বেলাশেষে পর্ব -১৫

#বেলা_শেষে। [১৫]

আলো- আঁধারের স্নিগ্ধ মিতালিতে ঝলমল হয়ে উঠে জ্যোৎস্নাপ্লাবিত রাত। এমন রাতে অস্পষ্ট মায়ালোকে নিমজ্জিত থাকে প্রকৃতি। এমন একটি মন মাতানো রাত কার না পছন্দ। সদ্য বিয়ে করা দম্পতি গুলো ব্যাস্ত হয়ে পড়ে জ্যোৎস্না বিলাসের। ব্যার্থ প্রেমিক বেলকনিতে বসে নিকোটিনের ধোয়া উড়িয়ে মনে করতে থাকে তার সেই প্রিয় মুহূর্তকে। এমন একটি জ্যোৎস্নাময় রাতে বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে ভূমিকা। গ্রিলের উপর হাত রেখে এই নিস্তব্ধ শহরটার দিকে তাকিয়ে এক মনে ভেবে যাচ্ছে সে। দু-দিন কেটে গেলো অথচ একটা টিউশানির জোগাড় করতে পরে নি সে। বাকি দিনগুলো কি ভাবে কাটাবে সে সেই ভাবনায় ডুবে আছে।

ভূমিকা বাড়ি থেকে বেড়িয়ে নিতুর কাছে চলে আসে। নিতু আর ওর কাজিন পাশের গলিতেই একটা ভাড়া বাড়িতে থাকে। আগে নিতুর কাজিন নয়না একাই থাকতো এখানে। চাকরি সুত্রে এখানে থাকেন তিনি। এখন তিনজনে মিলে থাকছে এই ভাড়া বাড়িতে। মাস শেষে তো বাড়ির ভাড়া মেটাতে হবে। কি করে মেটাবে সেই ভাড়া। এখনো কোন কাজের সন্ধান পেল না ভূমিকা। জানালার গ্রিলটা শক্তকরে চেপে ধরে দু-চোখ বন্ধকরে রইলো কিছুক্ষণ। তারপর আবার রুমে চলে আসলো। নিতু আর নয়না আপু ঘুমিয়ে গেছে। নিতুর ঘুমানোর স্টাইল দেখে হেসে ফেলল ভূমিকা। এই মেয়েটা এত বড় হয়েছে তবুও কেমন বাচ্চাদের মতো মুখে আঙ্গুল দিয়ে ঘুৃমাচ্ছে। মাথার নিচে বালিশ নাই। অথচ এক পায়ের নিচে পরে আছে বালিশ। আর মাথার নিচে রয়েছে নিতুর হাত। ভূমিকা বালিশটা নিয়ে নিতুর মাথার নিচে দিলো। তারপর ওর মুখ থেকে আঙ্গুল বের করে গায়ে কাথা দিয়ে দিলো। নিতুর পাশে গিয়ে শুয়ার সময় ভূমিকার মাথায় দুষ্ট বুদ্ধি আসলো। সে উঠে ফ্রিজ থেকে মিষ্টির বাটি বের করে নিতুর আঙ্গুলে মিষ্টির ঝোল লাগিয়ে দিলো। তারপর ফ্রিজে মিষ্টির বাটি রেখে আবার আগের জায়গায় এসে বসলো। কিছুক্ষণ পর নিতু আবারও ওর আঙ্গুল মুখে পুরে দিলো। এই দৃশ্যটা দেখে ঠোট চেপে হাসলো ভূমিকা। অতঃপর বলল,

-মিষ্টি আঙ্গুল খাও বোনু। তারপর ভূমিকা কাথা মুড়িয়ে শুয়ে পড়ে।

সপ্তাহ খানেক পড়েই দিগন্তের এক্সাম। পড়াশুনা নিয়ে এখন ভিষন ব্যস্ত সে। কোনদিকে মন দেওয়ার সময় নাই তার। যদিও ভূমিকা চলে যাওয়ার পর ওকে খুজার চেষ্টা করেছে। কিন্তু কোথাও খুজে পায়নি সে। এদিকে মাশহুদ কল করে শুধু ভূমিকার কথা জানতে চাইছে। কেননা ভূমিকা তার মোবাইল বন্ধকরে রেখেছে। তাকে কলে পাচ্ছে না মাশহুদ। দিগন্তের একের পর এক বাহানা দিয়ে তার কথা এড়িয়ে যাচ্ছে। কিন্তু মাশহুদ সে চিন্তায় তার পেসার হাই করে ফেলেছে। কবে যানি স্ট্রোক করে বসে।

বেশ মনোযোগ দিয়ে পড়ছে দিগন্ত। এক্কেবারে বইয়ের ভেতরে মুখ গুজে পড়ছে। এমনি সময় দিগন্তের মোবাইলে একটা ম্যাসেজ আসলো। আজকাল সিম কম্পানি থেকে সারাদিন একের পর এক মেসেজ আসতেই থাকে। তাই সেটাকে পাত্তাদিলো না দিগন্ত। পরো আবারও একটা মেসেজ আসলো। একসাথে দুটো এস এম এস। তাই দিগন্ত মোবাইল হাতে নিলো। পাওয়ার বাটনের চাপ দিতেই মিমির নাম ভেসে উঠলো। দিগন্ত মেসেজটা ভিও করে নিলো।

-মিস্টার হ্যান্ডসাম এখনি আমার বাসার সামনে আসুন। আমি নিচে অপেক্ষা করছি।

এই মেয়েটা আমাকে ফেল করিয়ে ছাড়াবে। বিরক্তি নিয়ে বলে মোবাইল পাশে রেখে দেয়। কিছুক্ষণ নিশ্চুপ হয়ে বসে থাকে। কিছুক্ষণ মৌনতা অবলম্বন করে আবার মোবাইল হাতে নেয়। মিমিকে বলতে হবে, আমি আসতে পারবো না। না হলে এই পাগলীটা অপেক্ষা করবে। ভাবতে ভাবতে মিমির নাম্বারে ডায়াল করে দিগন্ত। দুর্ভাগ্যবশত মিমির মোবাইল সুইচ অফ দেখাচ্ছে। মোবাইল পকেটে পুরে উঠে দাঁড়ায় দিগন্ত। মিমি ইচ্ছে করেই মোবাইল বন্ধকরে রেখেছে। এটা সে ভালো করেই বুঝতে পারছে । এমন কাজ মিমি মাঝে মাঝেই করে। হঠাৎ করে কল করে বলবে, দেখা করতে। তারপর দিগন্ত যে বলবে সে দেখা করতে পারবে না। একটু ব্যস্ত সেই সুযোগটাও নাই। মিমি মোবাইল বন্ধকরে রেখে দেয়। বাধ্য হয়েই যেতে হয় দিগন্তকে।

মিমির বাড়ির সামনে বাগানে দাঁড়িয়ে আছে দিগন্ত। ঢাকা শহরে সব উচু উচু দালানের মধ্যে মিমিদের বাড়িটা নিত্যান্তই সাধারন। দু-তলা বিশিষ্ট এই বাড়ির সামনে অনেকটা জায়গা জুরে রয়েছে নানা রকমের গাছ। বিশাল তেতুল গাছের নিচে বসে তেতুল খাচ্ছে মিমি। আর আড় চোখে দিগন্তকে দেখছে। দিগন্ত মন মরা হয়ে দাড়িয়ে আছে। দিগন্তের এমন মুখ দেখে মিমির পচন্ড রাগ হচ্ছে। আসলে দিগন্ত যখন মিমির সাথে দেখা করতে আসে প্রতিবারই একটা করে সাদা গোলাপ নিয়ে আসে। আর সেটা নিজ হাতে মিমির চুলে গুজে দেয়। আজ অনেক রাত, দেকান পাট সব বন্ধ তাই ফুল নিয়ে আসতে পারেনি। আর এজন্যেই মিমির অভিমান হয়েছে। সে দিগন্তের সাথে কথা বলছে না। আকাশের দিকে তাকিয়ে চাঁদ দেখছে আর মিটমিট করে হাসছে।

দিগন্ত গিয়ে মিমির পাশে বসলো। তারপর একহাত দিয়ে মিমিকে জড়িয়ে নিয়ে বলল,

-এত রাতে এভাবে ডাকার কোন মানেই হয় না। সামনে আমার এক্সাম সেটা ভুলে গেছো তুমি। মিমি কোন জবাব দিলো না।

-কি হলো মিমি কিছু বলছো না যে।

-চল না আমরা বিয়ে করে ফেলি। তড়িৎগতিতে ছুড়ে দেওয়া মিমির প্রশ্ন শুনে চমকে উঠলো দিগন্ত। মিমির কাদ থেকে হাত সড়িয়ে নিয়ে সোজা হয়ে বসলো। তারপর বলল,

-কি হলো চুপচাপ হয়ে গেলে কেন? বিয়ে করবে না আমাকে?? [মিমি]

অসহায় মুখ নিয়ে মিমির দিকে তাকালো দিগন্ত। অতঃপর বলল, তোমাকে অনেক কিছুই সহ্য করতে হবে। তুমি পারবে না মিমি আমার জন্যে লড়াই করতে??

-আমি তোমার কথার মানে বুঝতে পারছি না দিগন্ত।

দিগন্ত মিমিকে এক হাত দিয়ে জড়িয়ে নিলো তার বুকের সাথে। অতঃপর বলল,

– তোমাকে বিয়ে করার আগে আমার আর ভূমির ডিভোর্স টা হতে হবে। যেহেতু আমাদের পরিবার থেকে বিয়ে হয়েছিলো তাই ডিভোর্সটা সেখান থেকেই হওয়া দরকার। আব্বা হয়তো জেদ ধরে বসতে পারে তিনি আমাদের ডিভোর্স হতে দিবেন না। তখন কি হবে সত্যিই জানা নেই আমার।

দিগন্তের কথা শুনে মিমি শক্তকরে দিগন্তকে চেপে ধরলে। জড়ানো গলায় বলল, তোমার জানা নেই মানে!! আমি তোমাকে হাড়াতে পারবো না দিগন্ত। তোমার যদি কোথাও যেতে ইচ্ছে হয় তাহলে আমাকে মেরেফেলে তারপর যাও। আমি তোমাকে কারো পাশে দেখতে পাড়বো না। জানো যখন কারো উপর অধীকার পড়ে যায় না, তখন তার পাশে অন্যকাওকে দেখাকা অনেক যন্ত্রণাদায়ক।

দিগন্ত এবার মিমিকে দু-হাতে জড়িয়ে ধরলো। অতঃপর বলল,
-এই পাগলী কাঁদছ কেন? আমি কোথাও যাচ্ছি না। দিগন্ত তোমার ছিলো, তোমারই থাকবে?? আচ্ছা তোমার কি মনে হয় তোমাকে ছাড়া আমি ভালো থাকতে পাড়বো। কখনোও না। এত অপেক্ষার পর তোমার মনে জায়গা করে নিয়েছি। এই দখলদারি আমি কিছুতেই ছাড়বো না।

দিগন্তের এই কথায় হেসে দিলো মিমি।

খন্দকার আজহার মাওদুদ আজ নিজের হাতে কফি করেছে। তার একমাত্র নাতিকে খাওয়াবে বলে কথা। আরাভ ঘুমিয়ে ছিলো তখন আজহার কফির মগ হাতে নিয়ে আরাভের রুমে আসে। জানালার পর্দা খুলে দিলেন আজহার। যার ফলে সূর্যে লাল রশ্নি এসে পড়ছে আরাভের মুখের উপর। আরাভ চোখ মিটমিট করছে। এখনি ঘুমের রেশ কাটিয়ে চোখ মেলে তাকাবে সে। কিন্ত সেটা হলো না, আরাভ মুখের উপর চাদর টেনে উল্টোদিকে ঘুরে শুইলো। আজহার আরাভের পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। তারপর আরাভকে ডাক দিলেন,

-দাদুভাই,,,,

চট করে চোখ খুলে আরাভ। পিছনের দিকে ঘুরে আজহারকে কফির মগ হাতে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে,

-দাদু তুমি কফি হাতে আমার রুমে। সারভেন্টরা সব কোথায়??

আজহার আরাভের পাশে বসলেন। তারপর আরাভকে কফির মগ দিয়ে বললেন,

-তোমার কি হয়েছে দাদুভাই? কেন সারাক্ষণ নিজেকে রুমের ভিতরে আটকিয়ে রাখছো। বৌমা বলল, তুমি নাকি দু-দিন ধরে অফিসে যাচ্ছো না?

আরাভ একটু হাসার চেষ্টা করলো। তারপর মৃদু সূরে বলল,
-আমি ঠিক আছি দাদু। আজ অফিসে যাব। বলেই উঠে দাঁড়ায় আরাভ। আজহার বুঝতে পারছে আরাভ তাদের সকলের কাছ থেকে কিছু লুকাচ্ছে। কিন্তু কি লুকাচ্ছে সেটাই ভাবছে সে।

-দাদু, হোয়াট আর ইউ থিংকিং সো মাচ?

-নাথিং। অতঃপর আজহার চলে যায়। আরাভ ফ্রেশ হয়ে চলে আসে বেলকনিতে। আকাশের দিকে তাকিয়ে বিরবির করে বলে উঠলো,

-তোমার এমন বদলে যাওয়া পুড়িয়ে মারছে রোজ। রাতের আধার সঙ্গি হলো, চাঁদের হলো দুখ।

বুকের বা পাশে হাত রাখলো আরাভ। তারপর আবার বলল,জানো এই খান টায় খুব যন্ত্রণা হয়। আমি তোমার প্রেমানলে পুড়ে পুড়ে অঙ্গার হয়ে যাচ্ছি। ব্যর্থতায় এত কষ্ট এত যন্ত্রণা সেটা আগে জানা ছিল না আমার। না হলে কোন দিন কাওকে ভালোই বাসতাম না। আকাশ পরিমান ভালোবেসেছি আমি তাও সেই ভুল মানুষকে। এতটা ভালোবাসার পরেই আমার ভালোবাসা কোন দিনও পূর্ণতা পাবে না। এর গ্লানি সারাজিবন আমাকেই বয়ে বেড়াতে হবে।

কলেজে যাওয়ার জন্যে রেডি হচ্ছে ভূমিকা আর নিতু। বেচারি নিতু গাল ফুলিয়ে রেখেছে। রাতে ভূমিকা ওর আঙ্গুলে মিষ্টির ঝোল লাগিয়ে দিয়েছিলো যার কারনে হাতে প্লাস মুখে পিঁপড়ায় কামড়িয়েছে ওকে। নিতু পণ করেছে আর সারাদিনে সে ভূমিকার সাথে কথা বলবে না। এদিকে ভূমিকা নিতুর মুখের ভঙ্গি দেখে ঠোট চেপে হাসছে। এমনি সময় নয়না আসলো ওদের কাছে। আর ভূমিকাকে বলল,

-তোমার টো টিউশানি যোগাড় হলো না। আর হবে কি না সেটাও জানা নেই। বলছি যে, তুমি চাকরি করতে পারো। করবে চাকরি।

নয়নার কথা শুনে ভূমিকা এক চিলতে আশার আলো খুজে পেলো। উৎফুল্ল হয়ে জিগ্যেস করলো, কোথায় চাকরি করবো আপি??

-আমাদের অফিসে। আচ্ছা আমি বসের সাথে কথা বলে দেখবো কেমন। এখন তোমরা কলেজে যাও। আর হ্যাঁ তোমার ওই নাম মাত্র স্বামির সাথে ভুলেও কথা বলবে না। ওই রকম একটা মানুষের জন্যে তোমাকে কষ্ট পাওয়াটা মানায় না। যতটা সম্ভব দূরে থাকবে তার থেকে।

-আমি কষ্ট পাচ্ছি না আপু। উধরে হাসি ফুটিয়ে বলল ভূমিকা।

-না পেলেই ভালো। এখন কলেজে যাও। অতঃপর ভূমিকা মাথা নাড়ালো। সে দিগন্তের সাথে কোন সাক্ষাত করবে না।

ভূমিকা আর নিতু কলেজে যাচ্ছে। হেটেই যাচ্ছে। ওদের বাসা থেকে কলেজ খুব একটা দূরে নয়। নিতু গাল ফুলিয়ে ভূমিকার থেকে দু-কদম এগিয়ে হাটছে। ভূমিকা নিতুর পিছন পিছন যাচ্ছে আর ঠোট চেপে হাসছে। এমনি সময় একটা ছেলে এসে ভূমিকার সামনে এক গুচ্ছ লাল গোলাপ দিয়ে বলল, ওই ভাইয়াটা আপনাকে দিয়েছে।

ছেলেটার কথা শুনে কপাল কুচকিয়ে তাকালো ভূমিকা।

চলবে,,,,,,,

#লেখিকা- মাহফুজা আফরিন শিখা।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here