ভয়ংকর সে পর্ব -১৪+১৫+১৬+১৭

#ভয়ংকর_সে #পর্ব_১৪
#M_Sonali

“আজ তোর কী হয়েছে বলতো চাঁদনী বুড়ি। সেই সকালে ঘুম থেকে উঠছিস থেকে দেখছি, ঠিক ভাবে খাচ্ছিস না কোনো কথা বলছিস না। সারাক্ষণ মুখটা গোমড়া করে চুপচাপ বসে আছিস। বলছি জামাইয়ের কথা বড্ড মনে পড়ছে বুঝি তোর?”

জানালার ধারে বসে আকাশের দিকে তাকিয়ে ছিল চাঁদনী। চারিদিকে সবেমাত্র বিকেল পেরিয়ে সন্ধ্যা নামতে শুরু করেছে। সেইসাথে চাঁদনীর মনের আকাশটায় অন্ধকার হয়ে আসছে। তখনই পাশে থেকে দাদির এই কথায় চমকে যায় সে। আকাশের দিক থেকে চোখ সরিয়ে তার দাদির দিকে তাকায়। এবার উনি আর একটু কাছে এগিয়ে আসেন। পাশে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন,

“দেখ চাঁদনী বুড়ি আমি তোর কষ্ট বুঝতে পারছি। নতুন নতুন বিয়ে হয়েছে তোর। আর জামাই এভাবে তোকে রেখে গিয়ে আর কোন খবর নিচ্ছে না। তোর কষ্ট লাগাটাই স্বাভাবিক। আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। তোদের মাঝে আসলে কি হয়েছে বলতো? জামাইয়ের কোন ঠিকানা জানিনা। ফোন নাম্বারটাও নেই যে একটু ফোন করে কথা বলবো। জিজ্ঞেস করবো কিছু।”

এতোটুকু বলতেই ওনাকে থামিয়ে দিয়ে চাঁদনী উঠে দাঁড়াল। জানালাটা লাগিয়ে দিয়ে আবারো তার পাশে এসে বসে বললো,

“ওসব নিয়ে চিন্তা করো না দাদী। ওনার সাথে আমার কিছু হয়নি। আমি সেজন্য মন খারাপ করে বসে নেই। ওনার সময় হলে উনি ঠিক আসবেন। আসলে আজকে কেন জানিনা কিছু ভালো লাগছেনা। আচ্ছা তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করতে চেয়েছিলাম। আজকে কি আমাবস্যা?”

ওর কথার উত্তরে ওর দাদী রত্না বেগম একটু নড়েচড়ে বসল। নিজের ডান পা হালকা করে টিপতে টিপতে বলে উঠল,

“হ্যা রে আজ তো ভাদ্রমাসের ঘোর আমাবস্যা। তাইতো আমার পা দুটো কেমন ম্যাচম্যাচ করছে সকাল থেকে। জানিস তো প্রতি আমাবস্যার রাতেই আমার হাত পা ব্যথা করে।”

উনার কথার উত্তরে ভ্রু কুচকালো চাঁদনী। অবাক হয়ে বলল,

“আমাবস্যা রাতের সাথে তোমার শরীর ব্যথা হওয়ার কি সম্পর্ক দাদি? আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।”

“সে তুই বুঝবি না। আসলে কি বলতো আমাবস্যার রাত টা সবাই ভয়ংকর রাত বলে জানে। এই রাতে যত খারাপ কাজ যত খারাপ জিনিসের চলাফেরা শুরু হয় বাইরে। তাইতো আমাবস্যার রাতে একা বাইরে বের হওয়া নিষেধ। কারণ এই সময় যত খারাপ জিনিস আছে সবকিছু বাইরে ঘুরে বেড়ায়। আর মানুষের ক্ষতি করে। তুই কিন্তু সকাল সকাল দরজা জানালা ভালো করে লাগিয়ে দিয়ে ঘুমাবি বুঝলি। ছোট বেলায় এই রাতটাকে নিয়ে কত গল্প শুনেছি।”

“আমাকে একটু বলো না দাদী। আমিও এই রাত সম্পর্কে জানতে চাই।”

“দেখ আমি আগেই বলেছি আমার হাত পা ম্যাচম্যাচ করছে। আমি এখন রুমে যাই। আর এসব গল্প আজ রাতে বলা ঠিক হবে না। অন্য কখনো সময় করে বলবো।”

কথাটি বলেই ওকে রেখে রুম থেকে বেরিয়ে যান রত্না বেগম। চাঁদনী একটি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে সেখানেই বসে থাকে। নিজের হাতে থাকা শ্রাবণের পালকটিতে হাত বুলায়। মনে মনে ওর কথা ভেবে অনেক কষ্ট লাগতে শুরু করে তার। বারবার মনে হয় শ্রাবণের কোনো বিপদ হবে নাতো?
,
,
,
রাত ১২ টা ২০ মিনিট,
পুরো গ্রাম ঘুমে বিভোর। চাঁদনী অনেকক্ষণ জেগে ছিল। সে অপেক্ষা করছিল শ্রাবনের জন্য। যদিও সে জানতো আজ শ্রাবণ আসবেনা। তবুও কেন জানি অপেক্ষা করতে ইচ্ছে করছিল। একটু আগেই ঘুমিয়ে পড়েছে সে। হঠাৎ দরজায় কড়া নাড়ার শব্দে ঘুম ভেঙে যায় তার। সাথে সাথে বুকের মাঝে কেঁপে উঠে ভয়ে। শ্রাবনের বলা কথা গুলো মনে পড়ে যায়। সে দ্রুত বিছানা থেকে উঠে বসে। যদি তার বাবা গিয়ে দরজা খুলে দেয়। তাহলেতো বিপদ হতে পারে। তাই দ্রুত নিজের ঘরের দরজা খুলে বাইরে বের হয়। দেখে তার বাবা আর দাদিও বাইরে বেরিয়েছে। সবাই একে অপরের দিকে তাকায়।

“তোমরা দাঁড়াও আমি দেখছি বাইরে কে এসেছে।”

কথাটি বলেই রতন মিয়া এগিয়ে যেতে থাকে দরজার দিকে। তখনই দৌড়ে গিয়ে তার হাতটা ধরে ফেলে চাঁদনী। ভয়ে ভয়ে বলে,

“বাবা প্লিজ দরজা খুলো না। আজকে কোন ভাবেই দরজা খুলবে না। যে’ই দরজায় আসুক না কেন।”

ওর এমন কথায় ভ্রু কুচকায় রতন মিয়া। রত্না বেগম এর দিকে একবার তাকিয়ে আবার চাঁদনীর দিকে ফিরে তাকায়। গম্ভীর গলায় জিজ্ঞেস করে,

“এটা কেমন কথা চাঁদনী? একজন বিপদে পড়েও তো আমাদের দরজায় কড়া নাড়তে পারে। আর দরজা খুলবো না কেন?”

“আমি যেটা বলছি সেটা শোনো বাবা। দয়া করে আজকে কোন ভাবেই দরজা খুলবে না তুমি।”

ওর কথায় বেশ বিরক্ত হন রতন মিয়া। তখনই আবারও দরজায় শব্দ হয়। রতন মিয়া এবার সামনে এগিয়ে না গিয়ে সেখান থেকে জিজ্ঞেস করে,

“বাইরে থেকে দরজা ধাক্কাচ্ছে কে? কে আছে বাইরে কথা বলো।”

কিন্তু বাইরে থেকে কোনপ্রকার উত্তর আসে না। আবারও দরজার শব্দ হয়। এবার চাঁদনী শক্ত করে তার বাবার হাতটা জড়িয়ে ধরে বলে,

“প্লিজ বাবা আজকে আমাবস্যা রাত। এ রাতে অন্তত দরজা খুলো না। আমার মন বলছে দরজা খুললে অনেক বিপদ হবে আমাদের।”

ওর সাথে তাল মিলিয়ে পাশে থেকে রত্না বেগম বলে ওঠেন,

“হ্যাঁ রে রতন চাঁদনী ঠিকই বলছে। তুই দরজা খুলিস না বাবা। কে জানে বাইরে কি আছে। এমনিতেই তো এই এলাকায় নতুন নতুন দূর্ঘটনার শেষ নেই। কত মানুষ কিভাবে মারা গেল। আজকে রাতে দরজা না খোলাই ভালো হবে। চল আমরা যার যার রুমে গিয়ে শুয়ে পড়ি।”

কিন্তু রতন মিয়া উনাদের কথায় কোনরকম সায় দেন না। সে দরজার কাছে এগিয়ে গিয়ে আবারও জিজ্ঞেস করেন,

“কি হলো বাইরে কে আছো কথা বলছো না কেন? কথা না বললে দরজা খুলবোনা। কে বারবার দরজা ধাক্কাচ্ছো”

এবার দরজাটা এমনভাবে শব্দ হতে শুরু করে যেনো দরজা ভেঙে ভেতরে ঢুকে যাবে। এবার সবাই বেশ ভয় পেয়ে যায়। রতন মিয়া কয়েক পা পিছিয়ে এসে দাঁড়ায়। চাঁদনী তার হাতটা শক্ত করে ধরে থাকে। চাঁদনী এদিক ওদিক তাকিয়ে ওর বাবাকে বলে,

“বাবা এভাবে দাঁড়িয়ে থাকলে হবেনা। দরজার সামনে কিছু একটা দিয়ে আটকে দাও। আমার মন বলছে বাইরে খারাপ কিছু আছে। দরজা ভেঙে গেলে সর্বনাশ হয়ে যাবে।”

ওর কথার উত্তরে রতন মিয়া কিছু বলেন না। দ্রুত পাশে থাকা শোকেস টা টেনে টেনে নিয়ে এসে দরজার সামনে দাঁড় করিয়ে দেন। উনাকে দেখে বোঝাই যাচ্ছে উনিও এবার বেশ ভয় পেয়েছে। যেহেতু এলাকায় অনেক বাজে বাজে ঘটনা ঘটে গেছে। তাই ভয় পাওয়াটা স্বাভাবিক।

সবাই একসাথে জড়োসড়ো হয়ে কাচুমাচু হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। বেশ কিছুক্ষণ দরজা ধাক্কানোর পর সবকিছু নিরব নিস্তব্ধ হয়ে যায়। এবার সবাই একটি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে হাফ ছেড়ে বাচে। তখন’ই বাইরে থেকে কেউ বলে ওঠে,

“চাঁদনী দরজা খোলো। আমি শ্রাবণ তোমাকে নিতে এসেছি।”

কথাটা শুনতেই বেশ চমকে ওঠে চাঁদনী। পাশে থাকা রতন মিয়া এবং রত্না বেগমেরও একই অবস্থা। সবাই একে অপরের দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে থাকে। তারপর রতন মিয়া সন্দেহের কন্ঠে বলে ওঠে,

“এত রাতে জামাই কেন আসবে তোকে নিতে? সে কি দিনের বেলা আসতে পারে না?”

চাঁদনী কোন উত্তর দেয় না। সে ভেবে পায় না এখন তার কি করা উচিত। দরজাটি খুলে দিবে নাকি লাগানো থাকবে। তবে তার যতটুকু জানা তা হলো শ্রাবনের তো আজ আসার কথা নয়।

ওদের কাছ থেকে কোনরকম উত্তর না পেয়ে বাইরে থাকা লোকটি আবারো বলে ওঠে,

“কী হলো চাঁদনী দরজা খুলছো না কেন? তাড়াতাড়ি দরজা খোলো আমি তোমাকে নিতে এসেছি। তোমাকে নিয়ে এখনই চলে যাব। এখানে বেশিক্ষণ দেরী করতে পারবো না। তাড়াতাড়ি দরজাটা খোলো আমি বিপদে পড়েছি।”

ওর বিপদে পড়ার কথাটা শুনেই রতন মিয়া দ্রুত সেখানে এগিয়ে যায়। শোকেজটা দরজার সামনে থেকে সরিয়ে দিয়ে দরজা খুলতে যাবে, তখন’ই চাঁদনী খেয়াল করে তার হাতে থাকা পালকটি জ্বলজ্বল করে জ্বলছে। আর তার হাতে বেশ জ্বালা করছে। মুহুর্তেই তার কোন একটা কথা মনে পড়ে যায়। সে দৌড়ে গিয়ে তার বাবাকে থামিয়ে দিয়ে চিৎকার করে বলে,

“খবরদার বাবা দরজা খুলবে না। বাইরে উনি আসেনি। এসেছে অন্য কেউ। আমাদের মেরে ফেলার জন্য। এখন দরজা খুললে আমরা কেউ বাঁচতে পারব না।”

কথাটি বলেই শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে দরজার সামনে শোকেজ ও টেবিল এনে লাগিয়ে দেয় সে।
#ভয়ংকর_সে #পর্ব_১৫
#M_Sonali

“এসব কি হচ্ছে আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না। বাইরে আসলে কে দাঁড়িয়ে আছে? আর তোকে এমন ভাবে ডাকছে কেন চাঁদনী? জামাই না হলে আর কে হবে?”

কথাগুলো ভয় এবং বিরক্তি মিশ্রিত কন্ঠে বললেন রতন মিয়া। উনার কথায় চাঁদনী কি উত্তর দিবে ভেবে পাচ্ছে না। সে সব সত্য কথা বলতেও পারবেনা আবার এখানে কিছু লুকালেও ঝামেলা হতে পারে। মনে মনে কিছুক্ষণ ভেবে নিলো সে। তার পর বলে উঠল,

“প্লিজ বাবা আমি তোমাকে সব কিছু খুলে বলবো। কিন্তু এখন দয়া করে এটা নিয়ে কোন কথা বলো না। শুধু আমি যেটা করছি সেটা করতে দাও। কোনভাবেই দরজাটা খোলা যাবে না। আজকে রাতে কেউ বাইরে বের হব না আমরা। বাইরে বিপদ ছাড়া আর কিছু নেই।”

ওর এমন কথায় বেশ বিরক্ত হলেন রতন মিয়া। কিন্তু আর কিছু বললেন না। মেয়ের কথা মেনে নিয়ে চুপচাপ সবাই ঘরের মধ্যেই থাকলেন। বেশ কিছুক্ষণ দরজায় টোকা পড়তে পড়তে এক সময় সবকিছু শান্ত হয়ে গেল। এবার যেন সকলের মাঝে প্রান ফিরে এল। সবাই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল।

“আচ্ছা চাঁদনী বুড়ি সত্যি করে বলতো কি হচ্ছে এসব? বাইরে থেকে কে তোকে এভাবে জামাইয়ের মত করে ডাকলো? কিন্তু তুই দরজা খুলতে দিলিনা কেন? আমার যেনো সবকিছু কেমন গোলমেলে লাগছে। খুব সন্দেহ হচ্ছে তোর আর জামাইয়ের ওপর। সবকিছু খুলে বলতো সত্য সত্য!”

পাশ থেকে রত্না বেগম বলে উঠলেন কথাগুলো। ওনার কথা শুনে চাঁদনী একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলল। দাঁড়ানো থেকে পাশে থাকা সোফার ওপর গিয়ে বসলো। তারপর দাদির দিকে তাকিয়ে বলল,

“দেখো দাদি এখন এসব কথা বলার সময় নয়। তোমরা আমাকে একটু সময় দাও। কথা দিচ্ছি তোমাদের কাছে সব সত্য কথা খুলে বলবো আমি। তবে এটা জেনে রেখো আমি যেটা করছি সেটা আমাদের সকলের ভালোর জন্যই করছি।”

এতোটুকু বলতেই হঠাৎ জানালায় জোরে জোরে শব্দ হতে লাগলো। এই যেন জানালা ভেঙে কিছু ঘরে ঢুকে পড়বে। সাথে সাথে ভয়ে কেঁপে উঠল সবাই। সবাই একসাথে জড়োসড়ো হয়ে গেল। চাঁদনী এসে ওর বাবার হাতটা শক্ত করে ধরে ফেললো। জানালা এত জোরে শব্দ হতে লাগলো যে এ যেন সেটা ভেঙে ভেতরে চলে আসবে। চাঁদনী এবার প্রচন্ড পরিমাণের ভয় পেতে লাগল। ভয়ে দরদর করে ঘামতে লাগলো সে। তার মত একই অবস্থা রতন মিয়া ও রত্না বেগমেরও।

সবাই একে অপরের মুখের দিকে তাকিয়ে ভয়ে দরদর করে ঘামতে লাগলো। তখন’ই পুরো বাসার লাইট অফ হয়ে গেল। চারিদিকে অন্ধকার ঘুটঘুটে হয়ে গেল। কোন দিকে একটুখানি আলোর চিহ্নমাত্র নেই। এমন অবস্থায় কে কি করবে কিছুই বুঝতে পারছে না। তিনজনে একসাথে হয়ে জড়োসড়ো হয়ে রইলো। চাঁদনী খেয়াল করল তার হাতটা ভীষণ জ্বালা করছে। সে বুঝতে পারলো তার আশেপাশে প্রচুর বিপদ লুকিয়ে রয়েছে। মনে মনে ভাবল এই বুঝি তাদের শেষ রাত। আজকেই হয়তো ভ্যাম্পায়ারগুলো মেরে ফেলবে তাদের। কথাগুলো ভেবে ভীষণ রকম কান্না আসতে শুরু করলো তার। তবুও সে নিজেকে সামলে নিলো। এখন দুর্বল হলে চলবে না। তাহলে হয়তো তার বাবা আর দাদী ও দুর্বল হয়ে পড়বে। সে নিজেকে যতটা সম্ভব শান্ত রাখার চেষ্টা করে বলল,

“বাবা দাদি তোমরা প্লিজ ভয় পেও না। শুধু শক্ত করে একে অপরের হাত ধরে রাখো। আর হ্যা তোমাদের হাতে থাকা পালকগুলো যেনো কিছুতেই হাত ছাড়া করো না।”

ওর কথার উত্তরে পাশ থেকে রত্না বেগম বলে উঠলো,

“তুই এখন পালক নিয়ে পড়ে আছিস। এদিকে আমার প্রান যায় যায়। সন্ধ্যা থেকে দেখছিলাম ওই পালকের জন্য হাতটা ভীষণ জ্বালা করছিল। তাই সেটা তো আমি কখন খুলে রেখেছি।”

ওনার এমন কথায় চমকে উঠল চাঁদনী। উত্তেজিত হয়ে বললো,

“এসব তুমি কি বলছো দাদি? ওইটা খুলে রাখার কারণেই চারিদিকে এত বিপদ ঘিরে ধরেছে। তাড়াতাড়ি বল ওটা তুমি কোথায় রেখেছো? তোমাকে বারবার নিষেধ করা সত্ত্বেও কেন পালকটা খুলে রাখলে?”

“ঐ সাধারন একটা পালকের সাথে বিপদের কি সম্পর্ক? আর তাছাড়া ওটা আমার হাতে ভীষণ জ্বালা করছিল, তাই খুলে রেখেছি। কিন্তু তোর কথা তো কিছুই বুঝতে পারছি না।”

“আমার কথা পরে বুঝবে দাদি। আগে বলো তুমি পালকটা রেখেছো কোথায়?”

“কোথায় আবার রাখবো, আমার ঘরে বিছানার বালিশের নিচে রেখেছিলাম।”

“আচ্ছা তোমরা এখানেই দাড়াও। কেউ কোথাও যাবে না। আমি আসছি।”

কথাটা বলে চাঁদনী আর দেরী করলো না। অন্ধকারেই হাতরাতে হাতরাতে দাদির ঘরে চলে গেল। আন্দাজে বিছানার কাছে গিয়ে বালিশটা তুলে তার নিচে হাত দিতেই দেখল পালকটা পড়ে আছে। সে দ্রুত সেটা নিয়ে আবারও সবকিছু ধরে ধরে বাইরে বেরিয়ে এল। বাবার নাম ধরে ডাকতেই তারা উত্তর দিল। সেখানে গিয়ে হাতে থাকা জিনিসটা অন্ধকারেই তাড়াতাড়ি দাদির হাতে বেঁধে দিল। সাথে সাথে তিন জনের হাতে থাকা পালকগুলো জ্বলজ্বল করে উঠলো। কিন্তু এবার আর কোনরকম জ্বালা হলো না। সবাই অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল পালক গুলোর দিকে। তখন’ই জানালায় শব্দ হওয়া বন্ধ হয়ে গেল। সবকিছু আগের মত স্বাভাবিক এবং শান্ত হয়ে গেল। সাথে সাথে ঘরের লাইট গুলোও জ্বলে উঠলো।

এবার যেনো চাঁদনী হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। সে এবার বাবার হাত ছেড়ে দিয়ে বললো,

“আর কোন ভয় নেই। ইনশাআল্লাহ এবার সবকিছু ঠিক হয়ে গেছে। সব বিপদ কেটে গেছে।”

ওর কথায় রতন মিয়া এবং রত্না বেগম দুজনেই সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকায় ওর দিকে। রতন মিয়া এবার বলে উঠেন,

“এসব কি হচ্ছে চাঁদনী? আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। আমার এখন কেমন যেন সন্দেহ হচ্ছে। সত্যি করে বলতো এগুলোর পেছনে রহস্য কি?”

চাঁদনী একটি দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। তারপর ক্লান্ত গলায় বলে,

“আমি তোমাদের সবকিছুই বলবো বাবা। তবে এখন নয়। কালকে সকালে। আমার এখন ভীষণ টায়ার্ড লাগছে। তোমরা যে যার রুমে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ো। আর কোনো বিপদ নেই। তবে হাত থেকে কিন্তু এইগুলো কোনমতে খুলবে না। আমিও ঘুমাতে যাই সকালে সব কিছু বলবো।”

ওর কথার উত্তরে কেউ আর কিছু বলেনা। কারন সবাই অনেক টায়ার্ড হয়ে পড়েছে। এবার যে যার রুমে গিয়ে শুয়ে পড়ে। যদিও সবার মাঝেই ভয়ে টা এখনো কাজ করছে।
,
,
,
সকাল ৭:০৩ মিনিট,
রাত জাগার কারণে বিভরে ঘুমিয়ে আছে চাঁদনী। দরজা জানালা ভিতর থেকে লাগিয়ে দেওয়া। ঘুমের মাঝেই হঠাৎ চাঁদনীর মনে হতে লাগলো তার মুখের ঠিক সামনে কিছু একটা আছে। যে জিনিসটা লোভাতুর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে। যখন তখন হয়তো আক্রমণ করবে তার ওপর।
#ভয়ংকর_সে #পর্ব_১৬
#M_Sonali

সকাল ৭:০৩ মিনিট,
রাত জাগার কারণে বিভরে ঘুমিয়ে আছে চাঁদনী। দরজা জানালা ভিতর থেকে লাগিয়ে দেওয়া। ঘুমের মাঝেই হঠাৎ চাঁদনীর মনে হতে লাগলো তার মুখের ঠিক সামনে কিছু একটা আছে। যে জিনিসটা লোভাতুর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে। যখন তখন হয়তো আক্রমণ করবে তার ওপর।

পাশের রুমে রতন মিয়া এবং রত্না বেগম বিভোরে ঘুমাচ্ছে। প্রতিদিন অনেক ভোরে উঠে পড়লেও গতরাতে এত ঝড় ঝাপটা যাওয়ার কারণে তারাও এখন পর্যন্ত ঘুম থেকে উঠতে পারেনি। সবাই যে যার রুমে নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে।

ভয়ে এবার চাঁদনীর শিরদাঁড়া বেয়ে শীতল স্রোত বয়ে যেতে লাগলো। ভয়ে যেন শরীরের প্রতিটা পশম দাঁড়িয়ে গেলো। সে চোখ না খুলেও ভয়ে শিউরে উঠতে লাগলো। মনে মনে ভাবতে লাগল চোখ খুলতেই হয়তো এমন কিছু দেখবে, যা দেখে সে সহ্য করতে পারবেনা। জিনিসটা হয়তো চোখ খোলার সাথে সাথে তার ওপর আক্রমণ করে বসবে। কথাটা ভাবতে ভাবতেই সাহস করে চোখ মেলে তাকাল সে। আর তাকাতেই সামনে যা দেখলো তা দেখে চোখ বড় বড় করে জোরে চিৎকার দেওয়ার জন্য মুখ খুলল সে।

তখনই সামনে থাকা জিনিসটা ওর দু গালে হাত রেখে ঠোট দুটো নিজের ঠোটে আঁকড়ে নিলো। এভাবে কেটে গেল বেশ কিছুক্ষণ। চাঁদনী যখন শান্ত হয়ে গেল। তখন তাকে ছেড়ে দিলে সে। এবার চাঁদনী জোরে জোরে হাফাতে লাগলো। শ্রাবণকে নিজের সামনে বসে থাকতে দেখে চোখ বড় বড় করে তার দিকে তাকিয়ে রইল। আশেপাশে চোখ বুলিয়ে দেখল দরজা-জানালা সব কিছু ঠিক আগের মতোই লাগানো আছে। তাহলে শ্রাবণ ভিতরে এলো কিভাবে? কথাটা ভেবে ভীষণ রকম ভয় হতে লাগলো তাঁর। কিন্তু সে চিৎকার করলো না। কারণ শ্রাবণ তার সামনে মুখে দুষ্টু হাসি নিয়ে বসে আছে।

চাঁদনী হাঁপাতে হাঁপাতে জিজ্ঞেস করল,

“আপনি, আপনি এখানে কিভাবে এলেন? দরজা-জানালা সব তো লাগানো। আমি কি স্বপ্ন দেখছি নাকি?”

কথাটি বলতেই শ্রাবণ দুষ্টুমি করে ওর হাতে একটি চিমটি কাটল। সাথে সাথে আউচ করে উঠলো সে। হাতে হাত বুলাতে বুলাতে বলল,

“আমি তো সত্যিই জেগে আছি। কিন্তু আপনি ভিতরে এলেন কিভাবে? দরজা-জানালা সব তো ভিতর থেকে লাগানো।”

ওর কথার উত্তরে শ্রাবণ লাফ দিয়ে উঠে ওর পাশে বসলো। ওর দিকে কিছুটা ঝুঁকে ওর মুখের কাছে মুখ নিয়ে বলল,

“আমার বউটাকে এত বেশি মিস করছিলাম যে এক মিনিটও দেরি সইলো না। তাই দরজা জানালা বন্ধ থাকা অবস্থাতেই ভিতরে ঢুকে পড়েছি।”

ওর কথার উত্তরে শোয়া থেকে উঠে বসলো চাঁদনী। শুকনো ঢোক গিলে বলল,

“কিন্তু দরজা-জানালা বন্ধ থাকা অবস্থায় আপনি কিভাবে ভেতরে এলেন শ্রাবণ?”

“ও আমার জান পাখি। তুমি কি ভুলে গেছো তোমার স্বামী কোন সাধারন মানুষ নয়। সে একজন ভ্যাম্পায়ার। তাহলে এতো কেন ভয় পাচ্ছো? আমি যেখানে খুশি সেখানে পৌঁছে যেতে পারি। নিজের ইচ্ছায় বুঝেছ? এখন এসব কথা না বলে আমাকে আদর করো।”

ওর কথায় এতক্ষণে যেন সবকিছু মনে পড়ল চাঁদনীর। গত রাতের কথা মনে পড়ে ভয়ে শিরদাঁড়া বেয়ে শীতল স্রোত বয়ে গেল তার। মুখটা মুহূর্তেই শুকিয়ে গেল। ওর মনের কথা বুঝতে পেরে শ্রাবন মৃদু হাসলো। ওর হাতটা নিজের হাতে নিয়ে বললো,

“সত্যিই তোমাকে পেয়ে আমি অনেক খুশি চাঁদপাখি। তুমি যেমন বুদ্ধিমতী তেমনি সাহসী। গতরাতে তুমি যদি নিজের বুদ্ধি এবং সাহস দিয়ে সবকিছু মোকাবেলা না করতে, তাহলে হয়তো অনেক বড় বিপদ হতে পারত।”

ওর কথার উত্তরে চাঁদনী ওর দিকে গম্ভীর দৃষ্টিতে তাকাল। তারপর অভিমানি গলায় বললো,

“কিন্তু আপনি গতকাল কোথায় ছিলেন শ্রাবণ? আমাদের এত বিপদ দেখেও কেন এলেন না?আর ওই লোকটা কে ছিলো যে আপনার কণ্ঠস্বরে আমাদেরকে বারবার দরজা খোলার জন্য বলছিল?

ওর কথার উত্তরে একটি দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো শ্রাবণ। তারপর ওর হাতটা ধরে বলল,

“সবকিছুই বলবো তোমায়। তোমার কাছে কোন কিছুই লুকাব না। তবে এই মূহূর্তটাকে আমি নষ্ট করতে চাই না। তুমি কি এই মুহুর্তটা আমার নামে করে দিবে? শুধু তোমাকে ভালোবাসার জন্য?”

ওর কথায় বেশ লজ্জা পেল চাঁদনী। মাথাটা নিচু করে ফেলল সে। মুহূর্তে গাল দুটো যেন টকটকে লাল টমেটোর মত হয়ে গেল। লজ্জায় আর শ্রাবণের মুখের দিকে তাকাতে পারলো না সে। সেটা বুঝতে পেরে শ্রাবণ মৃদু হাসলো। ওর দু গাল টিপে দিয়ে আদুরে গলায় বলল,

“মানুষ যে এতটা কিউট হয় সেটা তোমাকে না দেখলে জানতাম না চাঁদ পাখি। যাও এত লজ্জা পেতে হবে না। এখনকার মত ছেড়ে দিলাম। কারণ তোমার কাছে অনেক কিছুই খোলাসা করে বলার আছে। এখন চলো রুম থেকে বের হওয়া যাক।”

ওর কথায় চাঁদনী এবার ওর দিকে বড় বড় চোখে তাঁকালো। তারপর উত্তেজিত কণ্ঠে বলে উঠলো,

“কি বলছেন আপনি? এখন আমার সাথে বাইরে বের হবেন কি করে? বাবা আর দাদী দেখলে কি ভাববে? তারা তো একের পর এক প্রশ্ন করবে। আপনি কখন এলেন কিভাবে এলেন। আমি কি উত্তর দিব তাদের? আমি কি তাদের বলে দিব আপনি একজন ভ্যাম্পায়ার? আর তাছাড়া এমনিতেই তো গত রাতে তাদের মনে নানা রকম প্রশ্ন তৈরি হয়েছে। আমি সেটাই ভেবে পাচ্ছি না তাদের কিভাবে সামলাবো।”

ওর কথার কোন উত্তর দিলেনা শ্রাবণ। উঠে দাঁড়িয়ে মুচকি হেসে নিজের হাতটা ওর দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল,

“আমার হাতটা ধরো। আর এসো আমার সাথে।”

ওর এমন কথায় ড্যাবড্যাব করে ওর দিকে তাকিয়ে রইলো চাঁদনী। কিন্তু উঠলো না। শেষে শ্রাবণ বাধ্য হয়ে ওর হাতটা টেনে ধরে ওকে দাড় করালো। তারপর ওকে টানতে টানতে নিয়ে দরজা খুলে বাইরে বের হল। বাইরে বের হতেই দেখল ওর দাদী এবং বাবা সামনে দাঁড়িয়ে আছে। তারাও এই মাত্র ঘুম থেকে উঠেছে।

ওদের দুজনকে দেখে বেশ অবাক হলেন রতন মিয়া এবং রত্না বেগম। রতন মিয়া কাছে এগিয়ে এসে বললেন,

“আরে জামাই বাবা তুমি কখন এসেছ?”

উনার কথার উত্তরে শ্রাবণ মুচকি হাসল। চাঁদনীর হাত ছেড়ে দিয়ে কাছে এগিয়ে এসে বলল,

“আমিতো রাতে এসেছি বাবা? আপনার মেয়ে দরজা খুলে দিয়েছিল। আপনারা ঘুমিয়েছেন বলে আমি আর আপনাদের ডাকতে দেইনি।”

“একটু খবর দিয়ে আসতে পারোনি বাবা! দেখোতো কত বেলা হয়ে গেলো অথচ এখনো কিছুই করা হলো না। বুঝলাম না আজকে এত বেলা হল কিভাবে ঘুম থেকে উঠতে। আচ্ছা তুমি থাকো আমি এক্ষুনি বাজারে গিয়ে বাজার করে আনছি। চাঁদনীমা দেখিস জামাই বাবার যেন কোন রকম সমস্যা না হয়।”

কথাগুলো বলেই ওকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে সেখান থেকে চলে গেলেন রতন মিয়া। উনি যেতেই রত্না বেগম কাছে এগিয়ে এলো। একটু রাগী সুরে বলল,

“এই যে নাতজামাই তোমার উপর কিন্তু বড্ড রেগে আছে আমি। বলছি আমার নাতনিটাকে সেই যে সেদিন রাত্রে রেখে দিয়ে চলে গেলে, আর একটি বার খোঁজ নিতে এলে না। তুমি জানো আমার নাতনি তোমাকে কত মিস করেছে। সারাক্ষণ মনমরা হয়ে বসে থাকতো। ঠিক মত খাওয়া দাওয়া পর্যন্ত করতো না।”

উনার কথায় মৃদু হেসে চাঁদনীর দিকে তাকালো শ্রাবণ। তারপর আবারও ওনার দিকে তাকিয়ে বলল,

” চিন্তা করবেন না দাদী। এখন থেকে আপনার নাতনি এর সকল দায়িত্ব আমার। তাকে খাইয়ে খাইয়ে কিভাবে মোটা বানাতে হয় সে দায়িত্ব আমি পালন করবো। তাকে ছেড়ে কোথাও যাবো না।”

“হ্যাঁ বাবা হ্যাঁ সেটা করলেই ভালো। আচ্ছা তোমরা ঘরে যাও আমি তোমাদের জন্য নাস্তার ব্যবস্থা করছি।”

কথাটি বলেই সেখান থেকে চলে গেলেন রত্না বেগম। এদিকে চাঁদনী যেন অবাক এর অপর অবাক হচ্ছে। সে কিছুতেই ভেবে পাচ্ছে না এসব কি হচ্ছে? গত রাতের কথা কি সব ভুলে গেছে তার দাদী এবং বাবা? তারা কিভাবে এত স্বাভাবিক ভাবে কথা বলছে?

ওকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকতে দেখে শ্রাবণ মৃদু হাসে। ওর হাত ধরে নিয়ে আবারো রুমে প্রবেশ করে। ওকে নিয়ে খাটের উপর বসিয়ে দিয়ে বলে,

“আমি জানি তুমি এখন কি ভাবছো। এত কিছু ভেবে নিজের মাথা খারাপ করো না। তোমার বাবা এবং দাদির গত রাতের কথা কিছুই মনে নেই। তারা কোন কিছুই মনে করতে পারবে না। তাদের স্মৃতি থেকে সব মুছে দিয়েছি আমি যাদু করে। তাই তাদের কোন প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে না তোমাকে।”

“সবই বুঝলাম শ্রাবণ। কিন্তু একটি কথা বুঝতে পারছি না। আপনি তো আমার কাছে বলেছিলেন আপনি দিনের বেলা কোথাও বের হতে পারেন না। সূর্যের আলোতে আপনার সমস্যা। তাহলে এখানে এলেন কিভাবে? চারিদিকে তো সূর্য উঠে পড়েছে! আপনি বাইরে বের হবেন কিভাবে? আর তাছাড়া দাদি এবং বাবা যেভাবে আপনার খাবার আয়োজন করতে গেল। তাতে তারা আজ আপনাকে খাবার খাইয়েই ছাড়বে। কিন্তু আপ,,,!”

এতোটুকু বলতেই ওকে থামিয়ে দিল শ্রাবণ। তারপর ওর হাতটি ধরে বললো,

“হয়েছে বাবা তোমার এত চিন্তা করতে হবে না। সবকিছুই আমি সামলে নিব। এত ভেবে নিজের মাথা নষ্ট করো না চাঁদপাখি। আমি সব ব্যবস্থা করে ফেলেছি। আর তাছাড়া এখন আমি অনেক শক্তির অধিকারী। সূর্যের আলোতে আমার আর কোন ভয় নেই। যতক্ষন পর্যন্ত সূর্যের আলো ডাইরেক্ট আমার বুক স্পর্শ না করবে, ততক্ষণ আমার কোন ক্ষতি হবে না। আর আমি যে জামাটা পড়ে আছি, এটার কারণে সূর্যের আলো আমার বুক কখনোই স্পর্শ করতে পারবে না। তাই আমি এখন একদম সেভ বুঝতে পেরেছ।”

ওর এমন কথায় এবার যেন আরও বেশী বিশ্মিত হলো চাঁদনী। সে বড় বড় চোখে ওর দিকে সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,

“কিন্তু আপনি শক্তি পেলেন কিভাবে শ্রাবণ? আপনিতো বলেছিলেন শক্তি পেতে হলে আমার রক্ত চুষে আমাকে মারতে হবে আপনার। তবেই আপনি আপনার পূর্ণ শক্তি ফিরে পাবেন। কিন্তু আমি তো এখনো আপনার সামনে জীবিত বসে আছি। তাহলে এটা কিভাবে সম্ভব হলো?”

কথাগুলো বলেই সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল ওর দিকে। মুহূর্তেই শ্রাবনের মুখটা মেঘে ঢেকে গেলো। সে মাথা নিচু করে কিছু একটা ভাবতে লাগলো।
#ভয়ংকর_সে #পর্ব_১৭
#M_Sonali

পুরো ডাইনিং টেবিল সাজানোর নানা পদের রান্না করা খাবার দিয়ে। তার সামনে বড় বড় চোখ করে দাঁড়িয়ে আছে শ্রাবণ। পাশে দাঁড়িয়ে চাঁদনী মিটিমিটি হাসছে তার অবস্থা দেখে। কারণ সে ভালো করেই জানে শ্রাবন এগুলোর কিছুই খেতে পারবে না। ওকে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে পাশ থেকে রত্না বেগম বলে উঠলেন,

“কি হলো জামাই এভাবে দাঁড়িয়ে আছো কেন? রান্না কি পছন্দ হয়নি? বস বস তোমার জন্যই তো এত আয়োজন।”

ওনার কথায় কি উত্তর দিবে তা যেন ভেবে পাচ্ছেনা শ্রাবণ। সে এবার করুন দৃষ্টিতে চাঁদনীর দিকে তাকাল। কিন্তু সে মিটিমিটি হেসে চলেছে তখন থেকেই। এবার বেশ রাগ হল তার। সে একটি চেয়ার টেনে সেটাতে বসে পড়ল। রত্না বেগম এর দিকে তাকিয়ে বলল,

“দাদি খাবার গুলো দেখে লোভ হচ্ছিল অনেক। তাই এতক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে নিজের মনকে সান্তনা দিয়ে বলছিলাম যে এগুলো সব আমার জন্যই। এখন দেরি না করে তাড়াতাড়ি আমার প্লেটে সব কিছু দিন তো, খাওয়াটা শুরু করি। ওর এমন কথা এবং কান্ডে চাঁদনীর চোখ যেন কপালে উঠে গেল। সে বড় বড় চোখে ওর দিকে তাকিয়ে বিশ্মিত গলায় বলল,

“কি বলছেন কি আপনি? আপনি সত্যিই এসব খাবেন?”

ওর এমন প্রশ্নে রত্না বেগম অবাক হয়ে ঝাঁঝালো গলায় পাশ থেকে বলে উঠলো,

“এটা কেমন প্রশ্ন করছিস রে চাঁদনী বুড়ি? সবকিছু তো ওর জন্যই রান্না করা হয়েছে। তাহলে এসব ও খাবে না তো কে খাবে? আর এমন করে বলছিস যেন জামাই এসব কিছুই খায় না?”

ওনার প্রশ্নে থতমত খেয়ে গেল চাঁদনী। কি বলবে ভেবে পায়না সে। এদিক ওদিক তাকিয়ে উসখুস করতে লাগল। ওর অবস্থা দেখে শ্রাবন মিটিমিটি হেসে বলল,

“আসলে হয়েছে কি জানেন তো দাদি? আপনার নাতনি না আমার খাওয়া একদমই সহ্য করতে পারে না। বাসায় থাকতে তো সারাক্ষণ আমার খাবার নিজেই চুরি করে খেত। আমাকে ঠিকমতো খেতে দিত না। তাইতো এত মোটা হয়ে গেছে দেখছেন না? কিন্তু আজকে ওকে দিব না। সব আমি একাই খাবো হুমম।”

“হ্যা জামাই হ্যা, তুমি বস আমি তোমারে খাবার বেরে দিতাছি।”

কথাগুলো বলে শ্রাবণের সামনে একটি প্লেট দিয়ে তাতে একে একে সব খাবার তুলে দিলেন রত্না বেগম। প্লেটটা এখন মাছ-মাংসে একদম ভরপুর হয়ে আছে। সেটা নিয়ে চুপচাপ বসে রইলো শ্রাবণ। চাঁদনী শুধু চোখ বড় বড় করে ওর অবস্থা দেখছে। সে তার নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না। কারণ সে তো জানে ভ্যাম্পায়ার শুধু রক্ত ছাড়া অন্য কিছুই খেতে পারে না। শ্রাবনও সেরকমই ছিলো। তাহলে আজকে সে খাবার খাওয়ার সাহস করছে কিভাবে?

কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই চেয়ে দেখল শ্রাবণ অলরেডি খাওয়া শুরু করেছে। একদম মানুষের মতো করে সব খাবারগুলো চেটেপুটে খাচ্ছে সে। দেখে মনে হচ্ছে যেন অনেক মজা করে খাবারগুলো খাচ্ছে। চাঁদনী এবার ধপ করে পাশে একটি চেয়ার টেনে সেটাতে বসে পড়ল। হা করে তাকিয়ে রইল ওর খাওয়ার দিকে। সে যেন অবাক এর উপর অবাক হচ্ছে ওর অবস্থা দেখে। ওকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে পাশ থেকে রত্না বেগম বলে উঠলেন,

“কিরে চাঁদনী বুড়ি এভাবে জামাইয়ের খাবারের দিকে নজর না দিয়ে নিজে একটি প্লেটে ভাত নিয়ে খেতে পারিস তো। তোকে তো কেউ ধরে রাখে নি। যে ভাবে তাকিয়ে আছিস বেচারার পেট খারাপ হবে তো ওই ভাবে তাকিয়ে থাকলে।”

চাঁদনী কোন উত্তর দিল না। একই ভাবে তাকিয়ে থেকে ওর খাওয়া দেখতে লাগল। বেশ কিছুক্ষণ পর খাওয়া-দাওয়া শেষ করে হাত ধুয়ে উঠে পরল শ্রাবণ। কিন্তু চাঁদনী কিছুই খেলো না। সে ওর পিছে পিছে উঠে গেল। দুজন মিলে রুমে চলে গেল। রত্না বেগম অবশ্য অনেক বার ওকে খেতে বলেছেন। কিন্তু ও বলেছে পরে খাবে। রুমে গিয়ে চাঁদনী দরজা লাগিয়ে শ্রাবণের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। মুখের দিকে সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকিয়ে বিস্মিত গলায় বলল,

“সত্যি করে বলেন তো আপনি কে? আপনি কি সত্যিই সেই ভাম্পায়ার শ্রাবণ! নাকি অন্য কেউ? আমার যেন কেমন ডাউট হচ্ছে আপনাকে!”

ওর কথার উত্তরে একটি দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো শ্রাবন। তারপর বিছানার উপর বসে ওর দিকে তাকিয়ে হাতটা বাড়িয়ে দিয়ে বলল,

“আমার পাশে এসে বসো চাঁদপাখি।”

চাঁদনী তার হাতটা ধরল না। বরং দু পা পিছিয়ে গিয়ে আবারও জিজ্ঞেস করল,

“আমাকে সবকিছু সত্যি করে বলুন। আমার আপনাকে সন্দেহ হচ্ছে। কেন যেন বারবার মনে হচ্ছে আপনার মধ্যে অনেক বড় পরিবর্তন ঘটেছে। কিন্তু সেটা কিভাবে?”

ওর কথার উত্তরে এবার বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো শ্রাবণ। তারপর গুটি গুটি পায়ে হেঁটে জানালার কাছে চলে গেল। জানালার গ্রিল টা হাত দিয়ে ধরে বাইরের দিকে দৃষ্টি রেখে শান্ত গলায় বলে উঠল,

“তা তুমি ঠিক ধরেছ চাঁদ। আমার মাঝে অনেক বড় পরিবর্তন ঘটেছে। কারণ এখন আমি আগের চাইতেও হাজার গুন বেশী শক্তিশালী একজন ভ্যাম্পায়ার। যার মাঝে মানুষ এবং ভ্যাম্পায়ারের দুরকম শক্তিই রয়েছে। তাই মানুষের মতো খাবার খাওয়াও আমার জন্য কোনো ব্যাপার নয়।”

“কিন্তু সেটা কিভাবে সম্ভব হলো? আপনার তো কোনো শক্তি পাওয়ার কথা নয়। আপনি তো আমাকে মারেননি। তাহলে আপনি এতো শক্তি কোথায় পেলেন? আমাকে সব কিছু খুলে বলুন শ্রাবণ। আমার আর এই গোলকধাঁধায় থাকতে ভালো লাগছেনা।”

“বলেছি তো তোমাকে আমি সবই বলব। কিন্তু তার আগে আমাকে একটু এলাকাটা ঘুরে দেখাবে চলো। এর আগে আমি কখনও দিনের বেলা পৃথিবীর সৌন্দর্য দেখি নি। আজ তোমার সাথে পুরো এলাকাটা ঘুরে দেখতে চাই। নিয়ে যাবে না আমায়?”

চাঁদনী কোন প্রশ্ন করতে গিয়েও থেমে গেল। কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো,

“আচ্ছা ঠিক আছে আপনি একটু বসুন আমি খেয়ে রেডি হয়ে আসছি।”

কথাটা বলে রুম থেকে বেরিয়ে গেল সে। তবে তার মনটা অনেক খারাপ সেটা তার চেহারা দেখেই বোঝা যাচ্ছে। সে বেরিয়ে যেতেই শ্রাবণ একটি দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। মনে মনে বললো,

“সত্যিটা তুমি জানতে পারলে হয়তো আমাকে ভুল বুঝবে চাঁদ পাখি। কিন্তু এছাড়া যে আমার আর কোনো উপায় ছিল না। সকলের ভালোর জন্যই এত বড় পদক্ষেপ নিতে হয়েছিল আমায়। কিন্তু এ কথাটা আমি এত সহজে তোমার কাছে বলতে চাই না। আমি চাই তোমার সাথে কিছু সুন্দর সময় কাটাতে।”

গ্রামের রাস্তা ধরে হাত ধরে হেটে যাচ্ছে চাঁদনী এবং শ্রাবণ। দুজনের মুখে মুচকি হাঁসি। কিছুক্ষণ পরপর গল্প করছে আর রাস্তা ধরে সামনে এগিয়ে চলেছে। আশেপাশের মানুষগুলো তাদের দেখে ফিসফিস করে একে অপরের সাথে কথা বলছে। চাঁদনীর ছোটবেলার বান্ধবীদের সাথে দেখা হয়েছে ইতিমধ্যে। তারা শ্রাবনকে দেখে একপ্রকার হিংসার দৃষ্টিতে তাকিয়েছে চাঁদনীর দিকে। যেটা বুঝতে পেরে মনে মনে ভীষণ খুশি হয়েছে চাঁদনী।

প্রায় একঘন্টা হলো এভাবে হাটতে হাটতে বাসা থেকে অনেক দূরে চলে এসেছে তারা। জায়গাটা বেশ জঙ্গলের মতো। সময় যেনো কখন পেড়িয়ে গেছে বুঝে উঠতে পারেনি তারা। দুপুর পেরিয়ে বিকেল হয়ে গেছে অনেক আগেই।

বেশ কিছুদূর এগিয়ে যেতেই জঙ্গলের মধ্যে বেশ কয়েকজন এর কথা শুনতে পেলো চাঁদনী। সে দ্রুত শ্রাবণের দিকে তাকিয়ে বলে উঠল,

“আমরা অনেক দূরে চলে এসেছি শ্রাবণ। এখন আমাদের বাসায় ফেরা উচিত। চলুন তাড়াতাড়ি বাসায় যাই। এখানে থাকা ঠিক হবে না।”

ওর এমন কথায় ওর দিকে বিরক্তির দৃষ্টিতে তাকায় শ্রাবন। গম্ভির গলায় জিজ্ঞেস করে,

“কেন এখানে কি হয়েছে? আমার সাথে থাকতে তোমার কিসের ভয় চাঁদপাখি?”

“না কিছুনা, কোন ভয় নাই। কিন্তু আমরা এখন বাসায় ফিরব। চলুন আমার সাথে।”

কথাটি বলেই শ্রাবনের হাত ধরে পিছনদিকে হাঁটার জন্য উদ্যত হয় চাঁদনী। তখনই জঙ্গলের মধ্য থেকে কয়েকজন নেশাখোর লোক বাইরে বেরিয়ে আসে। ওদের উদ্যেশ্য করে বলে,

“কই যাও সোনামনি। শুধু একজনকে নিয়ে থাকলে চলবে? আমাদের কাছেও একটু আসো।”

কথাগুলো কানে যেতেই রক্তচক্ষুতে ওদের দিকে ফিরে তাকায় শ্রাবণ। মুহূর্তেই যেন হাতের মুঠো শক্ত করে চোখ দুটো রক্তবর্ণ ধারণ করে তার। ব্যাপারটা বুঝতে পেরে চাঁদনী সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। তার কাছে হাতজোড় করে বলে,

“প্লিজ শ্রাবণ এখানে আর দাঁড়াবেন না। আমার সাথে বাসায় চলুন। এখানে থাকা ঠিক হবে না। আমি কোন রকম ঝামেলা চাইনা।”

কথাটি বলেই ওর হাত ধরে আবারও সামনে এগিয়ে যেতে চায় সে। তখনই ঐ লোকগুলো এসে ওদের সামনে দাঁড়ায়। নেশা ভরা গলায় ঢুলতে ঢুলতে বলে,

“কেন মামনি এত তাড়া কিসের তোমার। আমাদের কেও তো একটু সময় দাও। শুধু সুন্দর ছেলেদের পিছনে ঘুরলে হবে? আমরা অসুন্দর বলে কি আমাদের সাথে থাকা যায় না?”

কথাটি বলেই চাঁদনীর হাত ধরার জন্য হাত এগিয়ে দেয় একজন। সাথে সাথে লোকটির হাত ধরে ফেলে শ্রাবণ। অগ্নী দৃষ্টিতে তাকায় তার দিকে। মুহূর্তেই ওর চোখ দুটো টকটকে লাল হয়ে যায়। চোখের মনি লাল বর্ণ ধারণ করে। এমন ভয়ঙ্কর রূপ দেখে বেশ ভয় পেয়ে যায় লোকগুলো। কিন্তু তারা ভাবে তারা নেশার কারণে ভুল দেখছে। তাই চোখ ডলে নিয়ে বলে,

” আমি যা দেখছি তোরাও কি তাই দেখছিস? ওর চোখ কি আসলেই লাল হয়ে গেছে?”

ওর প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার সুযোগ পায় না বাকিরা। মুহূর্তেই শ্রাবণ নিজের ভ্যাম্পায়ার রূপ ধারণ করে। কিছুক্ষণের মাঝেই একে একে সকলের গলায় নিজের বিষাক্ত দাঁত বসিয়ে দিয়ে রক্ত চুষে মেরে ফেলে। ঘটনার আকস্মিকতায় চাঁদনী যেন পাথর হয়ে যায়। তার সারা শরীর থর থর করে কাঁপতে শুরু করে। এমন নৃশংস ঘটনা সে আগে কখনো দেখেনি। এত ভয়ানক দৃষ্ট সহ্য করতে না পেরে এক সময় জ্ঞান হারিয়েছে ঢলে পড়ে সে।

চলবে,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here