মন দিয়েছি তোমার নামে পর্ব -০৬ ও শেষ

#মন_দিয়েছি_তোমার_নামে
#অন্তিম_পর্ব
#লেখিকাঃদিশা_মনি

প্লবতা ধীরাজকে ফিরিয়ে দেওয়ার পর ধীরাজ ব্যথিত মনে বাড়িতে ফিরে যায়। অতঃপর আসমানী বেগম ও মিতুকে সব কিছু খুলে বলে। সব শুনে আসমানী বেগম বলেন,
‘যা হয়েছে তা তোরই দো’ষ। প্লবতা একদম ঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তোর মতো স্বার্থপর আর ঠকবাজ ছেলের সাথে সে কেন নিজের জীবন কা’টাবে?’

ধীরাজ কোন উত্তর দিতে পারে না। কিন্তু কষ্টে তার বুক দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে। সে প্লবতাকে সত্যিই অনেক ভালোবেসে ফেলেছে। তার মন থেকে অনেক বেশি ভালোবাসার প্রকাশ ঘটেছে প্লবতার প্রতি। তাই সে মিতুর কাছে পরামর্শ চায় কিভাবে প্লবতাকে ফিরিয়ে আনতে পারবে৷ তখন মিতুও আসমানী বেগমের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বলে,
‘ভাবির সিদ্ধান্তকে তুমি মেনে নাও ভাইয়া। তুমি ভাবির সাথে অন্যায় করেছ, আল্লাহর বান্দার সাথে অন্যায় করলে যতক্ষণ পর্যন্ত না সেই বান্দা ক্ষমা করছে ততক্ষণ স্বয়ং আল্লাহও ক্ষমা করেন না। তাই এই বিষয়ে আমার কিছু করার নেই৷ হয় তুমি নিজের মতো চেষ্টা করে যাও আর নাহলে সবকিছু সময়ের উপর ছেড়ে দাও।’

ধীরাজ নিরাশ হয় কিন্তু আশা হারায় না। সে এই আশা মনে লালন করে যে একদিন না একদিন ঠিকই প্লবতাকে আবার ফিরিয়ে আনতে পারবে।

কয়েক মাস পর,
প্লবতা আজ এসে উপস্থিত হয়েছে ধীরাজের বাড়িতে। এতগুলো দিন প্লবতাকে ফেরানোর জন্য অনেক চেষ্টা করে গেছে ধীরাজ কিন্তু প্লবতা ফেরেনি। আজ যখন প্লবতা নিজে থেকে ফিরে এসেছে তখন ধীরাজের খুশি আকাশ ছুয়েছে।

ধীরাজ এগিয়ে এসে প্লবতাকে উদ্দ্যেশ্য করে বলে,
‘আমি জানতাম আপনি একদিন না একদিন ঠিকই ফিরবেন আমার কাছে।’

ধীরাজের সব উচ্ছ্বাসকে এক লহমায় মাটিতে মিশিয়ে দেয় প্লবতা। ধীরাজের দিকে ডিভোর্স পেপারস এগিয়ে দিয়ে বলে,
‘আমি এখানে কোন সম্পর্ক জোড়া লাগাতে নয় বরং ভাঙতে এসেছি। এই নিন ডিভোর্স পেপারস আর এখানে সই করে দিন আর মুক্তি দিন আমাকে।’

ধীরাজের মূর্তির মতো তাকিয়ে রইল প্লবতার মুখপানে। এ কেন কথা বলছে প্লবতা?

ধীরাজ অবিশ্বাস্য স্বরে বলল,
‘আপনি কি সত্যিই এমনটাই চান?’

প্লবতা নিদ্বিধায় বলল,
‘জ্বি।’

ধীরাজের মাথায় হঠাৎ করে জেদ চাপল। সে ডিভোর্স পেপারে সই করে দিলো। মিতু ও আসমানী বেগমও ততক্ষণে হাজির হয়েছেন। প্লবতা তাদের কাছে গিয়ে বলল,
‘আপনাদের সাথে আমার কোন রাগ বা ক্ষো’ভ নেই। আপনারা আমার কাছে অতি আপনজন। কিন্তু আজ যেহেতু আমাদের তালাক হয়ে গেল তাই এরপর থেকে আর কখনো আমি এখানে আসব না। কারণ এখন থেকে আমাদের একে অপরের মুখ দেখাও হারাম৷ আপনারা ভালো থাকবেন। আল্লাহ হাফেজ।’

প্লবতা আর এক মুহুর্ত কাল বিলম্ব করল না। চলে গেল ধীরাজদের বাড়ির সামনে থেকে৷ রেখে গেল তিনটি ব্যথিত হৃদয়।

★★★
সময়ের স্রোত এগিয়ে এসেছে ৬ বছর। অনেক কিছুই এখন সম্পূর্ণ বদলে গেছে৷ ফুচকাওয়ালা ধীরাজ এখন ডাক্তারি ইন্টারশীপ করছে। এখন আর সে আগের মতো অসহায় নেই। নামের আগে ডাঃ শব্দটা জুড়ে গেছে। মা-বোনকে নিয়ে আগের থেকে ভালো অবস্থানে রয়েছে সে। এত পূর্ণতার মাঝেও কোথাও যেন কিছু একটার অভাব তাকে তাড়িয়ে বেড়ায়। প্লবতার সাথে ডিভোর্সের পর আর কাউকে নিজের জীবনে জড়ায় নি ধীরাজ। সে জীবনে এখনো মুভ অন করতে পারেনি৷ যদিও ধীরাজ শুনেছিল প্লবতার নাকি বিয়ে হয়ে গেছে,নিজের জীবন নিয়ে সে এখন অনেক খুশিও আসে। প্লবতার খুশির কথা শুনে ধীরাজের মাঝেও শান্তি বিরাজ করছে।

তবে সে যে নিজের মন প্লবতার নামেই লিখে দিয়েছে। তাই চাইলেও অন্য কাউকে সেই মন পিঞ্জিরায় ঠাই দিতে পারছে না।

অতীতের বিভিন্ন ভাবনা শেষে ধীরাজ আজও হাসপাতালের উদ্দ্যেশ্যে চলে এসেছে।

আজ একজন বড় ডাক্তারের সহযোগী হিসেবে সে একজন রোগীকে দেখবে। যার নাকি অনেক অবস্থা অনেক খারাপ। বাঁচার আশা একেবারেই ক্ষীণ। তাকে সুস্থ করার প্রয়াসই চালানো হবে।

ধীরাজ কেবিনের সামনাসামনি আসতেই অবাক হয়ে যায়। কারণ সে দেখে প্লবতার বাবা মাহিন হোসেন কেবিনের বাইরে দাঁড়িয়ে কান্না করে চলেছেন৷ ধীরাজ তার পাশে যেতেই তিনি ধীরাজের হাতে হাত রেখে কেঁদে দেন। করুণ আকুতি করে বলেন,
‘আমার মেয়েটাকে তুমি বাঁচাও বাবা, ওকে তুমি বাঁচাও। আজ শুধুমাত্র আমার জন্য আমার মেয়েটার এমন করুণ অবস্থা।’

‘আপনি শান্ত হন। কি হয়েছে প্লবতার?’

‘ওর ক্যান্সার হয়েছে, লাস্ট স্টেজ।’

প্লবতার বাবার কথা শুনে ধীরাজের চোখ অশ্রুসিক্ত হয়ে যায়। সে বলে,
‘এসব কি করে হলো? আর আপনি একা কেন প্লবতার হাজবেন্ড কোথায়?’

মাহিন হোসেন বললেন,
‘প্লবতার স্বামী তো আমার সামনে দাঁড়িয়ে তুমিই তো ওর স্বামী।’

‘এসব কি বলছেন আপনি? আমাদের তো ডিভোর্স হয়ে গেছে।’

‘না, তোমাদের ডিভোর্স হয়নি। তুমি ডিভোর্স পেপারে সই করলেও প্লবতা তা করে নি৷ বাড়িতে এসেই ডিভোর্স পেপারস ছিড়ে ফেলেছিল।’

‘আপনার কথা আমি বুঝতে পারছি না। প্লবতা যদি আমাকে ডিভোর্স না দিতে চায় তাহলে আমাকে দিয়ে ডিভোর্স পেপারসে সই করালো কেন? আর আমি যে শুনেছিলাম ওর বিয়ে হয়ে গেছে সেটা কি তাহলে মিথ্যা?’

‘এসব কিছুর জন্য আমি দায়ী। আমি প্লবতাকে বলেছিলাম তোমাকে ছেড়ে দিতে যার বিনিময়ে আমি তোমার ডাক্তার হওয়ার সব খরচ বহন করব।আর প্লবতার বিয়ের কথাটাও আমার ছড়ানো গুজব।’

ধীরাজ কাপা গলায় বলে,
‘তার মানে আমি কোন স্কলারশিপ পাই নি! প্লবতার ত্যাগের বিনিময়ে ডাক্তার হতে পেরেছি।’

ধীরাজ আর কালক্ষেপন না করে প্লবতার কেবিনে প্রবেশ করল। প্লবতার মুখপানে তাকাতেই তার বুক ধ্বক করে উঠল। সেই সুশ্রী মুখশ্রী এখন মলীন হয়ে গেছে। প্লবতার হাটু সমান চুল সব ঝড়ে গেছে। সারা শরীরে কালসিটে দাগ। এসব কিছু যেন প্লবতার বিদায়েরই বার্তা দিচ্ছে। ধীরাজের প্লবতার এমন অবস্থা দেখে চিৎকার করে কেঁদে ওঠে। প্লবতা ধীরাজের দিকে তাকিয়ে ভাঙা ভাঙা গলায় বলে,
‘আ,আপনি এসেছেন। আপনারই প্রতীক্ষায় ছিলাম।’

ধীরাজ প্লবতার কাছে এসে বলে,
‘কেন করলেন এমন? নিজেকেও কষ্ট দিলেন আর সাথে আমাকেও।’

‘আপনি যেমন নিজের মায়ের ভালোর জন্য আমার বাবার কথা শুনেছিলেন সেই একই কাজ আমি করেছি নিজের স্বামীর ভালোর জন্য।’

‘এটা কেমন ভালো প্লবতা? যেখানে আপনিবীনা জীবন কা’টাতে হবে?’

প্লবতার কন্ঠ ক্ষীণ হয়ে আসে। অনেক কষ্টে সে বলে,
‘আমাদের পথচলা আল্লাহ বেশিদূর লিখে রাখেন নি। আমার এই ক্ষয়িষ্ণু জীবনে আপনার প্রতি ভালোবাসাই সেরা প্রাপ্তি।’

‘আপনি কোন চিন্তা করো না। কিছু হবে না আপনার। আপনি একদম সুস্থ হয়ে উঠবেন। তারপর আমরা একসাথে বাকি জীবন কা’টাবো।’

‘আপনি অনেক অবুঝ ধীরাজ। বাস্তবতাকে মেনে নিন। আমি আর থাকবো না। কিন্তু আপনি আমাকে কথা দিন আপনি নিজের জীবনে থেমে থাকবেন না। নতুন কাউকে নিয়ে আবার নতুন ভাবে জীবন শুরু করবেন।’

‘একদম বাজে কথা বলবেন না। কিচ্ছু হবে না আপনার। আমার আর কাউকে লাগবে না। আমার শুধু আপনাকেই চাই।’

প্লবতা হঠাৎ করে কাশতে শুরু করে। কাশতে কাশতে তার রক্তবমি শুরু হয়। মুখ দিয়ে অনবরত রক্ত পড়তে শুরু করে। অবশেষে প্লবতা দুচোখের পাতা বন্ধ করে চিরবিদায় জানায় এই পৃথিবীকে। শেষ বিদায়ের আগে ধীরাজের দিকে তাকায়। অতঃপর আল্লাহর নাম নিয়ে দুনিয়া ত্যাগ করে।

ধীরাজ প্লবতার শ্বাস প্রশ্বাস ত্যাগ করে বুঝতে পারে প্লবতা তাকে ফাকি দিয়ে চলে গেছে। মুহুর্তেই ধ্রুবর সব কান্না দূর হয়ে যায়। পাথরের মতো হয়ে যায় সে।

৩০ বছর পর,
প্লবতার কবরের উপর একটি ফুল রাখে ধ্রুব। এখন আর আগের মতো নেই সে। বার্ধক্যের ছাপ পড়েছে চেহারায়। অনেক বড় ডাক্তারও হয়ে গেছে। দেশের সবাই তাকে একনামে চেনে। প্লবতার কবরের দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে ধ্রুব বলে,
‘আজ ৩০ বছর হয়ে গেল আপনি আমার থেকে দূরে। আশা করি যেখানেই আছেন অনেক সুখে আছ। আচ্ছা, আমার উপর আপনি কি রাগ করেছেম? কারণ আপনার শেষ ইচ্ছা যে আমি পূরণ করিনি। কি করব বলুন আমার মন যে আপনার নামে দিয়েছি৷ সেখানে আর কারো স্থান নেই।’

**The End***

1 COMMENT

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here