বেদনার রঙ নীল পর্ব -০২

#বেদনার_রঙ_নীল
দ্বিতীয় পর্ব
লিখা- Sidratul Muntaz

থপ থপ আওয়াজ করে দৌড়ে আসছে লোকগুলো। তুলি এদের ভীষণ ভয় পায় এবং তার চেয়েও ঘৃণা করে।সে একলাফে সামনে এসে ঠিক প্রণয়ের আসনেই বসল। প্রণয় তখনও হতবিহ্বল।তার চোখ এবং মুখের হাঁ কোনোটাই বন্ধ হয়নি। তার এটাও খেয়াল নেই যে দু’জন চাপাচাপি করে একই আসনে বসে। নিজের গাড়িতে বিয়ের কনে দেখে প্রণয়ের মাথা আগেই ফাঁকা হয়ে গেছিল। তাই এরপর তুলি কি করতে যাচ্ছে সেটা আর প্রণয়ের মাথায় ঢুকল না৷ তুলি খুব দ্রুত গাড়ি চালু করল। সে ভেবেছিল তারা বুঝি গ্রাম থেকেও বের হয়নি। কিন্তু তারা আসলে ব্যস্ত সড়কে চলে এসেছে! পেছনের লোকগুলো যেন তাদের নাগাল না পায় তাই তুলি দ্রুত ড্রাইভ করছিল। এরা সবাই চেয়ারম্যানের সাঙ্গ-পাঙ্গ। একবার যদি তুলি এদের হাতে পড়ে যায় তাহলে আর বাঁচার উপায় থাকবে না। নিজচোখে মৃ/*ত্যু দেখলে মানুষ বাঁচার জন্য যতটা ছটফট করে তুলিও ঠিক ততটাই ছটফট করছিল। প্রণয় যখন অনুভব করল গাড়িটা প্রচন্ড জোরে ধাক্কা খাচ্ছে আর আশেপাশের মানুষ চেঁচাচ্ছে তখন তীব্র ত্রাস নিয়ে প্রশ্ন করল, ” এই, আপনি ড্রাইভিং জানেন?”

তুলির হঠাৎ খেয়াল হলো, সে ঠিকঠাক ড্রাইভিং না জেনেই ড্রাইভ করতে লেগে গেছে। তার হাতের শক্তি কমে গেল। মনোবল দমে গেল। কিন্তু এটাও মনে হলো, ওদের হাতে ধরা পড়ার চেয়ে এক্সিডেন্ট করা ভালো। এই ভেবে তুলি গাড়ির গতি আরও বাড়িয়ে দিল। কারণ পেছনে যারা ছিল, তারাও গাড়ি নিয়ে অনেকটা কাছে চলে এসেছে। প্রণয়কে তো তারা গাড়ি নিয়েই অনুসরণ করছিল। তুলির এমন কান্ড-জ্ঞানহীন আচরণে সামনের বড় একটা মাইক্রোতে খুব জোরে ধাক্কা লাগল। মাইক্রোর সেই ড্রাইভার এবং যাত্রীরা তুমুল আওয়াজে চিৎকার করে উঠল। হৈহৈ করে তেড়ে আসতে লাগল মানুষ। প্রণয়ের মনে হয় না সে তার চব্বিশ বছরের জীবনে এতো ভয়ংকর অভিজ্ঞতা আগে কখনও ফেইস করেছে! ধ্বং/সাত্মক তুলিকে এক ধাক্কায় সরিয়ে সে এবার নিজে ড্রাইভিং শুরু করল। প্রণয় এতো দ্রুত কিন্তু নিরাপদে ড্রাইভ করছিল যে সব গাড়িকে ওভারটেক করে অনেকটা সামনে চলে গেল। তুলি পেছনে তাকিয়ে দেখল তাদের আর কেউ ধাওয়া করছে না। তুলি নিজের বুকে হাত চেপে ধরে খুব রিল্যাক্স হয়ে বলল,” আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। আমার যে কি শান্তি লাগছে!”

প্রণয় কটমট করে বলল,” আপনার জন্য আজকে আমি মায়ের নামে গালি শুনেছি৷ এর আগে কখনও কেউ আমাকে এভাবে গালি দেয়নি। অন্য সময় হলে চোয়াল ভেঙে গুঁড়ো করে দিতাম শা’*লাদের। কিন্তু নেহাৎ দোষ আমারই ছিল৷ আসলে তো আমার না, সব দোষ আপনার!”

তুলি অপ/*রাধী কণ্ঠে বলল,” স্যরি। কিন্তু আমিও কম বিপদে পড়িনি। যা করেছি বাধ্য হয়ে করেছি। আপনি জানেন, ওরা ধরতে পারলে আমাকে মে/*রে ফেলতো।”

প্রণয় চোখ বড় করে তাকাল,” কেন?”

” আমার কাছে বিয়ে করা আর ম/*রে যাওয়া একই কথা।”

প্রণয় হাসল৷ তার হাসিতে ভর্ৎসনা। তুলি আলতো স্বরে বলল,” মেয়ে না হলে কখনও বুঝবেন না এই জ্বালা। আপনাদের তো জোর করে বিয়ে দেওয়া হয় না।”

” আপনি এই গাড়িতেই কেন উঠে এলেন বলেন তো? আর কোনো গাড়ি ছিল না?”

” আপনাকে আমার ভালো মানুষ মনে হয়েছে।”

” অনেক দূর্ভাগ্য আমার। যে আমাকেই আপনার ভালোমানুষ মনে হলো।”

” এভাবে কেন বলছেন? আপনি মুসলিম তো?”

প্রণয় অবাক হয়ে বলল,” এখানে মুসলিম-অমুসলিমের প্রসঙ্গ এলো কেন?”

” মুসলিম হলে বিশ্বাস করুন যে আমি আপনার কাছে আসার আগে আল্লাহর কাছে সাহায্য চেয়েছিলাম। আল্লাহ আমার জন্য নিজ উদ্যাগে সাহায্যকারী পাঠিয়েছেন। আর তিনি হচ্ছেন আপনি। নাহলে বলুন তো, বিয়ে বাড়িতে এতো জায়গা থাকতে আপনার কেন আমার পাশেই বসে ফোনে কথা বলতে হলো? আর আমি সেই কথাগুলো শুনে পালানোর বুদ্ধি পেয়ে গেলাম। আমার ধারণা আল্লাহ ওই সময় পুরো জায়গার নেটওয়ার্ক বন্ধ করে রেখেছিলেন আর আমার আশেপাশে নেটওয়ার্ক খুলে রেখেছিলেম। যাতে আপনি এখানেই আসেন। আর আমি আপনার সাহায্য পেয়ে যাই। দেখুন, সেটাই হলো। কি সুন্দর আমি বেঁচে গেলাম।”

প্রণয় গম্ভীর কণ্ঠে বলল,” এখনও বাঁচেননি। সামনে দেখুন।”

তুলি সামনে তাকিয়েই চিকন কণ্ঠে ভীষণ জোরে চিৎকার দিল। সেই চিৎকার শুনতে প্রণয়ের এতো কষ্ট হলো, সে কেবল দাঁতে দাঁত চিপে সহ্য করে নিল। তারপর ত্বরিতে গাড়ি ঘুরিয়ে বিপরীত দিকে টার্ন করল। চেয়ারম্যানের সাঙ্গ-পাঙ্গরা হয়তো বিকল্প রাস্তা অবলম্বন করে তাদের আগে চলে এসেছিল। আরেকটু হলেই তারা তুলিদের পথটা আটকে দিচ্ছিল। কিন্তু প্রণয় পুরো পরিস্থিতি সামলে ফেলেছে। তুলি হাসতে হাসতে হাত তালি বাজিয়ে বলল,” দারুণ, বেস্ট, বেস্ট! আপনি এতো ভালো ড্রাইভ করেন? ড্রাইভিং-এ নোভেল দেওয়ার ব্যাপার থাকলে আমি আপনাকে এখনি দিয়ে দিতাম। উফ, সত্যিই আল্লাহ আপনাকে শুধু আমার জন্যই পাঠিয়েছেন। এখন আমি পুরোপুরি বিশ্বাস করি এটা।”

প্রণয় একটু অন্যরকম দৃষ্টিতে চেয়ে বলল,” কি বললেন?”

তুলি লজ্জা পেয়ে গেল। অপ্রস্তুত হয়ে বলল,” কিছু না। কিন্তু আপনার ড্রাইভিং বেস্ট।”

প্রণয় হাসল। তুলি তো আর জানে না, এটাই প্রণয়ের প্যাশন। রোজরাতে সে বন্ধুদের সাথে বসুন্ধরার ফাঁকা সড়কে বাজি ধরে কার রেসিং করে। এখন পর্যন্ত প্রণয় একটা রেসেও হারেনি। তাকে হারানো যে কোনো রেসারের পক্ষেই কঠিন। আর ওই পেটমোটা, গাবদা, গাবদা ভদ্রলোকদের জন্য তো অসম্ভবই বলা চলে। এজন্যই তো এমন রিস্ক নিয়েছে সে। তাছাড়া প্রণয় তুলিকে নিজের গাড়িতে দেখে একদমই অবাক হয়নি। সে ভেবেছিল এটাই হবে। পক্ষান্তরে, এটিই প্রণয়ের পরিকল্পনা ছিল। তবে তুলি যাতে বুঝতে না পারে তাই প্রণয় নিজের বিরক্ত হওয়ার অভিনয় সুক্ষ্মভাবে চালিয়ে গেল।

তুলি রীতিমতো মুগ্ধতা নিয়ে তাকিয়ে আছে। একটু পর বলল,” আচ্ছা আপনার সেই ফ্রেন্ডের কি হবে? তাকে তো আপনি উঠালেন না।”

” ওর কথা ভাবার কিছু নেই। আমারই ঢাকা যাওয়ার তাড়া ছিল। ও শুধু বলেছিল আমার সঙ্গে আসবে। তারপর কোথায় যেন গায়েব হয়ে গেল। আর আসেনি। আমিও ওকে নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছি না। মেয়েদের মিনিটে মিনিটে মুড সুইং হয়। আই হেইট গার্লস!”

” আপনি কি জানেন? আমিও যে একটা মেয়ে?”

” না। জানা ছিল না। জানানোর জন্য থ্যাংকস। ”

প্রণয় যেন রসিকতা করল। তুলি একটু রাগী কণ্ঠে বলল,” একটা মেয়ের সামনে আরেকটা মেয়ের বদনাম করছেন এটা খুবই বাজে ব্যাপার কিন্তু।”

” কেন? মেয়েদের সামনে মেয়েদের বদনাম করা যায় না? আচ্ছা আপনারা এমন কেন? হোয়াই ইউ গার্লস আর অল সেইম? নিজেদের দোষ তো মানতেই চান না, আবার নিজের মতো আরেকজনের দোষও জাস্টিফাই করেন। হাউ চিপ!”

” আচ্ছা থাক ভাই, আমরা দোষী। আর আপনারা নিষ্পাপ, নির্দোষ, ভদ্রলোক। খুশি?”

” খুশি হওয়ার কিছু নেই। এটাই চিরন্তন সত্য কথা। ইউনিভার্সাল ট্রুথ।”

” ইশ!” তুলি নিজের মুখে হাত ঠেঁকালো। খুব রাগ উঠলে সে এভাবেই নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে। যে মানুষের মাধ্যমে সে এতোবড় বিপদ থেকে নিস্তার পেয়েছে তার সঙ্গে ঝগড়া করা যায় না। তুলি কৃতজ্ঞতার খাতিরে চুপ রইল। প্রণয় দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,” যাইহোক, আপনি কোথায় নামবেন সেটা বলেন।”

” আমি এতো দ্রুত নামব না। সরাসরি ঢাকা যাবো আপনার সঙ্গে। আপনিও সেদিকে যাচ্ছেন। আশা করি আমাকে নিতে কোনো প্রবলেম হবে না।”

প্রণয় ভ্রূ উঁচু করে তাকালো। মহারাণীর আবদার শোনো! পায়ের উপর পা তুলে এমনভাবে আদেশ করছে যেন প্রণয় তার কথা শুনতে বাধ্য! অথচ তার জন্যই প্রণয় একটু আগে কতোবড় একটা বিপদে ফাঁসতে যাচ্ছিল। যদি লোকগুলো প্রণয়কে কোনোভাবে ধরে ফেলতো তাহলে মনে হয় না মার একটাও মাটিতে পড়তো৷ এতোক্ষণে প্রণয়ের অবস্থা কি হতো সেটা চিন্তা করলেও মাথা ঝিমঝিম করছে। সে কিছু বলবে না ভেবেও বলে ফেলল,

“একেই বলে মেয়ে মানুষ। বসতে পেলে শুতেও চান আপনারা।”

তুলি ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেল এমন কথায়। আপত্তিকর কণ্ঠে বলল,” আমি শুতে কখন চাইলাম? ছিঃ!”

প্রণয় উচ্চশব্দে হাসল। ঠাট্টা করে বলল,” এটা জাস্ট একটা প্রোভার্বস বললাম। মাইন্ড এতো নেগেটিভ কেন? অবশ্য মেয়ে মানুষ বলে কথা! নেগেটিভ তো হবেই।”

তুলি ঠাট্টাটা বুঝল না। সে রেগে বলল,” আপনি কি মেয়ে মানুষ বলে খোঁচা দেওয়া ছাড়া আর কিছু পারেন না? এমন ভাবে বলছেন যেন মেয়ে মানুষ হয়ে জন্মে আমি বিরাট অপ/*রাধ করে ফেলেছি।”

” মেয়ে মানুষ হয়ে জন্মানো অপ/*রাধ হবে কেন? তবে মেয়ে মানুষের মতো আচরণ করাটা অবশ্যই অপ/*রাধ।”

তুলি আশ্চর্য হয়ে গেল। অদ্ভুত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল,” আমরা কি তাহলে পুরুষের মতো আচরণ করব?”

” নরমাল আচরণ করবেন। উই অল আর হিউম্যান বিয়িং, রাইট? তাহলে আমাদের আচরণে কেন এতো পার্থক্য? ন্যাকামি, মুড সুইং, ঢং এসব কখনও ছেলেদের করতে দেখেছেন? ”

” মেয়েরা প্রকৃতিগত ভাবেই এরকম। বুঝেছেন?আর যাইহোক, আমরা মানুষের মতোই আচরণ করি। অমানুষের মতো করি না।”

” বিশ্বাস করুন, আমি অমানুষ থেকেও মেয়ে মানুষের আচরণ বেশি ভয় পাই। অমানুষদের মে/*রে মানুষ বানানো যায়। কিন্তু মেয়েদের মানুষ বানানো… ওহ গড! ইটস কোয়াইট ইম্পসিবল।”

তুলির মুখ দিয়ে অনেক বড়-সড় একটা গালি বের হচ্ছিল। সে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে ফেলল, অনেক কষ্টে! কিন্তু রাগটা কিছুতেই দমন করা গেল না। এতো টক্সিক ছেলে সে আগে কখনও দেখেনি। তুলি দাঁত খিচে বলল,” যে কথায় কথায় এভাবে মেয়ে মানুষদের অপমান করে সে কখনও ভালো মানুষ হতে পারে না। আমি ভুল ভেবেছিলাম। আপনি একটা খারাপ মানুষ। তাই আমি আমার আগের কমপ্লিমেন্ট ফিরিয়ে নিচ্ছি।”

” তাই? আমার মতো খারাপ মানুষের গাড়িতেই আপনি কেন বসে আছেন তাহলে? আপনি নিজে কতটা ভালো? ”

তুলি রাগে গজগজ করে বলল,” আমি নেমে যাবো।”

প্রণয় সঙ্গে সঙ্গে গাড়ি ব্রেক করল। তুলি চমকে উঠল। অবাক হয়ে বলল,” আমি কি এখনি নেমে যাবো নাকি?”

প্রণয় বিনয় ঝরা কণ্ঠে বলল,” শিউর! আপনি নামতে পারেন।”

তুলির বুক ধুকপুক করছে৷ আমতা-আমতা করে বলল,” ঠিকাছে। এবারের মতো আপনাকে মাফ করলাম। কিন্তু মেয়ে মানুষ সম্পর্কে আরেকটা বাজে কথা যদি বলেছেন তাহলে কিন্তু খুব খারাপ হবে।”

প্রণয় মুচকি হেসে বলল,” আমার গাড়ি। এখানে বসে আমি যা ইচ্ছা তাই বলব। আপনার শুনতে ইচ্ছা হলে শুনবেন। সহ্য করতে না পারলে চলে যাবেন। আই ডন্ট কেয়ার।”

তুলির রাগ হচ্ছে কিন্তু ভয়ও লাগছে। সে নিরুপায় হয়ে বলল,” আপনার কাছে তুলো আছে? কানে গুঁজবো৷ তারপর আপনি যা ইচ্ছা বলেন। আই ডন্ট কেয়ার।”

প্রণয় হেসে বলল,” আমার কাছে তুলো থাকলেও তো আমি আপনাকে দিবো না।”

” আপনি খুব অসহ্য।”

” সহ্য করতে কে বলেছে? আপনার কাছে তো অপশন আছেই। নেমে যান!”

” এতো অভদ্র আপনি? একটা মেয়ে মানুষকে নীরব রাস্তায় নামিয়ে দিতে লজ্জা লাগে না? কাওয়ার্ড!”

প্রণয় চোয়াল শক্ত করে ফেলল। থমথমে গম্ভীর গলায় বলল,” আপনি কি আসলেই ঢাকা পৌঁছাতে চান?”

” হ্যাঁ। ”

” তাহলে চুপ থাকুন একদম। পিনড্রপ সাইলেন্ট। কোনো কথা বলা যাবে না।”

তুলি খিটমিট করে বলল,” কথা তো আমার চেয়ে বেশি আপনি…”

প্রণয় একদম তুলির মুখের কাছে ঝুঁকে এসে বলল,” চুপ করতে বললাম না? চুপ! সাইলেন্ট!”

তুলি চোখে রাগের আগুন নিয়ে চুপ করল। প্রণয় গাড়ি চালু করল। তুলি ফিসফিস করে বলল,” অসহ্য!”

প্রণয় গরম চোখে তাকাল। তুলি অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নিল। ছেলেটা যতই ঘাড়ত্যাড়া হোক, অন্তত তাকে ঢাকা পর্যন্ত পৌঁছে দিবে। তুলি নিরাপদ থাকবে। এটাই অনেক। তাই ঝগড়া না করে চুপ থাকাটা অবশ্যই ভালো অপশন। তবে এখন তার মনে হচ্ছে, ছেলেটাকে কাওয়ার্ড বলে গালি দেওয়া উচিৎ হয়নি। হয়তো বাড়াবাড়ি হয়েছে। তবে ছেলেটাও তুলিকে কম কথা শোনায়নি। তাই প্রণয়ের রেগে যাওয়া গুরুগম্ভীর মুখটা দেখে তুলির একটা শান্তি লাগছে। সে একটু পর প্রণয়ের দিকে আঙুল ইশারা করল। প্রণয় ভ্রু বাঁকিয়ে কিছুটা বিরক্তি নিয়ে বলল,” হোয়াট?”

” একবার।”

প্রণয় চোখ বড় করে জানতে চাইল,” একবার মানে?”

” একবার মানে… একবার কথা বলব।”

” অলরেডি দুইবার কথা বলে ফেলেছেন।”

” আচ্ছা, তাহলে আরেকবার বলি?”

প্রণয় দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে সম্মতি দিল,” বলুন।”

” আমি আমার ফ্রেন্ডের সাথে একটু কথা বলতে চাই।”

প্রণয় হাসার ভাণ ধরে বলল,” তো বলুন কথা! এজন্য পারমিশন নিতে হবে কেন? আমার গাড়িতে বসে আছেন বলে যে আপনি অন্যকারো সাথে কথা বলতে পারবেন না, এমন কিছু তো আমি বলিনি। আপনি যার সাথে ইচ্ছা কথা বলেন। শুধু আমার সাথে না বললেই হলো।”

” আপনি নিজেও অনেক বেশি কথা বলেন, ঠিকাছে? আমার কাছে ফোন নেই। সেজন্য আপনার কাছে ফোন চাইছি। কথা বলার পারমিশন না।”

” ওহ। সেটা সরাসরি বললেই হতো যে ফোন লাগবে।”

তুলি অসহ্য হয়ে কপালে হাত ঠেঁকিয়ে বসল। প্রণয় পকেট থেকে মোবাইল বের করতে নিয়ে আশাহত হলো। নিভে যাওয়া মেজাজটা ধ্বক করেই আবার জ্বলে উঠল। কারণ সে তাড়াহুড়োয় ফোন বিয়ে বাড়িতেই ফেলে এসেছে। তার পকেটে এখন যেই ভারী জিনিসটা আছে, সেটা একটা ছোট খঞ্জরের বক্স। এই জিনিসটাই মোবাইল ভেবে পকেটে তুলে নিয়েছিল প্রণয়। শিট, এতোবড় ভুল কিভাবে হলো? তুলি শান্ত গলায় বলল,” কি হয়েছে? ফোনটা একটু দ্রুত দিন না!”

প্রণয় নিভে যাওয়া কণ্ঠে বলল,” আমার কাছে ফোন নেই।”

তুলি অবাক হলো। তারপর কটমট করে বলল,” আচ্ছা, এই একটা গাড়ি আর মাথাভর্তি মেজাজ ছাড়া আর কি আছে আপনার কাছে?”

প্রণয় রক্তিম দৃষ্টিতে তাকাল। তুলি দিশেহারার মতো বলতে লাগল,” এখন আমি কি করব? একটা ফোন কত প্রয়োজন ছিল জানেন? আমি যার বাড়িতে যাচ্ছি তাকে তো আগে জানাতে হবে। না জানিয়ে যাই কি করে? সামান্য একটা ফোনও আপনার কাছে থাকে না? অদ্ভুত মানুষ তো আপনি!”

প্রণয় হঠাৎ পকেট থেকে বের করে তুলির গলায় খঞ্জরটা চেপে ধরল। তুলি নিঃশ্বাস নিতে ভুলে গেল। আতঙ্কে চোখ দু’টো বেরিয়ে আসার উপক্রম হলো। প্রণয় বলল,” একদম চুপ থাকবেন। নাহলে কিন্তু মে/*রে ফেলবো।”

তুলি যেন জন্মের মতো চুপ হয়ে গেল। তার মনে হচ্ছে, এবার সে চেষ্টা করলেও আর কথা বলতে পারবে না। কারণ তার গলা দিয়ে শব্দই বের হচ্ছে না! খঞ্জরের চৌখাটা ঠিক তার গলার ডানপাশে, ধার পর্যন্ত অনুভব হচ্ছে! তুলি চোখ খিচে বন্ধ করে নিল। তারপর থেকে সে আর একটা কথাও বলেনি।

প্রণয়ের মেজাজটা আগে থেকেই খারাপ ছিল। মোবাইল হারানোর ব্যাপারে অবগত হওয়ার পর থেকে আরও রাগ লাগছে। সে চিন্তিত মুখে ড্রাইভ করছে আর ভাবছে, মোবাইল ছাড়া এখন কারো সাথে যোগাযোগ কিভাবে করবে? তার ছোটমা খুব অসুস্থ। মিষ্টি আপু বলেছিল ছোটমাকে হসপিটালে নিয়ে যাবে। এতোক্ষণে হয়তো নিয়েও গেছে। প্রণয় ফোন করে খোঁজ নিতে পারছে না। বাড়ির কি অবস্থা কে জানে? গ্রীনলাইট কি বাড়িতে একা আছে? তাহলে তো সর্বনাশ! গ্রীনলাইট হলো প্রণয়ের ছোটভাই। সে ক্লাস সিক্সে পড়ে। তাকে নিয়েই প্রণয়ের যত চিন্তা, আতঙ্ক!

প্রণয় চিন্তা করছে তার বাড়ির অবস্থা নিয়ে। এদিকে তুলির চিন্তা সম্পূর্ণ ভিন্ন। তার বুকের ভেতর দামামা বাজছে। এক বিপদ থেকে নিস্তার পেতে এখন আবার এই কোন বিপদে ফাঁসলো সে? ছেলেটা তার গলায় চাকু চেপে ধরেছে। এর মানে অবস্থা মোটেও সুবিধার নয়। তুলি একটুও নিরাপদে নেই। যে পকেটে চাকু নিয়ে ঘোরে, সে নিশ্চয়ই মানুষও খু/*ন করে! তুলির অসহায় আত্মাটা অবিদিত আতঙ্কে চিৎকার করে উঠল।

বেশ অনেকক্ষণ পর প্রণয় একটা বড় রেস্তোরাঁর সামনে গাড়ি থামালো। এতো রাতেও কোনো রেস্তোরাঁ খোলা থাকতে পারে? তুলি অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। প্রণয় এখানে কেন থামল? গাড়ি থেকে নেমে তুলির পাশে এসে দরজা খুলে দিল প্রণয়। তুলি তখনও মূর্তির মতো বসে আছে। প্রণয় বলল,” নামুন।”

তুলি থতমত খেয়ে বলল,” এইভাবে নামব?”

প্রণয় বিনয়ের সাথে বলল,” ও। ভুলেই গেছিলাম। আপনি তো রানী এলিজাবেথ। আপনাকে নামানোর জন্য কি স্পেশাল কার্পেট বানাতে হবে? ”

তুলি বিরস মুখে নামল। তার গায়ে বিয়ের শাড়ি। পরনের জুতোটা হলো বাথরুমের স্যান্ডেল। এই অবস্থায় তার ওই রকম জাঁকজমকপূর্ণ রেস্তোরাঁয় ঢুকতে লজ্জা লাগছে। আবার ভয়ও লাগছে। ছেলেটা তাকে নিয়ে কি করতে চায়? প্রণয় রেস্তোরাঁয় প্রবেশ করেই বলল,” আমার খুব ক্ষিদে পেয়েছে। আমি অর্ডার দিচ্ছি। আপনি চাইলে রিসেপশনে গিয়ে ফোন করতে পারেন আপনার ফ্রেন্ডের কাছে।”

তুলি স্বস্তির নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল,” থ্যাঙ্কিউ। ”

তুলি যখন হেঁটে যেতে লাগল, তখন প্রণয় অকারণেই তার দিকে তাকিয়ে রইল। মেয়েটা লম্বা, রোগা আর ছিপছিপে শরীর, হাঁটার ভঙ্গিটাও একদম সহজ-সরল। প্রিয়ন্তীর মতো কোমর দুলিয়ে অতিরিক্ত ঢং করে হাঁটে না। এই মেয়েটি অন্য মেয়েদের থেকে একটু আলাদা বলাই যায়।

তুলি রিসেপশনের টেলিফোন থেকে রাইফাকে ফোন করল। এতোরাতে রাইফার জেগে থাকার কথা নয়। কিন্তু সে জেগেই ছিল। কয়েকবার রিং হতেই রাইফা সাথে সাথে রিসিভ করে বলল,” হ্যালো।”

” রাইফা, আমি তুলি বলছি।”

” বুঝেছি। বল, কি অবস্থা?”

” তুই বুঝলি কি করে?”

” অপরিচিত নাম্বার দেখেই বুঝেছি। তোর ফোন তো খাটাশ মামা নিয়ে গেছে তাই না? কোথা থেকে ফোন করেছিস?”

” জানিস না তো রাইফা কতকিছু ঘটে গেছে। শোন তোকে আমি একটা একটা করে বলছি। আমি না, একটা স*/ন্ত্রা/*সীর পাল্লায় পড়ে গেছি। তার পকেটে চাকু ছিল। আমার গলায় চাকু ধরে মে/*রে ফেলার হুমকি দিয়েছে। সে আমাকে কই নিয়ে যাচ্ছে আমি জানি না। হয়তো আমি কিডন্যাপ হয়ে যাচ্ছি। আমার খুব ভয় লাগছে রাফু!”

রিসেপশনের লোকটি এসব কথা শুনে বড় বড় দৃষ্টিতে তুলির দিকে তাকিয়ে রইল। ওইপাশ থেকে রাইফা বলল,” কি বলছিস এসব আবোল-তাবোল? তন্বির থেকে শুনলাম তোর আজকে বিয়ে হওয়ার কথা ছিল। তুই নাকি পালিয়ে গেছিস। কিন্তু পালিয়ে কার কাছে গেছিস? আর তাকে কি তুই চিনিস না? না চিনলে তার সঙ্গে গেলি কেন?”

তুলি রাইফার প্রশ্নের উত্তর দিল না। কারণ রিসিপশনিস্ট তাকে পেছন দিকে তাকাতে বললেন। তুলি পেছনে ঘুরতেই থতমত খেল। প্রণয় দাঁড়িয়ে আছে হাত ভাঁজ করে। চোখমুখ শক্ত। তার নাকের ডগা হালকা লালচে দেখাচ্ছে। তুলি হতাশ ভঙ্গিতে ফোনটা নামিয়ে রাখল৷ প্রণয়ের চেহারায় রাগ। তুলি মাথা নিচু করে ভীত কণ্ঠে বলল,” আমার ফ্রেন্ডের কাছে আপনার প্রশংসা করছিলাম..”

চলবে

*❤

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here