#ভালোবাসাটা_ঘৃণার
#Love_OR_Revenge
লেখিকা : আনিশা সাবিহা
পর্ব ৭
সামনে বিয়ের জন্য ইনভাইটেশন কার্ড সাজিয়ে রাখা হয়েছে। একেক ইনভাইটেশন কার্ড একেক ডিজাইনের। আমার কোনটা পছন্দ সেটাই সিলেক্ট করা হবে। ইনভাইটেশন কার্ড এক সাইডে রেখে খাটের এক কোণে বসে বসে নখ কামড়াতে ব্যস্ত আমি। মাথা থেকে একটা কথা কিছুতেই বেরোতে চাইছে না। আয়াশের প্ল্যানিংটা কি? উনি কি সত্যি সত্যি সবকিছু মেনে নিয়েছেন নাকি এটাও তার প্ল্যানিংয়ের কোন অংশ মাত্র? সব থেকে বড় কথা, উনি কিনা আমার বিয়ের ডেট অবধি ঠিক করেছেন !সেটা ফোন করে বাবা কেউ জানিয়ে দিয়েছেন এবং রিকুয়েস্ট করেছেন যাতে ওই দিনটাতেই আমার বিয়ে হয়। এই দিনে বিয়ে হলে নাকি উনি সবথেকে বেশি খুশি হবেন! ভাবা যায় এসব? বাবা বেশ খুশ আমেজে থাকার কারণে ওই আয়াশের কথা খুব ভালোভাবে মেনে নিয়েছেন। আয়ার প্রতিনিয়ত আমার মাথা ব্যাথার কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছেন। জানি না কবে এই মাথাব্যাথা থেকে মুক্তি পাবো আমি!! উনার থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য আমি এক প্রকার জেদের বশে এই বিয়েতে রাজি হয়েছিলাম। নয়তো রোশন ভাইয়াকে বিয়ে করার কোনো ইচ্ছে নেই আমার। বিয়েটা আজ থেকে ঠিক ২৪ দিন পর। এই ২৪ দিন পর আয়াশ বিয়ের ডেট ঠিক করেছেন। এখানে আমার সবথেকে বেশি ভয়। কেননা ২৪ দিন পর আয়াশের বলা সেই ২৫ দিন ফুরিয়ে যাবে। কেন জানিনা মনে হচ্ছে আয়াশ আমার এবং আমার ফ্যামিলির সাথে কোন বড় ধরনের গেম খেলতে চাচ্ছেন।
এত এত ভাবনার মাঝে রিদ্ধি আপু এসে আমার পাশে ঘেঁষে বসল। আমি নাক ফুলিয়ে তার দিকে তাকিয়েও আবারও নখ কামড়াতে আরম্ভ করলাম। রিদ্ধি আপু আমার সামনে কতগুলো ইনভাইটেশন কার্ড তুলে ধরল। বিস্ময়ের সাথে বলে উঠলো…..
–” আরে সাবি, এত সুন্দর সুন্দর ইনভাইটেশন কার্ড তোর সামনে হাজির হয়েছে তবুও তোর একটাও কার্ড পছন্দ হচ্ছে না?(একটা কার্ড হাতে নিয়ে)দেখ অনেক সুন্দর। এটা পছন্দ না হলে ওই যে ওটা দেখ লাল এবং গোল্ডেন কালারের মত!”
–“উফফ… আপু আমার ভালো লাগছে না তুমি বরং তোমার পছন্দমত একটা কার্ড সিলেক্ট করে নাও।”
আপু খানিকটা বিরক্ত হলো। আরেকটা সুন্দর কার্ড হাতে নিয়ে বলল..…
–“বিয়ে তোর হবে। জামাই তোর হবে। ইনভাইটেশন যাবে তোর আর তোর জামাইয়ের নামে। আর কার্ড চুজ করবো আমি?”
কথাটা বলে আপু আমার হাতে কার্ড ধরিয়ে দিল। আমি বিরক্তের শ্বাস ফেলে কার্ড টা ছুড়ে ফেলে বললাম…
–“তো একটা কাজ করো। আমার জামাই তুমি নাও। বউ তুমি সাজো। বিয়েটাও তুমি করো। আই নেভার মাইন্ড।”
আমার কথা শোনার সাথে সাথে আপু হা হয়ে গেল। অবিশ্বাস্য কন্ঠ বলে উঠল…
–“বলছিস কিরে আমি বিয়ে করব না সে কারণে তোর বাড়িতে আমি আর ভাইয়া মিলে চলে এসেছি। এখন তুই বলছিস বিয়ে করতে?”
আমি কিছু বললাম না। একটু থেমে আপু আবারো বলে উঠলো…
–“আচ্ছা শোন কিছু কথা বলার ছিল।”
–“হ্যাঁ তো বল। এত কথা বললে কোন পারমিশন নিলেনা। এখন পারমিশন নেওয়ার প্রয়োজনবোধ করছো তুমি?”
আপু আবারো আমার গা ঘেঁষে বসে পড়ল বেশ ভালোভাবে। যেন আমার কোলের উপর উঠতে পারলে শান্তি হতো তার! ফিসফিস করা কন্ঠ বলে উঠল….
–“তুই তুই কি সত্যিই বাঘিনী হয়েছিস নাকি? কবে থেকে হলি রে?”
আপুর কথায় আমি ফুঁসে তাকালাম। অতঃপর কাশি উঠলো আমার। আপু আমার পিঠে কয়েকটা কিল দিতেই কাশি থেমে গেল।
–“সিরিয়াসলি? তুমি ওই লোকটার কথা বিশ্বাস করছ? কি ভুলভাল কথা বলে গেল আর তুমি কিনা সেই কথাতে নাচছো? অবিশ্বাস্য!!”
–” উনি যেভাবে কথাগুলো বলল বিশ্বাস না করে কি করে পারি বলতো? আর লাভ বাইট এর ব্যাপারটা…”
আপুর কথা শেষ হবার আগে আমি ধড়ফড় করে উঠে গেলাম। কপালে হাত দিয়ে বললাম….
–“হায় আল্লাহ! দেখো আমি এমনি খুব টেনশনে আছি। আমার চিন্তা আর বাড়িয়ো না। ওই লোকটার কথা বলবে না তুমি।”
কথাটা বলে ড্রেসিং টেবিলে চিরুনি নিয়ে বসলাম। মাথা বাঁধতে বাঁধতে আপুর দিকে তাকালাম। সে কার্ড দেখতে ব্যস্ত। আমার দিকে অসহায় চাহনি নিয়ে বলে উঠল….
–“এই বইন, শোন। আসলে আমাকে খালু দিয়ে পাঠিয়েছিলেন। তোর বিয়ের কার্ড দেখা হয়েছে কিনা, কোন কার্ড পছন্দ হয়েছে কিনা সেটা দেখার জন্য। কিন্তু তুই তো এখনো বিয়ের কার্ড পছন্দই করতে পারিসনি। খালু বলেছে কার্ড নিয়ে গিয়ে দিতে। তোর বিয়ের খুব কম সময়। তাই তাড়াতাড়ি ছাপতে হবে কার্ডগুলো।”
–“তুমি এক কাজ করো ওই কার্ড টা দাও।”
আমি ভালোভাবে নজর না দিয়েই কথাগুলো বললাম। আপু কার্ডগুলো বাছতে বাছতে বলল….
–“কোনটা এইটা? না এইটা।”
–“ওইযে ওইটা।” (ব্যস্ত ভঙ্গিতে)
আপু একটা লাল আর খয়েরী রঙের মিশ্রনের কার্ড ধরে বলল….
–“এইটা?”
–“হুমম।”
আমি ছোট্ট করে জবাব দিয়ে উঠে পড়লাম। ঘাড়ে সাইড ব্যাগ নিয়ে নিলাম। তখনি আপু দৌড়ে আমার কাছে এসে বলে উঠল….
–“এই এই কোথায় যাচ্ছিস?”
–“মায়ের সাথে দেখা করতে। দেখো বিয়ে এখন আমি জেদের বশেই করি আর নিজের মনের ইচ্ছের বিরুদ্ধেই করি বিয়েটা তো হচ্ছেই তাই নিজের জীবনের নতুন অধ্যায় শুরু করার জন্য মায়ের দোয়া নেব না সেটা কি হয়?”
–“আমিও যাব তোর সঙ্গে।”
আমি কোমড়ে হাত দিয়ে আঙ্গুল উঁচিয়ে বললাম…
–“কাভি নেহি। তোমার রেডি হতেই ৫ ঘন্টা লাগবে। ড্রেস চুজ থেকে শুরু করে একে একে বাড়িতে ছোটখাটো পার্লার খুলে বসবে। দেরি করার কোনো রিস্ক নিতে চাই না। নো ওয়ে।”
আপু আমার গাল ধরে বসল। টানতে টানতে মিনতি করা কন্ঠে বলল….
–“একদমই না। জাস্ট গিভ মি টুয়েন্টি মিনিটস। এর মধ্যেই রেডি হয়ে যাব। পাক্কা প্রমিস।”
আমি মুখ ফুলিয়ে বড় শ্বাস ছাড়লাম। খাটে গা এলিয়ে আধশোয়া হয়ে বললাম….
–“ওকে। ২০ মিনিটের মাঝে না এলে কিন্তু তোমাকে রেখে চলে যাব বলে দিলাম।”
আপু মন ভোলানো হাসি দিয়ে চলে গেল রেডি হতে।
সোফার এক কোণে বসে আছে আয়াশ। চোখটা তার বন্ধ। হাতের আঙ্গুলের ভাঁজে সিগারেট। সিগারেটের পোড়া অংশ অল্প অল্প করে ফ্লোরে পড়ে যাচ্ছে। নিজের পড়নের অ্যাশ কালার ব্লেজারের বোতাম খুলতে শুরু করল সে। তখনি ওর রুমের গেটে কেউ কড়া নাড়ালো। মূহুর্তের মাঝে আয়াশ নিজের মুখ খুলে গাম্ভীর্যের সঙ্গে বলল….
–“ভেতরে এসো, রকি।”
আয়াশের সমবয়সী একজন লোক ধীরে ধীরে ভেতরে এলো। আয়াশ নিজের ভয়ানক লাল চোখজোড়া খুলে সিগারেট ঠোঁটের সাথে চেপে ধরে বলল….
–“তোমাকে যে কাজের জন্য ডাকা সেটা হচ্ছে এই মেয়ে।”
ফোন বের করে স্ক্রিন ওন করে আনিশার ছবি দেখালো আয়াশ। একটু থেমে আবারও বলে উঠল….
–“তুমি আমার বন্ধুর মতো। তোমাকে আমার ডান হাতও বলা যায়। আমার বাড়িতে যখন তখন আসা যাওয়া করার পারমিশন আছে তোমার। সে হিসেবে তোমার সাথে সব কিছু শেয়ার করি আমি। এম আই রাইট?”
রকি মাথা হ্যাঁবোধক নাড়ালো। আয়াশ মুখ থেকে ধোঁয়া ছেড়ে বলে উঠল….
–“তাহলে শোনো। এই মেয়েটার খবর আমার চাই। আই মিন ও কোথায় যাচ্ছে, কি করছে কার সাথে থাকছে সব আপডেট চাই আমার। আমি তুমি ছাড়া কাউকে বিশ্বাস করতে পারি না তাই তোমাকেই কাজটা দিচ্ছি তুমি কি পারবে?”
–“ইয়েস বস। আপনি চিন্তা করবেন না। আপনার বলার মতোই সব কাজ আমি করব। নিরাশ হবেন না।”
–“আমার কথা বলার শেষ এখন তুমি আসতে পারো। আর এখন থেকেই কাজে লেগে পড়ো। রাইট নাউ।”
রকি মাথা এদিকে ওদিকে হেলিয়ে দ্রুত বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। আয়াশ জলন্ত সিগারেট নিজের হাতে মুঠোতে বন্দি করে নিল। চোখটা রাগে জ্বলজ্বল করছে। নিজের সামনে থাকা দাবার বোর্ডের গুটি সরিয়ে আরেকটা গুটিকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিয়ে বলল…
–“ইটস টাইম টু চেকমেট। আস্তে আস্তে একটু একটু করে রায়জাদা পরিবারের ধ্বংসের কারণ হিসেবে আনিশাকে খুঁটি বানাবো আমি। বিয়েটা তো হবে। তবে আমার সাথে হবে। হাহাহা!”
ভয়ানক হাসি হাসল আয়াশ।
প্রায় ১ ঘন্টা হয়েছে। আমি রিদ্ধি আপুর ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে পায়চারি করছি। আপু ঘরের দরজা লাগিয়ে রেখেছে। জোরেশোরে চিৎকার মেরে বললাম….
–“আপু আমি গেলাম। তুমি বরণ সাজতে থাকো।”
কথাটা বলা শেষ হতেই আপু তড়িঘড়ি করে দরজা খুলল। নিজের স্ট্রেট আর সিল্কি চুলগুলো ঠিক করতে করতে বলল…
–“উফফ…এমন কেন করিস বল তো সাবি? দেখ ঠিকঠাক রেডিও হতে দিলি না। সেই তখন থেকে বলেই চলেছিস আমি গেলাম। তোর বোনকে ছেড়ে যেতে একটুও কষ্ট হত না বুঝি?”
আমি আপুকে ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করলাম। রাগে তেড়ে এসে বললাম….
–“১ ঘন্টা সময় লাগিয়েছো রেডি হতে। তাও বলছো রেডি হতে পারোনি? ৬০ মিনিটে তো ভেবেছিলাম আমার বিয়ের দিনের সাজ অবধি সেজে বসে আছো। কিন্তু এখন তো দেখছি কিছুই করোনি।”
–“কে বলেছে কিছু করিনি। কত তাড়াহুড়ো করে রেডি হয়েছি জানিস? মাত্র ১০ মিনিটের মধ্যে নিজের ড্রেস বেছে নিয়েছি। ২০ মিনিট ধরে নিজের চুল বেঁধেছি আর….”
আমি কথা বলার মাঝে আপুকে থামিয়ে দিলাম। নিজের মুখ জড়িয়ে বললাম….
–“চুল বেঁধেছো? কই আমি তো চুল বাঁধা দেখতে পাচ্ছি না!” (এদিক ওদিক তাকিয়ে)
–“কি বলছিস? এইযে দেখ। ওপরে হেয়ারস্টাইল করেছি।”
–“এই স্টাইল করতে তো পাঁচ মিনিটও লাগবে না আর তুমি কি না! যাক তুমি চলো তো তোমার চক্করে সন্ধ্যা হয়ে আসবে। বিকেল গড়িয়ে যাচ্ছে এমনিতে। চলো চলো চলো।”
কথাটা বলে আপুর হাত টেনে ধরে দ্রুত হাঁটতে লাগলাম। বাইরে কেউ নেই। দুরে আসিফ ভাইয়াকে দেখলাম। ভাইয়াকে বাইরে যাচ্ছি বলে গাড়িতে উঠে বসলাম। বেরিয়ে পড়লাম মেন্টাল হসপিটালে যাওয়ার উদ্দেশ্যে।
–“আবার এ.. এসেছো? ক..কেন এসেছো? যাও যাও।”
হসপিটালে এসে আবারও মায়ের এমন কথায় হতাশ হয়ে পড়লাম আমি। তবুও মুখে হাসি ফুটিয়ে মায়ের সামনে হাঁটু গেঁড়ে বসলাম। মায়ের হাত ধরতেই মা হাত ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করল। আমি হাত শক্ত করে ধরলাম। হাত ছাড়াতে না পেরে মা শান্ত দৃষ্টিতে তাকালো। আমি মলিন হেসে মায়ের কোলে মাথা রেখে বললাম….
–“মা। তুমি কেন এমন করো বলো তো? তুমি তো ঠিক হতে পারতে তাই না? তুমি সুস্থ থাকলে কত খুশি হতে বলো তো।”
–“কি..কিসের খুশির বলছো তুমি?”
আমি মায়ের কোল থেকে মাথা উঠালাম। ছলছল নয়নে তাকিয়ে স্নিগ্ধ কন্ঠে বললাম…
–“আমার বিয়ে ঠিক হয়েছে মা। তুমি জানো তোমার মেয়ের বিয়ে ঠিক হয়েছে! তোমার বিয়ে বউ সাজবে।”
মায়ের চোখজোড়া চকচক করতে লাগল। হেহেহেহে করে হেসে দিয়ে ছোট বাচ্চাদের মতো তালি বাজালো মা। তারপর বলল…
–“বিয়ে ঠিক হয়েছে? আচ্ছা বউ সাজলে কেমন লাগে গো?”
কথাটা বলে মাথা চেপে ধরল মা। চোখ বন্ধ করে ফেলল। অস্থির হয়ে পড়লাম আমি। রিদ্ধি আপু আর আমি মিলে মাকে ধরতেই মা মাথা নাড়াতে নাড়াতে ভীতু চেহারা নিয়ে বলল….
–“না না না। বউ সাজলে অনেক ভালো লাগে। ক…কিন্তু বর ভা…ভালো না হলে বউ ভালো থাকে না। কষ্ট পায়। আমার মতো। সবাই শুধু ট…টাকা চায়। টাকা চায় শুধু।”
রিদ্ধি আপু হাঁটু গেঁড়ে বসল। মায়ের উদ্দেশ্যে নম্র গলায় বলে উঠল….
–“খালামনি, এভাবে কেন বলছো? এসব কেন বলছো তুমি? আনিশার বিয়ে। ওকে দোয়া করবেন না?”
মা হাত নাড়িয়ে মুখ ঢাকল। মায়ের চেহারার রঙ পাল্টে গেল। আমাকে আর রিদ্ধি আপুকে ধাক্কা মেরে কোথাও উঠে পালিয়ে গেল মা। আমি হাতের কনুইয়ে বেশ ব্যাথা পেলাম। মা চলে গেল। রিদ্ধি আপু উঠে আমাকে ধরে দাঁড় করাল। সঙ্গে সঙ্গে রিদ্ধি আপুকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দিলাম আমি। রিদ্ধি আপু হয়ত আমার কষ্টটা বুঝতে পারছে। আমাকে আগলে নিল রিদ্ধি আপু। অসহায় গলায় বলল…
–“কেন এখানে আসিস বল তো? জানিস তো এখানে আসলে তোর কষ্টটা কমে না বই বাড়ে।”
–“জানি না কেন আসি। আমার কিছু ভালো লাগছে না। ”
রিদ্ধি আপু আমার চোখের পানি মুছিয়ে দিল। আমাকে নানান কথা বলে শান্ত করালো সে। নিজের কষ্টগুলোকে কয়েক মূহুর্তের জন্য ধামাচাপা দিলাম। তারপর চলা শুরু করলাম। সন্ধ্যা নেমে আসছে। বাড়ি যেতে হবে। নাক টানছি আমি। নিজের গলার ওড়না ঠিক করতে করতে কিছুদূর যেতেই মনে হলো কেউ আমাদের পিছু নিয়েছে। শুকনো পাতার মড়মড়ে শব্দ আসছে পেছন থেকে। মাথা ঘুড়িয়ে পেছন দিকে তাকালাম। কাউকে দেখতে পেলাম না। আশেপাশে আযানের প্রতিধ্বনি শোনা যাচ্ছে। আমি আর রিদ্ধি আপু মাথায় কাপড় দিলাম। আবারও পেছনে পায়ের শব্দ পাচ্ছি। রিদ্ধি আপুও হয়ত পেয়েছে। তাই আমার হাত শক্ত করে ধরে আমার সাথে সেঁটে হাঁটতে লাগল। আমি শুকনো কন্ঠে বললাম….
–“এই জন্য কম সাজতে বলেছিলাম তোমায়। দেখতে তো তুমি মাশা আল্লাহ! ফরসা গায়ের রঙ একেবারে নায়িকার মতো। তার ওপর এতো সাজগোজ করলে তো কুকুর থেকে শুরু করে মানুষ, জ্বীন-ভূত সবাই পিছু লাগবে।”
আপু ভ্রু কুঁচকে তাকালো। অতঃপর ভ্যাবলার মতো বলে উঠল…
–“তুই কি আমাকে ইনসাল্ট করছিস?”
–“নাহ। আমি তোমার প্রশংসা করছি।” (ভেংচি কেটে)
তারপর আবারও আমরা নিঃশব্দে হাঁটা শুরু করলাম। পা টিপে টিপে ছোট ছোট পা ফেলে হাঁটছি। রাস্তা যেন শেষ হবার নামই নিচ্ছে না। হঠাৎ মনে একটা কথা এসে উঁকি দিল। সেটা চাপিয়ে রাখতে না পেরে বললাম…
–“আপু, আমি একটা কথা শুনেছিলাম। মাকে জড়িয়ে ধরলে বা মায়ের আশেপাশে থাকলে নাকি মা মা গন্ধ পাওয়া যায়!”
আপু কিছু একটা ভেবে বলে উঠল…
–“হুমম আমিও শুনেছি। আমি আম্মুকে জড়িয়ে ধরলে এটা ফিল করতে পারি।”
–“তাহলে আমি কেন ফিল করতে পারি না? মা মা গন্ধ কেন পাই না রিদ্ধি আপু?”
আমার কথায় আপু থেমে গেল। আযান ততক্ষণে পুরোপুরি শেষ হয়ে গিয়েছে। আমার হাত ধরে টেনে বলল…
–“এসব কি উল্টাপাল্টা কথা? কি মানে বের করতে চাইছিস তুই?” (শক্ত গলায়)
–“নাহ কিছু না।” (দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে)
–“এমন কথা যেন আমি আর দ্বিতীয় তোর মুখে না শুনি সাবি।”
পা চালালাম আমরা। কিছুদূর হাঁটতেই আমাদের সামনে কাউকে দেখে চমকে উঠলাম। অলরেডি রিদ্ধি আপু চিৎকার দিয়ে ফেলেছে। এই চিৎকারের মাঝে আমার কানে আরেকটা কথা ভেসে এসেছে।
–“নিশাপাখি!”
আপুর মুখ চেপে ধরলাম। আপু থেমে গেল। বুঝতে দেরি হলো না এতক্ষণ যে আমাদের পিছু পিছু আসছিলেন সেটা আয়াশ। পায়ের ধাপ ফেলে বললাম…
–“আপনি?”
–“আগেই বলেছি আমাদের কানেকশনটাই এমন।”
কথাটা বলে আমার কাছে এগিয়ে এলেন উনি। আমি মাথা ঘুরিয়ে বিরবির করতে লাগলাম। উনি স্নিগ্ধ গলায় বলে উঠলেন…
–“যা বলবে সামনাসামনি বলো নিশাপাখি।”
–“বলছিলাম যে আপনি এতোটাই অসভ্য যে আপনার সাথে বেকার।”
তখনি আমার হাতের ধরলেন কনুই সহ। আমি ব্যাথায় মৃদু চিৎকার দিলাম। আয়াশ আমার হাত ছেড়ে দিলেন। কিছুটা উত্তেজিত কন্ঠে বললেন…
–“কি হয়েছে? দেখি।”
আমি সরে গেলাম। রিদ্ধি আপু তখনও বাকরুদ্ধ হয়ে আমাদের দেখছেন। আয়াশ রিদ্ধি আপুর সামনে আমার কোমড় চেপে ধরলেন। কাছে টেনে আমার হাত ধরতে চাইলে সরে যেতে লাগলাম। উনি তবুও হাল না ছেড়ে আমার হাত ধরে একটু ঝুঁকলেন। রিদ্ধি আপু হালকা কাশি দিয়ে অন্যদিকে তাকালাম। আয়াশ আমার হাতের কনুই মনোযোগ দিয়ে দেখতে দেখতে রিদ্ধি আপুর উদ্দেশ্যে বলে উঠলেন….
–“মি. রিদ্ধিশা রাহমান, আমি আমার ভবিষ্যতে বউ (জ্বিহ্বাতে কামড় দিয়ে) মানে রোশনের ভবিষ্যত বউয়ের কেয়ার করছি। যাতে ওর বউ সুস্থ সবল ভাবে বাসরঘরে ঢুকতে পারে।”
মূহুর্তের মাঝেই আয়াশকে জোরেশোরে ধাক্কা মারলাম। আঙ্গুল উঁচিয়ে বললাম…
–“বাজে কথা একদম বলবেন না। মেয়েদের সামনে এসব বাজে কথা বলতে একটুও বাঁধে না তাই না?”
–“না বাঁধে না। বাঁধবেও না। আমি অসভ্য ছিলাম, আছি আর ভবিষ্যতে মহা অসভ্য হয়ে উঠব।”
আমি রিদ্ধি আপুর হাত ধরে হাঁটতে শুরু করলাম। দাঁতে দাঁত চেপে বললাম…
–“রিদ্ধি আপু চলো তো। জীবনটা নড়ক বানিয়ে ছেড়েছে একদম।”
পেছন থেকে আয়াশ চেঁচিয়ে বলে উঠল…
–“বাই বাই নিশাপাখি অ্যান্ড মিস. রিদ্ধিশা রাহমান।”
#ভালোবাসাটা_ঘৃণার
#Love_OR_Revenge
লেখিকা : আনিশা সাবিহা
পর্ব ৮
আঁকাবাঁকা পথে মাঝে হারিয়ে যায় আনিশা এবং রিদ্ধি। আয়াশ আশেপাশে তাকিয়ে পেছন ঘুটে হাঁটতে শুরু করে। মিনিট পাঁচেক হেঁটে মেন্টাল হসপিটালের মেইন গেটের সামনে এসে দাঁড়ায় সে। সেখানে থাকা দারোয়ান আয়াশকে দেখে টুল থেকে উঠে আসেন। আয়াশের উদ্দেশ্যে বেশ শান্ত গলায় বলে উঠেন…
–“আপনি কি ভেতরে যেতে চান? আপনার পেশেন্ট কি আছে?”
আয়াশ পকেটে হাত গুঁজে ঠোঁটে ঠোঁট চেপে কিছু একটা ভেবে মাথা দুলিয়ে বলে ওঠে…
–“হুমম। কাইন্ডলি আপনি দরজাটা খুলে দিন।”
–“কিন্তু আপনাকে তো মনে হয় কিছুক্ষণ আগেই দুটো মেয়ের পরে এখান থেকে বেরিয়ে যেতে দেখলাম।”
দারোয়ানের এমন কথা শুনে আয়াশ কিছুটা গম্ভীর হয়ে যায়। থমথমে গলায় বলে ওঠে…
–“এমন কোনো নিয়ম আছে কি? যে একবার হসপিটালে ঢুকলে দ্বিতীয়বার হসপিটালে প্রবেশ করা যাবে না?”
দারোয়ান না বোধক মাথা নাড়ালেন। আর কোনোরকম কথা না বাড়িয়ে মেইন গেটের ছিটকিনি খুলে দিলেন। সঙ্গে সঙ্গে তড়তড় করে ভেতরে ঢুকে পড়ল আয়াশ। হাঁটতে হাঁটতে এদিক-সেদিক সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকালো সে। সন্ধ্যা নেমে এসেছে। সে কারণে একটা পেশেন্টও বাইরে নেই। হয়ত সবাইকে বিল্ডিংয়ের ভেতরে রুমে নিয়ে গিয়েছেন ডক্টর রা। তাই আয়াশও দোতালা বিল্ডিংয়ের ভেতরে ঢুকে পড়ল। আশেপাশে সাদা আর নীল বর্ণের শাড়ি পড়া মেয়ে মানুষ দেখা যাচ্ছে। তারা তাদের কাজে ব্যস্ত। যার যা ইচ্ছে তাই করছে। এই বিল্ডিংটা শুধু মহিলাদের জন্য। পুরুষদের জন্য এরই বিপরীত দিকে আরেকটা দোতালা বিল্ডিং। সেদিন একটা লোকের সাথে দেখা করতে এসেছিল আয়াশ। লোকটা ছিল ১৬ বছর আগে ঘটা সেই ঘটনা গুলো সাক্ষী। যেই ঘটনাতে হারিয়েছিল নিজের মা বাবা। ঘটনা বললে ভুল হবে। সেটা ছিল ষড়যন্ত্র। কথাগুলো ভাবতে ভাবতে চোখমুখ শক্ত হয়ে আসে আয়াশের। নিজেকে তবুও শান্ত রেখে রিসেপশনের দিকে যায় সে।
রিসেপশনে একটা মেয়েকে কম্পিউটার নিয়ে বসে থাকতে দেখে আয়াশ সেখানে গিয়ে দাঁড়ায়। সে কিছু বলার আগেই মহিলাটি বলে ওঠেন….
–“হাউ ক্যান আই হেল্প ইউ?”
আয়াশ খানিকটা ইতস্তবোধ করে। কি বলবে সে? সে কার সাথে দেখা করতে এসেছে সে নিজেই জানে না। শুধু এতোটুকু জানে সে একটা মহিলার দেখা করবে। আর মহিলাটি আনিশার মা। আমতা আমতা করে বলে ওঠে….
–“আমি একজনের দেখা করতে চাই।”
–“জ্বি তার বলুন!”
–“জানি না তার নাম। কিন্তু নামের শেষে রায়জাদা পদবি নিশ্চয় আছে। প্লিজ কাইন্ডলি যদি আমাকে হেল্প করতেন।”
আয়াশের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকায় মহিলাটি। কিছুক্ষণ তাকিয়ে মোটা গলায় বলে ওঠেন…
–“আপনি কি বলতে চাইছেন? পেশেন্টের নাম বলতে পারছেন না। তাহলে কি করে বুঝব কার সাথে দেখা করতে চান? পেশেন্ট কি আদোও আপনার কেউ হয়?”
–“না হয় না। তবুও দেখা করতে চাই।”
–“সরি। আমরা কোনো অপরিচিত ব্যক্তিকে দেখা করতে দিই না পেশেন্টদের সাথে। আপনি আসতে পারেন।”
আয়াশ বিরক্তির শ্বাস ছাড়ে। নিজের হাতে মুখে হাত বুলিয়ে নেয়। সে কিছু বলতে যাবে তার আগেই কারো কন্ঠে পেয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে পাশে তাকায় সে। একজন মহিলা হাঁটতে হাঁটতে বিরবির করছেন। আয়াশ অবাক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে। এইতো সেই মহিলা। আনিশার মা! আগপাছ না ভেবে আনিশার মায়ের সামনে গিয়ে দাঁড়ায় সে। আয়াশকে দেখে থেমে যান আনিশার মা। আয়াশকে ভালোভাবে স্ক্যান করে সুন্দর হাসি দিয়ে বলে ওঠেন…
–“ওমা! কি সুন্দর দেখতে গো তুমি।”
আয়াশ হালকা কাশি দেয়। ফোন বের করে আনিশার মায়ের সামনে ধরে বলে ওঠে…
–“দেখুন তো চিনেন মেয়েটাকে?”
আনিশার মা দেখতে থাকে। মাথা হেলেদুলে বাচ্চামো কন্ঠে বলে উঠেন….
–“হ্যাঁ চিনি তো। এই মেয়েটা তো আমার সাথে মাঝে মাঝেই আসে। আমাকে মা মা বলে ডাকে। কতবার বলি আমি কারো মা নই বিশ্বাসই করে না।”
–“মেয়েটার নাম আনিশা। আচ্ছা আপনার কি কিছু মনে নেই? আপনার বিয়ে থেকে শুরু করে কোনো কিছু মনে নেই? আপনি এইযে এখানে আছেন। কবে থেকে আছেন কিছু মনে নেই?” (ভাবুক হয়ে)
আনিশার মায়ের চোখ আস্তে আস্তে ভীরু হয়ে আসে। ঠোঁট উল্টিয়ে বলে উঠেন…
–“সে তো অনেক আগের কথা। এখানে আনার পর সবাই শুধু আমার গায়ে অনেক তার লাগিয়ে শক দিত জানো তো। খুব কষ্ট লাগত আমার। ইনজেকশন দিত। খুব লাগত। এই আচ্ছা, তুমি এসব জিজ্ঞেস করছো কেন বলো তো? কে তুমি? আবার শক দিবে না তো?”
কথাটা বলে উনি পিছনে সরে যেতে থাকেন। আয়াশ কিছু বলার আগেই একজন ডক্টর ইয়াসমিন এসে উনাকে ধরেন। রিসেপশনিস্টও সেখানে উপস্থিত হন। তড়তড় করে বলে ওঠেন…
–“আপনাকে না বললাম এখান থেকে যেতে? আপনি এখনো এখানে আছেন?”
আয়াশের প্রচন্ড রাগ হতে থাকে। এভাবে কথা বলার সাহস কেউ রাখে না তার সাথে। এভাবে কেউ উঁচু গলায় কথা বললে মাথার রাগ চড়ে বসে তার। তবে এটা রাগ দেখানোর সময় নয়। তাই হাত মুঠোশক্ত করে সব শুনতে থাকে সে। ডক্টর ইয়াসমিন আনিশার মাকে নিয়ে চলে যান সেখান থেকে। আয়াশও আর কথা না বাড়িয়ে চলে আসে।
–“বাবা, আমি ভাবতে পারছি না। ওরা এভাবে পাল্টি খাবে? এখন কিনা ওরা ২০ পার্সেন্ট থেকে ৩০ পার্সেন্ট ভাগ চাচ্ছে।”
–“কি বলছিস তুই?”
রিক একগাদা রাগ নিয়ে বলে উঠল…
–“হ্যাঁ বাবা ঠিকই বলছি। জাস্ট রাগে মাথাটা ফেটে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে ওদের….”
–“আচ্ছা মাথা ঠান্ডা কর। যা হবে পরে দেখা যাবে। এখন রাজি হয়ে যা। আচ্ছা সব পেপারস রেডি তো?”
রিক মাথা নাড়ালো। রিকের বাবা স্বস্তির হাসি দিলেন।
বাড়িতে ঢুকছিলাম। এমনি আয়াশের নোংরা কথাবার্তাতে মেজাজটা বিগড়ে গেছে আমার। তার ওপর রিদ্ধি আপুর আলতুফালতু কথাগুলো আমার মেজাজকে আরো চড়ে দিয়েছে। বাড়িতে ঢুকতে ঢুকতে বাবা আর ভাইয়ার কথা শুনতে পেলাম। হুট করে বলে উঠলাম….
–“কিসের পেপারস এর কথা বলছো বাবা?”
বাবা আর ভাইয়া যেন আমাকে আশা করছিল না এই সময়। তাই আমাকে আর রিদ্ধি আপুকে দেখে বেশ হকচকিয়ে উঠল। আমি তাদের কাছে এলাম। ব্যাগ হাতে নিয়ে বলে উঠলাম…
–“কি হলো বললে না তো? কিসের পেপারস?”
–“আরে তোদের বিয়ের কাগজপত্র। সময় তো বেশি নেই। তাই লইয়ার এর সাথে কথাবার্তা বলছিলাম। বাবা সেটাই জিজ্ঞেস করল।”
আমি ছোট্ট করে উত্তর দিলাম…
–“ওহ।”
বাবা আমার কাছে এলো। আমার মাথায় হাত রেখে চিন্তিত গলায় বলল…
–“কোথায় গিয়েছিলি? আসিফ বলল মায়ের সাথে দেখা করতে গিয়েছিলি নাকি!”
–“হ্যাঁ বাবা। নতুন জীবন শুরু করতে যাচ্ছি। মায়ের দোয়া নিতে তো যেতেই হবে তাই না?”
বাবা মাথা দুলালো। শান্ত কন্ঠে বলল…
–“দোয়া দিয়েছে মা?”
–“না বাবা।”
কথাটা বলতে দিয়ে চোখে পানি ভরে গেল। আশেপাশে ঝাপসা দেখতে লাগলাম। বাবা আগের ন্যায় শান্ত থেকে বলল…
–“এভাবে কাঁদিস না। জানিস তো তোর মায়ের অবস্থা!”
আমি চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়ার আগেই মুছে ফেলে জোর করে হাসলাম। ভাইয়া তড়িঘড়ি করে বলে উঠল….
–“তোর বিয়ের কার্ড রেডি। যা ফ্রেশ হয়ে নে। ওপরে কার্ড রাখা আছে। তোর বান্ধবী বন্ধু যাকে ইনভাইট করতে চাস করে নিস। আর হ্যাঁ এটা ভুলে যাস না আয়াশ চৌধুরিকে আগে ইনভাইট করতে হবে। তাও সবার আগে।”
‘আয়াশ’ নামটা শুনে শান্ত মেজাজটা আবারও আগের মতো বিগরে গেল। মুখটা বাংলার পাঁচের মতো করে ভাইয়ার দিকে তাকালাম। আয়াশ নামটা আমার কাছে একটা পেইন। মস্ত বড় পেইন। ঘরে আয়াশ, বাইরে আয়াশ উফফ….! এই লোকটার জন্য জীবনটা থেকে ‘শান্তি নামটা হারিয়ে যেতে বসেছে। মাথার দুপাশে দুই আঙ্গুল দিয়ে ধরে মাথা ঝাঁকুনি দিলাম। বাবার দিকে তাকিয়ে অসহায় হয়ে বললাম…
–“ও বাবা! ওই লোকটাকে না ইনভাইট দিলেই নয়?”
–“একদমই নয়। এমনিতে আয়াশ চৌধুরীর সাথে অনেক খারাপ ব্যবহার করেছিস তুই। উনি একটা নামি-দামি মানুষ। উনার স্ট্যাটাসের মানুষের সঙ্গে শত্রুতা করা উচিত নয়। তাই ভাবছি তুই উনার সাথে যতটুকু শত্রুতা করেছিস সেটা এই বিয়েতে ডেকে সব মিটিয়ে নেব। শুধুমাত্র তোর বিয়ের প্রত্যেকটা ইভেন্টে থাকতেই তো চেয়েছে। তোকে বিয়ের তো করতে চায়নি।”
–কিন্তু বাবা, আমি উনার নামে যেসব অভিযোগ করেছি সেসব তো মিথ্যা নয়!”
বাবা এবার বেশ কড়া গলায় বলল….
–“দেখো আনিশা, তুই ছোট। আমি তোর বাবা। তোর থেকে আমি বেশি বুঝি কি করা উচিত আর কি করা উচিত নয়। তুই এখন ওপরে যা।”
আমি মুখ ফুলিয়ে ব্যাগ ঘুরাতে ঘুরাতে ওপরে চলে এলাম। বিছানায় এক গাদা কার্ড দেখতে পেলাম। এসে বসে কার্ড ঘাঁটতে লাগলাম। ওপরে থাকা কার্ড টা চোখে পড়ল। কার্ডের পেছনে বড় বড় করে লিখা, ‘আয়াশ চৌধুরী’। এর মানে এই কার্ডটা আয়াশ চৌধুরীর জন্য। ইচ্ছে তো করছে কার্ড টা জ্বালিয়ে দিতে। তবে এটা করা যাবে না। কার্ড টা দিয়ে একটু উনাকে উসকানি দিলে খুব একটা খারাপ হবে না। বেশ পৈশাচিক আনন্দ পাওয়া যাবে বটে। কার্ডটার দিকে তাকিয়ে একটা পৈশাচিক হাসি দিলাম। সেটা এক সাইডে রেখে ব্যাগ কাঁধ থেকে নামিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকলাম।
ওয়াশরুম থেকে বের হতেই দেখলাম ফোনটা নড়ছে। ভাইব্রেশনে কারণে সেটা নড়ছে। মানে কেউ কল করেছে। টাওয়াল দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে এগিয়ে গেলাম কল ধরার উদ্দেশ্যে। ফোন হাতে ধরতেই ভ্রু কুঁচকালাম। নম্বরটা অপরিচিত। কল রিসিভ করতে চাইলাম না তবুও করলাম। কানে ধরতেই ওপাশ থেকে একটা মিষ্টি গলায় ভেসে এলো….
–“হ্যালো নিশাপাখি!”
তখনি নিজের কপাল চাপড়ানো শুরু করলাম। দাঁতে দাঁত চেপে বললাম…
–“আচ্ছা আপনি কি ভেবে রেখেছেন বলুন তো? আমাকে এক সেকেন্ডের জন্যেও শান্তিতে থাকতে দেবেন না?”
–“ইউ আর সো বোরিং নিশাপাখি। হবু বর ফোন দিলে তার সাথে হাই হ্যালো করতে হয়। আমি তোমাকে ফোন দিয়ে কত সুন্দর কন্ঠে ‘হ্যালো নিশাপাখি বললাম। আর তুমি এমন রুড গলায় কথা বলছো?”
আমি উনার কথা শুনে হাসার চেষ্টা করলাম। রসকষহীন গলায় বললাম….
–“এক্সকিউজ মি! আপনি হয়ত ভুলে যাচ্ছেন যে আপনার সাথে নয় রোশন ভাইয়ার সাথে আমার বিয়ে ঠিক হয়েছে।”
ওপাশ থেকে হাসির আওয়াজ এলো। উনার হাসির কারণ উদ্ঘাটন করতে না পেরে ফোনে মনোযোগ দিলাম।
–“আচ্ছা ওই রোশন তোমার বর হয় কি করে বলো তো? তুমি একবার ওকে ভাইয়া বলছো একবার বর বলছো? ভাইয়া কি কখনো বর হতে পারে?”
–“কেন হতে পারে না? একশবার হতে পারে। হাজার বার হতে পারে। ইভেন আজকাল ভাইয়ারাই সাইয়া হয়ে যায় জানেন না? আরেকটা কথা শোনেন নি? মেয়েরা যাকে ভাইয়া ডাকে পরে তাদেরই প্রেমে পড়ে?”
প্রথমে ভাবলাম আমার কথাটাতে পুরোপুরি ভাবে দমে গেছেন উনি। তাই চুপ করে গেছেন। কিন্তু আমি ভুল ছিলাম। উনি গম্ভীর গলায় বললেন…
–“ফাউল লজিক সুইটহার্ট। ভাইয়া ডাকলে না প্রেম প্রেম ভাব টাই চলে যায়। রোমান্স করার মুড থাকে না। প্রেম প্রেম তো তখন পায় যখন তুমি গর্জে আমার নাম ধরে ডাকো। যখন বলে ওঠো,’আয়াশ চৌধুরী! আপনি নোংরা, অসভ্য, বাজে, বিরক্তিকর লোক।’ বাট বিলিভ মি তোমার কথা শুনে বিন্দুমাত্র রাগ হয় নাহ আমার। বরণ তোমাকে বিরক্ত জেগে ওঠে।”
–“আপনার কথা শেষ হয়েছে? এখন রাখি? আপনার সাথে কথা বলে সময় নষ্ট করার মতো কোনো ইচ্ছে আমার নেই। ইজ ভেরি ইম্পরট্যান্ট ফর মি। আর কয়েকদিন পর আমার বিয়ে। তাই আমার কাছে সময়ের অনেক দাম। অনেক প্রস্তুতি নিতে হবে আমায়। মানসিকভাবেও তৈরি হতে হবে।”
ওপাশ থেকে আয়াশ থমথমে কন্ঠে বলে উঠলেন…
–“হ্যাঁ তৈরি হও। মানসিকভাবে বা শারীরিক ভাবে তৈরি হয়ে নাও। কজ বিয়ের পর তৈরি হওয়ার সুযোগই পাবে না তুমি।”
আমি কান থেকে ফোন সরিয়ে ফোন কাটতে নিলাম। কি যেন মনে পড়তেই আবারও কানে ফোন ধরে হাসি দিয়ে বললাম…
–“আমার বিয়ের কার্ড তৈরি হয়ে গেছে। সর্বপ্রথম আপনিই ইনভাইটেশন পাবেন। আমি নিজের হাতে আপনাকে ইনভাইটেশন কার্ড দেব। আর হ্যাঁ প্রত্যেকটা ইভেন্টে থাকবেন। আমার আর রোশন ভাইয়ার খুব ভালো লাগবে হ্যাঁ?”
কথাটা বলে কল কেটে দিলাম। উনার প্রতিত্তোরে কোনো কথা শোনা ইচ্ছে বা ধৈর্য নেই আমার। তবে লাস্ট কথাগুলো বলে মনে একটা আনন্দ পেয়েছি! বড়ই আনন্দ….!
টেবিলে বই রেখে ঝিমুচ্ছি। বইটা কোনো কলেজ বা ভার্সিটির নয়। বইটা উপন্যাসের। লেখাপড়ার পাট চুকিয়ে ফেলেছি অনেক আগে ফাইনাল পরিক্ষা দিয়ে। হুমায়ন আহমেদের উপন্যাসের বই। উপন্যাসের নাম ‘একজন মায়াবতী’। শেষদিকে উপন্যাস পড়া। ঘড়ির কাটা ১১ টাতে ঠেকছে। ৯টার থেকে ঘরে দরজায় কড়া নাড়িয়েছে অনেকে। খেতে ডাকতে এসেছিল সবাই। আমার খাওয়ার ইচ্ছে নেই মোটেও। মোট ৭ কাপ চা খেয়ে পেট ভরিয়ে ফেলেছি। গালে হাত দিয়ে ঘুমে তলিয়ে যাচ্ছিলাম তখনই দরজার খটখট আওয়াজে চোখ খুলে চমকে উঠলাম। ঘাড় ঘুড়িয়ে পেছন দিকে তাকাতেই দেখলাম রিদ্ধি আপু দরজা ঠেলেঠুলে ঢুকছে। হাতে খাবারের ট্রে। আমার ঘুম ঘুম চোখ দেখে তৎক্ষনাৎ সে বলে উঠল….
–“কিরে, ঘুমে ঢুলছিস তবুও বই পড়ছিস?”
আমি ছোট্ট করে উত্তর দিলাম…
–“হু।”
–“আয় একটু খেয়ে নিবি।”
আমি চোখ ঢলতে ঢলতে গিয়ে খাটে বসলাম। আপু ভাত মাখিয়ে আমার সামনে খাবার তুলে ধরতেই হা করলাম আমি। খাবার চিবুতে চিবুতে বললাম…
–“বাড়ির সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে?”
–“না। রিক ভাইয়া জেগে ছিল। বলল তুই নাকি ডিনার করিসনি। তোর জন্য খাবার নিয়ে আসতে।”
–“আচ্ছা কালকে একবার আয়াশ চৌধুরীর বাড়ি যাবে?”
চুপচাপ খাবার মাখাচ্ছিল আপু। আমার কথা শুনে থেমে গেল। সন্দেহি গলায় বলে উঠল…
–“ব্যাপারটা কি বলতো? দেখ তুই কিন্তু বিয়েতে রাজি হয়েছিস। এখন আবার আয়াশের প্রেমে টেমে পরিস না। তাহলে কেলেংকারি হয়ে যাবে বলে রাখলাম।”
আমি দুর্বল গলায় বললাম….
–“আপু তুমিও না। পৃথিবীতে যদি আয়াশ ছাড়া আর কোনো ছেলে না থাকত। তবুও না চির কুমারি থেকে যেতাম বিশ্বাস কর। তাও ওই লোকটাকে বিয়ে করতাম না বা প্রেম করতাম না। এতোটা বাজে চয়েস না আমার।”
–“তাহলে কেন ওর বাড়িতে যাওয়ার কথা বলছিস? দেখ একটা কথা বলে রাখি। সামনে তোর বিয়ে। অনেক প্রস্তুতি নিতে হবে আমার। কি রঙের ড্রেস পড়ব, কেমন হেয়ারস্টাইল করব, কেমন মেকওভার হবে সব চুজ করতে হবে। তার ওপর আমার ফেসের অবস্থা দেখেছিস? পার্লারে যেতে হবে তো। বিয়ের অনেক কম সময়। আমি কোথাও যেতে পারব না বাবা।”
আমার কপালে ভাঁজ পড়ল। পিনপিনে গলায় বললাম…
–“রিদ্ধি আপু, আমার মনে হয় বিয়েটা আমার না তোমার হচ্ছে।”
রিদ্ধি আপু মুখ ফুলিয়ে তাকালো আমার দিকে। আমি রাগে ফোঁস ফোঁস করতে করতে বললাম…
–“লাগবে না। তুমি বাসায় বসে রুপচর্চা করো। আমি একা যাব। নয়ত ভাইয়াকে নিয়ে যাব।”
আপু যেন খানিকটা নিশ্চিন্ত হলো। আমাকে খাওয়ানোতে মন দিল সে। আমি আর দুইবার ভাত মুখে নিয়ে পানি খেয়ে ধপ করে শুয়ে পড়লাম। গায়ে চাদর টেনে নিয়ে চোখ বন্ধ করলাম। তখনও আপু হা করে তাকিয়ে আছে। একচোখ খুলে তাকিয়ে বললাম…
–“গুড নাইট!”
চলবে….🍂🍂
বি.দ্র. ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।
চলবে….🍂🍂
বি.দ্র. ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।