বড় অবেলায় তুমি এলে পর্ব ১

সকালবেলা ট্রেন থেকে নামলো অর্থী।। আপুর বাসায় যাবে সে।। বেশ কিছুদিন ভার্সিটি বন্ধ তাই ছুটি কাটাতে যাচ্ছে।। অবশ্য এটা গৌণ কারন,, মুখ্য কারণ আরও একটা আছে তবে সেটা সবার অগোচরে।। ট্রেন থেকে নেমে সামনে তাকাতেই চমকে উঠল অর্থী।। বুকের ভেতরটা যেন মোচর দিয়ে উঠল।। অনুভব করল চোখের কোনে বিন্দু বিন্দু পানিও জমাট বাধা শুরু হয়েছে।। সকলের অগোচরে সে পানিটুকু মুছে আবার সামনে তাকালো।। আবার দেখতে লাগলো সেই মানুষটাকে যাকে দেখে তার বুকের ভেতরটা মোচর দিল।। অর্থী ভাবলো হয়তো কাউকে রিসিভ করতে সে ষ্টেশনে এসেছে।। কিন্তু অর্থীকে অবাক করে দিয়ে সেই মানুষটা অর্থীর দিকেই এগিয়ে এলো।। অর্থীর যেন বিশ্বাসই হতে চায়ছে না যে ইহান ওর দিকেই আসছে।। হা সামনের ওই মানুষটার নামই ইহান।। আহনাফ আবরার (ইহান)।।। অর্থী তার দিক থেকে চোখ সরিয়ে ডানে বায়ে একবার চোখ বুলালো।। নাহ্ আশে পাশে তো কাউকে দেখে না তাহলে কি ইহান!!! এরমধ্যই ইহান অর্থীর ভাবনায় ছেদ ঘটিয়ে বলে উঠল ……

– অর্থী….. রাইট???

– হ্যা
বলেই প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে ইহানের দিকে তাকালো।। ইহান মুখে একটা হাসির রেখা ফুটিয়ে বলল,,,,

– ভাবী আমাকে পাঠিয়েছে,, আপনাকে আনতে।।

– ভাবী মানে?? (চিন্তিত মুখ নিয়ে বলল)

– আমার ভাবী মানে আপনার বোন।। ভাইয়া অফিসের একটা জরুরী মিটিং এ আটকে গেছে তাই আমাকেই পাঠালো আপনাকে আনতে।।

মৃদু হেসে কথাটি বলল ইহান।। অর্থীকে আর কোন কথা বলার সুযোগ না দিয়ে আবারও বলল ” এখন চলুন দেরী হয়ে যাচ্ছে,, বাকী কথা বাসায় গিয়ে ভাবীর কাছে শুনে নেবেন।।” অর্থী আর কথা না বাড়িয়ে ইহানের পিছে পিছে চলতে শুরু করল।। ইহান ষ্টেশনের বাইরে এসে একটা গাড়ির সামনে দাড়ালো।। অর্থীও এসে ইহানের পিছনে দাড়ালো।। ইহান গাড়ির ফ্রন্ট গেটটা অর্থীর জন্য খুলে দিয়ে অর্থীকে ইশারায় বসতে বলল।। অর্থী গাড়িতে উঠে বসতেই ইহান অপজিট দিকে গিয়ে ড্রাইভিং সিটে বসে পড়ল।।

ইহান এক দৃষ্টিতে সামনের দিকে তাকিয়ে ড্রাইভ করে যাচ্ছে।। অর্থী একবার ইহানের দিকে তাকালো।। ইহানের দিকে তাকাতেই অর্থীর বুকটা হু হু করে উঠল।। পুরনো সব স্মৃতিগুলো আবার তার মনে পড়ে গেল,, যে স্মৃতিগুলো অর্থীকে তাড়া করে বেড়াচ্ছে আজ তিন বছর ধরে।। যে স্মৃতিগুলো সে তিন বছর ধরে ভুলে যেতে চাইছে তা আবার অর্থীর সামনে এসে দাড়ালো।। কেন দেখলো অর্থী ইহানকে?? কেন ইহান আবার অর্থীর সামনে এসে দাড়ালো?? ইহানের তো কিছুই না ।। আজ তিন বছর ধরে অর্থী শুধু একাই কষ্ট পেয়ে যাচ্ছে।। ইহান তো জানেও না যে তার জন্য একটা মানুষ এভাবে দিন দিন তিলে তিলে কষ্ট পেয়ে মরে যেতে বসেছে।। অর্থী ইহানকে আর জীবনে কোন দিন দেখতে চায় নি।। ওকে দেখলেই কষ্টগুলো আরো বেশী করে বুকে বাসা বাধবে।। অর্থীর অজানতেই তার চোখ দিয়ে দু ফোটা পানি বেড়িয়ে পড়ল।। পানিটুকু ইহানকে দেখাবে না বলেই সে মুখটা ঘুরিয়ে জানালা দিয়ে বাইরে দৃষ্টি নিক্ষেপ করল।। ইহান আগের মতোই সামনে তাকিয়ে একমনে ড্রাইভ করে যাচ্ছে।। অর্থী জানালার দিকে তাকিয়ে আড়ালে চোখের পানিটুকু মুছে ফেলল।

ইহানের কথা শুনেই অর্থী বুঝতে পারছে যে ইহান ওকে চিনতেও পারেনি ।। চিনবেই বা কেমন করে অর্থীর দিকে তাকানোর তো সময়ই হতো না ইহানের।। কিন্তু অর্থী সে যে ইহানকে কোন ভাবেই মন থেকে মুছতে পারছে না।। চাইলেও ভুলে যেতে পারছে না ইহানকে।। অর্থীর চোখের সামনে যেন সেই তিন বছর আগের স্মৃতিগুলো ভেসে উঠছে।। সেই চির চেনা মাঠ যেখানে রোজ ইহান বসে থাকত।। আর অর্থী সে তার সকল কাজ ভুলে দুর থেকে শুধু ইহানকেই দেখে যেত।। আর ভাবত একটা মানুষ এতোটা পারফেক্ট হয় কেমন করে।। যেমন সে দেখতে তেমনই তার কথা বলার ভঙ্গী।। ইহান কথা বললে অর্থী শুধু চেয়েই থাকত ইহান কি বলছে কখনও কখনও তার কানে ঢুকতো না।।

অর্থী আবার সেই স্মৃতিতে ডুব দিবে এমন সময় ইহান গাড়িটা ব্রেক করল।। অর্থী ইহানের দিকে জিজ্ঞাষু দৃষ্টিতে তাকাতেই ইহান বলে উঠল “এসে গেছি”।। অর্থী সামনের দিকে তাকাতেই দেখল হ্যা এটা ওর আপুরই অ্যাপাটমেন্ট।। অর্থী গাড়ি থেকে নেমে আবার সামনে তাকালো।। আর ইহান গাড়িটা পার্কিং করতে গেল।।

দশতলা অ্যাপাটমেন্টের চারতলায় থাকে শুভ্র সাহেব এবং তার স্ত্রী জান্নাত আর ছোট্ট দুষ্টু মিষ্টি আরাফ।। ইহান এসে অর্থীর পাশে দাড়িয়ে বলল চলুন যাওয়া যাক।। অর্থী আর একবার ইহানের দিকে তাকিয়ে সামনে হাটা ধরল।।

বেল দিতেই জান্নাত( অর্থীর আপু) দড়জাটা খুলে দিল।। দড়জা খুলতেই অর্থী জান্নাতকে একটা টাইট হাগ করল।। কতদিন পর জান্নাতকে দেখলো সে।। অর্থী বিজি তার পড়াশোনা নিয়ে আর জান্নাত তার সংসার নিয়ে,, তাই তো দুই বোনের আর আগের মত সময় কাটানো হয়ে ওঠে না।। জান্নাতকে ছাড়তেই জান্নাত অর্থীর কপালে একটা চুমু দিয়ে বলল অনেকটা জার্নি করে এসেছিস,, যা আগে ফ্রেস হয়ে নে।। তারপর বাকী কথা বলব।।

অর্থী এক পা সামনে এগোতেই শুনতে পেল “বাহ্ নিজের বোনকে পেয়ে আমাকে ভুলে গেলে।। সেই কখন থেকে দড়জায় দাড়িয়ে আছি একবারও ভিতরে আসতে বললে না।। হুহ্ বলবে কেন কাজ তো শেষ।। আমি কিন্তু এ অবিচার মেনে নেব না,, বলে দিলাম।। পিছনে তাকাতেই দেখলো ইহান মুখ ফুলিয়ে দাড়িয়ে আছে।। জান্নাত শব্দ করে হেসে দিয়ে দিয়ে বলল হয়েছে বন্ধ কর তোর এই ড্রামা।। তুই জানিস আমি তোকে নিজের ভায়ের মত ভালোবাসি,, তারপর মুখটা একটু মলিন করে বলল তারপরও এ কথা তুই আমাকে বলতে পারলি।। বলেই জান্নাতও মুখটা ফুলিয়ে দাড়িয়ে থাকলো ওদের দুজনের মুখ ফোলানো দেখে অর্থীরও মন খারাপ হয়ে গেল।। অর্থী ভাবছে অর্থীর জন্যই তারা এভাবে মুখ ফুলিয়ে দাড়িয়ে আছে।। অর্থী একটা করুন মুখ নিয়ে ওদের দিকে তাকালো।। এবার অর্থীর মুখ দেখে দুজনেই শব্দ করে হেসে উঠল।। তার মানে উনারা মজা করছিল দুজনেই আর অর্থী কিনা ভাবলো।।।

অর্থী একটা অপ্রস্তুত হাসি দিয়ে ওদের দিকে তাকালো।। জান্নাত আর ইহানও বুঝতে পারল অর্থীর অবস্থা তাই তারা হাসি থামিয়ে দিল।। এর মধ্যেই আরাফ পিছন থেকে খালামুনি বলে চিৎকার দিল।। অর্থী গিয়ে আরাফকে কোলে তুলে নিল।। জান্নাত বলল আরাফ খালামুনিকে এখন একদম জানলাবে না।। খালামুনি অনেকটা পথ জার্নি করে এসেছে,, এখন রুমে যেতে দও।। আরাফ বলল আম্মু আমি খালামুনিকে একদম জালাবো না।। চলো খালামুনি আমি তোমাকে তোমার রুমে নিয়ে যায়।। চলো বাবাহ্ বলে অর্থী আরাফকে কোলে নিয়েই হাটা শুরু করল।। ঘরে গিয়ে অর্থী আরাফকে বিছানার উপর বসালো।। আরাফ অর্থীকে হাজারটা প্রশ্ন করে যাচ্ছে।। অর্থী সেসকল প্রশ্নের উত্তর হাসি মুখে দিলেও তার মনে প্রচন্ড অস্থিরতা কাজ করছে ।। জান্নাত এসে আরাফ কে নিয়ে চলে গেল আর অর্থীকেও ফ্রেস হওয়ার জন্য তাড়া দিয়ে গেল।।

অর্থীর মাথাটা কেমন জানি অসাড় লাগছে।। কেন এমন হচ্ছে তা সে বুঝতে পারছে না।। অর্থী বার্থরুমে গিয়ে শাওয়ারের নিচে দাড়ালো।। যেন সে শাওয়ারের পানি দিয়ে তার মাথার ভাবনা গুলো বের করে দিতে চায়।। কিন্তু আদো কি তা সম্ভব।। মাথার ভাবনা গুলো না হয় বের করে দিল কিন্তু মনেরটা,,,,,,, সেটা কি পারবে অর্থী কখনও মুছে ফেলতে।।

অর্থী শাওয়ার নিয়ে বেড়িয়ে এসে দেখলো জান্নাত আর ইহান ডাইনিং টেবিলে বসে গল্প করছে।। আর টেবিলে খাবার সাজানো আছে।। মানে তারা অর্থীর জন্যই অপেক্ষা করছে।। অর্থী গিয়ে একটা চেয়ার টেনে বসে পড়ল।। একসাথেই খাওয়া দাওয়া করল তারা।। কিছুক্ষণ গল্প করেই ইহান চলে গেল।। ইহান যাওয়ার পর অর্থীর কেন যানি আরও অস্থির লাগা শুরু করল।। মনে হচ্ছে তার নিজের প্রানটা তার থেকে দুরে সরে যাচ্ছে।। অনেক দুরে।।। যেন অর্থীর দমটা বন্ধ হয়ে আসছে।। হয়তো এটাই ভালোবাসা।।

ইহান যেতেই ঘরের দিকে পা বাড়াল অর্থী।। তার কিছুক্ষণ রেষ্ট নেওয়া লাগবে।। আজ যেন শারীরিক এবং মানসিক,, দুটো ক্লান্তিই তাকে ভর করে আসছে।। ঘরে গিয়েই বিছানায় গা এলিয়ে দিল অর্থী।। পুরোনো সব কথা আবার তার মনে পড়ছে।। কিন্তু সে এগুলো মনে করতে চায় না।। তাই জোর করেই চোখ দুটো বন্ধ করে শুয়ে রইলো সে।।

জান্নাতের ডাকে চোখ মেলে তাকালো অর্থী।। দেখলো সন্ধ্যা হয়ে গেছে,, তার মানে সে অনেকটা সময়ই ঘুমিয়েছে।। বিকালে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিল সে টেরও পায় নি।। এতোটা সময় ধরে ঘুমালো সে।। আসলে আজ জার্নিটা বেশী হয়ে গেছিল সাথে,, নাহ্!! আর মনে করতে চায় না অর্থী।। তাড়াতারি করে বিছানা ছেড়ে ওয়াসরুমের দিকে পা বাড়াল অর্থী।। ফিরে এসে দেখলো জান্নাত ওর বিছানায় বসে আছে সামনে কিছু নাস্তার প্লেট আর কফি।। জান্নাত অর্থীর সাথে আড্ডা দেওয়ার সকল ব্যবস্থা করে রেখেছে।। অর্থী জান্নাতের দিকে তাকিয়ে একটা হাসি দিয়ে টাওয়ালটা বেডের উপরে রাখলো।। বেডে বসে অর্থী বলল ,,,,,

– আরাফ কই আপু??

– ঘুমায়।। সারা বিকাল আমাকে জালিয়ে কিছুক্ষণ আগে ঘুমাতে গেল।।।

অর্থীএকটা শুকনো হাসি দিয়ে বলল ওহ্।।

– তোর ভার্সিটি কত দিন ছুটি?? শোন প্রত্যেক বার এসে কয়েক দিন থেকেই যাব যাব বলিস এবার কিন্তু তা শুনবো না বলে দিলাম।।

– ঠিক আছে যত দিন খুশি রাখ আমাকে।। ( একটা হাসি দিয়ে বলল)

দুই বনেই হালকা একটু হাসল।। হঠাৎ অর্থী বলে উঠল

– আপু এখন তো কেবল সন্ধ্যা হবে চলো না ছাদে যায়।। (আসলে অর্থীর কেমন জানি দম বন্ধ লাগছিল।। একে তো অর্থী খোলা হাওয়ায় বড় হওয়া মেয়ে তার উপড় এই ঢাকা শহরের যান্ত্রিকতা তার একদম পছন্দ নয়।। তাই তো ঢাকায় পড়া সুযোগ পেয়েও ও তা গ্রহন করে নি।। রাজশাহীতেই একটা ভার্সিটিতে পড়াশোনা করছে সে।। আপু সে সময় অনেক করে বলেছিল ঢাকায় চলে আসতে কিন্তু ওর এক কথা ও ঢাকার এই যান্ত্রিকতায় নিজেকে মানিয়ে নিতে পাড়বে না।। তার থেকে ওর শহর অনেক ভালো।।)

জান্নাত কিছুক্ষণ ভেবে তারপর বলল চল।।দুই বোনই কফির মগটা হাতে নিয়ে ছাদের দিকে পা বাড়াল।। ছাদের দড়জা প্রায় বন্ধই থাকে কেউ তেমন ছাদে আসে না।। সবাই যে যার নিজের কাজ নিয়ে ব্যস্ত।। অর্থীর ঢাকার প্রত্যেক মানুষকে যন্ত্রমানব মনে হয়।। যে যার মত কাজ করে যাচ্ছে।। কারও মধ্যে কোন আন্তরিকতা নেয়,, নেয় কোন আবেগ।। তারা শুধু নিজেদের কাজের সাথেই পরিচিত।। এছাড়াও যে মানুষের জীবনে আরও অনেক কিছুর স্থান আছে তা তারা প্রায় ভুলতে বসেছে।।। যেন এক একটা রোবট ঘুরে বেড়ায় পুরো শহরময়।।

ছাদে আসার পর অর্থীর মনটা অনেকটা ভালো হয়ে গেল।। জান্নাতদের ছাদটা অনেক সুন্দর করে সাজানো একদম অর্থীর পছন্দমত।। ছাদের একপাশটা পুরোটা সবুজ অরন্যে ঢাকা।। নানা ধরনের ফুলের গাছ থেকে শুরু করে অনেক প্রজাতির গাছই সেখানে স্থান পেয়েছে।। সেই পাশটাতে গেলে মনে হয় সত্যি কোন বনের মধ্যে দিয়ে হেটে যাচ্ছে সে।। এই কাটখোট্টা শহরে যেন কৃত্তিম বনের সৃষ্টি করতে চেয়েছেন এই বাড়ির মালিক।। সফল হয়েছেন অনেকটাই।। যেন পুরো শহরের এই এক জায়গায় এসে প্রান খুলে নিঃশ্বাস নেওয়া সম্ভব।। সম্পূর্ণ রেলিং জুড়ে লতানো গাছ গুলো ছাদের সোন্দয্যকে আরও বাড়িয়ে তুলেছে।। আর অন্য পাশটাতে আছে বসায় জায়গা।। সাথে মাখার উপরে বড় ছাতার মত করা।। ছাদে এসে যেন সে প্রান খুলে নিঃশ্বাস নিতে পারছে।। তার সারা দিনের ক্লান্তি যেন নিমিষেই দুর হয়ে গেল।।

বসার জায়গাটাতে গিয়ে বসল দুই বোন।। এখনও পুরোপুরি সন্ধ্যা নামেনি।। দিনের শেষ আর সন্ধ্যার পুর্বের মুহূর্ত।। গোধুলি লগ্ন।। অনেকদিন এই গোধুলি সময়টাকে উপভোগ করা হয় নি অর্থী।। এই কাটখোট্টা শহরে এমন সুন্দর দৃশ্য দেখার সুযোগ পাবে তা সে ভাবতেই পারে নি।। হঠাৎ জান্নাত বলে উঠল,,,,,,,,

– কেমন আছিস এখন??

– (অনেকটা বিষ্ময় নিয়ে) ভালো।। কেন আমাকে দেখে কি অসুস্থ মনে হয়।। (বলেই হেসে দিল)

– না,,, আন্টি বলছিল তোর নাকি কিছুদিন থেকে।।।

– মাথা ব্যাথা ছিল?? ডাক্তার দেখিয়েছি বলেছে ঠিক হয়ে যাবে।।( জান্নাতকে আর কিছু বলতে না দিয়ে অতি দ্রুত কথাগুলো বলে ফেলল।।মনে মনে যে অনেক ভয় পেয়েছে তা তার মুখের দিকে তাকালেই বোঝা যাবে।। কিন্তু অন্ধকার নেমে আসার জন্য জান্নাত তা নোটিস করল না।। ভয়ে তার শরীর ঘামতে শুরু করেছে)

– কিসের প্রবলেম বলেছে ডাক্তার।। মানে কোন কিছু সিরিয়াস নয় তো।।

– তেমন কিছু না সামান্য মাইগ্রেনের প্রবলেম।। ( অনেকটা তুতলিয়ে বলল.. এই ভয়টায় অর্থী পাচ্ছিল)

– মাইগ্রেনের ব্যাথা তো মারাত্মক রে একবার ব্যাথা শুরু করলে তো।।

– আমারটা অতোটা সিরিয়াস নয় আপু সামান্যই করে।। এসব এখন বাদ দাও তো।।

জান্নাত টপিক চেন্জ করে অন্য টপিকে কথা বলতে লাগলেন।। ছাদে অনেকটা সময় কাটিয়ে বাসায় ফিরে
আসে দুই বোন।। যদিও অর্থীর আসতে মোটেও ইচ্ছা করছিল না কিন্তু আরাফ বাসায় একা আছে দেখে নেমে আসতে হলো।। কিন্তু কিছুটা সময়ের জন্য হলেও ওর মনটা অনেক ভালো হয়ে গেছে।।

প্রায় রাত নয়টার দিকে বাসায় ফিরলেন শুভ্র সাহেব।। আজ তার জরুরী মিটিং থাকার জন্য বাসায় ফিরতে একটু দেরী হয়ে গেল।। শুভ্র আসার পর থেকে আর আরাফের কোন খোঁজ নেয় এখন সে বাবার পাশ থেকে একটুও নড়বে না।। সারা দিন পর এই রাতটুই কাছে পায় সে তার বাবাকে তাই এর সাথে কোন কম্পোমাইজ নয়।। শুভ্রর সাথে অর্থীর দেখা হয় খাবার টেবিলে।। অর্থীর সাথে কিছু কুসল বিনিময় করে খাওয়ায় মনোযোগ দেয় শুভ্র।। হঠাৎ জান্নাত বলে ওঠে,,,,

– আজ রান্না কেমন লাগছে।।

চিন্তায় পরে যায় শুভ্র সে খাওয়ার সময় শুধুই খায়।। সে খাবারের মধ্যে নতুনত্ব বা টেস্ট কোনোটাই বুঝতে পারেনা আর এর জন্য সে জান্নাতে কাছে মাঝে মাঝেই ঝাড়ি খায়।। জান্নাত নতুন কোন রেসিপি ট্রায় করলে শুভ্র কখনও কোন কম্পিমেন্ট দেয় না।। এতে জান্নাত খুব রেগে যায় তাই সে একটু ঢোক গিলে বলল অনেক টেস্টি হয়েছে।।

– আর কিছু না???

– আর কি হবে অনেক টেস্টি হয়েছে অনেক তৃপ্তি সহকারে খাচ্ছি।।

– তার মানে তুমি আমার রান্না তৃপ্তি সহকারে খাও না( ফেস টাকে কাদো কাদো বানিয়ে)

শুভ্র কিছুতেই বুঝতে পারছে না কি হলো ও তো ভাল প্রশংসাই করল তাহলে জান্নাত এমন করছে কেন??? এর মধ্যেই পাকনা আরাফ বলে উঠল বাবাই বলতো আজ রান্না কে করেছে?? এবার শুভ্র বুঝতে পারল আসল ঘটনা।। শুভ্র ভাবল আজ বোধ হয় তার শালিকা রান্নাটা করেছে তাই প্রশংসা শুনে জান্নাতে মন খারাপ যা হোক আরাফে কথার উত্তর না দিয়ে সে বলল,, ” অর্থী এখানে বেড়াতে এসেছে আর তুমি ওকে রান্না ঘরে ঢুকিয়ে দিয়েছ।।” এতে যেন জান্নাত আরও তেলে বেগুনে জলে উঠল।। বলল এতো দিন থেকে আমার হাতের রান্না খেয়ে তুমি এই চিনলে।।। বলেই হন হন করে চলে গেল।।।

এতোক্ষন অর্থী বুঝতে পারছিল না কি হচ্ছে এবার বুঝতে পেরে সে হেসে দিল।। আর শুভ্র জান্নাতের যাওয়ার পানে তাকিয়ে আছে আশ্চর্য হয়ে।। অর্থীর হাসি শুনে তার দিকে তাকাতেই অর্থী বলে উঠল জিজু আজকের রান্না আমি না আপু করেছে।। আপনার সাথে মজা করছিল।। এবার শুভ্রর মুখটা শুকিয়ে এটুকু হয়ে গেল।। অর্থী আবার বলে উঠল যান গিয়ে আপুর রাগ ভাঙ্গান না হলে আপনার কপালে খারাপি আছে।।

বলেই অর্থী ওঠে নিজের ঘরের দিকে চলে গেল।। বিছানায় শুতেই তার চোখ জুরে রাজ্যের ঘুম ভর করল।। আর অন্য দিকে ইহান ঘুমাতে পারছে না।। সে চোখ বন্ধ করলে যেন অজানা কিছু একটা তাকে ভর করে আসছে।। কিছুতেই ঘুমাতে পারছে না সে।। কিছুক্ষণ এপাশ ওপাশ করার পর অনেক রাত করেই ঘুম আসল তার।।

অনেক রাত করে ঘুমানোর জন্য সকালে উঠতেও দেরী হয়ে যায় তার কোন মতে রেডী হয়ে দৌড় দেয় ভার্সিটিতে।। ক্লাস শেষে সব ফ্রেন্ডরা মিলে ক্যান্টিনে বসে আড্ডা দিচ্ছিল কিন্তু সেখানে কোন মনোযোগ নেয় ইহানের।। আজ ক্লাসেও সে মনোযোগ দিতে পারছিল না।। কেন কি হয়েছে তার সে কিছুই বুঝতে পারছে না।। শুধু মনে হচ্ছে সেই অর্থী নামের মেয়েটার কথা।। কেন জানি মনে হচ্ছে ইহান ওকে আগেও দেখেছে কিন্তু সে কিছুতেই মনে করতে পারছে না।।

আজ ইহান নিজেকে অনেক ব্যস্ত রাখার চেষ্টা করছে কিন্তু সেই মেয়েটাই তার সকল ভাবনা জুরে বসে আছে।। ভাবা যায়।। কি করে মনে করবে সে কোথায় দেখেছে ও অর্থীকে।। অর্থীকে জিজ্ঞাষা করবে কিন্তু অর্থীকে দেখে তো মনে হলো না ওকে চেনে অর্থী।। অনেক স্বাভাবিক অপরিতর মতই কথা বলছিল ও।। তাহলে।। নাহ্ আজ ভাইয়ার বাসায় গিয়ে অর্থীর সাথে কথা বলতে হবে তার।।

অন্য দিকে অর্থীরও ঘুম ভাঙ্গতে একটু দেরী হয়ে যায়।। শুভ্রর অফিস থাকায় সে বড়িয়ে গেছে।। বাসায় শুধু সে জান্নাত আর আরাফ।। আরাফ সোনাটা এখনও খায় নি।। সে কিছুতেই খালামুনিকে ছাড়া খাবে না বলে দিয়েছে।। তাই অর্থী ফ্রেস হয়ে এসে আরাফকে খাইয়ে দিল সাথে নিজেও খেয়ে নিল।। এভাবেই আরাফের সাথে খুনসুটি করতে করতে অর্থী সারাটা দিন কেটে যায়।।

বিকালের দিকে অর্থী ঢুকে রান্না ঘরে।। এটা তার একটা অন্যরকম পছন্দের জায়গা।। অর্থীর রান্না করতে অনেক ভালো লাগে।। প্রত্যেক দিন নতুন নতুন রান্না করে সে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিতে চায়।। নতুন কোন রেসিপি দেখলেই সেটা তার ট্রাই করাই চায়।। তো আজ বিকালের জন্য নাস্তা বানাবে সে।। জান্নাত ঘরে বসে আরাফকে পড়াচ্ছে।। যদিও আরাফ মোটেও পড়ছে না।। সে দুষ্টুমিতে ব্যস্ত।। আর অর্থী মনোযোগ দিয়ে রান্না করছে।।

মেইন ডোরটা খোলা থাকার জন্য কাউকে কিছু না বলে বাসায় ঢুকে পড়ে ইহান।। বাসায় ঢুকে ডাইনিং স্পেসে আসলে সে রান্না ঘর থেকে হালকা কিছু আওয়াজ পায়।। সে ভাবল তার ভাবী জান্নাত হয়তো রান্নায় ব্যস্ত তাই ভাবীর সাথে একটু মজা করতে সে ঢুকে পড়ে রান্না ঘরে।। দড়জা দিয়ে ঢুকলে সে দেখে একজন মেয়ে উল্টো দিকে তাকিয়ে খুব মনোযোগ দিয়ে রান্না করছে।। ইহান নিশ্চিত থাকে যে এটা তার ভাবী জান্নাত।। তাই সে অনেকটা কাছে গিয়ে মুখটা একদম কানের কাছে নিয়ে জোরে একটা চিৎকার দেয় ভাবীইইইইইইইই,,,,,,,

অনেকটা অন্যমনস্ক হয়ে কাজ করছিল অর্থী।। হঠাৎ একটা চিৎকার শুনে সে অনেকটা ভয় পেয়ে যায় সে।। পিছনে ঘুরতে নিলেই ইহানের সাথে ধাক্কা লেগে পড়ে যেতে নেয় সে।। অর্থী ভয়ে চোখটা একদম বন্ধ করে ফেলে সে ভাবে আজ পড়ে বুঝি তার মাজাটায় যাবে।। সে অনেকক্ষণ যাবত চোখ বন্ধ করে আছে কিন্তু পড়ছে না কেন?? মনে হচ্ছে যেন কিছু একটা দিয়ে তাকে অনেক শক্ত করে বাধা আছে।। এতোটা শক্ত করে যে সে নড়তেই পাড়ছে না।। সে আরও ভয় পেয়ে যায়।। আস্তে আস্তে সে চোখ খুলে দেখে যে ইহান ওকে নিজের বুকের সাথে আষ্টেপৃষ্ঠে বেধে রেখেছে।। সে যেন বিশ্বাসই করে পাড়ছে না যে ইহান ওকে!! মনে হচ্ছে যেন এভাবে কাটিয়ে দেয় সারাটা জীবন।। ইহানের বুকে একটা অন্যরকম শান্তি অনুভব করছে অর্থী।। যেন আজ পৃথিবীর সকল সুখ তার হাতে ধরা দিয়েছে।। আজ যদি তার মৃত্যুও হয় তাতেও তার কোন আফসোস থাকবে না।। হ্যা আজকের পর সে শান্তিতে মরতে পারবে।। তার কিছু চাওয়ার নেয় জীবনে।। এভাবে ভাবতে ভাবতেই অনেকটা সময় পার করে দেয় দুজনে।। কিন্তু না এভাবে দাড়িয়ে থাকা যাবে না যদি আপু এসে ওদের এভাবে দেখে ফেলে।। ইহানের বুকে থেকেই একটু নড়ে ওঠে অর্থী।।

অর্থী নড়ে উঠতেই ইহান ওকে ছেড়ে দেয় ।। এতোক্ষন ইহান যেন একটা ঘোরের মধ্যে ছিল।। অর্থীকে পড়তে দেখে যেন তার বুকটা ধক করে ওঠে।। যেন অর্থী না সে নিজেই পড়ে যাচ্ছে।। ওকে পড়তে দেখে ইহান অতি দ্রুত অর্থীকে নিজের বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে পড়া থেকে আটকায়।।

কিন্তু অর্থীকে জড়িয়ে ধরার পর একটা অদ্ভুত স্মেল পায় ইহান।। এ যেন দুনিয়ার সকল পারফিউমকে হার মানাবে।। একটা নেশা ধরানো গন্ধ,, যেন মাতাল করে দিচ্ছে ইহানকে।। ইহান কোন দিন নেশা করে নি।। কিন্তু ও দিব্যি বুঝতে যে মদ খেলেও হয়তো এতো নেশা হতো না যতোটা এই স্মেল নিয়ে ওর হচ্ছে।।একবার নিলে যেন বারবার নিতে মন চায়।। ইহান আস্তে করে ওর মুখটা অর্থীর ঘাড়ের কাছে নিয়ে যায়।। ওর গরম নিঃশ্বাস পড়ছে অর্থীর ঘাড়ে।। অর্থীর ঘাড়ের কাছে ছড়ানো চুলগুলোতে নাক ডুবিয়ে সে আবার সেই স্মেলটা নিতে থাকে।। উফফ সেই স্মেল যেন পাগল করে দেবে।। ইহান বুঝতে পারে ওর হার্টবিট অনেক ফাস্ট হয়ে গেছে।। অর্থীরও কি এমন হয়েছে।। জানে না সে।। কিন্তু এটা যানে যে এই ভাবে সে সারাটা জীবন পার করে দিতে পারবে।। এ যেন একটা অন্য করম অনুভুতি।। ইহানের ঘোর ভাঙ্গে অর্থীর নড়ে উঠতেই।। সে অতি দ্রুত বুঝতে পারে ও কি করছিল এবং অর্থীকে ছেড়ে দেয়।।

অর্থী এই ঘটনায় লজ্জায় লাল টমেটোর মতো হয়ে গেছে।। ঠাই সে নিচের দিকে তাকিয়ে আছে কিন্তু মনে মনে বলছে “এতো তাততারি ছেড়ে দিলা কেন?? আর একটু জড়িয়ে রাখলে কি খুব ক্ষতিহয়ে যেত?? ভালোই তো লাগছিল।। তোমার লাগছিল না!!” আসলে এটাই ভালোবাসা।। ভালোবাসার মানুষের কাছে আসতেও সংকোচ বোধ হয় আবার দুরে গেলেও কষ্ট।। হায় রে ভালোবাসা।।

অন্যদিকে ইহানও অনেক লজ্জা পেয়েছে।। সে এতোক্ষন কি করছিল এটা ভাবতেই আরও বেশী লজ্জা লাগছে।। অর্থী ওর বিষয়ে কি ভাবছে।। নিশ্চিত ভাবছে লুচ্চা ছেলে যেই না সুযোগ পেয়েছে অমনি জড়িয়ে ধরার ধান্ধা।। কিন্তু ইহান তো এটা ইচ্ছা কোরে করে নি।। তখন যে ওর কি হয়েছিল তা ও নিজেও জানে না।। নিজের কনট্রোলে ছিল না ও।। লজ্জায় অর্থীর চোখের দিকে তাকাতেই পারছে না তবুও sorry তো বলতেই হবে তাই হালকা করে মাথাটা উঠিয়ে অর্থীর দিকে তাকালো সে।।

অর্থীর দিকে তাকাতেই ইহান হাসিতে ফেটে পড়ল।। ইহানের হাসির শব্দে অর্থী মুখ তুলে তাকালো।। ইহান তখনও হেসেই যাচ্ছে।।কোন ভাবেই তার হাসিকে কনট্রোল করতে পারছে না।। অর্থীর এখন খুব কান্না পাচ্ছে।। ইহান তার দিকে তাকিয়ে হাসছে ক্যান?? ইহানকে কি বলবে কিছুই বুঝতে পারছে না তবুও চোখের ইসারায় ইহানকে জিগ্গাষা করল কি হয়েছে।। ইহান তখনও হেসেই যাচ্ছে।। হাসতে হাসতে তার পেটে ব্যাথা হয়ে গিয়েছে।। সে তার এক হাত দিয়ে নিজের পেট ধরে অন্য হাত দিয়ে অর্থীর মুখের দিকে ইসারা করল।। কিন্তু অর্থী কিছুই বুঝতে পাড়ল না।। সে একটা করুন ফেস করে ইহানের দিকে তাকালো।। ইহান হাসতে হাসতেই পকেট থেকে ফোনটা বের করে অর্থীর একটা ছবি তুললো।। অর্থী কিছুই বুঝতে পারছে না তার ছবি তুলছে কেন?? ইহান ফোনটা ঘুরিয়ে অর্থীর দিকে ধরলো।। স্কিনে অর্থী নিজের মুখটা দেখে পুরাই হা হয়ে গেল সাথে কিছুটা লজ্জাও পেল।। এজন্য এভাবে হাসতে হবে।। অর্থীর মন খারাপ হয়ে গেল।।

রান্না ঘরে কিছু একটার শব্দ পেয়ে জান্নাত তার ছেলেকে ঘরে রেখে রান্নাঘরে দিকে পা বাড়ায়।। সে ও অর্থীকে দেখে হাসিতে ফেটে পড়ে।। অর্থীকে হাসার কারন হচ্ছে অর্থীর পুরো সুখে আটা,, হলুদের গুড়া,, মরিচের গুড়া,, সব লেগে একাকার অবস্থা হয়ে গেছে।। দেখতে অবশ্য অনেক কিউটও লাগছে তাকে এসবের সাথে।।

অর্থীর মুখে একসাথে রাগ,, কান্না,, অভিমান,, লজ্জা সব ভর করল।। শেষে কিনা তার বোনও!! সে সেখানে আর এক মুহু্র্তও থাকল না।। এক দৌড়ে গিয়ে ওয়াসরুমে ঢুকে পড়ল।। আর এদিকে ইহান আর জান্নাত তখনও হেসেই যাচ্ছে।।।

চলবে,,,,,,,,,,,,,,,,

#বড়_অবেলায়_এলে_তুমি,,,
#পর্ব_1
#জাকিয়া_সুলতানা

Repost

{ হ্যাপি রিডিং}

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here