ভ্রান্তির অগোচরে পর্ব ১৩

#ভ্রান্তির_অগোচরে
পার্ট ১৩
লেখা আশিকা জামান

অন্ধকারে নিজের অস্ত্বিত্বকে খুঁজে বেড়ানোর মাঝে এক অন্যরকম অনুভুতি কাজ করে। যার হদিস সবাই সবসময় পায়না। অন্ধকার হাতড়ে নিজের অস্তিত্ব যখন ধোঁয়াশায় আচ্ছন্ন তখন এই রিপোর্টটাই হয়তোবা ক্ষীন আশার আলোকবার্তা ছড়িয়ে দিয়ে গেলো।ওর এখনো বিশ্বাস হচ্ছেনা ও কনসিভ করেছে। অলমোস্ট আঠারো সপ্তাহের ফিটাস ওর মধ্যে আস্তে আস্তে বেড়ে উঠেছে হাউ!
রিপোর্টটা হাতে পাওয়ার পর যতোটানা খুশি হয়েছে তারচেয়ে বেশী চিন্তাগ্রস্ত হয়েছে। ওর কি সবুজকে জানানো উচিৎ? নাহ্ ওই হাতিটাকে জানানোর প্রশ্নই আসেনা। পেটে বাচ্চা দিয়ে ফুড়ুৎ করে যে ছেলে ঢ্যাং ঢ্যাং করে বিদেশ যেতে পারে অন্তত তার বাবা হওয়ার কোন যোগ্যতই নাই। হৃদয়পটে অভিমানী ভাবনাগুলো বেশীক্ষণ স্থায়ী হয়না। বালুকণার ন্যায় দমকা হাওয়ার তান্ডবে ক্ষয়ে ক্ষয়ে পড়তে থাকে। এই মুহুর্তে ওর সবুজকে খুব দরকার। বিলম্ব না করে সবুজকে ফোন করে যায় মিম। কিন্তু বরাবরের মতো ফোনটা রিজেক্ট করে সবুজ। একসময় মিম ক্ষান্ত হয় সবুজের ফোনটা সুইচড অফ থাকায়। অনিচ্ছাসত্ত্বেও মুখ ফুটে অমোঘ বানীর ন্যায় কথাটা বেরিয়ে আসে,
” আজকের দিনটার জন্য একদিন তুমি অনেক পস্তাবে। সেদিন মিমকে উপেক্ষা করার মাসুল তোমাকে বড় কঠিনভাবেই না দিতে হয়।”

এরকম কথা মুখে এনে মিম নিজেই স্তব্ধ হয়ে যায়। দুচোখের বন্যায় অবিরাম ভাসতে থাকে।
কোনকিছু বোঝার আগেই রুমে আলো জ্বলে উঠে। চোখ মুখ কুচকিয়ে পিছন ফিরে তাকাতেই অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবে মেঘের মুখ দেখে ও বিচলিত হয়ে পড়ে। এতোদিন পর বদমাশটা আবার কেন এলো। কিছুটা ঘাবড়ে যায় ও।
অস্ফুট স্বরে বলে উঠে,
” তুমি আমার পারমিশন ছাড়া আমার বেডরুমে কি করছো?”

মেঘ কেমন রহস্যঘেরা হাসি দিয়ে মিমের দিকে তাকায়।
” ওহ, সিরিয়াসলি তোর ঘরের সামনে তো এইটাইপের কোন লিখা দেখলাম না। তুই এক কাজ কর তুই বরং লিখে দে বিনা অনুমতিতে প্রবেশ নিষেধ। ”
আবার হো হো করে হাসতে লাগল মেঘ।

” তোমার লজ্জা করছেনা এইভাবে আমার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে।”

” নারে, লজ্জাটা আমার একটু কমই। তাছাড়া লজ্জাতো তোর পাওয়ার কথা। লজ্জা নারীর ভুষন। শুনিসনি কথাটা।”

” বের হও, আমি একা থাকতে চাই প্লিজ।”

” আচ্ছা তুই একা থাকতে চাইলেই আমি কেন বোকার মত তোর কথা শুনতে যাবো।”

মেঘের চোখেমুখে এক অজানা রহস্য ঘোরাফেরা করছে। এই মুহুর্তে মেঘকে ওর বড় অচেনা মনে হচ্ছে।
পূর্বের মেঘের সাথে এই মেঘের কোন সাদৃশ্য আপাতত ও খুঁজে পাচ্ছেনা। যেহেতু মেঘ ঘর থেকে বের হবেনা সেহেতু ওর ই চলে যাওয়া উচিৎ। মিম যাওয়ার জন্য পা বাড়ালেই মেঘ বেশ শক্ত হাতেই ওর পথ আটকায়।

” হাত ছাড়ো। কি অসভ্যতা হচ্ছে?”
মিম দাতমুখ খিঁচে মেঘের দিকে তাকায়।

” অসভ্যতা! হুয়াট’স অসভ্যতা?
ওটা আর পারলাম কই!
আর কতো অপেক্ষা করবো বল তর যে আর সইছেনা।”

মিম ঘেন্নায় নাকমুখ ছিটকাতে লাগলো।
” আজকে যদি আমার স্বামী এখানে থাকতো, তুমি কি আমাকে এইভাবে অপমান করতে পারতে?”

“স্বামী! কাম’অন মিম, এইসব তোকে মানায় না। প্লিজ এখন অন্তত আর স্বামী স্বামী বলিস না। আই থিংক সবুজ আর ফিরবে না। এইবার নিজেকে নিয়া ভাব। লাইফটাকে এনজয় করতে শিখ। আর তোরা বিডির মেয়েরা পারিসও এইসব স্বামী সংসার নিয়ে যাচ্ছেতাই রকমের ন্যাকামো করতে। ”
মিমের ধৈর্য্যের বাধণ আলগা হতে থাকে। কষিয়ে মেঘের গালে থাপ্পড় বসিয়ে ফের মেঘের দিকে তাকায়।

” আমার লাইফটাকে নিয়ে ছিনিমিনি খেলতে তোমার একটুও বাধলো না। কি ভেবেছো কি? আমার থেকে সবুজকে দূরে সরিয়ে দিয়ে তোমার উদ্দেশ্য সফল করে নিবে? লিসেন, এটা জীবনেও সম্ভব না। আমি সবুজকে ভালোবাসি আর বাকী জীবন ওরই থাকবো।”

মেঘ থাপ্পড়টা বেশ শান্ত ভাবেই হজম করে নিলো। কিন্তু ভেতরে হিংস্রপশুর মত ফুলে ফেঁপে উঠতে লাগলো।দুই দুইটা থাপ্পড় এর উসুল যে এবার অন্যভাবেই নিতে হয়।

” তাই নাকি।দ্যাট’স লাইক এ্যা গুড গার্ল। তুই কেমন আমার উদ্দেশ্যটা বুঝে গেলি। লাভ ইউ রে। এবার একটু কাছে আয়।
তোর খুব কাছে যাওয়ার জন্য মনটা বড্ড আকুপাকু করছিলোরে তাই চলে এলাম।”
মেঘ মিমকে জোড় করে কোলে তুলে নেয়। মিমের নিজের হাত পা ছুড়ে বারবার মেঘকে বাধা দিতে থাকে। ভয়ে আর ঘৃনার ওর মরে যেতে ইচ্ছে করে। এরকম হুট করে এসে হিংস্রপশুর মতো ওর ঘরে হামলা দিতে একটুও মেঘের বাধছেনা। মিম সর্বশক্তি দিয়ে মেঘকে বাধা দিতে গিয়ে একসময় ক্লান্ত হয়ে পড়ে। মনের জোড় হারিয়ে একসময় নিজেকে অসহায় হিসেবে আবিষ্কার করে। কেউ নেই ওকে বাচানোর মত? ওর একেকটা চিৎকার কারো কানেই বোধ হয় পৌছুবে না। ওর সব শেষ হয়ে যাবে? এর আগে ওর মরণ হওয়া উচিৎ।
মেঘ মিমকে বিছানায় বেশ জোড়েসোড়েই ফেলে দেয়। অনেক উঁচু থেকে উপড় হয়ে বিছানায় পড়ায় পেটে প্রচণ্ড চাপ অনুভুত হয়। ব্যাথায় কেকিয়ে উঠে।

” মেঘ, আমার পেটের বাচ্চার কথাটা ভেবে তুই আমায় ছেড়ে দে। আল্লাহর দোয়াই লাগে, তুই আমার সাথে কিছু করিস না।”

হিতাহিতজ্ঞানশুন্য ক্রোধে অগ্নিশর্মা হয়ে মেঘ মিমের উপড় ঝাপিয়ে পড়ে।
ঠিক তখনি সজোরে দরজায় কিল আর ঘুষির শব্দ শোনা যায়। মেঘ চমকে উঠে মিমের থেকে নিজেকে সরিয়ে নেয়। মিম ছাড়া পেয়ে বিছানা থেকে লাফ দিয়ে নেমে পড়ে। ঘটনার আকস্মিকতায় মেঘ বুঝে উঠতে পারনা এই মুহুর্তে কি করা উচিৎ?
কতক্ষণ ভাবলেশহীনভাবে তাকিয়ে থাকা ছাড়া অন্য কিছু বোধ হয় ভুলে। ঘর্মগ্রন্থি বাধ ভাঙ্গা নিঃসরণে ব্যাতিব্যাস্ত হয়ে পড়লো। চোখেমুখে উৎকন্ঠার ছাপ স্পষ্ট।
ততক্ষণে সুযোগ পেয়ে মিম দরজা খোলে ফেলে।
হুড়মুড়িয়ে শিউলি চৌধুরী ঘরে ঢুকে। ইদানীং উনার মনে হচ্ছে মিমের সাথে বোধ হয় বড্ড কঠিন আচরণই করে ফেলছেন। এতোটা রুঢ হয়তোবা না হলেও পারতো। মেয়েটা দিনকে দিন না খেয়ে দেয়ে শরীরের যে হাল করেছে স্বভালসুলভভাবে যার দৃষ্টিতে পড়বে তারই মায়া পড়ে যাবে। ছেলেটা বাড়ীতে না থাকায় না চাইতেও মন মেজাজ কেমন জানি খারাপ হয়ে যায়। ভালো কথাও শ্রুতিহীন মনে হয়। আর কোন এক অদ্ভুত কারণে মিমকে দেখে আর নিজেকে কনট্রোল করতে পারেনা। অন্তত মেয়েটার কথাওতো ভাবা উচিৎ। তাই সমস্ত দ্বিধা পিছু ফেলে কয়েকটা শান্তির কথা বলতেই এ ঘরে আসা।
” এতোক্ষন লাগে, দরজা খুলতে। রুমে কি করছিলি?”
কথাটা বলতে বলতেই রুমে ঢুকে।
হঠাৎ করেই মিমের ভয়ে সিটিয়ে যাওয়া মুখটায় দৃষ্টিপড়ে যায়।
চোখের কোণে নোনা জল চিকচিক করে উঠতে লাগলো।।যেকোন সময় যে বাধ ভাঙা জোয়ার নামতে পারে তারই পূর্বাভাস।
ওর ভয় আর উৎকন্ঠার কারণ খুজতে শিউলি ঘরের এদিক সেদিক তাকাতেই এলোমেলো বিছানা আর তার ঠিক ডানপাশে উদ্ভান্তের মতো মেঘকে দেখে ঈষৎ চমকে উঠলো। সমস্ত হিসেবনিকেষে গোলমেল বেধে গেলো। কোন কারণ খুঁজে অনাকাঙ্ক্ষিত কোন কিছু জানার আগ্রহ সাথে সামনে পা চলার শক্তিটুকুও হারিয়ে ফেললেন।
” মা, তুমি এসেছ। মেঘ আমার সর্বনাশ করতে যাচ্ছিলো… ”
মিম এটুকু বলেই হাউমাউ করে কান্না জুড়ে দিতে লাগল।
ঠিক তখনি মেঘ পাক্কা খেলোয়াড়ের মতো চাল চেলে দিলো।
” মিম, মিথ্যা বলে আর কতোদিন সম্পর্কটাকে লুকিয়ে রাখবো বলো। একদিনতো সত্যিটাকে সামনে আসতেই হতো।”

” কোন সত্যি? একদম নাটক করবিনা হারামী। মা ও এখন নাটক করতে চাইছে। বিশাস করোনা ওর কথা।”

” খালা, আমি আর মিম দুজন দুজনকে ভালোবাসি। সবুজ ভাই এই সম্পর্কের কথা জেনেই বিদেশে চলে গেছে। একচুয়ালি মিম আর সবুজ ভাইয়ের মাঝে কোন দাম্পত্য সম্পর্ক ছিলোনা। খেলনা বাটির বিয়ে ছাড়া এই বিয়ের কোন মানেই নেই।”
মেঘ আরো কিছু বলতে যাচ্ছিলো তার আগেই শিউলি চৌধুরী চোখে ঝাপসা দেখতে থাকে। চোখের সামনে সব পরিষ্কার হতে কুয়াশার চাদর সরে আস্তে আস্তে। মুহুর্তেই সেন্সলেস হয়ে পড়ে। এতোটা মানসিক চাপ কুলানো সম্ভবপর নয়।

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here