মন দিয়েছে ধরা পর্ব -০৩

#মন_দিয়েছে_ধরা
#পর্বঃ৩
লেখনীতে#পুষ্পিতা_প্রিমা

নীরা চোখ মুছতে মুছতে মুখটা অন্যদিকে ফিরিয়ে রাখলো। রিপ টেবিলের ডেস্ক থেকে কাগজপত্র সব বের করে গোছ করতে করতে ভাবলো মেয়েটা কাঁদছে কেন?

পরক্ষণেই বিছানার দিকে তাকালো সে। বিছানার দিকে এগিয়ে যেতেই নীরার হাতের নীচে ইশার ছবিটা চাপা পড়া দেখতে পেল। ক্ষিপ্র দৃষ্টি নিক্ষেপ করে নীরার দিকে তাকালো সে। এত তুচ্ছ একটা বিষয়ের জন্য মেয়েটা কাঁদছে? তাকে খারাপ ভাবছে?

নীরা তাকে অমনভাবে তাকাতে দেখে ঘর থেকে বেরিয়ে যাচ্ছিলো ভয়ে। রিপ ডাক দিল।

দাঁড়াও।

নীরা থমকে দাঁড়ালো। রিপ ছবিটা নিয়ে নীরার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। বলল

তোমার কান্নার কারণ কি এই ছবিটা? যা বলবে সত্য বলবে।

নীরা তার দিকে চোখ করে তাকালো। চোখগুলো তার অভিমানী জলে ভরা। চোখ সরিয়ে নিয়ে মাথা নত করে নখ দিয়ে মেঝে খুঁটতে খুঁটতে বলল

হ্যা।

এটা পরীর হাতে ছিল। ও রেখে গেছে।

নীরা ফিরে তাকলো তার দিকে। তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে হনহনিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল রিপ। নীরা কান্নাচোখে চেয়ে রইলো। সে এত ভুল কি করে করে সবসময়? এখন কি হবে?

__________

তিনতলায় রিপের অফিসের কাজকর্ম শেষ হয়েছে। বাইরের সিঁড়ি রাখা হয়েছে তিনতলায় ক্লায়েন্টের চলাচল ব্যবস্থা সহজ করার জন্য। অফিসের ভেতরকার সবকিছু সেট-আপ করা শেষ। নীরা তখন থেকে ওকে সব জায়গায় খুঁজে না পেয়ে ভাবলো তিনতলায় যাবে। এতদিন যাওয়া নিষেধ ছিল সেখানে কাজ চলছিল তাই। এখন নিশ্চয়ই যেতে পারবে। কিন্তু যাওয়ার পথেই পরী এসে পথ আটকালো। ডাকলো

বৌউউউ।

নীরা হেসে তাকে কোলে তুলে নিল। টুপ করে চুমু খেয়ে বলল

পঁচানি রিইই কোথায়?

পরী হাত ঘুরিয়ে উত্তর দিল।

নাই। নাই।

আছে। চলুন রিইই’র কাছে যাব।

পরীকে নিয়ে তিনতলায় চলে গেল নীরা। সাদা ঝকঝকে পরিষ্কার অফিস রুম। চারপাশটা গোছানো। দেয়ালে কতকগুলো পেইন্টিং, ঘরের কোণায় ইনডোর প্ল্যান্ট, টেবিলের উপর ফাইলপত্র গুছিয়ে রাখা। সাদা রঙের একটা আলমিরা। ক্লায়েন্টদের বসার জন্য তিনটি চেয়ার রাখা । বাদামী কালো কভার পড়ানো লম্বা একটা হাতল বিশিষ্ট বেঞ্চ। ক্লায়েন্ট বেশি হলে তারা সেখানে বসে অপেক্ষা করবে। কোণায় চোখে না পড়ার মতো একটা ডিভান।
এখানে এসে নীরার মন ভালো হয়ে গেল। সে এখানে এবার থেকে বেশিবেশি আসবে। পরীকে সে টেবিলের উপর বসিয়ে দিয়ে ইনডোরপ্ল্যাটগুলো ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখছিল। আলমিরাটি খুলে দেখলো। সবগুলো ফাইল। টেবিলের ডেস্ক খুলে দেখলো সবগুলোই কাগজে কাগজে ভর্তি। দেয়ালের পেইন্টিংগুলো ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখলো সে। হঠাৎ বেঞ্চটাতে চোখ যেতেই থমকে গেল। রিপ তার দিকে তাকিয়ে আছে। কখন এসেছে? সে ডেস্ক খুলেছে ওসব দেখেছে? দেখুক তাতে কি যায় আসে? নীরার অধিকার আছে। এখন যা তার সবটা নীরারও। কারণ নীরা তার বিয়ে করা বউ।

নীরা পরীকে কোলে নিয়ে নিল। পরী রিপকে দেখে খুশি হয়ে গেল। রিপ পরীর সাথে হাসলো। নীরার দিকে চোখ যেতেই মুখ গম্ভীর করে ফেললো। নীরা পরীকে নিয়ে রিপের কিছুটা দূরে গিয়ে বেঞ্চে বসলো। পরী হামাগুড়ি দিয়ে রিপের গলা ঝুলিয়ে কোলে উঠে বসলো। রিপ তার সাথে কথা বলতে বলতে বলল

এখানে হুটহাট আসা বারণ।

কারণ?

এটা বেডরুম নয়।

আমি এখানে ঘুমাতে আসিনি।

রিপ নীরার দিকে তাকালো। নীরাও তাকালো। তারপর চোখ সরিয়ে মাথা নামিয়ে বলল

মাঝেমাঝে উল্টাপাল্টা ভেবে বসার রোগ আছে আমার। বিয়ে করার আগে এটা জেনে নেয়া উচিত ছিল।

রিপ কোনোরূপ কথা বললো না। নীরা জানতে চাইলো

আপনি আমার উপর রেগে আছেন?

নাহ। সবার উপর রাগ করা যায় না।

নীরা ফুঁসে উঠলো। এখন সে সবাই হয়ে গেল?

রাগ করে অফিসরুম থেকে বেরিয়ে গেল সে।

———

রাতে খাওয়াদাওয়ার শেষে ঘরে এসে শুয়ে পড়েছে নীরা। ঘুম আসছিল না তাই কিছুক্ষণ জানালার ধারে দাঁড়িয়ে ছিল। তারপর জানালা বন্ধ করে বিছানার উপর বসে থাকলো হাঁটু গুঁজে। ফোন হাতে নিয়ে মাকে ফোন করলো। মায়ের সাথে কথা বলা শেষে বাবার সাথেও কথা বললো। কিন্তু তারপরও শান্তি লাগছেনা। এই বাড়িতে বিয়ে করে আসার পর থেকেই তার একটা ইচ্ছে ছিল সবচাইতে বেশি । বরের সাথে বসে দুষ্টুমিষ্টও গল্প করা। তার বান্ধবী অর্পির বিয়ে হয়েছে গত সপ্তাহে। এরেঞ্জ ম্যারেজ। তাও অর্পিকে কত ভালোবাসে ওর বর। অর্পিকে ফোন করলে সবসময় ওর বরের গলা শুনতে পায় নীরা। মাঝেমাঝে অর্পি বলে বসে একদম পিছু ছাড়েনা রে। আর ইশুর বর তো আরও ভালো। ইশুকে কেমন চোখে হারায়। শুধু তার বরটা এমন। সে অবশ্য কারণটা জানে। সেদিনই একটু ভাগ্য হয়েছিল নীরার তার সাথে কথা বলার । আর সেদিনই সে সবচাইতে বড় ধাক্কাটা খেয়েছিল। রিপ রেজওয়ান খানকে সে তখন থেকেই চেনে যখন সে হাইস্কুলে পড়ে। ইশাকে স্কুলে যাওয়ার পথে ডাকতে এসে কত বাহানা করে মানুষটাকে দেখতো সে। লুকিয়ে লুকিয়ে। সামনাসামনি পড়ে যাবে এই ভয়ে মাথায় স্কুলে স্কার্ফটা লম্বা করে টেনে দিত। ওই গলাটি শুনতেই বুকের ভেতর ভুমিকম্প টের পেত সে। তখনই হয়ত মন দিয়ে বসেছিল সে। অদ্ভুত ভাবে নিয়তিও তার পক্ষে ছিল। সে মনের মানুষকে পেয়েছেও। কিন্তু সবচাইতে কষ্টের মুহূর্ত সেটাই ছিল যখন সে তার জীবনের সবচাইতে বড় সত্যিটা জানতে পেরেছে। নীরাও কথা দিয়েছিল সেদিন এই ক্ষতহৃদয় সে সাড়িয়ে তুলবে। একদিন এই নীরাকে ছাড়া মানুষটার নিজেকে সবচাইতে একা মনে হবে। নীরা তার সবকিছু জুড়ে থাকবে। কিন্তু কবে আসবে সেই দিন? কান্নারা ভেঙে আসতে চাইলেও সে কাঁদলো না। ঘড়ির কাঁটা বরাবরের মতো বারোটা ছুঁয়েছে। নীরার একা একা ঘুমাতে ভয় করে। ঘুম আসেনা কিছুতেই। তাছাড়া এ’কদিনে ওই মানুষটার গায়ের সুগন্ধিটা নাকে না এলে একেবারেই ঘুম নামেনা চোখে। একটা ভরসা পায় সে। মনে হয় সে একা নেই। তাকে দেরীতে হলেও বুঝার এবং খোঁজার একটা মানুষ আছে পাশে। যে তার কষ্টে ব্যাথিত হবে। দায়িত্ব নয় ভালোবাসার চাদরে তাকে মুড়িয়ে রাখবে। বলবে নীরা তোমাকে ছাড়া আমার কেমনকেমন লাগে, একটু কাছে এসে বসো তো। নীরা হাঁটুতে মুখ গুঁজে কাঁদে। উফফ তার অপেক্ষা ফুরোয় না ফুরোয় না।

সে আর অপেক্ষা করলো না। তিনতলায় চলে গেল। অফিসরুমে ঢুকতেই দেখলো রিপ চেয়ারে হেলান দিয়ে চোখ বুঁজে রেখেছে। ঘুম চলে এসেছে হয়ত? রাত জেগে কাজ করার কি এমন দরকার? আঙুলের ভাঁজে কলম । কলমের নীচে সাদা ফাইল পেপার । নীরা ফাইলটা বন্ধ করলো। কলমটা নিয়ে নিল। রিপ তখনি চোখ মেললো। নীরা ভয়ার্ত চোখে তাকালো। রিপ কিছু বলল না। তাকিয়েই থাকলো। নীরা বলে উঠলো

আপনার বোধহয় ঘুম এসে গেছে। এখন শোয়া দরকার।

রিপ সোজা হয়ে বসে বলল

আরও কিছু কাজ বাকি আছে। তুমি যাও। তুমি না রাত দশটায় ঘুমিয়ে পড়ো। আজ কি হলো?

নীরা হতবুদ্ধিভাব নিয়ে তাকালো। কখন সে দশটায় ঘুমিয়ে পড়ে?

আপনাকে বলেছি আমি দশটায় ঘুমানোর অভ্যাস আমার। আপনি দু লাইন বেশি বুঝেন।

রিপ অবাক চোখে তাকালো। নীরা ভড়কে গেল। এই প্রথম সে উঁচু গলায় কথা বলে ফেলেছে। রিপ বলল

আমার কাজ আছে। তুমি গিয়ে লাইট অফ করে শুয়ে পড়ো।

নীরা এবার আরও অদ্ভুত একটা কাজ করলো। বলে বসলো

আপনি কি এখানেই ঘুমাবেন ঠিক করেছেন? যদি সেটা ঠিক করে থাকেন তাহলে আমাকে কাল সকালে আমার বাড়িতে দিয়ে আসবেন। একা একা আমার অতবড় ঘরটাতে আমার গা ছমছম করে।

রিপের বিস্মিত চোখজোড়ায় নীরা ভড়কালো না।

লাইট জ্বললে তুমি এপাশ-ওপাশ করো তাই আমি কাজ করার জন্য এখানে চলে এসেছি তাও তোমার সমস্যা নীরা?

নীরা আরেকদফা অবাক হয়ে বলল

বাহ আপনি অনেক বুঝদার এডভোকেট খান। অনেক। আপনার না আমাকে বুঝার বয়সটায় হয়নি এখনো। অথচ আমাকে বুঝার জন্য আপনার এই এত মোটা মোটা বইয়ের কখনোই প্রয়োজন পড়তো না।

রিপ দাঁড়িয়ে পড়লো। শান্ত গলায় বলল

নীরা শান্ত হও।

নীরা কেঁদে উঠে রুম ছাড়লো। রিপ কপালে হাত দিয়ে চেয়ারে বসে পড়লো।

নীরা ঘরে এসে ঘর অন্ধকার করে বসে থাকলো। ভয় করুক। এর চাইতেও বড়সড় ভয়ানক পরিস্থিতিতে সে নিজেকে সামলেছে। প্রতিনিয়ত সামলাচ্ছে। বাবার আদরের কন্যা হয়ে সবকিছু চাইলেই পেয়ে যাবে এই ভাবনা থেকে সে বেরিয়ে এসেছে। ভাগ্যে যা থাকবে তাই হবে।

মিনিট কয়েকের মাথায় রিপ ঘরে এল। ডিমলাইট জ্বালিয়ে দিতেই গোলাপি আলোয় নীরা কান্নারত মুখটা দেখা গেল। দরজা বন্ধ করে এসে বিছানায় বসলো সে। নীরা ঠাঁই বসে রইলো।

রিপ ধীরেসুস্থে বলল

এবার ঘুমিয়ে পড়ো।

নীরা শুলোনা। বলল,

আমার ঘুম আসছে না।

রিপ পিঠের নীচে বালিশ দিয়ে বসলো। বলল,

আমারও ঘুম আসছে না। চা কফি কিছু হবে না কি?

নীরা কিছুক্ষণ থম ধরে বসেছিল। তারপর বিছানা থেকে নামতে যাবে তখনি রিপ খপ করে তার হাত ধরে ফেললো। তারপর ছেড়ে দিয়ে বলল

তুমি ঘুমিয়ে পড়লেই হবে। কিচ্ছু লাগবে না।

নীরা ক্ষুদ্ধ গলায় বলল

আমার ঘুম নিয়ে এত তাড়া কেন আপনার? আবার চলে যাবেন নাকি?

জাগিয়ে রেখে যাইনি যখন ঘুমিয়ে রেখে যাব না।

নীরা তার দিকে ফিরে শুইয়ে পড়লো। চট করে বলে বসলো।

একটা কাজ করব?

রিপ কৌতূহলী হয়ে জানতে চাইলো।

কি কাজ?

আপনার একটা আঙুল দিন।

রিপ বাম হাতের আঙুলটা দিল। নীরা শাড়ির আঁচলে সেটিতে পেঁচিয়ে শক্ত করে গিঁট মেরে বলল

যদি চলে যান আমি টের পাব।

রিপ তার আচরণ দেখে হতবাক। নীরা মনে মনে হাসলো। আজ রেগে যাওয়ায় লাভ হয়েছে বেশ। রাগ দেখানোর অধিকারটুকু তো পেয়েছে। আজ শুধু একটা আঙুল বাঁধলো একদিন পুরো মানুষটাকে বেঁধে নেবে।

সে ঘুমিয়ে পড়লো। রিপ তার ঘুমন্ত মুখটার দিকে তাকিয়ে কি যেন ভাবছিল তখন!

চলবে…

রিচেক হয়নি

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here