বেলাশেষে পর্ব -১৪

#বেলা_শেষে। [১৪]

-আপনি? অস্ফুটভাবে ছুঁড়ে দেওয়া ভূমিকার প্রশ্নে সোজাসাপ্টা জবাব দিলো আরাভ,

-এদিক দিয়েই যাচ্ছিলাম। তখন দেখলাম আপনি বৃষ্টিতে ভিজছেন তাই এগিয়ে আসলাম। এনি ওয়ে দিগন্ত কোথায়?? আরাভের কথার একটু হাসলো ভূমিকা যেটা দেখা যায়নি। তবে কেও যাদি খুব যত্নকরে দেখে তাহলে এই হাসিটা দেখতে পারবে। সমানে তাকিয়ে কোন ভাবে জবাব দিলো, ও আসে নি। তারপর চলে যাওয়ার জন্যে সামনে পা বাড়াতেই আরাভ আবার ওর মাথায় ছাতা ধরে।

-ছাতাটা নিয়ে যান। দীর্ঘ সময় বৃষ্টিতে ভিজলে ঠান্ডা লেগে যাবে।

-এসবে আমার অভ্যস আছে। এবার আরাভের দিকে ঘুরে দাঁড়ালো ভূমিকা । আরাভের দিকে লক্ষ করতেই দেখতে পেলো আরাভ ওর উপরে ছাতা ধরে রেখে নিজেই বৃষ্টিতে ভিজছে। মৃদু হাসলো ভূমিকা। তারপর আরাভকে বলল,

-ঠান্ডা আমার নয় আপনার লাগবে মিস্টার আরাভ। ছাতা আমার নয় আপনার দরকার। বলেই বড় বড় পা ফেলে ভূৃমিকা চলে গেলো। আরাভ ছাতাটা ছুঁড়ে ফেলে দিলো রাস্তার মাঝখানে। তারপর হাটুগেরে বসে পড়লো। আকাশের দিকে তাকিয়ে দু-হাত দুদিকে প্রসারিত করে জোড়ে চিৎকার করলো। বৃষ্টির কারনে রাস্তায় মানুষ জনের কোন সমাগম নেই।আর নেই কোন টাফিক পুলিশ। নাহলে টাফিক পুলিশ এসে আরাভকে তুলে নিয়ে যেত।

ভেজা শরীরে বাসায় ফিরতেই জুবাইদা ব্যস্ত হয়ে পরে ছেলেকে নিয়ে। সাথে গাড়ি থাকতেও তার ছেলে বৃষ্টিতে ভিজছে এটা তার কাছে অস্বাভাবিক লাগছে। কেননা আরাভ খুব একটা বৃষ্টি পছন্দ করে না। যখনি বৃষ্টিতে ভেজে তখনি জ্বর হয়। মোদ্দাকথা বৃষ্টি থেকে সব সময়ই দূরে থাকে আরাভ। আর আজ সেই আরাভ কিনা বৃষ্টিতে ভিজছে। জুবাইদা অনেক বার আরাভকে জিগ্যেস করেছে কেন যে বৃষ্টিতে ভিজছে। প্রতিবারই আরাভ তার প্রশ্ন এড়িয়ে গেছে।

জানালার কাচের ওপর আছড়ে পড়া ফোঁটাগুলো আর ল্যাম্পপোস্টের নিচের আলোতে ঝিরঝির করে ফোটায় ফোটায় পড়তে থাকা বৃষ্টিকণাগুলো নিবিড়ভাবে তাকিয়ে দেখলে এতটাই অপূর্ব লাগে যে, পৃথিবীর কোনো উপমা দিয়ে তার প্রকাশ ঘটানো যাবে না। বৃষ্টি যতই তীব্রতর হতে থাকে অনুভূতির মাত্রা আরও গাঢ় হতে থাকে। অনেক দূরে পেছনে ফেলে আসা ঝাপসা স্মৃতি, তুচ্ছ রাগ শোক অথবা অনেক সুখের কোনো মুহূর্ত যে কারো ভেতরটাকে এতটাই শিহরিত করে যে মনে হয় কেউ একজন তার জীবনের ডায়েরি থেকে প্রতিটা লাইন নির্ভুলভাবে পাঠ করে যাচ্ছেন। নরম চেয়ারে একবার পিঠটা ঠেকিয়ে বসলো ভূমিকা। সেই কখন মেঘলা আকাশের বিষণ্নতা দেখতে—আর সেটা কিনা তাকে নেশার মতো আটকে ধরেছে যেন আর উঠতেই ইচ্ছে হবে না কোনো দিন।

কালের এই ক্ষুদ্র ক্ষণটিকে উপভোগ করা, হাজার বছর বেঁচে থাকার চেয়েও গৌরবময়। অপ্রসন্ন ও প্রশান্তিবিহীন চিত্ত নিয়ে সুদীর্ঘকাল বেঁচে থাকার চেয়ে শুধুমাত্র একটি পরিতৃপ্ত স্বল্পদৈর্ঘ্য অস্তিত্বের স্বাদ নিয়ে পৃথিবীতে বেঁচে থাকা বেশি সৌভাগ্যজনক।

জানালা দিয়ে হাত বাড়িয়ে বৃষ্টি ধরে রাখার ব্যর্থ চেষ্টা করছে ভূমিকা। বৃষ্টিশেষে আকাশে যেমন রংধনু সাত রং নিয়ে হাজির হয়। এক স্বচ্ছ আকাশ। যেখানে মেঘের কোন ছিটেফোঁটা নেই। রৌদ্রউজ্জল আকাশ।ভূমিকার মনটাও আজ তেমনি ফুরফুরে। মনের উপর থেকে অনেক বড় একটা বোঝা নেমে গেছে তার। কাল সকালে সূর্য উঠার সাথে সাথে ভূমিকার জিবনে শুরু হবে এক অধ্যায়। সেখানে দিগন্তের কোন ছায়া থাকবে না। সে জিবনে থাকবে শুধু ভূমিকা আর তার স্বপ্ন। একই ছাদের নিচে থেকেও যদি স্বামি স্ত্রীর মাঝে এক সমুদ্র দুরত্ব থাকে তাহলে সেই সম্পর্কে টেনেটুনে লম্বা না করাই বুদ্ধিমানের কাজ। আসলে ভূমিকা আর দিগন্তের একসাথে সংসার। করা হবে না কোনদিনও। আসলে হঠাৎ করে কোন সিদ্ধান্ত নেওয়াটা ঠিক না। সেদিন যদি একবার মাশহুদ দিগন্তের বিয়ে না করার কারনটা জানতে চাইতো তাহলে আজ ওদের জিবনে এমন দুর্বিষহ নেমে আসতো না। তাই যে কোন সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে সবার মাতামত নেওয়াটা অত্যন্ত জরুলি।

বিছানায় শুয়ে এপাশ ওপাশ করছে আরাভ। ঘুম কিছুতেই তার দু-চোখের পাতায় ধরে দিচ্ছে না। ঘুমানোর জন্যে চোখ বন্ধ করলেই ভূমিকার সেই বিষণ্ণ মুখ চোখের সামনে ভেসে উঠছে। আর আরাভের বুকের ভেতরটা ছেদ করে উঠছে। ভূমিকার এই বিষন্ন মুখ আরাভ যে কিছুতে সহ্য করতে পারছে না। বারবার কেন ভূুমিকার মুখটা ভেসে উঠছে পর দু-চোখের পাতায়। কিন্তু আরাভ তো চায়না ভূমিকাকে মনে করতে,
-এই অবেলায় কেন এলে আমার শহরে। আমি যে তোমার মায়াজাল থেকে কিছুতেই বের হতে পারছি না। কেন অন্যের প্রিয়তমা হয়ে এলে। আমার ভালোবাসা হীন জিবনে তুমি এলে ঠিকই তবে #বেলা_শেষে।

বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো আরাভ। দেয়ালে সাঁটানো ঘড়ির দিকে তাকাতেই দেখতে পেল, রাত বারোটা বাজে বিয়াল্লিশ মিনিট। তার মানে এখনো আদনান ঘুমায়নি। আরাভ কিছুক্ষণ মৌনতা অবলম্বন করে বসে রইলো। তারপর সে চলে যায় স্টাডি রুমে। কারন আদনান এখনো সেখানে বসে বই পড়ছে।

স্টাডি রুমে আরাভকে দেখে বেশ অবাক হয় আদনান। কারন সে ছাড়া সচরাচর কেও এই রুমে আসে না বললেই চলে। আরাভের যখন বই পড়ার নেশা ধরে তখনি সে আসে এই রুমে।তবে সেটা মাসে এক কি দু-বার। আদনাদ বইয়ের মধ্যেই মুখ গুজে বললেন,

-কি বই লাগবে আমাকে বল, আমি দিচ্ছি।
আরাভ নিঃশব্দে ওর বাবার পাশে বসলো। তারপর শান্ত কন্ঠে আদনানের দিকে তাকিয়ে জিগ্যেস করলো,

-তোমার কাছে এমন কোন বই আছে কি, যেখানে কোন মানুষ অন্য প্রাণীতে রুপান্তরিত হয়। আরাভের কথায় একটু অবাক হয়নি আদনান। আরাভ বরাবরই সায়েন্স ফিকশন খুব পছন্দ করে। মোহাম্মদ জাফর ইকবালের প্রতিটা বই- ই তার পড়া শেষ। আদনানের এখনো মনে আছে। আরাভ যখন স্কাস সিক্স এ পড়ে তখন তিনি আদনানকে বই মেলায় নিয়ে যায়। আর সেখানে সেদিন উপস্থিত থাকে জাফর ইকবাল স্যার। হাজার মানুষের ভীড় ঠেলে আরাভ জারফ ইকবাল স্যারের সামনে গিয়ে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলে,

-স্যার আমাকে একটা অটোগ্রাফ দিবেন। আমি আপনার সব বই পড়েছি। একটু খানি বিঞ্জান বই পড়েছি। আরো একটু খানি বিঞ্জান বই ও পড়েছি। এখন আরো, আরো একটু খানি বিঞ্জান বইয়ের জন্যে অপেক্ষা করছি?? আরাভের কথায় সেদিন লেখক মুচকি হেসে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়েছিলো।

-কি হলো আব্বু, বলো আছে এমন বই??

-সায়েন্স ফিকশন পছন্দ করিস বলে এখন মানুষ থেকে প্রাণীতে রুপান্তরিত হওয়ার বই পড়বি।

-কি করো বলবো তোমাকে, আমি যে মানুষ হয়ে বাঁচতে পাড়ছি না।বুকের বা পাশটায় খুব যন্ত্রনা হচ্ছে। এখন যদি একটা পাখি হতাম তাহলে উড়ে চলে যেতাম এক অজানা শহরে। কথাগুলো মনে মনে বলল আরাভ।

আদনাদ একটা বই বের করে আরাভের সামনে দিয়ে বলল, এই নে, নৈঃশব্দ্যের কান্না বই। এটাতে অমিত নামের একটা ছেলে আছে যে মানুষ থেকে গাছে রুপান্তরিত হয়েছে। আরাভ আনমনে বলে ফেলল, আমিও যদি গাছ হয়ে যেতাম। অতঃপর আরাভ বই নিয়ে সেটা পড়তে শুরু করে। বইয়ের যদি পারে ভূমিকাকে ওর মাথা থেকে দূরে সড়াতে।

রাতভর তুমুল বর্ষণের পর সকালবেলা ঝলমলে রোদে ভেসে যাচ্ছে চারপাশ। দিগন্ত ঘুম থেকে উঠে সামনের বারান্দায় গিয়ে বাইরে তাকিয়েই মুগ্ধ হয়ে যায়। সবুজ গাছ-গাছালির ডগায় সকালের কচি সোনা রোদ যেন আহলাদে ঢলে ঢলে পড়ছে। ভাল লাগে দিগন্তের । ইচ্ছে করে অনেকক্ষণ ধরে সবুজের বুকে রোদের হুটোপুটি খেলা দেখতে। সে বারান্দার গ্রীলে মাথা রেখে আনমনে তাকিয়ে থাকে বাইরের দিকে।

সুখের কোন রং হয় কি-না দিগন্তের জানা নেই। কিন্তু এই মুহূর্তে দিগন্তের মনে হচ্ছে সময়টা সুখের রং জড়িয়ে ওর সামনে হাজির হয়েছে। দিগন্ত ইচ্ছে করে রঙিন এই সুখকে গায়ে মেখে নিতে। গ্রীলের ফাঁক দিয়ে বাইরে হাত বাড়ায় দিগন্ত । তারপর সেই হাত আলতো করে মুখে ঘষে। আর তখনি কেও এসে ওকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে। কিন্ত কে ধরেছে সেটা বুঝতে অসুবিধা হয়নি দিগন্তের। এর আগেও যখন দিগন্ত রাগ করতে তখনো তার রাগ ভাঙানোর জন্যে মিমি এইভাবে তাকে জড়িয়ে ধরে পিঠে মাথা রেখে আহ্লাদী সুরে বলল, আমার ভুল হয়েছে। আনাকে মাফ করে দাও প্লিজ। এবারও তার ব্যতিক্রম হলো না।

মিমিকে পেয়ে দিগন্ত যেন হাতে চাঁদ পেয়েছে। এতটাই খুশি সে। সে মিমিকে সামনে এনে জড়িয়ে ধরে রইলো কিছুক্ষণ। বুকের ভেতরের ব্যথাটা এখন ধীরে ধীরে উপশম হচ্ছে। বেশ শান্তি লাগছে এখন তার। মিমি দিগন্তের বুকে মুখ গুজে বলল,

-তোমাকে অনেক কষ্ট দিয়েছি তাইনা। জানো যখন শুনলাম তুমি বিবাহিত তখন আমার কি অবস্থা হয়েছিলো। আমার পুরো পৃথীবি ঘুরতে ছিলো। চোখের সামনে সব কিছু অন্ধকার দেখছি সব। ভেবেছিলাম হয়তো মরেই যাব। কিন্তু কাল ভূমি এসে আমাকে সত্যিটা না বললে আমি হয়তো মরেই যেতাম। ভূমিকার কথা শুনতেই দিগন্ত মিমিকে ছাড়িয়ে ওর দিকে জিগ্যেসু দৃষ্টিতে তাকালো। তারপর অবাকের সুরে বলল,

-কি বলেছে ভূমি???

-তোমাদের এই বিয়ের কথা। তোমাকে যে জোড় করে বিয়ে করিয়েছে তোমার বাবা সেটা।

-আর কি বলেছে??

-ভূমি তোমার আর আমার মাঝখান থেকে চলে যাবে। ইন ফ্যাক্ট আজ তো ওর বাসা থেকে চলে যাওয়ার কথা।

-হোয়াট। কোথায় যাবে ভূমি।

-তুমি এত অবাক কেন হচ্ছো দিগন্ত। ভূমি যেখানেই যাক তাতে তোমার কি যায় আসে??

-মিমি, এই শহরে আমি ছাড়া ওর পরিচিত কেও নেই। আমার সাথে এই শহরে এসেছে ভূমি। কোন রাস্তা অলিগলি কিছুই চেনে না সে। যদি কোন বিপদে পড়ে তাহলের তার জবাবদিহি আমাকেই করতে হবে। ভূমিকে ডাকো। ভূমি ভূমি, এই স্টুপিড মেয়েটা কোথায় গেলো। দিগন্তের ডাকে ভূমিকা সাড়া দিলো না তাই দিগন্ত ভূমির রুমে যায়।কিন্তুু সেখানেও দেখতে পায়না ভূমিকাকে। তাহলে কি ভূমিকা চলে গেছে। হয়তো, রুম থেকে ফিরে আসার সময় চোখ পড়ে টেবিলের উপর একটা সাদা কাগজ দোল খাচ্ছে। দিগন্ত গিয়ে সেটা হাতে নেয়। তাতে কিছু লেখা আছে। দিগন্ত সেই লেখাটা পড়তে শুরু করে,

-আমার খোঁজ করবে না। আমি যেখানেই থাকবো ভালো থাকবো। আর হ্যাঁ আপনার যখন মনে হবে এখন ডিভোর্স দরকার, আমাকে ডাকবেন চলে আসবো। অন্যথায় ডিভোর্স পেপার পাঠিয়ে দিবেন।

ভূমিকা চলে যাওয়ায় বেশ চিন্তিত হয়ে পড়ে দিগন্ত। কোথায় গেলো ভূমিকা। মিমি দিগন্তের এক হাত জড়িয়ে ধরে কাঁদে মাথা রাখলো। তারপর বলল,

-তুমি শুধু শুধু চিন্তা করছো ওকে নিয়ে। আমার মনে হয়না ভূমিকা কোন বিপদে পড়বে। ভূমিকা খুব স্ট্রোং মেয়ে। না হলে যে সময় সব মেয়ে নিজেদের সম্মান বাঁচানোর জন্যে আকুতি মিনতি করে। সেই সময় ভূমিকা নিজেকে শক্ত রেখে হাতে লাঠি তুলে নেয়। সব মেয়েদের ই ভূমিকার মতো সাহসী হওয়া দরকার। দিগন্তকে শান্ত করার জন্যে কথাগুলো বললেও ভেতরে ভেতরে সেও পয় পাচ্ছে, বিপদ কখন কোন দিক থেকে আসে সেটা বলা মুশকিল।

চলবে,,,,,,

#লেখিকা- মাহফুজা আফরিন শিখা।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here