#বড়_অবেলায়_এলে_তুমি,,,,
#সমাপ্তি_পর্ব
নদীর পাড়ে একটা বেন্চিতে বসে আছে অর্থী আর ইহান। কারও মুখে কোন কথা নেয়। অর্থী ভয়ে ইহানের মুখের দিকে তাকাতে পারছে না।একবারই তাকিয়ে ছিল, যখন ফাইলটা নিয়ে ওর সামনে দাড়িয়ে ছিল। চোখ দুটো পুরো লাল হয়ে ছিল, মনে হচ্ছে যেন বেরিয়ে আসবে এখনই অক্ষি কুটুরি থেকে। মুখটাকে অসম্ভব রকমের একটা কালো ছায়া গ্রাস করেছে, নাকটা একদম ফুলে আছে আর হাত দুটো মুষ্টিবদ্ধ করা। বোঝায় যাচ্ছে অতিরিক্ত রাগ কে কনট্রোল করার চেষ্টা এটা। অর্থী চুপচাপ মাথাটা নিচু করে বসে আছে। আর ইহান ওর অতিরিক্ত রাগ কনট্রোল করতে ব্যস্ত।
ইহানের অনেক রাগ লাগছে অর্থী উপর। ইহানের ভালোবাসাটাকে এই মেয়েটা এতোটা ঠুনকে মনে করেছিল। কি হত একবার বললে, কেন এতো কষ্ট দিচ্ছে মেয়েটা? অর্থীর দিকে তাকালো ইহান। মেয়েটা মাথাটা নিচু করে চুপচাপ বসে আছে। ইহান বলে ওঠে,
– আমি আমার উত্তর কিন্তু এখনও পায় নি।
অর্থী কিছু না বলে নিরবে চোখের জল ছেড়ে দিল। ইহানের চোখ এড়ায় না সেটাও। ওর বুকের মধ্যে চিনচিনে একটা ব্যাথা অনুভব করছে। ইচ্ছা করছে এখনই অর্থীকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে বলতে, এই পাগলি কান্না করছ কেন আমি তো আছি। সব ঠিক করে দিব। কিন্তু মানুষের সব ইচ্ছা পুরন হয় না। তাই ইহানের এই ইচ্ছাটাও পুরন হয় না। অর্থীর দিকে তাকিয়ে বলে,
– কি হলো! কিছুই কি বলবা না?
অর্থী তখনও কেদে যাচ্ছে। কি বলবে, ও আজ যে নির্বাক। যে কথাটা ও এতোদিন নিজের বুকের মধ্যে চেপে রেখেছিল তা আজ ইহান কেমনে জানলো সেই প্রশ্নটাও মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে। অর্থী একটা শান্ত চাহনি নিয়ে ইহানের দিকে তাকালো। এবার ইহান নিজেকে আর কনট্রোল করতে পারলো না। জাপটে ধরল অর্থীকে নিজের বুকের সাথে। অর্থীও যেন এটাই চায়ছিল মনে মনে। সেও ঝাপিয়ে পড়ল ইহানের বুকে। ইহানের বুকের মধ্যে যেন একটা অদ্ভুত শান্তি অনুভব করছে অর্থী। এবার সে শব্দ করেই কেদে উঠল। ইহান বাধা দিল না। আজ কাঁদুক আর কাঁদতে দিবে না ওর পাগলীকে। বুকের মধ্যে আলতো করে জরিয়ে ধরেই বসে থাকল ইহান।
হঠাৎ অর্থী ইহানকে ধাক্কা দিয়ে দুরে সরিয়ে দিল। তারপর বলল,
– প্লিজ চলে যাও। আমি পারব না তোমাকে আমার এই অনিশ্চিত জীবনের সাথে জড়াতে।
ইহান অনেকটা গম্ভীর হয়ে বলল, যাওয়ার হলে কি তোমার মনে হয় আমি এখানে আসতাম?
– প্লিজ! কেন করছ এমন?
– ভালোবাসি অনেক বেশী। আর আমি না ব্যর্থ প্রেমিক হতে পারব না। তাই কি করব বলো তো! তোমাকে সুস্থ করে নিজের কাছে আটকে রাখব।
– পারবে না। তাই বলছি চলে যাও।
– পাগলের মতো কথা বলো না তো। তোমাকে পৃথিবীর বেষ্ট ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাব। দরকার পরলে সবার সাথে যুদ্ধ করে আমি তোমাকে ফিরিয়ে আনব।
– পাগলের মতো কথা আমি না তুমি বলছ। ইহান এটা রুপকথা নয়। বাস্তব জীবন, আর এখানে আবেগ চলে না। আমি আর খুব বেশী হলে তিন মাস মত বাচব। কিচ্ছু করতে পারবে না তুমি।
– আজ প্রথমবার বললে তাই কিছু বললাম না। কিন্তু next time মরার কথা বললে না আমার থেকে খারাপ আর কেউ হবে না বলে দিলাম।
অর্থী ইহানের দিকে তাকিয়ে থাকল। সে এখন হাসবে নাকি কাদবে বুঝতে পারছে না। ঠিক এমন ভালোবাসায় তো অর্থী দেখতে চেয়েছিল ইহানের চোখে নিজের জন্য। ইহান এলো কিন্তু #বড়_অবেলায়। অর্থী ইহানের চোখের দিকে তাকিয়েই বলল,
– এ সব তুমি কিভাবে জানলে?
– সে অনেক কাহিনী।
– বল আমি শুনবো।
– আচ্ছা,
ফ্লাসব্যাক,,,,,,,,,,,,,,,,,,,
সেদিন যখন তুমি আমাকে রিজেক্ট করে দিলে, প্রথমে আমি সেটাই ভেবেছিলাম যে তুমি আমাকে ভালোবাস না। অনেক কষ্ট পেয়েছিলাম,জানো । বুকের মধ্যে সবসময় একটা চিনচিনে ব্যথা করত। কিন্তু হঠাৎ মনে হলো, “না আমার অর্থী এমনটা করতে পারে না। ওর চোখে আমি আমার জন্য ভালোবাসা দেখেছি গভীর ভালোবাসা।” তারপর ভাবতে শুরু করলাম কেন তুমি আমাকে রিজেক্ট করলে। ভাবীকে ফোন দিয়ে জিজ্ঞাষাও করেছি জানো, যে তোমার কোথাও বিয়ে টিয়ে ঠিক হয়ে আছে নাকি। ভাবী না বলাতে মনে হলো না। অামার অর্থী এসব ঠুনকো কারনে আমাকে ছাড়তে পারে না। নিশ্চয় কোন বিশাল কারন আছে।
বসে বসে ভাবছিলাম কোন কুল কিনারা পাচ্ছিলাম না। হঠাৎ সেদিন হসপিটালে যাওয়ার কথাটা মনে পরে যায়, কেন যেন মনে হয় সেখানে গেলেই আমি কিছু জানতে পারব। ওখানে আমার মামা জব করে। তাই মামাকে বলাতে তোমার ইনফরমেশন বের করতে বেশী বেগ পেতে হয় নি আমাকে। মামা আমাকে শুধু তোমার রিপোর্ট গুলো বের করে দিয়েছিল। সেগুলো নিয়ে আমি সেই হসপিটালেরই একটা ডাক্তারের কাছে যায় উনি তোমীর রিপোর্ট দেখার পর প্রথমেই আমাকে জিজ্ঞাষা করে,
– আপনি পেসেন্টের কে হন?
– কেন ডাক্তার? কি হয়েছে ওর?
– আগে যেটা বলছি তার উত্তর দিন। কে হন আপনি উনার?
– ( কিছুটা ভেবে) উনার ফিয়ন্সে।
– তার মানে তো আপনি উনার ফিউচার গার্জেন।
– হুম তা বলতে পারেন। কিন্তু কি হয়েছে আমার অর্থী সেটা কি বলবেন?
– উনি আমারই পেসেন্ট। আমিই উনার চিকিৎসা করছি। দেখুন পেসেন্টের নিষেধ আছে যে উনার সম্পর্কে যেন কোন ইনফরমেশন লিক না করি। কিন্তু তার ভালোর জন্য আজ আপনাকে বলতেই হচ্ছে যে, মিস অর্থী মাথায় একটা টিউমার ছিল যা এখন ক্যান্সারের রূপান্তরিত হয়েছে।
ডাক্তারের কথা শুনে আমার মাথায় যেন বাজ পরল। আমার অর্থীর ক্যান্সার হয়েছে। আমি কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছি না। ইচ্ছা করছে ডাক্তারের কলার ধরে বলি তুই ভুল রিপোর্ট বলছিস। বল আমার অর্থীর কিছু হয় নি ও সম্পূর্ণ সুস্থ আছে। বুকের মধ্যে আবার সেই চিনচিনে ব্যথাটা অনুভব করছি। এর মধ্যেই আবার ডাক্তার বলে উঠল,
– উনি আর খুব বেশী হলে বড় জোর তিন মাস আছেন।
কথায় আছে না মানুষ অধিক শোকে পাথর হয়ে যায়। আমারও ঠিক একই অবস্থা।নির্বিকার চিত্ত্বে জিজ্ঞাষা করলাম, কোনোই কি চিকিৎসা নেই আমার অর্থীর। ডাক্তার কিছু একটা করুন যত টাকা লাগে আমি দিব কিন্তু আমার অর্থীকে সুস্থ করে তুলুন।
কথাটা বলতে বলতে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল
– ঠিক আছে। I will try my best. আমি বিদেশের বড় বড় ডাক্তারদের সাথে এ নিয়ে কলসাল্ট করছি। আপনি চিন্তা করবেন না।
– প্লিজ ডাক্তার যা করার লাগে করুন শুধু আমার অর্থীকে সুস্থ করে দিন।
– বললাম তো I will try my best…. বাকিটা আল্লাহর উপর নির্ভর করছে। আল্লাকে ডাকুন বেশী বেশী করে।
আমি আর কোন কিছু না বলে ডাক্তারের কেবিন থেকে বেড়িয়ে আসি।
বলা শেষ করে ইহান অর্থীর দিকে তাকায়। অর্থী ছলছল চোখে ইহানের দিকেই তাকিয়ে আছে।
অর্থী ওর ঘরের জানালার পাশে বসে আছে চুপচাপ। ইহান চলে গেছে কিন্তু যাওয়ার আগে অনেক কিছুই বলে গেছে অর্থীকে। অনেক সপ্ন দেখিয়ে গেছে। অর্থীরও ইচ্ছা করছে সেই সপ্নগুলো দেখতে কিন্তু নিয়তির কাছে যে আজ সে পরাজিত। অনেক ভয় হয় এখন ওর সপ্ন দেখতে। কারন জানে ওর সব সপ্ন ভেঙ্গে যাবে, একটাও পুরন হওয়ার নয়। খুব ইচ্ছা করছে ইহানের সাথে বাচতে, ইহানের বলা কথাগুলো বিশ্বাস করতে। কিন্তু ইহান না হয় পাগলামো করছে, ওর তো পাগলামি করলে চলবে না। ও জানে ওর বাস্তবতাকে। তাই যে করেই হোক ইহানের থেকে দুরে থাকতে হবে ওকে।
তাই অর্থী একটা কঠিন ডিসিশান নিয়েছে। ও আর ইহানের সাথে কোন যোগাযোগ রাখবে না। জানে ইহান যোগাযোগ করার অনেক চেষ্টা করবে। কিন্তু অর্থী ওর সাথে যোগাযোগ করার সকল পথই বন্দ করে দিয়েছে। এমন কি ফোন দিলেও ধরে না।।
অনেক কষ্ট হচ্ছে কিন্তু কিছু করার নেয়। প্রায় এক ঘন্টা থেকে ইহান ফোন দিয়ে যাচ্ছে অর্থীকে। কিন্তু অর্থী যে ডিসিশান নিয়ে ফেলেছে ও আর ইহানের সাথে কথা বলবে না । ইহান ওর সাথে কথা বললে আরও বেশী অর্থীর প্রতি দুর্বল হয়ে যাবে। পরে অর্থীকে ভুলতে অনেক কষ্ট হবে ইহানের। এখনই দুরে গেলে কষ্টটা হয়তো একটু কম হবে । এতেই অর্থীর শান্তি। তাই তো এই কঠিন সিধান্ত।
আজ তিন দিন যাবত অর্থী ইহানের সাথে কথা বলে না। কিন্তু ইহান অর্থীকে ফোন দিতে ভুলে নি। অনবরত প্রত্যেকটা সময় পাগলের মত ইহান অর্থীকে ফোন দিয়েই যাচ্ছে। কিন্তু অর্থী তার সিধান্তে অনড়। তার যতই কষ্ট হোক সে ফোন রিসিভ করবে না।
চতুর্থদিন সন্ধ্যাবেলায় আবার ইহান অর্থীকে ফোন দেয়। টানা বেশ কয়েকবার ফোন দেওয়ার পর বুঝতে পারে তার অর্থী আর তার ফোন কোন দিনও রিসিভ করবে না। তাই সে একটা ম্যাসেজ করে অর্থীর ফোনে। অর্থী ম্যাসেজটা openকরে পরতে শুরু করে।
” আমার স্কলারসিপ হয়েছে অষ্ট্রেলিয়াতে। চলে যাচ্ছি আমি। এই কয়দিন হয় তো তোমায় অনেক ডিসর্টাব করেছি। কিন্তু কি করব বল অনেক বেশী ভালোবেসে ফেলেছি যে তোমায়। কি মনে করছ আমার ফোন না রিসিভ করলে, আমার সাথে কথা না বললে আমি তোমাকে ভুলে যাব। এতোটাই কি সহজ আমার ভালোবাসা। না তার থেকেও বেশী কষ্ট দিচ্ছ তুমি আমাকে এসব করে। আমার কষ্টগুলো তো তুমি আর বুঝতে চেষ্টা করছ না। ঢিলা মাথায় যা আসছে তাই করে যাচ্ছ। একটা বারের জন্যেও ভেবে দেখছো না আমার মনের মধ্যে কি হচ্ছে। যদি বুকটা চিরে তোমাকে দেখাতে পারতাম তবে বুঝতে তুমি। যা হোক যাওয়ার আগে একবার তোমার ভয়েসটা শুনতে চেয়েছিলাম। কিন্তু তুমি তো! সত্যি বুঝতে পারি নি জানো তোমাকে রেখে আসার পর তুমি অামার সাথে এমন বিহেব করবে। বুঝতে পারলে তোমাকে রেখে আসতাম না, জোর করে নিজের সাথে নিয়ে আসতাম। কেন করছ এমন, প্লিইইইইজজজ ! যা হোক ভালো থেকো, নিজের খেয়াল রোখো কাউকে তে তা করতে দিবে না তাই নিজেই একটু নিজের খেয়াল রেখ প্লিজ। আর মনে রেখ আমি কখনও তোমাকে ভুলতে পারবো না, আমার মরার আগ পর্যন্ত তো নাই।”
ম্যাসেজটা পরে অর্থী সাথে সাথে ইহানকে কল করে কিন্তু ইহানের ফোন তখন একটাই কথা বলে sorry আপনার কাঙ্খিত নম্বরে এই মুহু্র্তে সংযোগ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। অর্থী পাগনলের মতো কল দিতেই থাকে কিন্তু ইহানের ফোনটা আর খোলা থাকো না। কিভাবে থাকবে ইহান তো ভাবতেও পারে নি যে অর্থী ওকে কল করবে। তাই তো ম্যাসেজটা পাঠিয়েই সাথে সাথে ফোনটা বন্দ করে দেয় সে। কারও সাথেই আর কথা বলতে ইহানের ভালো লাগে না। যার সাথে কথা বলতে চায় সে তো তার সাথে কথা বলতে চায় না।
অর্থী কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল। কেন কান্না করছে সে তা জানে না। ওর জন্য তো ভালোই হলো ইহান ওর থেকে দুরে থাকবে। যেটা অর্থী চেয়েছিল কিন্তু কেন আজ ইহানের চলে যাওয়াতে অর্থী এতো কষ্ট হচ্ছে । খুব তো বলে ভালোবাসি ভালোবাসি, তো কেন এখন সে অর্থীকে ছেড়ে চলে যাচ্ছে।
আজ অর্থীর নিজের জন্য যতটুকু না কষ্ট হচ্ছে তার থেকে বেশী কষ্ট হচ্ছে ইহানের জন্য। সেদিনও অর্থী আর ঘরের মধ্যে থেকে বের হয় না। কান্না করতে করতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়ে তা ও বুঝতে পারে না।
সকালে ঘুম থেকে উঠার পর কেন যেন অর্থীর সব কিছুতে একটা ফাকা ফাকা অনুভব করে। মনে হয় ওর সবচেয়ে প্রিয় জিনিসটা সে হারিয়ে ফেলেছে। অর্থী সবার সামনে স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করছে। কারন বাবা মা ওর অস্থিরতা দেখলে সন্দেহ করতে পারে। কিন্তু পারছে না। ওর শুধু এটা মনে হচ্ছে যে ইহান আর কটা দিন পরে গেলে হতো না। অর্থী তো মারাই যাবে তার আগে না হয় একবার ইহানকে শেষ দেখা দেখত। এতোই যখন ভালোবাসে তো তার কাছে ক্যারিয়ারটাই বড় হয়ে গেল। অর্থী কি একটুও জায়গা নিতে পারল না ইহানের জীবনে।
অর্থী ভাবছে আজও সে ইহানের life circle এর বাইরেই রয়ে গেল, ভিতরে ঢুকতে পারল না। কিন্তু অর্থী তো জানেই না যে ইহানের পুরো life circle টাই অর্থীকে নিয়ে। আসলে এই প্রেম বিদ্বেষী ছেলেগুলো যে একবার ভালোবাসলে তার সবটা দিয়েই ভালোবাসে তা অর্থীর জানার বাইরে।
আজ এক সপ্তাহ হয়ে গেল ইহান চলে গেছে। এখনও অর্থী নিজেকে সামলাতে পারে নি, কিন্তু সবার সামনে ভালো থাকার অ্যাকটিং টা ঠিকিই চালিয়ে যাচ্ছে সে। আজ আবার একটা অননোন নাম্বার থেকে কল আসলো অর্থীর ফোনে। ইহান ভেবে অর্থী তড়িঘরি করে ফোনটা ধরে কিন্তু তার ধারনা ভুল প্রমানিত করে একটা মেয়ে কষ্ঠ কথা বলে ওঠে।
ফোনের ওপাশে থাকা মেয়েটি তার পরিচয় দেয় নি। কিন্তু সে দিন ইহানের মত করেই দেখা করতে চাইছে অর্থীর সাথে। অর্থী উনাকে অনেক প্রশ্ন করলেও কোন যথা যোথ উত্তর তিনি দেন নি। শুধু রহস্যময় ভাবে বলেছেন দেখা করলেই জানতে পারবে আমি কে। কেন যেন ফোনের ওপাশে থাকা মহিলাটি অর্থীকে খুব করে টানছে। যাব না যাবনা ভেবেও অর্থী যাওয়ার জন্য তৈরী হয়ে নেয়। কেন যাচ্ছে তা অর্থী নিজেও জানে না কিন্তু ফোনের ওপাশের মহিলাটি প্রবল ভাবে টানছে অর্থীকে যা অগ্রাহ করার ক্ষমতা অর্থীর নেয়।
অর্থী আজও সেখানেই বসে আছে যেখানে প্রথমদিন ইহানের সাথে দেখা করতে গিয়েছিল। আজ অবশ্য এখানে মিট করার কথাটা অর্থীই বলেছে। কেন যানে না কিন্তু এই যায়গাটা অর্থী কাছে স্পেশাল মনে হচ্ছে। অর্থী তার ভাবনার জগতে ঢুবে ছিল। বাস্তবে ফিরল কারও একজনের ডাকে।
অর্থী পেছনে ফিরতেই দেখল একজন মহিলা তার দিকে হাস্যজ্জল মুখে তাকিয়ে আছে। অর্থীর দিকে তাকিয়েই বলল,
– অর্থী?
– হ্যা, কিন্তু অাপনি কে ঠিক চিনতে পারলাম না তো।
– তুমি আমাকে চিনবে না কিন্তু আমি তোমাকে চিনি।
– পরিচয় দেন তাহলে অবশ্যই চিনব।
– হুম, পরিচয় তো দেওয়া যেতেই পারে তবে সেটা তোমার উপর ডিপেন্ড করছে তুমি আমাকে চিনতে চায়বে কি না।
অর্থী বিষ্ময়কর চোখে তাকিয়ে বলল, মানে?
– আমি ইহানের ভাবী। বড় ভায়ের বউ। চিনতে পেরেছ।
অর্থী চোখ বড় বড় করে তার দিকে তাকিয়ে রইলো। অর্থীর কিছুতেই বিশ্বাস হচ্ছে না যে ওর সাথে ইহানের ভাবী দেখা করতে এসেছে। আর ওকে চিনলোই বা কেমন করে। হয়তো মহিলাটি তা বুঝতে পেরেছে তাই তিনি বলে উঠলেন,
– এটাই ভাবছ তো আমি তোমায় কেমন করে চিনলাম?
অর্থী মুখে কোন আওয়াজ করল না শুধু ঘারটা হেলিয়ে বুঝিয়ে দিল হ্যা। উনি আবারও বলে উঠলেন,
– ইহান আমাকে তোমার বিষয়ে সবই বলেছে।
– সব??
– হুম সব। এমন কি তোমার অসুখের কথাও। জানো যাওয়ার আগে আমাকে জরিয়ে ধরে অনেক কান্না করেছিল তোমার জন্য। ও সত্যি তোমাকে অনেক ভালোবাসে।
অর্থী আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল, ভালোবাসে তো ছেড়ে গেল কেন?অর্থী কথাটা বলকে চায় নি কিন্তু কেন যেন অটোমেটিক্যালি বের হয়ে এলো ওর মুখ থেকে।
সাথে সাথেই উত্তর দিলেন তিনি , যেন এমন একটা প্রশ্নই উনি এক্সপেক্ট করছিলেন, “তোমার জন্য”
– মানে?এবার অনেকটা বিষ্ময় নিয়ে কথাটা বলল অর্থী।
– হুম তোমার জন্যেই। দেশে তোমার ভালো কোন চিকিৎসার ব্যাবস্থা নেয় তা তুমিও জানো। তাই ও বিদেশে তোমার চিকিৎসার জন্য গেছে। স্কলারশিপটা তো শুধু একটা বাহানা ছিল।
অর্থী এখনও বিষ্মিত চোখে তাকিয়ে আছে ইহীনের ভাবীর দিকে। উনি আবার বললেন,
– তোমাকে সাথে নিয়ে যেত। কিন্তু তোমার যা কন্ডিশান এতে তোমার জন্য প্লেন জার্নি সেফ হবে না। তাই ও একা গেছে। বাইরের ডাক্তারদের সাথে কথা বলে তোমার জন্য বেটার চিকিৎসার ব্যবস্থা করবে। দরকার পড়লে সে সব ডাক্তারকে ও দেশে নিয়ে আসবে তোমার চিকিৎসার জন্য।
অর্থী এখন আর কিছুই বলতে পারছে না। শুধু শুনেই যাচ্ছে। ও কখনও ভাবে নি যে কেউ ওকে এতোটা ভালোবাসবে কোন দিন। আজ ওর ইহানকে সামনে দেখতে খুব ইচ্ছা করছে। ইহানকে সামনে পেলে জোরে জাপটে ধরে বলত ভালোবাসি আমিও তোমায় অনেক বেশী। কিন্তু অর্থী আজ নির্বাক হয়ে গেছে। শুধু ফ্যালফ্যান চোখে ইহানের ভাবীর দিকে তাকিয়ে আছে।
হঠাৎ আবার ইহানের ভাবী বলে উঠে আমি তোমার বাসায় যেতে চায়। তোমার বাবা মার সাথে কথা বলতে চায়।
আজ অর্থীর অপারেশন। অর্থীকে হসপিটালে ভর্তি করা হয়েছে। কিছুক্ষণ পরেই অর্থীকে নিয়ে যাওয়া হবে ওটি তে। একে একে সবাই অর্থীর সাথে দেখা করতে আসল। অর্থীর বাবা মা, জান্নাত আপু, শুভ্র ভাইয়া, পিচ্চি আরাফ, ইহানের বাবা মা, ভাইয়া ভাবী, আর আরও একটি পিচ্চি অদ্রিমনি। সবার চোখই চিকচিক করছিল কিন্তু সবাই তা অর্থীর থেকে আড়াল করার চেষ্টা করে চলেছে, অর্থী বুঝতে পারলেও কাউকে কিছু বলল না। জানে সবাই তার জন্য চিন্তা করবেই না চাইতেও চলে আসবে। আজ অর্থীর খুব ভাল লাগছে তার পুুরো পরিবার ওর সাথে আছে আজ, আজ ও মরতেও ভয় পায় না।
সবাই অর্থী সাথে দেখা করে চলে গেল, অর্থীকে অপারেশনের জন্য তৈরী করা হচ্ছে। আর কারও সাথে দেখা করতে দেওয়া হবে না, কিন্তু তবুও অর্থী চোখ শুধু একটা মানুষকেই খুজছে। মনে হচ্ছে এই এসে বলবে, “একটুও ভয় পাবে না, আমি তো আছি।” এটুকু কথায় যথেষ্ট আজ অর্থীর জন্য। কিন্তু অর্থীর অপেক্ষার আর অবসন ঘটে না। হ্যা, আসতে পারে নি তার ইহান।। আজ অর্থীর এতো বড় একটা অপারেশনে ইহান পাশে নেয়, মনে হচ্ছে যেন একা একা লাগছে।। আজ ইহান ওর পাশে ওর পুরো পরিবারকে এনে দাড় করিয়েছে। ছেলেটা পারেও বটে, এতো কিছু যে সে কখন করল তা অর্থী ঘুনাক্ষরেও টের পায় নি। কিন্তু আজ অর্থী ইহানের অনুপস্থিতি গভীর ভাবে অনুভব করছে অর্থী।
ইহান যে ইচ্ছা করে আসেনি তা না। সে অনেক চেষ্টা করেও আসতে পারে নি। অর্থীর অপারেশনটা অনেক তাড়াতাড়ি ডেট দেওয়া হয়েছিল ফলে এই কম সময়ে ইহান কোন প্লেনের টিকিট পায় নি। অনেক চেষ্টা করে, বেশী পে করেও ইহান কোন টিকিট ম্যানেজ করতে পারে নি। তাই শত কিলোমিটার দুরে বসে সে শুধু চোখে জলই ফেলে যাচ্ছে। তবে ওর অনেক শান্তি লাগছে যে সবাই আজ অর্থীর সাথে আছে ও পেরেছে সবাইকে এক করতে।
হ্যা, অর্থীর বাবা মা আর ইহানের বাবা মা কে ইহানই এক করছে। অনেক সাধনার পরে ওর সফল্য এসেছে। কিন্তু এই সাফল্যটা ও নিজ চোখে দেখতে পেল না। সেদিন ইহানই তার ভাবীকে দিয়ে সবটা করেছিল,
ফ্লাসব্যাক,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,
সেদিন ইহানের ভাবী অর্থীর সাথে কথা বলার পর অর্থীর বাবা মার সাথে কথা বলতে চায়। অর্থী কিছুতেই রাজী হয় না। কারন অর্থী ওর বাবা মাকে ওর অসুস্থতার কথাটা জানাতে পারবে না। শুনলে যে মারা যাবে ওর বাবা মা। তারা অনেক ভালোবাসে তাদের একমাত্র মেয়েকে। শুধু তারাই নয় সব বাবা-মাই তাদের সন্তানকে অনেক ভালোবাসে। আর যখন জানতে পারে তাদের নাড়ী ছেড়া ধন আর বেশীদিন পৃথিবীর আলো দেখতে পারবে না তখন সেটা কারও সহ্য করার ক্ষমতা থাকে না। তাই অর্থী ইহানের ভাবীকে অনেক রিকুয়েষ্ট করে তার বাবা-মাকে এসব কথা না বলার জন্য। কিন্তু ভাবী ওকে বোঝায় যে একদিন না একদিন উনারা এই বিষয়ে জানতে পারবে তখনও তো কষ্ট পাবেই। বরং তখন তারা আফসোস করবে তারা তাদের মেয়ের প্রোপার ট্রিটমেন্ট করাতে পারেন নি বলে তাদের মেয়ে আজ তাদের সাথে নেয়। তার থেকে এটাই বেষ্ট সময় নয় কি। আরও অনেক কথা বলে ভাবী অর্থীকে কনভেন্স করে। অবশেষে অর্থী ভাবীকে বাসায় নিতে রাজী হয়। কিন্তু ও ওর বাবা মার সামনে বলতে পারবে না। ভাবী ওকে আসস্থ করে যে অর্থীকে কিছুই বলতে হবে না যা বলার তা ভাবীই বলবেন।
অর্থী ভাবীকে তার বাসায় নিয়ে গিয়ে বাবা মার সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়। উনারা ড্রয়িং রুমে বসে গল্প করতে থাকে। আর অর্থী সবার চোখের আড়ালে ওর ঘরের দিকে পা বাড়ায়। কারন ওর বাবা মার কান্নামাখা মুখটা অর্থী দেখতে পারবে না।
অর্থী যেতেই ভাবী অর্থী বাবা মাকে সবটা খুলে বলে। উনারা শুনে তো প্রথমে কান্নায় ভেঙ্গে পরে, উনাদের একমাত্র মেয়ের এতো বড় অসুখ করেছে। কিন্তু ভাবীর কথায় তারা কিছুটা শান্ত হন। কারন তাদের মেয়েকেও যে তাদের কেই সামলাতে হবে।। তারা ভেঙ্গে পরলে যে অর্থী আরও ভেঙ্গে পরবে। তাই তারা তাদের চোখের পানিটুকু মুছে ফেললেন।
ভাবী চলে যেতেই উনারা অর্থী ঘরের দিকে পা বাড়ান। আশরাফ সাহেব দেখেন তার মেয়ে খাটের ঠিক মাঝখানটাই বসে হাটুর মধ্যে মাথা গুজে বসে আছে। তিনি গিয়ে আলতো করে মেয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। অর্থী মুখ তুলে তার বাবাকে দেখতেই উনাকে জরিয়ে ধরে কান্না করে দেয় আশরাফ সাহেবেরও ইচ্ছা করছে এখন জোরে শব্দ করে কাদতে কিন্তু না তার মেয়ের জন্য তো তিনি সব করতে পারেন এতো মাত্র একটা হাসার অভিনয় তিনি করতে পারবেন না।। অর্থীকে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরেই বললেন কিচ্ছু হবে আমার মামুনির। আমি আছি তো মামুনি, তুমি কোন টেনশন কর না। অর্থীও পরম শান্তিতে তার বাবার বুকে মুখ গুজে বসে রইল।
বর্তমানে,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,
অর্থীকে অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে যাওয়া হয়েছে তিনঘন্টা হলো। এখনও ডাক্তাররা কেন বের হচ্ছেন না সবার অনেক টেনশন হচ্ছে। সবাই বসে বসে অপেক্ষার প্রহর গুনছে। কিছুক্ষণ পর একটা নার্স বের হতেই সবাই ছুটে গেল তার কাছে। কিন্তু নার্সটা আশানুরুপ কিছুই বলতে পারল না। এখন অপেক্ষা শুধু ডাক্তার বের হওয়ার।
অর্থী বাবা মা অনেক টেনশন করছে। বাকীরা যে করছে না তা নয় কিন্তু তাদেরটা বেশী, তাদের একমাত্র মেয়ে আজ মৃত্যুর সাথে লড়ায় করছে। ইহানের বাবা অর্থীর বাবার কাছে আর ইহানের মা অর্থীর মায়ের কাছে এসে বসল। তারা অর্থীর বাবা মাকে যথা সম্ভব সান্তনা দিচ্ছেন কিন্তু তাদের মনের মধ্যেও তো একটা চাপা ভয় কাজ করছে। বাকীরা যে যার মত বসে বসে শুধু ওটির দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।
পার হয়ে যায় আরও অনেকটা সময়। এখনও ডাক্তার বের হওয়ার কোন নাম নিচ্ছে না। এবার সবার অপেক্ষার বাধ ভাঙ্গতে চলেছে। কিন্তু সবার অপেক্ষার অবসন ঘটিয়ে অর্থী আর ফিরে আসে না। হ্যা অর্থী আর নেয়। সে অপারেশন টেবিলেই তার শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করছে।
ডাক্তাররা বের হয়ে অর্থী পরিবারের লোককে বলে, we are sorry কিন্তু একথাটা বলতে তাদেরও বুক ফেটে যায় কারন তারা পুরো পরিবারের আর্তনাদ টা নিজ চোখে দেখেছিলেন।
শান্ত হয়ে যায় সব কিছু। অর্থী যাওয়ার সাথে সাথেই যেন সব থেমে যায়। বন্ধ হয়ে যায় সব কেলাহল। সবাই যেন আজ বোবা হয়ে গেছে। আজ তারা কাদতেও ভুলে গেছে। কেউ বিশ্বাসই করতে পারছে না যে তাদের আদরের অর্থী আর নেয়। মনে হচ্ছে যেন এখনই উঠে এসে বলবে এই তো আমি, তোমাদের সাথে তো একটু মজা করছিলাম। তোমরা এতেই ভয় পেয়ে গেলে, বলেই খিলখিল করে হেসে উঠবে। কিন্তু তা আর হয় না।
পরিশিষ্ট: ইহান দেশে ফেরে অর্থীর মারা যাওয়ার তিন দিন পর। অর্থীর করবের পাশে গিয়ে বসে পরে সে। আজ যেন তার সম্পূর্ণ পৃথিবীটা থেমে গেছে। নির্লিপ্ত কন্ঠে বলে ওঠে তুমি অনেক জেদি, শেষ পর্যন্ত তোমার জেদই বহাল রাখলে। কিন্তু তুমিও জানো না আমি কতোটা জেদি, এতো দিন আমার ভালোবাসা দেখেছো আজ থেকে দেখবে জেদ। আমি আর কখনও তোমার কাছে আসবনা, থাকো তুমি একা।
নেক্স ফ্লাইটের টিকিট কেটেই ইহান আবার ফিরে যায় অষ্ট্রেলিয়া। সেখানে সে সারা জীবনের মত সেটেল হয়ে যায়। কোনদিনও ফেরে না আর বাংলাদেশে, সোখানেই একটা ভার্সিটির প্রফেসর এখন ইহান। সারাটা দিন ওর ষ্টুডেন্টদের নিয়েই কেটে যায়। কিন্তু দিন শেষে যখন রাত আসে তখন নিজেকে অনেক বেশী একা লাগে তার। আজও ইহান বেচে আছে শুধুমাত্র অর্থীর স্মৃতিগুলো বুকে নিয়ে। আজও ইহান অর্থীকে ততটুকুই ভালোবাসে যতোটা ভালোবাসতো। এই ভালোবাসা কমে না বরং সময়ের সাথে বেরেই চলেছে।
এভাবেই সমাপ্ত হলো আরও একটি অমর প্রেম কাহিনির। যা পৃথিবীর বুকে সুপ্তই থেকে গেল, ঠাই পেলনা কোন ইতিহাসে।
“সমাপ্ত”
#জাকিয়া_সুলতানা
Story ta khub khub valo ……..but last a jeta holo khub kosto hoyaca amar😢😢😔😢
Sara jibon becheThakuk Sobar Bhalobasha
Amor Thakuk sob Prem Kahini
❤❤ SUPERB STORY 👏👏👏👏👏