ভালোবাসাটা_ঘৃণার পর্ব ১৩+১৪

#ভালোবাসাটা_ঘৃণার (সিজন ২)
#Only_Love
#Anisha_Sabiha
পর্ব ১৩
বসে আছে মেয়ে পক্ষ। ওপর থেকে সবটা দেখছি। আয়াশ আসবার কোনো নামগন্ধও নেই। মেয়েপক্ষ থেকে মেয়েটার বাবা, মা আর বড় ভাই এবং ভাবিও এসেছে। মেয়েটা দেখতে বেশ সুন্দর। হলদে ফর্সা গায়ের রঙ, চিকন গায়ের গড়ন। মাঝে মাঝে মুচকি হাসছে সে। বোধহয় লজ্জা পাচ্ছে। বিয়েটা না হলে এই মেয়েটার মন ভাঙবে। তবে আমি আমার স্বামীকে তো অন্য কারো পাশে দেখতে পারি না। এতোটা দয়ালু নই আমি। অহনা এসে দাঁড়ায় আমার পাশে। নিচটা পর্যবেক্ষণ করে বলে….
–“দাঁড়িয়ে থেকে নিজ থেকে আরো কষ্ট পেতে চাচ্ছো?”
–“এমনটা কেন মনে হলো তোমার? আমি কষ্ট পাচ্ছি না।”

অহনা নিঃশ্বাস ফেলে হাসে। নিঃশ্বাসটা বেশ ভারি। নিঃশ্বাসে মিশে আছে কষ্ট। এই মেয়েটার কীসের কষ্ট জানি না আমি। হয়ত আমার কষ্টে সে নিজেও কষ্ট পাচ্ছে।
–“একটা মেয়ে নিজের জীবন অবধি দিতে পারে কিন্তু সে নিজের স্বামীর সঙ্গে অন্য কাউকে দেখতে পারে না। তুমি যতই শক্ত দেখানোর চেষ্টা করো নিজেকে। আমি জানি তুমি ভেতরে ভেঙে পড়েছো।”
–“বাদ দাও ওসব কথা। আমি এই বিয়ে হতে দেব বলে মনে তোমার। আয়াশের সঙ্গে বিয়ের বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছি কি উনাকে অন্য কারোর সঙ্গে দেখবার জন্য? উনি আমার। শুধু আমার।”
আমার মুখে এমন কথা এক্সপেক্ট করেনি অহনা। হঠাৎই আগুনের ন্যায় জ্বলে উঠেছি আমি। হঠাৎ বলতে হঠাৎই। এটা অপরিকল্পিত!

যখন আমরা নিচের পরিবেশ দেখতে ব্যস্ত তখন আগমন ঘটে রিক রায়জাদার। তিন তালায় উঠে আমাদের দিকে অদ্ভুত হাসি নিক্ষেপ করে সে। প্রতি মূহুর্তে আমাকে আনিশা প্রমাণ করার একটা নিদারুন খেলায় নেমেছে এই রিক। এবারও মনে হয় এই খেলার একটা সুন্দর চাল চালতে এসেছে ও।
–“ওপর থেকে সবটা দেখলে হবে? নিচে চলুন মিসেস. রেজওয়ান। আর মি. রেজওয়ান কোথায়?”
আমি শান্ত সুরে বললাম….
–“উনি ঘুমোচ্ছেন আদ্রিতার সঙ্গে।”
–“তাহলে আপনি আর মিস. অহনা নিচে চলুন। ওপর থেকে ঠিকঠাক দেখা যায় না। ঠিক বলছি?”
–“আমরা বাইরের লোক মি. রিক। আমরা এখানে থাকায় ভালো।”
রিক আরো কয়েকবার বলল আমি গেলাম না। অহনাও আমার সঙ্গেই দাঁড়িয়ে থাকল। সে নিচে নেমে গেল পাত্রীপক্ষ আপ্যায়ন করার উদ্দেশ্য।

মাহতাব রায়জাদা বার বার কাউকে ফোন করে চলেছে। ফোনটা যে সে আয়াশকেই করছে সেটা বুঝতে পারছি। বার বার দরজার দিকে চোখ বুলাচ্ছি। উনি কি আসবেন না? বাইরে যাওয়ার সময় অসম্ভব রেগে ছিলেন। সেকারণেই বাড়িতে ফিরছেন না উনি।
সেঁজুতি মা পাত্রীপক্ষের সামনে হালকা খাবারের ট্রে টা রাখলেন। তখনই দরজার সামনে উপস্থিত হলেন আয়াশ। অহনাকে সেখানেই থাকতে বলে নিচে এলাম আমি। আমি জানি উনি এখন ক্ষণে ক্ষণে রেগে যাবেন। ব্যাপারটা আমাকেই সামলাতে হবে। নিচে নামলেও পাত্রীপক্ষের সামনে গেলাম না আমি। দরজার সামনে সাদা শার্ট পরিহিত মানুষটি সব অচেনা মুখের দিকে চোখ বুলাচ্ছেন। উনার বাম হাতে কালো রঙের কোট। যেটা উনি পিঠের দিকে ধরে আছেন হাত উল্টো করে। উনার ক্লান্ত চোখজোড়া হঠাৎ আমার দিকে এসে থেমে গেল। উনার চোখ যেন আবারও আমাকে সতর্কবানী দিয়ে দিল যে আমি ঠিক করছি না। সরে আড়ালে এলাম।

এলোমেলো পায়ের ধাপ ফেলে ভেতরে এলেন আয়াশ। সঙ্গে সঙ্গে মাহতাব রায়জাদা অস্থির কন্ঠে আয়াশের উদ্দেশ্যে কথা ছুটালো।
–“তোমাকে কয়েকবার ফোন করেছি। তুমি বোধহয় দেখোনি।”
আয়াশ পকেট থেকে বের করে ফোন চেক করেন। ভাবলেশহীন ভঙ্গিতে বলেন….
–“ফোন সাইলেন্ট ছিল। কাজে বিজি ছিলাম।”
–“দেখেছেন? বেশ কাজের ছেলে কিন্তু। সারাদিন কাজ কাজ করে।”
কথাগুলো গড়গড় করে পাত্রীপক্ষের উদ্দেশ্যে বলা হলো। রিক আয়াশের কাছে গিয়ে কানে কানে কি যেন একটা বলতে হেঁটে সিঁড়ির কাছে চলে এলেন উনি। আমি তখন আড়ালে। আকস্মিক ভাবে আমার এক হাত টান দিয়ে সবাই না দেখতেই আমাকে টানতে টানতে দোতালায় নিয়ে এলেন।

আচমকা হতভম্ব হয়ে তাকালাম আমি। ঘন ঘন চোখের পাপড়ি ফেলতেই হেঁচকা দিয়ে উনি দাঁড় করালেন আমাকে উনার সামনে। মাথা নতজানু করে দাঁড়ালাম। সিংহের মতো ফোঁস ফোঁস করে বললেন…..
–“একটা কথা বলো তো। তোমার একটুও খারাপ লাগছে না? এখনো সময় আছে। আমাকে আটকাও। নয়ত রাগের বশে কি করে ফেলব আমি জানি না।”
–“শান্ত হন। আপনাকে আটকালে কি হবে জানেন? ওরা সিউর হয়ে যাবে যে আপনার সবটা মনে আছে। তারপর কি হবে বলুন তো? ওরা আমাদের তো মেরে ফেলবেই সেই সঙ্গে আকাশ ভাইয়া, অহনা আর সব থেকে বড় কথা! আমাদের আদ্রিতারও ক্ষতি করবে। আমি শুধুমাত্র এইজন্যই সামনে আসিনি আয়াশ। আমি চাইনি ছোট থাকতে আমাকে যেভাবে নিজের মা-বাবাকে হারাতে হয়েছে ঠিক সেইভাবে আদ্রিতা আমাদেরকে হারাক। বার বার ওরা জিতে যাবে সেটা তো হবে না।”

আয়াশ তো আয়াশই। উনি কি দমবার পাত্র? মোটেই না। তবুও উনি মানতে নারাজ। উনি বিয়ে করতে নারাজ। আমার ওপর নিরাশ হয়ে বিরক্তির সুরে বললেন….
–“ইউ আর জাস্ট টু মাচ!”
কথাটা বলে ঘরে ঢুকে গেলেন উনি। চোখে জমাট বাঁধল বর্ণহীন একটা তরল পদার্থ। যাকে বলে চোখের পানি। কষ্টের এক বহিঃপ্রকাশ ঘটে এরই মাধ্যমে। কিন্তু এখন কাঁদার সঠিক সময় নয়। কাঁদবো। একদিন নিশ্চয় গলা ছেড়ে কাঁদবো। সেদিন আয়াশের বুকে আমার মাথা থাকবে।

পাত্রীপক্ষকে কোনোরকম সালাম না দিয়ে অভদ্রের মতো সরাসরি গিয়ে একটা সোফার ওপর পায়ে পা তুলে বসে পড়লেন আয়াশ। চোখ বেরিয়ে আসার উপক্রম হলো আমার। সবাই তীক্ষ্ণ দৃষ্টি এখন আয়াশের দিকে। মাহতাব রায়জাদা ম্যানেজ করার চেষ্টা করল ব্যাপারটি। জোর করে হেসে বলে ওঠে….
–“আসলে আয়াশ কিন্তু এমন না। ও সবাইকে যথেষ্ট সম্মান করে। আজকে হয়ত অফিস থেকে ফিরে ক্লান্ত। তাই….. ”
বাকিটা বলার সুযোগ পেল না সে। আয়াশ সরাসরি তার মুখের কথা কেঁড়ে বলে ওঠেন….
–“আমি এমনই। যাকে ভালো লাগে সম্মান ও শ্রদ্ধা দুটোই করি। যাকে ভালো লাগে না তাকে সম্মান ও শ্রদ্ধা কোনোটাই করি না।”

কাশি উঠে গেল পাত্রীর বাবার। দ্রুত পানি এগিয়ে দেওয়া হলো উনাকে। অতঃপর উনি বললেন….
–“ইটস ওকে। আমাদেরকে আগে চেনো জানো তারপরেই তো বুঝবে আমরা কেমন। তারপর তো সম্মান আর শ্রদ্ধা আসবে।”
আয়াশ জবাবে কিছু বলেন না। আরো কথাবার্তা হয় তাদের মাঝে। আয়াশ সব প্রশ্নের উত্তরই বাঁকা ভাবে দিতে থাকেন। এ অবশ্য নতুন কিছু নয়। যেখানে লোকটাই বাঁকা সেখানে কথাবার্তা আঁকাবাঁকা নদীর মতো হবে সেটা স্বাভাবিক। সব শেষে কথা বলতে দেওয়া হয় আয়াশ আর ওই মেয়েটাকে। আলাদা ঘরে নিয়ে যেতে বলা হয় আয়াশকে।
আয়াশ কিছু না বলে উঠে সোজা হাঁটতে থাকেন। পেছন পেছন যায় মেয়েটা। মেয়েটার নাম অধরা। যেমন দেখতে তেমন নাম।

আমিও পেছন পেছন যাই তাদের কথা শোনার জন্য। আয়াশ নিজের রুমে ঢুকে পড়েন। অধরা নামক মেয়েটি ঘরে ঢুকতে নিলে বাঁধা দেন উনি।
–“ওয়েট। ভেতরে আসবেন না। রুমটা আমার। আমি আমার রুমে অচেনা কাউকে এলাও করি না সহজে।”
কথাটা বলে ঘড়ি খুলে রাখলেন উনি। তারপর বাইরে বেরিয়ে এলেন। পকেটে হাত গুঁজে শক্ত গলায় বললেন….
–“আগে চেনা হয়ে উঠুন। তারপর ভেবে দেখব আপনাকে ঘরে ঢুকতে দেওয়া হবে কি না।”
অধরা মাথা নাড়ায়। আয়াশ আঁড়চোখে আমাকে দেখেন। তারপর শেষমাথার একটা খোলামেলা বারান্দায় গিয়ে চেয়ারে বসে পড়েন উনি। উনার হাবভাব দেখে মনে হচ্ছে বিয়ের সম্বন্ধ ভেঙে যাবে এবার।

অধরা দাঁড়িয়েই থাকল। দুজনেই চুপচাপ। আয়াশ কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন….
–“কিছু বলার আছে আপনার? কি কি জানতে চান বলুন।”
–“না কিছু না। আপনি কিছু জানতে চান না?” (মিনমিনিয়ে)
–“না চাই না। আমাকে বিয়ে করতে হবে তাই করছি। আপনি কি রাজি বিয়েতে?”
অধরা মৌনতা অবলম্বন করে। দূর থেকে বোঝা যাচ্ছে ওর গালে গোলাপি আভা ফুটে উঠেছে। তার মানে সে কি রাজি? তীক্ষ্ণ আর ধারালো অনেকগুলো সুচ আমার গায়ে বিঁধল। এতো যন্ত্রণা কেন হয় ভালোবাসায়? সব সময় সুখপাখি বুঝি ধরা দেয় না? আয়াশ চুটকি বাজিয়ে বলল….
–“হ্যালো! আই ওয়ান্ট অ্যান্সার।”
অধরা ধীরেসুস্থে মাথা নাড়ায়। তারপর বলে….
–“আমার বাবা আর ভাইয়া আপনাকে পছন্দ করেছে। তারা যা বলবে তাই হবে।”

আয়াশ কিছু না বলে উঠে চলে আসেন। আমাকে দেখেও না দেখার ভান করে চলে যান উনি। অধরা আসতেই পর্দার পেছনে লুকিয়ে গেলাম আমি। নিজের মুখটা চেপে ধরলাম। কাঁদতে চাইছি না। কান্নাকে রুখতে চাইছি। এমনটা কি না হলে হতো না?
পরে জানতে পারলাম আয়াশও বিয়েতে রাজি। তবে উনি দুটো শর্ত দিয়েছেন। প্রথমটা, বিয়েটা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব করতে হবে। দ্বিতীয়টা, বিয়েটা ধুমধাম করে হতে হবে। আত্নীয়-স্বজন কারোর কমতি যেন না থাকে। ভয় আঁকড়ে ধরলো আমার। উনি কি তবে আমার ওপর অভিমান করে বিয়েটা মেনে নিচ্ছেন? এমন অদ্ভুত কেন শর্তগুলো? শর্ততে মনে হচ্ছে উনি যত দ্রুত সম্ভব অধরাকে চান। আর বিয়েতে যথেষ্ট খুশি। ভালোবাসার এই মানুষটিকে হারিয়ে ফেলতে যাচ্ছি না তো??

আদ্রিতাকে নিয়ে বসে আছি। আদ্রিতা আমার কোলে বসে বসে ওর খেলনা নিয়ে খেলছে। আমি অন্যমনস্ক। আমার গাল ধরে হালকা থাবা দিতে শুরু করল আদ্রিতা। চমকে ওর দিকে তাকালাম আমি। ও আধো আধো কন্ঠে বলল….
–“মা..মাম্মা! তোমাল মন খালাপ?”
–“না আদ্রিতা। তুমি খেলো।”
আদ্রিতা কিছু না বলে আমার গলা জড়িয়ে ধরলো। আমিও ওর ছোট্ট শরীরটাকে জড়িয়ে ধরলাম। আমার দুই গালে ছোট্ট চুমু এঁকে দেয় সে। আমি ফিক করে হেসে দিই। আদ্রিতাও দাঁত বের করে হেসে বলে….
–“তোমাল মন ঠিক হয়েতে তো? আল মন খালাপ কলবেন না বলো!”
–“আচ্ছা ঠিক আছে আর মন খারাপ করব না।”

এমনই কথাবার্তা চলছিল আমাদের মধ্যে। ওর মিষ্টি কন্ঠটা শুনে মন খারাপ হারিয়ে গেল। তখনই ঘরে হাজির হলো রিক রায়জাদা। দরজায় টোকা দিয়ে ঘরে ঢুকল সে। ভ্রু কুঁচকে তাকালাম আমি। আমার দিকে বিয়ের কার্ড ছুঁড়ে দিল সে। বেডে পড়ল কার্ডটা। বিয়ের কার্ড কার হতে পারে তা জানতে বাকি নেই। কার্ডের দিকে তাকিয়ে বললাম….
–“বিয়ের কার্ড? এতো তাড়াতাড়ি?”
–“কি করব বলুন? আয়াশ তো বিয়ে তাড়াতাড়ি করতে চেয়েছে। তাকে মানা করা যায়? তাই প্রথম কার্ডটা আপনাকেই দিলাম।”
কার্ডটা হাতে নিয়ে নেড়েচেড়ে দেখলাম। সূক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে বললাম….
–“দ্যাটস মাই প্লেজার যে আমি প্রথম কার্ড পেলাম। বাট কি জানেন তো? কার্ডের ডিজাইন বেশ বাজে। চয়েসটা নিশ্চয় আপনার?”

আমার অপমানে মুখটা থমথমে হয়ে গেল রিকের। তাও পাল্টা জবাব দিয়ে বলল….
–“হ্যাঁ। আমি জানি আমার চয়েস খারাপ। সেকারণেই তো বিয়ের দায়িত্ব আপনাকে দেওয়ার কথা বলেছে আয়াশ।”
বিস্মিত চোখে তাকালাম আমি।
–“আমাকে? মি. চৌ…চৌধুরী বলেছেন?”
–“ইয়েস। কালকের পরের দিন এঙ্গেজমেন্ট তার দুই দিন পরেই বিয়ে। আপনার চয়েস নাকি খুব ভালো। সো আপনি দায়িত্ব নিতে রাজি তো?”
আমি গলা খাঁকারি দিয়ে বললাম….
–“হু..হুয়াই নট! আমি এমন বিয়ের আয়োজন করব সবার চোখে তাক লেগে যাবে আই প্রমিস।”
রিক রায়জাদা দাঁত কেলিয়ে বেড়িয়ে গেলো। এই রায়জাদা যতদিন বেঁচে থাকবে শান্তি পাবো না আমি। যন্ত্রণা দিয়ে দিয়ে মারতে চায় যেন সবাই। মাথা ধরে আসছে। শরীর দুর্বল হয়ে পড়ছে সেই সঙ্গে মনটাও। ভালোবাসার যে একি যন্ত্রণা সেটা যারা ভালোবাসে তারাই বোঝে…..!!

মধ্যরাত। চারিদিকে অন্ধকারে আচ্ছন্ন। অমাবস্যা আজ। চাঁদও মেঘের চাদরে মুড়ি দিয়েছে। ঘরে এক ফোঁটা আলোর দেখা পাওয়াও কঠিন। আকাশ ফ্লোরে ঘুমিয়ে আছে। আকাশ ফ্লোরে ঘুমোয় ব্যাপারটা যাতে কেউ না জানে সেকারণেই রাতে সব রকম লাইট ওফ থাকে। অপ্রত্যাশিত ভাবে ঘুম ভেঙে যায় আকাশের। কারো গোঙানির শব্দ শোনে ও। হালকা করে চোখ মেলে তাকায় সে। চারিদিকে অন্ধকার। চোখ ঘুমের কারণে খুলতে চাইছে না। চোখ কচলে উঠে বসে সে। বাড়ির বাইরে থাকা লাইট একটু একটু রুমের মাঝে পড়ছে। আনিশার অবয়ব দেখা যাচ্ছে। আনিশার গোঙানির শব্দ শুনে হকচকিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে পড়ে আকাশ।

বেডের কাছে হেঁটে গিয়ে ঝুঁকে দেখে সে। আনিশা কিছু একটা বিরবির করছে। আকাশ আনিশাকে ডাকতে আরম্ভ করে।
–“মায়া! মায়া! আর ইউ ওকে?”
আনিশা আগের মতোই করে যাচ্ছে। আকাশ আনিশার হাত ধরে ঘুম ভাঙানোর জন্য। আরো এক দফা চমকে যায় সে। হাত এতো গরম কেন? আকাশের হাতই যেন পুড়ে যাচ্ছে। হাত সরিয়ে কপালে হাত দেয় আকাশ। আনিশা মৃদু কাঁপছে। ওর গায়ে ধুম জ্বর। চিন্তিত হয়ে পড়ে আকাশ। মেয়েটা অসুস্থ হয়ে পড়ল কি করে সেটাই বুঝছে না আকাশ। উপায় না পেয়ে আনিশার ফোনে হাত লাগায় সে। স্ক্রিন অন করে দেখে ফোনের লক খুলতে ফিঙ্গারপ্রিন্ট লাগবে। দেরি না করে আনিশার হাতের কয়েকটা আঙ্গুল দিয়ে ফোনের পেছনে ধরতেই খুলে যায় লক। আয়াশের ফোনে কল করে সে।

অন্ধকার রাতে নির্ঘুম হয়ে জেগে বসে আছে আয়াশ। মাথার মধ্যে চলছে অজস্র প্লানিং। সেই সঙ্গে চলছে প্রেয়সীকে আবার কাছে পাওয়ার তৃষ্ণা। এই দহনের কাহিনীর যে কবে সমাপ্তি ঘটবে! অস্থির হয়ে মাথা একাধারে এপাশ-ওপাশ নাড়াতে থাকে সে। স্থির হতেই খেয়াল করে এই মাঝরাতে ফোনটা বাজছে। আনিশার নম্বর দেখে অবাক হয় ও। মনে মাঝে আসে জোয়ার। একদলা ছাই এর মাঝে একটা সবুজ পাতা দেখতে পায় সে। ফোনটা রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে কিছু শুনে চোখমুখ ফ্যাকাশে বর্ণের পরিণত হয়। কোনো উত্তর না দিয়ে দ্রুত পায়ে ঘর থেকে বেড়িয়ে পড়ে।

আনিশার কপালে বার বার হাত দিয়ে জোর মাপার চেষ্টা করছে আয়াশ। লাইট জ্বালাবে তারও কোনো উপায় নেই। আনিশা শুধু কাঁপছে। ওকে দুটো মোটা কম্বল দেওয়া হচ্ছে। তবুও কাঁপুনি থামছেই না। পাশে রয়েছে ঘুমন্ত আদ্রিতা। হাত-পা এলোমেলো করে স্বস্তিতে ঘুমোচ্ছে। কারো মুখটাই দেখা যাচ্ছে না তবে অবয়ব বোঝা যাচ্ছে। আকাশ বেরিয়ে গেছে ঘর থেকে। আনিশার কপালে হালকা চুমু এঁকে দেয় আয়াশ। জলপট্টি না দিলে এই জ্বর নামার নাম করবে না। আয়াশ বেড থেকে নেমে দাঁড়াতেই ওর হাত কারো হাতের ভাঁজে আঁটকে যায়। ফিরে তাকায় সে। আনিশা চোখের পাতা নড়ছে সেটা অন্ধকারেও বোঝা যাচ্ছে। ধীর গলায় সে বলে ওঠে….
–“আ…আপনি এসেছেন? আমি জানতাম আপনি আসবেন।”

আয়াশ আবারও বসে পড়ে। গম্ভীর কন্ঠে বলে ওঠে….
–“কি করে জানলে?”
–“সব কিছু জানতে হয় না। অনুভব করতে হয়।”
–“সত্যিই তুমি কিছু অনুভব করো?”
–“হ্যাঁ করি। আপনার ভালোবাসা।”,
আনিশার কন্ঠ অস্পষ্ট, দুর্বল। জ্বরের ঘোরে কথাগুলো বলছে সে। আয়াশ হাতটা ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করলে হাতটা আরো জাপ্টে ধরে আনিশা। তার গরম নিশ্বাস পড়ে আয়াশের হাতে।
–“হাতটা ছাড়ো। তোমার জ্বর এসেছে। জলপট্টি দিতে হবে।”
–“না। আপনি আমার কাছে থাকলেই আমি ভালো হয়ে যাব। আপনি কোথাও যাবেন না।”
–“এভাবে বললে কি করে হয়?”

আনিশা এসব প্রসঙ্গ পাল্টায়। আয়াশকে নিজের কাছে টেনে নেয় ও। আশাভরা গলায় বলে….
–“নিশাপাখি ডাকুন না।”
–“নিশাপাখি!”
–“আবার ডাকুন।”
–“নিশাপাখি!”
–“এবার জড়িয়ে ধরুন আমাকে।”
আয়াশ স্থির হয়ে থাকে আনিশার দিকে উবু হয়ে। আনিশা নিজের থেকে তাকে জড়িয়ে ধরে। আয়াশের কি সাধ্য আছে আনিশার ভালোবাসা উপেক্ষা করার? আয়াশও পরম আবেশে জড়িয়ে ধরে তাকে। আনিশা বিরবির করে বলে….
–“এবার প্রমিস করুন। আমাকে এভাবেই সারাজীবন জাপটে থাকবেন। একটুও দূরে যাবেন না।”

–“এই প্রমিস আমি আগেই দিয়েছি। শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত তুমি চাও বা না চাও তোমাকে জাপটে ধরেই কাটাবো।”
–“জানেন? ওই অধরা মেয়েটা অনেক সুন্দর। আপনার মতো সুন্দর মানুষের সঙ্গে একদম খাপে খাপ মিলে যায়। ও সুন্দর। আমার থেকেও সুন্দর। আপনি এজন্য আমাকে ছেড়ে দেবেন না তো?”
আয়াশের রাগ আর কৌতুহল দুটোই হয়।
–“এতোদিন এই চিনলে আমাকে?”
–“আমার ভয় করে।”
–“তুমি নিজেকে কম সুন্দর দাবি করো কিভাবে? ফর্সা চামড়া থাকলেই বুঝি সে সুন্দর হয়ে যায়? তোমার বাঘিনীর মতো চোখজোড়া, ফোলা গাল, খাঁড়া নাক, নিখুঁত ঠোঁটজোড়া সেই সঙ্গে বাম গালে এই ভয়ানক তিলটা তোমাকে কত সুন্দর আর যত্ন করে বানানো হয়েছে জানো নিশাপাখি?”

আনিশা কিছুক্ষণ চুপ থাকে। হুট করে বায়না করে ওঠে….
–“তাহলে ভালোবাসুন আমায়।”
বিষম খায় আয়াশ। হেসে বলে….
–“তুমি মাতাল বা ঘোরের মাঝে থাকলেই কেন ভালোবাসা নিতে চাও বলো তো…??”
আনিশা নিরুত্তর। ঘোরের মাঝে তো সে আছে। তবে সেটা ভালোবাসার ঘোর। রাত গভীর হতে থাকে সেই সঙ্গে তাদের ভালোবাসাও গভীর হতে শুরু করে। আয়াশ ও আনিশা বুঝতে পারে, হাজারো দুঃখের মাঝেও যদি চাওয়া যায় তবে সুখপাখিরা আসে। শুধু তাদের চিনে নিতে হয়। আজ বোধহয় চাঁদ টা নেই তাদের ভালোবাসার সাক্ষী হয়ে থাকবার জন্য তবে সবসময় সাক্ষীর প্রয়োজন হয় না।
#ভালোবাসাটা_ঘৃণার (সিজন ২)
#Only_Love
#Anisha_Sabiha
পর্ব ১৪
সবাই তড়িঘড়ি করে রেডি হচ্ছে। হাতে কারো সময় নেই। আমি ভাবলেশহীন হয়ে গালে হাত দিয়ে বসে আছি। মনটা একদিকে ভালো। আরেকদিকে খারাপ। গতকাল রাতে আয়াশ আর আমার মাঝে যেমন কোনো দূরত্ব ছিল না তেমনই আজ সকাল বেলায় আয়াশ আগে মতো আমার প্রতি গম্ভীর থাকার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন। ব্যাপারটা বেশ খারাপ লাগছে। মনটা অস্থির হয়ে উঠেছে। আদ্রিতাও সামনে নেচে নেচে রেডি হতে ব্যস্ত। বিয়ের শপিং করা হবে আজ। কালকে এঙ্গেজমেন্ট পার্টি করা হবে ছোট্ট করে। যেই পার্টি আয়োজন করার দায়িত্ব আমার। নিজের প্রিয় মানুষটাকে দ্বিতীয় বিয়ে দেওয়ার তোড়জোড় এবার শক্ত হাতে করতে হবে। এর জন্য শক্ত মন দরকার। কিন্তু এই মনটা কোথায় পাবো? যেটা পাথরের ন্যায় শক্ত?

–“মাম্মা আমি কোনতা পলব?”
হাতে একটা সাদা লং গাউন আর হালকা গোলাপি লং গাউন দেখিয়ে কথাটা বলে ওঠে আদ্রিতা। ওর কাছে শপিং মানেই বিরাট কিছু। এতটুকু বয়সে শপিং নামক জিনিসটার প্রতি টান সত্যিই অন্যরকম বিষয়। ও কি জানে ওর বাবার বিয়ের শপিং করতে যেতে হচ্ছে? আমার জবাব না পেয়ে আদ্রিতা অস্থির হয়ে বলল…
–“ও মা…মাম্মাম! কোনতা পলব?”
–“এইযে এটা পড়ো। সাদা রঙ দারুণ লাগে তোমায়। একদম তোমার বাবার মতো।”
আদ্রিতা নিজের মাথা চুলকে সাদা গাউনটা ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখল। তারপর আমার দিকে নিজের ছোটছোট চোখ দ্বারা দৃষ্টি ছুঁড়ে বলল….
–“মাম্মা, আমাল পাপা কে?”

প্রশ্নটা হৃদয় ফুটো করে বেরিয়ে গেল। থতমত খেয়ে আশেপাশে তাকালাম। রুমে সিসিটিভি ক্যামেরা লাগানো। যদিও আদ্রিতার কথাগুলো সহজে কেউ বুঝতে পারবে না তবুও! ওর মাথা বুলিয়ে দিয়ে বললাম…..
–“এইতো আর কয়েকদিন। সব জানতে পারবে।”
আদ্রিতা জবাব দিল না। আমার দিকে টলটল দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল। চটপট করে ওকে রেডি করিয়ে দিয়ে রেডি হয়ে নিলাম আমি। রিক রায়জাদার কথা, আমাকে বিয়ের শপিং এর দায়িত্বটাও নিতে হবে। বাড়িতে তেমন কোনো মেয়ে নেই যে জামাকাপড় চয়েস করবে। আমি জানি সবই তার বাহানা। আমাকে আনিশা প্রমাণ করবার ছলনা!

রেডি হয়ে ড্রেসিংটেবিলের দিকে তাকাতেই দেখলাম আকাশ ভাইয়া আমার দিকে চেয়ে আছে। একনাগাড়ে চেয়ে কিছু একটা ভাবছে সে। ভাবনার অন্তিম ঘটিয়ে বলল….
–“বলছিলাম যে, তুমি যদি বলো বিয়ের সমস্ত দায়িত্ব আমি নেব। তোমার কষ্ট করার দরকার নেই। আমি ক্যাটারিং এর লোক ডাকিয়ে করিয়ে দিই?”
–“দরকার নেই। যা যা করার আমিই করব। সবার চোখে তাক লেগে যাবে। আই এম সিউর, এমন বিয়ে কেউ কোনোদিন দেখেনি।”
আকাশ ভাইয়া ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইল। একটা হাসি দিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে এলাম আমি সঙ্গে আকাশ ভাইয়া। আদ্রিতা আগেই ছুটে গিয়েছে তার মি. হ্যান্ডসামের কাছে।
দুটো গাড়ি নেওয়া হলো। সামনের সিটে আয়াশ আর তার পাশের সিটে ছোট্ট আদ্রিতা। বাবা আর মেয়ের একই রঙের পোশাক। দুজনেই সাদা। দুজনেরই সৌন্দর্য যেন চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ছে। আদ্রিতা ওই গাড়িতে থাকার কারণে আমিও গিয়ে ওই গাড়িতে বসলাম।

আয়াশ আমাকে একনজর দেখলেন আয়না দিয়ে। তারপর ভেতরে থাকা আয়না আমার দিকে ঘুরিয়ে চুপচাপ বসে রইলেন। গাড়ি গিয়ে থামলো শপিংমলে। আদ্রিতা খুশিতে আটখানা। দুম করে নেমে আয়াশের সঙ্গে হেঁটে হেঁটে আগেই ঢুকে গেল ভেতরে। গাড়ি থেকে নেমে চোখমুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল আমার। সামনে অধরা। অসাময়িক হাসি দিয়ে স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করলাম। অধরা তাকিয়ে আছে আয়াশের যাওয়ার দিকে। কেননা, তাকে দেখেও আয়াশ কিছু না বলেই একা একা ওই পিচ্চি বাচ্চার সঙ্গে চলে গেছে। অধরার সঙ্গে ওর বড় ভাই ও ভাবিও রয়েছে। মাহতাব রায়জাদা ও রিক রায়জাদা কুশল বিনিময় করল বেশ কিছুক্ষণ ধরে। আমাদের দিকে তাদের নজর পড়তেই বলে উঠল….
–“ইনাদের ঠিক চিনলাম না। কাল তো ছিলেন না।”,

–“উনারা আমাদেরই লোক হয়ে গেছে বলা যায়। একই সঙ্গে একটা বিজনেস ডিল করেছি আমরা। আমেরিকা থেকে এসেছেন। আমাদের বাড়িতেই রয়েছেন কয়েকদিন গেস্ট হিসেবে।”
অধরা আমাকে মাথা থেকে পা পর্যন্ত দেখে নিল। এরই মাঝে সুযোগ বুঝে রিক রায়জাদা বলল….
–“অধরা, তোমার যদি কোনো কিছু চয়েস করতে সমস্যা হয় তাহলে অবশ্যই মিসেস. রেজওয়ানকে বলবে। উনার চয়েস জাস্ট ওয়াও।”
অধরা আমার দিকে তাকিয়ে বলল….
–“নিশ্চয়!”
শপিংমলে ঢুকলাম আমরা। প্রথমেই রিং এর শপে। সেখানে আয়াশ আগের থেকেই অপেক্ষা করছিলেন। শুরু হলো রিং পছন্দ করা। একেক জন একেকটা দেখে। আবার কেউ কেউ নিজেরটা দেখতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। আয়াশ গম্ভীর চোখজোড়া নিয়ে মোবাইলে এক ধ্যানে তাকিয়ে আছে।

অহনারও একই অবস্থা! সেও মোবাইল হাতে ধরে বসে আছে। দুজনেরই আশেপাশে কি হচ্ছে তা খেয়াল রাখছে না। আমি আমার হাতের অনামিকা আঙ্গুলের দিকে তাকালাম। হাত একটু উঁচু করলাম। চকচক করছে ব্ল্যাক ডায়মন্ড টা। অজান্তেই সেখানে চুমু বসিয়ে সামনে তাকাতেই দেখলাম আয়াশ ঠোঁট কামড়ে ধরে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। অস্বস্তিতে পড়ে চোখ নামিয়ে ফেললাম আমি। তখনই রিক গিয়ে আয়াশের পাশে দাঁড়ায়। একটা রিং ধরে বলে…..
–“দেখ তো, এই রিংটা অধরাকে দিবি নাকি?”
আয়াশ ভ্রু কুঁচকে তাকান। এর মানে উনি বিরক্তি হচ্ছেন। ফোনেই চোখ রেখে বলেন….
–“রিং আমি কিনে নিয়েছি।”
চোখ ছানাবড়া হয়ে যায় আমার। উনি সবাই আসবার আগেই রিং কিনলেন? অধরার প্রতি এতো আগ্রহ উনার? আমার দিকে আঁড়চোখে তাকিয়ে আবারও ফোনে মনোযোগ দেন উনি।

রিক হতভম্ব হয়ে বলে….
–“কখন?”
–“তোরা আসার আগে। নাউ লিভ মি। একা ছেড়ে দে। ভালো লাগছে না।”
রিক চলে যায়। না চাইতেই আমার চোখ পড়ে অধরার দিকে। অধরা লজ্জামিশ্রিত চাহনিতে তাকাচ্ছে আয়াশের দিকে। দাঁতে দাঁত চেপে সবটা সহ্য করছি আমি। আমার স্বামীকে অন্য কেউ এই নজরে দেখবে ব্যাপারটা আমার কাছে খুব রাগের। অসহ্য রাগে কান থেকে ধোঁয়া বের হতে শুরু করল যেন। গটগট করে হেঁটে গিয়ে আয়াশের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে রিং দেখতে লাগলাম। তাতেও আড়াল হলেন না আয়াশ। এতো লম্বা মানুষকে আমার এই হাইট দিয়ে কিভাবে আড়াল করব। তবে অধরা দৃষ্টি নামিয়ে নেয়।

আয়াশ ফোনটা পকেটে রেখে আমার পাশ ঘেঁষে দাঁড়ান। আমি চোখ রাঙিয়ে তাকাই উনার দিকে। উনি নিচের ঠোঁট কামড়ে হাসছেন। কি চমৎকার হাসি! ড্যাম কেয়ার ভাব নিয়ে বললেন….
–“সো ফিলিং জেলাস হ্যাঁ?”
–“কেন? হতে পারে না? আমি যায়? আকাশ ভাইয়ার জন্য আমি কিছু কিনি?”
চোখজোড়া শক্ত চাহনি দিলো উনার।
–“ওয়েট এ মিনিট। আমি তোমাকে বলিনি যে আকাশকে বিয়ে করো। তুমি আমাকে বলেছো ওই মেয়েটাকে বিয়ে করতে। আলটিমেটলি দোষ টা আমার নয় তোমার নিশাপাখি।”
তর্কাতর্কিতে হেরে মুখ গোমড়া করে দাঁড়িয়ে থাকলাম আমি। হঠাৎ গলা ভারি হয়ে এলো। সব কথা আটকাতে শুরু করল। এমতাবস্থায় বললাম….
–“খুব তাড়াতাড়ি বিয়ে করার শখ না আপনার?”

আয়াশ আমার গলার সুরের পরিবর্তন দেখে তাকালেন আমার চোখের দিকে। তারপর মুখ ফিরিয়ে বললেন…..
–“তুমিই বাধ্য করছো।”
আর কিছু না বলে সরে এলাম আমি। অবশেষে রিং পছন্দ হলো। সেটা আয়াশের মাপে কিনে যাওয়া হলো শাড়ির শপে। টুলে বসে পড়লাম আমি। আমার একপাশে বসল অহনা। তারপর আয়াশ। আমার অন্যপাশে বসেছে অধরা। আকাশ ভাইয়ার আশেপাশের খেয়াল নেই। যথারীতি আদ্রিতাকে নিয়ে ব্যস্ত উনি। বিয়ের সব লেহেঙ্গা আর শাড়ি দেখাতে বলা হলো। একটা একটা করে শাড়ি বের করা হলো। অতঃপর দোকানদার জিজ্ঞেস করল….
–“কি রঙের বিয়ের শাড়ি নিবেন আপনারা? সব রকমের বিয়ের শাড়ি আর লেহেঙ্গা আছে।”

–“কালো!!”
হকচকিয়ে উঠলাম আমি। আমার সঙ্গে আয়াশও ঠিক একই রঙ পছন্দ করেছেন। উনি কালো রঙ দেখতে চাইছেন। একটু অবাক হয়ে তাকালো অধরা। কাঁপা কাঁপা সুরে বলল….
–“কা…কালো? আমার কালো রঙ পছন্দ নয়। আর কালো রঙ বিয়ের সময় কে পড়ে?”
–“অনেকেই পড়ে। আমিও পড়েছিলাম। সেটা সত্যিই এক অন্যরকম অনুভূতি ছিল।”
কথাগুলো বিরবির করে বললাম আমি। অধরা না বুঝে জিজ্ঞেসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল….
–“সরি! কিছু বললেন?”
–“না। কিছু না। দেখো কোনটা পছন্দ হয়। কালো না হলে গোলাপী, লাল, নী….”
বাকিটা না বলেই থেমে গেলাম। গলা বার বার ধরে আসছে। কথাগুলো দলা পাকিয়ে যাচ্ছে। চুপচাপ সবটা দেখতে লাগলাম।

সবকিছু শেষে আয়াশ বরাবরের মতো কালো রঙের শেরওয়ানি কিনলেন। সব শেষে শপিংমল থেকে বেরিয়ে এলাম আমরা। বাড়িতে এসে সরাসরি নিজের ঘরে চলে এলাম। আর কিছু ভালো লাগছে না। চারিদিকটা বিষন্ন হয়ে উঠছে। দুর্বিষহ হয়ে উঠছে আমার বেঁচে থাকা।

ছাঁদের এক সিঁড়িতে বসে আছে অহনা। দৈনন্দিন জীবনে এতো ব্যস্ততার ভীরে নিজের অস্তিত্বকে যেন বিলিন করে চলেছে সে। তার এই সুন্দর হাসিখুশি মুখের পেছনে রয়েছে অজস্র চোখের পানি। জীবনে তার কোথাও শান্তি নেই। তার জীবনে সুখপাখি নামক জিনিসটাই নেই। সে তো জানেই না ওর জন্মপরিচয়। ওর মা-বাবা আদোও আছে কি না! মা-বাবার সঙ্গে দেখা হলে নিশ্চয় একবার জিজ্ঞেস করত, কেন ওকে রাস্তার এক নোংরা ডাস্টবিনে ফেলে দেওয়া হয়েছিল? ও কি তবে অবৈধ ছিল এই পৃথিবীতে? ভাবতেই চোখের পাতা ভিজে যায় অহনার। ভালোবাসা সে তো অনেক দূরের জিনিস। একবার ধরতে পেরেছিল ভালোবাসাকে। কিন্তু……! কিন্তুটা বাঁধা হয়ে রয়ে যায়। এই বাঁধার দেওয়াল টপকে পার হতে পারেনি সে। এই বাঁধাটা আজীবন থাকবে।

ফোনে ইম্পরট্যান্ট কথা বলে সিঁড়ির দিকে আসতেই সিঁড়িতে বসে থাকা মেয়েটাকে দেখে থেমে যায় আয়াশ। পেছন থেকেই ও উপলব্ধি করতে পারছে এই মেয়েটা ভীষণ বিষন্ন। আয়াশের মনেও কালো মেঘ জমতে থাকে। মনটা অজান্তেই খারাপ হয়ে আসে। গলা খাঁকারি দিতেই চমকে পেছনে তাকায় অহনা। আয়াশ অহনার অ্যাটেনশনই পেতে চেয়েছিল। অহনার মলিন চোখজোড়া দেখে আয়াশের কষ্ট দ্বিগুন হয়। অহনা আবারও মুখ ফিরিয়ে সামনে তাকায়। অন্যসময় হলে আয়াশকে তো অহনা রেগে দুই-চারটা কথা শুনিয়ে দিতো। আজ কেন শোনালো না?
আয়াশ দুটো সিঁড়ি নেমে অহনার পাশে গিয়ে বসে। অহনা মলিন হেসে বলে ওঠে…..
–“ঝগড়া করতে এসেছেন? আমার কিন্তু ঝগড়া করার ইচ্ছে নেই আজকে।”

–“আমাকে দেখে ঝগড়ুটে মনে হয় তোমার? আমি ঝগড়া পারি না।”
অহনা হালকা হাসে। আয়াশ হালকা কেশে আমতা আমতা করে বলে….
–“মন খারাপ তোমার?”
–“একটুখানি। ভালো হয়ে যাবে কিছুক্ষণ পর।”
–“কেন মন খারাপ?”
অহনা আয়াশের দিকে এক পলক তাকায়। দীর্ঘ নিশ্বাস ছেড়ে বলে…..
–“ওইযে, বাবা-মা না থাকলে যা হয়।”
–“আমারও কিন্তু মা-বাবা নেই।” (শান্ত সুরে)
প্রতিত্তোরে কিছু বলে না অহনা। কিছুক্ষণ নিস্তব্ধতা বিরাজ করে। অহনা প্রসঙ্গ পাল্টে বলে…..
–“আনিশাকে কেন কষ্ট দিচ্ছেন? ওকে কষ্ট দেবেন না। খুব ভালোবাসে আপনাকে। আপনার জন্য তিন বছর ঠিকঠাক হাসেনি ও। আপনাকে যখন পেলো আপনার স্মৃতি ছিল না। আর এখন আপনাকে অন্যের পাশে দেখতে হচ্ছে। একটা মেয়ের জন্য এটা মৃত্যু যন্ত্রণার মতো।”

আয়াশ অন্য সিঁড়িতে হাতে ভর রেখে ওপরের দিকে দৃষ্টি স্থির করে বলে…..
–“ভালোবাসা বোঝ?”
–“ভালোবাসা বুঝতে হয় না। অনুভব করতে হয়। এটা এমন এক যন্ত্রণা যেটার থেকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত নিস্তার পাওয়া যায় না। ভালোবাসা ছোট্ট একটা শব্দ এর গভীরতা মাপার ক্ষমতা কারোর নেই। আপনার কাছে ভালোবাসা মানে কি?”
আয়াশ চোখ বন্ধ করে। প্রথম আনিশাকে দেখার দৃশ্য ভেসে ওঠে। মুচকি হেসে বলে…..
–“ভালোবাসার কোনো নির্দিষ্ট সজ্ঞা হয় না। এটি একেকজনের কাছে একেকরকম হয়ে ধরা দেয়। কারো কাছে ভালো লাগা হয়ে আবার কারো কাছে ঘৃণা হয়ে। একজন নির্দয়, কঠোর, উম্মাদ, পাগল, অভদ্র, অসভ্য মানুষের মনেও ভালোবাসা জাগতে পারে। এটা চারিদিকের সব বাস্তবতা ভুলিয়ে এক অন্য জগতের রাস্তা করিয়ে দেবে। এটাই ভালোবাসা।”

অহনা অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ভাবতে থাকে। দুজন মানুষ দুজনকে কতটা ভালোবাসে। তবুও আজ তারা আলাদা। তাদের মন এক হয়ে থাকলেও তারা ক্ষণিকের জন্য কি কষ্ট টাই না পাচ্ছে। এই ভালোবাসার বন্ধন যেন সারাজীবন অটুট থাকে। অহনার মন খারাপ দূর হয়ে যায় কয়েক মূহুর্তেই। আয়াশ চৌধুরী নামক লোকটি মটেও এতোটা বাজে নয়। বেশ ভালো!

চলবে……🍂🍂
বি.দ্র. ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। আর হ্যাঁ কালকে গল্প নাও দিতে পারি। কেউ গল্পের আশায় থাকবেন না।
চলবে…..🍂🍂
বি.দ্র. ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here