ভালোবাসাটা_ঘৃণার পর্ব ৯+১০

#ভালোবাসাটা_ঘৃণার (সিজন ২)
#Only_Love
#Anisha_Sabiha
পর্ব ৯
ফ্লোরের একপাশে একটা ছাইরঙা শাড়ি পড়ে আছে। আয়াশ বসে আছে ঘরের দেয়ালের কোণায় পিঠ ঠেকিয়ে। ফর্সা ও সুন্দর মুখটা ইতিমধ্যে ভয়ানক হয়ে উঠেছে। কপালের রগ ফুলে উঠে একাকার। অন্যপাশে একটা ল্যাম্পশিট পড়ে আছে। সেটাও ভাঙা। এতো রাগ ওর মাথা পাগল করে ফেলছে। হাঁটুতে দুইহাত রেখে মুখটা নিচু করে রেখেছে সে। একসময় নিজে নিজে চিৎকার করে ওঠে আয়াশ।
–“এতো রাগ কেন আসছে? কেন? সবকিছু এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে কেন ওই মেয়েটা আসার পর থেকে? শান্তি পাচ্ছি না আশেপাশে কেন? ও যদি সত্যিই আমার হয়ে থাকে তাহলে ও অন্য কারো সঙ্গে থাকে কেন? আমার কাছে আসে না কেন? আমাকে ভালোবাসে না কেন? তবে কি সে আমার নয়?”

এতো এতো প্রশ্ন মনে আসতে আসতে ভেতরে বড়সড় প্রশ্নের পাহাড় তৈরি করে ফেলেছে সে। মাথা তুলে লাল চোখজোড়া দিয়ে ছাইরঙা শাড়ির দিকে তাকায় ও। ঘরে একটা ছোট্ট বাতি বলছে। আর চাঁদের হালকা আলো পড়ছে। সব মিলিয়ে পরিবেশটা ভয়ানক! হাতে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়ায় সে। একটু একটু করে হেঁটে যায় শাড়ির দিকে। পড়ে থাকা শাড়ি হাতে তুলে নেয় আয়াশ। হাসি বিহীন মুখ ও তার খাড়া, ঘেমে যাওয়া নাকের কাছে ধরে শাড়িটা। তীক্ষ্ণ আর নেশা জাতীয় গন্ধ আঁকড়ে ধরে ওকে। শাড়িটা খামচে ধরে সে। এই গন্ধ ওকে মাতাল করে তুলছে বারংবার। এই একটা শাড়ি নিজের পুরো আলমারি ঘেঁটে পেয়েছে সে।

আজ আয়াশ তার মনের মাঝে তৈরি হওয়া হাজারো প্রশ্নের উত্তর পেতে গিয়েছিল আনিশার ঘরে। কিন্তু আনিশা নেই। সেটা ওকে আহত করেনি যতটা আকাশ আর আনিশা একসাথে ঘরে না থাকার ব্যাপারটা আহত করেছে। এতো আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত হয়ে যাচ্ছে ওর মন। মড়মড় করে ভেঙে যাচ্ছে ওর মনে বেড়ে ওঠা ভালোবাসার অনুভূতি
।তৎক্ষনাৎ দরজার ঠকঠক আওয়াজ কানে ভেসে আসে।

চোখ তুলে দরজার দিকে তাকায় আয়াশ। দরজাটা লক করা। রাত প্রায় ১০ টা! এতো রাতে ওকে কেউ বিরক্ত করে না কারণ ছাড়া। শাড়িটা বেডে ছুঁড়ে ফেলে দরজার কাছে এগিয়ে যায় আয়াশ। খুলে দেয় দরজার লক। তড়তড় করে ঢুকে পড়ে রিক। ব্যাপারটা আয়াশকে বিরক্ত করে তোলে। ঘরে ঢুকে আশেপাশে তাকায় সে। ঘুরতে থাকে ওর চোখ। ঈগলের ন্যায় চাহনি যায় বেডের ওপরে। দ্রুত হেঁটে গিয়ে শাড়িটা ধামকি দিয়ে নিয়ে নেয় হাতে। একবার আয়াশের দিকে তাকিয়ে সরু ঠোঁটে বলে….
–“এ….এই শাড়ি কোথায় পেলি?”

একে তো আয়াশের রুমে হঠাৎ ঢুকে পড়া ব্যাপারটা পছন্দ করে না আয়াশ। তার ওপর শাড়িটা ওভাবে নেওয়ার ব্যাপারটাও ওর রাগের মাত্রা বাড়িয়ে দিয়ে চলেছে। ঝড়েরবেগে টেনে ধরে সেই শাড়িটা আয়াশ। এটা কেমন জানি ওর একান্তই মনে হয়। শাড়িটা ওর একান্ত। একেবারেই ওর। হয়ত শাড়ি পরিহিত মানুষটিও একেবারেই ওর ছিল। অধিকার নেই কারো এই শাড়িটা এবং মানুষটাকে ছোঁয়ার। রিকের হাত ঝাড়ি দিয়ে ঝাঁঝালো গলায় বলে…..
–“শাড়িটা ছাড় রিক।”
–“আগে বল কোথায় পেয়েছিস এটা?”

আয়াশ উত্তর না দিয়েই টেনেই শাড়িটা নিয়ে নেয়। তারপর তীক্ষ্ণ মেজাজ নিয়ে বলে…..
–“আমার আলমারি থেকে। একটা কোণায় পড়ে ছিল। তুই কেন হাত দিচ্ছিস শাড়িটাতে? সব থেকে বড় কথা উইদাউট এনি পারমিশন তুই আমার ঘরে ঢোকার সাহস পেলি কি করে?”
–“আয়াশ! ভুলে যাস না এটা আমার বাড়ি। রায়জাদা বাড়ি। তোকে থাকার জন্য এই রুমটা দেওয়া হয়েছে।”
রিকের কড়া গলা! আয়াশ দ্বিগুন কড়া গলায় বলে ওঠে…..
–“ডোন্ট ফরগেট দ্যাট রিক, যে আমি এখানে আসতে চাইনি। তোরা নিয়ে এসেছিস। এরপর থেকে আমার রুমে ঢোকা তো দূর আমার ঘরের দরজায় হাতও লাগাবি না। গেট আউট।”

রিক কিছু বলতে গিয়েও থেমে যায়। কটমট করে চেয়ে থাকে আয়াশের দিকে। মাঝে মাঝে রিকের ইচ্ছে করে আয়াশকে খুন করতে। আয়াশের মরণ চিৎকার আর প্রাণ ভিক্ষা উপভোগ করতে ইচ্ছে করে তার। কিন্তু পারে না শুধুমাত্র তার বাবার জন্য। যেদিন কাজ হয়ে যাবে সেদিন আয়াশকে কি করবে সে নিজেও জানে না। সিসিটিভি ক্যামেরাতে আনিশার শাড়ি দেখেই দৌড়ে এসেছিল ঘরে। আনিশার সব ছবিসহ শাড়ি, জামাকাপড় সরিয়ে ফেলেছিল সে। কিন্তু কোনো কোণার ভেতরে এই শাড়িটা বোধহয় রয়েই গিয়েছিল। আয়াশ রিকের রেসপন্স না দেখে দরজার দিকে হাত তুলে রাগে কেঁপে বলে ওঠে…..
–“আই সেইড গেট আউট।”
রিক আর কিছু না বলে চোখ রাঙিয়ে চলে যায়।

রুম থেকে বের হতেই গায়ের শক্তি দিয়ে দরজা লাগিয়ে দেয় আয়াশ। বিকট একটা শব্দ হয়। বাইরে এসে দেয়ালে ঘুষি মারে রিক। তারপর গটগট করে মাহতাবের ঘরে চলে যায়। মাহতাবের ঘরে কোনোরকম নক না করেই ঢুকে পড়ে সে। মাহতাব তখন মনের সুখে টাকার বান্ডিল গুনতে ব্যস্ত। মাঝে মাঝে আঙ্গুলে থুথু ভরিয়ে গুনে চলেছেন উনি। পায়ের শব্দে টাকা গুনতে ব্যাঘাত ঘটে উনার। হকচকিয়ে টাকা লুকোনোর চেষ্টায় ব্যস্ত হয়ে পড়েন। নিজের ছেলেকে দেখে স্বস্তি পান। শ্বাস ফেলে বলেন…..
–“আরে তুই! আগে বলবি তো? ভয়ই পেয়ে গিয়েছিলাম। আয় বস।”

রিক চোয়াল শক্ত করে বেডে গিয়ে বসে। মাহতাব রিকের সামনে টাকা ধরিয়ে বলেন….
–“এই দেখ আয়াশের ব্যাংক একাউন্ট থেকে টাকা তুলেছি। পারছিলামই না এতোদিন টাকা তুলতে। অনেক কাঠখড় পোড়াতে হলো বুঝলি! না জানি আর কতগুলো একাউন্ট আছে ওর। একবার পাসওয়ার্ড পেয়ে গেলেই টাকা আর টাকা।”
রিকের রাগ তখন চরমে গিয়ে পৌঁছে। চিৎকার করে বলে ওঠে….
–“বাবা, তুমি শুধু ব্যাংক একাউন্টের টাকাই গুনে যাও। অন্য কিছু করতে হবে না তোমাকে। আমি বরং আয়াশকে মেরে ফেলি।”
মাহতাব টাকা বালিশের তলায় রেখে চোখ বড় বড় করে বলে ওঠেন….
–“কি বলছিস কি? পাগল হয়ে গেছিস? ও আমাদের কাছে লটারির টিকিট। ওর ওপরে আঁচও আসতে দেওয়া যাবে না। খবরদার রিক। যদি ওর কিছু হয়েছে তো খবর আছে?”

রিক উঠে দাঁড়ায়। বিরক্ত ও রাগ মিশ্রিত কন্ঠে বলে…..
–“তো কি করব? তুমি জানো? ওই মায়াবিনী রেজওয়ান না কে ওকে দেখার পর থেকে আয়াশের স্মৃতি ফিরে আসতে শুরু করেছে? আজ ওই আকাশ রেজওয়ান আর ওই মেয়েটা একসাথে কোথায় যেন বেরিয়ে গেল। ফলো করতে করতে হারিয়ে গেল। সকালে আমি নিজ কানে শুনেছি আয়াশের বলা কথাগুলো। ও ওই মেয়েটা আনিশা ভাবতে শুরু করেছে। আদ্রিতা নামের মেয়েটা ওর মেয়ে কি না জিজ্ঞেস করছিল।”
–“কি বলছিস? তো ওই মিসেস. রেজওয়ান কি বলল?” (উৎসুক হয়ে)

–“বলল যে আদ্রিতা রেজওয়ান পরিবারের মেয়ে। কিন্তু তাও বাবা তুমি ভাবতে পারছো? আয়াশ কোন দিকে এগোচ্ছে?”
মাহতাব ভাবুক হয়ে উঠলেন। এপাশ ওপাশ হাঁটতে হাঁটতে বললেন…..
–“হুমম! আচ্ছা আমি কয়েকদিনের মধ্যে পেপার রেডি করার ব্যবস্থা করছি। কোনো না কোনো উপায়ে সই তো করে নেবই। শুধু একটা সই তারপর বাকিগুলো জাল সই করে নেওয়া যাবে।”
রিক যেন তবুও আশ্বস্ত হলো না। ওই মায়াবিনী মেয়েটার আসল সত্যিটা কোনটা সেটা জানতে চায় সে।

আলতোভাবে চোখ খুলে পাকানোর চেষ্টা করে রোশন। চোখজোড়া যেন ঘুমে টেনে ধরেছে। খুলতে চাইছে না। আশেপাশে হালকা আলো তবে সব অস্পষ্ট। হাত-পা নাড়ানোর চেষ্টা করতেই অসফল হয় সে। ভালো করে তাকায়। নিজের হাত-পায়ের দিকে লক্ষ্য করতেই দেখতে পায় ওর হাত পা বাঁধা তাও বেডের সঙ্গে। বেডের চারদিকে চার হাত-পা বাঁধা। নাড়ানোর মতো কোনো জায়গায় নেই। চোখমুখের রঙ পাল্টে যায়। ও ঘুমালো কি করে?
হ্যাঁ, ওর ওপর কি যেন ছিটানো হয়েছিল। তারপরই তো চারদিকে অন্ধকার হয়ে আসে। আনিশার কথা মাথায় আসতেই ঢক গিলে সে।
–“অবশেষে ঘুম ভাঙল তোমার! এটারই অপেক্ষা করছিলাম।”

রোশন মাথা ঘুরিয়ে তাকায় সিঙ্গেল সোফার দিকে। একজন মানবী পায়ের ওপর পা তুলে বসে আছে। মুখটা অন্ধকারে দেখা যাচ্ছে না। রোশন রাগ নিয়ে বলার চেষ্টা করে….
–“কে তুই? তোর সাহস তো কম না? তুই আমাকে বেঁধেছিস? রোশন রায়জাদাকে? শুধু এখান থেকে ছাড়া পাই। তোর কি অবস্থা করব ভাবতেও পারছিস না।”
হাসির আওয়াজ আছে। কি ভয়ানক সেই হাসি!

আমি হেসেই চলেছি। হাসির প্রতিধ্বনি শোনা যাচ্ছে বারবার। বেশ শান্ত কন্ঠে বললাম….
–“জীবিত অবস্থায় ছেড়ে দিলে তো আমার কোনো ব্যবস্থা করতে পারবে তাই না?”
কথাটা বলে হাতে থাকা লাইটার দিয়ে মোমবাতি জ্বালিয়ে নিলাম। আমার মুখ স্পষ্ট হয়ে উঠতেই বিস্মিত হলো রোশন রায়জাদা। মুখটা সেকেন্ডেই চুপসে গেল। আমি সোফা থেকে উঠে দাঁড়ালাম। বড় মোমবাতি নিয়ে এগিয়ে আসতে আসতে বললাম….
–“চুপসে গেলে কেন? অবাক হচ্ছো? আমি বেঁচে আছি কি করে? আমি কি সত্যিই আনিশা নাকি আনিশার ভূত? সেটাই ভাবছো তাই না?”
–“তু….তুমি বেঁচে আছো কি করে? তোমাকে তো ফেলে দিয়েছিল ওতো উঁচু পাহাড় থেকে না?”

আমার চোখজোড়া আরো হিংস্র হয়ে উঠল। মোমবাতিটা সরাসরি রোশন রায়জাদার হাতে ধরলাম। আগুনে ঝলসে যেতে শুরু করল এতো সুন্দর আর সবল মাংস। রোশন রায়জাদার চিৎকারে কেঁপে উঠল পুরো ঘর। পেলাম এক পৈশাচিক শান্তি। আমাকে বিশ্রী গালি দিয়ে বলল…
–“মোমবাতি সরা। তোকে মেরে ফেলব রে।”
মোমবাতি সরিয়ে তার পায়ের কাছে এসে মোমবাতি ধরলাম। ঝলসে যেতে লাগল পায়ের তালু। মেতে উঠলাম এক পৈশাচিক খেলায়। মোমবাতিটা সারা শরীরের বিচরণ করাচ্ছি। রোশন রায়জাদার শার্ট প্রথমেই খুলে নিয়েছি। আজ ঝলসে দেব ওর পুরো শরীর। না পেয়ে অবশেষে চিৎকার করে কাঁদতে লাগল সে। মোমবাতির আগুন তখন বুকের মাংস ঝলসে দিয়ে পুড়িয়ে কালো করে ফেলছে। মিনতি করে বলল…..
–“আমাকে ছেড়ে দাও আনিশা। মাফ করো আমাকে।”

মাথা এপাশ ওপাশ নাড়িয়ে সরাসরি তার থুতনিতে গিয়ে ধরলাম। জানি না কেন হলাম এতোটা ভয়ানক! এমনটা ছিলাম না কোনো কালেই। কিন্তু এরাই বোধহয় আমাকে এমন বানিয়েছে। ঘাড় কাঁত করে বললাম…..
–“এতোটা মিনতি বোধহয় সেদিন রকি সহ আরো কয়েকজন লোকও করেছিল না? ছেড়েছো তুমি তাদেরকে? আমিও করেছিলাম। বলেছিলাম আমাকে বাঁচাতে। আয়াশকে না মারতে। কি করতে তোমরা? ষড়যন্ত্র করলে? কি হলো এতোকিছু করে? নারী সবসময় কোমল মনের অধিকারী হয়। তার মন সবসময় মায়া ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকে। কিন্তু তাদের যখন আঘাত করা হয় তখন তারা লোহার মতো শক্ত হতে থাকে। তারা পুরুষের ভয়ানক রুপ নিতে পারে। এমন অনেক ইতিহাস আছে। আফসোস! তুমি সেসবের ধারণায় করো নি। এমন একজনের প্রাণ কেঁড়ে নিয়েছো যার কারণে নিঃস্ব হয়ে গেছে পরিবার।”

রোশন রায়জাদার কথা বলার শক্তি হারিয়েছে। মোমবাতি শেষ হয়ে আসছে। ফুঁ দিয়ে নিভিয়ে দিলাম। আরেকটা মোমবাতি ধরিয়ে সরাসরি তার চোখে ধরলাম। বোধহয় শেষ বারের মতো চিৎকার শোনা গেল রোশন রায়জাদার। চোখজোড়া ঝলসে গেল। একেবারে বিকৃত হয়ে গেল চেহারা। আমি তাও থামলাম না। শেষমেশ ট্রলি ব্যাগ থেকে একটা রিভলবার বের করে একের পর এক শুট করতে লাগলাম। হাত একবারও কাঁপল না। যার যেমনটা প্রাপ্য তার সঙ্গে তেমনটাই করা উচিত। রিভলবারে সাইলেন্সার লাগানো থাকার কারণে শব্দ হলো না। শুধু গুলি গিয়ে বিঁধল রোশন রায়জাদার বুকে, পেটে আর শেষটা মাথায়। শেষবারের মতো নড়ে উঠল তার দেহটা। নিষ্প্রাণ হয়ে উঠল হয়ে। মাথার রক্ত ছিটে উঠে পড়ল আমার চোখেমুখে।

ঠোঁটের কোণে হাসি এলো। রক্তগুলো বেশ লাগছে। দড়ি থেকে খুলে ফেললাম হাত-পা। একেকটা অংশ বেশ বাজে ভাবে পুড়ে খাক হয়ে গিয়েছে। বিশ্রি গন্ধ বের হচ্ছে। টেনেটুনে ফাঁকা ট্রলিতে ভরলাম দেহটা। ঘেমে একেবারে জবজবে হয়ে গিয়েছি। কোনোমতে বোরখা পড়ে নিলাম। ট্রলি নিয়ে বের হলাম বাইরে। গায়ের শক্তি লাগছে ট্রলি টানতে। রিসেপশনের পাশ কাটাতেই হলো বিপত্তি। রিসেপশনে কেউ না থাকলেও পাহারা দেওয়ার জন্য লোক রয়েছে। দ্রুত এগিয়ে এসে আমাকে প্রশ্ন করল…..
–“আপনি কোথায় যাচ্ছেন এতো রাতের বেলা?এই রাতের বেলা কোথাও যাওয়ার নিয়ম নেই। আপনি রুমে যান।”

গলা খাঁকারি দিয়ে পরিষ্কার করে নিলাম। সরু যথাসম্ভব মোটা করে বললাম….
–“আমার যাওয়া প্রয়োজন। আমি কাজে এসেছিলাম। কাজ শেষ চলে যাচ্ছি। আপনি আটকাতে পারেন না। আর যার রুমে ছিলাম সে এখনো ঘরেই রয়েছে। আপনি গিয়ে দেখুন বিশ্বাস না হলে। যান দেখুন।”
লোকটা ভ্রু কুঁচকে আমার দিকে চেয়ে থাকল। আমি হাত দিয়ে দেখিয়ে বললাম….
–“যান না যান ২৪৪ নম্বর রুমের গিয়ে দেখুন। আমি যাচ্ছি। আমার ইমারজেন্সি আছে।”
কথাটা বলে দ্রুত পাশ কাটিয়ে ট্রলি নিয়ে চলে এলাম। পেছন ফিরে দেখলাম লোকটা সিঁড়ি দিয়ে উঠে যাচ্ছে। ফ্লোরে চোখ যেতেই গলা শুকিয়ে এলো। রক্ত পড়ছে ফ্লোরে ট্রলি থেকে। হাঁটার বেগ বাড়িয়ে দিলাম।

বাইরে এসে রাস্তার একটা গলিতে ঢুকে পড়লাম। সেখানেই আকাশ ভাইয়া গাড়ি দাঁড় করিয়ে রেখেছে। গাড়িতে উঠে দ্রুততার সঙ্গে বললাম….
–“ভাইয়া, দ্রুত গাড়ি স্টার্ট দাও। নয়ত ধরা পড়তে হবে।”
ভাইয়া গাড়ির চাবি ঘুরিয়ে গাড়ি স্টার্ট দিয়ে ফুল স্পিডে গাড়ি ড্রাইভ করতে লাগল। আমি মুখ থেকে নিকাব সরালাম। আমার লাল বর্ণের মুখশ্রীর দিকে তাকিয়ে অবাক সুরে ভাইয়া বলল….
–“এতো সাহস কোথা থেকে জোগাড় করলে বলো তো? বলেছিলাম আমিও যাই তোমার সঙ্গে শুনলে না। একা একা এতো ভয়ানক কাজ করে ফেললে?”
–“এদের মারতে সাহস লাগে না আকাশ ভাইয়া। ঘৃণায় যথেষ্টা এদের মারতে। আচ্ছা তোমার কি ভয় করছে আমাকে দেখে?”
ভাইয়া হেসে ফেলল। হাসোজ্জল গলায় বলল…..
–“তোমাকে ভয় পেলে এতোদূর আসতাম না রিস্ক নিয়ে। তোমাকে ভয় পাইনি আমি। কারণ আমি জানি তুমি খুন করোনি। তুমি আর্বজনা পরিষ্কার করছো।”
আমি নিজের হাত দুটো তুলে হাতজোড়ার দিকে তাকালাম। এই হাতজোড়া খুন করে ফেলল?

সকালে…..
রাতে ঘুম না হওয়ায় সকালে এখনো ঘুমে মগ্ন আমি। একজোড়া ঠান্ডা হাত আমার গালে বিচরণ করছে ব্যাপারটা অনুভূত হয়। কম্পন সৃষ্টি হয়। হালকা নড়ে অন্যপাশ ফিরতেই গরম নিশ্বাস আঁচড়ে পড়তে লাগল আমার ঘাড়ে। হাতটা ধাক্কা দেওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিল। চোখ মেলতেই হাত নামিয়ে ফেললাম। আয়াশ আমার ওপর ঝুঁকে আছেন। এই রুমে না উনার সঙ্গে ঠিকঠাক ব্যবহার করতে পারব আর না উনাকে সব সত্যিটা বলতে পারব। লোকটা এমন কেন? আমাকে দ্বিধায় ফেলতে সবসময় প্রস্তুত থাকে।
শক্ত গলায় বললাম…..
–“কি হচ্ছেটা কি? কার পারমিশনে আমার ঘরে ঢুকেছেন?”

আয়াশের মাঝে কোনো পরিবর্তন ঘটলো না। আগের মতোই আমার দিকে তাকিয়ে থাকলেন। আমি উনাকে ধাক্কা দেওয়ার জন্য উদ্যত হতেই উনি আমার হাত ধরে উঠে বসালেন। আমার গাল শক্ত করে ধরে বসলেন। ব্যাথা পাচ্ছি না কিন্তু বিরক্ত হলাম। দাঁতে দাঁত চেপে বললেন….
–“এই মেয়ে! নিজেকে রহস্যের মায়াজালে কতদিন লুকিয়ে রাখবে? তুমি কে সেটা আমি জানি। তবুও কেন আড়াল করার চেষ্টা করছো? স্পিক আউট। এভাবে যদি চলতে থাকে আমাকে এই নেশার দহনে পুড়িয়ে ফেলবে তুমি। তুমি এমন নেশা যেটা আমার সামনেই থাকছে তবে আমি পাচ্ছি না। কেন এমন হচ্ছে বলো!”

আমি নিজেকে ছাড়িয়ে নিলাম। রেগে দাঁত কিড়মিড় করে বললাম….
–“আমি কেন আপনার থেকে নিজেকে লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করব? হু আর ইউ? চলে যান এখান থেকে।”
আয়াশ ব্যথিত হলেন। কিছুক্ষণ স্থির আমার দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন….
–“ওকে। সরি।”
উঠে চলে গেলেন উনি। টলটল দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে চাদর খামচে ধরলাম। উনাকে যে আমি ইচ্ছে করে ব্যথিত করিনি সেটা কি উনি বুঝবেন?

ফ্রেশ হয়ে নিলাম তাড়াতাড়ি। বাইরে করিডোরে আকাশ ভাইয়াকে সোফায় বসে চা খেতে দেখলাম। তার পাশেই গিয়ে বসলাম আমি। আদ্রিতাকে নিয়ে উপস্থিত হলো অহনা। ওকে কোলে নিতে যেতেই মুখ ফিরিয়ে নিল সে। ছোট্ট মুখ খানা লাল টকটকে হয়ে গিয়েছে। উঠে দাঁড়িয়ে বললাম….
–“আদ্রিতা, মাম্মার কোলে আসবে না?”
আদ্রিতা নাবোধক মাথা নাড়ায়। তারপর অহনার কোল থেকে নেমে ছোট ছোট পায়ে ধাপ ফেলে কোথাও যেতে শুরু করে। আমি পেছন থেকে ওকে ডাকতে থাকি।
–“আদ্রিতা! কোথায় যাচ্ছো মা? দাঁড়াও। রাগ করেছো?”
দাঁড়াবার নাম নেই মেয়েটার। নিচের দিকে চোখ যেতেই থেমে গেলাম। মারহাব রায়জাদা! তবে কি উনি নিজের ছেলের মৃত্যুর খবর নিয়ে এসেছেন?
#ভালোবাসাটা_ঘৃণার (সিজন ২)
#Only_Love
#Anisha_Sabiha
পর্ব ১০
সবার মাঝে গাম্ভীর্য বিরাজ করছে। কারো মুখ থেকে টু শব্দ অবধি বের হচ্ছে না। মারহাব রায়জাদা কেঁদে একাকার। নিজের চোখটা মুখে মাহতাব রায়জাদার দিকে তাকালেন উনি। টলটল দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললেন…..
–“মাহতাব, আমার ছেলে খুন হয়েছে। বুঝতে পারছিস ব্যাপারটা?”
মাহতাব রায়জাদার হাতে চশমা। চশমা নাড়িয়ে শান্ত গলায় জবাব দিল….
–“এমনটা কি করে হলো? কখন হলো?”
–“কাল রাতে হয়েছে। পুলিশ তেমনটাই ধারণা করছে। আমার ছেলে হোটেল সোনালীতে গিয়েছিল। মাঝে মাঝেই সেখানে যেত। কিন্তু জানতাম না কাল গেলে ওর আর ফিরবে না। আজ ভোর বেলা নদীর পাড়ে ট্রলি ব্যাগের ভেতরে ওর দেহ পাওয়া গেছে।”

কথাটা বলে আবার কাঁদতে আরম্ভ করলেন মারহাব রায়জাদা। আমি ওপর থেকে ব্যাপারটা বেশ উপভোগ করছি। তখনই আমার পাশে এসে দাঁড়ালো আকাশ ভাইয়া। নিচটা পর্যবেক্ষণ করে বলল….
–“বডিটা তাহলে পেয়েই গেল। কি মনে হয়? পুলিশ ধরতে পারবে বিষয়টা?”
আমি কনফিডেন্স এর সঙ্গে বললাম…..
–“চান্স খুব কম। হোটেলে রক্ত ছাড়া অন্যকিছু পাওয়ার কথা নয়। আর ওদের ওখানে সিসিটিভি ক্যামেরা থাকলে ফুটেজে হোটেলে ঢোকার সময়ও স্কার্ফ দিয়ে আমার মুখ ঢাকা ছিল। ওপরে আলাদা কোট পড়ে নিয়েছিলাম। আর বের হবার সময় বোরখা পড়ে বের হয়েছি। নিজের গায়ের সমস্ত গয়না খুলেই কাজটা সেড়েছি। তবে একটা বিষয় কি জানো তো! মানুষ লুকিয়ে-চুরিয়ে বা কোনো অপরাধমূলক কাজ করলে একটা একটা প্রমাণ নিজের অজান্তে ফেলেই যায়। পুলিশ যদি বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে কাজ করে প্রমাণ পেয়েও যাবে। দেখা যাক কি হয়!”

আকাশ ভাইয়া মনোযোগ দিয়ে আমার কথা শুনে নিচে তাকালো। আমিও নিচে তাকালাম। কয়েকজন লোক একটা সাদা চাদরে ঢাকা দেহ নিয়ে এসে রেখে গেল। মারহাব রায়জাদা বসে পড়ল নিজের ছেলের মৃত দেহের সামনে। কেন জানি না, আমার বেশ হাসি পাচ্ছে। কারণ মারহাব রায়জাদার কান্নাটা কুমিরের কান্না ছাড়া কিছুই মনে হচ্ছে না। আমি ভুল না হলে ছেলের শোক উনি দুই দিনের মাঝেই ভুলে যাবেন। রোশন তো তার ছেলে নয় পাপের সঙ্গী ছিল মাত্র! নিজের সঙ্গী কে হারাবার দুঃখেই কাতর হয়ে পড়েছেন এর বেশি কিছুই নয়।

আমি আর আকাশ ভাইয়া দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে নিচে নামতে শুরু করলাম। দোতালায় আসতেই আদ্রিতার হাসির আওয়াজ শুনে পাশে তাকালাম। আয়াশ আসছেন আদ্রিতাকে কোলে নিয়ে। আদ্রিতার মুখে হাসি ধরে না। বার বার উৎসুক দৃষ্টিতে আয়াশের খোঁচা খোঁচা দাঁড়িতে হাত বুলিয়েই ফিক করে হাসছে সে। তার হাসি দেখে আয়াশও হেসে উঠছেন। কি সুন্দর বাবা-মেয়ের মূহুর্ত! আচ্ছা আমাকেও বুঝি আমার বাবা এভাবেই নিয়ে ঘুরে বেরিয়েছেন?
আমাকে দেখে নজর ফিরিয়ে নিলেন আয়াশ। মুখ থেকে হাসি বিলিন হলো উনার। চোখমুখে ফুটে উঠল গাম্ভীর্যতা। আমার পাশ কাটিয়ে নিচে নেমে গেলেন উনি আদ্রিতাকে নিয়ে। পেছন থেকে হুট করে দ্রুত নেমে আসতেই আমার মাথার সঙ্গে অহনার মাথায় ঢিপ লাগল।

চোখমুখ জড়িয়ে মাথায় হাত দিয়ে পেছনে তাকালাম। অহনা জ্বিহ্বা তে কামড় দিয়ে বলল….
–“সরি সরি। দেখতে পাইনি।”
–“মাঝে মাঝে কি মনে হয় জানো? তুমিও একজনের মতো চোখজোড়া ওপরে নিয়ে চলো।”
রাগ মিশ্রিত গলায় বললাম আমি। অহনা কিছু না বুঝে মাথা চুলকিয়ে জিজ্ঞেস করল….
–“সব ঠিক আছে। আসলে আমি অতিরিক্ত এক্সাইটমেন্টে খেয়াল করিনি। কিন্তু আমার মতো আবার কে গো?”
–“কে আবার? আমার একমাত্র হাজবেন্ড। তার মনে হয় স্মৃতির সঙ্গে বুদ্ধিও লোপ পেয়েছে। তাই উদ্ভট ব্যবহার করে আমাকে অস্বস্তিতে ফেলছে।”
অহনা আয়াশের কথা শুনে তেতিয়ে বলে উঠল…..
–“একদম ওই লোকটার সঙ্গে আমার তুলনা করবে না। আমাকে শুধু রাগায়।”

–“শুধু তোমাকে নয় গো উনি সবাইকেই রাগাতে বেশ দক্ষ।”
কথাটা বলে নিচে চলে এসে দাঁড়ালাম। পেছনে আকাশ ভাইয়াও হাসতে হাসতে এসে দাঁড়াল আমার থেকে বেশ খানিকটা দূরে। আয়াশ আদ্রিতার হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছেন। মাঝে মাঝে আঁড়চোখে আমাকে দেখে চোখ নামিয়ে ফেলছেন। রিক রায়জাদা আস্তে আস্তে গিয়ে রোশনের মুখের ওপর থেকে কাপড়টা সরিয়ে দিল। সঙ্গে সঙ্গে চোখ বন্ধ করে ফেলল সবাই। আদ্রিতা ভয় পেয়ে কান্না শুরু করে দিল।

আয়াশ আদ্রিতাকে কোলে তুলে নিয়ে জড়িয়ে ধরেন। আদ্রিতা শব্দ করে কাঁদছে। তাছাড়া সবাই চোখ খিঁচে দাঁড়িয়ে আছে। মাহতাব রায়জাদা ঢক গিলে বলেন…..
–“এতো নৃশংস অবস্থা কে করেছে বলো তো মারহাব ভাই? তাকানো যাচ্ছে না তো।”
এরই মাঝে হানা দেয় পুলিশ। পেছন পেছন ঘটে মিডিয়ার উপদ্রব। পুলিশ লোকজন দিয়ে মিডিয়ার লোকজনের আটকানোর চেষ্টা মগ্ন। পুলিশ অফিসার রোশন রায়জাদার বডির দিকে ভালোভাবে তাকালেন। এতো চেঁচামেচি শুনে ঘর থেকে বেরিয়ে এলো সেঁজুতি মা। সামনে রোশনের নৃশংস অবস্থা দেখে চমকে উঠলো সে। আমার দিকে তাকিয়ে ইশারায় জিজ্ঞেস করার চেষ্টা করল। আমি তাকে চোখ টিপে চুপ করতে বললাম। সেঁজুতি মা চুপ হয়ে সবটা দেখতে লাগল।

মারহাব রায়জাদা হা-হুতাশ করছেন। রিক রায়জাদা হাত মুঠো করে কঠোর দৃষ্টিতে ফ্লোরে তাকিয়ে আছে। সবাইকে চমকে দিয়ে সে বলে ওঠে….
–“আমি জানি এই কাজটা কে করেছে!”
সবাই চমকে উঠল। আমি ভ্রু কুঁচকে তাকালাম। তারপর নিজে থেকে বললাম….
–“যেই করুক না কেন! নিশ্চয় কোনো কোনো পাপের কারণেই এতো নৃশংস ভাবে মৃত্যু হয়েছে উনার। পাপই পাপীকে বিনাশ করে।”
ঝড়ের গতিতে এসে আমার গলা টিপে ধরলো রিক রায়জাদা। নিশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। গলার রগে টান পড়ছে। অগ্নি দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি এই পশুটার দিকে। দাঁতে দাঁত চেপে সে বলে উঠল….
–“তুই ই করেছিস সবটা। আমি জানি। তুই মায়াবিনী রেজওয়ান নয়। তুই আনিশা। তুই মেরেছিস ওকে।”

পুলিশ এই অবস্থা দেখে তড়িঘড়ি করে বলে উঠলেন….
–“ছাড়ুন উনাকে। এভাবে আমাদের সামনে আপনি কাউকে আঘাত করতে পারেন না।”
কথাটা পুলিশ অফিসার বললেন ঠিকই। কিন্তু আটকানোর চেষ্টা করলেন না। মূহুর্তের মধ্যে আমার নিশ্বাস যখন আঁটকে এলো। ছটফট করতে নিলাম। তখন আকাশ ভাইয়া আর আয়াশ দুজনেই এগিয়ে এলেন। আয়াশ সরাসরি রিক কে ধাক্কা মেরে ফেলে দিলেন। উনার চোখজোড়াও রক্তবর্ণে পরিণত হয়েছে। বড় বড় নিশ্বাস ফেলছেন বারে বারে। আমি ছাড়া পেয়ে পিছিয়ে গেলাম। অহনা আমাকে ধরল। আয়াশ ক্ষ্যান্ত হলেন না। রিক কে টেনে তুলে ওর কলার চেপে ধরে বলে উঠলেন…..
–“আর একবারও যদি ওর দিকে হাত বাড়াস তোর এই হাত তোর শরীর থেকে আলাদা হয়ে যাবে।”

কলার ছেড়ে জোরেসোরে থাপ্পড় মেরে বসলেন আয়াশ। বিকট শব্দ হয়ে ওঠে। তবুও উসখুস করছেন উনি। আবারও মারতে উদ্যত হলেন। আমি এবার দ্রুত পায়ে এগিয়ে গিয়ে উনার হাত ধরে বসলাম। শান্ত হয়ে পড়লেন উনি। ঘাড় ঘুড়িয়ে আমার দিকে তাকালেন। আমি মাথা নাড়িয়ে উনাকে থামতে বললাম। উনি স্থির হয়ে আমার হাতে দিকে তাকালেন যেই হাত দিয়ে উনার হাত আঁকড়ে ধরেছি। ছেড়ে দিলাম হাত। উনি বড় নিশ্বাস ফেললেন।

আমি রিক রায়জাদার দিকে তাকিয়ে স্বাভাবিক ভাবেই বললাম…
–“সবাইকে নিজের মতো ভাবতে যাবেন না মি. রায়জাদা। আমি যদি এই রোশন রায়জাদাকে মেরেও থাকি তাহলে তার কারণ খুঁজে বের করুন। তারপর না হয় আমাকে শ্বাসরোধ করে মারতে আসবেন।”
পরিবেশ শান্ত হয়। আরো কিছু কথাবার্তা চলে পুলিশের সঙ্গে রায়জাদা পরিবারের। আমি আদ্রিতাকে নিয়ে ওপরে চলে আসি।

বিকেল হয়ে এসেছে। আকাশের মাঝে রঙের মেলা লেগেছে। বাড়ির পেছনের বাগানে থাকা চেয়ারে ঠেস লাগিয়ে ওপরের দিকে তাকিয়ে আছি আমি। মাঝে মাঝে জুসের মগে একটু করে চুমুক লাগাচ্ছি। মনের মধ্যে হাজারো ভাবনা চিন্তা। এই ভাবনার ভীর অতিক্রম করে কেউ আমার হাতে থাকা মগ ছোঁ মেরে নিয়ে আমার পাশের চেয়ারে বসে পড়ল। দৃষ্টি আকাশ থেকে নিচে নাড়াতেই আয়াশ নামক ব্যক্তিটার চেহারা ভেসে উঠল। উনি আমার মগটা মুখে লাগিয়ে ঢকঢক করে জুস পান করতে শুরু করলেন। হা হয়ে গেলাম আমি। আশ্চর্য হয়ে বললাম….
–“ওটাতে আমি মুখ লাগিয়েছিলাম।”
উনি মগ থেকে ঠোঁট সরিয়ে বাঁকা হেসে বললেন….
–“ওহ রিয়েলি? তাই তো বলি, জুস একটু স্বাভাবিকের চেয়ে বেশিই মিষ্টি।”

বিরক্ত হয়ে চেয়ে রইলাম। তারপর আশপাশটা পর্যবেক্ষণ করে নিলাম। কাউকে না দেখতে পেয়ে আয়াশের দিকে তাকালাম। উনি মগটা বেতের টেবিলে রেখে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলেন।
–“রোশনকে খুন তো তুমিই করেছো। এম আই রাইট?”
চোখজোড়া কপালে উঠে গেল। কিছুক্ষণ চুপ থেকে ধীর গলায় বললাম….
–“আমি কেন খুন করতে যাব? এনি রিজন?”
–“আমি জানি না। কারণটা তোমার থেকে বেশি ভালো করে কেউই বলতে পারবে না। পুলিশ কিন্তু ওই হোটেলের রুমে রোশনের রক্ত ছাড়া অন্য কারোর রক্ত পেয়েছে সুইটহার্ট!”
হাতটা জোড়ে চেপে ধরলাম চেয়ারে। ঢক গিলতেই আমার বাম হাতের দিকে তাকালেন উনি। ভ্রু উঁচিয়ে বললেন….
–“আর তোমার হাতটাতে আঘাত লেগে অনেকটা রক্ত বেরিয়েছিল। ওই হাত দিয়েই এমন কিছু করেছো যেটাতে রক্ত ফ্লোরে পড়েছে।”

নিজের হাতের দিকে তাকিয়ে মনে করার চেষ্টা করলাম আমি রাতের ঘটনা। হ্যাঁ, রাতের বেলা রোশনকে বাঁধতে গিয়ে আমার বাম হাতে অনেকটা চাপ পড়েছে। রক্তও বেরিয়েছে। এবার কোনোরকম কথা ঘুরানোর চেষ্টা না করে বলে উঠলাম….
–“হ্যাঁ মেরেছি আমি। ওকে মেরেছি আমি। তো?”
–“নাথিং। দ্যাটস লাইক এ গুড গার্ল। সত্যি কথাটাই শুনতে চাইছিলাম। নাথিং মোর। পরেরবার এমন কাজ করলে সাবধানে করার চেষ্টা করবে।”
আমি কিছু বললাম না। অনেকক্ষণ নিস্তব্ধতা বিদ্যমান থাকল। কিছু বলার জন্য উসখুস করে চলেছি আমি। গলা থেকে আওয়াজ বেরই হচ্ছে না। আয়াশকে অন্য রকম লাগছে দেখতে। কেন তা অজানা।

সাহস জুগিয়ে দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে বললাম…..
–“আপনি আমার কথাগুলোতে অনেক কষ্ট পেয়েছেন তাই না আয়াশ?”
আয়াশ জবাবটা অনেকক্ষণ পর দিলেন। উঠে দাঁড়িয়ে শুকনো হেসে বললেন….
–“হয়ত পেয়েছি। হয়ত অতীতকে আবার চাওয়া আমার ভুল হয়ে গিয়েছিল। আমাকে মানুষ কিছু দিলে প্রতিদানে আমিও কিছু দিই জানো তো? তাই আমিও ভেবে ফেলেছি তুমি আমাকে কষ্ট দিয়েছো তার বদলে তুমিও তা রিটার্ন পাবে।”
আয়াশের কথা বুঝতে কিছুক্ষণ সময় লাগল। অতঃপর আমিও দাঁড়িয়ে গেলাম। উনি আমাকে ভুল বুঝছেন। আমি চাই না এই ভুল বুঝাবুঝির পর্ব বেশিক্ষণ চলুক। আমি কিছু বলতে নিলেই হাত উঁচু করে থামিয়ে দেন উনি।

আমাকে টেনে ধরে উনি নিজের সঙ্গে মিশিয়ে ঘাড় কাঁত করে বাঁকা হাসেন। আমি বোকা বনে যাই। আমার চোখেমুখে ফুঁ দিয়ে উনি বলেন….
–“খুব ভয় পেয়েছো? তোমাকে ভয় পেতে দেখতে ভালো লাগে না নিশাপাখি।”
উৎসুক দৃষ্টিতে তাকালাম।
–“আপনি আমাকে ভুল বোঝেন নি তো?”
আয়াশের হাসি আরো প্রশস্ত হতে থাকে। আমার কপাল থেকে চুল সরিয়ে মাথার পেছনে হাত দিয়ে আমার কপালে দৃঢ় চুমু খেলেন উনি। চোখ বড় বড় করে পাকালাম। শীতল কন্ঠে বললেন….
–“নিজের ওপর থেকে বিশ্বাস যদি কোনোদিন উঠেও যায়। তোমার ওপর থেকে আমার বিশ্বাস উঠবে না। আর তোমাকে কষ্ট দেওয়ার কথা আমি কখনো ভাবতেও পারি না। কোনোদিন তোমাকে সজ্ঞানে আঘাত বা কষ্ট দেয়নি যেই মানুষ সে এখন কি করে কষ্ট দেবে তোমায়? তার সাধ্যি নেই নিশাপাখি।”

আমি মনের ভেতরে উথাল-পাতাল ঢেউ খেললো। চোখ বন্ধ করে উঁচু হয়ে উনার কপালে চুমু দিয়ে চোখ খুললাম আমি। আমার নাক টেনে দিলেন আয়াশ। আমি মাথা ঝাঁকাতেই উনি বলে উঠলেন….
–“আমাকে পাগল বানানোর প্লানিং করো না নিশাপাখি।”
আমি হেঁসে উনাকে জাপ্টে ধরলাম। বুকে মাথা রাখলাম। কত বছর পর এই শান্তিপ্রিয় স্থানে মাথা রাখতে পারছি। আজ খুশির দিন। এই মানুষটাকে পাওয়ার জন্য ডুকরে ডুকরে কেঁদেছি বার বার। সেটাকে কি এই মানুষ জানে?
আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে শান্ত ভঙ্গিতে উনি বলে উঠলেন….
–“আমার সব মনে পড়ে গেছে।”
বুক থেকে মাথা তুলে তাকালাম আমি। উনার চোখমুখের রঙ হঠাৎই বদলে গেল। ফুঁসে উঠে বললেন….

–“কালকে রাতে মা-বাবা আর আমার বোনকে মারার দৃশ্যটা ভেসে উঠেছিল। মাথায় অনেক চাপ দিয়ে ফেলেছিলাম। সকালে সব মনে পড়ে যায়। আমি তো ভাবতেও পারছি না যাদেরকে আমি দুই চোখে সহ্য করতে পারতাম না তাদের সঙ্গে একই ছাঁদের তলায় বসবাস করছি। আর তোমার ওপর নিরাশ হয়েছিলাম আমি। ভেবেছিলাম তুমি কি করে পারছো অন্য কারোর সঙ্গে বসবাস করতে?”
–“তারপর কি করে হলো আপনার ভুল ধারণা দূর?”
আয়াশ অন্যদিকে তাকিয়ে আনমনে বললেন….
–“হয়নি দূর। ওইযে বলছি না? তুমি আমার এতোটাই গাঢ় নেশা যাকে না পেলে উম্মাদ লাগে। সেই প্রথম দিন থেকে আমাকে নিজের এই ভয়ানক দৃষ্টি আর হাসি দিয়ে খুন করে চলেছো তুমি। তোমার প্রত্যেকটা কদম আমার বুকের হৃৎস্পন্দনকে জাগিয়ে তোলে নিশাপাখি। তাই দূরে থাকতে পারিনি তোমার থেকে। চলে এলাম।”

চলবে…..🍂🍂
বি.দ্র. ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।
চলবে…..🍂🍂
বি.দ্র. ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here