ভয় আছে পথ হারাবার পর্ব -৩৪+৩৫+৩৬+৩৭

#ভয়_আছে_পথ_হারাবার
ফারিশতা রাদওয়াহ্ [ছদ্মনাম]

৩৪,,
(এলার্ট! বাচ্চারা দূরে থাকো☠️☠️)

আটতলার ছাদের উপর রেলিঙে হাত ঠেকিয়ে ঝুঁকে দাঁড়িয়ে আছে অরিক। পাশে তিলোও প্রায় একই ভঙ্গিমায় দাঁড়িয়েছে। পূর্ণ চাঁদ আকাশে নেই। যতটুকু আছে, সে আলো অরিকের চুলগুলোতে যেন প্রতিফলিত হচ্ছে কিছুটা। সে নির্মেদ, সুঠাম, মানানসই উচ্চতার, যদিওবা বলতে পারি সেরকমটা, বিধ্বংসী সুন্দর একটা যুবক সে না হলেও যথেষ্ট যোগ্যতা রাখে সেরকম একটা তকমা পাওয়ার। তার চোখগুলো যেন অবাস্তব কোনো জগতের রাস্তা দেখিয়ে টেনে নিয়ে চলে সেখানে।

মৃদুমন্দ বাতাসে গরমটা কমই লাগছে। মাঝে মধ্যে বাঁদর উড়ে গেলো মাথার ওপর থেকে। এখানে দৃশ্যমানভাবে উপস্থিত দুটি জীব ছিলো এতক্ষণ একদম নির্বাক। দুটি ম্যানিকুইন, যারা শপিংমলে দোকানের সামনে একটা দাম্ভিক ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকে।

তিলো দূরের রাস্তার আলো থেকে চোখ সরিয়ে আকাশের দিকে তাকালো। তাচ্ছিল্য ভরে হেসে উঠলো এরপরই। অরিক মুখ ঘুরিয়ে ওর হাসির দৃশ্যটা নিজের চোখ দিয়ে লুফে নিলো। তিলো ওর দিকে ফিরে তাকাতেই অরিক চোখের ইশারায় ওকে হাসির কারণ জিজ্ঞাসা করলো। তিলো দীর্ঘ একটা নিশ্বাস ফেলে বললো,
-আমাদের মাথার ওপরের আকাশটা একটা ভ্রম। তাই না?

অরিক ভ্রু কুঁচকে বললো, ‘কেন?’

-যতগুলো নক্ষত্র দেখছি ইতিমধ্যে তাদের মাঝে কতোগুলো মারা গিয়েছে। কিন্তু এখনো দেখছি। অনেক শহরগুলোর সার্বিক অবস্থার মতো তাদের যাত্রা। অনন্ত অসীম। কিন্তু নিজের শেকড় ভোলা।

অরিকও এবার একবার তাকালো তারাভরা আকাশটার দিকে। আবারও মুখ নামিয়ে নিলো।

বহুদিন আগে খোদ নক্ষত্রগুলোর মৃত্যুর পরেও তাদের দ্যুতি এখনো যাত্রা করে চলেছে ব্রহ্মন্ডের মধ্যে দিয়ে। শহরগুলোর মতোই। তারা বেখেয়ালি, বেপরোয়া। কল্পিত জীবনের ঐন্দ্রজালকে প্রতিনিয়ত বাস্তবিক রূপ দিচ্ছে বা নকল করে চলেছে। অস্থির, উৎফুল্ল চিত্তে তারা কেবল নিজেদেরটুকুই ভেবে চলেছে, যখন তাদেরই আশেপাশে মারা যাচ্ছে ধীরে ধীরে ধুঁকে ধুঁকে, তাদের লুটতরাজ চালানো গ্রহটা। কে ভাবে তার কথা? থাকছি সেখানে। কিন্তু সেটাই নষ্ট করে চলেছি। কয়েকদিন আন্দোলন হয় ‘সেভ দ্য আর্থ’। যে আন্দোলন করে সে একটা প্রাইজ পাবে। নতুন কোনো খবর আসার আগে এই ধাক্কা সামলাতে সময় নেবে। তাকে কিছুদিন টিভিতে দেখা যাবে, সংবাদপত্রে পরিচিত মুখ হয়ে উঠবে। যেটা তাকে পরিণত করবে যাকে ম্যাগাজিন আর সংবাদপত্ররা বলে থাকে ‘সেলিব্রেটি’, যেটাকে লোকজন মনে করতো সেটা নিজেই একটা আলাদা পেশা। কিছুদিন দৃঢ়কণ্ঠে ভাষণ দেবে। পারসন অব দ্য ইয়ার হয়ে নিজের আখেরি গুছিয়ে নেবে। কয়েকদিন আমজনতা তাকে কদর করার পাশাপাশি তাকে অনুকরণ করার একটা ঘোর লাগিয়ে দেবে। এরপর সে সেই সুযোগগুলো পেতে থাকবে যেগুলো আসলে তার যোগ্যতায় যায়না কখনোই। সে নিজের ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়বে। আর তারপর? তারপর সে একটা পর্যায়ে পৌঁছে বাকিসব শান্ত। তাকে তার ব্যক্তিগত জীবনের বাইরে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। পরিবেশ আবার পূর্বের ন্যায়।

যদিও তিলোর গাত্রবর্ণ তার পরিবারের বাকি সদস্যদের থেকে নাটকীয়ভাবে ভিন্ন রকমের ছিলো, তার সাথে তার বাবা-মায়ের চেহারার বৈশিষ্ট্যগুলো ছিলো লক্ষণীয়ভাবে একইরকম। এবং কাকতালীয় কিনা জানা নেই। অরিকের সাথে তার চেহারায় কিছুটা মিল ছিলো। বিশেষ করে তাদের ভ্রুযুগল। তারা ছিলো যেন চারজোড়া জমজ। প্ল্যাগ না করেও তেমনি চিকন এবং একটা রেখায়। এলোমেলোভাবটা ছিলোনা। আর তাদের আচরণের ক্ষেত্রে একটা বৈশিষ্ট্য। তারা মাঝে মাঝেই নিজেদের নিরবতা দিয়ে পরিবেশটা গম্ভীর করে তোলার চমৎকার একটা গুণের অধিকারী। ফলে সে মূহুর্তে কৌতুকগুলোকেও মনে হতো বিশেষ অর্থবহ৷

-তুমি কি এখনো তাকে ভালোবাসো?

নিস্তব্ধ পরিবেশে হঠাৎ অরিকের প্রশ্নটায় তিলো চমকে উঠলো। ওর বুঝতে সময় লাগেনি অরিক কার কথা বলছে। তিলো একপেশে হেসে বললো,
-আমি থামাতে পারবোনা আমাকে। কিন্তু তোমায় ঠকাবো না।

অরিক নিজের কপালের উপর পড়া চুলগুলো ডানহাতের আঙুল দিয়ে ঠিক করতে করতে বললো,
-তার চুলগুলো নাকি আমার মতো? আমি জানি না। সবাই বলে আরকি।

-আমি খেয়াল করিনি।

-কার টা? আমাকে দেখেছো কখনো ঠিক করে?

-অস্বীকার করবো না। এখনো সেভাবে নয়। এটা তুমি বলতে পারো, লজ্জা।

অরিক মৃদু হাসলো। কিন্তু কিছু বললো না। তিলো একদৃষ্টিতে ওর দিকে চেয়ে আছে এই মূহুর্তে। অরিক এখন চশমা পড়ে নেই। ওর ছোট ছোট চোখগুলো চেহারার সাথে মানানসই। বরং চোখ বড় হলে খারাপ লাগতো। অরিক এখন তিলোর স্বামী না হলে, তিলো উপমা দিতো গরুর মতো।
অরিক ওর দিকে না তাকিয়েও বুঝতে পারছে যে, ও এখন অরিকের দিকেই তাকিয়ে আছে। অরিক একটু লজ্জামিশ্রিত কন্ঠে ডা. এজাজুল ইসলামের মতো করে বললো,
-আমার লইজ্জা লাগে।

তিলো হঠাৎ করে শব্দ করে হেসে দিলো। গম্ভীর ভারী বাতাস কেটে সেখানে ফুরফুরে একটা পরিবেশ তৈরি হলো। বাক্যটা পরিস্থিতির গাম্ভীর্যতা দূর করার একটা হাতিয়ার ছিলো মাত্র। হাসি এক অদ্ভুত ক্রিয়া। যার প্রতিক্রিয়া বরাবরই একটা মিষ্টি পরিবেশ। তিলোর হাসিতে অরিক ইন্ধন যোগাড় করে নিলো। রেলিঙের উপর রাখা তিলোর হাতের উপর সে হাত রাখলো। তিলো তাতে কিছুই বললো না। অরিক ওর না বলাটাকেই অনুমতি ধরে নিয়ে তিলোর পিছনে গিয়ে দাঁড়িয়ে ওকে নিজের বাহুডোরে আবদ্ধ করে নিলো। সজ্ঞানে অরিকের ছোঁয়া পেয়ে তিলো শিউরে উঠছে বারবার। অরিক নিজের মুখটা গুঁজে দিলো সেই পাখির নীড়ে, যাকে জগৎ জানে তার স্ত্রীর বন্য চুল হিসাবে। চুলের শ্যাম্পুর ঘ্রাণটা যেন আজ ফিকে। সেই গন্ধ নির্লজ্জভাবে তিলোর মতোই। তিলো অরিককে বাঁধা দিলো না৷ আবেশের বহিঃপ্রকাশ ঘটালো নিজের হাতের আঙুলগুলোর সামান্য বর্ধিত নখগুলোর দাগ অরিকের হাতের উপরিভাগে বসিয়ে দিয়ে। কেবল নিজের অস্বস্তি প্রকাশ করে বললো,
-কেউ এসে পড়লে?

তিলোর কন্ঠে আশঙ্কা। অরিক ওর চুলগুলোতে মুখটা গুঁজে রেখেই বললো,
-আসবে না। সানজিদ আছে।

-সানজিদ কে?

-এই বাড়িটার মালিক আঙ্কেলের ছেলে।

তিলো তিক্ত কন্ঠে বললো,
-ওই গায়ে পড়া ছেলেটা।

-উঁহু। ও মোটেই গায়ে পড়া না৷ ও আসলে মিশুক। আর যেমন বলে থাকি, জলি মাইন্ডের মানুষ। সে যদি ট্রেনের টিকিট কাটতে লাইনে দাঁড়ায় তো কিছুক্ষণের মাঝেই সামনে পেছনে নিজের বন্ধু বানিয়ে আড্ডা দিতে শুরু করে দেবে। যদিনা তোমার মতো মানুষ থেকে থাকে তাহলে৷ ও প্রথমদিন থেকেই তোমার কথা জানে।

-তুমি ওর সাথে কথা বলো?

-আমার বন্ধু বলতে পারো।

তিলোকে হুট করে নিজের দিকে ফিরিয়ে নিয়ে ওর শাড়ির ওপর থেকেই তিলোর মেরুদণ্ডের দুপাশের উঁচু উঁচু পেশিগুলোর ওপর নিজের হাত রেখে অরিক ওর মুখের দিকে তাকিয়ে বললো,
-জরুরি তো নয় যে নতুন স্বামীদেরকে বেহায়া হতে হবে, নাকি হতে হয়?

তিলো কয়েক সেকেন্ড অরিকের চোখের দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে ওর বুকে একটা ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিয়ে বললো,
-আমি চিন্তা করছি, আমার সন্তানেরা তোমার চোখ রাঙানি দেখে একদমই ভয় পাবে না। তারা যদি আমার স্বভাব পেয়ে থাকে, তবে তাদের মানুষ করা কতোটা কষ্টসাধ্য একটা ব্যাপার হবে। তোমার চোখ খুব বড় বড় করলেও আমার সমান হবে না।

অরিক ওর কথা শুনে মাথা নিচু করে দুবার ডানে এবং দুবার বামে নাড়িয়ে বললো,
-তোমার সন্তানেরা! কতোজন চাও? বাবাজানা, আমি ভেবেছিলাম, তুমি এখনো অনেক ছোট।

বাবাজানা! আমার প্রিয়! ডাকটা তিলো শুনে সামান্য কেঁপে উঠলো। নতুন নতুন অনুভূতিগুলো একদমই অপরিচিত তিলোর কাছে। তিলো খেয়াল করলো। অরিক করলোনা। ডাকটা তিলোর অস্থির হৃদয় মূহুর্তেই ঠান্ডা করে দেওয়ার মন্ত্র যেন।
তিলো সেটা পাত্তা না দিয়ে বললো,
-আমি অবুঝ নই। একুশ বছর!

অরিক এক ভ্রু উঁচু করে বললো,
-একুশ হয়েছে তোমার?

-দুমাস পর হবে।

-তো এখন থেকেই একুশ একুশ করে চিৎকার করছো কেন?

-এটা একটা কথার কথা আসলে। যেমন পৌঁনে চারটা বাজলেই বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ‘এই তো চারটা বাজে’ বলে থাকি। তাই আমি আরো তিন চার মাস আগে থেকেই বলছি।

-তাহলে একুশের বুড়ি, আমি যে আপনার অনুমতি না নিয়ে এতো বড় একটা অন্যায় করে ফেললাম। তো এখন এ সম্পর্কে আপনার বক্তব্য কি?

তিলো মৃদু হেসে বললো,
-অনুমতি কি কেবল মুখেই দিতে হয়। মজা করোনা। আমি জানি যে, তুমি আমার সম্মতি সাপেক্ষেই ছুঁয়েছো। যদি তোমার মনে হতো, আমি অনুমতি দেইনি, তো তুমি সেই মূহুর্তে আমাকে ছেড়ে দিতে। নিচে চলো।

অরিক তিলোর সম্পূর্ণ কথা অগ্রাহ্য করে ওর খুব নিকটে দাঁড়িয়ে কন্ঠে দৃঢ়তা এনে বললো,
-আমি জানি, জীবনে প্রথম ভালোবাসার স্থান ভিন্ন এবং কখনোই সে স্থান কাউকে দেওয়া যায়না। কিন্তু আমি কেবল তোমাকে তোমার শেষ মূহুর্ত পর্যন্ত সঙ্গ দেওয়ার অনুমতি চাই। বা আমার শেষ পর্যন্ত আমার পাশে থাকবে৷ তোমার গন্তব্য।

তিলো নিশ্চুপ থেকেই সম্মতি প্রদান করলো। অরিক একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেললো। অরিকের ঠোঁটের কোণের হাসিটা ওর জন্য তিলোর প্রেমকে আরও উসকে দিলো।

ওরা সবসময় একে অন্যের সাথে জোড়া লেগেছে একটা অসমাধিত ধাঁধাঁর দুটো টুকরোর মতো। অরিকের ধ্রুম্রময়তাটি গিয়ে জুড়েছে তিলোর দুর্ভেদ্যতার সাথে, তিলোর নির্জনতাটি অরিকের জনবহুলতার সাথে, ওর ঔদাসিন্য ওর সংযমের সাথে। অতঃপর তাদের দুজনের নিরবতা মিলেমিশে এক হয়ে গিয়েছে। একজন অনাহুত অপরিচিতের মতো কক্ষ থেকে পিছলে বেরিয়ে গিয়েছে অস্বস্তি সে বহুক্ষণ আগে।
তারপর আর কিছু ছিলোনা যেগুলো কখনো জুড়বে না। যা ঘটেছে সেরাতে, তা ছিলো প্রণয় চরিতার্থ করার সর্বোচ্চ পন্থা। ক্ষুদ্র একটা সময়ের জন্য তারা অস্বীকার করতে পেরেছিলো সেই পৃথিবীকে যেখানে বাস করতো তারা আর ওটার যায়গায় ডেকে এনেছিলো অন্য আরেকটিকে, যেটি একইভাবে সত্য।

তিলো নিজের শরীর ছড়িয়ে দিয়ে অরিকের উপর শুয়ে পড়লো যেন একটা তোষক অরিক, তার চিবুক রাখা ছিলো নিজের হাতের লম্বাটে আঙুলগুলোর উপর, যেগুলো অভিজাত ভঙ্গিতে পেতে রাখা ছিলো অরিকের অনাবৃত বুকের উপর। চোখজোড়া অরিকের মুখে নিবদ্ধ। নিরবতম কিছু মূহুর্ত কাটিয়ে তিলো অরিকের পাশে শুয়ে পড়লো। অরিক ওকে নিজের বাহুডোরে আঁকড়ে ধরে বললো,
-আমার একটা পরামর্শ শুনবে বাবাজানা?

-হুম।

-নিজের পড়াশোনা শেষ করে নাও৷ তারপর আর কারো কথা ভেবো।

-হুম।

-এখন ঘুমিয়ে পড়ো।

তিলো আর কথা বাড়ালো না। নিজের উদ্ভট চিন্তাগুলোকে অস্বস্তির মতোই মাথা থেকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দিয়ে নিজের বড় বড় টানা টানা হরিণী চোখজোড়া বুজে ফেললো।
#ভয়_আছে_পথ_হারাবার
ফারিশতা রাদওয়াহ্ [ছদ্মনাম]

৩৫,,

তিলোত্তমার বিয়ে উপলক্ষে আনিস সাহেব অফিস থেকে কয়েকদিন ছুটি নিয়েছেন। সেই সুবাদে সকালের নাস্তাটা সকলে একসাথে করতে বসেছেন তিলোর অনুপস্থিতিতে কেবল। এমনিতে বাড়ির কারো একসাথে সকাল এবং দুপুরে খাওয়া হয়না। শুধু রাতেই হয়। একেকজন একেক সময় বাড়ি থেকে বের হওয়ার আগে খেয়ে নেয়।

আনিস সাহেবের পাশের চেয়ারটায় নাসীরা পারভীন বসতেই আনিস সাহেব বললেন,
-ছোটমা ফোন করেছিলো তোমাকে? ভালো আছে?

নাসীরা পারভীন স্বাভাবিক কন্ঠেই বললেন,
-সন্ধ্যায় করেছিলো একবার। সে নিজে যেচে গিয়েছে। খারাপ থাকবে কেন?

আনিস সাহেব কথা বাড়ালেন না। নাসীরা পারভীন যে এখনো ধাক্কাটার রেশ ধরে রেখেছেন বুঝতে পারলেন।

তুলি ইশানকে কোলে নিয়ে খেতে বসে বেশ ঝামেলায় পড়েছে। ছেলেটা বড্ড জ্বালায়! হাত বাড়িয়ে টেবিলের উপর থাকা সবকিছু ফেলে দিতে চাচ্ছে। তুলি চোখ রাঙিয়ে ওকে দাবড় দিলো। কিন্তু তাতে কোনো লাভ হলোনা। ছোট্ট ছোট্ট টিকটিকির পায়ের মতো আঙুলগুলো এক করে হাতটা গালে ঢুকিয়ে দাঁতহীন একটা মিষ্টি হাসি দিয়ে ও আবারও দুষ্টুমি করতে শুরু করলো। তুলি ওর হাসি দেখে দীর্ঘ একটা নিশ্বাস ফেললো। ছোট্ট ফোলা গাল দুটোয় সামান্য গর্তের সৃষ্টি হয় ও হাসলে। বংশগত ত্রুটি এটা। মানুষের তীর্যকভাবে হাসির জন্য দ্বায়ী মাংসপেশি জাইগোম্যাটিক মেজরের ত্রুটির কারণে গালে টোলের সৃষ্টি হয়। মাংসপেশিটা স্বাভাবিকের তুলনায় ছোট বা দুভাগে বিভক্ত হয়ে গেলে চিবুকে বা গালে টোল পড়ে। চিবুকের টোল সবসময় দেখা যায়। কিন্তু গালের টোল হাসলে বা কোনো কথা বলতে হাসির ভঙ্গিমা চলে আসলে দেখা যায়। এটা বংশগতভাবে হয়।
ইমনের টোল পড়ে গালে। সেখান থেকেই ইশান পেয়েছে এটা।

নাসীরা পারভীন তুলির কোল থেকে ইশানকে নিয়ে বললেন,
-শান্তিতে খা এবার।

ইশান ওনার কোলে গিয়ে ওনার মুখ খামচে ধরলো। ওনি সামান্য ব্যথা পেয়ে বললেন,
-ফাজিল ছেলে। সারাক্ষণ হাত পা চলে! চুপ করে বোস। আমি খেয়ে নিই।

ইশান আবারও হেসে দিয়ে নিজের আকাজে মনোযোগ দিলো। হাত দিয়ে টেবিলের উপর থাবা দিয়ে শব্দ করে চলেছে।
তুলি করুণ দৃষ্টিতে একবার ওর দিকে তাকিয়ে শেষমেষ নিজের নেওয়া উদ্যোগ বাস্তবায়ন করেই ফেললো।
কোনোমতে গালে একটা রুটি ঠেসে দ্রুত খেয়ে পানি খেয়াল নিলো। তারপর আনিস সাহেবের খাওয়া শেষ হওয়ার আগেই হঠাৎই বলে উঠলো,
-আব্বু, আমি আবারও ইমনের সংসারেই ফিরতে চাই। ইশানের বাবা ও। ও যা বলবে মেনে নেবো। আবার ওকে বিয়ে করবো।

তুলির কথাগুলো আনিস সাহেবের কানে পৌঁছাতেই ওনি থমকে গেলেন। এদিকে নাসীরা পারভীন কটমট করে তাকালেন তুলির দিকে। চোখ দিয়ে শাসিয়ে চলেছেন এমন বোকামির জন্য।

তুলির বিশ্বাস ছিলো, ইমন এখনো হয়তো ওকে ভালোবাসে। বিশেষ করে নিজের ছেলের জন্য অন্তত ওকে মেনে নেবে। যে ঝড়ই উঠুক তুলি এবার সামলে নেবে। কিন্তু ওর পক্ষে আর ইমনকে ছেড়ে থাকা সম্ভব না। তিলোর নতুন সংসার দেখে নিজের সুপ্ত ইচ্ছাটা আরো জোরদার হয়েছে।

আনিস সাহেব কোমল কন্ঠে বললেন,
-ওই বদ লোকের সংসার তুই আবারও করতে যাবি? আত্মীয় স্বজনের কাছে মুখ রাখতে তিলের বিয়েতে ডেকেছিলাম। এখন আবার তোর ওই হারা** সংসার করতে মন চাইছে! তুই পড়াশোনা শেষ করে নে, তারপর তোর আরও ভালো বিয়ে দেবো।

তুষার ভবিষ্যৎ পরিস্থিতি আন্দাজ করতে পেরে দ্রুত খাওয়া শেষ করে উঠতে নিতেই নাসীরা পারভীন ওকে ইশারায় ইশানকে নিয়ে যেতে বললেন। তুষার অগত্যা সেটাই করলো। বড়দের বিষয়ে তুষার তিলোর মতোই কখনো থাকতে চায়না৷ বিশেষ করে ঝামেলাপূর্ণ বিষয়গুলোতে। তুলি যতটা সম্ভব নিজেকে বাঁচিয়ে বললো,
-ইশান তো ওর বাবাকে তাহলে কখনো পাবে না। ওর কি হবে?

-আমরা কি মরে গিয়েছি? আমার সামর্থ্য নেই আমার নাতিকে মানুষ করার যে তোমার ভিক্ষা চাইতে যেতে হবে? তোমার আবার বিয়ে হলে ও বাবাও পেয়ে যাবে।

-পরের ছেলেকে কে রাখবে? ওর নিজের বাপই তো ওকে অস্বীকার করে।

আনিস সাহেব ইমনের নামে আরও কিছু বললেন। তবে কথাগুলো একসময় অসহনীয় হয়ে আসতেই তুলি কেঁদে দিয়ে চিৎকার করে উত্তেজনায় বলে উঠলো,
-ভুলগুলো তো আমারও ছিলো। কিন্তু আমি এখনও ওর সাথেই থাকতে চাই। অরিক তো তিলের সাথে ঠিকই সংসার শুরু করে দিয়েছে। আমি কেন করবো না? ইমন ছাড়া আর কাউকে বিয়ে করা আমার পক্ষে কখনো সম্ভব না।

আনিস সাহেব এতক্ষণ উত্তেজিত হয়ে থাকলেও এবার কম্পিত কণ্ঠে বললেন,
-তোর ভুল মানে?

তুলি ওনার কথার উত্তর দেওয়ার প্রয়োজনবোধ করলোনা। আসলে ওর আর সাহস নেই আনিস সাহেবকে সবটা বলার। তুলি উঠে চলে গেলো সেখান থেকে। আনিস সাহেব ওকে ডেকেও থামাতে পারলেননা। মেয়ের স্পর্ধায় ওনি বেশ অবাক হয়েছেন। তুলি চলে যেতেই ওনি নাসীরা পারভীনের দিকে রুক্ষ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে তুলির ভুলটা জিজ্ঞাসা করায় নাসীরা পারভীনও উঠতে নেন। আনিস সাহেব এবার কর্কশ কন্ঠে চিৎকার করে ওঠেন। নাসীরা পারভীন এমনটা আশা করেননি একদমই। আনিস সাহেব নাসীরা পারভীনের সাথে জোর গলায় খুব একটা কথা বলেননা৷ ঝগড়ার সময় বরং ওনি নাসীরা পারভীনকে মানিয়ে নিতে চেষ্টা করেন। মাঝে মাঝে খুব বেশি বাড়াবাড়ি হয়ে গেলে তেতে ওঠেন। আজ ওনার ধমকের সুরে কথাটা নাসীরা পারভীনের এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। ওনি মনে মনে তুলির উপর রেগে গেলেও আনিস সাহেবকে ওর বিষয়ে বলে দেন।

তুলি গতানুগতিক একটা ধূর্ততার শিকার মাত্র। বিয়ের কিছুকাল পরে ও জানতে পেরেছিলো, ইমনের অফিসেই একটা মেয়ের সাথে ওর সম্পর্ক রয়েছে। সে তুলিকে সময় দিতো কম। গুরুত্ব কমিয়ে দিয়েছিলো। এটা নিয়ে ইমনের বাড়িতেই তুলির শাশুড়ী ইমনকে খুব বাজেভাবে শাসিয়েছিলেন। ঘরে বউ রেখে সে বংশের মানসম্মান নষ্ট করছে, সহ ইত্যাদি ইত্যাদি। ইমন মায়ের কথা না শুনে বরং বেপরোয়া হয়ে ওঠে। তুলির গায়ে হাত তোলে পর্যন্ত। তবে আরেকদিকে সে ঠিক ছিলো। যখনই তার বৈবাহিক সম্পর্কের সর্বোচ্চ উসুলের কথা উঠতো, সে ছাড় দিতো না। আবার সেটা তুলির চাহিদা মতোও একদমই নয়৷ নিজের প্রয়োজন অনুসারে। ইমনের বন্ধু আবিরের নিয়মিত যাতায়াতে পাল্টে যায় অনেক কিছু। ইমনের বড় ভাই তার স্ত্রী পুত্র নিয়ে সে বাড়িতে খুব কমই আসতেন। তিনি কুমিল্লায় থাকেন চাকরির সুবাদে। ইমনের বাবা বেঁচে নেই। ওর মা বড় ছেলে, ছোট ছেলে আর মেয়ের বাড়িতে সারাবছর ভাগ করে কয়েকমাস করে থাকেন৷ ইতিমধ্যে তুলি আবিষ্কার করলো, সে সন্তান ধারণ করেছে। ছোট্ট একটা প্রাণকে সে নিজের সাথে বহন করে চলেছে। সে ইমনকে জানালো। ইমন সেদিন ভীষণ খুশি ছিলো এবং সে তুলিকে কথা দিয়েছিলো যে, তার বাইরের সম্পর্কটা থেকে সে বেরিয়ে আসবে৷ তুলি নিজেও এটা নিয়ে খুব খুশি ছিলো এবং তুলির প্রতিটা বিষয় নাসীরা পারভীন জানতেন। তিনি আবিরের বিষয়ে তুলিকে সতর্কও করতেন। তবে ইমন এতো বেশি নিজের বেস্ট ফ্রেন্ডকে বিশ্বাস করতো দেখে তুলি নিজেও আবিরকে খুব বেশি বিশ্বাস করতে শুরু করে। এটা ইমনকে অনুকরণ করার একটা ঘোরে আবিষ্ট হওয়ার ব্যাপার ছিলো
সবটা একটা শিল্পীর আঁকা সুনিপুণ ছবির মতো সুন্দর ছিলো। কিন্তু বিপত্তিটা ঘটে আবিরের আবির্ভাবে। যেন সেই ছবিতে রঙের শেষ প্রলেপটা লেপনের আগেই শিল্পীর ছোট্ট বাচ্চাটার দুরন্তপনায় হাতে ধাক্কা লেগে সবটা নষ্ট হয়ে যায়। আবির তুলিকে জানায়, ইমন আসলে ওর কলিগের সাথে তখনও প্রনয় সম্পর্কটায় জড়িয়ে ছিলো। তুলির মনোবল একদমই ভেঙে যায়। ও ইমনের সাথে এবিষয়ে কথা বলতে চাইলেও আবির ওকে অদ্ভুত এক পরামর্শ দেয়। সবটা ও ঠিক করে দিতে পারবে। কাটা দিয়ে কাটা তুলতে হবে। তুলি ওর সাথে প্রণয় সম্পর্কের একটা অভিনয় করলেই ইমন নিজের ভুলটা বুঝে বেরিয়ে আসবে সেই সম্পর্ক থেকে। তুলি কয়েকঘন্টা চিন্তা করে আবিরের প্রস্তাবে রাজি হয়ে যায় রোমাঞ্চকর একটা অনুভূতি প্রাপ্তির নেশায়। আবির এরপর থেকে ওকে খারাপভাবে ছুঁতে শুরু করে, যেটাকে তুলি অভিনয়ের একটা অংশই ভেবেছিলো। ওর অস্বস্তি হলেও বাঁধা দেয়নি। তুলি মাঝে মাঝেই বলতো, এসব ইমনের সামনে করবেন। কিন্তু আবির বরং গোপনেই করতো। তুলির নিজে বুঝতে বুঝতে বেশ দেরি হয়ে গিয়েছে। ও নাসীরা পারভীনকে বলে দেয় এরপর সব। নাসীরা পারভীন সেদিন ওর বাড়িতে এসে ওকে দুটো শক্ত থাপ্পড় বসিয়ে দেয়৷ হয়তো আরো মারতো। কিন্তু তুলির শারীরিক অবস্থার কথা ভেবে থেমে যান। তুলির বোকামিতে নিজে মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়েন। সুন্দরীরা বোকা হয়, সংসার টিকিয়ে রাখতে লড়াই করতে হয়৷ এসব যে সত্যি, তা ওনি তুলিকে দিয়ে বুঝলেন। মেয়ে তাকে বিষয়টা প্রথমে জানালোও না? কি ভূগোল পড়ালো সেই ছেলে যে, মেয়ে তার তাকেই ভুলে গিয়েছে?
তুলি এরপর স্বীকার করলো, ওর নিজেরও একসময় বেকার আবিরকে ভালো লেগেছে, তার সঙ্গ পেতে। সারাদিন বাড়িতে একা থাকে। রাতে ক্লান্ত ইমন ওর সাথে কয়েকটা কথা বলেই শুয়ে পড়ে। তুলি একাকিত্বে ভুগতো। সুযোগ দুজনেই নিয়েছে। নাসীরা পারভীন আবিরের সাথে কথা বলে বিষয়টা মিটমাট করতে চাইলে আবির ওনাকে কিছু লিপিবদ্ধ তথ্য দিয়ে হুমকি দেয়। সেগুলো ছিলো তুলি আর আবিরের কিছু বিশেষ মূহুর্তের ছবি আর কথাবার্তা। টাকা দাবি করে। নাসীরা পারভীন একবার নিজের ব্যাংকে জমানো টাকাগুলো দেন।
এরপর আবার দাবি করলে নাসীরা পারভীন জানান, ওনি পুলিশে যাবে। তাতে মেয়ের সম্মান গেলে যাক। ওনার দৃঢ়তায় আবির আর ওনাকে জ্বালায়নি।
ইশানের জন্ম পর্যন্ত আবির শান্ত ছিলো। তবে ইশানের জন্মের পর সে ইশানের পিতৃত্ব দাবি করে বসে একদমই অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে। প্রমাণ হিসাবে সেইসমস্ত লিপিবদ্ধকৃত তথ্য।
এখনো সেসব দিয়ে তুলিকে ভয় দেখিয়ে ওর সাথে সম্পর্ক রেখেছে আবির। সেগুলো আনিস সাহেবের হাতে পড়ার ভয়ে।

তুলি নিজের রুমে এসে দেখে তুষার ইশানকে নিয়ে খেলছে। তুলিকে কাঁদতে দেখে তুষার একবার ওর মুখের দিকে তাকিয়ে আবারও ইশানে মনোনিবেশ করলো। তুলি ইশানকে কোলে নিয়ে তুষারকে কড়া গলায় রুম থেকে বেরিয়ে যেতে বললো। সে একা থাকতে চায়৷ ইশান হাত বাড়িয়ে তুষারের কাছে যাওয়ার জন্য কান্না শুরু করে দিলো। তুষার ওকে কোলে নিয়ে বললো,
-তুই একাই থাক। আমি আমার জামাই নিয়ে যাচ্ছি।

তুলি নিজের গালে লেপ্টে থাকা পানি মুছে বললো,
-তোর জামাই কে?

তুষার একবার ইশানের দিকে তাকিয়ে আবার বললো,
-না থাক৷ আমার মেয়ের সাথে তোর ছেলের বিয়ে দেবোনা। যদিও ইশানকে আমার জামাই হিসাবে অনেক পছন্দ। কিন্তু ওর বাপ মা দুটোর চরিত্রই মুড়িঘণ্ট মার্কা। দুটোর মাথাতেই মশার বুদ্ধি। আমার মেয়ের জীবনটা তেজপাতা হয়ে যাবে।

বলেই ইশানের গাল টিপে ধরে সজোরে শব্দ করে একটা চুম্বন করলো। ইশান ওর শার্টের বোতাম নিয়ে গবেষণায় ব্যস্ত। তুলি ড্যাবড্যাব করে তুষারের দিকে তাকিয়ে ওর বলা কথাগুলো বিশ্লেষণ করেই তেতে উঠলো। ওকে কিছু বলার আগেই ও দৌড়ে বেরিয়ে গেলো রুম থেকে।

আনিস সাহেব সবটা জানার পর খানিকটা ভেঙে পড়েছেন। এতোদিন কেবল ইমনেরই দোষ দিয়ে গিয়েছে। কিন্তু তারা দুজনেই যে একইরকম সেটা বুঝতে সময় লাগলো। তিনি যতোটা রেগে যাবেন বলে তুলি এবং নাসীরা পারভীন ভয় পাচ্ছিলেন, ততটা তিনি রাগেননি৷ বরং মুষড়ে পড়েছেন মেয়ে মানুষ করতে না পারার ব্যর্থতায়। নাসীরা পারভীন এখন ভয় পাচ্ছেন ওনি মানসিকভাবে আদৌও সক্ষম ছিলেন কিনা তুলির কীর্তি শোনার জন্য।

সোভিয়েত কৌতুকভ একটা মনে পড়ে এবিষয়ে,
এক শিয়াল বনের পাশ থেকে হেঁটে যাওয়ার সময় ঝোপের আড়ালে একটা মোরগ ডাকতে শুনলো। সে খুব খুশি হয়ে সেই মোরগের ডাক অনুসরণ করে ঝোপের আড়ালে গেলো। এরপর সেখানে বিশাল এক ধস্তাধস্তি হলো। অবশেষে শেয়ালের মৃতদেহ মুখে ধরে বেরিয়ে এলো এক নেকড়ে। শেয়ালটাকে ছুঁড়ে ফেলে নিজেকেই বাহবা দিয়ে বললো, ‘একটা বিদেশি ভাষা শেখার কতো গুণ!’

উৎকর্ষের বিচারে সোফিয়েত পণ্য বিশ্বমানের না হলেও তাদের ব্যঙ্গ এবং কৌতুক বরাবরই ছিলো খুব উঁচু মানের। বস্তুত শাসনব্যবস্থা যেখানে যত কঠোর কৌতুক রচনা সেখানে তত ব্যাপক।

সকালে তিলোর ঘুম ভাঙতেই নিজেকে সে অরিকের পাশে খুঁজে পেয়ে প্রথমে ধড়ফড়িয়ে উঠে বসলো। হঠাৎ করে মাথা থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলো পুরো বিষয়টা। নিজের দিকে তাকিয়ে আবারও শুয়ে পড়লো। গতরাতের কথা মনে পড়ে এখন দিনের আলোতে অরিকের ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকাতেও পারছে না ও। আবারও উঠতে গেলে অরিক ওর হাত টেনে নিজের অনাবৃত অতি স্বল্প লোমশ বুকে ফেলে ওকে আঁকড়ে ধরলো। তিলো চোখ বড় বড় করে বললো,
-জেগে আছো তুমি?

-কেবল উঠলাম।

-কি একটা অবস্থা!

-ভালো।

অরিকের ঘুম জড়ানো কন্ঠটা খুব নেশাক্ত শোনাচ্ছে। বাচ্চাদের কন্ঠের মতো লাগছে তিলোর কানে। তিলো হাত দিয়ে ওকে ছাড়িয়ে উঠতে গেলে অরিক আরো শক্ত করে ওকে ধরলো। তিলো মৃদু কন্ঠে বললো,
-আমার ক্ষুধা লেগেছে। এতো দেরি করে সকালে খাই না আমি৷ রাতেও ভালো করে খাইনি।

অরিক ওর চুলের মাঝে থেকে একটা লম্বা চুম্বন করে বললো,
-পেট ভরেছে?

-আজব! অরিক, আমার এখন নাস্তা করা প্রয়োজন।

-একটু থাকো।

তিলো চুপ করে ওর হৃৎস্পন্দনের শব্দ শুনছে। ‘লাব – ডাব’ শব্দজোড়াকে ঠিক এমনটা শোনা যায় বলে ওর মনে হয়না।
চুপ করে কিছুক্ষণ থেকে যখন ও বিরক্ত হয়ে উঠলো। তখন আবারও অরিককে ডাকলো। অরিক চোখ বুজে আছে। তিলো আবার চুপ। কিছুক্ষণ পর ওর অস্বস্তিটা বুঝতে পেরে অরিক ওর মাথায় আরেকবার ছোট করে চুম্বন করে বললো,
-একুশের বুড়ি বা হয়তো ভদ্রমহিলা, আমার কথা মানো আর তোমাকে ছাড়তে বলো।

তিলো দীর্ঘ একটা নিশ্বাস ফেলে বললো,
-ঠিক আছে। ছাড়ো আমাকে।

অরিক তিলোর শরীরের উপর থেকে হাত সরিয়ে নিতেই তিলো উঠে পড়লো। অরিক ঘুরে শুয়ে চোখ বন্ধ রেখেই বললো,
-বাবাজানা, সকালটা তোমার হাতের কফি দিয়েই শুরু হোক। আমাকে ডেকো।

তারপর আবার ঘুম অরিক। তিলো মৃদু হেসে বিছানা ছেড়ে উঠে পড়লো।
#ভয়_আছে_পথ_হারাবার
ফারিশতা রাদওয়াহ্ [ছদ্মনাম]

৩৬,,

সকালে শাওয়ার নিয়ে তিলো শোবার ঘরের দরজা খুলে বের হতেই লিভিং কাম ডাইনিং এর, ডাইনিং টেবিলের দিকে তাকালো। সেখানে গতকালকের সেই যুবতী বসে আছে। ডানহাতে কফি মগ আর বামহাতে একটা ম্যাগাজিন চোখের সামনে মেলে রেখেছে। তিলো জানতে পেরেছে মেয়েটার নাম রোৎশী। সে অরিকের বড় মামার বড় মেয়ে। তার পাশে বসে আছে তার বড় ভাই রাফি। সে মোবাইল স্ক্রোল করে চলেছে। সে গতকাল বিছানার তলা থেকে বেরিয়েছিলো। ওদের আরেকটা বোন আছে। কিন্তু সে আসেনি।
তিলোকে বের হতে দেখে রোৎশী তাকে মিষ্টি একটা হাসি উপহার দিয়ে ভ্রু নাচিয়ে জিজ্ঞাসা করলো,
-কেমন আছো ভাবি?

তিলো স্বাভাবিক কন্ঠে উত্তর দিলো, ‘ভালো।’

মেয়েটা ঠোঁট টিপে হেসে বললো,
-আচ্ছা, ঠিক আছে। ভাইয়া ওঠেনি।

তিলো হতাশার নিশ্বাস ফেলে বললো,
-নাহ্। তিনি এখনো ঘুম।

-তাতো হবেই। যতোই হোক, সারারাত জেগে প্রেম ….। আহহ্।

ওর কথা শেষ হওয়ার আগেই রাফি ওর হাতে চিমটি কাটলো। রোৎশী কটমট করে ওর দিকে তাকিয়ে বললো,
-শালার রাফু। চিমটি কাটলি ক্যান?

রাফি উত্তর না দিয়ে উঠে চলে গেলো সেখান থেকে। রোৎশী ওর দিক থেকে নজর সরিয়ে তিলোর দিকে তাকিয়ে দেখলো তিলো সেখানে নেই। রোৎশী হতাশ হলো তিলোকে লজ্জায় ফেলতে ব্যর্থতা মেনে নিয়ে।

তিলো যেন ওর সামনে থেকে পালিয়ে বেঁচে গিয়েছে। মেয়েটা বড়ই নির্লজ্জ বলে মনে হচ্ছে ওর। কিভাবে রাফির সামনে কথাগুলো বলতে যাচ্ছিলো! পরে মনে হলো, না ঠিক আছে। ওরা মজা করবে না তো করবে কে? তিলো নিজে থেকে একটু লজ্জাশীল হওয়ার পাশাপাশি রক্ষণশীলও যথেষ্ট। তাই বলে সবাই তো আর তা হবে না। রোৎশী তিলোর বয়সী প্রায়। তবে একটু বেশিই এক্ষেত্রে ম্যাচিউর বোঝা গেলো।

তিলো রান্নাঘরে গিয়ে দেখলো, কাজের মেয়েটার পাশাপাশি অরিকের বড় মামীও হাতে হাতে রান্না করছেন। তিলো বেশ লজ্জা পেলো। আজ তো ওর রান্না করা উচিত ছিলো। এতো দেরি হয়ে গিয়েছে ওর খেয়ালই নেই।
তিলো রান্নাঘরে ঢুকে রোৎশীর মাকে সালাম দিলো। ওনি উত্তর দিলেন ঠিকই তবে সেটা ঠিক আন্তরিকতার ধারে কাছেও ছিলোনা। তিলো সেদিকে পাত্তা দিলো না। হয়েই থাকে সংসারে এসব। নিজেদের রক্তের সম্পর্কের বাইরের মানুষগুলোর ক্ষেত্রে বাছবিচার বেশি করা হয়ে থাকে। কারণ সেখানে নির্বাচন করার সুযোগ থাকে। আর নিজেদের ভেতর তা থাকে না। এটা সোভিয়েত স্টাইলে নির্বাচন হয়ে থাকে আসলে।
এই কৌতুকটা এইরকম –
সোভিয়েত স্টাইলে নির্বাচন শুরু হয়েছে কবে থেকে?
-যেদিন ইশ্বর ইভকে সৃষ্টি করে আদমকে বলেছিলেন নিজের স্ত্রী বেছে নাও।

এখানে আসলে তাঁর আর কাউকে বেছে নেওয়ার সুযোগই নেই।
কিন্তু বাইরে কোথাও সম্পর্ক স্থাপনের ক্ষেত্রে বিশেষ করে প্রণয় ঘটিত সম্পর্কের ক্ষেত্রে গণতান্ত্রিক নির্বাচন হতে পারে। বেশ কয়েকজন প্রার্থীর মাঝে কাউকে বেছে নেওয়া আরকি।

তিলো কফি তৈরি করতে করতে আপনমনেই কথাগুলো ভেবে মনে মনে হেসে চলেছে।
কালো কফিতে চিনি ব্যতীত ঘি ঢেলে তিলো আবারও অরিকের রুমে প্রবেশ করলো।
অরিক তখনও উবু হয়ে বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। তিলো বেডসাইড টেবিলের উপর কফিটা রেখে অরিককে ডাকতে শুরু করলো। অরিক পিটপিট করে চোখ মেলে তাকালো। তিলো তা দেখে হেসে দিলো। এখানে হাস্যরসের কিছু নেই। কিন্তু তিলোর ভেতর একটা আনন্দ কাজ করছে, যার ফলে আশেপাশের প্রতিটা ঘটনা দ্বারাই মস্তিষ্কে যেন সুড়সুড়ি লাগছে। অরিক নিজেও হেসে দিয়ে উঠে বসলো। বিছানার ঠিক পাশে পড়ে থাকা টিশার্টটা গায়ে চড়াতে চড়াতে তিলো বললো,
-তুমি দেখতে পাও কি করে বলো তো ওই টুকু চোখ দিয়ে?

অরিক নাকের রন্ধ্রগুলো ফুঁসিয়ে বললো,
-নিজের চোখজোড়া একটু বড় বলে উঠতে বসতে আমাকে যে কথা শোনাবে আমি সেটা ভালো করে বুঝতে পারছি। এখন বলো, নাস্তা করেছো?

-নাহ্।

-কেন? তোমার না ক্ষুধা লেগেছে?

-তুমি ফ্রেশ হয়ে নাও একসাথে করবো।

অরিক আর কিছু বললো না। কফি মগে ঠোঁট ছুঁইয়ে ভ্রু যুগল উঁচু করে চুল পর্যন্ত উঠিয়ে বললো,
-এটার স্বাদ ভালো।

-অভ্রকে একবারও দেখিনি। ও কোথায়?

অরিক ওর দিকে না তাকিয়েই বললো,
-অভ্র সিমলা গিয়েছে বন্ধুদের সাথে। তোমার হঠাৎ অনুমতি দেওয়ায় ও ফিরে আসার সময় পায়নি। আজ ফিরবে৷ হয়তো এতক্ষণে বর্ডারের এপারেও চলে এসেছে। বেচারা একটা ব্যাচেলর পার্টির আয়োজন করতে চেয়েছিলো বিয়ের আগের রাতে। কিন্তু ও নিজেই ছিলোনা বিধায় হয়নি।

-এখানে আসবে?

-হুম।

আবারও দুজনের মাঝে কিছুক্ষণের নিরবতা শেষে অরিক বললো,
-সামনের সপ্তাহে আব্বু ছোটখাটো একটা রিসেপশনের ব্যবস্থা করেছে।
তিলোর দিকে তাকিয়ে বললো,
-তোমার কোনো আপত্তি আছে?

তিলো স্থির দৃষ্টিতে ওর দিকে এক মূহুর্ত তাকিয়ে থেকে বললো,
-নাহ্। কোনো আপত্তি নেই।

অরিক প্রত্যুত্তরে হেসে দিয়ে ওকে জানালো যে, আশাতীত উত্তরে অরিক সন্তুষ্ট।

তিলো সেখানে আর দাঁড়ালো না। বেরিয়ে এলো এই আশায় যে কোনো কাজ সে পাবে করার জন্য।

বিকালের দিকে অভ্র এসে উপস্থিত হয়েছে। সাথে তুষারও এসেছে তার কিছুক্ষণ পরই। অভ্র এসে কোনো ক্লান্তির চিহ্নমাত্র মুখে না রেখে আবদার জুড়ে বসলো আজ রাতে তারা নিজেদের ভেতর ছোট একটা পার্টি দেবে। শুধু এই জেনারেশন নিয়ে। প্রাক- বৈবাহিক পার্টিটা নষ্ট হয়ে যাওয়ার ক্ষোভ থেকেই বিবাহ পরবর্তী পার্টির আয়োজন করবে তারা। ওদের বাকি কাজিনদের মাঝেও সমান উত্তেজনা দেখা গেলো বিধায় ওরা আর নিষেধ করেনি।
অরিকের থেকে অনুমতিপ্রাপ্ত হতেই অভ্র ছুটলো সানজিদের কাছে। তারা ছাদে আয়োজন করবে এসবের। অরিকের মামী, খালারাও চলে গিয়েছে আজ বিকালে। শুধু তাদের ছেলেমেয়েরা রয়েছে। কিন্তু নতুনতম সদস্যটি নেই। সে তার মায়ের নেওটা।

সব আয়োজন ওরা করে ফেলেছে খুব দ্রুততার সাথেই। তিলো সেই উপলক্ষে একটা অফ হোয়াইট শাড়ি পড়েছে। গায়ের রঙের জন্য ও বরাবরই উজ্জ্বল হালকা রঙগুলো বেছে নেয় নিজের সাজসজ্জার জন্য। রঙের জ্ঞান এবং ওর পছন্দমত বাছাইকৃত কাপড়গুলো, তাদের বুনন ওর রুচিশীলতার পরিচয় দেয়। পাশাপাশি তার ব্যক্তিত্ব ফুটিয়ে তোলে। খানিকটা ধূর্ততা। নিজেকে আড়াল করার অদম্য চেষ্টা। যেমনটা মানুষ আসলে বলে থাকে, ওর গায়ের রং চাপা, কালো পোশাক বা নীল পোশাক মানাবে না। উজ্জ্বল রঙ দাও ওকে। লোকের চোখে যেন সেটা না পড়ে এবং সে যেন গিরগিটির ন্যায় মিশে থাকে নিজেকে লুকিয়ে।
আবার ফর্সাদের বলে, ওদের তো যেকোনো রঙ মানাবে। তেমনি একটা ব্যাপার পোশাক বাছাইয়ের ক্ষেত্রে। পোশাক কি তবে গিরগিটিয় অস্ত্র? তিলোর মনে প্রশ্নটা মাঝে মাঝেই জাগে।

তিলো এখন ভাবলো না ওর সার্বিক ভাবনাগুলো নিয়ে। এখন সে নিজেকে প্রস্তুত করতে ব্যস্ত। অরিক রুমে ঢোকার মূহুর্তে তিলোকে একমনে সাজতে দেখে দরজার সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়ালো। হাত দুটো জিন্সের পকেটে পুরে রেখেছে।

অরিক ধীর তৃপ্ত উল্লাসে নিজের চোখজোড়া বিচরণ করে বেড়াচ্ছে তিলোর সমস্ত শরীরে। যতোই হোক, এখন সেই অবচেতন আতঙ্কটা নেই যে, তিলো কেবলই তার জীবনের মাঝখান থেকে পার হয়ে যাচ্ছে, যেন মরুভূমির ভেতর থেকে পার হওয়ারত একটি উট বা গভীর সমুদ্রের তলে কোনো ছোট মাছের ঝাঁকের একটা ক্ষুদ্র মাছ যারা ঝাঁক বেঁধে কেবল এগিয়েই চলেছে বা কোনো পেশাদার পর্যটক, যে একদিন তাকে ছেড়ে যাবেই। তিলো কোনো ক্ষণস্থায়ী স্টেশন নয় অরিকের জীবনে যেখানে কিনা যাত্রাপথে থামে কেবল চা পান করতে। অরিকের জন্য তিলো কেবল গন্তব্য। তার শেষ এবং স্থায়ী গন্তব্য।

অরিক এগিয়ে গেলো তিলোর দিকে। পকেট থেকে তিলোর জন্য কেনা পেনডেন্টটা বের করে হুট করেই পেছন থেকে তিলোর গলায় আবৃত করে পেছনে আটকে দিতে শুরু করলো। তিলো প্রথম ছোঁয়ায় চমকে উঠলেও অরিককে দেখে স্বস্তি পেলো।

অরিক ওর ঘাড়ের ওপর থেকে চুলগুলো সরিয়ে চেইনটা আটকে দিয়ে মুখ নিচু করে ওর ঘাড়ে নিজের ওষ্ঠজোড়া ছুঁইয়ে দিয়ে বললো,
-পছন্দ হয়েছে?

তিলো পেনডেন্টটা হাত দিয়ে একবার ছুঁয়ে বললো,
-ভীষণ।

-উপরে চলো। ওরা অপেক্ষা করছে।

তিলো ড্রেসিং টেবিলের উপর থাকা আংটিটা অনামিকায় পড়ে ঘুরে দাঁড়িয়ে অরিককে ইশারায় যেতে বললো। অরিকও ওর সম্মতিক্রমে যাত্রা শুরু করলো।
#ভয়_আছে_পথ_হারাবার
ফারিশতা রাদওয়াহ্ [ছদ্মনাম]

৩৭,,

ছাদটা বেশ সুন্দর করেই সাজানো হয়েছে। গতরাতে কেবল ছাদের একটা বাতি জ্বালানো থাকায় তিলো ভালো করে দেখেনি। তবে আজ যেন ঘোরটাই পাল্টিয়ে গিয়েছে। ছাদটা বেশ বড় এবং ছোট বড় গাছে বাগান করা। পরিবাতিগুলো ডালপালার ফাঁকা থেকে ঢিলা সেলাইয়ের ন্যায় বোনা হয়েছে। ছোট গাছগুলোর উপর সেগুলো পড়ে আছে মাকড়শার জালের মতো। গাছের ডাল থেকে লন্ঠন ঝুলছে যেগুলো লাল রঙের একটা আভা ছড়িয়ে দিয়েছে পুরো ছাদময়, একটা জাপানি আমেজ। পার্টির নামে যেসব উদ্ভট অসংযত কাজকারবার আজকাল জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে তার তুলনায় এই আয়োজনটা আসলে খুবই ভিন্ন এবং ছিমছাম।

নিজেদের মাঝে আড্ডা, ছোটখাটো গানের আসর আর খাওয়া দাওয়াই মুখ্য এখানে। মিশুক প্রকৃতির সানজিদের সাথে রোৎশীর ভাব জমে উঠেছে, যেটাকে সে যথাসম্ভব লোকচক্ষুর অন্তরালে রাখার চেষ্টা করছে। তিলো বিষয়টা খেয়াল করে দীর্ঘ একটা নিশ্বাস ফেললো। মেয়েটা নিজের ব্যক্তিগত নিরাপত্তা নিয়ে খুব বেশি সতর্ক। কিন্তু অপরের ক্ষেত্রে একদমই না।

খাওয়ার সময় রোৎশী নিজের প্লেটে একের পর এক চিকেন তুলে নিচ্ছে দেখে ওর প্লেট থেকেই রাফি নিজের প্লেটে তুলতে শুরু করলো। রোৎশী ঝাঁঝালো কণ্ঠে বললো,
-তোর সমস্যাটা কি বলবি? নিজে নিয়ে খেতে পারিস না?

রাফি আগের মতোই ওর প্লেটে থাকা শেষ পিছটা তুলে নিয়ে বললো,
-মোটা হয়ে যাচ্ছিস তুই মুটি। ডায়েট কর। এরপর বিয়ে দিতে পারবোনা। বরপক্ষ তোর সাইজ দেখে পালাবে হাতি।

-আমার বিয়ে নিয়ে তোকে ভাবতে হবে না। আর আমি মোটেও মোটা নই। আর একবার আমাকে মোটা বললে তোর বাড়িতে খাওয়া বন্ধ করে দেবো। গত দুমাসে দুই কেজি ওজন কমেছে আমার।

বলে আবারও আরেক পিছ তুলতে গেলে রাফি সেটাও তুলে নেয়। রোৎশী মেকি কান্নার ভান ধরে পা দাপিয়ে ওর থেকে সেটা কেড়ে নিতে গিয়ে ব্যর্থ হয়।
অভ্র এসে রোৎশীর প্লেটে এক পিছ তুলে দিয়ে বললো,
-খাবে তো আজকেই। নাকি? রোজ তো নিয়ম ভাঙার সুযোগ হয়না৷ কাল থেকে ডায়েট করিস।

রাফি এই পিছ আর নিলো না। প্রতিবাদী সুরে বললো,
-খাওয়া। যতো ইচ্ছা খাওয়া এই মুটিকে। এরপর বিয়ে না হলে তো গলায়ও দড়ি দিতে পারবে না। যার সাথে দেবে সেটাই ভাঙবে।

অভ্র ওর পিঠে বেশ জোরে চাপড় মেরে বললো,
-মোটাদেরও বিয়ে হয় রে ছাগল। আর খুব ভালো চিকন ছেলেদের সাথেই হয়।

রোৎশী আরো দুই পিছ তুলে নিয়ে অভ্রের দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হেসে বললো,
-আই লাভ ইউ অভ্র।

অভ্র সরু চোখে ওর দিকে এক মূহুর্ত তাকিয়ে ওর প্লেটের দিকে তাকালো। আরো নিয়েছে দেখে হতাশ নিশ্বাস ফেলে স্বাভাবিক কন্ঠেই বললো,
-অনুগ্রহ পূর্বক আপনি আপনার ভালোবাসা নিয়ে জাহান্নামে যান।

অভ্র আর দাঁড়ালো না ওর সামনে। গটগট করে হেঁটে চলে গেলো। রোৎশী মাংসে কামড় বসিয়ে ওর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে চিন্তা করছে, আদৌও ও কি ভুল বললো!

সারাদিনে তিলোর মাত্র একবারই ওর মায়ের সাথে কথা হয়েছে। নাসীরা পারভীন যতোটা না অসন্তুষ্ট ওর বিয়েটা নিয়ে এখন তার থেকে বেশি অভিমান জমেছে মেয়ের উপর। ওনি খেয়াল করেছেন তিলোকে ওনি তুলির থেকে বেশি ভালোবাসেন আসলে। বিষয়টা আবার সেরকম না হলেও তিনি একটু বেশি ভাবেন ওকে নিয়ে। আর আশাও করেন বেশি। হয়তো কেউ কেউ ওকে সরাসরি প্রত্যাখ্যান করে বা অবজ্ঞা করে বিধায় ওনার বেশি মায়া হয় নিজের মেয়েটার প্রতি। তুলির বিয়ের পর তুলি ওনাকে কতোটা গুরুত্ব দিলো সেটা নিয়ে ওনি ভাবতেন না। কিন্তু তিলোর বিষয়ে সংবেদনশীল। ওনি এটাও লক্ষ্য করেছেন, আসলে ওনি অরিককে হিংসা করেন৷ হয়তো তিলোর আর কোথাও বিয়ে হলে সেই জামাইকেও হিংসা করতেন। মেয়েটা তাঁর কথা মনেও করে না সারাদিনে? সংসারে এতো ব্যস্ত!! হিংসার সাথে সাথে অরিকের উপর রাগও হচ্ছে, তাঁর মেয়েকে নিয়ে গিয়েছে বিধায়। ওনি নিজেও জানেন ওনার এই অনুভূতিটা নিতান্তই অমূলক। কিন্তু ওনি আটকাতে পারছেন না এই অনুভূতিকে। মেয়েটা তো তাঁর আদরের। আবেগ এবং বাস্তবতা এক নয়। আবেগের বশে মনে হয়, মেয়ের বিয়ে না হয়ে সারাজীবন কাছে থাকলেই ভালো হতো। কিন্তু বাস্তবতা হলো, তাকেও তো জীবনে এগিয়ে যেতে হবে। আবেগের বশে তার জীবন থামিয়ে রাখার কোনো মানে হয়না৷
সাইকোলজি বলে, সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে অন্য কোনো ভাষায় চিন্তা করলে আরো সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার সম্ভাবনা থাকে। কারণ মাতৃভাষায় চিন্তা করলে অবচেতনভাবে মস্তিষ্কে একটা আবেগ কাজ করে। কিন্তু অন্য ভাষায় চিন্তা করলে, মস্তিষ্কে লজিকের অংশটা অধিক সক্রিয় হয়। ফলে যুক্তি দিয়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়া সুবিধাজনক।
অভিমানে নিজেও ফোন দেননা তিলোকে। আবার তিলোর সাথে ওনার কথা বলতেও ইচ্ছা করে। ভালো হতো যদি তিলোকে কখনোই কেউ না ভালোবাসতো। কখনোই কারো পছন্দ না হতো। কখনোই ওর বিয়ে না হলে। তাহলে সবসময় তিলো ওনার কাছেই থাকতো। সেটাই ভালো হতো।
আনিস সাহেব ওনার উপর রেগে কথা বলছেন না। তুলির ওপর ওনি রেগে আছেন। ফলে ইশানকেও কোলে নিচ্ছেন না৷ তুষারও বাড়িতে নেই। ওনার কেউ নেই। ভেবে এখন ওনার নিজেরই কান্না পাচ্ছে। ওনি একজন মানুষ। এই সংসারের কর্ত্রী। এতোবছর সংসারটার প্রতিনিধিত্ব করে গিয়েছেন। কিন্তু আজ কেউ ওনাকে পাত্তাই দিচ্ছে না!! কেউ ভাবে না ওনার কথা।
সন্ধ্যা থেকে বিছানায় শুয়ে আছেন নাসীরা পারভীন। দুপুরে ঠিকমতো খাননি আনিস সাহেবের সাথে ছোটখাটো একটা প্রলয়কাণ্ড ঘটানোর পর। ক্ষুধায় নাড়ী জ্বলে যাচ্ছে। তিলো যে কেন ক্ষুধা সহ্য করতে পারে না, সেটা ওনার আজ আবারও মনে পড়লো। ওনার থেকেই অভ্যাসটা পেয়েছে তিলো।
এরপরও রাগে দুঃখে অভিমানে উঠলেন না বিছানা ছেড়ে। কি দরকার! যে যার মতো আছে। তাঁর প্রয়োজন তো ফুরিয়েছে সংসারে। একরাশ অভিমান নিয়ে অবশেষে ঘুমিয়ে পড়লেন তিনি।

ওদের আড্ডা শেষ হতে হতে অনেক রাত হয়ে গিয়েছে। তিলো শেষেরদিকে কে কি বলেছে কিছুই শোনেনি৷ বসে বসে ঝিমুচ্ছিলো। অরিক অবাক হয়েছে তিলোর ঘুমকাতুরতা দেখে। এতোগুলো মানুষের এতো কথার মাঝেও তিলোর বারবার চোখ লেগে আসছিলো। অবশেষে অরিক বলেই ওদের আসর ভেঙেছে। না হলে বোধহয় সারারাত চালানোর পরিকল্পনা করেছিলো অভ্র।

অদ্ভুতভাবে ঘরে ফিরে তিলোর ঘুম কেটে গিয়েছে। এখন সে আবারও সতেজ একটা ভাব নিয়ে ফ্রেশ হয়ে এসে বিছানায় বসে বসে ফোন টিপছে। অরিক আড়চোখে একবার ওর দিকে তাকিয়ে বললো,
-তুমি না এতক্ষণ ঘুমে পড়েই যাচ্ছিলে?

তিলো ফোন থেকে মাথা না তুলে বললো,
-এখন ভেঙে গিয়েছে। আর ঘুম আসছে না।

নিরবতায় কিছুক্ষণ কেটে যাওয়ার পর অরিক বললো,
-বাবাজানা।

-হুম।

-আমার সাথে যাবে?

-কোথায়?

-ইউএস যাবো। যাবে তো?

তিলো ফোন থেকে মুখ তুলে অরিকের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালো। অরিক ওর প্রশ্ন বুঝতে পেরে বললো,
-এখনো পড়াশোনা বাকি রয়েছে আমার।

তিলো বালিশটা বিছানায় ঠেকিয়ে আধশোয়া হয়ে বসে বললো,
-তোমার কি সারাক্ষণ পড়াশোনা ছাড়া মাথায় কিছু থাকে না? আর কতো পড়বে? এখন তো পড়াও। আরও নিজে পড়বে?

অরিক উঠে বসে তিলোর কপালে ওষ্ঠজোড়া স্পর্শ করে বললো,
-যতো বেশি পড়বে ততই তো জ্ঞান বাড়বে, সম্মান বাড়বে। আরো দ্রুত সামনে এগোতে পারবো। জানো, আমার খালু বলেন, লেখাপড়া শিখে অর্জিত কাগজগুলোর ওজন যদি আধাকেজি না হয় তো জীবনে কি করলাম?

তিলো অরিকের দিকে ফিরেই মাথার একপাশ বালিশে ঠেকিয়ে বললো,
-আমার একটা আফসোস আছে জীবনে। কখনো পোস্টার গার্ল হতে পারলাম না।

অরিক ভ্রু কুঁচকে বললো,
-সেটা কী?

-এই যে তুমি যেমন পোস্টার বয়। আমার ম্যাথ টিচার এই নামটা সবসময় ভালো স্টুডেন্টদের জন্য দিতেন, যাদের পরীক্ষা শেষে রাস্তার মাথায় পোস্টারে দেখা যেতো। তোমাকেও কয়েকবার দেখেছি। কোচিং সেন্টারগুলো বোর্ড স্ট্যান্ড স্টুডেন্ট বা দেশের নামকরা ভার্সিটিতে সুযোগ পাওয়া স্টুডেন্টগুলোর ছবিগুলো ছেপে নিজেদের প্রচার করে। তারা তাদের কারখানার ত্রুটিহীন পণ্যগুলো সগর্বে প্রদর্শন করে কাস্টমার যোগাড় করে। তোমার মতো ত্রুটিহীন পণ্য। কিন্তু আমার প্রশ্ন হচ্ছে, আদৌও কি তাদের হাত থাকে পণ্যগুলো নিখাদ হতে? তারা তো সকলের পেছনেই চেষ্টা করে তাহলে একজন দুজন ভালো হয় বাকিরা কেন নয়? তাহলে নিশ্চয়ই এখানে শিক্ষার্থীর চেষ্টাটাই মুখ্য। না হলে তো ওই কারখানার গাফিলতি। তারা ওই একজন দুজনকেই গুরুত্ব দেয়। বাকিদের দেয়না। তাই পোস্টারে একজনকেই দেখা যায়। সবাইকে না। স্টুডেন্টটার পরিশ্রমের কৃতিত্ব কেন তারা নেবে? ওই একজন যে, যে এই প্রচারে মুগ্ধ হয়ে নিজের সন্তানকে সেখানে পাঠাবে তার সন্তানই হবে তার কোনো মানে নেই। সুতরাং, পুরো কার্যক্রমটা হলো একধরনের ভণ্ডামি। লোক ঠকানো এবং একটা খেলা। ‘বোকা বোকা’। বাজে কোচিং বাণিজ্য।

অরিক তিলোর কথাগুলো শুনে প্রথমে গুরুত্ব না দিলেও এখন ওর নিজের কাছে নিজেকে একটা ক্লাউন মনে হচ্ছে। প্রতিবার বোর্ড পরীক্ষার পর ও যে কোচিং সেন্টারে পড়তো সেখানে সেজেগুজে গিয়ে ফুলের তোড়া গ্রহণ করতো আর ক্যাবলা মার্কা একটা হাসি দিয়ে ছবি তুলতো। তখন সেটা খুব ভালো লাগলেও এখন সত্যিই মনে হচ্ছে, সে আসলে একটা মুরগী ছিলো যাকে প্রতি সফলতার পর জবাই দেওয়া হতো নিজেদের ভোজে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েও দ্বিতীয় হয়ে সুযোগ পাওয়ার পর যে কোচিং এ পড়তো সেখানে গিয়ে মডেলিং করে এসেছে। এখন সেই অবচেতন উত্তেজনা কেটে বাস্তবতা বুঝতে পেরে, একদিক থেকে ভালো লাগছে যে তাকে এই মাঠে অনেকে চিনেছে। কিন্তু তাকে সমানভাবে ব্যবহারও করা হয়েছে। সে তো নিজের যোগ্যতায় সুযোগ পেয়েছিলো। কিন্তু তার কৃতিত্ব সেই কোচিং সেন্টার নিয়ে শিকার ধরেছে। মাছ ধরার টোপ যেন।
তিলোর এই কথাগুলো শোনা একটা ভুল হয়ে গিয়েছে। বাজে একটা ভুল। ওর ভেতর হীনমন্যতা কাজ করছে। অরিক ঘৃণা করে, ওকে কেউ ব্যবহার করুক। কিন্তু সেটা সে নিজেই সুযোগ দিয়েছে প্রতিবার।

অরিক ওর কথার প্রত্যুত্তর না করে ছোট করে বললো,
-শুয়ে পড়ো। ঘুম চলে আসবে।

তিলো নিজের ভঙ্গিমায় সম্মতি দিলো। অরিক তিলোর দিকে পিঠ দেখিয়ে শুয়ে পড়লো। তিলো বুঝতে পারছে, অরিক অস্থিরতায় ভুগছে কোনো কারণে। ওকে পেছন থেকে আঁকড়ে ধরে তিলো চোখ বুজলো। অরিক ওর স্পর্শ পেয়ে মৃদু হাসলো।

#চলবে

ভাষাগত যে সমস্যাটা রয়েছে, আমি দুঃখিত সেজন্য। এটা শুধু প্রভাবিত হওয়ার সমস্যাটা থেকে উদ্ভুত। আমার পড়া উপন্যাসগুলো থেকে শব্দগুলোর প্রতি যত্নশীল হয়ে পড়েছিলাম। আবার বলা যায়, কিছু শব্দের প্রেমে পড়েছি। রাশভারী শব্দ সমূহ মাঝে মাঝে ব্যবহার করতে হয় বলে আমি মনে করি। না হলে সেটা গল্প বা উপন্যাস হবে কিভাবে? আচ্ছা সেটা না করলাম। আজকের শব্দগুলো সহজ ছিলো আশা করি। আর পরিবেশের বর্ণনা নিয়ে যে সমস্যাটা, তার বিষয়ে বললো, এটা মাধুর্যতা। আশেপাশের আবহ সৃষ্টি না করলে কিভাবে একজন নিজেকে সেখানে কল্পনা করতে পারে? তাছাড়া পরিবেশের বর্ণনা ছাড়া কোনো রোম্যান্সধর্মী গল্প, গল্প হয় কি? থ্রিলারে পরিবেশের বর্ণনার প্রয়োজন পড়ে কম। আমি দুঃখিত, এবিষয়ে নিজের স্বকীয়তা থেকে বের হতে পারবো কিনা জানি না। আর মাত্র কয়েকটা পর্ব দিয়ে বিরক্ত করবো। খুব তাড়াতাড়ি এই ছোট উপন্যাসটা শেষ হবে। যারা দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করছেন কোনো উপায় না পেয়ে, আরেকটু করুন।
ধন্যবাদ।
#চলবে
#চলবে

😜)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here