ভ্রম_নাকি_তুমি পর্ব ৩

#ভ্রম_নাকি_তুমি!(৩য় পর্ব)
লেখাঃ Md. Nazmul Huda

পায়ের সাথে কিছু একটায় বিঁধে আয়ান উপুড় হয়ে পড়ে গেল। হাতে ভর দিয়ে উঠতে যাবে তখন অনুভব করলো হাতের নিচে কিছু আছে। তরল থকথকে কিছু একটা। জমাট বাঁধা রক্তের মতো। লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়ালো। পকেট থেকে ফোন বের করে ফ্ল্যাশ অন করেই চমকে উঠলো। ফ্লোরে বেশ খানিকটা জায়গা জুড়ে রক্ত পড়ে আছে। ফোনের ফ্ল্যাশ জ্বালিয়ে তাড়াতাড়ি গিয়ে রুমের লাইট অন করলো।

“রুমে এতখানি রক্ত কোথা থেকে এলো?” নিজের মনেই বলে উঠলো আয়ান। “অবনীকা? অবনীকা কোথায় গেলো? ওর কিছু হয়নি তো?” অবনীকা, কোথায় আপনি??”

আয়ান অবনীকা কে খুঁজতে লাগলো। রুমের মধ্যে সব জায়গায় খুঁজলো কিন্তু কোথাও পেল না। বারান্দায় গিয়ে দেখে অবনীকা এক কোণে বসে আছে। হাটুর ওপর মাথাটা দিয়ে দুইহাত দিয়ে কান চেপে রেখেছে। দেখে মনে হচ্ছে অনেকটা ভয় পেয়ে আছে। ডান হাতের কনুই এর খানিকটা ওপরে অনেক খানি কেটে গেছে। কনুই বেয়ে রক্ত পড়ছে। ফ্লোরেও কিছুটা রক্ত জমা হয়ে আছে। আয়ান গিয়ে অবনীকা কে ধরলো। অবনীকা ওর দিকে না তাকিয়েই বলতে শুরু করলো “ছেড়ে দাও আমাকে প্লিজ। আমি কিছু করিনি। আমাকে ছেড়ে দাও।”

আয়ান কিছুটা দুশ্চিন্তায় পড়ে গেল। অবনীকা এরকম আচরণ করছে কেন? এত ভয় পেয়ে আছে। আয়ান অবনীকা কে ধরে একটা ঝাঁকি দিলো,

– আমি আয়ান। কি হয়েছে আপনার? এরকম অদ্ভুত আচরণ করছেন কেন?

– একটা মেয়ে আছে এখানে। ও আমাকে মারতে চায়।

আয়ান কে জড়িয়ে ধরে কথাগুলো বললো অবনীকা। ভয়ে কেঁদে ফেলেছে। গলা কাঁপছে ওর।

“কিচ্ছু হবে না আপনার। আমি আছি তো। উঠুন, আমার সাথে ঘরে চলুন।”

অবনীকাকে ধরে ঘরে নিয়ে গেল আয়ান। অবনীকা এখনো কাঁপছে। আয়ান অবনীকার হাতে ব্যান্ডেজ বাঁধতে বাঁধতে বললো,

– কি হয়েছে আমাকে খুলে বলুন তো একটু। পড়ে গেলেন কি করে? আর এতখানি কাটলো কি করে??

– আমি পড়ে যাইনি। আমার ঘরে কেউ একজন এসেছিলো।

– কে এসেছিলো?

– জানিনা। আমি ওকে দেখিনি। তবে ও একটা মেয়ে ছিলো।

– দেখেন নি তাহলে কি করে বলছেন ও মেয়ে ছিলো?

– নূপুর এর আওয়াজ পেয়েছিলাম। আমি দরজা লক করে ফেসবুকিং করছিলাম। হঠাৎ করে ঘরের লাইট বন্ধ হয়ে যায়। তখন খেয়াল করলাম নূপুর পায়ে কেউ একজন জোরে জোরে হেটে আসছে আমার দিকে। আমি জিজ্ঞেস করলাম কে? কিন্তু কোন উত্তর দিলো না। আমি বিছানা থেকে নেমে লাইট অন করতে যাচ্ছিলাম তখনই সে আমাকে কি দিয়ে যেন আঘাত করে। আমি চিৎকার করতে গেলে আমার গলা টিপে ধরে। আমি অজ্ঞান হয়ে যাই।

– তাহলে আপনি বারান্দায় কি করে গেলেন?

– জানিনা, চোখ খুলে বুঝতে পারছিলাম না আমি কোথায় আছি। ওঠার সাহস হয়নি। বসা অবস্থাতেই সরতে সরতে দেখলাম দেয়ালের সাথে পিঠ ঠেকে গেছে। ওখানেই বসে রইলাম।

– আপনি কাউকে ডাকতে পারতেন তো।

– আমি খুব ভয় পেয়ে গেছিলাম। আমার মনে হয়েছে আমি শব্দ করলেই ও চলে আসবে আর আমাকে মেরে ফেলবে।

– আচ্ছা।

– আমার মনে হয় আপনার বাসায় কোন অশরীরী আছে যে আমাকে মেরে ফেলতে চায়।

– ওসব আপনার মনের ভুল। ভূত বলে কিছুই হয়না আগেই বলেছি। আর তাছাড়া আপনাকে মেরে ফেলতে চাইলে তো মেরেই ফেলতো। বাঁচিয়ে রাখলো কেন? আপনি হয়ত পড়ে গেছিলেন। আর অতিরিক্ত হরর শো দেখার জন্য আপনার হ্যালুসিনেশান হচ্ছে।

– আপনি আমার কথা বিশ্বাস কেন করছেন না? সত্যিই কেউ ছিলো। ও আমার গলা টিপে ধরেছিলো অনেক জোরে।

আয়ান কোন কথা বললো না। অবনীকার দিকে তাকিয়ে দেখলো ওর গলায় কয়েকটা আঙুলের ছাপ। তার মানে অবনীকা সত্যি বলছে। কিন্তু অবনীকা কে খুন করতে চাইবে কে? যদি কেউ চেয়েই থাকে তাহলে তো এখনই মেরে ফেলতে পারতো। কিন্তু প্রশ্ন হলো অবনীকার ঘরের দরজা ভেতর থেকে লক ছিলো। সুতরাং বাইরে থেকে ওর ঘরে ঢোকার কোন উপায়ই নেই। জানালা থেকে বারান্দা দিয়েও কেউ আসতে পারবে না। তাহলে কিভাবে কেউ অবনীকার ওপর আক্রমন করতে পারে? হয়তো অবনীকার ভুল হচ্ছে। হয়তো গলায় কিছু বিঁধে গিয়েছিলো যেটা ছাড়ানোর চেস্টা করেছিলো আর তখন ওর নিজের হাতের আঙুলের ছাপ পড়েছে গলায়। আয়ান আর কোন কথা বলে নি। অবনীকাও আর কথা বাড়ালো না। কিছুক্ষণ পরে আয়ান নিচে গিয়ে খাবার নিয়ে আসলো অবনীকার জন্য। তারপর নিজ হাতে খাইয়ে দিলো আর নিজেও খেয়ে নিলো।

পরদিন সন্ধ্যাবেলা। আয়ান এখনো বাসায় ফেরে নি। অবনীকার শাশুড়ি রাতের খাবার রান্না করার জন্য রান্নাঘরর গেল। কিছুক্ষণ পরে অবনীকাও সেখানে গেলো। অবনীকাকে কি একটা বলতে গিয়ে ওর শাশুড়ী একেবারে পিলে চমকে গেলো। অবনীকা একমনে কাজ করে যাচ্ছে। কিন্তু ওর মুখটা একদম অবনীর মতো লাগছে। এমনিতেই অবনীর সাথে অনেকটা মিল রয়েছে। কিন্তু আজ যেন পুরোটা মিল। মনে হচ্ছে যেন অবনী দাঁড়িয়ে আছে। অবনী যেদিন মারা যায় সেদিন অবনী যেরকম শাড়ি পরে ছিলো অবনীকা আজ সেরকম একটা শাড়ি পরে আছে। পার্থক্য শুধু সেই শাড়িটা একটু বেশি গাঢ় নীল ছিলো, এটা একটু হালকা। অবনীর মতো চোখে গাঢ় কাজল, কপালে শাড়ির সাথে ম্যাচিং করা টিপ আর ম্যাচিং গয়না। সব কিছু যেন অবনীর মতো। এমনিতে অবনীকা কাজল আর টিপ পরে না। গয়নাও খুব সামান্য। তাহলে আজ এরকম ভাবে অবনীর মতো সেজেছে কেন?? অবনিকার এরকম সাজ দেখে ওর শাশুড়ির সেদিনের কথা মনে পড়ে গেলো।

২ বছর আগের সেদিন টায় ও ঠিক এভাবে অবনী আর ওর শাশুড়ী সন্ধ্যাবেলায় সবার জন্য ডিনার রেডি করেছিলো। আয়ান তখন দুদিনের জন্য বিজনেস এর কাজে শহরের বাইরে গিয়েছিলো। সেদিন রাতেই ওর ফেরার কথা ছিলো। অবনী সব কাজ শেষ করে নিজের ঘরে চলে যায়। প্রায় ঘন্টাখানিক পরেই অবনীর চিৎকার শুনে ওর ঘরে যায় ওর শাশুড়ী। কিন্তু গিয়ে যা দেখে তাতে তার শরীরের রক্ত হিম হয়ে যায়।

হঠাৎ অবনীকার কথায় বাস্তবে ফিরলো মিরা রহমান। অবনীকা মোমবাতি হাতে তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। চারদিকে অন্ধকার। অবনীকার চোখদুটো রক্তবর্ণ ধারণ করেছে। চুলগুলো বাতাসে উড়ছে। কেমন ভয়ংকর দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছে মিরা রহমান এর দিকে। অবনীকার এরকম রূপ দেখে কয়েকবার ঢোক গিললেন তিনি। অবনীকা থমথমে গলায় বললো “আপনাকে যদি ইট দিয়ে থেতলে থেতলে মেরে ফেলি তাহলে কেমন হবে মা? খুব মজা হবে, তাই না?” মিরা রহমান ভয়ে যেন জমে গেলেন। নড়ার শক্তি টুকুও পাচ্ছেন না। কেবল ভয়ার্ত চোখে অবনীকা কে দেখছে। অবনীকার মুখের এক পাশ দিয়ে রক্ত গড়িয়ে পড়লো। শাশুড়ির আরেকটু সামনে এগিয়ে বিশ্রী ভাবে হেসে দিলো। মোমের অল্প আলোতে তিনি দেখতে পেলেন অবনীকার মুখের ভেতর রক্তে মাখামাখি। আর সহ্য করতে পারলেন না। অজ্ঞান হয়ে মেঝেতে পড়ে গেলেন।

প্রান দু’ঘন্টা পরে জ্ঞান ফিরে অবনীকাকে পাশে দেখেই চিৎকার দিয়ে দূরে সরে গেলেন মিরা রহমান। পাশে আয়ান, আয়ান এর বাবা আর ছোট ভাই বসে আছে। মিরা রহমান এর এরকম অদ্ভুত আচরণ দেখে কিছুটা ঘাবড়ে গেল অবনীকা। বাকি সবাই ও অবাক হয়ে গেছে। হঠাৎ এরকম করছে কেন? আর অবনীকা কে দেখে এতটা ভয় বা কেন পাচ্ছে? আর কিসব বলছে? অবনীর আত্মা, ভূত এসব কি বলে যাচ্ছে আয়ান এর মাথায় ঢুকলো না। এই যুগে এসেও মানুষ এসব বিশ্বাস করে?? আয়ান বুঝতে পারছে না ওর মা আর অবনীকা দুজনেই কেন ভূতের কথা বলছে। কই অন্য কেউ তো কোন কিছু দেখতে বা শুনতে পাচ্ছে না। আয়ান কিছুটা বিরক্তি নিয়ে নিজের ঘরে চলে গেল। পেছনে পেছনে অবনীকাও আসলো।

– আপনি কি সত্যি ই বিশ্বাস করছেন না?

– কি বিশ্বাস করবো হ্যাঁ? বিশ্বাস করার মতো কিছু কি হয়েছে??

– দেখুন সেদিন আমি আপনাকে বলেছিলাম এ বাড়িতে নিশ্চয়ই কিছু না কিছু আছে। আজ তো মা ও বলছেন যে তিনি ভূত দেখেছেন। কিন্তু আমি এটা বুঝতে পারছি না উনি আমাকে কেন ভয় পাচ্ছেন আর আমার দিকে আঙুল তুলছেন। আমি তো কাজ শেষ করে নিজের রুমে চলে গিয়েছিলাম৷ কিছুক্ষণ পরে কিচেনে গিয়েছিলাম রুমে পানি আনার জন্য। তখন দেখলাম মা ওখানে পড়ে আছে। তারপর আমি ওনাকে তার ঘরে নিয়ে যাই। কিছুই বুঝতে পারছি না। তবে এটুকু বুঝতে পারছি যে কিছু অদ্ভুত ব্যাপার ঘটছে, যেগুলো মোটেও স্বাভাবিক নয়।

– দেখুন আমি আগেও বলেছি, এখন আবার ও বলছি, এসব আপনাদের মনের ভুল। এসব ভুলভাল জিনিস দেখা বন্ধ করুন। যদি সত্যিই এরকম কিছু হতো তাহলে আমি, বাবা, কিংবা রিয়ান আমরা কেউ না কেউ কিছু অন্তত ফিল করতাম।

অবনীকা আর কথা না বাড়িয়ে শুয়ে পড়লো। আয়ান কে বুঝিয়ে লাভ নেই। ও মানবে না কখনোই।

পরদিন সকাল পেরিয়ে দুপুর হয়ে গেছে প্রায়। আয়ান একটা মানসিক হাসপাতালের ভেতর গিয়ে একটা কেবিনে ঢুকলো। বিছানায় একজন মহিলা ঘুমিয়ে আছে। আয়ান গিয়ে কিছুক্ষন তার পাশে বসলো। তার মাথায় একবার হাত বুলিয়ে দিয়ে বাইরে এসে ডক্টর এর সাথে কথা বললো।

– পেশেন্ট এর কি অবস্থা ডক্টর?

– আগের থেকে অনেকটাই ভালো। আশা করি খুব শীঘ্রই উনি সম্পূর্ণ ভাবে সুস্থ্য হয়ে যাবেন।

– প্লিজ ডক্টর যে করেই হোক ওনাকে সুস্থ করে দিন।

– আল্লাহ ভরসা, সুস্থ করা কেবল আল্লাহ এর হাতে। আপনি দোয়া করুন, আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করছি।

ডক্টর এর সাথে কথা বলে আয়ান বের হয়ে অফিসে চলে গেল…..

[

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here