ভালোবাসাকে দিলাম ছুটি পর্ব ১

— তুলি, আমাদের বিয়েটা সম্পর্ণ আমার অনইচ্ছাতে হয়েছে। আমি কখনোই তোমাকে বিয়ে করতে চাই নি। তোমাকে কখনো সেভাবে দেখিও নি। এবং আমাদের বিয়ে হয়ে গেছে বলেই যে আমরা পাঁচ দশটা স্বামী – স্ত্রীর মত হয়ে যাবো তার কোনো মানে নেই। তোমাকে বলে রাখি আমি একজনকে ভালোবাসি। তাকে ছাড়া অন্য কাউকে আমার বুকে স্থান দিতে পারবো না।

বাসর ঘরে তুলি আমাকে সালাম করে উঠে দাড়াতেই আমি তুলির দিকে তাকিয়ে কথা গুলো বললাম। আমার মুখে এরকম কথা শুনার জন্য তুলি মোটেও প্রস্তুুত ছিলো না।
মূহতের মধ্যেই তুলির চেহারা পরিবর্তন হয়ে গেলো। একটু আগে যে চেহারার মাঝে ছিলো কিছুটা লাজুকতা,কিছুটা খুশি খুশি ভাব। এখন সেই চেহারার মাঝে রয়েছে ভয়, কিছুটা আতংক। তুলি মাটির দিকে তাকিয়ে জিঙ্গেস করলো,
— আপনি কি মজা করছেন আমার সাথে?
— না, আমি তোমার সাথে কোনো মজা করছি না।

তুলি এবার ঝাপসা চোঁখে আমার দিকে তাকালো। আমি বুঝতে পারলাম তুলি যে কোনো সময় কান্না করে দিবে। তুলি বললো,
— তাহলে আমাকে বিয়ে করলেন কেনো?
— বাবার জন্য, তুমি তো যানো আমি বাবার সামনে কোনো কথা বলতে পারি না। বাবা আজ পযান্ত যেটা বলেছে, সেটাই হয়েছে। তার কথার বিরুদ্ধে যাবার সাহ্রস কারো নেই।

তুলি আমার দিকে তাকিয়ে বললো,
— আপনি কি জানেন? আপনার বাবাকে করা আপনার মিথ্যা সম্মানের জন্য আমার জিবনটা নষ্ট হয়ে যেতে পারে। আপনি নিজের বাবার প্রতি মিথ্যা ভক্তি দেখাতে যেয়ে আমাকে ঠকিয়েছেন।

— আমি তোমাকে ঠকাতে চাইনি বলেই সব সত্য কথা বললাম। এই বিষয়টা তুমি পরে যানতে পারলে কষ্ট পেতে। সেজন্যই আগে বলে দিলাম।

— আপনার কি মনে হয়? আগে বলাতে আমি কষ্ট পাই নি? বাসর রাতে যখন একটা মেয়ের স্বামী এসে বলে সে অন্য একটা মেয়েকে ভালোবাসে। তখন সেই মেয়ের কেমন অনুভতি হয় বুঝতে পারেন? আপনি বিয়ের আগে এই বিষয়টা আমাকে যানাতে পারতেন। আমি নিজেই বিয়ে ভেঙে দিতাম।

— সেই সময় টুকু আমার হাতে ছিলো না। আমি যানতামও না যে বাবা এভাবে হুট করে আমার বিয়ের সিদ্ধান্ত নিবে। যানতে পারলে আমি কখনই গ্রামে আসতাম না।

— এখন আমাকে কি করতে বলছেন?

— তোমাকে কিছুই করতে হবে না। এই ঝামেলাটা আগে শেষ হোক তারপর ঢাকায় ফিরে আমরা কোনো একটা সিদ্ধান্ত নিবো। আমার মনে হলো বিষয়টা তোমাকে যানানো উচিৎ তাই বলে রাখলাম।

তুলি কোনো কথা বললো না। মাথা নিচু করে আমার সামনে দাড়িয়ে রইলো। আমি বললাম,
— অনেক রাত হলো যাও ঘুমিয়ে পড়ো। কাল আবার সকাল সকাল উঠতে হবে।

— আপনি ঘুমাবেন না?

— সারারাত জেগে থাকবো না কি? তুমি বিছানায় ঘুমাও আমি সোফাতে ম্যনেজ করে নিবো।

তুলি কিছু বললো না। চুপচাপ বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়লো। আমি রুমের আলো নিভিয়ে সোফায় শুয়ে পড়লাম। কিন্ত একটু পরেই বুঝতে পারলাম ভুল হয়ে গেছে। হেলিকপ্টারের মত বড় বড় মশা এসে আমার নাক মুখ দিয়ে ঢুকতে লাগলো সাথে কানের কাছে একটানা গান গাওয়া শুরু করলো। প্রথমবার মনে হলো হিরো আলমের গানের চেয়ে অসহ্যকর কিছু আছে পৃথিবিতে। মাশাদের অত্যচার এখানেই শেষ হলো না। একটুপর অনুভব করলাম বেচারারা অনেক যত্নে আমার শরিরের মধ্যে হুল ঢুকিয়ে রক্ত পান করছে। আমাকে পেয়ে মশারা যেনো তাদের সমস্ত আত্নীয়- স্বজনকে দাওয়াত করেছে পেট ভরে রক্ত পান করার জন্য। কিছুক্ষণ দাতে দাত চেপে মটকা মেরে শুয়ে রইলাম। মশারা রক্ত খাচ্ছে খাক। তাদের ও বেচেঁ থাকার অধীকার আছে। মানবজাতি খুবই স্বাথপর, তারা নিজেরা বেচেঁ থাকার জন্য ঠিকই গরু,মহিষ খেয়ে ফেলে। অথচ মশাদের জন্য এক ফোটা রক্ত
তাদের শরিরে বরাদ্দ থাকে না। নিশ্চয় কোনো একটা মশা আজ সারাদিনে কোনো কাজ পায় নি, তাই। সন্তানদের জন্য খাবারের ব্যবস্থাও করতে পারে নি। এখন নিশ্চয় আমার শরির থেকে রক্ত নিয়ে বাসায় ফিরবে আর তখন তার পরিবার খুশি হয়ে যাবে। তাদের আর না খেয়ে থাকতে হবে না। এটা ভেবেই নিজেকে মহান মনে হতে লাগলো। কিন্ত এই সমাজ সেবা থুক্কু মশাসেবা বেশিক্ষণ করতে পারলাম না। একটা সময় ঠাস ঠাস করে দুহাত দিয়ে হামলা চালিয়ে দিলাম মশাদের উপর। অনেকে নিহত হলো, অনেকে আহত হলো, কারো কারো একটা ঠ্যং ভেঙে গেলো, কারো একটা পাখা খুলে গেলো। আমি যেয়ে রুমের লাইট জ্বলে কয়েল খুজতে লাগলাম। হঠাৎ চোঁখ পড়লো তুলির উপর কি মায়বী চেহার মেয়েটা। ঘুমন্ত তুলিকে একদম পুতুলের মত হনে হচ্ছিলো, যেনো একটা পুতুল বউ সেজে আছে। মেয়েটা নিশ্চয় কান্না করেছে কারন চোখের নিচ দিয়ে একটা দাগ পড়ে গেছে। নিশ্চয় চোঁখের জল শুকিয়ে দাগটা হয়েছে। তুলির দিকে তাকাতেই মনটা খারাপ হয়ে গেলো।

আমি বারান্দায় এসে দাড়ালাম। আমার বার বার মনে হতে লাগলো আমি হয়ত সত্যই তুলিকে ঠকাচ্ছি। ওর তো কোনো দোষ নেই। তাহলে ও কেনো নিজের অধীকার, স্বামীর ভালোবাসা থেকে বন্চিত হবে? কিন্ত আমার কিছু করার নেই। আমি কথাকে ভালোবাসি, অনেক বেশি ভালোবাসি। কথাকে ছাড়া আমি শূন্য, কথাকে ছাড়া কিছু ভাবতেই পারি না।

আমি আকাশ, বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান। পড়াশোনা শেষ করেছি এক বছর হলো। কিন্ত কোনো চাকরি করছি না, বা করার চেষ্টাও করছি না। বাবা চাইছে আমি তার ব্যবসা দেখাশোনা করি। এই বিষয়ে আমি এখনো কোনো সিদ্ধান্ত নেই নি।

ভার্সিটি লাইফ থেকেই আমার আর কথার রিলেশন চলছে। আমরা একে অপরকে অনেক বেশি ভালোবাসি। আম্মুর মাধ্যমে বাবাকে জানিয়েছিলাম কথার কথা। কিন্ত কোনো উত্তর পাই নি। কয়দিন আগে আব্বু- আম্মু কি যেনো একটা কাজে গ্রামে আসে। আমি জিঙ্গেস করেছিলাম গ্রামে যাবার কারন কি? কিন্তা তারা আমাকে কিছু বললো না। আম্মু শুধু বললো,
— কি যেনো জমি জমার একটা ব্যপারে যেতে হচ্ছে।

আমিও আর প্রশ্ন করি নি। আব্বু আম্মু গ্রামে আসার কয়দিন পর আব্বু আমাকে ফোন করে গ্রামে আসতে বলে। আমি ছোট বেলা থেকেই আব্বুকে একটু বেশি ভয় পাই। কখনো আব্বুর মুখের উপর কথা বলতে পারি নি। সে যেটা বলেছে সেটাই করেছি ইচ্ছায় হোক বা অনইচ্ছায় হোক। আব্বুর ফোন পেয়ে আমিও গ্রামে চলে আসি। বাড়িয়ে আসতেই অবাক হয়ে যাই, বাড়িটা একদম বিয়ে বাড়ির মত করে সাজানো। সাথে সমস্ত আত্নীয় স্বজন বাড়িতে গিজগিজ করছে। ছোট মামা,বড় খালা, মেজ চাচ্চু সবাই পরিবার নিয়ে শহর থেকে এসে হাজির। কেমন যেনো একটা উৎসব উৎসব ভাব। অথচ আমি কিছুই জানি না। বাড়িতে ঢুকতেই যার সাথে দেখা হয় সেই শুধু বলে ” এতক্ষনে আসার সময় হলো তোর? ”

হঠাৎ ছোট মামার মেয়ে তিন্নির সাথে দেখা, আমাকে দেখেই তিন্নি বললো,
— এজন্যই কথায় আছে, যার বিয়ে তার খবর নেই পাড়া পড়শির ঘুম নেই।
— মানে? কি বলছিস তুই? আর তোরা কবে আসলি ঢাকা থেকে?
— আমরা তো তিনদিন হলো এসেছি।
— কেনো এসেছিস? মানে এখানে কি হচ্ছে?
— ভাইয়া,তুমি এমন একটা ভাব করছো যেনো কিছুই যানো না।
— আমি সত্যই কিছু যানি না।
— তোমাকে যানতে হবে না। যা যানার বউয়ের কাছ থেকে যেনে নিও।
— পাকনামী হচ্ছে না? একটা থাপ্পর দিয়ে দাত ফেলে দিবো।
— দু দিন পর দেখবো এই বাঘটাই বিড়াল হয়ে গেছে।

তিন্নি হাসতে হাসতে চলে গেলো, আমি আম্মুকে খুজে বের করলাম। আম্মু আমাকে দেখে এগিয়ে আসতে আসতে বললো,
— কখন আসলি?
— তার আগে বলো বাড়িয়ে কি হচ্ছে?

আম্ম আমার প্রশ্নর জবাব না দিয়ে বললো,
— আমার সাথে আয়।

আমি আম্মুর সাথে রুমে ঢুকলাম। রুমে ঢুকে দেখি আব্বু বিছানার উপর বসে আছে। আম্মু বললো,
— কি হচ্ছে সেটা তোর আব্বুকে জিঙ্গেস কর।
— আব্বু কোনো অনুষ্ঠান না কি বাড়িতে? সবাই এসেছে দেখছি।

আব্বু বললো,
—অনুষ্ঠান বলতে একটা বিয়ের অনুষ্ঠান।
— কার বিয়ে?
— তোমার বিয়ে।

আব্বুর কথা শুনে মনে হলো আমার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো। পায়ের তলা থেকে মাটি সড়ে গেলো। আমি যেনো শূন্যে ভাসছি। আব্বু যে কখনো আমার সাথে ফান জাতীয় কিছু করবে না সেটা খুব ভালো করেই যানি। আব্বু যখন বলেছে আমার বিয়ে, তখন আমার বিয়েই। এজন্যই কথাটি আম্মু আমাকে বললো না। কারন, আম্মু যদি বলতো তাহলে এতক্ষন চিৎকার করে বাড়ি মাথায় তুলে ফেলতাম সেটা আম্মু যানে। আমি আব্বুকে বললাম,
— কিন্ত একটাবার তো, আমাকে যানাতে পারতে। আমি কিছুই জানি না। আমাকে না জানিয়েই আমার বিয়ে ঠিক করে ফেললে?

কথাগুলো বলার পর মনে হলো আমি মহাভারত অশুদ্ধ করে ফেলেছি। জিবনের প্রথম আব্বুর সামনে দাড়িয়ে আমি আব্বুকে প্রশ্ন করেছি। বিষয়টা ভাবতেই আমি অবাক হয়ে গেলাম। আব্বু বললো,
— তুমি কি আমাকে প্রশ্ন করছো? তোমাকে যানানোর প্রয়েজন মনে করি নি তাই বলি নি। জার্নি করে এসেছো রুমে যাও, ফ্রেশ হও। এই বিষয়ে আর কথা বলতে চাইছি না। শুধু একটা কথা শুনে রাখ, কারন ছাড়া আমি কোনো কাজ করি না।

আমি আমার রুমে এসে বিছানায় বসে পড়লাম। সব কিছু কেমন যেনো উল্টা পাল্টা লাগছে। বুকের ভিতরের অস্থিরতা ক্রমশই বৃদ্ধি পাচ্ছে। আম্মু আমার রুমে আসতেই আমি বললাম,
— আম্মু আমি কথাকে ভালোবাসি। আর তোমরা আমাকে না জানিয়ে আমার বিয়ে ঠিক করে ফেললে? চিনি না, জানি না অচেনা একটা মেয়েকে বিয়ে করতে হবে?

— চিনিস না মানে? আর অচেনা মেয়ে কে? তোর বাবার বন্ধু তৌফিক আংকেলের মেয়ে তুলিকে চিনিস না। কত সুন্দর লক্ষী একটা মেয়ে।
— আম্মু আমি কথাকে ভালোবাসি।
— তাহলে তোর আব্বুকে গিয়ে বল।
— পারবো না।
— যেটা পারবি না সেটা বলবি না।

আম্মু রুম থেকে চলে গেলো। আমি নিরুপায় হয়ে কথাকে ফোন দিয়ে কান্না শুরু করলাম। কথা অনেকবার যানতে চাইলো আমি কান্না করছি কেনো? কিন্ত আমি কান্না করা ছাড়া কিছু বলি নি।

পরদিন, মানে আজকে এক প্রকার ধুমধামের সহিত আমার বিয়ে হয়ে গেলো তুলির সাথে। হাতের ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি রাত তিনটা বাজে। আমি আবারো সোফায় যেয়ে শুয়ে পড়লাম। বার বার কথার কথা মনে পড়ছে। কথা যদি যানতে পারে আমি বিয়ে করে ফেলেছি, এবং একটা মেয়ের সাথে এক রুমে থেকেছি তাহলে নিশ্চয় আমাকে খুন করে ফেলবে।

আকাশ থেকে মাটিতে পড়েও বেচেঁ আছি কি করে সেটা ভাবছিলাম। হঠাৎ উপর দিকে তাকিয়ে দেখি তুলি হাসছে। তখনই আমার মনে হলো, আমি আকাশ থেকে না সোফার থেকে মাটিতে পড়ে গেছি। আমি উঠে দাড়িয়ে বললাম,
— তুমি আমাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছো?
— মোটেও না, আমি আপনাকে ডাকছিলাম আপনি নিজেই পড়ে গেলেন। এতবেলা পযান্ত কেউ ঘুমায়? আম্মু ডাকছে নিচে যাওয়ার জন্য। যান ফ্রেশ হয়ে আসুন। আর কালকের সেই সেরোয়ানী এখনো পড়ে আছেন। একদম কার্টুনের মত লাগছে। যানতো ফ্রেশ হয়ে রেডি হন।

তুলি একদমে কথা গুলো বলে থামলো। আমি ভূ কুচকে তুলির দিকে তাকালাম। তুলির চুল গুলো বেশ বড়, একদম কোমড় পযান্ত, চোঁখে কাজল দিয়েছে, ঠোটে হালকা লিপষ্টিক, হালকা মেকাপে মেয়েটাকে একদম অপ্সরার মত লাগছে। আমি বললাম,
— তোমার মাথায় কি সমস্যা আছে?
— দেখে কি তাই মনে হয়?
— জি, তোমার মাথায় সমস্যা না থাকলে কাল রাতে যে কথা গুলো বললাম সেটা শুনার পর এত সাজগোজ করলে কিভাবে? আমি তো ভেবেছিলাম সকালে ঘুম থেকে উঠে একটা দুঃখীনির মুখ দেখবো। কিন্ত দেখছি একদম উল্টো। ঘঠনা কি?
— কোনো ঘঠনা নেই। আমার প্রচন্ড খুদা পেয়েছে, আপনি ফ্রেশ হয়ে আসুন একসাথে নিচে যাবো তারপর নাস্তা করবো।

তুলি আমাকে জোর করে ঠেলে বাথরুমে ঢুকিয়ে দিলো। আমি দরজা বন্ধ করতে করতে দেখি তুলি হাসছে। আমার একবারের জন্য মনে হলো ওই হাসির মাঝে হারিয়ে যাই।

চলবে……?

ভালোবাসাকে_ দিলাম_ ছুটি
Ariful_Islam_Akash

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here