১.
এসএসসি পরীক্ষায় ফেল করার কারণে একজন ফুচকাওয়ালার সাথে প্লবতার বিয়ে দিয়ে উদ্যত হয়েছেন তার বাবা মাহিন হোসেন। প্লবতা উদাস মনে বসে আছে কাজি অফিসে। নিজেকে বড্ড অসহায় মনে হচ্ছে।
প্লবতা তার বাবাকে কোন দোষ দিচ্ছে না। এখানে সব দো’ষই তার। এসএসসি পরীক্ষার আগেই প্লবতার পড়াশোনার প্রতি অমনোযোগীতা ও খামখেয়ালিপনা দেখে মাহিন হোসেন তাকে সতর্ক করে দিয়েছিলেন যে, পরীক্ষায় খারাপ রেজাল্ট করলে ফুচকাওয়ালার সাথে তার বিয়ে দিয়ে দেবেন। কিন্তু প্লবতা সেসব কথায় কর্ণপাত করে নি৷ সে ভেবেছিল তার বাবা এমন করবেন না শুধু শুধু তাকে ভয় দেখাচ্ছেন।
এমন ভাবনা নিয়েই প্লবতা পড়াশোনায় তেমন আগ্রহ দেখালো না। যার ফলস্বরূপ সে এসএসসি পরীক্ষায় ফেল করল। গতকাল রেজাল্ট আসার পর থেকে প্লবতার বাবা মাহিন হোসেন নিশ্চুপ ছিলেন। প্লবতার মা তাকে অনেক গা’লমন্দ করলেও তিনি কিছু বলেন নি৷ তাই প্লবতা ভেবেছিল এই যাত্রায় সে বেঁচে গেছে। কিন্তু তার বাবার নিশ্চুপ থাকা যে আজকের এই ঝড়ের পূর্বাভাস ছিল সেটা এখন ভালোই উপলব্ধি করছে প্লবতা।
কাজি সাহেব প্লবতাকে অনেক আগেই রেজিস্ট্রি পেপারে সই করতে বলেছেন। কিন্তু প্লবতা চুপ করে বসে আছে। মাহিন হোসেন এবার তাড়া দিয়ে বললেন,
‘কি হলো চুপ করে আছ কেন? সই করো বলছি।’
প্লবতা এইপর্যায়ে কেঁদেই দিল। মাহিন হোসেনের পায়ের কাছে বসে অনুরোধ করে বলল,
‘প্লিজ আব্বু এমন করো না। আমাকে আরেকবার শুধু সুযোগ দাও। আমি আল্লাহর কসম করে বলছি এবার দিনরাত জেগে পড়ে হলেও পাস করব। তাও আমার এতবড় সর্বনাশ করো না।’
মেয়ের এমন আকুল আবেদনেও মাহিন হোসেনের মন গলল না। তিনি রাগী গলায় বললেন,
‘তোমার উপর আমার আর কোন আস্থা নেই। আমি এই এলাকার একজন স্বনামধন্য লোক। সবাই আমাকে মান্য করে চলে। কিন্তু আজ শুধুমাত্র তোমার জন্য আমার মাথা নিচু হয়ে গেছে। যারা এতদিন আমায় দেখে সম্মানের সহিত সালাম করত তারা আমাকে দেখে ফিসফিস করে বলছে, এই দেখ প্লবতার বাবা যেই প্লবতা এসএসসিতে ফেল করেছে। একবার ভেবে দেখেছ তোমার জন্য আমার সম্মান কোথায় গিয়ে ঠেকেছে? না, তোমাকে আর কোন সুযোগ দেব না। তাছাড়া তোমাকে আমি আগেই এই বিষয়ে সতর্ক করেছিলাম। তুমি তো জানোই আমি এক কথার লোক। তাই আমার কথার কোন নড়চড় হবে না।’
প্লবতা আর কিছু বলতে পারল না। এদিকে ধীরাজ অনিমেষ চেয়ে আছে প্লবতার দিকে। মেয়েটাকে সে অনেক আগে থেকে চেনে। প্রায় প্রতিদিনই তার কাছে ফুচকা খেতে যেত। মেয়েটা নিঃসন্দেহে ভারী সুন্দরী। ধীরাজের কেন জানি বিষয়টা ভালো লাগছে না যে ম্যাট্রিক পরীক্ষায় ফেল করার দরুন এত সুন্দর একটা মেয়ের ভবিষ্যত এভাবে ন’ষ্ট হবে। তাই সে বলে ওঠে,
‘ওনার যদি ইচ্ছা না থাকে তাহলে আমি এই বিয়েটা করতে চাইনা।’
মাহিন হোসেনের জোড়া ভ্রুযুগল কুঁচকে গেল। তিনি গম্ভীর গলায় বললেন,
‘তোমার কাছে আমি কোন পরামর্শ চাইনি ছেলে! তোমার মায়ের চিকিৎসার সব খরচ কিন্তু আমি বহন করছি এই কথাটা ভুলে যাবা না।’
ধীরাজ চুপসে গেল। আজ সে সত্যি বড্ড নিরুপায়। নিজের মায়ের জীবন বাঁচানোর জন্য আজ নিজের মতের বিরুদ্ধে এই বিয়েটা করতে হচ্ছে তাকে। দারিদ্রতা যে কতোটা ভয়াবহ অভি’শাপ সেটা আজ বেশ টের পাচ্ছে ধীরাজ। সে তো শুধু এই হিসাবই মেলাতে পারছে না যে একজন বাবা কিভাবে এত নিষ্ঠুরতা দেখাতে পারেন তার মেয়ের প্রতি? মুখের কথার দাম কি সত্যিই এত বেশি!
কাঁদতে কাঁদতে বেহাল দশা প্লবতার। কিন্তু এই কান্না তার পিতার কঠোর হৃদয় গলাতে কার্যকর নয়। প্লবতা এই পর্যায়ে একটি কঠিন সিদ্ধান্ত নিল। সে দৌড়ে চলে যাওয়ার চেষ্টা করল। ঠিক সেই সময় মাহিন হোসেন বলে উঠলেন,
‘যদি আজ তুমি এই বিয়ে না করে পা’লিয়ে যাও তাহলে আর কখনো আমার বাড়িতে পা রাখতে পারবে না। আমার বাড়ির দরজা চিরকালের মতো তোমার জন্য বন্ধ হয়ে যাবে। তাই যদি নিজের ভালো চাও তাহলে বাধ্য মেয়ের মতো বিয়েটা করে নাও।’
প্লবতার দুটো পাই থমকে গেল। পুনরায় ফিরে এসে চেয়ারে আসন গ্রহণ করল সে। অতঃপর প্রস্তুত হলো নিজের নিয়তিকে বরণ করে নেওয়ার জন্য।
কাজি সাহেব প্লবতার দিকে রেজিস্ট্রি পেপার এগিয়ে দিয়ে সেখানে সই করতে বললেন প্লবতাকে। প্লবতা কিছুক্ষণ ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল তার বাবার দিকে। অতঃপর সই করে দিলো।
প্লবতার পরে ধীরাজও সই করল সেই পেপারে। অতঃপর মাহিন হোসেন তাদের দুজনকে নিয়ে বেরিয়ে এলেন কাজি অফিস থেকে। ধীরাজ মাথা নিচু করে হেঁটে চলেছে। প্লবতার দিকে একটি বারের জন্যেও তাকাচ্ছেনা। আজ নিজের কাছেই নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছে তার।
এদিকে প্লবতা যেন এক অনুভূতিহীন এক মানবীতে পরিণত হয়েছে। নিজের খামখেয়ালিপনার জন্য যে এতবড় শা’স্তি ভোগ করতে হবে সেটা হয়তো কখনো কল্পনাতেও আনেনি মেয়েটি।
★★★
কিছুদূর পথ এগিয়ে এসে মাহিন হোসেন প্লবতার উদ্দ্যেশ্যে বলল,
‘তুমি এখান থেকে সরাসরি ধীরাজের সাথেই চলে যাও। এখন থেকে তুমি ওর সাথেই থাকবে।’
প্লবতা মলিন হেসে বলল,
‘তার মানে আজ থেকে কি তোমার সাথে আমার সব সম্পর্ক শে’ষ আব্বু।’
‘ধরে নাও সেটাই৷ যেই মেয়ে আমার সম্মান ধূলোয় মিশিয়ে দিয়েছে, তার সাথে সম্পর্ক রাখার কোন অভিপ্রায় আমার নেই।’
প্লবতার নরম মনে এই শক্ত কথাটির গভীর প্রভাব পড়ল। হঠাৎ করেই অদম্য জেদ এসে ভড় করলো তার মনে। সে বলে উঠলো,
‘বেশ, তবে ধরে নাও আজ থেকে আমি মৃ’ত। কথা দিচ্ছি, ম’রে যাবো তবু কোনদিন তোমার বাড়িতে পা রাখব না।’
মাহিন হোসেন প্লবতার মুখে এমন কথা শুনে বেশ অবাক হলেন। তবে তিনি কথাটাকে বেশি গুরুত্ব দিলেন না। প্লবতাকে আর কিছু না বলে ধীরাজের কাধে হাত রেখে বললেন,
‘ওর খেয়াল রেখো। এখন থেকে কিন্তু ও তোমার দায়িত্ব।’
ধীরাজ কি বলবে কিছু বুঝতে পারছিল না। কিছুক্ষণ ভেবে বললো,
‘চিন্তা করবেন না। আমি আপনাকে মেয়েকে আমানত হিসেবে খেয়াল করে রাখব। কখনো এই আমানতের খেয়ানত করব না।’
মাহিন হোসেন তাদের মাঝরাস্তায় রেখে বাড়ির দিকে রওনা দিলেন। তার যাওয়ার পানে দুঃখভরা দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো প্লবতা। ধীরাজ প্লবতার উদ্দ্যেশ্যে বলল,
‘এখন তাহলে আমার বাড়িতে চলেন।’
প্লবতা ধীরাজের দিকে না তাকিয়েই বলল,
‘আমি কোথাও যাব না। আমি ফে’ল করেছি জন্য আমার বাবা আমার সাথে এমন করল! আমার তো বেঁচে থাকাই উচিৎ নয়। আমি শে’ষ করে দেবো নিজেকে।’
কথাটা বলেই প্লবতা সেখান থেকে ছুট লাগালো। ধীরাজ প্লবতার পেছন পেছন দৌড় দিল। প্লবতাকে আটকে বলল,
‘ইহকালের জীবনটা ক্ষণস্থায়ী। এখানে সামান্য একটা পরীক্ষায় ফেল করে নিজের মহামূল্যবান জীবন শে’ষ করে পরকালে অনন্তকালের জীবনকে দো’যখে পরিণত করবেন না।’
‘এসব জ্ঞান দেওয়া খুব সহজ। আমার যায়গায় থাকলে বুঝতেন।’
ধীরাজ মৃদু হেসে বললো,
‘আমি আপনাকে কোন জ্ঞান দিচ্ছি না। আপনি হয়তো এই পৃথিবীর বাস্তবতা ভালো ভাবে বুঝে উঠতে পারেন নি। আপনি আজ সামান্য এটুকু কষ্ট সহ্য করতে না পেরে নিজেকে শে’ষ করতে চাইছেন। অথচ এই পৃথিবীতে এমন অনেক মানুষ আছে যারা নিত্যদিন এর থেকে হাজারগুণ বেশি ক’ষ্ট সহ্য করেও বাঁচার জন্য ল’ড়াই করে যাচ্ছে। জীবন যে কতোটা দামী সেটা আপনি উপলব্ধি করতে পারেন নি। আমার সাথে চলুন আমাদের বস্তিতে। সেখানে গেলে দেখতে পারবেন জীবন কতটা বে’দনাদায়ক হতে পারে। সেখানকার মানুষদের ক’ষ্ট দেখলে আপনার হয়তো তাদের তুলনায় নিজের এই অবস্থা খুবই নগণ্য মনে হবে।”
প্লবতা কিছুক্ষণ ভেবে বললো,
‘আচ্ছা চলুন। আমিও দেখি বাস্তবতা আসলে কতটা কঠিন!’
অতঃপর দুজনে রওনা দিলো ধীরাজের বাড়ির দিকে।
চলবে ইনশাআল্লাহ ❤️✨
#মন_দিয়েছি_তোমার_নামে
#পর্বঃ১
#লেখিকাঃদিশা_মনি