ভিনদেশী পর্ব ৪৫+৪৬

#ভিনদেশী
#আদ্রিয়ানা নীলা
#পার্ট ঃ৪৫

রজনী মানে নিস্তব্ধ ও আঁধারে ঢাকা আকাশ। আর এই রজনীর গভীরতা যত বাড়তে থাকে চারপাশের পরিবেশ ততই হয়ে ওঠতে থাকে নির্জন, থমথমে,শান্ত। কিন্তু সিয়াটলে দেখা যাচ্ছে ভিন্ন চিত্র। রাত্রের থমথমে নিস্তব্ধ পরিবেশের পরিবর্তে দেখা যাচ্ছে নানারকম আলোয় সজ্জিত রাস্তা,গাড়ির হর্ন এর শব্দ। রাত হলেই এখানের বিচিত্র রকমের আলোয় ভরে ওঠে৷ হয়তো এই খানে রাতের আধারের জায়গা নেই। হঠাৎ মসজিদ থেকে শোনা গেলো আজানের সুরেলা কন্ঠ। চারপাশের আকাশ বাতাসে ছড়িয়ে গেলো আজানের মধুর সেই ধ্বনি।
জ্যাক রাস্তা কীনারা দিয়ে হাঁটছিল।হঠাৎ শুনতে পেলো এশার আজান দিচ্ছে। সে দ্রুত পায়ে সিয়াটলের স্হানীয় একটা মসজিদে ঢুকল। উদ্দেশ্য নামাজ আদায় করবে, আল্লাহর কাছে শ্রুতির জন্য প্রার্থনা করবে।
জ্যাক নিজের জুতা খুলে মসজিদ প্রবেশ করল।মসজিদের ভিতরের চারদিকে নিজের চক্ষু বুলালো। সাদা মার্বেল পাথরে মুড়ানো পুরো মসজিদ।ভিতরে তেমন কোনো মানুষ নেই। অল্প কয়েকজন আছে। জ্যাক একপাশে গিয়ে বসল।কীভাবে কী করতে হয় কিছুই জানে না সে? ধীরে ধীরে লোক লোকারণ্যে ভরে গেলো। জ্যাক দেখলো সবাই মসজিদের ভিতরে চোখ, নাক, মুখ, হাত ধুয়ে আসছে। জ্যাক একজনকে অনুসরণ করে ওযু করে মসজিদের ভিতর প্রবেশ করলো। প্রবেশ করে দেখলো সবাই সারিতে দাড়িয়ে প্রার্থনা করছে ,সবার সামনে একজন ইমাম দাড়ানো৷ জ্যাক ভাবলো, হয়তো তাকেই ফলো করে সকলে প্রার্থনা করছে৷ সবার মাথায় টুপি পড়া । জ্যাক ভাবলো, তার কাছে তো টুপি নেই। সে কী করবে? পরক্ষণেই মাথায় বুদ্ধি আসলো৷ নিজের পকেটে থাকা রুমালটা বের করে সুন্দর করে মাথায় পেচিয়ে নিল। অতঃপর এক কোনায় গিয়ে একজন নামাজির পিছনে দাড়ালো কিবলামুখী হয়ে। সামনে থাকা নামাজিকে দেখলো, বিরবির করে কী কী যেনো পড়ছে? জ্যাক বুঝলো না কী পড়ছে? সে চুপচাপ দাড়িয়ে থাকলো। তারপর দেখলো লোকটি নিজের দুটো হাত কান বরাবর উপরের দিকে প্রায় সোজা করেছে। জ্যাক ও ওরকম করলো। তারপর দেখলো লোকটা দুহাত নাভীর সামান্য নিচে পেটে সাথে চেপে ধরে কী জানো বিরবির করছে। জ্যাক ও নিজের হাত ও ভাবে রাখলো৷ এখাবে একে একে লোকটাকে অনুকরণ রুকু, সিজদা দিলো।সিজদা করতে গিয়ে একটু সমস্যা হলো। বুড়ো আঙ্গুলটা মুড়ে থাকতে চাচ্ছে না। বার বার মুড়ে দিতে হচ্ছে। সর্বশেষ সালাম ফিরিয়ে লোকটি চলে গেলো। জ্যাকও সালাম ফিরালো।তখন অনেকেই মসজিদ থেকে বের হচ্ছে। জ্যাক ভাবলো হয়তো প্রার্থনা করা শেষ।
জ্যাক বসে রইলো। শ্রুতির জন্য দোয়া করবে। নিজের চোখ দুটো বন্ধ করে বললো,

–গড,আমার শ্রুতিকে ঠিক করে দেও। ওর যেনো কিছু না হয়। ওর যেন তাড়াতাড়ি জ্ঞান ফেরে। কোনো ক্ষতি যেনো না হয়।তুমি শ্রুতিকে ঠিক করে দিলে আমরা দুজন একসাথে এসে তোমার কাছে প্রে করব। প্লিজ প্লিজ প্লিজ।

অতঃপর জ্যাক ধীরে ধীরে উঠে নিজের জুতা পড়ল।জুতা পড়ে মসজিদের একপাশে দাড়িয়ে নিজের মাথা থেকে রুমালটা খুলে ঠিক ভাবে আবার পকেটে পুড়ে নিলো। চারপাশে একবার দেখে নিলো। সব নামাজিরা ধীরে ধীরে বের হচ্ছে৷হঠাত্ জ্যাকের চোখ আঁটকে গেলো। হতবাক হয়ে তাকিয়ে থাকলো সেই দিকে৷ মনে মনে ভাবলো,

–এটা তো ড্যাড এর গাড়ি৷ এই মসকোতে কী করছে ড্যাড?

জ্যাক ধীরে ধীরে গাড়িটার দিকে এগিয়ে গেলো। মিস্টার উইলিয়াম তখন গাড়িতে উঠবেন এইসময় জ্যাককে দেখে বিস্মিত হয়ে গেলেন। উনি জিজ্ঞেস করলেন,

–জ্যাক তুমি এইখানে কী করছো?

জ্যাক নির্দিধায় উত্তর দিলো,

–ড্যাড প্রার্থনা করতে এসেছিলাম, বাট তুমি কী করছো?

মিস্টার উইলিয়াম ঘামতে শুরু করলেন। কী উত্তর দিবেন ছেলেকে?পরক্ষণেই ভাবলেন, এখন তো কোনো ঝামেলা নেই । তাহলে তো জ্যাককে বলাই যায়৷ তিনি আমতা আমতা করতে করতে বললেন,

–আমিও প্রার্থনাই করতে এসেছিলাম।

জ্যাক একটু ভাবুক হয়ে ভাবতে লাগলো৷ মনের ভিতর প্রশ্নের জট পাকছে৷ সে আনমনেই বলল,

–আমি তো এসেছিলাম শ্রুতির জন্য গড এর কাছে প্রে করতে, যেনো সে তাড়াতাড়ি ঠিক হয়ে যায়।শ্রুতির গড শ্রুতির কথা শুনবে। কিন্তু তুমি কার জন্য এসেছো?

মিস্টার উইলিয়াম জ্যাকের ঘাড়ে হাত রেখে বললেন,

–মাই ডিয়ার সান, আমার ধর্ম এইটা। তাই আমাদের এইখানেই তো প্রার্থনা করতে হবে?

জ্যাক বিস্মিত হয়ে উচ্চস্বরে বলল,

–মানে? আমরা তো ক্রিশ্চিয়ান।

মিস্টার উইলিয়াম হালকা হেসে বললেন,

–আস্তে আস্তে৷ বাসায় চলো সব বলছি।

বলেই তিনি গাড়ির ডোর খুললেন।
জ্যাকের মুখটা মলিন হয়ে গেলো। সে থমথমে গলায় বললো,

–না ড্যাড আমি বাসায় যেতে পারবো না। আমাকে হাসপাতালে যেতে হবে।

মিস্টার উইলিয়াম ভ্রু কুঁচকে বললেন,

–হাসপাতালে কেন? কিছু হয়েছে কারো?

–হুম, শ্রুতি অনেক সিক। এখনও জ্ঞান ফেরেনি। তাই যেতে হবে৷

–শ্রুতি কে?তোমার গার্লফ্রেন্ড যে মেয়েটা, সে নাকি ?

–হুম

মিস্টার উইলিয়াম হালকা চমকে উঠলেন।

–কী হয়েছে ওর?

জ্যাক নিজের ঘড়িটা দেখে হালকা তাড়া দিয়ে বললো,

–অনেক বড়ো ঘটনা ড্যাড। বাসায় এসে বলবো৷ এখন তাড়াতাড়ি হাসপাতালে যেতে হবে৷

বলেই সে তাড়াহুড়ো করে মসজিদ থেকে বের হয়ে গেলো।

_______

হাসপাতালে এসে দেখলো শ্রুতির কেবিনের সামনে লুসি, আরিচ বসে আছে। আর কেউ নেই। জ্যাক ওদের দিকে একপলক তাকিয়ে কেবিনের ভিতর ঢুকলো। শ্রুতির এখনও জ্ঞান ফেরেনি। কেবিনের ভিতর তখন একজন নার্স ছিলো । তিনি স্যালাইন ভরাচ্ছিলেন। জ্যাক বেরিয়ে এলো কেবিন থেকে। লুসি আর আরিচের পাশে গিয়ে বসে বললো,

–এলিশা আর লিও কী চলে গেছে?

আরিচ বললো,

–হুম, আমরা দুজন কে পাঠিয়ে দিছি। যেতে চাচ্ছিলো না। এলিশার মা টেনশন করছিলো৷ তাই লিও ওকে বাসায় ড্রপ করে ও নিজের বাসায় যাবে৷

–ওহ! তোমরাও যেতে পারো।আজকের রাতে আমি এখানে থাকবো। আমি দেখা শোনা করবো৷

লুসি না করে বলল,

–না,আমি যাবো না জ্যাক৷ কোনো কিছুর দরকার হলে লাগতে পারে৷

জ্যাক আস্বস্ত করে বলল,

–লুসি তোমার বাসায় যাওয়া দরকার। তোমার মম কিছু জানে না । টেনশন করছেন। আর রাত হচ্ছে তুমি যাও আরিচের সাথে আমি এখানে আছি তো সব সামলে নিবো৷

লুসি যেতে চাচ্ছিলো না। জ্যাক অনেক্ষণ জোড়াজুড়ি করে দু জনকেই পাঠিয়ে দিলো৷

ওরা যাওয়ার পরই জ্যাক কেবিনে ঢুকলো। অনেকক্ষণ
শ্রুতির পাশে বসে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো । তারপর কখন যে চোখ লেগে এলো বুঝতেই পারলো না।

________

সকালে জ্যাকের কোনো কিছুর ঝনঝন শব্দে ঘুম ভেঙ্গে গেলো৷ পাশে তাকিয়ে দেখে শ্রুতি পানি পান করার জন্য ছটফট করছে। কিন্তু পানির গ্লাসটা নিচে পড়ে ভেঙ্গে গেছে। জ্যাক দ্রুত আর একটা গ্লাস এনে বোতল থেকে পানি ঢেলে এক হাত দিয়ে শ্রুতির মাথাটা হালকা উঠিয়ে মুখের সামনে গ্লাসটা ধরল। শ্রুতি ধীরে ধীরে পানি টুকু খেয়ে নিল। জ্যাক গ্লাসটা পুনরায় টেবিলের উপরে রেখে অস্হির হয়ে বললো,

–শ্রুতি তুমি এখন ঠিক আছো? আরও পানি খাবে?

শ্রুতি মাথা নাড়িয়ে না বললো।
জ্যাক পুনরায় অস্হির হয়ে বলল,
–কখন জ্ঞান ফিরেছে তোমার?পানি খেতে চাও আমাকে বললেই তো হতো?নিজে নিয়ে খেতে হবে নাকি?

শ্রুতি উঠে বসার চেষ্টা করলো। জ্যাক হেল্প করলো। বালিশটা পিছনে দিয়ে হেলান দিয়ে বসিয়ে দিলো। শ্রুতি কোনো মতে বললো,

–একটু আগে জ্ঞান ফিরেছে। খুব পানির পিপাসা লেগেছিল। পাশে চেয়ে দেখি তুমি ঘুমাচ্ছো। তাই আর না ডেকে পানির গ্লাসটা নেয়ার চেষ্টা করি। কিন্তু উলটো ভেঙ্গে যায়।
জ্যাক খানিকটা ধমকের সহিত বললো,

–আমি ঘুমিয়ে আছি বলে জাগাও নি। ভারি অন্যায় করেছো।এরকম সবার কথা ভাবো বলেই দেখেছো আজ তোমার কী অবস্হা!

শ্রুতি একদৃষ্টিতে জ্যাকের দিকে তাকিয়ে থাকলো। দুইদিনে ছেলেটার কী অবস্হা হয়েছে!একের উদ্ভ্রান্তের মতো লাগছে!

জ্যাক শ্রুতির মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে হেসে বললো ,

–আমি অনেক খুশি শ্রুতি।তোমার গড আমার কথা শুনেছে। তুমি জ্ঞান ফিরেছে৷

শ্রুতি থেমে থেমে বলল,

–আমার গড মানে?
জ্যাক আলতো হাসলো। খানিকটা লাজুক হয়ে বলল,

— কালকে আমি মসকোতে গিয়েছিলাম। তোমার জন্য তোমার গডের কাছে প্রে করতে৷

শ্রুতি জ্যাকের কথা শুনে হালকা হাসলো। নিজের বন্ড ইচ্ছা করলো জ্যাকের গালে হাত রাখার।জ্যাক গাল দুটো ফুলে উঠেছো লজ্জায় লাল হয়ে গেছে,ঠিক মেয়েদের মতো। নিজের ইচ্ছা দমন করতে না পেরে ধীরে ধীরে হাতটা উঠানোর চেষ্টা করলো কিন্তু পারলো না। ব্যথা করছে হাতটা।

কিছুক্ষণ নীরবতায় কেটে গেলো। জ্যাক বললো,

–শ্রুতি তোমাকে কীভাবে কিডন্যাপ করেছে? মনে আছে কিছু?

শ্রুতি মৃদু কন্ঠে বলল,

–আমার প্রাইভেট সেন্টার থেকে বের হয়ে একটু মার্কেটের দিকে গিয়েছিলাম। খালামনি কিছু বাজার নিতে বলেছিলো৷ শপ থেকে যখন বের হয়েছি তখন হালকা অন্ধকার হয়ে গিয়েছিলো। রাস্তার মানুষের আনাগোনা একটু কম ছিলো। রাস্তার একপাশে দাড়িয়ে গাড়ির জন্য অপেক্ষা করছিলাম। তখন একটা ব্লাক কার এসে সামনে দাড়ালো৷ কয়েকজন লোক বের হয়ে আমার মুখ চেপে ধরে জোরজবোধস্তি করে গাড়িতে উঠালো৷ আমি নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করতে লাগলাম কিন্তু পারলাম না। গাড়িতে উঠিয়ে মুখে কিছু স্প্রে করে দিলো। আমি জ্ঞান হারালাম। আর কিছুই মনে নেই৷

শ্রুতি কথা শুনে জ্যাক কিছু বলতে নেবে তার আগেই কেবিনের দরজা খুলার শব্দ পেলো। জ্যাক ঘাড় ঘুড়িয়ে তাকালো। ডাক্তার এসেছেন সাথে নার্সও । জ্যাক উঠে দাড়ালো।
ডাক্তার এসে শ্রুতিকে দেখে বললো,

–পেসেন্টের অবস্হা তো মোটামুটি ভালোই। ভেবেছিলাম ড্রাগস এর সাইড ইফেক্ট পড়বে। বাট পড়েনি।

জ্যাক আলতো হাসলো।

তিনি আবার বললেন,

–এখন ওর একটু রেস্টের প্রয়োজন। আমি ঘুমের ইনজেকশন দিয়ে যাচ্ছি।ডিস্টার্ব করবেন না।
#ভিনদেশী
#আদ্রিয়ানা নীলা
#পার্ট ঃ৪৬

সময় ও স্রোত কারো জন্য অপেক্ষা করে না। নদীর প্রবাহের মতো সেটি গতিশীল৷ দেখতে দেখতে কেটে গেল তিনটে বছর শ্রুতি স্বপ্নের দেশ আমেরিকায়। কীভাবে কেটে গেলো সে নিজেও জানে না? এখানে জীবনের প্রতিটা মুহূর্ত উপভোগ করেছে।এক মুহূর্ত মন খারাপ করার অবকাশ পায়নি৷ প্রত্যেক সপ্তাহের ছুটির দিনে কমপক্ষে একটি জায়গায় ঘুরেছে।ছন্নছড়া হয়ে ঘুরেছে জ্যাকের সাথে। এই তিনটা বছর সিয়াটল শহর, ওয়াশিংটন, নায়াগ্রা ফলস, নিউইয়র্ক, টাইমস স্কয়ার, হোয়াইট হাউজ, ম্যানহ্যাটান, স্ট্যাচু অফ লিবার্টি আরও অনেক দর্শনীয় জায়গা যা বলেও শেষ হবে না ।ফলে মন খারাপ থাকলেও এইসব জায়গায় গেলে মুহূর্তই প্রকৃতির সৌন্দর্যে হারিয়ে অভিমান, অভিযোগ, মনোমালিন্য কোথায় চলে যেতো! আর এই ভিনদেশে শ্রুতির সব চেয়ে কাছের মানুষ ছিলো জ্যাক আর লুসি৷ লুসি সবসময় না থাকলেও জ্যাক ছিলো সর্বদা৷ ভালোবাসার মানুষের সাথে এমন সব জায়গায় গিয়ে সময় কাটানোর মুহূর্তটা সত্যিই জীবনের সবচেয়ে অমূল্য উপহার।
তুমি যখন কারো ভালোবাসায় পরবে, তখন তোমার কাছে বাস্তবতা স্বপ্নের চেয়েও মধুর মনে হবে।

শ্রুতির কাছেও ঠিক তেমনি লেগেছে৷ জীবনের স্মৃতির পাতায় দিনগুলো স্মরণীয় হয়ে থাকবে।
সময় যেমন প্রবহমান মানুষের জীবনও তেমনি প্রবহমান। সব কিছুর সাথে মানিয়ে নিতে হয় না চাইলেও। অনেক কিছুই বদলেছে এই তিন বছরে। চারপাশের পরিবেশ, মানুষ, শ্রুতি নিজেও। ক্লেভ আর জেসিকার ঘটনা শ্রুতি জেনেছে। তাদের শাস্তি স্বরুপ ৫বছর জেল হবে।

শ্রুতির চেহারাও আগের চেয়ে পাল্টে গেছে। মাঝে মাঝে শ্রুতি নিজেকে দেখে নিজেই বলে, শ্রুতি তুই আগের চেয়েও সুন্দরী হয়েছিস।সাবাস! বলে একা একাই হাসে। এই তিন বছর অনেক সুনাম কুরিয়েছি এই ভিনদেশী ভার্সিটিতে তার বাইরে। বিভিন্ন মার্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে ইন্টার হিসেবে কাজ করেছে। ভার্সিটিতে হওয়া বছরভিত্তিক পরীক্ষা গুলোর ফলাফল ছিলোও প্রসংশনীয়। শ্রুতির ইচ্ছা পড়ালেখা শেষ করে নিজেই এই আমেরিকায় বিজনেস শুরু করবে।নিজে পরিশ্রম করে পৃথিবীর বুকে সুনাম অর্জন করতে চায়৷

তবে শ্রুতির কাছে মনে হয় সব কিছুর থেকে জ্যাকই বেশি বদলে গেছে। নিজের বাবার বিজনেস সামলাচ্ছে।শ্রুতি প্রথম দেখা জ্যাক আর এই জ্যাকের ভিতর আকাশ-পতাল তফাত্৷ চেহারাও তেমন মিল নেই অনেক পাল্টে গিয়েছে৷সদ্য যৌবনে পা দেয়া এক কিশোর৷ অনেক ম্যাচুরিটি এসেছে চেহারায়, চলা ফেলায়৷ আগের মতো হাসে না কথায় না।গম্ভীর থাকে অধিকাংশ সময়। তবুও তার সৌন্দর্য কমেনি আরও দ্বিগুণ বেড়েছে। তবে শ্রুতির কাছে আগের জ্যাকেই বেশি ভালো লাগলো। এখনকার জ্যাক শুধু কথায় কথায় বকে, এটা করবে না তো এটা করবে না, এটা ধরবে না, তো ওটা ধরবে না। সবকিছুতে খবরদারি। আগের জ্যাকটাকে বেশি মিস করে। তবে সেটা সৌন্দর্যের কথা, ভালোবাসা কখনো কমেনি জ্যাকের প্রতি, দিন দিন বাড়ছে৷ জ্যাকের করা কেয়ার গুলো শ্রুতিকে প্রতিনিয়ত আরও দুর্বল করছে।

এইসব ভাবতে ভাবতে শ্রুতি নিজেই হাসলো। কাচের জানালাকে হালকা একটু ফাক করে দেখতে লাগলো শ্বেত শুভ্র এয়ারপোর্ট টা। তুষারে ভরা চারপাশ। হবেই না কেন? কাল রাতেই তো স্নো ফলস হয়েছিল৷ একটা কথা তো বলাই হয়নি। আজ তিন বছর পর শ্রুতি বাংলাদেশে যাচ্ছে৷ সে শুধু একা না লুসি, তার মম, জ্যাক, তার মম। এতো জন যাওয়ার কারণ আছে অবশ্য। শ্রুতির বোন সোহার বিয়ে ১৫দিন পর।সেই উপলক্ষে। আর জ্যাকের মম যাচ্ছে শ্রুতি আর জ্যাকের বিয়েটা পাকাপাকি করতে।শ্রুতির বাড়ির সবাই তাদের সম্পর্কের কথা জেনেছে। দ্বিমত করেনি কেউ। বাট শ্রুতির বাবা সর্বদাই মেয়েদের পড়াশোনা সম্পর্কে সিরিয়াস। পড়াশোনা শেষ না করে মেয়ের বিয়ে দিবে না বলেছেন।

শ্রুতি জানালার ফাঁক দিয়ে তুষারপাতে ঢাকা এয়ারপোর্ট টা দেখছিলো।প্লেন আর একটু পরই টেক ওফ করবে৷ এমন সময় পাশে বসে থাকা জ্যাক ধমকের সহিত বলল,

–শ্রুতি জানালা খুলেছো কেন? বন্ধ করো। ঠান্ডা লাগবে তোমার।

শ্রুতি এক পলক জ্যাকের দিকে তাকিয়ে বলল,

–থাকুক না। কিছু হবে না।

–No.

বলেই জ্যাক নিজেই জানালা বন্ধ করে দিলো। শ্রুতি মুখ ফুলিয়ে বসে রইল।ওই আগের জ্যাকটাই ভালো ছিল৷ এই জ্যাকটা খারাপ৷

–শ্রুতি কফি খাবে?

শ্রুতি অন্যদিকে ঘুরে বলল,

–না।

জ্যাক বুঝেছে শ্রুতি রাগ করেছে৷ শ্রুতির কানের কাছে ফিসফিস করে বলল,

–তো চুমু খাবে?

জ্যাকের কথা শুনে শ্রুতি বিস্ফোরিত নয়নে তাকালো। জ্যাকের কোনো হোলদোল নেই।বিপরীতে তার মুখে ঝুলছে দুষ্টু হাসি৷ শ্রুতি লজ্জায় মাথা নিচু করে রইল।

প্লেন টেক অফ করেছে ২ঘন্টা হলো। শ্রুতি এতক্ষণ চুপচাপ বসে ছিল। কিন্তু শ্রুতির চোখে এখন তন্দ্রা ভাব চলে এসেছে। জ্যাকের দিকে তাকালো। সে একটা ম্যাগাজিন পড়ছে। শ্রুতি জ্যাকের কাঁধে মাথাটা এলিয়ে দিলো আর এক হাত দিয়ে কোমর জড়িয়ে ধরল৷

জ্যাক বইটা পাশে রেখে শ্রুতির মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকলো। মৃদু কন্ঠে বলল,

–শরীর খারাপ লাগছে?

–না,ঘুমাবো।

জ্যাক শ্রুতির মাথাটা দুহাত দিয়ে বুকে আগলে নিলো। শ্রুতিও কিছুই বললো না। বাস্তবতার কথা চিন্তা করলো না। শ্রুতির আরাম লাগছে৷ চারদিকটা উষ্ণতায় ভরে আছে। নিদ্রায় তলিয়ে গেল শ্রুতি।

হালকা ঝাঁকুনিতে শ্রুতির ঘুম ভাঙ্গলো। ধীরে ধীরে চোখ খুলে তাকালো। প্রথমেই নজর পড়ল জ্যাকের থুতনি। খোঁচা খোঁচা দাড়ি। অল্প অল্প করে মাথা তুলে দেখলো জ্যাক তাকে জড়িয়ে ধরে নিজের সিটে মাথা এলিয়ে হা করে ঘুমোচ্ছে৷ শ্রুতি হাসলো জ্যাকের অবস্হা দেখে।জ্যাকের গালটা টেনে বলল,

–কত্তো কিউট লাগছে! এটা আমার বর হবে। আমার কাছেই অবিশ্বাস্য লাগে।

শ্রুতি জ্যাক কাছ থেকে সরে আসলো৷ বেশি নড়াচড়া করলে আবার ঘুম ভেঙ্গে যাবে। শ্রুতি মাথা একটু উপরে তুলে আশেপাশের পরিবেশ টাকে দেখলো৷ প্লেনে সবাই প্রায় ঘুমোচ্ছে।কিছুসংখ্যক মানুষ জেগে আছে।অবশ্য ঘুমানোরই কথা, কারণ এখন রাত। শ্রুতি কী মনে করে সোহার দিকে তাকালো৷ শ্রুতির কয়েকসিট সামনেই তাদের সিট। নিজের মম এর সাথে বসেছে।সোহা শ্রুতিকে দেখতেই হাসলো৷প্রতিউত্তরে শ্রুতিও হাসলো।
নিজের সিটে বসল শ্রুতি।আবার নিজের সিটে মাথা এলিয়ে দিয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করলো। কিছুক্ষণ এপাশ ওপাশ করলো। ঘুম আসছে না। হাতে থাকা ঘড়িটির দিকে তাকালো। ভোর ৪টা বাজে। দুবাই থেকে সোজা বাংলাদেশ।ঘুম যেহেতু আসছে না শ্রুতি সময়গুলো নষ্ট না করে নিজের ব্যাগ থেকে সক্রেটিসের জবানবন্দি বইটি বের করে তার ভিতরে ডুব দিলো৷

সকাল ৮.৩০। বাংলাদেশেও তখন শীতকাল। হালকা ঠান্ডা অনূভুত হচ্ছে। তবে সূর্যের মিষ্টি আলো চারপাশে আভা ছড়াচ্ছে। এয়ারপোর্ট থেকে একে একে সবাই নিজের ব্যাগপত্র নিয়ে বের হলো।
এয়ারপোর্ট থেকে বের হতেই শ্রুতি নিজের বাবা -মা, বোনকে দেখতে পেলো৷ শ্রুতি অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল৷চোখের কোণে পানি জমলো। কতদিন পর দেখছে। এক দৌড়ে গিয়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরল নিজের বাবাকে।
শ্রুতি থেমে থেমে বললো,

–Dad, I miss you so much.

শ্রুতি বাবা নিজের মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,

–আমিও আমার মামনিটাকে অনেক মিস করেছি।

শ্রুতির মা পাশ থেকে অভিমানী কন্ঠে বললেন,

–দেখেছো, তোমার মেয়ে আমাকে ভুলেই গেছে?শুধু নিজের বাপকেই ভালোবাসে। আমাকে আর ভালোবাসে না।

শ্রুতি নিজের মায়ের কথা শুনে হাসলো।নিজের চোখের পানি টুকু মুছে বাবা কাছ থেকে সরে মায়ের কাছে গেলো। নিজের মায়ের গাল দুটো টেনে বলল,

–কে বলেছে? আমি আমার মাকেও অনেক ভালোবাসি।
একটু থেমে ব্যঙ্গ করে বলল, তবে বাবার চেয়ে কম।

শ্রুতি মা হেসে দিলেন। এতোদিন পর মেয়েকে দেখে নিজের চোখের অশ্রুকণা জমেছে৷ শ্রুতি নিজের হাতদিয়ে মুছে দিলো। শ্রুতিও হাসলো৷ সোহার পাশেই ছিলো।সোহা শ্রুতিকে জড়িয়ে ধরে বলল,

–কেমন আছিস রে বোন?

–তোমাদের ছাড়া কী ভালো থাকতে পারি হুম?

–আপু মিথ্যা বলছে। ও অনেক ভালো ছিলো৷ তোমাদের কথা তো মনেই ছিলো না। ওতো ওর বয়ফ্রেন্ডকে নিয়ে বিজি ছিলো। আমিই মনে করে দিতাম।

পাশ থেকে লুসি বলে উঠলো। শ্রুতি লুসির দিকে চোখ গরম করে তাকালো। বাবা -মার সামনে সম্মানের ফালুদা করে দিলো। শ্রুতিকে এরকম তাকাতে দেখে লুসি দাত কেলিয়ে হাসলো।
অতঃপর লুসি, তার মা শ্রুতির বাবা মার সাথে কুশলবিময় করলো৷
শ্রুতির বাবা এদিক ওদিক তাকাতে লাগলেন। জিজ্ঞেস করলেন,

–বেয়াইন,জামাই বাবাজি কোথায়? তারা কী আসে নি শ্রুতি?

শ্রুতি মনেই ছিলো না জ্যাক ও তার মায়ের কথা। বাবা,মার কাছে এসে একমুহূর্ত ভুলেই গেছি৷ শ্রুতি এদিক এদিক তাকাতে লাগলো। দূরেই চোখ পড়ল,
জ্যাক আসছে। হাত দুটো ট্রলি ব্যাগ। গায়ে নেভি ব্লু কালার একটা বিলিতি কোর্তা ।হাটার সাথে সাথে সেটি এদিক ওদিক দুলছে। দূর থেকে কতো হ্যান্ডসাম লাগছে। পাশে তার মম।শ্রুতি হাত দিয়ে দেখিয়ে দিলো,জ্যাক ও তার মমকে। সোহা গালে হাত অবাক হওয়ার ভান করে বলে উঠল,

–বাবাহ, শ্রুতির হবু জামাই কতো হ্যান্ডসাম!

লুসি হেসে বলল,

–নজর দিও না আপু৷ শ্রুতি তোমাকে আস্ত রাখবে না।

বারবার লজ্জায় পড়তে হচ্ছে লুসির কথায় শ্রুতির।
অবশেষে জ্যাক, তার মা এসে শ্রুতির বাবা মার সাথে কুশল বিনিময় করে গাড়িতে চড়ল। বাসার উদ্দেশ্যে।

চলবে…..

[ছোট হওয়ার জন্য দুঃখিত৷ আর একটা পর্ব আছে তাহলেই গল্পটা শেষ। ]
চলবে……..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here