বৃষ্টিস্নাত সাঁঝ পর্ব -০৩

#বৃষ্টিস্নাত_সাঁঝ
|৩|
#সা_জি_দ

প্রহররা যখন চট্টগ্রাম পৌছালো তখন প্রায় এগারোটা বাজে। শেষ বিকেলে রওনা দিয়েও যে এত দেরি হবে তা প্রহর ভাবতেও পারেনি। এই যানজট নামক ঝা’মেলা যে কবে দুর হবে! বাড়ির সামনে এসেই অবাক হলো প্রহর। এত আয়োজন এই অল্পসময়ে কী করে সম্ভব! আর এত মানুষকেই বা খবর দিল কে? বাড়ির সামনে গাড়ি থামতেই সাঁঝ এর দিকে তাকালো প্রহর। প্রহর এর বাহুতে হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে আছে। ইচ্ছে না থাকা সত্বেও আলতো করে সাঁঝকে ডাকলো প্রহর। পরপর কয়েকবার ডাকার পরও সাঁঝ এর কোনও হেলদোল না দেখে কিছুটা ঝাকিয়েই উঠতে বললো প্রহর।

চোখ মেলেই প্রহরকে নিজের এত কাছে দেখে হকচকিয়ে গেল সাঁঝ। প্রহর তখনও সাঁঝ এর মুখের উপর ঝুকে আছে। নিজের অবস্থান সম্পর্কে অবগত হতেই একরাশ লজ্জা ঘিরে ধরলো সাঁঝকে। সাঁঝ এর ভাবনার মাঝেই প্রহর গাড়ি থেকে নেমে সাঁঝ এর পাশের দরজা খুলে সাঁঝ এর দিকে হাত বাড়িয়ে দিল। সাঁঝ প্রহরের হাত স্পর্শ করতেই শক্ত করে সাঁঝ এর হাত নিজের হাতে আবদ্ধ করে নিলো প্রহর। যেন ছেড়ে দিলেই হারিয়ে যাবে সাঁঝ। সাঁঝ এর দিকে তাকিয়ে ঈষৎ হেসে চলতে শুরু করলো প্রহর। সাঁঝও তাল মেলালো প্রহর এর সাথে।
_________________________

সদর দরজার সামনে দাড়িয়ে ছেলে আর বউমার জন্য অপেক্ষা করতে করতে হাঁপিয়ে উঠেছেন নীলিমা চৌধুরী। তাই একটু ড্রইংরুমের সোফায় গিয়ে বসেছিলেন, এরমধ্যেই খবর পেলেন যে প্রহররা চলে এসেছে, তখনই ছুটলেন সদর দরজার দিকে। একমাত্র ছেলের বিয়ে এত সাদামাটা ভাবে হবে বুঝি! তাই তো, আগেভাগে এসে এসব ব্যাবস্থা করেছেন!
___________________

এত মানুষের ভীড়ে বসে থাকতে প্রথমে অস্বস্তি হলেও এখন বি’র’ক্ত হচ্ছে সাঁঝ। নিজেকে কেমন যেন এলিয়েন এলিয়েন মনে হচ্ছে। কিছুক্ষন পরপর একজন আসছে আর সাঁঝকে দেখে যাচ্ছে। এত মানুষের ভীড়ে থাকায় এই শীতেও তীব্র গরম অনুভুত হচ্ছে, তারউপর আবার এত ভারী জামাকাপড়। কি একটা বিরক্তিকর অবস্থা! অপরিচিত কন্ঠের কথায় সাঁঝ এর ধ্যান ভাঙলো। একটু ভালো করে তাকিয়ে বুঝতে পারলো যে ইনি প্রহর এর ফুপু। নীলিমা চৌধুরী কিছুক্ষণ আগেই ওনার সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন।

“মেয়ের তো দেখি চুল নাই-ই। কোমড়সমান চুল না হইলে কী হয় নাকি!”

সাঁঝ বুঝতে পারলো না যে ঘোমটার ভেতর দিয়ে উনি কীভাবে বুঝেছেন যে সাঁঝ এর চুল কোমড়সমান নয়! আরও একজন তাল মেলালো ওনার সাথে। গম্ভীর মুখে বললো-

“আবার মেয়ের শরীরও দেখেন, একদম খালি। আমার মেয়েকে তো আমি গয়না দিয়ে মুড়িয়ে দিয়েছিলাম।”

এবার সাঁঝ এর কিছুটা কান্না পেলো, তবে কোনওমতে কান্নাটা গিলে ফেললো। সময় পায়নি দেখেই তো ওর বাবা-মা ব্যাংকের লকার থেকে গয়নাগুলো আনতে পারেনি। নাহলে নিশ্চয়ই মেয়েকে এমনভাবে পাঠাতো না! একনজর আশেপাশে তাকালো সাঁঝ। না, তার পরিচিত কেওই নেই আশেপাশে। হঠাৎই সাঁঝ এর মনে হলো ওর বাবা-মা এখানে থাকলে নিশ্চয়ই এসব কথা সহ্য করতেন না। মুহুর্তেই চোখের কোনে জল এসে ভীড় করলো। পলক ফেললেই গড়িয়ে পড়ার অপেক্ষায় রইলো। এমন সময়ই সাঁঝ পরিচিত একটি কন্ঠস্বর শুনলো, চোখ ঘুরিয়ে দেখলো প্রহর।

“আমার স্ত্রীর চুল যেমনই হোক, তাতে নিশ্চয়ই আপনাদের কোনও সমস্যা হওয়ার কথা না। আর আমি বিয়ে করেছি, কোনও সওদা করিনি যে মেয়ের সাথে গয়নাও দিতে হবে।”

কথাগুলো বলেই লম্বা লম্বা পা ফেলে বেরিয়ে গেলো প্রহর। প্রহর বেরিয়ে যাওয়ার প্রায় সঙ্গে সঙ্গে নীলিমা চৌধুরী এসে ঘরে ঢোকেন। হাতে ভাত এর থালা সাঁঝ এর হুট করেই প্রচন্ড ক্ষিদে পেয়ে যায়। একে একে সবাইকে ঘর থেকে বের করে নিজের হাতে খাইয়ে দেন নীলিমা চৌধুরী। সাঁঝ এর নয়নদ্বয় ঝাপসা হয়ে আসে। শাশুড়ীর থেকে মায়ের মত আচরণ সে আশা করেনি। নীলিমা চৌধুরী বোধহয় সাঁঝ এর মনের কথা বুঝেছেন। সাঁঝকে খাওয়ানো শেষ করে সাঁঝ এর সামনে বসে বলতে শুরু করেন-

“দেখো মা, প্রহর আমার একমাত্র সন্তান। বিয়ের আগে থেকেই আমার একটা মেয়ের শখ ছিল, মেয়েকে নিজের হাতে খাওয়াবো, পুতুলের মত সাজিয়ে রাখবো। কিন্তু আল্লাহ তো সেই শখ পুরণ করলেন না, তবে এখন তোমাকে দিয়েছেন। নিজের মায়ের জায়গায় শাশুড়ীকে বসানো সম্ভব নয় কিন্তু চেষ্টা তো করতেই পারো, তাই না?”

সাঁঝ ঈষৎ মাথা ঝাকায়। চোখের কোন বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ে। এমন সময়ই কেও একজন এসে ডেকে নিয়ে যায় নীলিমা চৌধুরীকে। একা একা বসে বিরক্ত হচ্ছিল সাঁঝ। এতক্ষণ এত মানুষ ছিল, আর এখন কেও নেই! বুঝলো যে, এসব প্রহর এর কাজ।

“আসবো ভাবি?”

দরজার বাইরে থেকে একটি অপরিচিত নারীকণ্ঠের প্রশ্ন শুনে চমকায় সাঁঝ। অনুমতি দিতেই মেয়েটি ঘরে ঢুকে পড়ে। সাঁঝকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই সাঁঝকে নিয়ে চলতে শুরু করে। সিড়ির কাছে এসে সাঁঝ প্রশ্ন করে-

“আমরা কোথায় যাচ্ছি?”

মেয়েটা একগাল হেসে উত্তর দেয়-

“ভাইয়ার ঘরে।”

মেয়েটার হাসি দেখে মুগ্ধ হয় সাঁঝ। কেও বুঝি এত সুন্দর করে হাসে!
___________________

ঘড়ির কাটা একটার ঘরে। ঘুমে সাঁঝ এর চোখ জড়িয়ে আসে। সেই কখন থেকে প্রহর এর জন্য অপেক্ষা করছে অথচ এখনও তার কোনও পাত্তা নেই। এতক্ষণ বসে থাকায় একে তো কেমড় ব্যাথা করছে তারওপর আবার ঘুম! বালিশের সাথে হেলান দিয়ে একটু চোখ বন্ধ করে সাঁঝ। মুহুর্তেই তলিয়ে যায় গভীর ঘুমে।

প্রহর এসে ঘরে ঢোকে আরও মিনিট ত্রিশ পর। টাকার জন্য কাজিনগুলো এতক্ষণ আটকে রেখেছিল! ঘরে এসে সাঁঝ এর ঘুমন্ত মুখ এর দিকে চেয়ে থমকে যায়। কিছুক্ষণ একমনে সেদিকে তাকিয়ে থেকে নিজের জামাকাপড় নিয়ে ফ্রেশ হতে যায়। এই খুটখাট শব্দেই সজাগ হয়ে যায় সাঁঝ। প্রহর অবাক হয়, যে মেয়েকে তখন এত বলেও ঘুম ভাঙাতে পারেনি সে এই অল্প শব্দেই জেগে গেছে! সাঁঝ এর দিকে তাকিয়ে বলে-

“যাও, তুমি ফ্রেশ হয়ে এসো। এসব ভারী জামাকাপড় পড়তে কষ্ট হয় না?”

উত্তর দেয় না সাঁঝ। ট্রলি থেকে একটা থ্রিপিস বের করে চলে যায় ফ্রেশ হতে। হঠাৎই প্রহর এর খেয়াল হয় যে ও ফ্রেশ হতে যাচ্ছিলো!

আধ ঘন্টা পর ফ্রেশ হয়ে আসে সাঁঝ। প্রহর তখন বিছানার একপ্রান্তে বসে ঝিমুচ্ছিলো। সাঁঝ মৃদু স্বরে বলে-

“যান, ফ্রেশ হয়ে আসুন।”
_____________________

ফ্রেশ হয়ে এসে সাঁঝকে ঘরে না দেখে বারান্দায় উকি দেয় প্রহর। সে যা ভেবেছিলো তাই ঠিক। একমনে আকাশের দিকে চেয়ে আছে সাঁঝ। প্রহরও গিয়ে সাঁঝ এর পাশে দাড়ায়। তবে একবারও আকাশের চাদ এর দিকে দৃষ্টিপাত করে না, একমনে তাকিয়ে রয়। নিজের ব্যাক্তিগত চাদটির দিকে।

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here