মনমোহিণী পর্ব -০৬+৭

#মনমোহিণী
#Part_06
#Writer_NOVA

দুই মিনিট যাবত দরজায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছি। চোখ দুটো হাতে থাকা মোবাইলের দিকে থাকলেও কান দুটো খাড়া হয়ে আছে তায়াং ভাইয়ার কথা শুনার জন্য। খালামণির রুমের বরাবর তায়াং ভাইয়ার রুম। তবে দরজা বরাবর নয়। চার বন্ধু মিলে শলাপরামর্শ করছে ভাইয়াদের পুরান বাড়িতে যাবে। সেখানে দুটো নারিকেল গাছ আছে। গাছ থেকে নারিকেল ও ডাব পারাই এখন তাদের উদ্দেশ্য। আমি নিশ্চিত আমাদের দুই বোনকে নিয়ে যাবে না। তাই ঘাপটি মেরে দাঁড়িয়ে আছি কখন তারা বেরুবে আর তাদের লেজুড় জুড়ে আমরাও যাবো। ভাইয়া সবাইকে তাড়া দিয়ে বললো,

‘জলদী উঠ। সন্ধ্যা হলে গাছে উঠার জন্য মানুষ পাওয়া যাবে না।’

‘কই যাবি?’

শাহেদ ভাইয়া জিজ্ঞেস করলো। এতে সম্ভবত কেউ একজন শাহেদ ভাইয়ার পিঠে জোরে থাপ্পড় মেরেছে। শাহেদ ভাইয়ার চেঁচানোর আওয়াজ পাওয়া গেলো। কে মেরেছে আমি জানি না। আমি শুধু তাদের কথার শব্দ পাচ্ছি। কিছু দেখতে পাচ্ছি না।

‘এতখন কোথায় ছিলি? আমরা কি নিয়ে কথা বলছিলাম বল তো?’

ইমরান ভাইয়ার গলা পাওয়া গেলো। শাহেদ ভাইয়া কাতর গলায় বললো,

‘আমি শুনতে পাইনি বলেই তো জিজ্ঞেস করছি।’

‘শুনতে পারবি কি করে? মনটা তো পরে আছে গার্লফ্রেন্ডের কাছে।’

এনাজ বললো। তারপর একদফা ধুম ধারাক্কা মারপিট চললো। আমি সেদিকে কান দিলাম না। তায়াং ভাইয়া দরজা দিয়ে বেরিয়ে এলো। আমাকে এড়িয়ে খাবার রুমে কিছু একটা খুঁজতে লাগলো। কাঙ্ক্ষিত বস্তুটা খুঁজে না পেয়ে চিল্লিয়ে উঠলো।

‘আম্মু, কাচি (কাস্তে) কই?’

কাস্তে কে অনেক আঞ্চলিক ভাষায় কাচি বলা হয়। আমরাও বলি। খালামণি বললো,

‘খাটের নিচে।’

‘পাই না তো।’

‘খুঁজে দেখ।’

‘তুমি দিয়ে যাও।’

‘আমি যদি এসে পাই না তাহলে তোর খবর আছে।’

খালামণি তেতে উঠে বললো। আমি মুখ টিপে হেসে উঠলাম। ভাইয়া কিছু সময় এদিক সেদিক খুঁজলো।

‘কিরে তানভীর পাইছিস?’

‘হুম পাইছি।’

‘না খুঁজে ষাঁড়ের মতো চিৎকার পারে।’

এবার আমি হো হো করে উচ্চস্বরে হেসে উঠলাম। ভাইয়া আমার সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় হাত উঠিয়ে মারতে উদ্যত হলে আমি লাফিয়ে পিছনে সরে গেলাম।উপরের পাটি দাত দিয়ে নিচের ঠোঁট কামড়ে ধমকে উঠলো।

‘হোপ।’

আমি ওর ধমক গায়ে মাখলাম না। মোলায়েম কন্ঠে জিজ্ঞেস করলাম,

‘কোথায় যাবি ভাইয়া?’

সব জেনেও না জানার ভান করে তাকিয়ে রইলাম। ভাইয়া জিহ্বা বের করে ভেংচি কাটলো।

‘তোকে বলবো কেন?’

‘বল না প্লিজ।’

‘পুরান বাড়িতে যাবো ডাব পারতে।’

‘আমিও যাবো।’

‘কই যাবি?’

‘তোদের সাথে।’

‘যা ভাগ।’

‘এমন করিস কেন? নিয়ে যা না।’

অনুনয়ের সুরে বললাম। ভাইয়া পাত্তা না দিয়ে বললো,
‘বিরক্ত করিস না। সর এখান থেকে।’

আমি খালামণিকে ডেকে বিচার দেওয়ার ভঙ বললাম,
‘খালামণি দেখো ওরা পুরান বাড়িতে ডাব পারতে যাবে। কিন্তু আমাদের নিবে না।’

খালামণি রুম থেকে উত্তর দিলো,
‘তানভীর ওদের নিয়ে যা।’

‘ওরা ঐখানে গিয়ে কি করবে আম্মু?’

‘যেতে চাইছে যখন মানা করিস না।’

আমার দিকে তাকিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
‘দুই মিনিট সময় দিচ্ছি। এর মধ্যে বাইরে দেখতে চাই। নয়তো রেখেই চলে যাবো।’

আমি সম্মতি পেয়ে দৌড়ে তন্বীর রুমে ঢুকে ওড়না পাল্টে নিলাম। মাথা আঁচড়িয়ে ঝুটি পাকাতে পাকাতে তন্বীকে বললাম,

‘জলদী রেডি হো। এক জায়গায় যাবো।’

সন্ধ্যার আগেই দুই কাদি ডাব নিয়ে আমরা বাসায় ফিরলাম। সাথে ছয়টা নারিকেল। বাসায় ফিরতেই ইমরান ভাইয়া দা দিয়ে ডাব কাটতে লেগে গেলো। আমরা ততক্ষণে কলপাড়ে হাত-পা ধোয়ার প্রতিযোগিতায় নেমেছি। ইমরান ভাইয়া তন্বীকে বললো,

‘গ্লাস নিয়ে এসো।’

‘গ্লাস দিয়ে কি করবি? কেটে যার যার হাতে দিয়ে দে।’

শাহেদ ভাইয়া বললো। শাহেদ ভাইয়ার কথার পিঠে এনাজ বললো,

‘পাইপ ছাড়া কি করে খাবি?’

‘তার ব্যবস্থা আমি করছি।’

তায়াং ভাইয়া বললো। ডাবের খোসার কাটা এক ছোট টুকরো আমার শরীরে ছুঁড়ে মারলো। আমি চোখ পাকিয়ে ওর দিকে তাকাতেই আমাকে বললো,

‘রান্নাঘর থেকে ভালো দেখে কতগুলো পাটকাঠি নিয়ে আয় তো।’

‘পারবো না। নিজেরটা নিজে করে খা।’

‘মনে রাখিস। তাহলে আমিও কিন্তু তোর ভাগের ডাব কেটে দিবো না।’

আমি দাঁত কিড়মিড় করে ওর দিকে তীক্ষ্ণ চোখে তাকালাম। এখন যদি ওকে আমি চিবিয়ে খেতে পারতাম তাহলে শান্তি লাগতো। ধুপধাপ পা ফেলে রান্নাঘর থেকে ভালো দেখে কতগুলো পাটকাঠি এনে দিলাম। সেগুলো ধুয়ে ভেতরে ফুঁ দিয়ে পরিষ্কার করে ডাবের পানি খাওয়ার জন্য উপযোগী করা হলো। যার যারটা সেই করে নিয়েছে।

সাদা মেঘের ফাঁকে এক ফালি চাঁদ দেখা যাচ্ছে। তা থেকে ঠিকরে যতটুকু জোস্না ধরণীর বুকে পরছে তাতে পথ চলতে আমাদের অসুবিধা হচ্ছে না।একটু আগে আমি বায়না ধরেছিলাম রাতে নদীর পাড়ে হাঁটতে বের হবো। তায়াং ভাইয়া কিছুতে আমাদের নিয়ে বের হবে না। রিতীমত যুদ্ধ করে ভাইয়াকে রাজী করিয়েছি। এর জন্য এই অব্দি কম কথা শুনায়নি। বোনদের নিয়ে ঘুরতে বের হতে ওর এতো কষ্ট লাগে কেন তা খুঁজে পাই না। মনে হয় কলিজা ছিঁড়ে যায়।

চারিদিকে শুনশান নীরবতা। মাঝে মাঝে কংক্রিট বিছানো রাস্তায় শা গতিতে দু-একটা ভ্যান গাড়ি পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছে। গ্রামের ভেতর দিকের রাস্তায় ভ্যান দিয়ে মানুষ যাতায়াত করে। ভ্যানে চড়ে কোথাও যেতে আমার ভীষণ ভালো লাগে। বড় রাস্তায় দেখা মিলে ব্যাটারি চালিত অটো। এদিকে রিকশা একেবারেই দেখা যায় না। যা আছে ভ্যান আর অটো।

খালের ওপরের রাস্তা পার হয়ে আমি মেপে মেপে পা ফেলছিলাম। সবাই আগে চলে গেছে।রাতের পরিবেশ তন্ময় হয়ে দেখতে দেখতে আমি পিছু পরে গেছি।

‘জলদী হাঁটো।’

এনাজ পাশ থেকে বললো। আমি একবার সামনে তাকিয়ে ফের পাশে তাকালাম। উনি মোবাইল চাপতে চাপতে আমার পাশাপাশি হাঁটছে। চারিদিকে নজর দিতে দিতে উনাকে দেখিনি।

‘আপনাদের বাসা কোথায়?’

হাঁটতে হাঁটতে উনার মুখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলাম। এনাজ মোবাইল পকেটে ঢুকিয়ে আমার চোখের দিকে তাকালো।আবছা আলোতে আমি দেখলাম প্রথম দিনের মতো আবারো নজরকাড়া দৃষ্টি।বিব্রত হয়ে চোখ নামিয়ে ফেললাম।

‘ঢাকায়।’

‘ওহ।’

‘তুমি কি আগে কখনো তায়াংদের বাসায় যাওনি?’

একটা ছোট কংকর আমার জুতার ভেতর ঢুকে গেছে।হাঁটতে কিছুটা কষ্ট হচ্ছে। পায়ে ব্যাথা পাচ্ছি দেখে বারবার পায়ের দিকে নজর দিচ্ছিলাম। এনাজের প্রশ্ন শুনে বললাম,

‘যেতাম তবে কম।আমার ঢাকা পছন্দ নয়।’

‘তোমাকে আগে কেনো দেখিনি বলো তো?’

‘সেম কোশ্চেন আমারো।’

দুজন একসাথে মুচকি হেসে উঠলাম। হাত কচলাতে কচলাতে তাকে জিজ্ঞেস করলাম,

‘আপনার ভাইয়ার সাথে বন্ধুত্ব কত বছর ধরে?’

‘অনেক বছর। একসাথে হাইস্কুল, কলেজ, ভার্সিটি পেরিয়েছি।’

‘আপনি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তেন?’

‘হুম।’

‘ভাইয়াদের বাসায় যেতেন না?’

‘হুম যেতাম তো।’

‘দেখুন কান্ড! আমি আপনাকে কখনো দেখিনি।’

‘আমিও না। এমন কি আমি জানতামও না তায়াং এর এতবড় একটা খালাতো বোন আছে। আমি জানতাম ওর ছোট দুটো খালাতো বোন আছে। তাই ভেবেছিলাম অনেক ছোট।’

‘পড়াশোনা তো শেষ। এখন কি করছেন?’

‘বেকার ঘুরিফিরি।’

মুখ টিপে হেসে বললো। আমি চোখ ছোট ছোট করে বললাম,

‘সত্যি বলেন।’

‘আব্বুর একটা কাপড়ের দোকান আছে। সেখানে বসা হয়। চাকরীর জন্য চেষ্টা করছি।’

‘ওহ আচ্ছা! বাড়িতে কে কে আছে আপনার?’

‘মা-বাবা, আরেক ছোট ভাই।’

‘বাহ্ ভালোই তো। আমাদের মতো ছোট পরিবার।’

‘একটা ছোট বোন ছিলো।’

আস্তে অথচ কাটা কাটা সুরে সে বললো। আমি উৎসুক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম,

‘ছিলো বলতে?’

‘এখন নেই।’

‘কি হয়েছে?’

‘ভুয়া চিকিৎসায় মারা গেছে।’

শেষের কথাটা বলার সময় তার কন্ঠ জড়িয়ে যাচ্ছিলো। যাতে স্পষ্ট বিষাদ মাখা ছিলো। আমি কিছুটা ইতস্তত হয়ে বললাম,

‘দুঃখীত!’

এনাজ দীর্ঘ শ্বাস টেনে নিজেকে স্বাভাবিক করে বললো,

‘না না ঠিক আছে।’

কিছু সময় আবার নীরবতা। ঝোপঝাড় থেকে পোকা-মাকড়ের ডাক ভেসে আসছে। মাথার ওপর দিয়ে একটা বাদুড় চেচিয়ে ডাকতে ডাকতে তার গন্তব্যে চলে গেলো। আমি একটু থেমে নিচুস্বরে বললাম,

‘আমি জানি আমার বিষয় কিছু বলতে হবে না। ভাইয়ার থেকে সব জেনে নিয়েছেন।’

আগ্রহ ভরা চোখে এনাজের দিকে তাকালাম। এনাজ পিটপিট চোখে হেসে উঠলো৷ এতে আমি নিশ্চিত হয়ে গেলাম আমি ঠিক ধরতে পেরেছি।

‘তোমাদের মেয়েদের একটা বিষয় আমার ভালো লাগে। তা হলো কোন ছেলেটা তোমাদের দিকে কোন নজরে তাকাচ্ছে তোমরা চট করে বুঝে ফেলতে পারে। যা ছেলেরা পারে না।’

এনাজের কথার মাঝে আমি রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে গেছি।জুতার ভেতর কংকরটা এতো জ্বালাচ্ছে যে শান্তিমতো হাঁটতে পারছি না। এনাজ জিজ্ঞেস করলো,

‘কোন সমস্যা?’

‘জুতায় ইটের কোণা ঢুকছে। এটাই বড্ড জ্বালাচ্ছে।’

‘জুতা খুলে উপুড় করে কয়েকবার ঝাড়া দাও।’

আমি তাই করলাম। এখন শান্তি। অনায়াসে হাটা যাচ্ছে। তন্বী সামনে থেকে চেচিয়ে বললো,

‘নোভাপু আছো?’

আমি হাত উঁচিয়ে বলছি,
‘হ্যাঁ,আছি।’

‘না,তোমার বোনকে বেচে দিছি।’

এনাজের কথায় আমি ফিক করে হেসে উঠলাম। টুকটাক নানা কথা বলতে বলতে আমরা পথ চলতে লাগলাম। নদীর পাড়ে অনেক সময় দাঁড়িয়ে আমরা গল্প করলাম।আবছা চাদের আলোর সাথে ঝিরিঝিরি বাতাস। পরিবেশটাকে মোহনীয় করে তুলছে। একটা ছোট ট্রলার ভটভট শব্দ করে চলে গেলো।নদীর কোল ঘেঁষে ছোট একটা বাজার।মাছ, মাংস থেকে শুরু করে চাল, ডাল,আটা,শাক-সবজি নিত্য ব্যবহার্য যাবতীয় জিনিসপত্র পাওয়া যায়। আমরা বাজারের কিনার দিকের এক টং দোকান থেকে খাঁটি গরু দুধের চা খেলাম। মোড়ের দিক থেকে ঝালমুড়ি খাওয়া হলো।ইমরান, এনাজ, শাহেদ ভাইয়ার সাথে আমি অনেকটা ফ্রী হয়ে গেছি।ইমরান ভাইয়া ভীষণ মজার মানুষ। এমন এমন কথা বলে যে হাসতে হাসতে পেটে খিল ধরে যায়। হাসি-ঠাট্টায় জম্পেশ আড্ডা দেওয়া হলো। আরো কিছু সময় এদিক সেদিক ঘুরে আমরা বাড়ির পথ ধরলাম। ঘন্টাখানেক আমাদের চমৎকার সময় কেটেছে।

#চলবে#মনমোহিণী
#Part_07
#Writer_NOVA

সকাল বেলা পুকুর ঘাটে বসে সানন্দে নিমের ডাল দিয়ে দাঁত ঘষছে তিন বন্ধু। তায়াং ভাইয়াকে দেখা গেলো বালতি হাতে মাছদের খাবার দিতে। খালামণি লাড়কির ঘর থেকে এক আঁটি পাটকাঠি এনে চুলো ধরাতে লেগে গেছে। আমি একবার পুকুরঘাটের দিকে উঁকি দিলাম।

‘বুঝলি, এরেই কয় কপাল!সকাল সকাল রায়হান বউ জড়িয়ে ধরে ঘুমায়। আর আমরা চার ভাদাইম্মা নিমের ডাল দিয়া দাঁত মাজি।’

ইমরান ভাইয়া বললো। তায়াং ভাইয়া এক বাটি মাছের খাবার পুকুরে ছুড়ে মেরে পাড় থেকে চেচিয়ে বললো,

‘কেন তোর কি হিংসে হয়?’

‘না ভাই।কষ্টে বুকের বা পাশটায় চিনচিন ব্যাথা করে।’

ইমরান ভাইয়া এক হাতে বুকের বা পাশ ধরে কষ্ট পাওয়ার ভান করে বললো।শাহেদ ভাইয়া মুখে জমে থাকা ফেনা থু করে ফেলে ইমরান ভাইয়ার কথার উত্তর দিলো।

‘তোদের বিয়ে করতে মানা করছে কে শুনি?’

‘আহ্ যেই চেহারা! এই চেহারায় মাইয়া দিবে কেডা?যেই চেহারা কু’ত্তায়ও পছন্দ করবো না।’

‘আফরান নিশোর নাটকের ডায়লগ কম মা’র।’

শাহেদ ভাইয়া ধমকে উঠলো।ইমরান ভাইয়ার কথায় আমি ফিক করে হেসে উঠেছি। হাসির শব্দ পেয়ে তিনজন ঘুরে তাকালো। ইমরান ভাইয়া আফসোসের সুরে বললো,

‘আমার দুঃখে তুমি হাসো খালাতো বোইন? কেউ আমার দুঃখ বুঝলো না।’

আমি মুখ টিপে হেসে বললাম,
‘কু’ত্তা না মানুষই পছন্দ করবো ভাইয়া।’

‘ও যদি নিজের জন্য কু’ত্তা পছন্দ করলে আমাদের কি বলো তো নোভা?’

শাহেদ ভাইয়া আমার দিকে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলো। আমি ঠোঁট চেপে হাসলাম। ইমরান ভাইয়া লুঙ্গি গোড়ালির দিক থেকে কিছুটা উচু করে শাহেদ ভাইয়াকে লাথি মারলো। ব্যাস দুজন লেগে গেছে। এনাজ এর মধ্যে একটা কথাও বললো না। আমার দিকে কপাল কুঁচকে তাকিয়ে নিমের ডাল দিয়ে জোরে জোরে দাঁত ঘষতে লাগলো। আমি মুখ বাঁকিয়ে বললাম,

‘আস্তে ঘষেন।এতো ঘষলে তো দাঁত ক্ষয় হয়ে যাবে।’

এনাজ চোখ ছোট করে তীর্যক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালো।আমি ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে চলে এলাম।শান্তি লাগছে, তার কথা তাকে ফিরিয়ে দিয়েছি।আমি আবার কারো ঋণ রাখি না।

‘খালামণি কি রান্না করবা?’

‘ভাঁকা।’

‘ভাঁকা জানি কি?’

‘বৌয়া।’

‘ওহ আচ্ছা।দাও আমি আলু কুচি করে দেই।’

বটি নিয়ে আলু কাটতে বসে পরলাম। চালের সাথে ডাল, আলু কুচি দিয়ে তৈরি করা হয় এই মুখরোচক খাবার।সাথে কয়েকরকম ভর্তা হলে তো কথাই নেই।স্বাদ দ্বিগুণ বেড়ে যায়। এই খাবার বানানোর উপকরণ হলো চাল, ডাল, আলু,কাঁচা মরিচ কিংবা শুকনা মরিচ,তেল,লবণ, পানি। অনেকে ডাল, আলু দেয় না।শুধু চালের সাথে বাকি উপকরণ দিয়ে বানায়।চাল, ডাল, আলু ধুয়ে এক পাত্রে রাখা হয়। কালারের জন্য অল্প পরিমাণ হলুদ গুঁড়া দেওয়া হয়।এটা অপশনাল, না দিলেও চলে। তবে দিলে সুন্দর একটা কালার আসে।এর সাথে কাঁচা মরিচ ফালি করে কেটে দেওয়া হয় নয়তো শুকনো মরিচ। লবণ, তেল, পরিমাণমতো পানি দিয়ে একসাথে মেখে অল্প আঁচে রান্না করা হয় বৌয়া।অঞ্চলভেদে এই খাবারের নাম ভিন্ন। আমাদের অঞ্চলিক ভাষায় বলে বৌয়া। মাদারীপুরের ভাষায় ভাঁকা।

খালামণি চাল, ডাল ধুয়ে এনে আমার সামনের পাত্রে রেখে বললো,

‘তন্বী উঠেনি?’

‘না ঘুমায়।’

‘বাড়িতে মেহমান আসলে ওর ঘুম বেড়ে যায়।’

পুকুর ঘাট থেকে তাদের হাসির শব্দ কানে ভেসে আসছে। জোরে জোরে চেচিয়ে কথা বলছে। একজন আরেকজনকে পচানি দিয়ে আবার উচ্চস্বরে হেসে উঠছে৷ আমি সেদিকে কান না দিয়ে খালামণিকে জিজ্ঞেস করলাম,

‘কি কি ভর্তা বানাবা?’

‘আলু, বেগুন, মরিচ, লাউ শাক,কালোজিরা। আর ভাবছি ডিম ভাজবো।’

‘আহা, ইয়াম্মি খাবার। শুনেই তো জিভে জল চলে এলো।’

দাঁত কেলিয়ে বলে উঠলাম।খালামণি আমার কথা শুনে নীরবে হেসে উঠলো। আমি মনোযোগ দিলাম আলু কুচি করতে।

হৈ-হুল্লোড়ে মাথা ধরে যাওয়ার উপক্রম। চার বাঁদর গিয়েছে পাশের মাঠে ক্রিকেট খেলতে। খেলার থেকে চেঁচাচ্ছে বেশি। একটু পরপর এতো জোরে চিল্লানি দিয়ে উঠে যে মাথার মধ্যে টক করে চিলিক দিয়ে উঠে। আমি ও তন্বী বসেছিলাম উঠানের সামনের দিকে থাকা পাকা বেদীতে। কিন্তু এদের জন্য বোধহয় বসে থাকা যাবে না। খালামণি পিঠে বানাবে। তাই নারিকেল কোড়াতে লাগিয়ে দিয়েছে আমাদের দুই বোনকে। কোরানী দিয়ে নারিকেল কোড়াতে কোড়াতে দুই বোন গল্প জমিয়েছিলাম।

‘দেখছো কি চিল্লাইতাছে? শুধু শুধু চিল্লাইতাছে।’

তন্বী বিরক্তি নিয়ে বললো। আমি একবার পিছন ফিরে তাদের অবস্থান দেখে একগাল হেসে নিজের কাজে লেগে গেলাম। আমি যেখানে বসে আছি সেখান থেকে মাঠ স্পষ্ট দেখা যায়। তায়াং ভাইয়া বোলিং করছে। এনাজ ব্যাটিং-এ আছে। ইমরান ভাইয়া ফিল্ডিং-এ দাঁড়িয়ে চেচাচ্ছে। এলাকার অনেক ছেলেপেলে আছে।

‘তোমার বিরক্ত লাগতাছে নোভাপু।’

‘হুম একটু-আধটু!’

‘আমার মাথা ধরে যাচ্ছে।’

‘অনেকদিন পর খেলছে তো খুশিতে হুশ নেই।’

‘হুশ আমি ফেরাচ্ছি।’

তন্বী উঠে মাঠের দিকে চলে গেলো। কাঁঠাল গাছের সামনে দাঁড়িয়ে ভাইয়াকে বললো,

‘এতো জোরে চেঁচাচ্ছিস কেন? আস্তে খেল। তোদের চিৎকারে বিরক্ত লাগতেছে।’

‘হোপ! এখানে কি? যা, বাড়ির ভেতরে যা।’

তায়াং ভাইয়া হাত উঠিয়ে থাপ্পড় দেখিয়ে তন্বীকে শাসালো।আমি উঠে কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে ছিলাম।তাই সবকিছু নজরে এসেছে। এনাজের দিকে তাকাতে সে হাত নাড়িয়ে হাই জানালো। আমি ভ্রু কুঁচকে ভেংচি কেটে অন্য দিকে তাকালাম। সে নিশ্চয়ই কপাল কুঁচকে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। তাতে আমার কি? আমি তো আর তার দিকে তাকাচ্ছি না।

‘নোভা।’

এনাজের ডাক শুনে চট করে ওর দিকে তাকালাম। এই যা বলেছিলাম তো আর তাকাবো না। হাত নাড়িয়ে আবারো হাই জানালো।

‘খেলবা?’

ইমরান ভাইয়া দূর থেকে জিজ্ঞেস করলো। আমি হেসে মাথা নাড়িয়ে বললাম,

‘না!’

‘কেন?’

তায়াং ভাইয়াকে ইশারায় দেখিয়ে মুখ নাড়িয়ে বললাম,

‘ছেঁচা দিবে।’

‘বুঝি না। কি বলো?’

এনাজ আমার কথা বুঝতে না পেরে জিজ্ঞেস করলো। ইমরান ভাইয়া বললো,

‘চলে এসো খালাতো বোন।’

ইমরান ভাইয়াকে থামিয়ে দিয়ে এনাজ বললো,
‘এখানে আসার দরকার নেই। মাথার মধ্যে কি কমন সেন্স আছে নাকি গেছে?’

আমার দিকে ঘুরে হাত নাড়িয়ে বললো,
‘ভেতরে যাও।’

‘মাঠের মধ্যে একটা পা রেখে দেখ। ব্যাট দিয়ে পিটিয়ে পা ভেঙে ফেলবো। বাড়িতে যা।’

তায়াং ভাইয়া হুংকার দিয়ে উঠলো। মন খারাপ হয়ে গেলো। সবার সামনে এমনি বলবে? আমি কি খেলতাম নাকি। মুখ ঝামটা মেরে তন্বীকে টেনে বাড়ির ভেতর চলে গেলাম।

আজ আকাশে চাঁদ নেই। বরং হাজারো তারার মেলা। মাঝে মাঝে ভেসে আসছে নিশাচর পাখির ডাক। পাশের কোন গর্ত থেকে একঘেয়ে সুরে তুরকুলা পোকা ঝিঁঝিঁ শব্দে ডাকছে। আমড়া গাছের ডালে বসে দুবার হুতোম প্যাঁচা ডাকলো। নাগ বারান্দায় বসে সবাই একসাথে আড্ডা দিচ্ছিলাম। তায়াং ভাইয়া উঠে নিচ থেকে একটা ঢিল তুলে নিলো। শাহেদ ভাইয়া জিজ্ঞেস করলো,

‘ঢিল দিয়ে কি করবি?’

‘দেখ কি করি!’

ভাইয়া হাতে থাকা মাটির ঢিলটাআমড়া গাছে থাকা হুতোম প্যাঁচাকে লক্ষ্য করে ছুঁড়লো।ঢিলটা নিশ্চয়ই একদম প্যাঁচার গায়ে লেগেছে। কিছু সময় ডানা ঝাপটাতে ঝাপটাতে অন্য দিকে শা গতিতে উড়ে চলে গেলো। তায়াং ভাইয়া আমার পাশে এসে বসে বললো,

‘অনেকখন ধরে ডাকছিলো। মাথা ধরে গেছে।’

বারান্দার লাইট নেভানো।বাড়ির দক্ষিণ কোণায় একটা ছোট এনার্জি লাইট জ্বলছে। সেখানে অনেকগুলো উইপোকা উড়ে বেড়াচ্ছে। লাইট জ্বালালেই এরা দল বেঁধে বিনা দাওয়াতে চলে আসে। খালামণি মালপোয়া পিঠা ভাজছে। সেই ঘ্রাণ একটু পরপর নাকে এসে সুড়সুড়ি দিচ্ছে। বিবি খানা পিঠাও বানাবে।আমাদের গল্পের বিষয়বস্তু হলো ভুত।সবাই নিজের জানা গল্পগুলো বলছে।ইমরান ভাইয়া তার চাচার সাথে ঘটে যাওয়া একটা হরর গল্প শুনাচ্ছিলো।আমরা সবাই তন্ময় হয়ে গল্পের ভেতর ঢুকে পরেছি।

‘তায়াং বাজার থেকে চিনি নিয়ে আয় তো।’

হঠাৎ করে খালামণির গলার স্বরে পেয়ে সব কয়টা ভয় পেয়ে লাফিয়ে উঠলাম।

‘আন্টি ভয় পাইয়ে দিয়েছিলেন।’

শাহেদ ভাইয়ার কথা শুনে খালামণি হেসে উঠলো। তায়াং ভাইয়া বললো,

‘চিনি কি একটুও নেই?’

‘থাকলে আনতে বলি?’

ভাইয়ার কন্ঠে বাজারে যাওয়ার অনিচ্ছা প্রকাশ পাচ্ছে। তবুও ভাইয়া উঠে বললো,

‘আমার সাথে কে যাবি বল?’

‘কিরে ভুতের গল্প শুনে কি তুই ভয় পাচ্ছিস তায়াং?’

এনাজের কন্ঠে কৌতুকের আভাস। ভাইয়া এনাজের বাহুতে দুম করে এক ঘুষি মেরে বললো,

‘তায়াং কিছু ভয় পায় না।’

‘কি ভয় পায় না তাতো দেখতেই পাচ্ছি।’

কথাটা বলে হাত দিয়ে মুখ আটকে হাসি চেপে রাখার চেষ্টা করলাম। ভাইয়া চোখ গরম করে তাকিয়ে আমার চুল ধরে টান দিয়ে ধরলো। আমি ঠাস করে ওর হাতে থাপ্পড় দিতেই চুল ছাড়লো।অবশেষে শাহেদ ভাইয়া রাজী হতেই তায়াং ভাইয়া তাকে নিয়ে বাজারে চলে গেলো।

‘কি করা যায় বলো তো?’

তন্বীকে জিজ্ঞেস করলো এনাজ। তন্বী কিছু সময় ভেবে খুশি হয়ে বললো,

‘লুডু খেলবেন?’

‘হুম খেলা যায়।’

বারান্দার পাশের রুমে চারজন মিলে লুডু খেলতে বসেছি।জোর খেলা হবে। আমি ও ইমরান ভাইয়া, তন্বী ও এনাজ। দু পক্ষের মধ্যে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই। কে আগে ছয় উঠাতে পারে, কার গুটি খাওয়া যায়। খেলার পাশাপাশি গরম গরম পিঠে খাচ্ছি। খালামণি একটু পরপর এসে পিঠা দিয়ে যাচ্ছে।

‘ইমরান ভাইয়া আপনি কিন্তু চোরাপানি করছেন।’

তন্বী ঠোঁট ফুলিয়ে বললো। ইমরান ভাইয়া মাথা নাড়িয়ে পিঠেতে কামড় বসিয়ে বললো,

‘একটুও না।’

‘দুই নাম্বারি তো তোরাও করছিস। আমরা কি তখন কিছু বলছি?’

আমার কথায় এনাজ বললো,
‘কোথায় করেছি দেখাও তো?’

‘কাঁচা গুটি পাকা বলে চালালো কে?’

‘তোমরা যে টিপ মেরে ছয় উঠালে সেই বেলা?’

‘দেখছেন আপনি?’

‘না, দেখে বলিনি।’

ইমরান ভাইয়া দুজনকে থামিয়ে বললো,
‘ঝগড়াঝাটি মাফ করো।খেলা এবার চালু করো।’

চুপচাপ খেলায় মনোযোগ দিলাম। আমার পাকা গুটি এনাজের কোটের সামনে দিয়ে আসতে নিলে ওর গুটি দিয়ে খেয়ে ফেললো। পাকা গুটির শোকে দাঁত কিড়মিড় করে এনাজের দিকে তাকাতেই সে ভ্রু নাচিয়ে শয়তানি হাসি দিলো। মনে মনে বললাম, ‘দাঁড়াও বেটা তোমার পেপসুডেন্ট টুথপেষ্টের এড দেওয়া ছুটাচ্ছি’।

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here