মন নিয়ে কাছাকাছি পর্ব – ১১+১২

#মন_নিয়ে_কাছাকাছি
#জেরিন_আক্তার_নিপা
১১
🌸

রেজাল্টের দিন সকালে বাবা, কাকারা কেউ কাজে গেল না। বাড়ির দুইটা মেয়ের রেজাল্ট দিবে। টেনশনে সবাই আধমরা হয়ে বারবার ওদের সান্ত্বনা দিচ্ছে।

“টেনশন করিস না মা। জিপিএ দিয়ে তো মানুষের যোগ্যতা যাচাই করা যায় না। তোরা ভালো ছাত্রী আমরা জানি। রেজাল্ট খারাপ হলেও সমস্যা নেই।”

যাদের সান্ত্বনা দেওয়া হচ্ছে তাদেরই তো কোন টেনশন নেই। উল্টো তারা সবাইকে এত বেশি টেনশন করতে দেখে বিরক্ত হচ্ছে। পরীক্ষা তো দিয়েই ফেলেছে। রেজাল্টও চলে এসেছে। এখন টেনশন করে মরে গেলেও তো কোন লাভ নেই।
মীরা মাহিমা সব বান্ধবীদের কল করে খোঁজ নিয়েছে। ওহ আরেকটা কথা। বাড়ি থেকে তাদের ফোন কিনে দিয়েছে। কাল রাতেই ফেসবুক আইডিও খুলে ফেলেছে। মীরার আইডির নাম ভোরের পাখি। মাহিমার আইডির নাম রাতের পাখি। দুই পাখিই অনেক খোজাখুজি করে মুবিন ভাইয়ের আইডি বের করে রিকোয়েস্ট পাঠিয়ে দিয়েছে। মুবিন ভাই এখনও এক্সেপ্ট করেনি। শুধু মুবিন ভাইকে রিকোয়েস্ট পাঠিয়েই ক্ষান্ত হয়নি। এলাকার সব বড় ভাইদের রিকোয়েস্ট পাঠিয়েছে। সুন্দর প্রোফাইল পিক দেখে কয়েকজন সাথে সাথে এক্সেপ্টও করে নিয়েছে। কয়েকজন মেসেজও করেছে। কিছু হাই, হ্যালো মেসেজ। কেউ কেউ জানতে চেয়েছে, আপনি কে? আপনি কি আমাকে চেনেন? মীরা মাহি বড় ভাইদের প্রোফাইলে ঢুকে লাভ রিয়েক্ট আর ওয়াও নাইস কমেন্টের বন্যা বইয়ে দিয়েছে।
রুমে এসে মীরা রিমুকে কল করল।

“হ্যালো রিমু।”

“মীরা আমার ভীষণ ভয় করছে। কাল রাতে স্বপ্ন দেখেছি আমি ফেল করেছি। বাবা মা আমাকে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে। ভোরের স্বপ্ন। এই স্বপ্ন সত্যি হয়ে গেলে সত্যি সত্যিই আমাকে বাড়ি থেকে বের করে দিলে আমি কোথায় যাব?”

“কোথায় যাবি আবার? দেশে অনাথ আশ্রম কম আছে? কোন একটায় গিয়ে উঠে পড়বি।”

“মীরা তোর কি মনে হয় আমি সত্যিই ফেল করব।”

“পরীক্ষা তুই দিয়েছিস। খাতায় কী লিখেছিস তুই জানিস। আমি কীভাবে বলব তুই পাস করবি নাকি ফেল করবি?”

“জানি না। মাহি কি তোদের বাড়িতে?”

“হ্যাঁ। কথা বলবি?”

“না। এই ভোরের পাখি, রাতের পাখি কি তোদের আইডি?”

“আমাদের আইডি হতে যাবে কেন? ওসব নামে আইডি খুলব এটা ভাবলি কীভাবে তুই? আমাদের বাপ মা আকিকা দিয়ে যে নামটা রেখেছে ওটা কি কম সুন্দর।”

“না। কিন্তু কেনই যেন মনে হলো। সবার সাথে মিউচুয়াল ফ্রেন্ড আছে দেখলাম।”

মাহিমা ইশারা করে বারণ করছে রিমুকে না জানাতে। ঠোঁট পাতলাটা সবাইকে বলে দিবে। তখন আর মজা করা যাবে না।
ইভান ভাই রেজাল্ট জেনে অফিস থেকে আসার সময় মিষ্টি নিয়ে এসেছে। মীরা মাহি দু’জনই এপ্লাস পেয়েছে। আবির খুশিতে টপাটপ পাঁচটা মিষ্টি খেয়ে নিল। আসলে এপ্লাস যে পাবে এটা ওরাও ভাবেনি। ইভান বোনদের নিয়ে গর্ব করছে।

“আমার কলিগরা সবাই জানতো আমার দুই বোন পরীক্ষা দিয়েছে। ওরা আগেই মিষ্টি আনিয়ে রেখেছিল। আমি কিছুটা ভয়ে ছিলাম। কিন্তু বোনেরা আমার ইজ্জত রেখেছে। সবাই আমাকে কংগ্রাচুলেশনস জানাচ্ছিল। যেন পরীক্ষা আমিই দিয়েছি।”

আবির একহাতে নিজের বোনের ঘাড় পেঁচিয়ে ধরে দম আটকে মেরে ফেলার উপক্রম করে বলল,

“পরীক্ষায় টুকেছিলি তাই না? নইলে তোরা দুইটাই এপ্লাস পেলি কীভাবে? আমি শিওর তোরা নকল করেছিস।”

মাহিমা রেগেমেগে বলল,

“আমি কি তোমার মতো খারাপ ছাত্র। কত কষ্ট করে পড়ে পরীক্ষা দিয়েছি।”

তনি ওসব কিছু জানে না। তার ট্রিট পাওয়াই হলো কথা।

“ট্রিট কবে দিচ্ছিস তোরা? ফাইভ স্টার হোটেলে খাব। কোন টালবাহানা চলবে না।”

মীরা মুখ মুচড়ে বলল,

“আমরা তো কষ্ট করে পড়ে এপ্লাস পেয়েছিই। এখন ট্রিট তোমরা আমাদের দিবে। তাই না রে মাহি?”

“হ্যাঁ। কষ্ট করেছি আমরা। এখন ট্রিটও দিব আমরা। এটা শুধু অন্যায় না, জুলুম।”

ইভান ওদের ঝগড়া দেখে রাজি হলো। ট্রিট সে দিবে। এতেই সবাই খুশি হয়ে গেল।
রাতে সবাই বাইরে খেতে যাওয়ার জন্য রেডি হয়েছে। ছোট ফুপা মীরা মাহিমাকে রেজাল্টের উপলক্ষে নতুন ড্রেস এনে দিয়েছে। দু’জনের জামা একইরকম। মীরা মাহিমা সাদা চুরিদার পরে নিজেরাই হালকা সেজে সবার আগে রেডি হয়ে বসে রইল। দেরি করছে প্রিয়া আপু। তার সাজগোজ শেষই হচ্ছে না। তনিও চলে এলে আবির বলল,

“প্রিয়া আপুকে ছাড়াই চলে যাই চল। ও রেডি হয়ে এসে দেখবে আমরা নেই।”

ইভান প্রিয়াকে ডাকল। প্রিয়া আর একটু বলে আরও দশ মিনিট সময় নিল। শেষে সবাই একসাথে বের হচ্ছে। মীরা মাহিমা নতুন ফোনে পিক তুলেই যাচ্ছে। বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময় হাঁটতে হাঁটতে তুলেছে। গাড়িতে বসেও বাদ রাখেনি। এখন রেস্টুরেন্টে এসেও ছবিই তুলে যাচ্ছে। তনি বিরক্ত হয়ে বলল,

“তোদের দুইটার মোবাইল ধরে কিন্তু আছাড় মারব। এত ছবি তুলতে হয়?”

কে শুনে কার কথা? তনি আপুর বকা ওরা গায়েই মাখল না। উল্টো ইভান, আবিরকে নিয়ে ছবি তুলতে লাগল।

“ভাইয়া আমাদের সাথে কয়টা সেল্ফি তুলো না।”

আবির নাচতে নাচতে রাজি হয়ে গেল।

“সেল্ফি তুলবি? আয় আয়।”

একেকজন একেক রকম মুখের ভঙ্গিমা বানিয়ে পোজ দিচ্ছে। আবির দু’জনের কান ধরে টানছে। কয়েক ছবিতে জিভ বের করে দিয়েছে।
প্রিয়া বিরক্ত হয়ে বলল,

“আগে খেয়েদেয়ে তারপর পিক তোল। পিক তো আর চলে যাচ্ছে না।”

রেস্টুরেন্টে ঢোকার সময় ফোনের দিকে ধ্যান থাকায় মাহিমা কারো সাথে ধাক্কা খেল। ওর হাত থেকে ফোন পড়ে গেলে মাহিমা চিৎকার করে উঠল,

“আমার নতুন ফোন! ইশ, ভেঙে গেল রে। গ্লাসটা মনে হয় ভেঙেই গেছে।”

মুবিন দেখেই আসছিল। কিন্তু মাহিমাই পাশ থেকে এসে ধাক্কা খেল। তবুও মুবিন দুঃখিত হলো। সে ঝুঁকে নিচে থেকে মাহিমার ফোন তুলে নিল।

“কপালের নিচে চোখ নেই? চোখে দেখতে পান না?”

বলতে বলতে মাহিমা সামনের ব্যক্তিটির দিকে তাকাল। এবং মুবিনকে দেখে কথার মাঝপথেই থেমে গেল। মুবিন চেহারার ভাব যথেষ্ট করুণ বানিয়ে বলল,

“সরি। আসলে আমি দেখিনি।”

মুবিন মাহিমার দিকে ফোন এগিয়ে দিল। মাহিমা সেটা মুবিনের হাত থেকে নিল। কিন্তু তাৎক্ষণাৎ কিছু বলতে পারল না। দোষ যে তার এটা সে-ও জানে।

“সরি। আমি সত্যিই দেখতে পাইনি।”

“ইট’স ওকে মুবিন ভাই।”

যাক মেয়েটা রাগ করেনি। মুবিন সামান্য হেসে বলল,

“তুমি এখানে?”

“আমি একা না। ভাইয়ারা সবাই এসেছে। আপনি কার সাথে এসেছেন?”

ওরা কথা বলতে বলতেই জায়িনও চলে এসেছে। জায়িনকে দেখে মাহিমা বিশাল সাইজের একটা ক্রাশ খেয়ে ফেলল। ব্লু শার্টে জায়িন ভাইকে যে কী সুন্দর লাগছে! মাহিমা হাঁ করে তাকিয়েই রইল।
এদিকে মাহিমাকে খুঁজতে খুঁজতে মীরা হয়রান। ওরা সাথেই ছিল। পেছন থেকে মাহিটা আবার কোথায় চলে গেল। মীরা দূর থেকে মাহিমার ড্রেস দেখে চিনে ফেলে ডাকল।

“ওই আবাইত্তার বংশ তোরে রেখে সবাই খেয়ে ফেলল। এখানে দাঁড়িয়ে হাওয়া খাও তুমি।”

মীরা ওদের কাছাকাছি এসে জায়িনকে দেখে থেমে গেল। সাথে মুবিনও আছে দেখে ভরসা পেল। সে এগিয়ে এসে জায়িনকে দেখে বলল,

“আসসালামু আলাইকুম জায়িন ভাই। কেমন আছেন আপনি?”

আবির ভাই-ই তো বলেছিল। রাস্তাঘাটে জায়িনকে যেখানে পাবি সালাম দিয়ে হালচাল জিজ্ঞেস করবি। মীরা সেটাই করেছে। মুবিন মীরাকে ভাইকে সালাম দিতে দেখে কিছুটা অবাক হলো। জায়িন শান্ত চোখে মীরার দিকে তাকিয়ে সালাম নিল।
মীরা মুবিনকে উদ্দেশ্য করে বলল,

“আপনারা এখানে কি করেন মুবিন ভাই? যা কী প্রশ্ন করছি! রেস্টুরেন্টে তো খেতেই আসে মানুষ।”

“আজ তো রেজাল্ট বেরিয়েছে, না?”

মাহিমা ফট করে বলে উঠল,

“সেজন্যই তো আমরা এখানে এসেছি। আমরা দু’জনই এপ্লাস পেয়েছি। তাই ইভান ভাই আমাদের সবাইকে খাওয়াচ্ছে।”

“অভিনন্দন। কলেজে কোথায় এডমিশন নিবে?”

মীরা বলল,

“জানি না। ভাইয়া চাচ্চুরা যেখানে বলবে।”

মীরা মাহিমা জোর করে জায়িন মুবিনকেও ওদের সাথে নিয়ে এলো। বাকিরাও ওদেরকে তাদের সাথেই বসতে বলল। জানা গেল গতকাল মুবিনের জন্মদিন গেছে। আজ সে ভাইয়ের থেকে ট্রিট নিতে এসেছে। মাহিমা শুনে বলল,

“যার জন্মদিন সে ট্রিট নেয় নাকি দেয়? আমাদের জন্মদিনে তো সবসময় আমরা ট্রিট দিয়ে এসেছি। তাই না রে মীরা?”

“হুম।”

তনি মুবিনের সাপোর্ট করে বলল,

“জায়িনের মতো বড় ভাই থাকলে তোরাও নিজের জন্মদিনে ট্রিট পেতি। এটাই হলো ভাইয়ের প্রতি ভাইয়ের ভালোবাসা।”

মীরা মাহিমা মন খারাপ করে দুই ভাইয়ের দিকে তাকাল। ভাইয়েরা সেটা বুঝতে পেরে বলল,

“আজকে কার ট্রিট দেওয়ার কথা ছিল? আর কে দিচ্ছে হু? তবুও বলবি তোর ভাইয়েরা ভালো না?”

মীরা মুখ মুচড়ে বলল,

“ইভান ভাই দিচ্ছে। তুমি জীবনেও দিতে না।”

“ওরে পাগল, ইভান ভাই আর আমি কি আলাদা রে?”

সবাই হাসতে লাগল। এদিকে প্রিয়া জায়িনকে দেখেই পছন্দ করে ফেলেছে। কারো কোন কথা তার কানে যাচ্ছে না। সে এক ধ্যানে জায়িনকেই দেখে যাচ্ছে। জায়িন বলল,

“তোরা থাক তাহলে। আমরা উঠি।”

আবির বাধা দিয়ে বলল,

“উঠবি কেন? ভয় পাস না। তোর খরচা হবে না। আজ সব খরচা ইভান ভাইয়ের। বোস। ছোট ভাইয়ের জন্মদিন গেল গিফট দিব না? এই মীরা, তুই তোর টিচারকে কোন গিফট দিলি না!”

চলবে_#মন_নিয়ে_কাছাকাছি
#জেরিন_আক্তার_নিপা
১২
🌸

মীরা মুবিন ভাইকে গিফট কি দিবে! সে তো জানতোই না মুবিন ভাইয়ের জন্মদিন কবে। তবে এখন যখন জেনেছে তাহলে কিছু একটা দেওয়া উচিত। কিন্তু তার হাতে কোন টাকা নেই। টাকা থাকলেও অনলাইনে কোনকিছু অর্ডার দিয়ে ফেলে। নয়তো মাহিকে নিয়ে রেস্টুরেন্টে গিয়ে পছন্দের সব খাবার খেয়ে ফেলে। মীরা ভাবল, বাবার কাছে থেকে চেয়ে নিয়ে কোন গিফট কিনে দিবে।

“মুবিন ভাই আপনার গিফটটা আমি কিছুদিন পরে দিব। আপনি রাগ করবেন না হ্যাঁ।”

মুবিন লজ্জিত মুখে হেসে জানাল,পরবর্তীতেও মীরা যেন ভালো রেজাল্ট করে। ওটাই তাহলে তার গিফট হবে। মাহিমা টেবিলের নিচ দিয়ে মীরার পায়ে লাথি দিয়ে বলল,

“দেখলি, কী ভালোবাসা! বেচারা রীতিমতো তোর প্রেমের সাগরে তলিয়ে গেছে।”

জায়িন পরেও চলে যেতে চাইলে ইভানও জোর করল। ফলে বাধ্য হয়ে জায়িন মুবিনকেও ওদের সাথে যোগ দিতে হলো। খেতে খেতে সবাই কত কথা বলছে। মাহিমার ঝাল লেগে গেলে সে ফোঁপাতে ফোপাঁতে বলল,

“অনেক ঝাল। ভাইয়া এত ঝাল খেতে পারব না আমি।”

মাহিমাকে নিয়ে সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়ল। ওর সত্যিই অনেক ঝাল লেগেছে। চোখের জলে নাকের জলে একাকার। মুবিন তাড়াহুড়ো করে পানির গ্লাস এগিয়ে দিয়ে বলল,

“পানি খাও।”

ইভান বলল,

“হ্যাঁ হ্যাঁ পানি খা।”

আবির মাহিমার সামনে থেকে ঝাল ওয়ালা ওই খাবারটা নিয়ে এসে বলল।

“ঝাল লাগছে তবুও খেয়েছিস কেন? দাঁড়া তোর জন্য কেক আনতে বলি।”

পরিস্থিতি শান্ত হলো। মীরাও ঝাল ওয়ালা খাবারটা খাচ্ছে দেখে আবির ধমক দিয়ে বলল,

“তুইও এখন ঝাল লাগিয়ে কান্নাকাটি শুরু করে দিবি।”

“না। আমি ঝাল খেতে পারি। আমার এটা খেতে মজা লাগছে।”

মাঝে মাঝে এই টেবিলে হাসির রোল পড়ছে। আশেপাশের সবাই ঘাড় ঘুরিয়ে ওদের দেখছে। খাওয়ার সময়ও মীরা মাহিমা ছবি তুলতে ভুললো না।

“ইভান ভাই, নড়ো না। যেভাবে চামচ ধরে রেখেছ ওভাবে থাকো। অনেক সুন্দর লাগছে।”

ভাইবোন সবার ছবি তুলে মুবিনের ছবি তুলতে গিয়ে অনুমতি নিল মীরা।

“মুবিন ভাই, আপনার ছবি তুললে কি রাগ করবেন?”

মুবিন হেসে জানাল সে রাগ করবে না। কিন্তু জায়িনকে জিজ্ঞেস করার সাহস হলো না। প্রিয়া মীরার কানের কাছে মুখ এনে বলল,

“এটা কি আবিরের বন্ধু?”

মীরা ঠিক বুঝতে পারল না প্রিয়া আপু কার কথা বলছে। তাই সে জিজ্ঞেস করল,

“কোনটা?”

“ব্লু শার্ট।”

মীরা জায়িনের দিকে তাকালেই জায়িনও এদিকে তাকালো। মীরা সাথে সাথে চোখ নামিয়ে নিল। ফিসফিস করে বলল,

“হুম। কেন আপু?”

“ছেলেটা কী হট দেখেছিস? সাথেরটা মনে হয় ওর ছোট।”

মীরা চোখ বড় বড় করে প্রিয়া আপুর দিকে দেখল। অবিশ্বাস্য গলায় বলল,

“ছি আপু! উনি তোমার ছোট হবে। আবির ভাই তো তোমার ছোট।”

“এক বছরের ছোট। আজকাল ছোটবড় ম্যাটার করে না। সিনিয়র জুনিয়র লাভ স্টোরি গুলোই বেশি ইন্টারেস্টিং হয়। ছেলেটার নাম্বার নিয়ে দিতে পারবি?”

“আপু না প্লিইজ! তোমার বর তোমার থেকে ছোট হবে এটা কেমন কথা। আর তাছাড়া উনাকে দুলাভাই হিসেবে আমার একটুও ভালো লাগবে না। তুমি উনাকে বিয়ে কোরো না। প্লিজ।”

“তুই কি পাগল মীরা! বিয়ে করব বলেছি? টাইমপাস তো করাই যায়।”

“না। প্লিজ।”

মীরা কথাটা একটু জোরেই বলে ফেলেছে। সবাই একসাথে ওর দিকে তাকাল। প্রিয়া টেবিলের নিচ দিয়ে মীরার পায়ে পাড়া দিল। আবির জিজ্ঞেস করল,

“কী না করছিস মীরা?”

মীরা থতমত খেয়ে গেল। কী বলবে এখন সে। তবুও কিছু তো বানিয়ে বলতে হবে। মীরা হাসবার চেষ্টা করে বলল,

“কিছু না ভাইয়া। এমনি বলেছি। কিছু না তো।”

প্রিয়া মীরাকে শাসালো। চোখ পাকিয়ে বলল,

“শয়তান মেয়ে! ওভাবে চেঁচালি কেন?”

“তুমি জানো না?”

“তুই এমন রিয়েক্ট করছিস যেন আমি তোর বয়ফ্রেন্ডের নাম্বার চাচ্ছি। চুপচাপ কাজটা করে দে। কোন কথা বলবি না।”

“আপু না প্লিজ। আমি পারব না। তুমি মাহিমাকে বলো।”

“তুই পারবি তোর ঘাড় পারবে।”

“উনি তোমার ছোট।”

“তাতে তোর এত সমস্যা কিসের? আমার সমস্যা না থাকলে তুই না করছিস কেন?”

মীরা রাগ করে বলল,

“ঠিক আছে। তোমার যা খুশি করো। আমি কিছু বলব না।”

বাড়ি ফেরার সময় চাচী, ফুপুদের জন্য খাবার প্যাকেট করে নিয়ে নিল। মীরা ওয়াশরুমে গিয়েছিল। ও ফিরে আসতে আসতে সবাই বাইরে বেরিয়ে গেছে। মীরা ওদের ধরতে দৌড় দিয়েছিল। এমন সময় ঠাস করে একজনের সাথে বাড়ি খেল। তার মাথাটা লোকটার বুকে গিয়ে ঠুকেছে। মীরা কপালে হাত রেখে উপরের দিকে তাকাতেই চোখ বড় বড় করে ছিটকে সরে গেল। জায়িন ভাইয়ের সাথেই ধাক্কা খেতে হলো! দুনিয়ায় আর মানুষ ছিল না। মীরা চুপসে যাওয়া মুখে বলল,

“সরি জায়িন ভাই, সরি। আমি দেখিনি। সরি।”

“হু।”

“আপনার লাগেনি তো? আমি সত্যি দেখিনি।”

“লেগেছে।”

জায়িনের শান্ত কন্ঠে কথাটা শুনে মীরা ঝট করে ওর মুখের দিকে তাকাল। অপরাধী মুখে বলল,

“অনেক লেগেছে? কোথায় লেগেছে? আমি ইচ্ছে করে ধাক্কা দিইনি। সত্যি।”

“ওরা তোমার জন্য বাইরে অপেক্ষা করছে।”

মীরা ভাইবোনদের কাছে আসতে আসতে মনে মনে ওদের উপর রাগ হলো। ওরা তাকে ফেলে চলে এসেছে বলেই তো মীরা দৌড় দিয়েছিল। দৌড় না দিলে কি ধাক্কা লাগতো? জায়িন ভাইয়ের লেগেছে। মীরা তো ইচ্ছে করে ব্যথা দেয়নি।

🌸

মীরা মাহিমা দু’জন একই কলেজে ভর্তি হয়েছে। ওদের দূরে কোথাও গিয়ে পড়ার ইচ্ছে ছিল। কিন্তু পরিবার মানলো না। ওরা দুই মেয়ে একা গিয়ে এখন কোথাও থাকতে পারবে না। আরেকটু বড় হোক। তখন দূরে থেকে পড়তে দিবে। পরিবারের কথার বাইরে ওরা যায়নি। এখানকার কলেজেই ভর্তি হয়েছে। ক্লাসও শুরু হয়ে গেছে। স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে এসে কলেজে পা রেখে নিজেদের কেমন বড় বড় মনে হচ্ছে। যেন হুট করেই কত বড় হয়ে গেছে। আগের মতো এত বাধা নেই। আগে মতো পড়াশোনা নিয়ে এত চাপও দেয়না কেউ। মন চাইলেই কলেজ থেকে বান্ধবীদের সাথে ঘুরতে যেতে পারে। এভাবেই কয়েকমাস কেটে গেল। বাড়িতে একটুও পড়া হয়না। তাই ছোট চাচ্চু আবার মুবিন ভাইয়ের কাছে পড়া শুরু করার কথা বললো। মীরাও রাজি হয়েছে। কারণ পড়তে না গেলে মুবিন ভাইয়ের সাথে দেখা হয় না। মীরা মুবিন ভাইকে কেমন পছন্দ করে এটাই ভেবে পায় না। মুবিন ভাইয়ের কথা সে মাঝে মাঝে একেবারে ভুলে যায়। কেউ মনে করিয়ে না দিলে মনে পড়ে না। এটা মনে হয় তেমন ভালো লাগা না৷ মীরা বড় হয়েছে। সে এখন এই অনুভূতি গুলো কিছুটা হলেও বুঝতে শিখেছে।

🌸

মুবিন ভাইয়ের কাছে পড়া শেষ করে বাড়ি ফেরার সময় মীরা মুবিন ভাইদের বাসার নিচের ফুলগাছ থেকে ফুল চুরি করছিল। নয়নতারা ফুল ছিঁড়ে তার দুই বিনুনিতে গেঁথে নিয়েছে। দেখতে সুন্দর লাগছে। একটা কাঠগোলাপ ছিঁড়ে মাত্রই কানে গুজবে এমন সময় পিছনে কারো শব্দ পেয়ে চমকে তাকাল।
জায়িন চোখ মুখ কঠিন করে তার দিকে তাকিয়ে আছে। চুরি ধরা পড়ে যাওয়ায় মীরা জোর করে হাসার চেষ্টা করল। হাতে ধরা কাঠগোলাপটা ঝট করে পেছনে নিয়ে লুকিয়ে ফেলল। নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করতে বলল,

“ফুল ছিড়িনি ভাইয়া।”

জায়িন ভ্রু জোড়া সামান্য কুঁচকিয়ে মীরার বেণীতে গাঁথা ফুলের দিকে দেখলে মীরা ঠোঁট টেনে হাসল। বলল,

“চুরি করে ফুল ছিড়িনি। সত্যি। আন্টিকে বলে এসেছি।”

তিন মাস পর জায়িন আজ বাড়ি ফিরেছে। আর গেট দিয়ে ঢুকতেই এই ঘটনা ঘটলো। জায়িন তাকে কিছু না বলে চলে যেতে নিলে মীরা পেছন থেকে ডাকল। জায়িন ভাই তার কাছে এখনও রিকশা ভাড়ার সেই টাকাটা পায়। মীরা একদমই ভুলে গিয়েছিল। জায়িন ভাইয়ের সাথে দেখা হলেও টাকার কথাটা মনে ছিল না। কয়দিন আগেই মনে পড়েছে। কিন্তু তখন জায়িন ভাই বাড়িতে ছিল না। মীরা টাকাটা ব্যাগে নিয়েই ঘুরছে। জায়িন দাঁড়িয়ে গেলে মীরা এগিয়ে এসে কাঁধ থেকে ব্যাগ নামিয়ে টাকা বের করে জায়িন দিকে ধরে বলল।

“ভাইয়া আপনার টাকাটা।”

জায়িন কপালে ভাঁজ ফেলে মীরাকে দেখছে। কিসের টাকা এটা সে ঠিক বুঝতে পারছে না। ওকে এভাবে তাকাতে দেখে মীরা বলল,

“নিন।”

“কিসের টাকা?”

জায়িন ভাইয়েরও তাহলে মনে নেই। মীরা মনে করিয়ে দেবার চেষ্টা করে বলল,

“আপনার মনে নেই, ওইযে অনেকদিন আগে ওইদিন রিকশা ভাড়া দিয়ে দিলেন না। ওইযে পড়ে গিয়ে আমি যে পায়ে ব্যথা পেয়েছিলাম। আপনি রিকশা ভাড়া দিয়ে দিলেন। আপনাকে তো সেদিন ধন্যবাদ দিইনি। রিকশা ভাড়ার টাকা দিতেও মনে ছিল না। জানি অনেকদিন হয়ে গেছে। তবুও ধন্যবাদ ভাইয়া।”

মীরা জায়িনকে মনে করিয়ে দেওয়ার অনেক চেষ্টা করছে। জায়িন চাপা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। স্থির দৃষ্টিতে মীরার চোখে চোখ রেখে বলল,

“রিকশা ভাড়ার টাকা ফিরিয়ে দিচ্ছ। কিন্তু আমি যে তোমাকে কোলে করে তিনতলায় উঠলাম। ওটা কীভাবে ফিরিয়ে দিবে? তোমাকে দেখে তো মনে হয় না আমাকে কোলে নিয়ে তিনতলায় উঠতে পারবে।”

মীরা হাঁ করে জায়িনের দিকে তাকিয়ে আছে। ওর চোখ জোড়া মার্বেলের মতো জায়িনের মুখের উপর স্থির হয়ে আছে। জায়িন এমন কিছু বলবে মীরা হয়তো কল্পনাও করেনি। বিস্ময়ের ধাক্কাটা সামলে উঠতে সময় লাগছে। জায়িন ঠোঁটের কোণে সামান্য হাসি নিয়ে বলল,

“মুখের ভেতর মশা ঢুকে যাবে।”

মীরা ঝুপ করে মুখ বন্ধ করে নিল। জায়িন ওকে হতভম্ব অবস্থায় রেখেই চলে যাচ্ছে। মীরা চোখ পিটপিট করে জায়িনকে চলে যেতে দেখছে। এটা কি সত্যি জায়িন ভাই? নাকি উনার ভূত!

চলবে…<

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here