বৃষ্টিস্নাত সাঁঝ পর্ব -০২

#বৃষ্টিস্নাত_সাঁঝ
|২|
#সা_জি_দ

প্রহর ভেবেছিলো, তার কথা সাঁঝ এর মনে নেই। তবে ওকে আবারও চমকে দিয়ে সাঁঝ ওকে চিনে ফেললো। পাত্র-পাত্রীকে যখন আলাদা করে কথা বলার জন্য পাঠানো হলো তখন সাঁঝ বললো-

“আমার কথা মনে আছে আপনার? ওইযে বছর দুয়েক আগে এক ঝড়বাদলার সন্ধ্যায় আমাকে সাহায্য করেছিলেন, সেদিনের জন্য আবারও ধন্যবাদ।”

সাঁঝ এর কথা শুনে মনে মনে হাসলো প্রহর। হৃদয়ের গহীনে জায়গা করে নেওয়া মানুষটাকে কী কেও ভুলতে পারে! সাঁঝ এর প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে সাঁঝ এর ঘর ঘুরে দেখতে লাগলো প্রহর। ঘরের সাথে লাগোয়া বারান্দায় গিয়ে মুগ্ধ হলো। অপরাজিতা আর কুঞ্জলতার ফুল-পাতায় ঢেকে আছে রেলিঙ। এই ভরদুপুরেও কেমন একটা ঠান্ডা ঠান্ডা ভাব বিরাজ করছে। প্রহর বুঝলো, সাঁঝ এর পছন্দ বেশ চমৎকার। প্রহরকে এভাবে সব ঘুরে দেখতে দেখে বি’রক্ত হলো সাঁঝ। বাইরের একটা মানুষ তার ঘর ঘুরে দেখছে ব্যাপারটা বেশ অস্বস্তিকর। হঠাৎই ওর খেয়াল হলো যে, প্রহর যদি ফুল ছিঁড়ে! সাধারনত ছেলেরা এসব করে না, তবে যদি করে বসে!ব্যাস্ত পায়ে বারান্দায় প্রবেশ করলো সাঁঝ। বেশ আয়েশ করেই বারান্দায় রাখা বেত এর চেয়ারটায় প্রহরকে বসে থাকতে দেখে কপালে কিঞ্চিৎ ভাজ ফেললো। লম্বা লম্বা পা ফেলে প্রহরের দিকে এগিয়ে গেল। নিজেকে যথাসম্ভব স্বাভাবিক রেখে প্রশ্ন করলো-

“আপনি কী করছেন, বলুনতো? আপনাকে আমার ঘরবাড়ি স্ক্যান করার জন্য আমার সাথে পাঠানো হয়নি।”

“তো আপনি কী চাচ্ছেন? আমি আপনার সাথে প্রেমালাপ করি? আপনি চাইলে করতেই পারি।”

প্রহর এর কথা শুনে সাঁঝ এর কাশি এসে গেল। এই লোক এসব কী বলছে! পাগল-টাগল হয়ে গেল নাকি! সাঁঝ এর এই অবস্থা দেখে প্রহর হালকা হাসলো। স্বাভাবিক কন্ঠে বললো-

“এখনই এই অবস্থা! বিয়ের পর কী হবে?”

“কার বিয়ে? কীসের বিয়ে? আপনার মত ঠোটকাটা লোককে আমি জীবনেও বিয়ে করবো না।”

নিজের বিয়ের কথা বলতে সাঁঝ এর বোধহয় কিছুটা লজ্জা লাগলো, ওর গলা ধরে এসেছিল! সাঁঝ এর কথা শুনে প্রহর এর খুব একটা ভাবান্তর হলো না। শান্ত ভঙ্গিতে চেয়ার থেকে উঠে গ্রীল এ হেলান দিয়ে দাড়ালো। হাতদুটো বুকের কাছে ভাজ করে রেখে সাঁঝ এর দিকে তাকালো। অস্বাভাবিক শান্ত কন্ঠে বললো-

“বিয়ে তো আপনি আমাকেই করবেন, সাঁঝ।”

প্রহর এর অস্বাভাবিক শান্ত কথাতেই হালকা কেপে উঠলো সাঁঝ। এই অস্বাভাবিক জিনিসটাই বোধহয় এর কারন। তবে নিজেকে সামলে নিয়ে শক্ত কন্ঠে বললো-

“মগের মুল্লুক নাকি? আমি এই বিয়ে কিছুতেই করবো না।”

সাঁঝ এর কথা শুনে একমুহূর্তও অপেক্ষা করলো না প্রহর। ধুপধাপ করে বেরিয়ে এলো।
_______________

ছেলের কথা শুনে তাজ্জব হয়ে বসে আছেন নীলিমা চৌধুরী। যে ছেলেকে এতদিন মেয়ে দেখার জন্যই রাজি করাতে পারেননি, সে এখন সোজা বিয়ের কথা বলছে! এ’যে অষ্টম আশ্চর্য! কনেপক্ষের মতামত নিয়ে তার চিন্তা নেই, কারণ কনের মা যে তার ছোটবেলার বান্ধবী! সেই কবেই তো তারা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়েছিলেন যে একে অপরের বেয়াইন হবেন। কিন্তু ওনার চিন্তা অন্য জায়গায়, এত অল্প সময়ে এত আয়োজন কীভাবে করবেন! একনজর স্বামীর দিকে তাকালেন নীলিমা চৌধুরী। তিনিও ওনার মতই তাজ্জব হয়ে বসে আছেন। তবে প্রহর এর কোনও হেলদোল নেই। সে নিজের সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিয়ে আয়েশি ভঙ্গিতে সোফায় বসে ফোন চাপছে। সাথে হু’মকিও দিয়ে দিয়েছে, আজ বিয়ের ব্যাবস্থা না করলে সে জীবনেও বিয়ে করবে না। এরপর বড় করে অনুষ্ঠান হোক বা যা-ই হোক, এ নিয়ে তার মাথাব্যথা নেই। তবে সে আজ যেভাবেই হোক, বউকে নিয়ে বাড়ি ফিরবে।
________________

বান্ধবীর থেকে এমন প্রস্তাব পেয়ে কিছুটা হকচকিয়ে গেলেন আফিয়া বেগম। প্রহর আর ওর পরিবার সম্পর্কে উনি ভালো করেই জানেন, তাই খোজ নেওয়ার কিছু নেই। কিন্তু এভাবে বিয়ে হয়? একমাত্র মেয়ের বিয়ে নিয়ে কত কিছু ভেবে রেখেছিলেন তিনি! আর সাঁঝ’ই কী রাজি হবে এভাবে হুট করে বিয়ে করতে! তবে আফজাল আহমেদ খুব একটা চিন্তা করলেন না। প্রহর এর মত পাত্র হাতছাড়া করা উচিত নয়। তাই স্ত্রীকে সাঁঝ এর কাছে পাঠিয়ে কাজে ব্যাস্ত হয়ে পড়লেন। কাজ বলতে তেমন কিছুই না, কাজি ডাকা আর রেস্টুরেন্ট থেকে খাবার আনা। তবে ওনার মনেও কিছুটা আফসোস রয়েই গেলো। একমাত্র মেয়ের বিয়ে এভাবে সাদামাটা ভাবে হবে!
_________________

সাঁঝ এত সহজে রাজী হয়ে যাবে এটা আন্দাজ করতে পারেননি আফিয়া বেগম। মেয়েটা বেশ খুতখুতে। মায়ের দিকে তাকিয়ে সাঁঝ বুঝলো যে তিনি সে এত সহজে রাজী হওয়ায় বেশ অবাক হয়েছেন। তবে আগবাড়িয়েই কিছু না বলে বারান্দায় গিয়ে আকাশের পানে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো। এই পৃথিবীতে ভালো মানুষের সংখ্যা খুবই কম। এই ভালো মানুষগুলোর মধ্যে একজন যদি তার ভাগ্যেই থাকে, তাহলে ক্ষতি কী? অন্তত এই নিশ্চয়তাটুকু তো পাবে যে সে জীবনসঙ্গী হিসেবে একজন ভালো মানুষ পাচ্ছে! আর ওর পরিবার এর সবাইও তো রাজি। তাহলে ওর রাজি না হওয়ার কোনও কারণ আছে?
___________________

ঘন্টা দুয়েকের মধ্যেই কাজী ডেকে প্রহর আর সাঁঝ এর বিয়ে পড়ানো হলো। ‘কবুল’ বলার সময় সাঁঝ এর মনে হলো কে যেন ওর গলা চেপে আছে, আবার সাইন করার সময়ও সেই একই অনুভূতি। হাত যেন জমে বরফ হয়ে গেছে! আচ্ছা, সব মেয়েরই কী বিয়ের সময় এমন অদ্ভুত অনুভুতি হয়? বিয়ে পড়ানো শেষ হতেই ঘরে চলে আসে সাঁঝ। কোনও কারণ ছাড়াই এ’মুহুর্তে তার লজ্জা লাগছে। ভ’য়’ঙ্ক’র রকমের লজ্জা। ড্রইংরুমে তখন সবাই মিষ্টিমুখে ব্যাস্ত। কিন্তু একজনের ব্যাস্ত অক্ষিযুগল ঠিকই খুজে বেড়ায় সাঁঝকে।
__________________

“জোর করো না তো আম্মু। আমি কিছু খাবো না। ক্ষিদে নেই।”

সাঁঝ এর কথায় পাত্তা দেন না আফিয়া বেগম। জোর করেই কয়েক লোকমা খাবার খাইয়ে দেন ওকে। তবে সাঁঝের জোরাজোরিতে পুরোটা শেষ করতে পারেন না। এরমধ্যেই শুরু হয় কনে বিদায় এর জন্য তোড়জোড়। প্রতীবেশীদের বাসায় আফিয়া বেগম রঙ্গনকে দিয়ে কিছুক্ষণ আগেই মিষ্টি পাঠিয়েছেন। তাই সবাই-ই এসে ভীড় করে বরকে দেখার জন্য। এই ফাকে সাঁঝকে বিয়ের সাজে সাজিয়ে দেন আফিয়া বেগম। নিজের বিয়ের শাড়ি মেয়ের গায়ে জড়ানোর সময় পুরনো স্মৃতিগুলো তাজা হয়ে ওঠে। সময় কত দ্রুত চলে যায়! আফিয়া বেগম এর চোখ ভিজে ওঠে।

এতক্ষণ একধরনের মিশ্র অনুভূতি হলেও বিদায়ের সময় সাঁঝ এর বুক ভে’ঙে কান্না আসে। সে কী কোনদিন কল্পনা করেছিল যে, এই বাড়ি ছেড়ে যেতে তার এত কষ্ট হবে?

দুহাতে বাবা-মাকে জড়িয়ে কেদে বুক ভাসায় সাঁঝ। কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে থাকা রঙ্গন এর দিকে চোখ যেতেই ওর দিকে এগিয়ে যায়। ভাই-কে জড়িয়েও কিছুক্ষণ অশ্রু বিসর্জন দেয় সাঁঝ।

সাঁঝকে এভাবে কাদতে দেখে প্রহর এর বুকে চাপা যন্ত্রণা হয়। এতক্ষণ কোনওমতে সহ্য করলেও এরপর আর পারে না। সবার থেকে বিদায় নিয়ে গাড়িতে উঠে বসে। ধীরে ধীরে চলতে শুরু করে গাড়ি, সাঁঝ এর ভবিষ্যতের দিকে।

চলবে…?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here