মন দিয়েছি তোমার নামে পর্ব -০২

#মন_দিয়েছি_তোমার_নামে
#পর্বঃ২
#লেখিকাঃদিশা_মনি

প্লবতা ধীরাজের বাড়ির কাছাকাছি এসে অবাক হয়ে গেল। বস্তির লোকেদের মানবেতর জীবনযাপন তাকে গভীরভাবে স্পর্শ করছে। সকলে একবেলা ভাতের জন্য যেভাবে সংগ্রাম করছে, এত অভাব অনটনের মধ্যেও বেচে থাকার জন্য আপ্রাণ লড়ছে তা প্লবতার মনে গভীর ভাবে দা’গ কে’টে যাচ্ছে।

প্লবতা ধীরাজের দিকে তাকায়৷ ধীরাজ বলল,
‘দেখছেন তো মানুষ কত কষ্ট করে বেচে আছে এই পৃথিবীর মধ্যে। অথচ আপনি কত সাধারণ কারণে নিজেকে শেষ করতে চাইছিলেন৷ একবার ভেবে দেখুন তো, আজ যদি আপনি নিজেকে শেষ করে দিতেন তাহলে সব থেকে ক্ষতির স্বীকার কি হতো? এসএসসি পরীক্ষা হলো আমাদের এই বিশাল সমুদ্র সমতূল্য জীবনের মধ্যে এক ফোটা পানির মতো। যার মূল্য যে একেবারেই নেই সেটা আমি বলব না। কিন্তু এই পরীক্ষায় ফেল করে নিজের জীবন শেষ করে আমরা নিজেদের জীবনের সবথেকে বড় পরীক্ষায় হেরে যাবো।’

‘হুম’

‘আপনি যদি আস্তিক হন,তাহলে নিশ্চয়ই আখিরাতে বিশ্বাস করেন। এসএসসি বা অন্য যেকোন পরীক্ষায় ফেল করার জন্য আপনি পৃথিবীতে যত কষ্ট পাবেন আত্ম’হত্যা করলে কিন্তু আখিরাতে তার থেকে কয়েক হাজারগুণ বেশি কষ্ট পাবেন। যেই কষ্টের কোন শে’ষ নেই। আমার মনে হয়, আপনার এখন এসএসসি পরীক্ষায় খারাপ করা নিয়ে ভাবা উচিৎ নয়। চাইলে আবার পরীক্ষা দিয়ে পাশ করতে পারবেন। কিন্তু আল্লাহর দেয়া পরীক্ষায় পাশ করছেন কিনা ভেবে দেখেছেন?’

প্লবতা জানতে চায়,
‘মানে? কি বলতে চাইছেন আপনি?’

‘আপনি কি পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়েন?’

প্লবতা আমতাআমতা করে বলল,
‘মাঝে মাঝে এশা অথবা মাগরীবের নামাজ পড়ি।’

ধীরাজ স্মিত হেসে বললো,
‘এইজন্য তো মনে হয়না আপনার কোন চিন্তা আছে, অথচ এসএসসিতে ফে’ল করায় নিজেকে শে’ষ করতে চাইছিলেন। আচ্ছা, আমায় বলুন এসএসসি পরীক্ষায় পাশ করে কি হবে? মানলাম আপনি অনেক ভালো রেজাল্ট করলেন,খুব ভালো একটা কলেজে গেলেন। তারপর ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার হলেন। এভাবে সারাজীবন সুখে, শান্তিতে আয়েশ করে কাটিয়ে দিলেন। কিন্তু এই জীবন তো ক্ষণস্থায়ী পরকালের জীবন নিয়ে কি কখনো ভেবে দেখেছেন?’

প্লবতা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল ধীরাজের দিকে। একজন সামান্য ফুচকাওয়ালা যে এত অপরিসীম জ্ঞান নিজের মধ্যে ধারণ করে রেখেছে সেটা তার ধারণার বাইরে ছিল। ধীরাজ একটু থেমে আবার বলে,
‘আপনাকে আমি জ্ঞান দিচ্ছি ঠিকি, কিন্তু আমি যে খুব বেশি ধার্মিক সেটা নই। আমি চেষ্টা করি ইসলাম মেনে চলার, আর যেহেতু এখন আপনি আমার সহধর্মিণী তাই আমি আপনাকেও উপদেশ দিব ইসলাম মেনে চলার। আপনি এখন থেকে পরিপূর্ণ পর্দা করার চেষ্টা করবেন। এটা কিন্তু একটা ফরজ বিধান। কি করবেন তো?’

প্লবতা মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ সূচক জবাব দিল৷ ধীরাজ পুনরায় বলল,
‘আর হ্যাঁ, পাঁচ ওয়াক্ত নামাজও পড়বেন।’

প্লবতা পুনরায় মাথা নাড়ায়। ধীরাজ বলে,
‘আপনি চাইলে পরের বার পুনরায় এসএসসি পরীক্ষা দিতে পারি। আমি আপনাকে সাহায্য করব।’

‘আপনি?’

‘হ্যাঁ, আমি। একজন ফুচকাওয়ালা হলেও আমি মূর্খ নই। আমি বিকেলে ফুচকা বিক্রি করলেও সকালে কলেজে যাই। আমি কলেজে সাইন্স নিয়ে পড়ছি৷ এই বছর এইচএসসি দিব।’

প্লবতা ভালো করে তাকালো ধীরাজের দিকে। সাধারণ আমাদের চোখে একজন ফুচকাওয়ালা মানেই ক্ষ্যাত আনস্মার্ট কিন্তু ধীরাজকে তাদের দলে ফেললে হবে না। ধীরাজকে দেখতে অনেক স্মার্ট লাগে। গায়ের রং ধবধবে সাদা হলেও উজ্জ্বল বর্ণের। চাপা দাড়ি শোভা পাচ্ছে গালে। চোখ, মুখের গঠনও অনেক সুন্দর। এককথায় সুদর্শন পুরুষ বলা যায়। প্লবতার একটু কৌতুহল হলো। কৌতুহল দমিয়ে রাখতে না পেরে বলে উঠল,
‘আপনি এভাবে ফুচকা বিক্রি করে পড়াশোনা সামলান কিভাবে?’

‘শুধু পড়াশোনা নয় আমাকে আরো অনেক কিছু সামলাতে হয়। আমার বাবা একজন ফুচকাওয়ালা ছিলেন। দরিদ্রতার মধ্যে বড় হলেও তিনি আমাদের কষ্টের আচ পেতে দেননি। আমাদের দুই ভাইবোনকে মানুষ করেছেন বেশ আদরে। বাবা যতদিন বেচে ছিলেন ততদিন আমাকে এসব কিছু করতে হয়নি। আমি শুধু পড়াশোনা করেছি। আমি মেট্রিক পরীক্ষায় গোল্ডেন A+ পেয়েছিলাম জানেন, বোর্ডের মধ্যে প্রথম হয়েছিলাম। কিন্তু আফসোস যেদিন রেজাল্ট এলো সেদিন আমার বাবা সড়ক দূর্ঘটনায় মারা গেলেন। আমার মা আগে থেকে অসুস্থ ছিলেন। এদিকে আমার ছোট বোনকেও সামলাতে হতো। তাই আমি বাধ্য হয়ে আমার বাবার পেশায় আছি। বাবার থেকেই ফুচকা বানানো শেখা।’

ধীরাজের জীবন সংগ্রামের এমন করুণ কাহিনি শুনে প্লবতা চমকে গেল। এক সমস্যার মধ্যে থেকেও ধীরাজ এখনো পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছে, পরীক্ষায় ভালো রেজাল্টও করেছে। অথচ সে এত সুযোগ সুবিধা পেয়েও কিছু করতে পারেনি। ফোনে আসক্ত হয়ে ছিল। প্লবতা মনে করে তার মা-বাবা তার কোন অভাব রাখেনি। প্লবতার বাড়িতে কোনও কাজও করতে হতো না। তার মা-বাবা চাইত সে শুধু পড়ুক। অথচ প্লবতা নিজের অবহেলায় আজ এই অবস্থায় এসে গেছে।

ধীরাজ প্লবতার দিকে তাকিয়ে বলে,
‘আপনার নামের মানে জানেন তো?’

‘হু!’

‘ফিজিক্সে একটা বলের নাম হচ্ছে প্লবতা। কোন বস্তুকে তরল বা বায়বীয় পদার্থে আংশিক বা সম্পূর্ণরূপে নিমজ্জিত করলে,তরল বা বায়বীয় পদার্থ যে উর্ধমূখী বল প্রয়োগ করে তাই প্লবতা। আপনার বাবা পদার্থকে খুব ভালোবাসেন তাই তিনি আপনার এই নাম রাখেন।’

‘আপনি কি করে জানলেন?’

‘আপনার বাবাই বলেছে। জানেন আপনার বাবা অনেক শিক্ষিত ছিল। পড়াশোনা করতে চাইতেন। কিন্তু কম সময়ে ওনার বাবা মানে আপনার সাদা ওনাকে পড়াশোনা ছাড়িয়ে ব্যবসা করতে লাগিয়ে দেন। তাই উনি পড়তে পারেন নি৷ তাই উনি চেয়েছিলেন ওনার একমাত্র মেয়ে মানে আপনাকে উচ্চশিক্ষিত করতে। অনেক আশা ছিল ওনার৷ কিন্তু আপনি ওনার আশার মর্যাদা রাখেন নি। উনি নিজে আমায় এসব বলেছেন।’

প্লবতা অনুশোচনার অনলে দগ্ধ হতে লাগল। ধীরাজ বলল,
‘আপনি নিজের বাবার উপর রাগ করবেন না। উনি অনেক কষ্ট পেয়েছেন। আপনি না চাইলে আপনাকে আমার সাথে সংসার করতে হবে না। কয়েক মাস পর আমি আপনাকে তালাক দিয়ে দেবো।’

প্লবতা বলে,
‘আমি আপনার সাথেই সংসার করতে চাই। এই জীবনের আসল মানে আপনি আমাকে শিখিয়ে দিয়েছেন। এখন আমাকে একটু গাইড করে সঠিক পথ দেখান।’

‘আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করব।

তাদের কথার মাঝে একজন দরজায় এসে দাঁড়িয়ে বলে,
‘ভাইয়া!’

ধীরাজ দরজার দিকে তাকিয়ে বলে,
‘আরে মিতু। আয় ভেতরে আয়।’

মিতু চলে আসে। ধীরাজ মিতুর সাথে প্লবতার পরিচয় করিয়ে বলে,
‘ও আমার বোন মিতু। ক্লাস এইটে পড়ে।’

প্লবতা মিতুর দিকে তাকিয়ে দেখতে পায় আপাদমস্তক পর্দায় আবৃত করে রাখা একটি মেয়ে। প্লবতাকে দেখে নিজের নেকাব খুলে। মিতুকে দেখে প্লবতা অবাক হয়ে যায়। অপার সৌন্দর্যের অধিকারিণী মেয়েটি। যাকে দেখে আপনাআপনি মুখ থেকে বেরিয়ে আসে, ‘ মাশাল্লাহ।’

মিতু প্লবতার সামনে এসে সুমিষ্ট কন্ঠে বলে,
‘আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহি ওয়াবারকাতুহু। ‘

‘ওয়ালাইকুম সালাম।’

মিতু বলে,
‘আমি জানি আপনি আমার ভাবি। এই পরিবারে আপনাকে স্বাগতম। বর্তমানে আম্মু নেই তাই আমিই এই পরিবারের কর্তী। আপনার কিছু সমস্যা হলে আমাকে বলিয়েন ভাবি।’

প্লবতা মিতুর ব্যবহারে মুগ্ধ হয়।

চলবে ইনশাআল্লাহ ✨

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here