#মধুবালা
অরিত্রিকা আহানা
পর্বঃ১৫
খাটের ওপর হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে আশরাফি। একটু আগেই নীলার সঙ্গে তাঁর বিয়ের কথাবার্তা সব ফাইনাল করে এসেছে সোহাগ এবং নাঈম। তীব্র অনিচ্ছাসত্ত্বেও ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকা ছাড়া কিছুই করার ছিলো না আশরাফির। বন্ধুদের বাস্তবসম্মত যুক্তির বিপরীতে পালটা জবাব দেওয়ার মতন কোন যুক্তি ছিলো না তাঁর কাছে। তাই বাধ্য হয়ে মেনে নিতে হয়েছে।
মোটামুটি এখন ভালোই সুস্থ সে। হাঁটাচলাও করতে পারে। যদিও গতকালই প্লাস্টার খোলা হয়েছে তবে ডাক্তার বলেছে আর কোন ভয় নেই। আগের মত চলাফেরা করতে পারবে সে। তাই বন্ধুরা যততাড়াতাড়ি সম্ভব বিয়ের কাজ সেরে ফেলতে চাইছে। আর নীলা তো এক পায়ে খাড়া! মেয়েটাকে আশরাফি কিছুতেই বোঝাতে পারে নি এই বিয়েটা তাদের দুজনের জন্যই মস্তবড় ভুল সিদ্ধান্ত।
★
দুদিন আগের ঘটনা, ব্যাগপত্র সব গুছিয়ে নিয়ে বাসা থেকে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য মোটামুটি প্রস্তুত সোহাগ এবং নাঈম। বিয়ের জন্য কোনভাবেই আশরাফিকে রাজি করতে না পেরে শেষে এই পন্থা অবলম্বন করেছে দুই বন্ধু। এবার যদি কাজ হয়!
আশরাফি তখন বাসায় ছিলো না। ফিরে এসে ড্রয়িংরুমে একগাদা ব্যাগপত্র গোছানো দেখে মনে মনে ঝড়ের পূর্বাভাষ আন্দাজ করে নিলো সে। তথাপি দেখেও না দেখার ভান করে চুপচাপ নিজের ঘরে চলে গেলো। বই পড়ার অজুহাত দিয়ে চুপচাপ অপেক্ষা করলো কিছুক্ষণ। ঘন্টাখানেক বাদেই সোহাগ এবং নাঈম দুজনেই একসঙ্গে ঘরে ঢুকলো তাঁকে বিদায় জানানোর জন্য। আশরাফি রাগে ফিরেও তাকালো না। পুনরায় বিদায় জানালো দুই বন্ধু।
এবারে হাতের বইটা সজোরে বন্ধ করলো আশরাফি। চেঁচিয়ে উঠে বললো,’হ্যাঁ! তো যা না। এক্ষুনি বেরিয়ে যা আমার বাসা থেকে। আমি কি বাধা দিয়েছি? আমি তো খারাপ। আমার মত খারাপ মানুষের সঙ্গে কেন থাকবি তোরা? তোরা তো একেকটা ন্যায়ের দেবতা! দুধে ধোয়া তুলসী পাতা। জীবনে কোন অন্যায় করিস নি! তোদের দরকার নেই আমার সঙ্গে থাকার। যা বেরিয়ে যা!’
সোহাগ প্রতিউত্তরে কিছু বলতে চাইছিলো ইশারায় বাধা দিলো নাঈম। আশরাফির কথাগুলোকে পুরোপুরি ইগ্নোর করলো সে। কোনরকম এক্সপ্লেনেশন দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করলো না। মেজাজ আরো খারাপ হয়ে গেলো আশরাফির। রাগে টেবিল বরাবর লাথি মেরে বললো,’ন্যায় অন্যায় শেখাতে এসেছে আমাকে। আমি কি তোদের চাকর? তোদের কথামত উঠবো বসবো? আমার লাইফের ডিসিশন আমি নিজেই নিতে পারি। আমার যা ভালো মনে হবে আমি তাই করবো।’
জবাবে নাঈম শান্ত গলায় বললো,’চিৎকার করে বলার কোন দরকার নেই। এমনিতেও আমরা আর তোর কোন ব্যপারে থাকবো না বলে সিদ্ধান্ত নিয়েই নিয়েছি। অতএব নিশ্চিন্তে থাকতে পারিস তুই। হ্যাঁ! চোখের সামনে থাকলে হয়ত সহ্য করতে পারবো না। সে জন্যই তো আলাদা বাসা নিয়েছি। তোর আর কোন অসুবিধে হবে না। যা মন চায় করতে পারবি। একটা কেন একশোটা পতিতা মেয়ে নিয়ে সংসার করার চিন্তাভাবনা করলেও এখন আর কেউ বাধা দেবে না তোকে।’
রাগে সর্বাঙ্গ জ্বলে উঠলো আশরাফির। তেড়ে গেলো সে। সোহাগও বিরক্ত হলো। ইতোপূর্বে সে এই বিষয়ে অনেকবারই বারণ করেছে নাঈমকে। তাদের কাছে মধু যতই খারাপ হোক না কেন আশরাফি মেয়েটাকে ভালোবাসে। তার সম্পর্কে খারাপ কথা বললে আশরাফির খারাপ লাগবে। কিন্তু এই সামান্য বিষয়টা কেন নাঈমের মাথায় ঢুকলো না সেটাই বুঝতে পারছিলো না সে। আশরাফি রাগে দাঁতমুখ খিঁচে নাঈমের কলার ধরে,’ওকে নিয়ে এত জ্বালা কেন তোর? কি ক্ষতি করেছে ও তোর? যা করেছে আমার সঙ্গে করেছে, তুই বলার কে? কোন সাহসে ওকে নিয়ে বাজে কথা বললি তুই?’
নাঈমও খেপে গেলো। আশরাফির এসব পাগলামি অনেক সহ্য করেছে। আর না। ক্ষিপ্ত কন্ঠে বললো,’হ্যাঁ ঠিকই বলেছিস। যা করেছে তোর সঙ্গে করেছে। কিন্তু এখন আমি বুঝতে পারছি সে কেন এসব করেছে। আসলে তোর মত একটা বদরাগী, মাথাখারাপ মানুষের সাথে একসঙ্গে থাকাটা যে কোন সুস্থ মানুষের পক্ষেই অসম্ভব। আর তোর শুধু মাথাখারাপই নয় ভীষণ স্বার্থপরও তুই। সেইজন্যই আমাদের বেরিয়ে যেতে বলতে পারলি!’
অবাক হলো আশরাফি! তাঁর অভিমানের কথাগুলো সত্যিই সত্যি ধরে নিলো বন্ধুরা? এতদিনেও আশরাফিকে চিনতে পারলো না? রাগে দুঃখে সেও আর কোন কিছু ব্যাখ্যা করার প্রয়োজন মনে করলো না। চেঁচিয়ে উঠে বললো,’হ্যাঁ আমি স্বার্থপর! এবার খুশি হয়েছিস তুই? যেখানে যাচ্ছিস যা। কাউকে ধরে রাখার কোন দায় পড়ে নি আমার।’
মনে মনে দুঃখ পেলো দুইবন্ধু। অথচ তারা নিজেরাও জানে এই কথাগুলো আশরাফির মনের কথা নয়। কিন্তু এইমুহূর্তে তাদের এই পাগলাটে, খেপা, সরলমনা বন্ধুটির মনের কথার কথার চাইতেও মুখের কথাটাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে গেলো তাদের কাছে। অবশ্য তাদের দোষ দিয়েও বা লাভ কি? আশরাফিকে বোঝাতে বোঝাতে হাঁপিয়ে গেছে দুজনে। বন্ধুত্বের মর্যাদা তো আশরাফিরও রাখা চাই? এত করে বোঝানোর পরেও সে ঘুরেফিরে মধুর কাছে ছুটে যায়। সব জেনেশুনে আবারো তাঁকে একই ভুলটা তো করতে দেওয়া যায় না। তাছাড়া ঘটনাটা যদি একবার কোনরকমস জানাজানি হয়ে যায় লোকে থুতু দেবে মুখে। নতুবা বন্ধুকে ছেড়ে যেতে কি তাদের কষ্ট হচ্ছে না? কিন্তু এছাড়া আর কি-ই বা করার আছে তাদের? আশরাফির ভালোর জন্যই এই সিদ্ধান্তটা নিতে হয়েছে। তাই আশরাফির রাগের পাত্তা না দিয়ে বললো,’আসছি আমরা।’
জবাব দিলো না আশরাফি। আড়চোখে একবার চাইলো কেবল। সত্যিই সত্যিই বেরিয়ে যাচ্ছে সোহাগ এবং নাঈম! চোখে পানি চলে এলো তাঁর। সামান্য একটা কারণে এতদিনের বন্ধুত্বের সম্পর্ক শেষ করার সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছে ওরা? আশরাফির কষ্টটা একবারও বোঝার চেষ্টা করলো না? এতটা খারাপ হয়ে গেছে ওদের চোখে আশরাফি? কিন্তু মুখে স্বীকার না করলেও ভেতরে ভেতরে বুকটা ফেটে যাচ্ছিলো তাঁর! ওরা এভাবে রাগ করে বেরিয়ে গেলে কিছুতেই শান্তিতে থাকতে পারবে না সে। একা বাসায় দমবন্ধ হয়ে মরে যাবে! আত্মাভিমানের ঠেলায় সেকথা আর মুখ ফুটে বলতে পারলো না। নিজের অনুভূতি প্রকাশে ব্যর্থ হয়ে অবশেষে রাগে,অভিমানে বাসার ভেতর ভাংচুর শুরু করে দিলো সে।
সিঁড়ি কাছে যেতে না যেতেই ভাঙচুরের বিকট আওয়াজে চমকে উঠে একে ওপরের দিকে চাইলো সোহাগ এবং নাঈম। তাদেরকে বাধা দিতে না পেরেই খেপে গেছে আশরাফি। বেশ বুঝতে পারলো যাওয়াটা আর হবে না। ভেতরে ভেতরে খুব খুশিই হলো দুইবন্ধু। কিন্তু প্রকাশ করলো না।
সোহাগ বিরক্ত গলায় বললো,’পাগল খেপেছে!’
নাঈমও কৃত্রিম রাগ দেখিয়ে বললো,’ভেবেছে এসব ছেলেমানুষি করলে ফিরে যাবো আমরা।’
-‘যাবি না?’ অবাক হয়ে উত্তরের অপেক্ষায় চেয়ে তাঁর মুখের দিকে রইলো সোহাগ। ভ্রু জোড়া অটোমেটিক কুঁচকে গেছে তাঁর। নাঈম দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। হতাশভাবে মাথা দুলিয়ে আবারো ভেতরে ঢুকলো দুই বন্ধু। দুই মিনিটেই বাসার অবস্থা কাহিল করে ফেলেছে আশরাফি। ওদেরকে ভেতরে ঢুকতে দেখে ফের রাগে ক্ষোভে চেঁচিয়ে উঠে বললো,’ফিরে এলি কেন? যা বেরো! বেরো বলছি! নইলে এক্ষুনি বাড়ি মেরে মাথা ফাটিয়ে দেবো। বেরো আমার বাসা থেকে।’
-‘ভাংচুর করে কি প্রমাণ করতে চাইছিস তুই?’
-‘কিচ্ছু প্রমাণ করতে চাইছি না। তোরা যা, বেরো আমার বাসা থেকে। অনেক করেছিস আমার জন্য আর লাগবে না।’
বন্ধুর বাধা দেওয়ার পদ্ধতি দেখে হেসে ফেললো নাঈম! ভাঙবে তবু মচকাবে না! তাকে হাসতে দেখে ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলো আশরাফি! হাসির কারনটা ঠিক বুঝে উঠতে পারলো না।
বাস্তবিকই বন্ধুদের সম্পর্কগুলো বড় অদ্ভুত। কখনো কখনো সম্পর্কের দায়ভার অনেক বেশি জেনেও সম্পর্কটাকে উপেক্ষা করতে পারে না কিছু মানুষ। সোহাগ এবং নাঈম তাদেরই অন্তর্ভূক্ত।
এবং মুখে যতই রাগ দেখাক না কেন মনে মনে আশরাফি নিজেও জানে তাঁর বন্ধুদুটি ঠিক কতটা ভালোবাসে তাঁকে। তার ভাঙাচোরা, উদ্দেশ্যহীন জীবনে এই বন্ধুদুটি অবদান কখনোই অস্বীকার করতে পারবে না সে। নিজের আপন মানুষের চাইতে অনেক বেশি করেছে ওরা তাঁর জন্য। সুখে দুঃখে বিপদে আপদে সবার আগে ছুটে গিয়েছে। তাঁর অসুখে রাত জেগে মেয়েদের মত সেবা করেছে। মেহের চলে যাওয়ার পর তাঁরাই ওকে সামলেছে। তাই আজ ওরা যখন ছেড়ে চলে যাচ্ছিলো রাগে দুঃখে মাথা ঠিক রাখতে পারে নি সে। কিন্তু এতকিছু পরেও নিজের জেদ বজায় রেখে গম্ভীর গলায় বললো,’আমি কাউকে ফিরে আসতে বলি নি।’
নিজেকে সামলে নিলো নাঈম। নরম হলেই আশরাফি বেঁকে বসবে। তাই গম্ভীর গলায় পুনরায় বাসা ছেড়ে যাওয়ার হুমকি দিয়ে বললো, ‘কথা ঘুরিয়ে কোন লাভ নেই রাফি। তুই ভালো করেই জানিস তোর সঙ্গে আমাদের কি সম্পর্ক? আমরা দুজন তোকে কতটা ভালোবাসি! সবসময় তিনভাইয়ের মত চলেছি তিনজন একসঙ্গে!
এতকিছুর পরেও যখন ঐ মেয়েটাই তোর কাছে সব হয়ে গেলো তখন আমাদের আর কিছু বলার নেই। ব্রোথেলের একটা বাজে মেয়ের জন্য তুই নিজের জীবন বরবাদ করতে চাইছিস কর। কিন্তু দয়া করে আমাদেরকে মুক্তি দে। এসব কথা লোক জানাজানি হলে লজ্জায় কাউকে মুখও দেখাতে পারবো না।’
জবাবে আশরাফি রাগত চেহায়ার তীব্র ব্যথার ছাপ দেখা দিলো। চোখ জোড়া ছলছল করে উঠলো। অসহায়ের কন্ঠে বললো,’আমি ওকে ভালোবাসি।’
-‘ভালোবাসিস ভালো কথা। তোকে তো কেউ ভালোবাসতে বারণ করে নি। কিন্তু এইকথাটাও তো ভুলে গেলে চলবে না সে এখন অন্য একজনের স্ত্রী? তাঁকে তাঁর নিজের মত লাইফ লিড করতে দেওয়া উচিৎ!’
সোহাগও সম্মতিসূচক মাথা দুলিয়ে বললো,’নাঈম ঠিকই বলেছে দোস্ত। মেহেরকে ওর নিজের মত থাকতে দেওয়া উচিৎ। একটা বিবাহিত মেয়ের পেছনে ঘুরে শুধুশুধু নিজের সময় নষ্ট করছিস তুই। ভালো করে একবার ভেবে দেখলে তুই নিজেই বুঝতে পারবি ঠিক করছিস না ভুল করছিস।’
★
এরপর অনেক বাকবিতণ্ডা, কথা কাটাকাটি হলো! কিন্তু বন্ধুরা নিজেদের সিদ্ধান্তে অনড়। হয় আশরাফিকে মধুর চিন্তা বাদ দিতে হবে নয়ত তাদেরকে ছাড়তে হবে। শেষমেশ তাদের সিদ্ধান্তেই রাজী হতে হলো আশরাফিকে। বাধা দেওয়ার মত অবশ্য কোন পথ খোলা ছিলো না তাঁর কাছে। অনেক আগেই সব পথ বন্ধ করে দিয়েছে মধু। কিন্তু এতকিছুর পরেও সে যদি শুধু একবার মুখ ফুটে আশরাফিকে বিয়ের জন্য বারণ করতো স্বেচ্ছায় সমস্ত জীবনটা তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে পার করে দিতো আশরাফি! পৃথিবী আর কারো কথার শোনার কোন প্রয়োজন মনে করতো না। কারণ সে এখনো মনে প্রাণে বিশ্বাস করে তাঁর ওপর সমস্ত অধিকার কেবল মধুর! মধু ছাড়া অন্যকাউকে নিজের জীবনে কল্পনাও করতে পারে না সে।’ কিন্তু যার জন্য সে ভালোবাসার পাহাড় জমিয়ে ব্যাকুল হয়ে আছে সে তো মনে মনে আশরাফির জীবন নিয়ে কোনরকম মাথা না ঘামানোর পণ করে বসে আছে। নিজেকে নিষ্ঠুর, স্বার্থপর প্রমাণ করার জন্য উঠে পড়ে লেগেছে সে।’
বন্ধুদের সাথে কথা শেষ করে চুপচাপ নিজের ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলো আশরাফি। বন্ধুরা এই নিয়ে তেমন মাথা ঘামালো না। বরঞ্চ এতসহজে সে আশরাফিকে রাজি হবে ভাবতেও পারে নি তাঁরা। খুশিতে চোখ চকচক করে উঠলো দুজনের। একে অপরের দিকে তাকিয়ে হাসলো! রাগ করে বলুক আর যেভাবেই বলুক আশরাফি যে বিয়ে করতে রাজি হয়েছে তাতেই অনেক। কোনমতে একবার বিয়েটা হয়ে গেলে ঠিকই মাথা থেকে মধুর ভুত নামবে তাঁর।
.
.#মধুবালা
অরিত্রিকা আহানা
পর্বঃ১৬
ক্লান্ত দেহ, অবসন্ন মনে নিজের ঘরে শুয়ে ছিলো মধু। আজকেও সারাদিন নাওয়াখাওয়া কিছুই হয় নি তাঁর। বিশেষ কোন আগ্রহও নেই খাবারে প্রতি। সন্ধ্যায় আরমান বেরোনোর সময় বারবার করে সতর্ক করে দিয়ে গেছিলো সে যেন সময়মত আহার সেরে নেয়। অসুস্থ শরীরে না খেয়ে থাকা মোটেও ঠিক নয়। কিন্তু মধুর কি আর সেসব শোনার সময় আছে। মনের সমস্ত জ্বালা, ক্ষোভ, আক্ষেপ তো এই পোড়া দেহটার ওপরেই মেটায় সে। না খেয়ে, শরীরটাকে দুর্বল করে তিলে তিলে কষ্ট দিয়ে মারতে চায়।
সন্ধ্যার দিকে, আনুমানিক সাতটা কিংবা আটটা হবে, নির্জীব হয়ে বিছনায় পড়েছিলো সে হঠাৎ নিচতলা থেকে একটা মেয়ে এসে জানালো আশরাফি এসেছে তাঁর সঙ্গে দেখা করার জন্য। মেয়েটা তাঁকে অবাক হওয়ার সময়টুকুও দিলো। হড়বড়িয়ে বললো,’জলদি নিচে চলো মধুমা। তিনি খুব চিৎকার চেঁচামেচি করছেন।’
ধড়ফড়িয়ে উঠে বসলো মধু। ভয়ার্ত কন্ঠে বললো,’কখন এসেছে?’
-‘এইমাত্র। নেশা করেছে বোধহয়। আবোলতাবোল বকছে। তুমি না গেলে শান্ত হবে না!’
আঁতকে উঠলো মধু। অবাক হয়ে মেয়েটার মুখের দিকে চেয়ে রইলো কিছুক্ষণ। বড় বড় দম নিয়ে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করলো। বুকের ভেতরটা দুপদাপ করছে তাঁর। ইদানীং অল্পতেই ভীষণ ঘাবড়ে যায় সে। বিশেষ করে আশরাফির অ্যাক্সিডেন্টের পর থেকে সমস্যাটা আরো বেড়ে গেছে। সামান্য কিছুতেই বুক কেঁপে উঠে। হাতে পায়ে খিঁচুনি ধরে!
তবে একটা কথা ভেবে স্বস্তির নিশ্বাস ফেললো সে। ভাগ্যিস আরমান বাড়িতে নেই! নাহলে বিরাট ঝামেলা হয়ে যেতো এইমুহূর্তে। নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করে বললো,’তাঁকে গিয়ে বল আমি কারো সাথে দেখা করতে পারবো না। সে যেন ফিরে যায়।’
মেয়েটা ভীত কন্ঠে মিনমিন করে বললো,’আমার কথা কি শুনবে মধুমা? দেখে তো মনে হলো খুব খেপে আছে।’
-‘তোকে যা করতে বলেছি কর। সে যেন কোনভাবেই উপরে আসতে না পারে।’
মেয়েটা বেরিয়ে যাওয়ার পর নিজের ঘরে খিল দিয়ে বসে রইলো মধু। ধড়ফড়ানি এখনো কমে নি। এই অবস্থায় কিছুক্ষণ অপেক্ষা করাটাই উত্তম হবে। আরো একটা কারণ অবশ্য আছে। সেটা হলো আশরাফির বিয়ের খবরটা শোনার পর থেকেই আর কোনভাবে তাঁর মুখোমুখি হতে চাইছে না মধু। কেন যেন মনে হচ্ছে আশরাফির সামনে গেলে নিজেকে স্থির রাখতে পারবে না সে। ফের দুর্বল হয়ে পড়বে। তাই নিজেকে শান্ত করার জন্য হলেও কিছুটা সময় চাই। এরমাঝে যদি আশরাফি চলে যায় তবে ভালো। আর যদি না যায় তখন নাহয় নামবে মধু।
উপরতলা থেকে তখনো আশরাফির চিৎকার চেঁচামেচি শোনা যাচ্ছিলো। অগত্যা বাধ্য হয়ে নিচে নামতে হলো মধুকে। কয়েকজন কাস্টমার বিশ্রীভাবে হাসছে আশরাফিকে নিয়ে। তারাও মাতাল, উন্মত্ত। খেপাটে, মতিচ্ছন্ন আশরাফিকে নিজেদের স্বজাতিভুক্ত ধারণা করে নিয়েছে হয়ত। সেদিকে একবার তাকিয়ে চোখের দৃষ্টি ধারালো হয়ে গেলো মধুর। বদ্ধ,উন্মাদ, দুশ্চরিত্র নরপশুগুলো মনে মনে নিজেদের সঙ্গে আশরাফির তুলনা করছে বুঝতে পেরে রাগে সর্বাঙ্গ জ্বলে উঠলো তাঁর। ইশারায় মেয়েগুলোকে সরে যেতে নির্দেশ দিলো সে। সরে গেলো সবাই। আশরাফি চোখমুখ লাল করে ফের চেঁচিয়ে উঠে কিছু বলতে যাচ্ছিলো কিন্তু মধুকে দেখে থমকে গেলো। হাহাকার করে উঠলো বুকের ভেতরটা! নিজেকে সংযত করে মধু উদ্দেশ্য করে তিরস্কারপূর্বক হাতে তালি দিয়ে বললো,’মধুবালা? তোমার জন্য অপেক্ষা করছিলাম। এতক্ষনে নামার সময় হলো?’
তাঁর গলার স্বর শুনে চমকে গেলো মধু। মেয়েটা ঠিকই বলেছে হুঁশে নেই আশরাফি। বুদ্ধিভ্রষ্ট হয়েছে তাঁর। কাছে এগিয়ে গেলো মধু। দাঁতেদাঁত চেপে বললো,’কেন এসেছে এখানে?’
-‘তোমাকে সুসংবাদ দিতে। এই দেখো এ্যাংগেইজমেন্ট হয়ে গেছে আমার!’ হাতের আঙুল উঁচিয়ে মধুকে এ্যাংগেইজমেন্ট রিংটা দেখালো আশরাফি। এখানে আসার আগেই নীলার সঙ্গে এ্যাংগেইজমেন্ট হয়েছে তাঁর।
এখানে আসার অপরাধের শাস্তিস্বরূপ ক্ষীপ্ত কণ্ঠে তাঁকে কিছু কটু কথা শুনিয়ে দেওয়ার জন্য মুখ খুলতে যাচ্ছিলো মধু কিন্তু হাতের রিংটা দেখে থমকে গেলো। ধক করে উঠলো বুকের ভেতরটা। এলোমেলো হয়ে গেলো সমস্ত চিন্তাভাবনা। কথা খুঁজে পেলো না। হাহাকার করে উঠলো শূন্য হৃদয়! অপলক চোখে নিরবে কিছুক্ষণ চেয়ে রইলো আশরাফির মুখের দিকে। জলে ভরে এলো দুচোখ। চোখভর্তি টলমল করতে থাকা পানি নিয়ে কাঁপাকাঁপা কন্ঠে বললো,’ভালো কথা। কিন্তু এখানে কেন এসেছো?’
কি অসহ্য যন্ত্রণা আর অভিমানের পাহাড় আশরাফির ব্যাকুল, তৃষাতুর হৃদয়টা আজ পাগলের মত মধুর কাছে ছুটে এসেছে তা কেবল সেই জানে। আর জানে তাঁর অন্তর্যামী। সমস্ত পৃথিবীতে কেবল এই একজনের কাছেই নিজের সমস্ত রাগ, দুঃখ, মনের জ্বালা উদগিরণ করতে পারে সে। আজও তাঁর ব্যতিক্রম হয় নি।
নীলার হাতে আংটি পরানোর সময় মনে হয়েছিলো বুঝি মধুকে ফিরে পাওয়ার তীব্র আকাঙ্ক্ষা, তাকে না পাওয়ার দুর্বিষহ যন্ত্রণা নিঃশব্দ ভাঙচুরে তাঁর সমস্ত হৃদয়টাকে ভেঙে গুড়িয়ে একেবারে লণ্ডভণ্ড করে দিচ্ছে। কিন্তু এমন তো হওয়ার কথা ছিলো না। ভালোই তো ছিলো আশরাফি। সবকিছুর পেছনে বিয়েটাই আসল কারণ। তাই বন্ধুদের ওপর রাগ মেটাতে না পেরে দিশেহারা হয়ে এখানে ছুটে এসেছে। কিন্তু বিনিময়ে মধুর নিরব, নির্বিকার চাহনী নিষ্ঠুরভাবে আঘাত করলো তাঁর ক্ষতবিক্ষত হৃদয়টাকে। অথচ ইতোপূর্বেও ঠিক এমনটাই ঘটেছে। আঘাতের নিরাময় খুঁজতে এসে এরচেয়ে অনেক বেশি আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে ফিরে গেছে সে। এসকল সত্যি জানার পরেও তাঁর ব্যাকুল, বিগলিত, নির্বোধ প্রেমিক হৃদয় একটুখানি সান্ত্বনা পাবার আশার ঘুরেফিরে সেই আঘাতকারিনীর কাছেই ছুটে এসেছে।
মধুর প্রশ্নের জবাবে ক্ষিপ্ত কন্ঠে বললো,’আমার প্রশ্নের জবাব চাইতে এসেছি। কেন তুমি এই জঘন্য জায়গায় পড়ে আছো? কেন একটা শয়তান দুশ্চরিত্র লোককে বিয়ে করেছো?’
-‘সেই কৈফিয়ত তোমাকে দিতে বাধ্য নই। তুমি ফিরে যাও। আরমান এসে পড়লে ঝামেলা হতে পারে।’
আশরাফি রক্তলাল চোখজোড়া ভয়ংকরভাবে তাক করলো মধুর দিকে। দাঁতেদাঁত চেপে ক্রুদ্ধ কন্ঠে বললো,একশোবার বাধ্য। আমার প্রশ্নের জবাব তোমাকে দিতে হবে। আমার লাইটাকে এভাবে হেল করে দেওয়ার কোন অধিকার তোমার নেই।’
-‘বললাম তো তোমার কোন প্রশ্নের জবাব আমি দিতে পারবো না। এককথা বারবার বলতে ভালো লাগে না।’
রাগে তাঁর গালে চড় মারতে গিয়েও নিজেকে সংযত করে নিলো আশরাফি। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে অধৈর্য কন্ঠে বললো,’তুমি আমাকে কষ্ট দিচ্ছো মেহের।’
-‘তবুও ভালো যে কষ্ট হয়। লজ্জাশরম তো নেই তোমার! নতুবা এতকিছুর পরেও নির্লজ্জের মতন এখানে আসতে পারতে না।’
অপমানে রক্তবর্ণ ধারণ করলো আশরাফির ফর্সা মুখখানা। ধক্ করে জ্বলে উঠলো চোখজোড়া। ভালোবাসার অপরাধে মধুর নিষ্ঠুর পরিহাস হলো না। পাল্টা আঘাতে সেও ক্ষতবিক্ষত করে দিলো মধুর ভেতরটাকে। রাগে দিগ্বিদিকশূন্য হয়ে ক্রুদ্ধ কণ্ঠে বললো,’এইজন্যই বলে রাস্তার কুকুরকে কখনো প্রশ্রয় দিতে নেই। প্রশ্রয় পেলে মাথায় চড়ে বসে ওরা। ঠিক তোমার মত!’
আশ্চর্য সহ্য ক্ষমতা মধুর। এতবড় অপমানের পরেও বিন্দুমাত্র বিচলিত হলো না। উল্টো আশরাফির কথার জবাবে তাঁর সর্বাঙ্গে জ্বালা ধরিয়ে নির্লজ্জের হাসলো। সহাস্যমুখে ঠাট্টার সুরে বললো,’রাস্তার কুকুর রাস্তাতেই আছে। তাঁকে তাঁর অবস্থান নিয়ে জ্ঞান দেওয়ার প্রয়োজন নেই। কিন্তু ঘরের কুকুর ঘর ছেড়ে রাস্তায় কেন বেরোলো সেটাই বুঝতে পারছি না।’ কথা শেষ করে ফের হাসলো সে। কৃত্রিম ভয় পাওয়ার ভান করে জিভ কাটলো। তারপর পরই আবার নিষ্ঠুর বিদ্রুপপূর্ণ হাসি। রাগে কটমট করে চাইলো আশরাফি। কিন্তু পূর্বের সেই তেজ এলো না। বুদ্ধিভ্রষ্ট, নির্বোদ, বেয়াড়া মেয়েটার লাগাতর হাসি তাঁর সমস্ত চিন্তাভাবনাকে বিকল করে দিয়েছে। তথাপি কৃত্রিম গাম্ভীর্য বজায় রাখতে বললো,’আমার যা খুশি আমি তাই করবো। তুমি বলার কে?’
এইকথার জবাবে পুনরায় গম্ভীর হয়ে গেলো মধু। থমথমে গলায় বললো,’এটা যা খুশি তা করার জায়গা নয়। এখানে যারা আসে তারা টাকা দিয়ে নিজেদের চাহিদা মেটাতে আসে। তুমি খামোখা নিজের সময় নষ্ট করছো।’
-‘টাকা? টাকা দিলে তোমাকে পাওয়া যাবে? কত লাগবে বলো? কত টাকা দিলে তোমাকে পাওয়া যাবে?’,অবজ্ঞাভরে চাইলো আশরাফি।
এবারের তিরস্কারটা তীক্ষ্ণভাবে গিয়ে বুকে বিঁধলো মধুর। তীব্র অপমানে ঝাঁজরা হয়ে গেলো সমস্ত শরীর। কোনমতে নিজেকে সামলে নিয়ে থমথমে গলায় বললো,’আমি আরমানের সঙ্গে কথা বলা ছাড়া কাস্টমারদের সাথে ডিল করি না।’
-‘ঠিক আছে আমি অপেক্ষা করবো।’
আশরাফি কঠিন, শক্ত মুখের দিকে তাকিয়ে ভেতরে ভেতরে ভয় পেয়ে গেলো মধু। অধৈর্য কন্ঠে বললো,’কি চাও তুমি?’
-‘আমার প্রশ্নের জবাব।’
-‘কোন প্রশ্ন? তোমাকে আমি সবই বলেছি।’
-‘সেসব আমি বিশ্বাস করি না।’
-‘সেটা তোমার সমস্যা। আমার নয়!’
-‘তারমানে তো ঘুরেফিরে একই হলো। তুমি আমাকে সত্যিটা বলবে না!’
-‘আমি সত্যিই বলেছি। তুমি দয়া করে এখান থেকে যাও প্লিজ। আরমান এসে তোমাকে দেখলে অশান্তি করবে!’
-‘কেন? আমাকে দেখলে অশান্তি করবে কেন?’
-‘কারণ কাস্টমার ছাড়া এখানে বাইরের কেউ আসতে পারে না।’
-‘ঠিক আছে আমিও পেমেন্ট করবো। বলো, একরাতের জন্য রেট কতো তোমাদের?’
তারকথাগুলো ঠিক বুঝলো না মেহের।দ্বিধাগ্রস্ত কন্ঠে বললো,’মানে?’
-‘মানে আমার প্রশ্নের জবাব না পাওয়া পর্যন্ত আমি এখানেই থাকবো। তুমি আমার জন্য একটা মেয়ের ব্যবস্থা করো। দেখতে যেন একদম তোমার মত হয়। কিন্তু স্বভাবটা তোমার চাইতে ভালো হওয়া চাই। যে ভালোবাসা দিয়ে, আদরে, সোহাগে আমার সমস্ত দুঃখ ভুলিয়ে দিতে পারবে!’
অপ্রত্যাশিত আক্রমণে শিউরে উঠে কানে হাত চাপা দিলো মধু। লজ্জায়, অপমানে সমস্ত শরীর নুইয়ে এলো তাঁর। বিব্রত গলায় বললো,’এবার আমি দারোয়ানকে ডাকবো। সে এলে কিন্তু গলাধাক্কা দিয়ে বের করে দেবে তোমাকে!’
আশরাফি যেন শুনতেই পায় নি তেমনিভাবে নিজের মত করে বললো,’ঠিক আছে। তোমার মত হতে হবে না। একটা ভালো মেয়ে হলেই চলবে।’
মধু যথাসম্ভব নিজেকে শক্ত রাখার চেষ্টা করে বললো,’আমি ভালো করেই জানি তোমার এসবে কোন আগ্রহ নেই। তুমি আমাকে রাগানোর জন্য ইচ্ছে করে এসব বলছো।’
বাস্তবিকই তাঁকে আঘাত করার জন্য কথাগুলো বলেছে আশরাফি। এছাড়া মধুর মুখ থেকে সত্যিটা বের করার আর কোন উপায় নেই। অন্তত আশরাফির সম্মানের কথা ভেবে যদি সত্যিটা বলে। মনে মনে সেই প্রত্যাশা করছে আশরাফি। নতুবা কেউ যদি একবার জানতে পারে আশরাফি এখানে রাত কাটিয়েছে তাহলে বন্ধুরা বাস্তবিকই বয়কট করবে তাঁকে। ছাত্রছাত্রীদের কাছেও মুখ দেখাতে পারবে না। তথাপি ঝুঁকিটা নিলো সে। মধুর কথার জবাবে বললো,’কেন করছি,কিসের জন্য করছি সেসব তোমার না জানলেও চলবে। তোমাকে যেটা করতে বলা হয়েছে তাই করো।’
-‘বললাম কোন মেয়েটেয়ে দেওয়া যাবে না এখন। সবাই বুকিং হয়ে গেছে। তুমি প্লিজ ফিরে যাও।’
-‘প্লিজ? হুকুম না অনুরোধ!’ হাসলো আশরাফি!কণ্ঠে স্পষ্টত তিরস্কার, চোখে যন্ত্রণা তাঁর। মধু নিজেকে সংযত করে নিয়ে বললো,’তুমি নিজেই তো বলেছো এটা নোংরা জায়গা।’
-‘সে তো এখনো বলছি।’
-‘তবে?’
-‘তোমার সব তবের মানে তো আমি তোমাকে বলবো না। তোমার যেটা কাজ সেটাই করো না।’
-‘সব মেয়েরা ব্যস্ত! কেউ নেই এখন।’
-‘মিথ্যে কথা। মিথ্যে বলছো তুমি। কল হাউজে কলগার্ল থাকবে না এ আমি বিশ্বাস করি না। আমি অন্যকারো সঙ্গে রাত কাটাবো শুনে নিশ্চয়ই তোমার খুব জ্বলছে তাইনা? নতুবা সবার জন্য মেয়ে আছে আমার জন্য নেই কেন?’
অনড় মনোভাব আশরাফির। স্থিরভাবে কিছুক্ষণ তাঁর মুখের দিকে চেয়ে থেকে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো মধু। থমথমে গলায় বললো,’বেশ এসো তবে আমার সঙ্গে।’
-‘কোথায়?’
-‘যেখানে তুমি যেতে যাচ্ছো।’
আলাদা একটা ঘরে আশরাফিকে ঢুকিয়ে দিলো মধু। ছোট খুপরির মত ঘর। ছোট একটা চৌকি আর নোংরা বিছানা। মেঝেতে ছোপছোপ দাগ আর স্যাঁতসেঁতে গন্ধ! গা গুলিয়ে বমি আসতে চাইলো আশরাফির। মাথা ভার হয়ে এলো। মধু তার মনের অবস্থা বুঝতে পেরে শীতল কন্ঠে বললো,’কিছুক্ষণ অপেক্ষা করো। তোমার পার্টনার পাঠিয়ে দিচ্ছি।’
আশরাফি তখনো ভেবেছিলো নিছক তাঁকে ভয় দেখানোর জন্যই এখানে নিয়ে এসেছে মধু। কিন্তু পার্টনার পাঠিয়ে দেওয়ার কথা শুনে অবাক হয়ে মধুর মুখের দিকে চেয়ে রইলো সে। তাকে হতবাক হয়ে চেয়ে থাকতে দেখে মধু গম্ভীর গলায় বললো,’এভাবে তাকিয়ে কোন লাভ নেই। কারণ যেই উদ্দেশ্য নিয়ে তুমি এসব করছো সেই উদ্দেশ্য একেবারেই বিফল। আমি বিন্দুমাত্রও বিচলিত নই।’
-‘মিথ্যে কথা!’, অবিশ্বাসী কন্ঠস্বর আশরাফির।
সেদিকে একবার চেয়ে মধু ব্যাখ্যা করার ভঙ্গিতে বললো,’কারণটা কি জানো?’
-‘না। জানতে চাইও না।’
-‘আমি জানি বললে তুমি কষ্ট পাবে। কিন্তু তবুও আমাকে বলতে হচ্ছে, এবার যদি অন্তত তোমার বিশ্বাস হয়। যাইহোক, কারণটা হচ্ছে তোমার কোনকিছুতে এখন আর কিছু যায় আসে না আমার। আমি নিজের জীবন নিয়ে সুখে থাকতে চাই।’
-‘সত্যি বলছো? সত্যিই সহ্য করতে পারবে তো তুমি?’ অটল অবিচল কণ্ঠস্বর আশরাফির। থমকে গেলো মধু। কিন্তু পরমুহূর্তে মন প্রশ্রয় দিয়ে বললো আশরাফি এমন কিছুই করবে না! সে কেবল ভয় দেখাচ্ছে মধুকে। তাই জবাবে সেও অবিচল কন্ঠে বললো,’পারবো।’
-‘পারবে না মেহের!’ নাসূচক মাথা দোলালো আশরাফি।
-‘বেশ। তবে দেখা যাক কার জয় হয়?’
বেরিয়ে যাচ্ছিলো মধু। বরাবরের মতন এবারেও তাঁর সংকল্পেরই জয় হলো। অবাক চোখ হাঁ করে তাঁর দিকে চেয়ে আছে আশরাফি! রাগে সমস্ত শরীর জ্বলছে তাঁর। হেঁচকা টানে মধুকে কাছে নিয়ে এলো সে। নিজের অক্ষমতার সমস্ত দায়ভার মধুর ওপরে চাপিয়ে তীব্র ঘৃণায় মুখ বাঁকিয়ে বললো,’তুমি একটা নিষ্ঠুর, পাষাণ হৃদয়ের মেয়ে। তোমার মনটা নোংরা আবর্জনার চাইতেও অনেক বেশি নোংরা। আমি তোমাকে ঘৃণা করি! আই হেইট ইউ!’ তারপর ধাক্কা মেরে মধুকে ফেলে দিয়ে বেরিয়ে গেলো সে। যাওয়ার সময় ক্ষিপ্ত কন্ঠে বললো,’এই শেষ দেখা। আর কোনদিন আমার মুখও দেখবে না তুমি!’
রাগে দিগ্বিদিক শূন্য হয়ে বেরিয়ে যাচ্ছিলো সে। ধাক্কা খেয়ে মেঝেতে পড়ে গেলো মধু। আশরাফির পরের কথাগুলো শুনে ভয়ে বুকটা কেঁপে উঠলো তাঁর। তড়িৎবেগে উঠে দাঁড়িয়ে আশরাফিকে থামানোর জন্য ছুটে গেলো। তাঁর রাগ সম্পর্কে ভালো করেই জানা আছে মধুর। মধুর সঙ্গে পেরে না উঠলে ক্ষতিটা নিজেরই করবে আশরাফি। এই কথাটা যে কেন আরো আগে মাথায় এলো না সেই অনুতাপেই লক্ষকোটিবার নিজেকে অভিসম্পাত করলো মধু। রাগের বশে সেদিনের মত আজও যদি কোন অ্যাক্সিডেন্ট ঘটিয়ে বসে তবে তো মরণ ছাড়া আর কোন উপায় থাকবে না তাঁর। দিশেহারা হয়ে পথ অবরোধ করে দাঁড়ালো আশরাফির। দুহাত মেলে বাধা দিয়ে বললো,’কোথায় যাচ্ছো?’
-‘যেখানে খুশি ইচ্ছে। তোমার তাতে কি? তুমি পথ ছাড়ো।’
-‘না। আমি তোমাকে এখন কোথাও যেতে দেবো না!’
-‘সামনে থেকে সরো বলছি!’
-‘বুকিং হয়ে গেছে। এখন কোথাও যেতে পারবে না তুমি।’
রাগে তেড়ে এলো আশরাফি। ক্রুদ্ধ কন্ঠে দাঁতেদাঁত চেপে বললো,’সহ্যের একটা সীমা আছে মেহের!’
-‘ কিন্তু তবুও এখন এখান থেকে যেতে পারবে না তুমি।’
আশরাফি হতবিহ্বল হয়ে মধুর দৃঢ়সংকল্প মুখের দিকে চেয়ে থেকে কিছুই বুঝতে পারলো না । একটু আগে তাঁকে এখান থেকে বের করে দেওয়ার জন্য উঠেপড়ে লেগেছিলো মধু। উল্টাপাল্টা কথা মনে তাঁর মাথায় আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছিলো। এখন আবার যেতে দিতে চাইছে না! ঠিক কি চাইছে টা কি সে? অগ্নিদৃষ্টিতে মধুর মুখের দিকে চেয়ে থেকে বললো,’তবে কি করতে বলছো তুমি আমাকে? ঐ মেয়ের সঙ্গে রাত কাটাতে?’
-‘হ্যাঁ। দরকার হলে তাই করবে! কিন্তু এখন কোথাও থেকে যেতে পারবে না।’
ফোঁস করে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো আশরাফি। রাগে নিচের ঠোঁটটা কামড়ে ধরলো। বড় বড় করে নিশ্বাস নিয়ে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করলো। কিছুক্ষণ সময় নিয়ে শীতল কণ্ঠে,’তুমি কি চাইছো মেহের? আমি এখানে ভাংচুর করি? ঝামেলা করে তোমার মাথা ফাটিয়ে দেই?’
-‘যা ইচ্ছে করো। কিন্তু আমি যখন বলেছি তুমি এখান থেকে যেতে পারবে না তারমানে পারবে না, ব্যস!’
-‘তুমি আমাকে জোর করে আটকে রাখবে?’
-‘মোটেই না। বুকিং তুমি দিয়েছিলে! মেয়েও রেডি।’
আচমকাই ঠাস করে চড় পড়লো মধুর গালে। চড় খেয়ে চোখেমুখে তারা দেখলো সে। এমনিতেই দুর্বল শরীর তার ওপর সারাদিনের অভুক্ত। ছিটকে মেঝেতে পড়ে গেলো। উপরন্তু কাচের টেবিলের কোনার সাথে বাড়ি খেয়ে কপাল ফেটে গেলো। তাতেও রাগ কমলো না আশরাফির। গরগর করে রাগে কাঁপতে কাঁপতে মধুর ডানহাতটা বাঁকিয়ে ধরে বললো,’বলেছিলাম না সহ্যের একটা সীমা আছে? তবুও কেন বারবার আমার কাটা ঘায়ে নুনের ছিঁটা দিচ্ছো?’
ব্যথায় কঁকিয়ে উঠলো মধু। চোখ দিয়ে টুপটুপ করে পানি গড়িয়ে পড়লো। কান্না চাপার বৃথা চেষ্টা করে বললো,’আমি তোমাকে এখানে আসতে বারণ করেছিলাম। এলে কেন তুমি?’
-‘এসেছি বেশ করেছি। তোমার কথামত চলতে হবে আমাকে? কে হও তুমি আমার?’
-‘কেউ না। কিন্তু তুমি আর এখানে এসো না প্লিজ!’
রাগে দাঁতকিড়মিড় করে পুনরায় কিছু বলতে যাচ্ছিলো আশরাফি তখনই পেছনের ঘর থেকে একটা মেয়ে দৌড়ে এসে বললো,’একি মধুমা তোমার কপাল ফাটলো কি করে? রক্ত ঝরছে যে!’
সম্বিত ফিরে পেলো আশরাফি। রাগের কারণে এতক্ষণ মধুর কপালের রক্ত খেয়াল করে নি সে। হাতের বাঁধন আলগা হয়ে গেলো। সে ছেড়ে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই হাত দিয়ে কপাল চেপে ধরলো মধু। মেয়েটা আশরাফির দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে বললো,’আপনি মধুমাকে মারছেন কেন?কি করেছে মধুমা?’ জবাবে আশরাফি মধুর দিকে ক্রুর দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললো,’সেটা তাকেই জিজ্ঞেস করো।’
মধু তাড়াতাড়ি করে চোখের পানি মুছে কৃত্রিম হাসার চেষ্টা করে বললো,’আমি ঠিক আছি। তুই যা এখান থেকে।’
-‘রক্ত ঝরছে যে…? চলো উপরে চলো। তোমাকে ব্যান্ডেজ করে দেই।’
-‘ঝরুক! সামান্য একটু রক্ত ঝরলে কেউ মরে যায় না ।’,অবরুদ্ধ ক্রন্দনে ধরে এলো মধুর গলা।
কথাটা তাঁর অভিমানের! সমস্তটাই বুঝলো আশরাফি। কিন্তু প্রকাশ করলো না। পূর্বের তুলনায় শীতল কন্ঠে বললো,’একদম ঠিক বলেছো। এই সামান্য আঘাতে কেউ মরে যায় না। তারচেয়ে বড় কথা হলো, এর থেকে অনেক খারাপ কিছু ডিজার্ভ করো তুমি। তোমার মত মেয়ের জন্য এই আঘাতটা সত্যিই সামান্য। কিন্তু আফসোস চাইলেও তোমাকে তোমার প্রাপ্য শাস্তিটা আমি দিতে পারি না।’
প্রতিবাদ করলো না মধু। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে মেয়েটার কাধে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়ালো সে। কান্না চাপতে গিয়ে ঠোঁটদুটো তিরতির করে কাঁপছে তাঁর! নিরবে একপলক আশরাফির মুখের দিকে তাকিয়ে ধীরে ধীরে উপরে উঠে গেলো।
যতক্ষণ দেখা যায় চেয়ে রইলো আশরাফি। অবসন্ন চোখজোড়া বন্ধ করতেই গড়িয়ে পড়লো দুফোঁটা তপ্ত অশ্রু। অনুতাপে, অনুশোচনায় কলিজাটা ফেটে যাচ্ছে তাঁর ! মধুর আঘাতপ্রাপ্ত করুণ মুখ, শূন্য দৃষ্টি একনিমিষেই সবকিছু ওলটপালট করে দিয়েছে। রাগের মাথায় সে যতবারই মধুকে আঘাত করেছে তাঁর চেয়ে বেশি আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছে সে নিজে। প্রতিবারই মধুকে আঘাতের যন্ত্রণা শতগুণ শক্তিশালী হয়ে তার কাছেই ফিরে এসেছে।
আঘাতে আঘাতে আজ বড্ড ক্লান্ত সে। বেরিয়েই যাচ্ছিলো। হঠাৎ একটা মেয়ে পথ আটকে দাঁড়ালো তাঁর। ফিসফিস করে বললো,’যাবেন না স্যার। কথা আছে আপনার সঙ্গে!’ টেনে তাঁকে দরজার কাছ থেকে সরিয়ে আনলো। অবাক হয়ে মেয়েটার মুখের দিকে চেয়ে রইলো আশরাফি। এই মেয়েটাকে আগেও দেখেছে সে। তাদের কম্পানীর সঙ্গে ফরেইনারদের মিটিংয়ের জন্য যেই কয়টা মেয়েকে সিলেক্ট করার হয়েছিলো তার মাঝে এই মেয়েটিও ছিলো। নাম সুলেখা! দেখতে বেশ ভালোই সুন্দরী! কিন্তু আশরাফির সঙ্গে তাঁর কি কথা থাকে বুঝতে পারছিলো না সে। সুলেখা পূর্বের মতন ফিসফিস করে বললো,’মধুমা আপনাকে মিথ্যে বলেছে স্যার! আরমানের সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয় নি! ঐ লোকটা জোর করে মধুমাকে এখানে ধরে নিয়ে এসেছে।’ হতভম্ভ,বিস্ফোরিত নয়নে বিমূঢ় হয়ে তার মুখের দিকে চেয়ে রইলো আশরাফি। আকস্মিক সমস্ত পৃথিবীটা নাড়া দিয়ে উঠলো তাঁর। ক্ষণকালের জন্য স্তব্ধ হয়ে গেলো সে! ছলছল চোখে, বোবা দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ সুলেখার মুখের দিকে চেয়ে বজ্রাহতের ন্যায় কাঁপাকাঁপা কন্ঠে উচ্চারণ করলো সে,’মেহেরের বিয়ে হয় নি!’ জবাবে মৌনমুখে দুদিকে মাথা নাড়িয়ে না বোঝালো সুলেখা!
.
.
.
চলবে
.
চলবে