বৌপ্রিয়া পর্ব -১৪+১৫

#বৌপ্রিয়া
#আভা_ইসলাম_রাত্রি
#পর্ব – |১৪|

‘ আপা আমার ভয় হচ্ছে কুসুমকে নিয়ে। এত ছোট বয়সে কুসুমকে স্বামীর ঘরে তুলে দেব? মেয়ে আমার সংসার সম্পর্কে বুঝেটাই বা কি? ‘

সাহেদার কথা শুনে পারুল বুঝতে পারেন অনেককিছু। তিনি বোনকে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করে বলেন,

‘ বুঝে না, আর বোঝার দরকারও নেই। আমি আছি না। আস্তে আস্তে সব বুঝিয়ে দেব। কুসুম আমার নিজের মেয়ের মতোই রে। আমার বাড়ি আমার মেয়েকে দিতে তোর এত কিসের ভয়? ‘

সাহেদা তবুও চিন্তিত। মেয়েকে নিয়ে চিন্তার পাহাড় জমেছে তার মনে। পারুল যে কুসুমকে নিজের মেয়ের মতোই গড়ে তুলবে, সেটা তিনি মনেপ্রাণে মানেন এবং বিশ্বাস করেন। কিন্তু তার চিন্তা সম্পূর্ন অন্য জায়গায়। কিন্তু সংকোচ হবার ফলে তিনি সেটা প্রকাশ করছেন না। যদি পারুল কিছু মনে করে বসেন। সাহেদাকে এখনও চিন্তিত চেহারায় বসে থাকতে দেখে পারুল এগিয়ে আসেন। বসেন বোনের পাশে। বোনের কাঁধে হাত রেখে বলেন,

‘ তোর আসলে কি নিয়ে চিন্তা হচ্ছে? এতদিন কিছু বলিস নি। আচমকা আজ এত চিন্তা কোথা থেকে এলো তোর? ‘

সাহেদা অসহায় চোখে বোনের দিকে তাকান। ভ্রু জোড়া বাঁকালে, পারুল আবার বলেন, ‘ আমাকে সব খুলে বল। এভাবে ভেতরে ভেতরে গুমড়ে মরলে চলবে? ‘

সাহেদা কিছুটা আশ্বস্থ হোন। তিনি সকল সংকোচ একপাশে রেখে কথা তুলেন,

‘ আপা, কুসুম এখনো অনেক ছোট। শারীরিক ভাবে এখনো ও অনেক দূর্বল। দেখই তো। খাওয়া দাওয়া করে না ঠিকমত। শুকিয়ে যাচ্ছে দিনদিন। এখন বিয়ে দিয়ে তুলে দেওয়া মানে বছর ঘুরতেই…’

সাহেদা থেমে যান। পারুল ভ্রু কুঁচকে চেয়ে আছেন সাহেদার দিকে। বাকি কথা শোনার জন্যে তিনি উদগ্রীব হয়ে আছেন। সাহেদাকে থামতে দেখে তিনি বিরক্ত হোন। বললেন, ‘ থামলি কেন? বল। বছর ঘুরতেই কি? ‘

সাহেদা অপ্রস্তুত হয়ে বলেন, ‘ যদি এই বয়সে কুসুম বাচ্চা নেয়, তবে এটা কুসুমের জন্যে মোটেও ভালো হবে না। ওর শরীর ভালো নেই। তাই বলছিলাম আরেকটু বড় হোক। বয়স হলে এমনিতেই শরীরে পরিপক্কতা আসবে। তখন নাহয়….’

পারুল হতভম্ব হয়ে যান। সাহেদার দিকে চেয়ে বিষ্ময় নিয়ে প্রশ্ন করে,

‘ তোর কি মনে হয়, আমাদের উচ্ছ্বাস এই বয়সে আদৌ কুসুমকে বাচ্চা নিতে দিবে? ও একজন ডাক্তার। ও জানে কোন বয়সটা বাচ্চা নেবার জন্যে সঠিক। তুই এমন অহেতুক চিন্তা কেন করছিস? ‘

সাহেদার মন মানে না। তিনি অধৈর্য্য হয়ে বলেন,

‘ আল্লাহ যদি বাচ্চা দিতে চান, তবে আল্লাহর হুকুম আটকানো যায় না আপা। যদি ভুলবশত…’

‘ কিছু হবে না ভুলবশত। আমি উচ্ছ্বাসের ভাবিকে দিয়ে ওর সঙ্গে কথা বলাব এই নিয়ে। তুই নিজেও কুসুমকে বুঝাস উষাকে দিয়ে। আর এসব চিন্তা মাথা থেকে ঝাড়। প্রেশার বাড়বে কিন্তু চিন্তা যাবে না। কুসুমের বয়স, কুসুমের স্বাস্থ্য, কুসুমের মানসিকতা সবদিক আমরা খেয়াল রাখব। ভরসা রাখ আমার উপর। আমি সব সামলে নেব। ‘

সাহেদা কি করবেন ভেবে পাচ্ছেন না। পারুল একপ্রকার চেপে ধরে রেখেছে তাকে। তাই না চাইতেও বোনের কথাতেই সায় দিতে হল তাকে।
__________________________
কুসুম-উচ্ছ্বাসের বিয়ে ঠিক হয় আগামী শুক্রবার। মঙ্গলবার গায়ে হলুদ এবং বৃহস্পতিবার মেহেদী অনুষ্ঠান হবে। দুই পক্ষ মিলে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। যখন থেকে কুসুম বিয়ের কথা শুনেছে, কুসুমের গলা শুকিয়ে যাচ্ছে। এতদিন বিয়ে হওয়া স্বত্বেও নিজেকে বিবাহিত মনে হয় নি কুসুমের।নিজের বাড়িতেই খেয়েছে, ঘুমিয়েছে, ফুর্তি করেছে। কিন্তু এখন বিয়ে হওয়া মানে উচ্ছ্বাসের সঙ্গে সংসার করা, তাদের বাড়িতে থাকা, রান্নাবান্না করা। এতকিছু কি করে সামলাবে কুসুম? কুসুম আপাতত সেই চিন্তাই করছে।

আজকে হয়ত কুসুমদের বাড়িতে মেহমান আসছে। তাই সকাল থেকে বাড়িঘর সাজানো হচ্ছে। কুসুমের কাজিরা সব সকাল থেকে তাদের বাড়িতে এসে বসে আছে। সবার সঙ্গে গল্প করে কুসুম মাত্রই ছাড়া পেল। উষা দুপুরের দিকে কুসুমের ঘরে এলো। কুসুম তখন সবে গোসল করে বেরিয়েছে। চুলের পানি ঘরময় ছড়িয়ে ছিটিয়ে পরছে। সেদিকে লক্ষ্য নেই কুসুমের। কুসুম আপাতত ব্যস্ত ড্রয়ার থেকে কাপড় বের করতে। গোসলে যাবার সময় ভুলবশত কাপড় নেয়নি। তাই এখন বাথরুব গায়ে দিয়ে কাপড় নিতে এসেছে। উষা ঘরে ঢুকে ঘরের মেঝে পানিতে ভেজা পেল। উষা বিরক্ত হয়ে বলল,

‘ এসব কি কুসুম? তোর চুলের পানিতে ঘর ভিজে যাচ্ছে। কবে চুলের পানি মোছা শিখবি? ‘

বলতে বলতে কুসুমের দিকে এগিয়ে যায় উষা। কুসুম ড্রয়ারে কাপড় খুঁজতে খুঁজতে বলে, ‘ শেখা লাগবে না। কারণ আমার আলসেমি লাগে। ‘

উষা ভ্রু কুঁচকে চায়। পরপরই টিপ্পনী কেটে বলে, ‘ হ্যাঁ, তাও ঠিক। কদিন পর উচ্ছ্বাসের হাতে চুলের পানি মোছার পাঁয়তারা করছিস তুই। তাহলে শিখবি কেন? ‘

কুসুমের বুক কেঁপে উঠে। মিছে বিরক্ত হবার ভান করে বলে, ‘ উফ! মজা করো না তো আপা। আমি আমার লাল স্কার্ট ওইটা পাচ্ছি না। ধুয়ে দেওয়া হয়েছে নাকি? ‘

উষা আরাম করে বিছানায় বসে। হাতে থাকা হালকা গোলাপী রঙের শাড়ি বিছানায় রেখে দুহাত ঠেসে রাখে বিছানায়। তারপর বলে,

‘ আজকে কিছু পড়ার দরকার নেই তোর। ‘

কুসুম এই কথা শুনে চমকে উঠে। দ্রুত উষার দিকে চেয়ে চেঁচায়,

‘ পাগল হয়েছ? আমি বাথরুব পরে বসে থাকব সারাদিন? উফ, আপা! খালি মজা করো না তো। আমি এমনি ডিস্টার্ব আছি কদিন ধরে। ‘

‘ কেন? বিয়ে হচ্ছে বলে? ‘

ড্রয়ারে কাপড় খুঁজতে থাকা কুসুমের হাত থেমে যায়। কুসুম মাথা তুলে অসহায় চোখে উষার দিকে চেয়ে নিষ্পাপ কণ্ঠে বলে, ‘ হু। যখন থেকে বিয়ের কথা শুনেছি, আসলেই খুব ভয় লাগছে।’

উষা হাসে। তারপর বলে,

‘ ভয়ের রাণী, ভয় সব পাশে রেখে জলদি জলদি এই শাড়ি পরে নে। গেস্ট আসছে। ‘

কুসুম প্রশ্ন করে, ‘ কে আসছে? ‘

উষা চোখ টিপে বলে, ‘ সে তো বলা যাবে না। তবে কেউ একজন আসছে। স্পেশাল কেউ। এখন যা। দ্রুত দুই কাপড় পরে আয়। শাড়ি তো পরতে পারিস না। আমাকেই পরিয়ে দিতে হবে। গো ফাস্ট।’

কুসুমের কেন যেন মনে হচ্ছে, উচ্ছ্বাস আসবে। কারণ যতবার উচ্ছ্বাস ভাইয়ের ব্যাপারে কিছু কাহিনী ঘটে, উষা আপা এভাবেই ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে উত্তর দেন। তবে আজকে কেন আসছে সে? সে ব্যপারে কিছুই জানে না কুসুম। উষা আবার তাড়া দিলে কুসুম দুই কাপড় নিয়ে বাথরুমে চলে যায়। বাথরুম থেকে বের হলে উষা খুব সুন্দর করে কুসুমকে শাড়ি পরিয়ে দেয়। কুসুমকে আয়নার সামনে দাঁড় করায়। কুসুম ঘুরে ঘুরে নিজেকে দেখে। এই শাড়িতে কুসুমকে খুব সুন্দর দেখাচ্ছে। কুসুম আবার প্রশ্ন করে,

‘ বললে না আপা, কিসের জন্যে আমার এই সাজগোজ? সত্যি করে বলবে, উচ্ছ্বাস ভাই আসছে? ‘

উষা কুসুমের মাথায় থাপ্পড় বসায়। শাসানোর স্বরে বলে, ‘ ভাই কি, হ্যাঁ? জামাইকে কেউ ভাই বলে? ‘

কুসুম বোকা বোকা কণ্ঠে বলে, ‘ কি বলে ডাকব তাহলে? ‘

উষা শাড়ির কুঁচি ঠিক করে দিতে দিতে বলে,

‘ আপাতত কিছু বলের ডাকার দরকার নাই। উনি করে বলতে পারিস। তুই উনি বললেই সবাই বুঝে যাবে কার কথা বলছিস। কিন্তু ভাই না। এটা খারাপ শোনায়। ‘

কুসুম মাথা দুলায়। আসলে ভাই বলা নিয়ে কুসুম নিজেই দ্বিধায় জড়িয়েছিল। উচ্ছ্বাসকে ভাই বলতে তার নিজেরও ভীষন অস্বস্থি হত। উষা আপা বুদ্ধি দিয়েছে। তাহলে আজ থেকেই সেটাই করবে কুসুম।
উষা শাড়ি পরিয়ে দিয়ে কুসুমকে বিছানায় বসিয়ে রেখে যায়। যাবার আগে সফসাফ বলে যায়, উষা না বলা অব্দি কুসুম যেন এই ঘর থেকে না বের হয়। কুসুম বাধ্য মেয়ের মত মেনে নিয়েছে উষার কথা। কিন্তু মনেমনে ভীষন কৌতূহল জেগেছে কুসুমের। কে আসছে আজ? কার জন্যে কুসুমের এত সাজগোজ? উচ্ছ্বাসের জন্যে?

কুসুমের ভাবনার মধ্যেই শোনা গেল বসার ঘর থেকে পরপর কয়েকটা বেলুন ফাটানোর শব্দ। সবাই মিলে হুই-হল্লোর করছে। সবার এত খুশির আয়োজন দেখে কুসুম বোকা বনে যায়। বিয়ের অনুষ্ঠান শুরু হবে আরো তিনদিন পর। তাহলে আজকে এত কিসের খুশির আয়োজন হচ্ছে তাদের ঘরে?
#বৌপ্রিয়া
#আভা_ইসলাম_রাত্রি
#পর্ব – |১৫|

খানিক পর সাহেদা হন্তদন্ত হয়ে রান্নাঘর থেকে কুসুমের ঘরে এলেন। কুসুম তখন উকি দিচ্ছিল দরজার ওপাশে। কে এসেছে, কার জন্যে এত আয়োজন এসব জানতে ও ভীষন কৌতুহলী। মা কে আসতে দেখে কুসুম দ্রুত পিছিয়ে গিয়ে বিছানায় বসে। সাহেদা ঘরে ঢুকেই বলেন,

‘ কুসুম তুই তৈরি আছিস? ‘

কুসুম উঠে দাঁড়ায়। আরো একবার শাড়ির কুচি ঠিক করা চেষ্টা করে বলে, ‘ হ্যাঁ মা। কিন্তু কে এসেছে? ‘

সাহেদা উত্তর দেন না। এগিয়ে গিয়ে কুসুমের মাথায় আঁচল তুলে দিয়ে বলেন, ‘ আমার সাথে আয়। ওদের চা করে দিবি। ‘

কুসুম এখনো বুঝে উঠতে পারছে না সবকিছু। এবার বড্ড অস্থির লাগছে কুসুমের। তবুও বাধ্য মেয়ের মত মায়ের পিছু পিছু চলল কুসুম। রান্নাঘরে যেতেই দেখতে পেল উষা চা বানাচ্ছে। কুসুমকে দেখেই উষা চায়ের কাপ সুন্দর করে ট্রে তে সাজিয়ে নিয়ে কুসুমের হাতে তুলে দিল। কুসুম ট্রে হাতে নিয়ে সটান দাড়িয়ে রইল মায়ের আদেশের জন্যে। উষা বলল,

‘ ফুপু, ওকে তুমি ওখানে নিয়ে যাও। আমি পায়েস দেখছি। ‘

সাহেদা আশ্বস্ত হলেন। পুনরায় বললেন, ‘ চিনি একটু চেকে নিস। কম পরলে দিয়ে দিস কিছু। ‘

উষা মাথা দোলালো। সাহেদা মেয়ের কাধে হাত চেপে তাকে নিজের কাছে নিয়ে এলেন। অতঃপর মেয়ের সঙ্গে চলেন বসার ঘরে। বসার ঘরের সামনে যেতেই কুসুম শুনতে পেল উচ্ছ্বাসের কণ্ঠস্বর। হেসে হেসে কোনো এক বাচ্চার সঙ্গে খেলছে। প্রিয় পুরুষের কণ্ঠ শুনেই কুসুম সেখানেই জমে গেল। ওরা আবার এসেছে? কুসুম মায়ের সঙ্গে বসার ঘরে ঢুকল। বসার ঘরে ঢুকতেই চমকে উঠল কুসুম। উচ্ছ্বাসের পুরো পরিবারকে বগলদাবা করে খালামনি ওদের বাসায় এসেছেন। দুই সেট সোফায় ওদেরকে জায়গা দেওয়া যাচ্ছে না। কেউ চেয়ারে, কেউবা মাদুর পেতে নিচে বসেছে। সবার সামনে ফলমূল, মিষ্টি রাখা। বাচ্চারা উচ্ছ্বাসের পাশেই খেলাধূলা করছে। উচ্ছ্বাসের সামনে একেকজন আসছে, আর উচ্ছ্বাস ওদের মুখে একটু একটু করে মিষ্টি কাটা চামচ দিয়ে তুলে দিচ্ছে। উচ্ছ্বাসের কি বাচ্চা খুবই পছন্দ? সবসময় কুসুম দেখে, উচ্ছ্বাস বাচ্চাদের সঙ্গে খেলা করতে থাকে। তাদের সঙ্গে থাকলে উচ্ছ্বাসের দিন দুনিয়ার খবর থাকে না। মজে যায় তাদের পবিত্রতার সঙ্গে। কুসুমের হঠাৎ করে মনে হল, বিয়ের পর যদি তাদের বাচ্চা হয় উচ্ছ্বাস কি খুব খুশি হবে তাতে? কুসুমের প্রতি তার ভালোবাসা কি আরো বেড়ে যাবে? তখন কি উচ্ছ্বাস নিজের বাচ্চার মাকে চোখে হারাবে? কুসুম মনেমনে অনেককিছুই ভেবে ফেলে। মায়ের কথায় ধ্যান ফেরে কুসুমের। চায়ের কাপের ট্রে নিয়ে সবার প্রথমে উচ্ছ্বাসের দাদুকে চা দেয়। তারপর একে একে খালামনি, উচ্ছ্বাসের ফুপু, তার ভাইবোন সবাইকে চা দেয় কুসুম। সবার শেষে উচ্ছ্বাসের দিকে চায়ের কাপ এগিয়ে দেয়। কুসুম চা দেওয়ার সময় উচ্ছ্বাসের দিকে ঝুঁকে এলে উচ্ছ্বাস ফিসফিস করে বলে,

‘ আমাকে সবার শেষে চা দিলে কেন? আমি হলাম আজকের প্রধান গেস্ট। আমাকেই সবার শেষে অ্যাপায়ন? ‘

উচ্ছ্বাস চেয়েছিল কুসুমকে ভরকে দিতে। কিন্তু কুসুম নির্লিপ্তভাবে বলে দিল, ‘ সবার শেষে দিয়েছি বলে জ্বলছে নাকি? ‘

উচ্ছ্বাস আরেকটু ঝুঁকে কুসুমের দিকে। ফিসফিস করে বলে, ‘উচ্ছ্বাস কারো জন্যে জ্বলে না। সবাই উচ্ছ্বাসের জন্যে জ্বলে পুড়ে মরে। ‘

কুসুম আড়চোখে উচ্ছ্বাসের দিকে চেয়ে ক্ষুদ্র নিঃশ্বাস ফেলে সরে এল। উচ্ছ্বাসের মা কুসুমকে ডেকে এনে নিজের পাশে বসালেন। পারুল নানা প্রশ্ন করলেন কুসুমকে। তার কেমন লাগছে, ভালো আছে কি না,খাওয়া দাওয়া ঠিকঠাক করছে কি না এসব। কুসুম বেশ সুন্দর করে পারুলের সকল কথার উত্তর দিল। কুসুমের এক পাশে পারুল অন্যপাশে উচ্ছ্বাসের দাদু বসে ছিলেন। পারুল এবং কুসুমের কথা বলার মধ্যে দাদু আঙ্গুল দিয়ে খোঁচা দিলেন কুসুমের কোমরে। কুসুম চমকে উঠে তাকাল দাদুর দিকে। দাদু ফিসফিস করে বললেন, ‘ আবার বিয়া করবি রে কুসুম আমার নাতিরে? ‘

কুসুম লজ্জা পেয়ে যায়। মাথা নত করে বসে থাকে ঠায়। দাদু ফোকলা দাঁতে হাসেন। আবারো কুসুমের কোমরে খোঁচা দিয়ে বলেন, ‘ লজ্জা পাস ক্যান? বিয়া তো হইয়াই গেসে তোগো। এখন সংসার করবি, ভালোবাসবি আমার নাতিরে তারপর বছর শেষে আমাগো এক ফুটফুটে বংশধর আইনা দিবি। বুঝসস? ‘

দাদুর কথা শুনে কুসুম লজ্জা পেলেও আশ্বস্ত হতে পারলেন না পারুল। তিনি শাশুরির দিকে চেয়ে ফিসফিস করে বললেন,

‘ আম্মা, বিয়ে এখনো হয়নাই। এখনি বাচ্চার কথা শুরু করে দিলেন আপনি? কুসুমের বয়স হলে বাচ্চা এমনি আসবে। এখন এসব বলে ওর ছোট মাথাটা নষ্ট করে দিবেন না। ‘

দাদু বিরক্ত হলেন। বললেন, ‘ ছোট ছোট কইরা যেমন তোমরা মা ছেলে মিলে মুখে ফ্যানা তুইল্যা ফেলতেস বৌ,ততটা ছোট না হে। হুদাই পোলার বউরে ছোট ছোট কইরা নিজের কপাল পুড়াইও না। ‘

পারুল আবার কিছু বলতে চাইলেন। কিন্তু পুরনো যুগের মানুষের মানসিকতার সঙ্গে কথা বলে যুদ্ধ করতে তার মন সায় দিল না। তাই তিনি চুপচাপ সয়ে গেলেন। সবাই কথা বলছে। একসময় উচ্ছ্বাসের বাবা বললেন, ‘ সাহেদা, কনে দেখাদেখি তো হয়েই গেল। সময় পেরিয়ে যাচ্ছে। এবার কুসুমকে আংটি পরিয়ে দেই? কি বলো? ‘

সাহেদা উচ্ছসিত হয়ে বলেন, ‘ যা আপনি বলবেন দুলাভাই। ‘

সাহেদা সোফা ছেড়ে উঠেন। নিজের ঘরের দিকে এগিয়ে যান। আলমারি খুলে লকার থেকে উচ্ছ্বাসের জন্যে বানানো হীরের আংটি বের করেন। এই আংটি কুসুমের বিয়ের জন্যে তার বাবা বানিয়ে রেখে দিয়েছিলেন। আজ বহু বছর পর আংটি দেখে সাহেদার পুরনো দিনের কথা মনে পরে যায়। কত সুখে ছিলেন তারা। কিন্তু এইটা সড়ক দুর্ঘনার তাদের সোনার সংসার এক নিমিষে লণ্ডভণ্ড করে দিল। সাহেদার চোখে অশ্রু ছলছল করছে। সময় পেরিয়ে যাচ্ছে ভেবে দ্রুত সাহেদা চোখের পানি মুছে ফেলেন। আংটি একহাতে চেপে ধরে বসার ঘরের দিকে ছুটেন।

কুসুমকে উচ্ছ্বাসের পাশে বসানো হয়েছে। উচ্ছ্বাস এক হাতের আঙ্গুলে আংটি রেখে ওপর হাত কুসুমের দিকে এগিয়ে বলে,

‘ হাত দাও। ‘

কুসুম লজ্জা, সংকোচে জমে উঠে। থরথর করে কেপে উঠা হাত বাড়িয়ে দেয় উচ্ছ্বাসের দিকে। উচ্ছ্বাসের কুসুমের হাত তার একহাতে চেপে ধরে। কুসুমের হাতের কাপুনি এখনো থামছে না। উচ্ছ্বাস কুসুমের হাতে মৃদু চাপ দিয়ে ফিসফিস করে বলে,

‘ এত কাপছ কেন? খেয়ে ফেলছি না তোমাকে। ‘

কুসুম থমকে যায় এই কথা শুনে। উচ্ছ্বাসের মত নিরামিষ লোকও কি এমন অসভ্য কথা বলতে পারে? কুসুমের কান গরম হয়ে যায়। চোখ দিয়ে শাসায় উচ্ছ্বাসকে। উচ্ছ্বাস পরোয়া করে না। একহাতে কুসুমের হাত চেপে ধরে আংটি বাড়িয়ে কুসুমের আঙ্গুলে আংটি পরিয়ে দেয়। সামনে থেকে কয়েকটা ফ্ল্যাশ লাইট জ্বলে উঠে। পুরো সময়টাই ভিডিও করেছিল উচ্ছ্বাসের চাচাতো ভাই মাহবুব। কুসুমের পালা এবার। উচ্ছ্বাস হাত বাড়িয়ে দিয়েছে কুসুমের দিকে। কুসুম থরথর করে কেঁপে উঠা হাত দিয়ে দ্রুত উচ্ছ্বাসের আঙ্গুলে আংটি পরিয়ে সরে এলো। ইব্রাহিম মিষ্টির প্যাকেট খুলে সবাইকে মিষ্টি মুখ করাতে লাগল। মাহবুব ভিডিও বন্ধ করে উচ্ছ্বাসের পাশে এসে বসে। কুসুম তখন উচ্ছ্বাসের পাশে চুপটি মেরে বসে। মাহবুব ভিডিও চালু করে উচ্ছ্বাসকে দেখাল। কুসুমের আংটি পড়ানোর অংশে মাহবুব কুসুমকে টিপ্পনী কেটে বলল,

‘ ভাবিকে দেখে মনে হচ্ছে তাকে কেউ মেরেধরে আংটি পড়াচ্ছে। এই কেঁদে দিবে অবস্থা। আংটি পড়ানোর সময় উচ্ছ্বাস ভাই কিছু করেছে নাকি ভাবি? আমাকে বলতে পারো। ডোন্ট মাইন্ড। ‘

উচ্ছ্বাস মৃদু হেসে কুসুমের দিকে তাকাল। কুসুম তখন লজ্জায় যায় যায় অবস্থা। উচ্ছ্বাস কুসুমের এহেন অবস্থা দেখে বেশ মজা পেল। তারপর মাহবুবের দিকে চেয়ে বলল,

‘ কুসুমকে কিছু করা লাগে না। কিছু না হলেও এমনি এমনি কেঁদে ভাসায়। ‘

মাহবুুব এসব শুনে হেসে বলে,

‘ তাহলে তো তুমি গেছো ভাই। একটু বকাঝকা দিলেই ভাবি কেঁদেকেটে তোমাকে কেইস খাওয়াবে দেখছি। ‘

উচ্ছ্বাস আড়চোখে কুসুমের দিকে তাকায়। তারপর জিজ্ঞেস করে,

‘ কেইস খাওয়াবে নাকি, কুসুম? ‘

কুসুম কি বলবে? উচ্ছ্বাসের দিকে আড়চোখে রাগ নিয়ে তাকিয়ে দ্রুত সোফা থেকে উঠে নিজের ঘরে চলে আসে। পেছন থেকে উচ্ছ্বাস আর মাহবুব এবার উচ্চস্বরে হেসে উঠে।
_________________
কুসুম- উচ্ছ্বাসের বিয়ের তারিখ ক্রমশ ঘনিয়ে এসেছে। আগামীকাল তাদের বিয়ে। কুসুমের হাতে উচ্ছ্বাসের নামের মেহেদী লেগে গেছে। কুসুমের বাম হাতের ঠিক মাঝবরাবর উচ্ছ্বাসের নাম ছোট অক্ষরে লেখা। সে নামই কুসুম বারবার চোখ ঘুরেঘুরে দেখে যাচ্ছে। পাশ থেকে বোনদের হাসির ঢল ভেসে যাচ্ছে। কুসুমের বিয়েতে পড়ার গহনা, শাড়ি থেকে শুরু করে প্রয়োজনীয় সবকিছু একপাশে গুছিয়ে রাখা হয়েছে যেন দরকারের সময় হাতের নাগালে সব খুঁজে পাওয়া যায়। যত রাত গড়াচ্ছে, কুসুমের বুকের ভেতরের ধুকপুকানি বেড়েই যাচ্ছে বরং থামছে না। আজ রাতটাই শুধু। তারপরের সারাজীবনের সব রাত কুসুম উচ্ছ্বাসের সঙ্গে কাটাবে। দুজনের ছোট্ট এক সংসার হবে। কুসুম-উচ্ছ্বাসের ভালোবাসায় ভরে উঠবে তাদের সেই ছোট্ট সংসার। সব কেমন যেন স্বপ্ন স্বপ্ন লাগছে কুসুমের কাছে। কুসুমের যেমন এই বিয়ে নিয়ে অনেক স্বপ্ন আছে, তেমন স্বপ্ন কি উচ্ছ্বাসেরও আছে? কুসুমের বড্ড জানতে ইচ্ছে হল।

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here