মনের গহীনে পর্ব ২২+শেষ

#মনের_গহীনে
২২তম পর্ব
লেখনীতে :নাদিয়া হোসাইন

তিন দিন হয়ে গেলো, প্রিয়দের বাসায় আছে প্রাচুর্য। প্রাচুর্যর টিকিৎসা অনেকটা বাসায়-ই হচ্ছে। প্রিয় তার স্টাডি ফেলে সারাক্ষণ সময় দিয়ে যাচ্ছে প্রাচুর্যকে। তার খুব ইচ্ছে, এবাড়ির সবাইকে রান্না করে খাওয়ানোর। কিন্তু এই অবস্থায় তাকে কেউ কিচেনে ঢুকতে দেবে না। প্রাচুর্যের বাবা-মা ও প্রিয়দের বাড়িতেই আছে। কোন সন্তানকেই বোধহয় এই অবস্থায় বাবা-মা একা ছাড়তে পারে না। প্রাচুর্যর এখন নিজেকে পূর্ণ মনে হচ্ছে। এভাবে যে সবার ভালোবাসা পাবে, তা ভাবে নি। ছোট থেকেই তাকে বেশির-ভাগ সময় একা থাকতে হয়েছে। তাই স্বপ্ন ছিলো একটা বড় ফ্যামেলিতে বিয়ে হবে তার। এখন সেই স্বপ্ন-ও পূরন হয়েছে।শুধু একটাই ভয়, সভাইকে হারানোর ভয় যখন হয় -তখন সব কিছু কেমন অন্ধকারে ঘিরে যায়। প্রাচুর্য সবার মুখেই এই ভয়ের ছাপ দেখে থাকে , কিন্তু কেউ তা প্রকাশ করে না।

গোসল করে চুল মুছতে মুছতে রুমে আসলো প্রাচুর্য। প্রিয় তাকে এখন দশ মিনিটের বেশি গোসল করার টাইম দেয় না, যদি ঠান্ডা লাগে সেই ভয়ে! তাওয়ালটা চুল থেকে সরিয়ে দেখতে পেলো অনেকগুলো চুল তাওয়ালের সাথে লেগে আছে। গোসলের সময়ও দেখেছিলো। এটা স্বাভাবিক হলেও প্রতিটা মেয়ের জন্য অনেক যন্ত্রণার। চুল গুলো সরাতে গিয়ে চোখের কুর্ণিশ বেয়ে কিছু পানি পরে গেলো।
প্রিয় বিছানায় শুয়ে প্রাচুর্যের জন্য অপেক্ষা করছিলো। প্রাচুর্য আসায় তার কাছে গেলো। কিন্তু এভাবে প্রাচুর্যের কান্না দেখে বুকটা ধক করে উঠলো। ভালোবাসার মানুষটাকে কান্না করলেও দেখতে যেমন সুন্দর লাগে, তেমনি বুকে ব্যাথা-ও লাগে। প্রিয় প্রাচুর্যর কপালে চুমু দিয়ে তাকে জিজ্ঞেস করলো,__ কি হইছে বাচ্ছাটা, কষ্ট হচ্ছে? প্লিজ বলো আমাকে। আমারও তো কষ্ট হয়।
কি করবো বলো । এতোগুলো বছর চুল গুলোকে যেভাবে যত্ন করলাম। আজ দু’তিন দিনে মাথায় অর্ধেক চুলও নেই। আজ বুঝতে পারছি, ক্যান্সারের রোগীরা কতোটা অসহায় হয়।
হুস… কোন কথা নয়। চুল কোন ম্যাটার হলো বলো। তোমার প্রিয় তো সর্বত্র আছে তোমার সাথে, তো আর চাই বলো? আমার এখন একটাই স্বপ্ন, তোমার সুস্থতা। তারপর আমরা এক নতুন পৃথিবী গড়বো। তোমার সাথে যে আমার এখনো অনেক কথা বলা, পথ চলা বাকি। বিধাতা আমাদের প্রতি এতোটা নিষ্ঠুর হবে না, দেখো।
হুম। তোমাকে ভালোবেসে ভুলও করিনি আমি। এতোদিন তোমাকে না পাওয়ার যন্ত্রণাটা হয়তো এই জন্য-ই পেয়েছিলাম, যে তুমি আমার সব কিছু বুঝবে। আমার না থাকায় তুমি কি খুব কষ্ট পাবে প্রিয়?
প্লিজ প্রাচুর্য! এসব বলো না, আমার ভালো লাগছে না। তুমি এখন আমার কাছে সব। আমার অর্ধাঙ্গিনী তুমি। তাই একজন প্রেমিক তার প্রেমিকার চলে যাওয়ায় যতোটা না কষ্ট পায়, তার থেকে আমার কষ্ট খানিকটা বেশি-ই হবে৷ তাই আমি এসব শুনতে চাই না। তোমার কিছু-ই হবে না। তুমি সব সময় আমার ভালোবাসার উষ্ণতায় আমার সাথে থাকবে।
ইস.. হাউ লাকি আ’ম। এখন থেকে আর চুল-টুল নিয়ে ভাববো না। আমার চুল না থাকুক, তোমার তো আছে। তাতেই হবে। জানেন, মানুষের যদি তাৎক্ষণিক বাচ্ছা জন্ম দেওয়ার ক্ষমতা থাকতো, তাহলে আমি এখনি আমাদের একটা বাচ্ছা নিয়ে নিতাম। তখন এখটা মা মা ফিলিং আসতো।
বাহ… এতো কিছু ভেবে নিয়েছো তুমি। সমস্যা নেই, তুমি সুস্থ হও সব হবে। আর তোমাকেই তো আমি বাচ্ছা বলি। এইতো কাল রাতেও তো তোমাকে কোলে নিয়ে বারান্দায় বসে ছিলাম।তখন কিন্তু আমার একটা বাচ্ছা পালার ফিল-ই এসেছে। আর যখন আমাদের বাচ্ছা হবে, তখন দু দুটো বাচ্ছা যে কীভাবে সামলাবো।
আসো এখন বারান্দায় যাবো। আর এখনও তুমি আমাকে কোলে নিবে।
ওলে.. আমার বাচ্ছাটা। প্রাচুর্যকে কোলে নিয়ে প্রিয় বারান্দায় চলে এলো। দু’দিন আগে প্রাচুর্যের ইচ্ছেতে প্রিয় তার বারান্দায় একটা দোলনা নিয়ে এসেছিলো। প্রিয় সেটাতেই বসলো আর প্রাচুর্য প্রিয়র কোলে বসে তাকে আষ্টেপৃষ্টে জরিয়ে ধরলো। প্রিয়র সিক্স প্যাক তৈরি বুকে নাক ঘসে তার খোচাখোচা দাড়ি নিয়ে আলতো করে টানাটানি শুরু করলো। দু’জনেই নিরবতাকে সঙ্গী করেছিলো এতোক্ষণ। কিছুক্ষণ পর প্রাচুর্য বললো, __তোমার সাথে সব ইচ্ছে-ই পূরণ করলাম। কিন্তু আফসোস বৃষ্টি হলো না।
কেন বৃষ্টি হলে ভিজতে না-কি?
তা তো অবশ্যি। কিন্তু রাতের বেলা। রাতে আমরা বৃষ্টি বিলাস করতাম। আর মেইন ব্যাপার হলো, আমি দেখতে চাইছিলাম বৃষ্টি হলে চাঁদ দেখা যায় কি-না।
প্রিয় হেঁসে দিলো। প্রাচুর্যর গালে চুমু দিয়ে বললো, __ নাহ যায় না। দিনের বেলায় বৃষ্টি হলে যেমন সূর্য দেখা যায় না, তেমনি রাতেও বৃষ্টি হলে মেঘের জন্য বৃষ্টি দেখা যায় না।
কেনো যায় না? আমাকে দেখতেই হবে কেনো যায় না।তোমার সাথে ভিজবো আর তুমি আমাকে বর্ননা দিবে সব কিছুর। আমি তো সেই রকম ব্রিলিয়ান্ট না। তাও আমার কি কপাল দেখো, একটা ভবিষ্যত ডাক্টার বর পেয়ে গেলাম।
আমিও তোমাকে ডাক্তার বানানোর চেষ্টা করবো। তাও না হলে সমস্যা নেই। তোমাকে কিছু জ্ঞান দিয়ে দিবো, জ্ঞান গুলো হবে ভিলেজ ডক্টরদের মতো। আর তোমায় নিয়ে বৃষ্টি বিলাশও করবো কোন এক বর্ষার রাতে। আমার যে তোমার ভালোবাসা পুষিয়ে দিতে হবে তোমাকে। নিজের কাছে প্রমিজ করেছি, তোমার থেকেও বেশি ভালোবেসে দেখাবো তোমাকে।আর কোন কারণে যদি তোমার প্রতি আমার ভালোবাসা বিন্দুমাত্র কমে যায়, তাহলে মৃত্যু যেনো নিয়ে যায় আমাকে।
চুপ করো তুমি। আমার যা কিছু হয়ে যাক, তুমি বাঁচবে। আমাকে মনের গহীনে বাঁচিয়ে রাখবে। দিনে একবার আমাকে মনে করলেও নিজেকে স্বার্থক ভাববো।
যদি তার উলটো-টা হয়? ধর তোমার আগে তোমার প্রিয়-ই চলে যায়?
প্লিজ স্টপ প্রিয়। প্রাচুর্য কান্না করে দিলো। আমরা দু’জন-ই বাঁচবো। তুমি না বললে, আমার সাথে তোমার আরো কথা বলার আছে, পথ চলার আছে। তো কিভাবে আমরা দুজন না থাকি বলেন? দু’জনেরই দু’জনার পাশে থাকার ইচ্ছে আছে।তাদের জীবনে আরো নতুন কিছু দেখার, বলার বাকি আছে। বাকিটা ভবিষ্যৎ-ই না হয় জানিয়ে দেবে।
#মনের_গহীনে
২৩ তম পর্ব /শেষ পর্ব
লেখনীতে: নাদিয়া হোসাইন

হসপিটালের কেবিনে বসে আছে প্রাচুর্য । আজ দু’দিন হলো হসপিটালে এসেছে। বাড়ির সবাই দু’বেলা করে এসে দেখে যায় তাকে আর প্রিয় ও তার বাবা – মা তো সর্বক্ষণ-ই থাকে। কিন্তু প্রাচুর্যের অনেক বাড়িতে যেতে হয়। তার তো এখন দু’টো বাড়ি। যে বাড়িতে ছোট থেকে বড় হলো সে’বাড়িতে আর যাওয়া হবে কি-না জানে না প্রাচুর্য। এমনকি প্রিয়র বাড়িতেও যাওয়া হবে কি-না সে জানে না। প্রিয় যতোই বলুক না কেন, ভবিষ্যত নিয়ে ভাবতে। প্রাচুর্যের এখন খুব ইচ্ছে হয় এখন ভবিষ্যতে কি হবে, তা দেখতে। নিজেকে এতো অসহায় মনে হয়। ইচ্ছে করে গলা ফাটিয়ে কাঁদতে। প্রিয়র ও বাবা-মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে ইদানিং সে কাঁদতেও যেনো ভুলে গেছে। ইদানিং তার শরীরটাও খুব ভালো যাচ্ছে না। দু’মিনিট ও বসে থাকতে পারে না তীব্র মাথা ব্যাথায়। মাঝে মাঝে মনে হয় সে হাওয়ায় উড়ছে। হঠাৎ তার মনে হলো চিঠি লেখা দরকার। ইদানিং সব কথা সবাইকে সে বলতে পারছে না।তার কথাগুলো অনেকটা আবেগে মাখা থাকে এখন। এই কথাগুলো বললে তার প্রিয় জনেরা কাঁদতে বাধ্য হবে। তাই সব চিঠিতে লিখে। তার চিঠিটা অর্ধেক লিখা হয়েছে। এখন সম্পূর্ণ করতে ইচ্ছে করছে।বেডের পাশের টেবিল থেকে কাগজটা নিয়ে লিখতে বসে গেলো। আধ ঘন্টা পর প্রিয় রুমে প্রবেশ করলো। অনেক বলে কয়ে প্রিয়কে বাসায় পাঠিয়েছিলো ফ্রেশ হওয়ার জন্য। ছেলেটা এখন বাসায় যেতেই চায় না। প্রাচুর্যর লিখা চিঠিটা সম্পূর্ণ হয়েছে ঠিকই। কিন্তু এতোক্ষণ নিজেই তার লিখা চিঠিটা পরে দেখতে লাগলো, কোন খানে ভুল আছে কি-না। প্রিয়কে দেখে সে চিঠিটা ভাঁজ করে প্রাচুর্যর বক্সে রেখে দিলো। যেদিন থেকে প্রিয়র দেওয়া জিনিস গুলো বক্সে কালেক্ট করতো প্রাচুর্য, সেদিন থেকেই সে এই বক্সটা সাথে নিয়ে ঘুরে। প্রিয় প্রাচুর্যের কাছে এসে প্রাচুর্যে হাতে একটা উষ্ম স্পর্শ এঁকে বললো, __কি করছিলে এতোক্ষণ? নিশ্চয়ই আমাকে মিস করছিলে। দেখছো, এই জন্যই বাসায় যেতে চাই নি আমি।
নাহ একদমই মিস করছিলাম না। ঘন্টা খানিক হয়েছিলো তুমি গিয়েছো আর খুব দ্রুত এসেছো। তুমি অলওয়েজ আমার মনের গহীনে থাকো। তাই এই কথা একদমই বলো না। প্রাচুর্য প্রিয়র গাল টেনে দিলো।

রাত প্রায় দেড়টা। প্রাচুর্যের খুব অস্থির লাগছে। মনে হচ্ছে কিছু একটা ঠিক নেই। ঘুম আসছে না আজ প্রাচুর্যের। প্রিয়র বুকে শুয়ে আছে, তাও মনে হচ্ছে সে প্রিয়র থেকে অদূরে আছে। ডক্টর রা কেবিনে কোন পুরুষ এলাও করে না, কিন্তু প্রাচুর্যর একা ভালো লাগবে না, তাই সুবহান সালেহ অনেক রিকুয়েষ্ট করেছে ডক্টর. তারিফের কাছে, যেনো প্রিয়কে তার সাথে থাকতে দেয়া হয়। সেই জন্য-ই প্রিয় প্রাচুর্যের সাথে থাকতে পারছে। প্রাচুর্যের ইচ্ছে করছে প্রিয়র বুকের ভেতর ঢুকে যেতে। প্রিয় সারাদিন ক্লান্ত থাকায় খুব দ্রুতই ঘুমিয়ে পরেছিলো। প্রাচুর্য-ই কিছুটা ঘুমানোর অভিনয় করেছিলো , নাহলে প্রিয় প্রাচুর্যকে সজাগ রেখে কিছুতেই নিদ্রাকে আপন করে নিতো না। কিন্তু এখন প্রাচুর্যের ভালো লাগছে না। কিছুটা খারাপও লাগছে।তাই প্রিয়কে আলতো করে ধাক্কা দিয়ে ঘুম ভাঙিয়ে দিলো। আচমকা ঘুম ভাঙায় প্রিয় বিচলিত হয়ে গেলো। পরক্ষণেই মনে হলো প্রাচুর্য ঠিক আছে কি-না। প্রাচুর্যের গালে আলতো করে ছুঁয়ে দিতে বললো,__ বাচ্ছাটা, আর ইয়্যু ওকে? খারাপ লাগছে তোমার, প্লিজ বলো!
প্রাচুর্যের আসলেই খারাপ লাগছে,কিন্তু প্রিয়কে কিছু বললো না। শুধু বললো, নাহ আমার তোমার সাথে গল্প করতে ইচ্ছে করছে। আজকে হাজারো কথা বলবো, আর তুমি শুনবে।
আচ্ছা বলো তুমি। আমি শুনতে রাজি। তোমার কথা শুনবো না, তো কার কথা শুনবো বলো?
সবার কথা-ই শুনতে পারেন। আমি আপত্তি করবো না।বাট আজ যা বলবো, প্লিজ বকা দিয়েন না। এমন-ও তো হতে পারে, আমার আর সময়ই হবে না বলার। প্লিজ বাধা দিয়েন না।
প্রিয় প্রাচুর্যর গলায় নাক ডুবিয়ে দিলো। প্রাচুর্য নিরবতা সম্মতির লক্ষণ মনে করে বলতে থাকলো, জানেন, মানুষ চলে যাওয়ার আগে সে নাকি টের পায়। আমারো কিছুটা তেমনি লাগছে। ইদানিং খুব আপসোস হয়, কেনো তুমি আমাকে ভালোবাসো তা নিয়ে। নিজেকে এতোটা অপরাধী মনে হয় কি বলবো। সামায়ার চলে যাওয়ায় তুমি স্বাভাবিক হতে পেরেছো । আমি চলে গেলে তুমি কি করবে , আমি জানি না।প্লিজ নিজেকে স্বাভাবিক করে নিয়ো ? তোমাকে যে আমার শূন্যতাটা ভরাট করতে হবে। আমার স্বপ্ন গুলো সব তোমাকে দিয়ে দিলাম। যদি আমাকে একটুও ভালোবাসো , তাহলে নিজের ক্ষতি-টা করো না। আমি আর কিছু বলবো না। হয়তো আমি তোমার সাথে বাকি জীবন বাঁচতেও পারি। সব-ই উপর ওয়ালার ইচ্ছে। যদি আমাকে একটু মনে হয়, তো ভেবো তোমার কাছেই আছি আমি। আর আমি যদি না থাকি তো আমার স্বাদের বক্সটা ফেলো না প্লিজ! ওটা আমার কাছে অনেক প্রিয়। তুমি যা-ই করো এই বক্সটা তোমার ত্রিসীমানায় রাখলেও আমি খুশি হবো। আমার বদলে সবাই-কে ভালোবাসার দায়িত্ব কিন্তু তোমার। প্রিয়র কি হলো সে জানে না, এতোদিন এই ছেলেটা নিজেকে অনেকটা স্ট্রং রাখার চেষ্টা করেছে। কিন্তু আজ পারছে না। কেঁদে কেঁটে প্রাচুর্যের গলা ভিজিয়ে দিলো। প্রাচুর্য তাকে বাধা দিলো না, তারও যে চোখের পানি অবিরাম ঝরে যাচ্ছে। প্রিয় আজ প্রাচুর্যকে থামালো না। প্রিয় নিরবে সব শুনে যাচ্ছে আর প্রাচুর্য কথা বলেই যাচ্ছে। অনেক কথা বললো প্রাচুর্য। তার মন খুব হালকা লাগছে। রাতে আর দু’জনার কেউ-ই ঘুমালো না। ফজরের দিকে প্রাচুর্য বেশ কয়েক বার বমি করলো। অবস্থা কিছুটা খারাপ তার। তাও সে কথা বলে যাচ্ছে। বাবা-মা ও প্রিয়কে বলতে লাগলো, __তোমাদের কিন্তু আমি অনেক ভালোবাসি। আম্মু, আব্বু তোমরা কিন্তু আমাকে একদমই ভুলে যাবা না। আমার রুমটা প্লিজ কাউকে ইউজ করতে দিও না। আমার বই খাতা, জামা – কাপর, খেলনা সব কিছুই ওই রুমে আছে। তোমরা পারলে সব কিছু একটা আলমিরাতে ভরে রেখো। আমার রুমের প্রতিটা বস্তু কিন্তু সুন্দর করে রাখবে। আর যদি না রাখো, খুব রাগ করবো কিন্তু আমি।
প্রাচুর্যর বাবা-মা কাঁদতে লাগলো। প্রিয়ও নিরবে শুনে যাচ্ছে। কাল রাতে তাকেও এমন বহু কথা বলেছে প্রাচুর্য । কিয়ারা আর সহ্য করতে পারলো না। প্রাচুর্যকে বললো, __চুপ করো মা। আম্মুর তো কষ্ট হচ্ছে। তোমারও শরীর ক্রমশ খারাপ করছে। দিহানের আব্বু, শুনো না। প্রাচুর্যের এখানে কোন উন্নতি হচ্ছে না।ওর জিদের কারনে ওকে ও হসপিটালে রাখলে হিতে বিপরীত হবে। দ্রুত ওকে বাইরের দেশে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করো। আমার বাচ্ছাটাকে এভাবে দেখতে পারছি না।প্রিয় বাবা, ওরে চুপ করতে বলো। আমার সহ্য হয় না, আমি তো মা!
হঠাৎ প্রাচুর্যের অসহনীয় মাথা ব্যাথা শুরু হলো। জোরে জোরে চিৎকার শুরু করলো। সুবহাব সালেহ ডক্টর আনতে গেলো। প্রিয় প্রাচুর্যর হাত ধরে তাকে থামানোর চেষ্টা করতে লাগলো। কিছু পারছে না। প্রাচুর্যের চারদিন অন্ধকার হয়ে আসছে। ক্ষানিকের মধ্যে-ই সেন্সলেস হয়ে পরলো।প্রিয় অনেকবার ডাকলো, কিন্তু প্রাচুর্য কোন সাড়া দিচ্ছে না। পার্লস চেক করে দেখলো। এখনো চলছে। খানিকটা দীর্ঘশ্বাস নিলো প্রিয়। ডক্টর আর নার্সরা এসে প্রাচুর্যকে আইসিইউ-তে নিয়ে গেলো। প্রিয় এক ফলক তাকিয়ে রইলো আইসিইউ-র সামনে। বুকে একটাই আশা এখন। কখন তার প্রেয়সী বেড় হয়ে তার কাছে আসবে। চোখের জ্বল তখন শুকিয়ে গেছে।শুরু হলো এক অপেক্ষাময় প্রহর। তার অঅর্ধাঙ্গিনীর অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে রইলো সে।দরজার এপাশে ও আর ওপাশে তার প্রেয়সী। বাকি কথা না-হয় সময়ের জন্য-ই বাকি থাকুক।

ত্রিশটা বছর অতিবাহিত হয়ে গেলো। সেদিনের সেই বাইশ বছরের ছেলেটা আজ বায়ান্ন বছরের পুরুষ। মাথার চুল গুলোতেও বেশ পাঁক ধরেছে। ধরার-ই কথা, ত্রিশটা বছর তো কম নয়। আজ প্রাচুর্যের ত্রিশ তিম মৃত্যু বার্ষিকী। প্রাচুর্যের কবরের সামনে দাড়িয়ে সেইসব দিনের হিসেব গুলো করে যাচ্ছে। জীবনের ছয়’টা মাসও সে তাকে কাছে পায় নি, অথচ ত্রিশটা বছর সেই সময় গুলোকে আঁকড়ে কাটিয়ে দিলো। প্রাচুর্য তো প্রিয়র মনেফ গহীনে থাকতে চায় নি। কিন্তু প্রিয় তাকে আর মনের গহীন থেকে সরাতে পারেনি। প্রিয় আজ দেও লিয়া। ত্রিশটা বছরে আপন মানুষ গুলো কেমন করে চলে গেলো। সব-ই নিয়ে গেলো ওই প্রাচুর্য।

প্রাচুর্য সেদিন আইসিইউ থেকে ফিরেছিলো ঠিকই, কিন্তু একটা লাশ হয়ে।দেহ’টাই ফিরেছিলো মূলত, কিন্তু মন নয়। কেউ-ই মেনে নিয়ে পারে-নি তার মৃত্যু । নিবে-ই বা কি করে, সকলের মনের গহীনে যে সে ছিলো। প্রাচুর্য যাওয়ার পর প্রিয় একটুও কাঁদেনি। শুধু সেদিন-ই কেঁদেছিলো, যেদিন সে প্রাচুর্যের সেই বক্সটা বেড় করেছিলো। এতোদিনে প্রাচুর্যের দেহ যেমন মাটিতে মিশে গিয়েছিলো, তেমনি প্রিয়-র দেওয়া ফুল গুলোও শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। চুড়ি, আংটি, পায়েল এসব অনেক দিনে পেয়েছিলো প্রাচুর্য। সেই বক্সে তাদের বিয়ের দেনমোহর-এর পাঁচ হাজার টাকাও ছিলো। একটা চিঠিও পেয়েছিলো প্রিয়, যার উপরে লিখা ছিলো প্রিয়-র চিঠি। যার ভাজ খুলে দেখতে পেলো….
খুব ভালোবাসি তোমাকে। এতোসুখ আমি ৷
পাবো মরার আগে, ভাবিনি। আমার মন সব৷
সময় বলতো, আমি আর বাঁচবো না। তাই
তোমার জন্য চিঠিটা খুব দরকার ছিলো।
দু’বার হার্ট ব্রোকেন হওয়া খুব সহজ নয়
প্রিয়। তুমি তোমার আব্বু-আম্মুর বড়
ছেলে। তাদের ছেলেকে নিয়ে তাদের অনেক
স্বপ্ন। আমাদের এই দু’তিন মাসের জীবনের
জন্য বাকি জীবন নষ্ট করো না। তোমাকে
তো বলেছিলাম-ই মরার পর কেউর হিংসা
থাকে না। তুমি নিজের জীবনে অন্য এক
নারী নিয়ে এসো। আমি কিছু মনে
করবো না। জান্নাতেও তো স্বামীর পাশে
অনেকগুলো হুর দেওয়া হয়। আমার
জন্য হলেও একটা বিয়ে করো। কিছু
বলবো না আমি। আমাকে শুধু দিনে
এক’দু বার মনে করলেই হবে।আমার
আম্মু-আব্বু কে একটু দেখো প্লিজ।
আমি তাদের অনেক আদরের ছিলাম।
আমার ভাইয়ারা আছে ঠিক-ই কিন্তু
তোমাকে তো আমার একটা অংশ করেই
নিলাম। তুমি না’হয় আমার শান্তনা।যদি
উলটা পালটা কিছু কর , তোমার বউ
বাচ্ছা কিন্তু ক্ষমা করবে না তোমায়।
আমি ডাক্তার হতে পারি নি, তাতে কি।
তুমি কিন্তু অনেক ভালো ডাক্তার হবে।
আমার মতো যেনো কাউকে অবেলায়
বিদায় নিতে না হয়। অনেক
ভালোবাসি। টেইক লাভ।

ইতি,
মিসেস প্রিয় চৌধুরী।

সেদিন চিঠিটা পরে বদ্ধ ঘরে খুব কেঁদেছিলো প্রিয়। প্রাচুর্য সত্যি-ই খুব নিষ্ঠুর ও স্বার্থপর। কীভাবে পারল এতো সহজভাবে প্রিয়কে বিয়ের কথা বলতে। নিজে চলে গিয়ে তো বেঁচে গিয়েছে। সাথে প্রিয়র সব কিছু নিয়ে নিয়েছে। প্রাচুর্য চলে যাওয়ার পর সুবহান সালেহ কেমন পাথর হয়ে গিয়েছিলো। একমাত্র মেয়ের এভাবে যাওয়া তার বাবা সহ্য করতে পারে নি।প্রাচুর্য চলে যাওয়ার এক বছরের মধ্যে-ই উনি স্ট্রোক করে মৃত্যু বরন করলেন। তার দু বছর পর কিয়ারাও না ফেরার দেশে চলে গেলেন। বাবা-মা বেঁচে থাকতে সব সময় প্রাচুর্যের রুমেই তার স্মৃতি নিয়ে ছিলো।মেয়ের রুমের একটা জিনিসেরও অবহেলা করেন নি। তারা চলে যাওয়ার পর প্রাচুর্য-র সব কিছু প্রিয় তার কাছে নিয়ে এলো। এসব যে তার বাচ্ছাটার শেষ স্মৃতি। খুব সহজ ছিলো না প্রিয়র একা থাকার পদক্ষেপ। তার বাবা-মা চাইছিলো সে যেনো বিয়ে করে। কিন্তু প্রিয় করেনি, উলটো তাদের কষ্ট দিয়েছিলো আরোও বেশি। দশটা বছর তার বাবা-মা তাকে নতুন করে জীবন শুরুর তাগিদ দিয়েছিলো। মানুয় মরণশীল, তাই একে একে প্রিয়র বাবা-মা ও না ফেরার দেশে চলে গেলেন। ওর মাঝে প্রিয় আরোও একা হয়ে গেলো। আপন বলতে কেউ রইলো না তার জীবনে। প্রিয়র বাবা-মা বেঁচে থাকা কালীন সময়ে এক অদ্ভুত কান্ড ঘটেছিলো। সামায়ার বিয়েটা কোন এক কারনে ইহানের সাথে হয়নি। কিন্তু কেনো, তা প্রিয় জানে না। সামায়ার বাবা-মা প্রিয়র জন্য সামায়াকে বিয়ে দেবার কথা বলেছিলো, কিন্তু সে রাজি হয়নি। বিয়ে তো একবারই হয়, তাও তার প্রাচুর্যের সাথে হয়ে গেছে।তার বউ তো তার মনের গহীনে আছে-ই। অন্য কাউকে কি দরকার। কি অদ্ভুত তাই না? যে সামায়ার জন্য এতো কিছু করলো প্রিয়। সে সামায়াকে তার পাওয়ার আশা ছিল, কিন্তু গ্রহণ করে নি।ততোদিনে তার একমাত্র ভালোবাসা প্রাচুর্য-ই ছিলো। প্রিয় পেরেছে, প্রাচুর্যের থেকেও বেশি তাকে ভালোবাসতে৷ খুব জানতে ইচ্ছে হয় প্রিয়র, প্রিয়কে এভাবে একা দেখে কি বলে প্রাচুর্য।

এতোক্ষন এসব ভেবে একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস নিলো প্রিয়। আজ সে প্রাচুর্যের পছন্দের সূর্যমুখীত, কৃষ্ণচূড়া ও শিউলি ফুল এনেছে। প্রাচুর্য থাকলে হয়তো এতোক্ষণে তার বক্সে ফুল গুলো রেখে দিতো।এটা ভাবতেই প্রিয়র মুখে হাঁসি ফুটে উঠলো। আকাশের দিকে তাকিয়ে প্রিয় বলল,__ আজ বহুদিন আমি অনেক একা প্রাচুর্য। কেউ নেই আমার। যারা আছে, তারা নিজেদের জীবন নিয়ে ব্যস্ত। আমার মনের গহীনে শুধুই তুমি। ত্রিশটা বছর ধরে তোমার অপেক্ষায় আছি প্রাচুর্য। তোমার সাথে যে আমার আর কথা বলা হলো না,পথ চলা হলো না।ওপাড়ে গিয়ে আমাদের একটা না পাওয়া সংসার হবে। এপাড়ে না-হয় তুমি আমার মনের গহীনে আমার একটা অংশ হয়ে থাকো৷

শূন্যতা যখন আমার সঙ্গি,
তুমি আমার অপ্রাপ্তি।
আছো মনের গহীনে।
যার সাথে আছে আমার
অদূরের পথ চলা।
যাকে হয়নি কো বলা,
এখনো ভালোবাসি।

সমাপ্তি..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here