#বৃষ্টিপ্রিয়া
পর্ব- ০২।
লেখা- জাহান লিমু।
সেদিন জেনেছিলাম সেই মেয়েটি সোহাগের বোন। নাম প্রীতি। আর চেহারা এতো মিল হওয়ার কারন হলো,ওরাও আমাদের মত জমজ। আমাদের মত বলছি,কারন আমার বোন আর আমিও জমজ। তবে আমাদের চেহারা দুই মেরুর,কোন মিল নেই। আর মেয়েটা আমাদের এক ক্লাস নিচে,কারন এপেনডিক্স এর ব্যাথার কারনে এসএসসি পরীক্ষা দিতে পারেনি আমাদের সাথে। পরীক্ষা চলাকালীন হঠাৎ পেটে ব্যাথা হলে,ডাক্তারের কাছে নিয়ে জানতে পারে তৎক্ষনাৎ অপারেশন করতে হবে। তখন তিনটা পরীক্ষা বাকী ছিলো। সেগুলো আর দেয়া হলো না।
মেয়েটার সাথে আমার কিছু অদ্ভুত মিল খুঁজে পেয়েছিলাম। সেও অনেক চুপচাপ। বেশ কয়েকবার ওদের বাসায় যাওয়ার পরেও,খুব একটা কথা হয়নি। ততদিনে সোহাগের সাথে আমার সম্পর্কটা পাকাপোক্ত হয়ে গিয়েছিলো। যাকে বলে জানে জিগার দোস্ত। ওর বাবা,মায়ের সাথেও বেশ ভালো সম্পর্ক হয়ে গিয়েছিলো। সোহাগের বাবা আবার আমাদের কলেজেরই উদ্ভিদবিদ্যার প্রভাষক ছিলেন।
আমাদের বায়োলজি ক্লাস নিতেন। আর তাদের বাড়িটা যে এত চমৎকার,তার সবটাই উনার পরিশ্রম। তীল তীল করে গড়ে তুলেছেন। মানুষটা নিজেও ভীষণ যত্নশীল। তাকে দেখলেই সেটা বোঝা যায়। গাছের প্রতি তার অকৃত্রিম প্রেম।
সোহাগদের বাসায় যতটা না যেতাম ওর জন্য, তারচেয়ে বেশি যেতে লাগলাম আমার বৃষ্টিপ্রিয়াকে একপলক দেখার জন্য। নামটা আমারি দেয়া। বৃষ্টির সাথে যার গভীর সখ্যতা,তার নামই বৃষ্টিপ্রিয়া। আমি আরো বেশ কয়েকবার তাকে বৃষ্টির জলে খেলা করতে দেখেছি। তবে সে হয়তো আমাকে খেয়াল করেনি। আমি জানালা দিয়ে লুকিয়ে দেখতাম, সোহাগের চোখ ফাঁকি দিয়ে। মনে হতো বৃষ্টির মধ্যে বাগানে কোন বৃষ্টি পরী নেমে এসেছে। আচ্ছা পরীরা কি বৃষ্টিতে ভিজে? লাল পরী,নীল পরী আছে, বৃষ্টি পরীও কি আছে?
তা আমার জানা নেই। তবে আমি বৃষ্টি পরী দেখতে পেতাম। তার পাখা নেই,তবুও বৃষ্টির জলই যেন তার উড়ার বাহন। মেঘেদের সাথে যেন সে উড়ে যেতে চায়তো। চোখ বন্ধ করে, ঠোঁট নাড়িয়ে কি যেন বলতো বিড়বিড় করে। আর আমি বিস্ময়ে হতবাক হতাম। তাকে যতই দেখছিলাম,ততই আমি বৃষ্টিপ্রিয়াতে আসক্ত হয়ে যাচ্ছিলাম। বৃষ্টির জল তাকে টানে,আর সে আমাকে। কি অদ্ভুত এক মায়াচক্র, কি রহস্যময় সে মায়াজাল। আমি সে মায়াজালে বেশ শক্তপোক্ত ভাবেই আঁটকে গিয়েছিলাম।
সেটা অবশ্য কেউ ঠাহর করতে পারেনি। পারলে অপবাদ পেতে হতো বেশ। কারন বন্ধুর বোনকে পছন্দ করা একটা সাধারণ বিষয় আমাদের দেশে। আর সেটা যে ঠিক কতটা ঝামেলার,সেটা একমাত্র ভুক্তভোগীই জানে। আমার ক্ষেত্রে অবশ্য অন্য বিষয় হয়েছিল। যাকগে, সে কথা পরে বলি।
একটা বিষয় আমি ততদিনে বুঝে গিয়েছিলাম,আমাকে ভীষণ মনোযোগ দিয়ে পড়তে হবে। এর কোন বিকল্প নেই। কারন প্রীতি আমার একক্লাস ছোট হলেও,সমবয়সী। আর যেটা একটা পাহাড়সম বাঁধা। সেম এজ কথাটা শুনলেই,আমাদের মধ্যে আগেই নেগেটিভিটি কাজ করে। অথচ আমি মনে করি,সম্পর্কে বয়সটা কোন ফ্যাক্টই না। যদি আমাদের যথেষ্ট ম্যাচিউরিটি থাকে। পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ থাকে। সমবয়সী হলেই যে সম্পর্কে সম্মান থাকবেনা,এমনটা ভাবার কোন মানে নেই। সব সম্পর্কেই বিশ্বাসের পরেই সম্মান থাকাটা জরুরি।
হ্যাঁ,আমি প্রীতির প্রেমে ভীষণভাবে পুড়ছিলাম। যাকে বলে প্রেমের জ্বরে পোড়া। তবে তার উত্তাপ কেউ টের পাইনি। সেটা আমার অন্তরেই জ্বলতো আর নিভতো। তবে আমি যেহেতু চাপা স্বভাবের,তাই সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছিলাম লুকানোর। যদিও এই অনুভূতি চেপে রাখা,পাহাড়সম কষ্টের কাজ। তবুও আমি সেটা পেরেছিলাম। সেজন্য অবশ্য নিজের সাথেই নিজের যুদ্ধে লিপ্ত হতে হয়েছিল প্রতিনিয়ত। তবে সে যুদ্ধও কেউ টের পায়নি। ভালোবাসার ঝড় আমার মনেই তুফান তুলেছে,আবার মনেই শান্ত হয়েছে। আমি প্রতিনিয়ত ভয়ে থাকতাম। হয়তো এ ভালোবাসার কোন পূর্ণতা পাবোনা,সেটা ভেবে। এবং ভাবনাটা খুবই স্বাভাবিক ছিলো। তাও আবার শুধু আমি মনে মনে ওকে ভালোবাসতাম। ওর দিকের কিছুই জানতাম না। সেখানে তাকে নিজের করে পাওয়ার স্বপ্ন দেখা কিছুটা আকাশ কুসুমই বলা যায়। তবে আকাশ কুসুম হলেও,আমি সেই স্বপ্নটা ছেঁড়া কাঁথায় শুয়ে দেখতে চাই নি। সেজন্য নিজেকে সর্বাত্বকভাবে গড়ে তোলার চেষ্টায় নিবেদিত ছিলাম।
যাকে ভালোবাসি, সে কিছুই জানেনা। আমিই তাকে কিছুই জানায়নি। কি গোপনে তাকে ভালোবেসে গিয়েছি আমি একা একা। সে এক অন্যরকম অনুভূতি। ভালোলাগার অনুভূতি, ভালোবাসার অনুভূতি। সেই দিনগুলো ছিলো একইসাথে উৎকন্ঠার,আবার রোমাঞ্চকর। সে আমার সাথে ধীরে ধীরে টুকটাক কথা বলতে লাগলো। তবে সেটা খুবই সামান্য। আমিই আসলে প্রীতির সামনে পড়লে হতবিহ্বল হয়ে পড়তাম। সামান্য কথা বলতে গেলেও বিচলিত বোধ করতাম। দিশেহারা লাগতো নিজেকে। অনুভূতি বন্দি করার যদি কোন তালা থাকতো,বেশ হতো। অন্তত ঐ সময় আমার জন্য সেটা বেশ প্রয়োজন ছিলো। প্রীতি সেসব খেয়াল করতো কিনা তা জানা ছিলো না অবশ্য। তবে পরে কোন একসময় জেনেছিলাম। সেটার অবশ্য ভিন্ন কাহিনী।
বিজ্ঞানের ছাত্ররা মূলত ইংরেজিতে কিছুটা দুর্বল হয়ে থাকে। সবাই না,তবে অধিকাংশ। তবে আমি আবার গণিত,ইংরেজি দুটোতেই সমানতালে দক্ষ ছিলাম। সেটা অবশ্য আমার মায়ের জন্যই। আর সোহাগ ছিলো ইংরেজিতে কিছুটা দুর্বল। সে কারনে কলেজ শেষে ওর বাসায় গিয়ে দুজনে মিলে একসাথে পড়তাম। আর সেই সুবাধে প্রীতিকে প্রতিদিন দেখতে পেতাম।
সেবার গ্রীষ্মের সময় ওদের বাসার বাগানে বসে দুজন আড্ডা দিচ্ছিলাম,আর ফাঁকে ফাঁকে পড়াশোনা। বাগানটাতে পার্কের মতো করে বসার জায়গা করা হয়েছে। এককথায় ওদের বাড়িটা একটা ছোটখাটো বাংলো টাইপ বাড়ি বলা যায়।
মাঝে মাঝে মনে হতো, এতো সুন্দর বাড়ি দেখেই কি বাড়ির মেয়ের প্রেমে পড়ে গেলাম কিনা!
তারপর নিজেই আনমনে হাসতাম নিজের কথা ভেবে।
তখন চারদিকে গাছে গাছে কাঁচা আম ভর্তি। সোহাগদেরও বেশ কিছু আমগাছ ছিলো। আমরা যখন বসে ছিলাম,তখন প্রীতি বাটিতে করে আমভর্তা নিয়ে এসেছিল। আমি আবার টক খেতে ভীষণ পছন্দ করতাম। এখন এতোটা করিনা। কাঁচা আম, শশা, রসুন,কাঁচা মরিচ দিয়ে একসাথে ভর্তা করেছিল।
আবার সাথে পাঁকা তেতুল মাখা। শুনলেই জিভে জল এসে যায় যে কারো।
সবুজ আর কাঁচা হলুদের মিশেলে একটা থ্রিপিছ পরা ছিলো সে। মাথায় যথারীতি কাপড় দেয়া। এই জিনিসটা আমার ভীষণ ভালো লাগলো। প্রীতিকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সোহাগ বাটিটা রেখে চলে যাওয়ার জন্য বললো। আমার তখন সোহাগের নাক বরাবর দুটো দিতে মন চাইছিলো। শালার জন্য আমি আমার বৃষ্টিপ্রিয়াকে একটু মনভরে দেখতেও পারিনা। সামনে আসতেই, তাড়িয়ে দেয়। সোহাগকে যে আমি মনে মনে কতবার শালা বলে মনের ক্ষোভ মিটিয়েছি। সামনা-সামনি তো আর বলতে পারিনা। শত হলেও প্রীতির ভাই। যদিও প্রীতিকে বিয়ে করলে, শালায় হবে। এটা ভেবে আমি সেদিন ভর্তা মুখে দিয়ে বেশ হেসেছিলাম। হাসির ছুটে আমার হেঁচকি উঠে যায়। সোহাগ সেটা দেখে বিরক্ত হয়ে বলেছিলো,তোর তো দেখি মেয়েদের মত হেঁচকি উঠার স্বভাব। আমি কিছু বলতে পারছিলাম না। তখন আমার সামনে আমি সরিষা ফুল দেখতে পাচ্ছিলাম। মানে প্রীতিকে দেখতে পাচ্ছিলাম। সবুজ হলুদ রঙের জামায় ওকে একটুকরো সরিষা ক্ষেত মনে হচ্ছিলো। পানির গ্লাস নিয়ে সামনে দাঁড়িয়েছিল। আমি সেদিন বেশ, বেশ অবাক হয়েছিলাম। কারন সে চলে গিয়েছিলো,তাহলে হেঁচকি উঠার সাথে সাথে পানি নিয়ে হাজির হলো কি করে?
আমি বিষয়টা নিয়ে বিস্তর গবেষণা করে ফেললাম। তবে সেটার অর্থ দুটো দাঁড়ালো। এক প্রীতি তখনো রুমে যায় নি তাই। দুই প্রীতি লুকিয়ে আমাকে দেখছিলো। তবে দ্বিতীয়টা হয়তো আমার মনের সুপ্ত ইচ্ছার বহিঃপ্রকাশ। মানুষ মনে মনে যা চায়,তা নিয়ে ভাবতে ভালোবাসে। আমিও তার ব্যতিক্রম নয়। তবুও বিষয়টা আমাকে এক অন্যরকম অনুভূতির ছোঁয়া দিয়েছিল। আমি পানি খেতে গিয়েও আবার বিষম খেয়েছিলাম। আর তখন আরো একটা ভালোলাগার মুহুর্ত যোগ হয়েছিল। সে আমার মাথায় হাত রেখেছিলো। সোহাগ বিষয়টা স্বাভাবিক ভাবেই নিয়েছিল অবশ্য। কারন জানে আমি কেমন। তবে আমার কাছে ঐদিন সব অস্বাভাবিক ঠেকছিলো। চোখেমুখে রাজ্যের বিস্ময় নিয়ে অপলক তার দিকে তাকিয়ে ছিলাম। আর ঠিক তখনি আমার হেঁচকি,বিষম সব থেমে গিয়েছিলো। তবে অন্য আরেকটা সমস্যা দেখা দিয়েছিলো। হৃদযন্ত্রটা এতো জোরে লাফাচ্ছিল, যেন সে বেরিয়ে গেলেই খুশি। আমার হৃদয়, আমাতে থাকতে চাইছিলোনা তখন। টুকটুক করে সামনে দাঁড়ানো বৃষ্টিমানবীর হৃদয় ছোঁয়ে দিতে চাইছিলো। তবে কোন এক অদ্ভুত শক্তি আমাকে সেদিন জানান দিয়েছিলো, হয়তো তার হৃদয়ের একফালি অংশ জুরে হলেও আমার বিচরণ ছিলো।
#চলবে…
#জাহান_লিমু।