয়ার পর রোগীর অবস্থা আশংকাজনক বলে চিহ্নিত করে ডাক্তাররা। রক্তের প্রয়োজন। ঐ অবস্থায় রক্তের সন্ধ্যান করা ছিলো দুর্বিষহ। প্রীতির রক্তের গ্রুপ ছিলো এ নেগেটিভ। যেটা খুবই বিরল।
ভাগ্যিস, ভাইবোনের রক্তের গ্রুপ এক ছিলো। সোহাগ না থাকলে আমি হয়তো আমার বৃষ্টিপ্রিয়া আর পুলককে পেতাম না। যদিও বাঁচা মরা সব উপরওয়ালার হাতে। আমরা তো উপলক্ষ্য মাত্র। হ্যাঁ,আমাদের ছেলে হয়েছে। পুলক, আমার আর আমার বৃষ্টিপ্রিয়ার ভালোবাসার অংশ।
প্রীতির উপর ভীষণ একটা ট্রমা গিয়েছে। শারীরিক, মানসিক উভয়দিকে। আমার নিজেকে অপরাধী লাগছিলো সব শোনার পর। আমি যখন ছুটি পাই,তখন আমার ছেলের একমাস বয়স। প্রীতির সে কি অভিমান আমার প্রতি। কথায় বলেনা। ছেলেকে কোলে দিলো,তবুও আমার দিকে ফিরেও তাকালো না। বুঝলাম,সহজে কাজ হবে না।

রাতে যখন সবাই ঘুমিয়ে পড়লো,তখন প্রীতিকে ঘুম থেকেই টেনে কোলো তোলে নিলাম। কিন্তু সাথে সাথে আমার পুত্রধন ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কেঁদে উঠলেন। প্রীতি আমার দিকে অগ্নদৃষ্টিতে তাকালো। আমি অসহায়ভাবে তাকালাম। প্রীতি বাবুকে শান্ত করালো। কিছুক্ষণ পর ঘুমিয়ে পড়লো। আমি তখন বারান্দায় মন খারাপ করে বসে ছিলাম। কিছুক্ষণ পর প্রীতি আসলো ঠিকই,তবে কোন কথা বললোনা। আমি কানে ধরে সরি বলে প্রীতিকে আর কোন কথা বলার সুযোগ না দিয়ে বুকের ভেতর আবদ্ধ করে নিলাম। প্রীতিও চুপ করে গেলো। তবে প্রীতি কাঁদছে, সেটা বেশ বুঝতে পারলাম। কাঁদতে কাঁদতে বলতে লাগলো,
” যদি আমি মরে যেতাম?”
আমি সাথে সাথে প্রীতির মুখে চেপে ধরলাম। আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরলাম। যেন ছেড়ে দিলে,কোথাও চলে যাবে।
আমি পাগলের মত বলতে লাগলাম,আর কখনোও এমন কথা বলবেনা। আমার কথা জড়িয়ে আসছিলো। সত্যি বলতে আমারও ভীষণ ভয় করছিলো। কারন, প্রীতি চলে আসার পর থেকে আমি আজেবাজে স্বপ্ন দেখতাম। তবে সেসব প্রীতিকে বলতাম না। কিন্তু নিজে ভীষন আতঙ্কের মধ্যে দিনগুলো কাঁটিয়েছি। আল্লাহ আমাদের বিপদের থেকে উদ্ধার করেছেন।
প্রীতি তখনো কেঁদে চলেছে। আর কান্নাজড়িত কন্ঠে বলছে,
আমার ভীষণ ভয় হচ্ছিলো। যখন অপারেশন করতে নিচ্ছিলো,আমার মনে হচ্ছিলো হয়তো তোমাকে আর দেখতে পাবোনা। তোমার সাথে কথা বলতে ভীষণ মন চাইছিলো। তিনদিন পর্যন্ত আমার সেন্স ছিলো না। আমি আর ভাবতে পারিনা সেই মুহুর্তটা। আমি প্রীতির কপালে ভালোবাসার পরশ এঁকে দিয়ে বললাম,
” আর ভেবোও না সে মুহুর্তটা। ধরে নাও,এটা আমাদের জীবনের একটা খারাপ সময়। যেটা ভুলে যাওয়াই ভালো।”
প্রীতি আমাকে আরো শক্ত করে আগলে ধরলো। আমিও জড়িয়ে ধরে রইলাম। অনেকদিন পর শান্তি অনুভূত হচ্ছে।
তখনি বৃষ্টির ছিটা এসে আমাদের হালকা ভিজিয়ে দিলো। আমি বৃষ্টিকে হিংসে করতাম। এখনতো মনে হচ্ছে, বৃষ্টিও আমাকে হিংসে করে। কেমন হুঁট করে এসে ভিজিয়ে দিলো। যেন আমাদের এভাবে দেখে তার হিংসে হচ্ছিলো। আমি বৃষ্টি কোনদিন ভালোবাসেনি,বাসবোও না। বৃষ্টি আমার চরম শত্রু। এই বৃষ্টির কারণেই আমি আমার সর্বস্ব হারাতে চলেছিলাম। এরপর প্রীতিকেও আমি আর কোনদিন বৃষ্টিতে ভিজতে দেয়নি। যদিও সেটা আমার বোকা অভিমান।

আট বছর পর ছাদে দাঁড়িয়ে একজন রমণী বৃষ্টিতে ভিজছে। সাথে তার দুই ছেলে মেয়ে। হ্যাঁ,আমাদের আরেকটা পরীও হয়েছে। ওর নামই পরী। বৃষ্টির শব্দ শুনলেই ছেলেমেয়ে দুটো পাগলের মতো নামতে চেষ্টা করে। করবেই বা না কেন?
তাদের মা-ই যে বৃষ্টিপ্রিয়া।
আমার বৃষ্টিপ্রিয়া।
আমি বৃষ্টিকে ভালোবাসিনি,বৃষ্টিপ্রিয়াকে ভালোবেসেছিলাম।
এটাই আমার আর আমার বৃষ্টিপ্রিয়ার, পরিণয় থেকে পরিণতির গল্প।

~ সমাপ্ত ~

ভুলত্রুটি মার্জনীয়।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here