ভালোবাসাটা_ঘৃণার পর্ব ১৫+১৬

#ভালোবাসাটা_ঘৃণার (সিজন ২)
#Only_Love
#Anisha_Sabiha
পর্ব ১৫
বাড়িতে অনেক মেহমান এসে উপস্থিত হয়েছে। এর মাঝে বেশির ভাগ মানুষ আমাকে আনিশা ভেবেছে। রিক রায়জাদা আমাকে খোঁচা মেরে কথা বলতে বাদ রাখেনি। হঠাৎ চোখটা ওপরে গেল। আয়াশের তীক্ষ্ণ নজরটা আমার দিকে। চোখ নামিয়ে নিলাম আমি অভিমানে! ধীর পায়ে নিচে নেমে এলেন উনি। সবার নজর উনার ওপর গেল। তবে আয়াশ ভ্রুক্ষেপহীন হয়ে একপা দুইপা করে নিচে নামছেন দুই পকেটে হাত গুঁজে। শুরু হলো কিছু মেহমানদের কানাকানি। একজনের কথাগুলো এসে লাগল আমার বুকে।
–“এইতো কয়েকদিন হলো। কয়েকদিন আগেই না এই মিসেস. রেজওয়ানের মতো আমাদের আনিশার বিয়ে হয়েছিল এই ছেলেটার সঙ্গে? ছেলেটা বিয়ে নিয়ে কতো কান্ডই না বাঁধিয়েছিল। এখন ধেই ধেই করে অন্য জনের সঙ্গে বিয়ের পীড়িতে বসছে।”

তা শুনে ভেংচি কেটে বিরক্তির শব্দ করল ওপর মহিলাটি। তাচ্ছিল্যের সুরে বলল….
–“সব ছেলের এক মেয়ে দিয়ে ক্ষুধা মেটে নাকি? সব ছেলে না হলেও এসব বড়লোক ছেলেদের হালচাল এমনই হয়। একজন গেল তো আরেকজন এলো। আনিশা তো ছিল এই ছেলেটার আর্কষণ। এছাড়া কিছুই না। ওসব ভালোবাসা টালোবাসা বিয়ের পর সংসার টানতে গিয়ে এমনি চাপা পড়ে।”
চোখের কার্নিশে একটু একটু করে পানি জমা হলো। তাহলে কি আয়াশ আস্তে আস্তে সত্যি পাল্টে যাচ্ছেন? আমার ভালোবাসা হারিয়ে যাচ্ছে? ঠুনকো হয়ে যাচ্ছে?

বড় বড় শ্বাস নিয়ে নিজেকে শান্ত করে নিলাম। জানু না নিয়তির এই ভয়ানক খেলার শেষে কার ভাগ্যে কি লিখা আছে! অবশেষে কি আমার মৃত্যু হবে নাকি ওই জানোয়ারদের? ভাবনার ফোড়ন কেটে ফেললেন আয়াশ। আমার দিকে তাকিয়ে হঠাৎ হেসে দিলেন উনি। একটু একটু করে আমার কাছে এসে আমার দিকে ঝুঁকে ঘাড় বাঁকিয়ে বলল…..
–“সো মিস. উপস….মিসেস. রেজওয়ান! কাল তো আমার এঙ্গেজমেন্ট। আপনার তো কোনো তোড়জোড় দেখছি না। আই মিন বাড়িটা কেমন হয়ে আছে না? বাড়ি সাজাতে কেউ আসেনি। আপনি দায়িত্বটা ঠিকঠাক পালন করতে পারবেন তো?”
–“ডাউট ক্লিয়ার হয়ে যাবে কালকে। এমন এঙ্গেজমেন্ট হবে সবার চোখে তাক লেগে যাবে।”

আয়াশ আমার কানের কাছে ঠোঁটজোড়া এনে স্নিগ্ধ গলায় বললেন….
–“আই এম ওয়েটিং নিশাপাখি। লেটস সি, কে কাকে তাক লাগাতে পারে!”
কথাটা বলে দূরে সরে গেলেন আয়াশ। আমি সূক্ষ্ম চোখজোড়া নিয়ে উনার দিকে তাকিয়ে রইলাম। পরিচিত কারো গলা শুনে চোখ নিমিষেই ছোট ছোট হয়ে গেল। অবিশ্বাস্য মনে হতে লাগল সবকিছু। মেইন দরজায় চোখ রাখতেই খুশিতে মনটা নেচে উঠল। রিদ্ধি আপু, মি. ভদ্র ওরফে আসিফ ভাইয়া। সেই সঙ্গে রয়েছে খালামনি আর খালু। দুই পা এগিয়ে গেলো অজান্তেই। তারপরেই পিছিয়ে গুটিয়ে নিলাম নিজেকে। ঢক গিলে চেয়ে রইলাম তাদের দিকে। বার বার উত্তেজনার বশে উল্টোপাল্টা কাজ করে ফেলছি আমি।

পেছন ফিরে আয়াশকে খুঁজতে লাগল দুই চোখ। চোখজোড়া আঁটকে গেল সিঁড়ির ওপরে থাকা উনার দিকে। অর্ধেক দেখা যাচ্ছে উনাকে। মস্ত বড় দেওয়ালের সঙ্গে গা এলিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন উনি। মুখে বাঁকা চমৎকার হাসি। উনার হাসি বলে দিচ্ছে, কি অবাক হচ্ছো? বলেছিলাম না? কে কাকে তাক লাগাতে পারে দেখতো থাকো। আই এম উইন দ্যা গেম।
পুরোপুরি দেওয়ালের ওপাশে চলে গেলেন উনি। আমি আমার হাসি মুখটা গায়েব করে স্বাভাবিক মুখ রেখে রিদ্ধি আপুদের দিকে তাকালাম। তাদের সঙ্গে কি যেন কথাবার্তা বলছে মাহাতাব রায়জাদা। তার চোখমুখ বলে দিচ্ছে, রিদ্ধি আপুরা আসাতে সে মটেও খুশি নয়। মাহতাব রায়জাদা নিজের কথাবার্তা শেষ করে আমার দিকে তাকালেন। আকাশ ভাইয়া আর অহনা ব্যস্ত আদ্রিতাকে নিয়ে।এতো লোকজন দেখে শুধু ছুটে বেড়াচ্ছে মেয়েটা।

রিদ্ধি আপু বাদে সবাই আমাকে দেখতে দেখতে পাশ কাটিয়ে চলে গেল। রিদ্ধি আপু দাঁড়িয়ে পড়ল আমার সামনে এসে। আমার দিকে হাত বাড়াতে গিয়েও থেমে গেল সে। আমি তার হাতের দিকে তাকালাম। রিদ্ধি আপু আগের মতো নেই। তার চেহারায় কত বদল! আগের মতো চকচক করে না তার ত্বক। উজ্জ্বলতা যেন রোদে পুড়ে গিয়েছে। বেশি সাজগোজ করে না। হাসোজ্জল মেয়ের মুখে হাসি অবধি নেই।
–“তুমি দেখতে পুরোপুরি আমার সাবি এর মতো। তুমি আমার সাবি নই ব্যাপারটা অবিশ্বাস্য! এক মূহুর্তের জন্য মনে হয়েছিল আমি আমার সাবিকে ফিরে পেয়েছি।”
তার কথার মাঝে স্পষ্ট ফুটে উঠেছে নিরাশা, কিছু হারিয়ে ফেলার যন্ত্রণা। আমি যদি এখনি তাকে জড়িয়ে ধরে বলে দিতে পারতাম আমিই তোমার সাবি। যার সঙ্গে জড়িয়ে আছে তোমার হাজার হাজার স্মৃতি। বলতে পারলাম না আফসোস! রিদ্ধি আপুও চলে গেল ওপরে।

আমার অনেক কাজ আছে। সেই কারণে ঘরো যেতে হবে। যেই ভাবা সেই কাজ। পা চালিয়ে সিঁড়ির রেলিং এ এক হাত রাখতে সেই হাতের ওপর হাত রাখল অন্য কেউ। কিছু বুঝে উঠবার আগেই টান দিল কেউ আমার হাত ধরে। আমার হাত ছিঁড়ে যাওয়ার উপক্রম। কিন্তু ছিঁড়ল না। চলে গেলাম সেই ব্যক্তিটার বুকে। সিঁড়ির কোণার ঘরের সামনে আছি বর্তমানে। শার্টের ওপরে দুটো বোতাম খোলা থাকায় মানব টার লোমশ চুল স্পষ্ট। মানুষটাকে চিনতে বেশি বেগ পেতে হলো না আমার। আলতো ধাক্কা দিয়ে সরে আসতেই উনি আমার দিকে ঝুঁকে পড়লেন। চোখ টিপ দিয়ে বললেন…..
–“কেমন লাগল আমার সারপ্রাইজ?”
–“আই ইনজয় ইট। বাট আপনি আমাকে এভাবে টেনে আনলেন কেন?”

ভ্রু কুঁচকে প্রশ্ন করলাম আমি। আয়াশ জবাব দিলেন না। আমার কাঁধে উনার লোহার মতো শক্ত হাতজোড়া তুলে দিয়ে কাছে টেনে নিলেন। আমার চোখেমুখে ফুঁ দিয়ে বললেন….
–“ইটস টাইম টু রোমান্স!”
–“বিয়ে একজনের সাথে, রোমান্স আরেকজনের সাথে? আপনার স্বভাবটা কোনোদিনও কি পাল্টাবে না?”
কাট কাট করে জবাব দিয়ে আঘাত করলাম আমি। অসহ্য লাগছে এতোকিছু। এতো মেহমান, এতো সাজসজ্জা, এতো তোড়জোড় আমার মাথার প্রত্যেকটা স্নায়ু ছিঁড়ে ফেলছে একটু একটু করে। তবে আমার কথার পরিবর্তে আয়াশ সরাসরি আমার গালে চুমু দিয়ে বসলেন। মুখটা অটোমেটিক হা হয়ে গেল। হা করে তাকাতেই আমার ঠোঁটের নিচের অংশটা নিজের ঠোঁট দিয়ে ছুঁইয়ে দিলেন উনি।

আমার রগে রগে শিহরণ বইতে শুরু করল। গলা শুকিয়ে এলো। আয়াশের থামার নাম নেই একটু একটু করে আমার কপাল, গাল আর চিবুক চুমু দিয়ে একাকার করে ফেলছেন উনি। আমার হুঁশ আসতেই আমি নিজেকে ছাড়াতে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। দাঁতে দাঁত চেপে বললাম….
–“আপনি কি করছেন? পাগলামি কমান। এটা সেঁজুতি মায়ের রুম। সেঁজুতি মা দরজা খুললেই বিশ্রি কান্ড ঘটবে।”
–“সো হোয়াট?” (ভ্রু উঁচিয়ে)
আমি চোখ রাঙিয়ে বললাম….
–“সো হোয়াট মানে? আমি জানি আপনার কিছু যায় আসে না। আপনার লজ্জা সেই অনেক আগের থেকে নেই তা আমার ভালোভাবে জানা। কিন্তু আপনার জন্য আমার লজ্জা জলাঞ্জলি দিতে পারি না আমি।”

কথাগুলো বলা শেষ হতে না হতেই দরজা খোলার আওয়াজ এলো। চোখ রসগোল্লার মতো হয়ে এলো আমার। আয়াশকে ধাক্কাতে ধাক্কাতে দরজার পেছনে নিয়ে এলাম আমি। আমিও উনার পাশে এসে দাঁড়ালাম। সেঁজুতি মা বেরিয়ে এলো। নিশ্বাস বন্ধ হয়ে যাবার জোগাড়। এরই মাঝে খেয়াল করলাম আমার কাঁধে ভর দিয়ে একেবারে টেনশন ফ্রি হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন উনি। উনাকে এমন দেখে মনে হচ্ছে উনার কোনো চিন্তাই নেই। যত রাজ্যের চিন্তা আমার। সেঁজুতি মা মাথায় কাপড় দিয়ে স্ট্রেট চলে গেল। হাফ ছেড়ে বেঁচে রেগেমেগে চলে আসতে নিলে আমার হাতটা ধরে নেন উনি। ঠোঁট কামড়ে হেসে বলেন….
–“এভাবেই কষ্ট পাবে, ভালোবাসাও পাবে সুইটহার্ট। কষ্টটা পাবে এতোদিন আমার থেকে দূরে থাকার জন্য। আর ভালোবাসা পাবে আমার ভালোবাসা লাগবে সেজন্য।”

উনার কথার আগামাথা একটু বুঝলেও পুরোটা বোধগম্য হতে একটু সময় লাগল। ততক্ষণে উনি ঝড়ের গতিতে সিঁড়ি দিয়ে উঠে গেছেন। আমি মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে থাকলাম। ঘোর কাটতেই চলে এলাম ঘরে। এসেই ড্রেস পাল্টে নিলাম। ওপরে পড়লাম লং কোট। পুরো মুখ পেঁচিয়ে নিলাম আমার স্কার্ফ দিয়ে। অতঃপর ঘর থেকে বেরিয়ে এপাশ ওপাশ দেখে চলে এলাম দোতালায়। দোতালায় সর্বপ্রথম মাহতাব রায়জাদার ঘর পড়ে। আশেপাশে দ্বিতীয় বারের মতো সূক্ষ্ম পর্যবেক্ষণ করে ঘরে ঢুকে পড়লাম আমি। ঘরে কেউ নেই। দরজা ছিল হালকা করে লাগানো। ঘরে ঢুকতেই মদের উটকো গন্ধ আসতেই নাক শিটকে গেল আমার। বুড়ো হয়েছে অথচ আজেবাজে জিনিসের প্রতি নেশা এখনো কমেনি।

আস্তে আস্তে একটু একটু করে পুরো ঘর ঘাটলাম। প্রায় মিনিট পনেরো পর একটা ড্রয়ার খুলতেই সামনে এলো পড়ল একটা কাগজ। দেখে মনে হচ্ছে প্রোপার্টি পেপার! সেটা হাতে নিয়ে মনোযোগ দিয়ে দেখতে থাকলাম আমি। নিচে সিগনেচার ব্রাঞ্চ ফাঁকা। আমি ভুল না হলে এখানে আয়াশের সাইন হবে। কিন্তু কিভাবে? আয়াশ সচেতন অবস্থায় কিছুতেই এসব পেপারে সাইন করবে না। সাইন করার আগে পেপার পড়ে নেবে। সেখানে এরা কি করে সাইন করাবে? বড় নিঃশ্বাস নিয়ে ভাবতে লাগলাম। মাথায় এলো বিয়ের ব্যাপারটা। ওহ, তাহলে কি বিয়ের পেপারের মাধ্যমে সই জাল করবে মাহতাব রায়জাদা? পেট ফেটে হাসি বের হতে চাইলেও হাসতে পারলাম না আমি। এই বিয়ে হলে না কাগজে সই পড়বে? আর জাল করবে? বয়সের সঙ্গে বুদ্ধি লোপ পায় স্বাভাবিক ব্যাপার।

পেপার আগের জায়গায় রেখে দিয়ে চুপচাপ রুমের বাইরে বেরিয়ে এলাম। রুমের বাইরে বেরিয়ে আসতেই একটা কান্নার আওয়াজ শুনতে পেয়ে সজাগ হয়ে উঠলাম আমি। আওয়াজটা শেষ মাথার ঘর থেকে আসছে। দেরি না করে পা টিপে টিপে দাঁড়ালাম দরজার কাছে। রিদ্ধি আপুর কান্না দেখে ধড়ফড় করে উঠল আমার বুকের ভেতরটা। কিছু না ভেবেই ঢুকে গেলাম ঘরে। আমাকে দেখে হকচকিয়ে উঠে চোখের পানি সেকেন্ডের মাঝে মুছে ফেলল সে। আমি মলিন হেসে বললাম….
–“লুকিয়ে লাভ আছে? আমি তো দেখে ফেলেছি রিদ্ধি আপু।”
গোলগোল চোখ করে তাকালো সে। কেঁপে উঠে বলল….
–“আপনি আমার নাম কি করে জানলেন?”
–“আমি তোমার নাম জানব না? এটা কোনো কথা? তোমার সাবি তোমার নাম জানবে না?”

রিদ্ধি আপুর কিছুক্ষণ স্থির থেকে অসাময়িক হাসি দিয়ে উঠল। আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। কান্না ছেড়ে দিল।
–“আমি জানতাম। তুই ই সাবি। আমাদের আনিশা। তোকে প্রথম দেখেই চিনেছিলাম। কিন্তু মাহতাব খালু বলল তুই নাকি মায়াবিনী রেজওয়ান। আমাদের আনিশা নস। তবুও অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছিল।”
–“ওরা জানে না আমি আনিশা। জানে না বললে ভুল হবে। জানে হয়ত। সন্দেহ করে। তবে প্রমাণ করতে পারে না।”
–“মানে?”
আমাকে ছেড়ে দিয়ে বিষয়টা বোঝার চেষ্টা করল সে। আমি সংক্ষেপে পুরো কাহিনীটা বলতেই নিজের মুখ চেপে ধরল রিদ্ধি আপু। হতবাক হয়ে বলল….
–“এরা কত ভয়ানক! ছি!!”

–“এরা তো আগে থেকেই এমন ছিল। কিন্তু তুমি কেন কাঁদছিলে? কি হয়েছে বলো তো?”
আমার কথায় মুখটা কালো করে ফেলল রিদ্ধি আপু। চোখ থেকে টপটপ করে গড়িয়ে পড়ল পানি। হাউমাউ করে কেঁদে দিতেই চমকে গেলাম আমি। আমার হাত ধরে মাথা ঠেকিয়ে সে বলল….
–“আমি বোধহয় মরে গেলেই সেদিন ভালো হতো রে সাবি। রিক ভাইয়ের গুলিতে মরে গেলে সব ঠিক থাকত।”
–“এসব কি যা নয় তাই বলছো তুমি?” (রেগে)
–“যা নয় তাই বলছি না আমি। আমাকে তো আয়াশ ভাইয়া কয়েকদিনের জন্য আমি কোমায় থাকা অবস্থায় গায়েব করে দিয়েছিল। সেখান থেকেই কুৎসা রটে। আজেবাজে কথা চারিপাশে ছড়িয়ে পড়ে। কেউ কেউ ভাবে আমি পালিয়েছি কারো সঙ্গে উল্টোপাল্টা কিছু করে। আরো অনেক কথা ছড়ায়। আমি বাড়িতে ফিরলে আমার বিয়ের জন্য পাত্র দেখা হয়। সবাই শুধু মানুষের মুখে কথা শুনে আমাকে যা নয় তাই বলে চলে যায়। শুধু তাই নয় আমার পরিবারকেও কথা শুনায়। বিয়ে হচ্ছিল না আমার। সব সম্বন্ধ ভেঙে গেছে। সবাই আশা ছেড়ে দিয়েছে। আমার আর বাঁচতে ইচ্ছে করে না।”

অস্থির হয়ে উঠলাম আমি। প্রাণ বাঁচাতে গিয়ে এখন দুর্নাম রটে যাচ্ছে। মানুষগুলো এমন কেন? আশেপাশের কিছু মানুষ অন্যের বেঁচে থাকা দুর্বিষহ করে তোলে। আমি রিদ্ধি আপুকে শান্তনা দিয়ে বললাম….
–“তোমার জন্যেও ঠিক কেউ না কেউ আছে। সে হয়ত দেরিতে আসছে। তবে আসবেই। চিন্তা করো না।”
আপুকে বুঝিয়েশুনিয়ে বেরিয়ে এলাম আমি। সব এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। জানি না কি করব? কোনদিকে যাব! পথ হারিয়ে ফেলেছি। কান্না পাচ্ছে খুব কান্না পাচ্ছে।

ঘরে চোখ বন্ধ করে স্ট্রেট হয়ে শুয়ে ছিল আয়াশ। হাত আর মস্তিষ্ক দুটোই বলছে, কেন তুই তোর শত্রুর বাড়িতে রয়েছিস? মারতে পারছিস না কেন? ওদের মারতে নিজের হাতে অস্ত্র তুলে নিয়েছিস আজ কি হলো তোর?
মাথা কাজ করা বন্ধ করে দেয় এক পর্যায়ে। উঠে বসে মাথার চুল টানতে থাকে আয়াশ। কিছু একটা বিরবির করে থাকে সে। তার কর্মে বিচ্ছেদ ঘটে ফোনের রিংটোনে। ঘাড় ঘুড়িয়ে তাকায় ফোনের দিকে। ফোনটা বাজছে অনবরত। হালকা হালকা কাঁপছে। তাড়াহুড়ো না করে ফোনটা নেয় সে। আননোন নম্বর দেখে কপালে ভাঁজ পড়ে তার। ঠোঁট হালকা বাঁকিয়ে কল রিসিভ করে কানে ধরে সে।

–“হ্যালো? আয়াশ চৌধুরী স্পিকিং!”
ওপাশটা নিরব। এক রাশ বিরক্ত হয় আয়াশ। কান থেকে ফোন সরিয়ে নেয় সে। আবার কানে ধরে বলে….
–“হ্যালো, হ্যালো। হোয়াট দ্যা হেল? কথা বলার জন্য দিলে কথা বলা উচিত এতোটুকুও বুদ্ধি কি নেই?”
বেড থেকে নেমে ফোনটা কানে ধরেই বেরিয়ে যায় আয়াশ। আয়াশের ধমকানি শুনে ওপাশ থেকে কাঁপা কাঁপা আওয়াজ ভেসে আসে।
–“হ…হ্যালো।”
একটা মেয়ের গলা শুনে অতি মাত্রায় বিরক্ত হয় আয়াশ। প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয়।
–“হু আর ইউ?”
–“আ…আমি অধরা।”
–“হঠাৎ ফোন করলেন? এনি রিজন?”
ওপাশ কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে উত্তর আসে….
–“না.. ইয়ে মানে, আমার ভাইয়া বলল আ…আপনার সঙ্গে কথা বলতে তাই।”
–“সো হোয়াট? আমি এখন বিজি আছি। ফোন রাখছি।”

কিছু বলার আগেই ওপর পাশটা স্তব্ধ হয়ে গেল। অধরা নিজের ফোনটা হাতে ধরে এক নজরে তাকিয়ে থাকে। ফোনটা এখনো কাটেনি। মনে প্রশ্ন উঠতে থাকে। মানুষটা এতো রুক্ষ কেন? একেবারে মরুভূমির মতো। একটু পরেই মুচকি হাসল সে। তার হাসিটা মিষ্টি বেশ। মনে মনে ভাবল, কয়েকদিন পর তো তার সঙ্গে বিয়ে হচ্ছেই। সমস্যা কি? নিজের ভালোবাসা দিয়ে না হয় ঠিকঠাক করে নেবে সব।
হাজারো রাগ-বিরক্ত নিয়ে বড় বড় পায়ের ধাপ ফেলে হাঁটছে আয়াশ। ওর হাতে এখনো ফোন। বিরক্ত ওই অধরা মেয়েটার জন্য। আর রাগ তার নিশাপাখির ওপর। মেয়েটাও না কি এক জালে ফাঁসিয়ে দিয়েছে আল্লাহ জানে। বার্গারের মতো চিবিয়ে খেতে পারলে শান্ত হতে পারত সে। আনিশার কথা ভাবতে ভাবতেই করিডোরের শেষ প্রান্তে এসে পৌঁছায় সে। সেখানে রয়েছে খোলামেলা বারান্দা। আশেপাশে কাঁচের আবরণ। আবরণ ঘেঁষে তার প্রেয়সীকে দেখে চোখে ঘোর লাগে তার।

বাড়ির পেছনের গাছপালার পাতার নড়াচড়া দেখতে মগ্ন আমি। মনে কতশত দ্বন্দ্ব! খুঁজে চলেছি পথ। এক চেনা স্পর্শ আমার কাঁধ ছুঁইয়ে গেল। ঠোঁটের স্পর্শ কাঁপিয়ে তুলল আমার লোমকূপ। আস্তে করে পিছনে ঘুরতেই আয়াশ আমার কোমড় চেপে ধরলেন। আমি উনার চোখের নিজের চোখ স্থির রেখে বললাম….
–“পেয়ে গেছি। আপনিই সেই। যেই পথ আপনাকে দিয়ে শেষ হয়। যেই পথের শেষে আপনি দাঁড়িয়ে থাকেন। আপনিই সেই মানুষ আয়াশ।”
আমার গাল নিজের হাতজোড়া দিয়ে ছুঁইয়ে দিলেন উনি।
–“আমিই হয়ে থাকতে চাই তোমার সেই পথ। কেউ তোমার শেষ পথ হবার চেষ্টা করলেও হতে দেব না আমি। তুমি চাও বা না চাও তোমার শেষ পথ আমিই হয়ে থাকব সারাজীবন।”
#ভালোবাসাটা_ঘৃণার (সিজন ২)
#Only_Love
#Anisha_Sabiha
পর্ব ১৬
ঘরে ফেরার পথে নিজের ফোনে চোখ পড়তেই ভ্রু কুঁচকে আরো বিরক্তি হয় আয়াশ। অধরা মেয়েটা এখনো ফোন কাটেনি? আজব! তখনই মনে পড়ে সে কিছুক্ষণ আগেই আনিশার সঙ্গে তাদের ভালোবাসার কথা বলছিল। ইন্সট্যান্ট ফোনটা কানে ধরে সে। রুক্ষ আর রসকষহীন গলায় বলে….
–“হ্যালো, মিস. অধরা? আপনি লাইনে আছেন?”
ওপাশটা একেবারেই নিরব। শুধু একটা শোনশোন আওয়াজ আসছে। যেটা সম্ভবত নিশ্বাসের। তাহলে কি মেয়েটা সব শুনে ফেলল? এবার খানিকটা জোরেই সে বলল….
–“মিস. অধরা, আপনি শুনতে পাচ্ছেন?”
–“আ…আপনি অন্য কা…কাউকে ভালোবাসেন?”
কাঁপা কাঁপা আওয়াজটা থামিয়ে দেয় আয়াশকে। সুঁচের মতো ভয় তার মনে এসে ফুটে যায়। ও সব শুনেই ফেলেছে। নিজের ঠোঁট ভিজিয়ে নেয় আয়াশ।

–“আপনি সব শুনেছেন?”
–“হ্যাঁ। আমি সব শুনেছি। অন্য কাউকে ভালোবাসেন আমাকে বললেই পারতেন। সম্পর্ক এ..এতোদূর এগিয়ে যেতো না।”
অধরার শেষ কথাগুলো দলা পাকিয়ে যায়। গলা ধরে আসে। দুই-একদিনের পরিচয় হওয়া এই রুক্ষ মানুষটার প্রতিও তার একটা টান অজান্তেই হয়েছে। এবার তার কাছে স্পষ্ট ওই মানুষটার তার প্রতি রুক্ষ ব্যবহারের কারণ। সে শুনেছে আয়াশের শীতল কন্ঠে যেটা ছিল অন্য কারোর জন্য। আয়াশ বৃদ্ধা আঙ্গুল দিয়ে কপাল বুলিয়ে দম নিয়ে বলল….
–“আমার কোনো উপায় ছিল না। আ…”
কথাগুলো বলবার মাঝ মূহুর্তে আয়াশ খেয়াল করে তার হাতে আর ফোনটা নেই। পেছন ফিরে তাকায় সে।

আয়াশের সঙ্গে অধরার সাথে কথা বলার ভঙ্গি দেখে মনে হলো অধরা কিছু জেনে গিয়েছে আমাদের ব্যাপারে। ও হয়ত কোনো না কোনো ভাবে শুনে ফেলেছে আমাদের কথা। আয়াশ সব ফাঁস করার আগে ছোঁ মেরে কেঁড়ে নিলাম ফোনটা। নিজের কানে ধরে দ্রুত বললাম….
–“অধরা, তুমি ভুল বুঝছো। আমার আর আয়াশের মাঝে তেমন কিছু ন….নেই (আটকা আটকা গলায়)।”
–“আমি জানি না আপনি কে বলছেন। তবে আমি এতোটা বোকা নই যে আপনাদের কথপোকথন বুঝতে অসুবিধে হবে। আপনারা দুজন দুজনকে ভালোবাসলে এভাবে লুকোচুরি করবেন না।”
ভাবুক হয়ে আয়াশের দিকে চোখ রাঙালাম আমি। আজ যদি বিয়ে ভাঙে সন্দেহটা আমাকে আর আয়াশকে ঘিরেই হবে। তীরে এসে তরী ডুবতে পারে না। কিছুতেই না।”

পরের কথাগুলো বলতে কষ্ট হবে জেনে হালকা কেশে বললাম….
–“আমি জানি তুমি যথেষ্ট স্মার্ট মেয়ে। এখন যেহেতু তুমি সব জেনেই গিয়েছো তোমাকে সবটা না বলে উপায় নেই। হ্যাঁ আমাদের ভালোবাসায় লুকোচুরি আছে। আমরা ইচ্ছে করে তা করছি না। আমি আয়াশের প্রথম স্ত্রী। কিন্তু কারণবশত আমাকে উনার থেকে দূরে থাকতে হচ্ছে। আমিই বলেছিলাম বিয়েতে রাজি হতে। উনি বিয়েতে রাজি হতে চাননি। জানি না কথাগুলো তুমি কিভাবে নেবে কারণ আমি জানি, একটা মানুষের সঙ্গে যদি আমাদের বিয়ে ঠিক হয় তখন আমরা সেই মানুষকে নিয়ে কি পরিমাণ স্বপ্ন দেখি। আয়াশ আর আমার সংসার ছিল একসময়। তা ভেঙে গেছে রায়জাদা পরিবারদের জন্য। এখন তুমি যদি চাও আমাদের সাহায্য করতে পারো। সাহায্য না করতে পারলেও সমস্যা নেই তবে প্লিজ ইটস মাই রিকুয়েষ্ট, কাউকে এসব জানিয়ে দিও না।”

ওপাশটা হঠাৎ নিরবতায় ছেয়ে গেল। কিছুক্ষণ উত্তর না আসায় বিচলিত হয়ে পড়লাম আমি। তখনই উত্তর এলো….
–“আমি কাউকে কিছু বলব না। আর আমি সাহায্য করব কি না সেটা নির্ভর করবে আপনাদের ওপর। আপনারা আমাকে যদি মিট করে সবটা বলেন তাহলে আমি সাহায্য করতে পারি। আমার কোনো অধিকার নেই কারো ভালোবাসা ছিনিয়ে নেওয়া। আমি মেয়ে হয়ে এটা চাইব না। এতে যদি দুটো ভালোবাসার মানুষের মিলন ঘটে নিজেকে ধন্য মনে করব!”
শেষ কথাটার পর একটা দীর্ঘ নিশ্বাসে ভেসে এলো ওপরপাশ থেকে। বুঝতে পারছি, মেয়েটা যন্ত্রণা পাচ্ছে। একপলক আয়াশের দিকে তাকালাম। উনি দুইহাত বুকে রেখে গম্ভীর ভাবে তাকিয়ে আছেন। অধরার কষ্ট লাঘব করতে পারব না আমি। কারণ আয়াশ একান্তই আমার ভালোবাসার মানুষ! যার ভাগ নিতে আসলেও আমি বরদাস্ত করব না।

রাতে সব কাজ সেড়ে এসে বেডে বসে এপাশ ওপাশ নিজের পায়ের স্যান্ডেল ছুঁড়ে মারে রিক। ঘাড়টা ম্যাচম্যাচ করছে। নিজের বাম হাত দিয়ে একা ঘাড় ধরে থাকল সে। পাশের গোল টেবিলটাতে হাতালো কিছু পাওয়ার উদ্দেশ্যে। কাঙ্ক্ষিত জিনিসটা না পাওয়ায় চোখমুখ জড়িয়ে এলো তার। পাশ ফিরে তাকালো সে। ওর ল্যাপটপ টা নেই? চোখমুখের রঙ নিমিষেই পাল্টে গেল। ওখানে তার কত জরুরি জিনিস আছে হিসেব নেই। শুকনো ঢক গিলে পাগলের মতো খুঁজল আশপাশ। ল্যাপটপ না পেয়ে মেজাজটা তুঙ্গে উঠে গেল রিকের। স্যান্ডেল কোনোমতে পড়ে বাইরে হনহন করে বেরিয়ে গেল সে। বড় বড় পায়ের ধাপ ফেলে হাঁটতে গিয়েই কারো সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে বসল সে। বিরক্ত আর রাগ মিশ্রিত শব্দ করে মানুষটার দিকে অগ্নিঝরা দৃষ্টি নিয়ে তাকায়। নিজেরই বাবাকে দেখে অবাক হয়ে যায় সে। মাহতাব চোখের চশমা ঠিক করে টিমটিমে আলোয় রিককে দেখে বলল….
–“আস্তে চলবি তো! তোর ধাক্কা খেলে আমার এই বুড়ো শরীর থাকবে?”

–“দেখো বাবা, মেজাজ খারাপ করে দিও না। এমনি খুব রাগ লাগছে। মাথা গরম আছে।”
–“আমাকে দেখে কি মনে হয় তোর? আমার মন ভালো আছে? আমার ফোন খুঁজে পাচ্ছি না রুমে। ওখানে সব সিসিটিভি ক্যামেরার কানেকশন আছে।”
চোখ বড় বড় করে তাকায় রিক। অবাক সুরে বলে….
–“কি বলছো কি? তোমার ফোন পাচ্ছো না? আমিও আমার ল্যাপটপ পাচ্ছি না। ওখানে আমার অনেক জরুরি জিনিস আছে তার সঙ্গে সিসিটিভি ক্যামেরার কানেকশন।”
মাহতাব হতবাক হয়ে যায়। একই সঙ্গে দুজনের ফোন আর ল্যাপটপ হাওয়া? এটা নিশ্চয় কাকতালীয় হতে পারে না। কেউ ইচ্ছাকৃত কাজটা করেছে। কে করতে পারে? রিক আর মাহতাব দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে ভাবতে থাকে।

নিজের ঘরের দরজা বন্ধ করে পায়ের ওপর পা তুলে রিকের ল্যাপটপ ক্রমাগত ঘাঁটছে আয়াশ। মুখে তার রহস্যময় হাসি। কপাল আর ঘাড়ের রগটা দপদপ করছে। ফুলেফেঁপে উঠেছে। অন্যহাতে মাহতাব রায়জাদার ফোনটা হাতে নিয়ে ভালো করে দেখে নেয় আয়াশ। ঘাড় বাম দিকে কাঁত করে হিংস্র কন্ঠে বলে ওঠে…..
–“অনেক ভালো মানুষ হয়ে থেকেছি। আর নয়। আই এম নট এ গুড বয়। আমি আমার মর্জি অনুযায়ী চলি। অন্য কারো ইশারায় নয়। এতোদিন ওরা খেলেছে। নাউ মাই টার্ন। কাউন্ট ডাউন বিগিনস। সব হবে আমার ইশারায়।”
কথাটা বলে ভয়ানক ঝংকার তোলা হাসি হেসে ওঠে আয়াশ। সেই হাসিতে কেঁপে ওঠে ঘরের দেওয়াল। জানান দেয়, ভয়ানক কিছু ঘটতে চলেছে।

পরেরদিন….
কফিশপে অধরার সামনা-সামনি বসে আছি আমি। সামনে টেবিলে কফির কাপ থেকে ধোঁয়া উড়ছে। আমার সামনের চেয়ারে বসে আছে অধরা। ওর মুখে সেই লজ্জামিশ্রিত হাসি নেই। বেশ শান্ত মুখ। কফির কাপ হাতে নিয়ে কিছু একটা ভাবতে ব্যস্ত সে। নিরবতা কাটিয়ে সে বলল….
–“তাহলে আপনি মায়াবিনী রেজওয়ান নন? মিসেস. আনিশা চৌধুরী তাই না?”
–“হুমম।”
অধরা কাঁপা কাঁপা হাতে রেখে দেয় তার কফির কাপ। ধীর গলায় বলে….
–“কি করে সাহায্য করতে পারি আপনাদের?”
–“প্রথমত, আমাকে আপনি আপনি বলা বন্ধ করো। আমি তোমাকে আপনি বলা সেই প্রথমেই বন্ধ করেছি। সো প্লিজ!”
–“সরি। আমি তোমাকে তুমিই বলব। আমিও চাই তোমরা মিলে যাও। আমার খুব ভালো লাগবে। আর ওদের শাস্তি হক সেটাও চাই। এর মধ্যে আমি সাহায্য করতে পারলে ভালোই লাগবে।”

মুখে কুলুপ এঁটে বসে থাকলাম আমি। কিভাবে বলব এই কথাটা? স্বার্থপরের মতো আচরণ হয়ে যাবে না? বড় বড় শ্বাস নিয়েই বলা শুরু করলাম…..
–“জানি আমি যেটা চাইছি সেটা করলে তোমার সাথে অন্যায় করা হবে। কিন্তু তোমার সাহায্য ছাড়া আমরা কিছু করতে পারব না। তুমি প্লিজ, আয়াশের সঙ্গে বিয়ের করার মিথ্যে অভিনয় চালিয়ে যেতে পারবে? এই ব্যাপারটা অনেক কষ্টদায়ক। তবে আমি নিরুপায়। এই রায়জাদা ফ্যামিলি ক্ষণে ক্ষণে আমাকে আনিশা প্রমাণ করতে চাইছে।”
মাথা নত করে বসে থাকল অধরা। ছোট করে উত্তর দিল…..
–“আমি নিজেকে সামলে নিতে পারব। তাহলে আজ এঙ্গেজমেন্ট হচ্ছে তাই তো?”
–“হুমম।”
–“তাহলে আমি আসি। বাড়ি থেকে জোর করে বেরিয়েছি। তাড়াতাড়ি বাড়ি যেতে হবে।”
কথাটা বলে দেরি না করে হুরমুর করে বেরিয়ে যায় অধরা।

কিছুক্ষণ থেকে আমিও বেরিয়ে আসি।
আকাশ ভাইয়ার সঙ্গেই বাড়ি ঢুকছিলাম। কিন্তু কোথা থেকে যেন হাওয়ায় ভাসতে শুরু করলাম আমি। ভয়ে চিৎকার দিতেই মনে হলো কেউ আমাকে কোলে তুলে নিয়েছে। মুখ উঁচু করে দেখতে পাই আয়াশকে। মুখ হা হয়ে গেল। অতঃপর লজ্জায় নেতিয়ে পড়লাম। পিটপিট করে আকাশ ভাইয়ার দিকে তাকালাম। ভাইয়ার সামনে থেকে আমাকে কোলে তুলে নিয়েছে অসভ্যেলোকটা। শুরু হলো ছটফটানি। আয়াশের বুকে কিল দিয়ে বললাম…..
–“আপনার কোনো পরিবর্তন হলো না। অসভ্য, লজ্জাহীন দের নিয়ে যদি কোনো কম্পিটিশন হতো আপনিই ফার্স্ট প্রাইজ নিয়ে ঘরে ফিরতেন আই এম ড্যাম সিউর। আমাকে নামান আয়াশ। কেউ দেখে ফেললে কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে।”
আমার এতগুলো কথার বদলে একটা জবাব অবধি পেলাম না আর না নামতে পারলাম। উনার মুখের দিকে তাকিয়ে লক্ষ্য করলাম উনার ঠোঁট কামড়ে মুখচোখ লাল করে আমাকে নিয়ে ওপরে হাঁটছেন।

চিন্তায় নখ কাটতে শুরু করলাম দাঁত দিয়ে। আমি কি কোনো ভুল করলাম? যার কারণে আয়াশ রেগে আছেন? আর কিছু ভাববার আগেই মুখ থুবড়ে পড়লাম বেডের ওপর। বেড নরম হওয়ায় তেমন লাগেনি। আমি সোজা হওয়ার আগেই আমার ওপর আধশোয়া হয়ে পড়লেন আয়াশ। আমার মুখের কাছে মুখ নিয়ে আসতেই বাজে গন্ধতে নাকে হাত দিলাম আমি। তেতিয়ে বললাম….
–“আপনি ড্রিংকস করেছেন??”
–“বউ কাছে না থাকলে কি করব? ইউ নো? তুমি আমার লাইফে আসার আগে এই ড্রিংকস-ই ছিল আমার সকাল-বিকালের বন্ধু। এখন বউ থেকেও নেই। সো হোয়াট আই ডু?”
আয়াশের স্ট্রেটকাট উত্তর। আমি উনার মুখ চেপে ধরে চোখ রাঙিয়ে বললাম….
–“আপনি হয়ত মাতাল হয়ে ভুলে গিয়েছেন এই রুমে সিসিটিভি ক্যামেরা লাগানো আছে।”

আয়াশ আমার কথা বেশ স্বাভাবিক ভাবে নিয়ে আমার গলায় মুখ ডুবিয়ে ধীরে বললেন…
–“সো?”
–“সো মানে? আপনি পাগল হয়ে গেছেন আয়াশ। উঠুন। সর্বনাশ হয়ে যাবে আজকে।”
আয়াশ নড়চড় করলেন না। বরণ আরো আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। চোখমুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল আমার। এই বুঝি এই রিক রায়জাদা ঘরে প্রবেশ করল! উনার পিঠে খামচি দিয়ে উঠানোর বৃথা চেষ্টা করলাম আমি। তারপর নিজের কপাল চাপড়ালাম। রিদ্ধি আপু আগে বলত, ‘সাবি, নিজের নখ দাঁত দিয়ে কম কাট। এই নখের মর্ম অনেক। পরে নখ লাগবে কিন্তু আঙ্গুলে নখ পাবি না। সব ভোঁতা নখ পাবি।’
আপুর কথার গুরুত্ব এখন হারে হারে বুঝছি। আমার হাতে থেমে গেল। আয়াশ বিরবির করে বললেন….
–“সিসিটিভি ক্যামেরা নষ্ট করে ফেলেছি আমি। ওদের ফোন ল্যাপটপ সব আমার কাছে।”

কথাটা বলে থেমে গেলেন উনি। আমার গলায় পড়ছে উনার উষ্ণ আর গরম নিশ্বাস। যেটা আমার হৃদয়ে আঘাত করছে। একসময় অনুভব করলাম আয়াশ গা ছেড়ে দিয়েছেন। উনার মাথা তুলে দেখি উনি ঘুমিয়ে গিয়েছেন। মনে হয় সারা রাত ঘুমোন না উনি। কি করেন আল্লাহ মালুম! ধাক্কা দিয়ে দিয়ে উনাকে বিছানায় শুইয়ে দিলাম। মাথায় বালিশ গুঁজে দিয়ে আস্তে ধীরে বেরিয়ে এলাম ঘর থেকে।
আদ্রিতাকে রিক রায়জাদার কোলে দেখে পিলে চমকে উঠল আমার। বুক ধড়ফড় করে উঠল। দৌড়ে গিয়ে আদ্রিতাকে নেওয়া জন্য হাত বাড়ালাম আমি। রিক অন্য দিকে ঘুরে গেল। এই ছেলের কোনো বিশ্বাস নেই আমার। ও আমার আদ্রিতার কোনো ক্ষতি করে দিলে আমি মানতে পারব না। চিল্লিয়ে বলে উঠলাম…..

–“ওকে আমার কোলে দিন।”
–“এতো হাইপার হচ্ছেন কেন মি. রেজওয়ান? আমি তো জাস্ট কোলেই নিয়েছি।” (শয়তানি হেসে)
–“আমি বলছি ওকে আমার কোলে দিন!”
রিক রায়জাদা তবুও দিল না আমার কোলে। আদ্রিতাকে আরো চেপে ধরে দাঁতে দাঁত চেপে বললেন….
–“আমার ল্যাপটপ আর বাবার ফোন কই রেখেছেন ছদ্মবেশী আনিশা?”
আমি কোনো উত্তর না দিয়ে আদ্রিতাকে জোর করে কোলে নিয়ে হিসহিসিয়ে বললাম….
–“আমার আদ্রিতাকে ছুঁয়েও দেখবেন না আপনি। আপনার ভালো হবে না। আর বার বার আনিশা বলে কি প্রমাণ করতে চাইছেন আপনি? যথাযথ প্রমাণ আনুন আগে।”
রিক আমার দিকে হিংস্র দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলল…..
–“পীপিলিকার পাখা গজায় মরিবার তরে। ভালো হবে না আপনার।”
–“সেটা তো সময় বলবে।”

সন্ধ্যে প্রায় ৭ টা। সন্ধ্যে নেই বললেই চলে। রাত ঘনিয়ে এসেছে। কমিউনিটি সেন্টারে প্রচন্ড ভীড়। আশেপাশে লোকজন গমগম করছে। অহনা আদ্রিতাকে নিয়ে এক চেয়ারে বসে আছে। তার পরনে সাদা রঙের গাউন। আশেপাশে সাদাকালো সব কিছু। আনিশা নিজেই সাদাকালো থিম করে পার্টিটা সাজিয়েছে। মেয়েদের পরনে সাদা পোশাক আর ছেলেদের কালো। আদ্রিতাও পরে আছে গাউন। এই গাউনটা আয়াশ নিজে ওকে দিয়েছে। অহনা আদ্রিতার দিকে তাকিয়ে মাঝে মাঝে মিটমিটিয়ে হাসছে। কারণ আদ্রিতার চেয়ে তার গাউনটা লম্বা। তাই হাঁটতে না পেয়ে অগত্যা গাল ফুলিয়ে বসে আছে। একসময় সে অস্পষ্ট গলায় বলল….
–“মি…মিমি! আমি মাম্মামেল কাতে যাব।”
–“এখনই যেতে হবে?”

আদ্রিতা মাথা দুলায়। কি আর করার? ও তো হাঁটতে পারবে না। তাই অহনা ওকে কোলে তুলে নিয়ে ভীড় ঠেলে হাঁটতে লাগল। ভীড়ের মাঝে সদর দরজার পাশ কাটিয়ে যেতেই মনে হলো সেই রাজকীয় দরজায় কোনো চেনা মানুষ দাঁড়ানো। থেমে পেছন ফিরে তাকায় অহনা। চোখ ছোট ছোট করে ফেলে সে। সদর দরজার সামনে ভীর। কয়েক সেকেন্ড পরেই ভীড় গায়েব হয়। তখনই বুকটা ছ্যাঁত করে ওঠে ওর। নিশ্বাস ঘন হয়ে আসে। মাথাটা চক্কর দিয়ে উঠলেও সামলে নেয় নিজেকে। ও কি ঠিক দেখছে? হ্যাঁ ঠিকই তো দেখছে। আয়াশ মানুষটাকে জড়িয়ে ধরেছে। মানুষটার মুখে প্রশান্তির হাসি। এতো বছর পর সেই মানুষটা আবারও তার সামনে?

চলবে…..🍂

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here